নীল সীমানার শেষপ্রান্তে পর্ব-১৭

0
8033

#নীল_সীমানার_শেষপ্রান্তে
#Writer_Mahfuza_Akter
||পর্ব_১৭(ধামাকা স্পেশাল🎉)||
;
;
;

জয় রুমে ঢুকে সোফার ওপর ধপ করে বসে পড়লো। এতোদিন ধরে এতো পরিশ্রম করেছে, সব অবশেষে বৃথা যাবে বলে মনে হচ্ছে।

—“আপনাকে এতো ডিপ্রেসড দেখাচ্ছে কেন? কী হয়েছে? এভাবে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন যে! ”

জয় আমার দিকে মাথা তুলে তাকালো। তার উসকোখুসকো চুল, মলিন চেহারায় একরাশ ক্লান্তির ছাপ, টাইটা গলায় বলতে গেলে অনেকটা দড়ির মতো ঝুলছে আর চাহনিতে রয়েছে হাজারো হতাশা ও ব্যর্থতার আভাস। এমন রুপে আমি তাকে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। এক অজানা ভীতি যেন এসবের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে আমায় জাপটে ধরছে।

—“সব যদি শেষ হয়ে যায়, তাহলে আমি কীভাবে কী সামলাবো বলতে পারো? ”

জয়ের ভেজা এবং ধরা গলা শুনে আমার হাত-পা কেমন যেন অসাড় হয়ে যাচ্ছে। সব শেষ হয়ে যাবে মানে? শেষ, ধ্বংস এসব তো শুধু আমার জীবনের সাথে মিশে আছে! আমি চাই না, কেউ এসবের তিক্ত স্বাদ অনুভব করুক। কাছের মানুষ তো একদমই না!

কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম,
—“কী শেষ হয়ে যাওয়ার কথা বলছেন? কী এমন হয়েছে যে, আপনি সামলাতে পারবেন না?”

—“আমাদের এতোদিনের কষ্ট, পরিশ্রম ও অর্থ দিয়ে গড়ে তোলা ব্যবসা আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। ”
বলতে বলতে রুমে ঢুকলো জায়েদ, আর তার পিছনে পিছনে অদ্রি।

—“বাবা-মা এখনো ভালোভাবে কিছু জানে না, জানলে যে কী হবে? এতো বড় ধাক্কা সামলে উঠতে পারবো তো আমরা?”
বলেই অদ্রি নখ কামড়াতে লাগলো।

—“আমি তো ভাবছি অন্য কথা।”
আমরা তিনজন জয়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম।

জয় সিক্ত কন্ঠে বললো,
—“আমাদের মানসম্মান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এটা ভাবলেই আমার মাথা হ্যাং হয়ে যাচ্ছে। ”

আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই জয়ের ফোন বাজতে শুরু করলো। আমি আমার কথা গুলো নিজের মধ্যে দমিয়ে নিলাম।

জয় দেখলো একটা আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে। এখন রাত দুটো বাজে। এই অসময়ে কে কল দিবে? ভাবতে ভাবতে কল রিসিভ করে কানে গুজে বললো,
—“হ্যালো, কে বলছেন? পরিচয় দিন। ”

একজন ব্যক্তি হালকা হেসে বললো,
—“আরে, এতো সিরিয়াস কেন, হুম? গলা শুনে বুঝতে পারছিস না, কে আমি?”

এমন ঘুরানো পেঁচানো কথা শুনে বড্ড বিরক্ত লাগছে। এমনি ডিপ্রেশনে আছে, তার ওপর এসব হেঁয়ালিপূর্ণ কথাবার্তা কার ভাল্লাগে?

—“দেখুন, গলার স্বর শুনে চিনার ইচ্ছে আপাতত নেই আমার। সো, যা বলার ক্লিয়ারলি বলুন।”

—“উহুম, বলা যাবে না। একটা ঠিকানা পাঠাচ্ছি, এতো রাতে রাস্তা ফাঁকা তাই বিশ মিনিটে পৌঁছে যাবি। আর মনে রাখিস, এখানে আসার উপরই নির্ভর করছে তোর, তোর পরিবারের এবং তোর কোম্পানির ভবিষ্যৎ। অযথা সন্দেহ ধরে বসে থাকিস না। চাইলে একাও আসতে পারিস, অথবা কাউকে সাথে আনতে পারিস। বাট, তাড়াতাড়ি আয়।”
বলেই ফোন কেটে দিল। জয় ভাবছে, কে ফোন দিতে পারে? যে ফোন দিয়েছে, সে তার ব্যাপারে সবকিছু জানে; আর গলাটাও অনেক চেনা ঠেকছে। তবে কথা বার্তায় এটা বোঝা যায় যে, সে জয়ের কোনো ক্ষতি করবে না।
এরই মধ্যে ফোনে মেসেজ চলে এলো। একটা লোকেশন দেওয়া। হয়তো এটা তার কাছে শেষ সুযোগ, তাই আর দেরী করা উচিত হবে না।

—“আমায় এক জায়গায় যেতে হবে।”
বলেই উঠে দাঁড়ায় জয়।

আমি অবাক হয়ে বললাম,
—“মানে? এতো রাতে আবার কোথায় যাবেন?”

—“একজন ফোন দিয়ে বললো,,
জয় সব খুলে বললো।

—“কিন্তু কে হতে পারে? ”
জায়েদ চিন্তায় পড়ে গেল।

—“যেই হোক, আমার দ্রুত যাওয়া উচিত। ”

—“দাঁড়া, আমিও যাবো। তোকে এসবে একা ছাড়তে আমি একদমই রাজি না।”

জয় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
—“যতোই গালাগাল করো না কেন দিনশেষ এই বেয়াড়াটাকেই ভালোবাসো।”

জায়েদ মুখ বাকিয়ে বললো,
—“এখন তোর আর খোঁচা না মারলেও চলবে। তোর জন্য যাচ্ছি না, আমার বোনটার জন্য যাচ্ছি। ”

—“ওকে ওকে, চলো। ”
________________

একটা আটতলা ভবনের সামনে গাড়ি থামালো জয়। ফোনের মেসেজের সাথে বাড়ির এড্রেস প্লেট মিলিয়ে দেখলো এটাই সেই বাড়ি, যার লোকেশন পাঠানো হয়েছে।
জয় ও জায়েদ গাড়ি থেকে নেমে গেল। সাথে সাথে দুজন ব্ল্যাক হুডি পরা লোক এসে জিজ্ঞেস করল,
—“ফোন পেয়ে এসেছেন আপনারা?”

জয় থতমত খেয়ে বললো,
—“হ্যাঁ, আমাদের এখানে আসতে বলা হয়েছে। ”

—“জয় মাহমুদ??”

—“হ্যাঁ। ”

দুজন বাড়ির ভেতর ঢুকতে ঢুকতে বললো,
—“আসুন আমাদের সাথে। ”

—“কিন্তু,,,, ”

—“সব প্রশ্নের উত্তর সাত তলায়। টাইম বেশি নেই। ”

অগত্যা ওদের লোক দুটোর পিছে পিছে যেতে হলো। গার্ডসরা প্রথমে বাঁধা দিলে লোক দুটো একটা কার্ড দেখালো যা দেখে গার্ড একটা ঢোক গিলে বললো,
—“স্যরি স্যার। ”

সাত তলায় একটা অ্যাপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে লোক দুটোর একজন হাত দিয়ে মেইন ডোরের নব ঘুরালো। কিন্তু দরজা লক করা।

জায়েদ বললো,
—“দরজা তো ভেতর থেকে লক করা। ”

—“সব ব্যবস্থা আছে। আপনারা একদম চুপ থাকবেন। ”

জয়-জায়েদ একে অপরের দিকে একবার তাকালো। তাদের সাথে কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। কিন্তু যে ডেকে এনেছে, সে খুব সাবধানী ও কৌশলী এটা ঠিকই বুঝেছে।

লোকটা নিজের হুডির পকেট থেকে একটা চাবি বের করে সেটা দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেল আর ওদের ইশারায় ঢুকতে বললো।

জয় ঢুকতে নিবে এমন সময় জায়েদ হাত ধরে বাধা দিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। জয় ইশারায় বললো,
—“এছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই। আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। সো চলো।”

তারা ভেতরে ঢুকতেই ড্রয়িং রুম পেরিয়ে একসারিতে পরপর তিনটা রুমের সামনে দেখলো লোকদুটো একটা রুমের সামনে দাড়িয়ে আছে, যার দরজা খোলা, কিন্তু হালকা চাপানো।
সারা বাড়িতে পিনপতন নীরবতা।

একজন জয়কে ইশারা দিয়ে বললো, রুমের ভেতরে যেতে।
জয় ভেতরে ঢুকে দেখলো, রুমের ভেতর অন্ধকার এবং বেডে কেউ শুয়ে আছে। জয় তার ফোনের ফ্লাশ লাইট জ্বালিয়ে সেদিকে আলো দিতেই পুরো স্তব্ধ হয়ে গেল আর হাতে থেকে ফোনটা ধপাস করে ফ্লোরে পড়ে গেল।

কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে তনিমা ঘুমঘুম কন্ঠে বললো,
—“নিবিড়, মনে হয় একটা শব্দ হলো। গিয়ে দেখো না।”

নিবিড় তনিমাকে বললো,
—“তুমি আমার বুকের ওপর থেকে সরলে না তার পরে যাবো।”

—“আমি সরবো না।”

নিবিড় হেসে বললো,
—“আমিও যাবো না।”

এর মধ্যে জায়েদ ভেতরে ঢুকে গেছে, সাথে ঐ লোক দুটোও। কোনো দম্পতির এমন কথা বার্তা শুনে জায়েদ জয়ের কানে কানে বললো,
—“এখানে দুজনের রোমান্স দেখানোর জন্য আমাদের ডেকে এনেছে?”

জয় কোনো কথা বলছে না, অন্ধকারে মুর্তির মতে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক বড় ধাক্কা খেলে মানুষ অনেকটা পাথরের মতো হয়ে যায়। জয়ও এটা সামলে উঠতে পারছে না। শুধু অস্ফুটস্বরে বললো,
—“নিবিড় আর তনিমা!!! ”

জায়েদ অক্ষিগোলক মার্বেলের ন্যায় করে বললো, —“হোয়াটটটটট!!!”

হঠাৎ ঘরের ভেতর লাইট জ্বলে উঠলো, আর সারা ঘর আলোকিত হয়ে গেল।

জয় তনিমার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে নিল, তার সেই বন্ধ চোখের কোটর দিয়েই দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো।

রুমের আলো জ্বলে উঠায় তনিমা হুট করে নিবিড়ের ওপর থেকে উঠে বসলো, সাথে নিবিড়ও চোখ পিটপিট করে ভালোভাবে তাকালো।
জয়কে দেখে ওদের দুজনেরই মনে হচ্ছে দুনিয়া উল্টে পাল্টে গেছে। এসময়ে জয় এখানে এলো কীভাবে? আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, জয় ওদের একসাথে একরুমে এক বিছানায় দেখে ফেলেছে।

জায়েদ জয়কে বললো,
—“এই তো, তনিমা আর এই ছেলেটাকেই আমি আর অদ্রি একসাথে দেখেছিলাম। দেখেছিস, আমি আগেই বলেছিলাম! বিশ্বাস করিসনি! এখন চোখের সামনে প্রমান হয়ে গেল!!”

নিবিড় এসির নিচে থের দরদর করে ঘামছে। এতো বাজে ভাবে ধরা পড়ে যাবে যে, কোনো কথা বলার মতো কিছু থাকবে না, এটা ভাবতেও পারেনি।

তনিমা কাঁপা কাঁপা পায়ে বিছানা থেকে নেমে জয়ের সামনে গিয়ে দাড়িয়ে বললো,
—“জয়, আসলে আমি বলছিলাম যে, তুমি যা ভাবছো, তেমন কিছু,,,, ”

কথা শেষ করার আগেই জয় তনিমার গালে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলো। তনিমার গাল চেপে ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে রক্তবর্ণের চোখে তাকিয়ে বললো,
—“কেন করলি এমন? বল? বিশ্বাসঘাতক!! একজন মানুষের মন নিয়ে খেলতে একটুও বাঁধলো না তোর!”

হঠাৎ আকস্মিক ভাবে একজন নিজের পেছনে আরো একদল লোক নিয়ে ভেতরে ঢুকে বললো,
—“দ্য গেম ইজ ওভার এন্ড দ্য ট্রুথ ইজ রিভেলড নাও।”

সবাই তার দিকে তাকাতেই চমকে গেল।
নিবিড় চকিত স্বরে বললো,
—“আহিল আহরার।”

আহিল ঘাড় বাকিয়ে ডেভিল হাসি দিয়ে বললো,
—“নো, ম্যান। দিস ইজ ডিটেকটিভ আহিল আহরার, হেড অফিসার অফ ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি)।”

নিবিড় আর তনিমা চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে আছে আহিলের দিকে।

আহিল জয়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো
—“কী রে, ঝাটকা হজম করতে পেরেছিস তো? শালা, এই তোর বন্ধুত্বের নমুনা? আমারে যে ভুলে গেছিস, সেটা আমি তখনই বুঝেছি যখন তুই আমার গলা শুনে চিনতে পারিসনি।”

জয় নিজেকে সামলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বললো,
—“তার মানে, তুই আমায় ফোন করে এখানে এনেছিস?”

আহিল আগের মতো হেসেই বললো,
—“কেন? কোনো সন্দেহ আছে নাকি তোর? থাকতেও পারে! একটা বিবাহিত মেয়ে তোর চোখে পট্টি পড়িয়ে টাকা হাতিয়ে নিলো, আর তুই কিছু বুঝতেও পারলি না। নিজের ঘরে হীরের টুকরো রেখে বাহিরের আরএফএল প্লাস্টিক ধরে বসে আছিস।”

-চলবে……..