নীল সীমানার শেষপ্রান্তে পর্ব-৪২+৪৩

0
5701

#নীল_সীমানার_শেষপ্রান্তে
#Writer_Mahfuza_Akter
||পর্ব_৪২ (বোনাস পর্ব)||

সবাই আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে, কিন্তু আমি কারো দিকে তাকাতে পারছি না। চোখ দুটো বারবার জলে ভরে উঠছে। আমি বেশ ভালো করেই জানি এ পরিবারের মানুষগুলোর সামনাসামনি হলে আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারবো না। তারা আমায় অনেক স্নেহ আর ভালোবাসা দিয়েছে। সবার সাথে কাটানো মোমেন্ট গুলো বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে।

হঠাৎ বাপি (মিহাদ চৌধুরী) এসে আমাকে আর মিরাজকে নিয়ে সবার সামনে দাঁড় করিয়ে বললেন,
—এই যে, এরা হচ্ছে আমার ছেলে আর মেয়ে। আর এটা হচ্ছে ডক্টর নিখিল, আমার বন্ধুর ছেলে।

আমি মাথা হালকা উঁচু করে তাকিয়ে দেখলাম, মা, বাবা ছলছল চোখে আমায় দেখে চলেছেন। অন্য দিকে জায়েদ ভাইয়া, অদ্রি ভাবি আর আহিল ভাই এখনো অবাকতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু তারা এতো অবাক কেন হচ্ছে? আমি এতো বছর পর এসেছি বলে নাকি আমায় ওয়েস্টার্ন আউটফিটে দেখে নাকি অন্য কোনো কারণ আছে।

হঠাৎ গালে কারো স্পর্শ পেতে আমি ভাবনার রাজ্য থেকে বের হয়ে সামনে তাকাতেই দেখলাম মা আমার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে আছেন। অথচ তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছেই। তিনি আমার সারা মুখে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন,
—তুই ফিরে এসেছিস! আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। এতো বছর পর মনে পড়লো আমাদের!

আমি জোরপূর্বক হেসে বললাম,
—আন্টি, আই থিংক আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি মালিশা চৌধুরী, ছোট বেলা থেকে অস্ট্রেলিয়াতেই ছিলাম।

সবাই আমার দিকে আরো বেশি অবাক হয়ে তাকালো। মাঝখান থেকে আহিল ভাই কী মনে করে যেন উপরে চলে গেল। চালাক মানুষ, নিশ্চয়ই জয়কে ডাকতে গেছে। এতো দিক থেকে এতো প্রেশার! আমি কোনটা রেখে কোনটা মেনেজ করবো?

—আচ্ছা, মানলাম আমরা ভুল। তাহলে তোর চোখে পানি কেন? কাঁদছিস কেন তুই?

মায়ের কথা শুনে আমি গালে হাত দিতেই ভেজা অনুভব করলাম। কখন চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গেল, টেরই পাইনি। চোখ মুছে হালকা হেসে উঠে বললাম,
—ঐ চোখে কিছু পড়েছে হয়তো!

আমার কথা শেষ হতে না হতেই একটা নয় কি দশ বছরের ছেলে আমার সামনে দাঁড়িয়ে কোমড়ে দুই হাত গুঁজে বললো,
—আচ্ছা, তোমার ফেসটা আমার কাছে এতো চেনা চেনা ঠেকছে কেন বলো তো! কোথায় যেন দেখেছি!

আমি ছেলেটার কথা শুনে হেসে দিলাম। এটা যে সেই ছোট্ট জুনায়েদ, তা আমার বেশ ভালো করেই মনে আছে। এখনো মনে রেখেছে ছেলেটা আমায়! ও হঠাৎ পকেট থেকে একটা ট্যাব বের করে কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটি করার পর একবার আমার দিকে একবার ট্যাবের দিকে তাকাতে লাগলো। হঠাৎ অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো,
—ছোট মাম্মাম!!!

আমি শকড হয়ে তাকিয়ে আছি। ও-ও আমায় এতো তাড়াতাড়ি চিনে ফেললো। আমার জ্যাকেট ধরে টানতে টানতে কাঁদো সুরে বললো,
—তুমি আমার ছোট মাম্মাম, তাই না? বলো, বলো।

আমি ওর সামনে বসে বললাম,
—আমি তোমার ছোট মাম্মাম নই, বাবা। তোমার ছোট মাম্মাম তো অন্য কেউ! আর তার তো এখন এ বাড়িতেই থাকার কথা! তোমার একটা কাজিনও আছে, তাই না?

জুনায়েদ অবাক হয়ে বললো,
—ছোট মাম্মাম, কাজিন এ বাড়িতেই আছে! কই কেউ তো আমাকে কিছু বলে নি!

বলেই পেছন ফিরে অদ্রির দিকে তাকালো। অদ্রি বলে উঠলো,
—জুনায়েদ, যাও ঘরে যাও। এখানে সবাই বড়রা কথা বলছে।

জুনায়েদ মাথা নাড়িয়ে ভেতরে যেতে যেতে বললো,
—ছোট মাম্মাম, আমার তুমি ছাড়া আর কোনো ছোট মাম্মাম নেই আর কাজিনও নেই। সো, তুমি কিন্তু আর এ বাড়ি থেকে যাবে না।
—————–

—জয়, এই জয়, শালা ওঠ না। কী ঘুম ঘুমাচ্ছিস? নিচে গিয়ে দেখ, কে এসেছে?

জয় ঘুম ঘুম কন্ঠে বললো,
—আবার চলে এসেছিস! আমি ঘুমের ওষুধ খেয়েছি, এখন ওঠতে পারবো না।

আহিল বিরক্ত হয়ে বললো,
—তো মিস্টার দেবদাস, তোমার বউয়ের মতো দেখতে কেউ একজন এসেছে। যদি দেখতে চান, তাহলে নিচে চলেন।

জয় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বললো,
—ওটা আমার বউয়ের মতো দেখতে না,ওটা আমার বউ-ই। মিহাদ আংকেলের সাথে এসেছে, রাইট?

আহিল অবাক হয়ে বললো,
—তার মানে তুই বলতে চাচ্ছিস, ওই আমাদের ফিহু। ওয়েট ওয়েট, তুই এসব কীভাবে জানলি? আর তুই এতো শান্ত হয়ে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিস কীভাবে? আরে শালা, ওঠ না।

—জানি কয়েকদিন ধরে। এখন যা তো, আমি একটু পরে আসছি।

—আচ্ছা, এক শর্তে যাবো।
—————

—জাহিদ, আমার মেয়েটাকে দেখে সবাই এমন করছে কেন?আর এসব কী জিজ্ঞেস করছেআমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

মিহাদ চৌধুরীর প্রশ্নে জাহিদ মাহমুদ হেসে বললেন,
—অপেক্ষা কর, সব বুঝতে পারবি।

এদিকে, ডক্টর নিখিল মিরাজের কানে ফিসফিস করে বললো,
—মিরাজ ব্রো, আই থিংক এই পরিবারের সাথে মালিশা পাস্টের কোনো কানেকশন আছে। সো, মালিশাকে নিয়ে আমাদের এখান থেকে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়াটাই বেটার হবে।

—আমিও তাই ভাবছি। এমনি হ্যালুসিনেশনের একটা সমস্যা আছে। আমি চাই না, এসবের কারণে আপুমনির কোনো ক্ষতি হোক।

—সেটা তো আমিও চাই না, এজ আ ডক্টর বলো আর অন্য কিছু বলো।

মিরাজ এসে হঠাৎ আমার হাত চেপে ধরে বললো,
—ড্যাড, আমি আপুমনিকে নিয়ে যাচ্ছি। তুমি না হয় আসিফ আর রনির সাথে এসো। আমাদের তো আর কোনো কাজ নেই। চল আপুমনি।

আমি আর মিরাজ বের হয়ে যাবো এমন সময় আহিল সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামত বললো,
—আরে আরে, দাঁড়াও। এতো তাড়া কিসের? পাঁচ মিনিট চাই, ওনলি ফাইভ মিনিটস দাও, এরপর তোমরা যা চাইবে তাই করো।

মিরাজ আর কথা বাড়ালো না। পাঁচ মিনিট তো আর খুব বেশি না। দেওয়াই যায়। কিন্তু আমার মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে, আমি এতোক্ষন ধরে এ বাড়িতে আছি, একবারো জয় আমার সামনে এলো না। ও কি তনিমার সাথে আছে, নাকি আমি ওকে ওর মুখ দেখাতে নিষেধ করেছি বলে আমার সামনে এলো না।

-চলবে………

#নীল_সীমানার_শেষপ্রান্তে
#Writer_Mahfuza_Akter
|| পর্ব_৪৩ (রহস্যভেদ-১) ||

আমার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে, এমন মনে হচ্ছে যে, আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। চোখের সামনে প্লে হওয়া ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, তনিমা নিজের মুখে স্বীকার করছে যে, সবটাই ওদের চক্রান্ত ছিল, ওরা জয়কে ধ্বংস করতে চেয়েছিলো। তারমানে আর্থিক ভাবে ধ্বংস করতে না পারলেও মানসিক ভাবে শেষ করে দেওয়ার জন্যই ওরা এই প্ল্যানটা করেছে। আর ঐ ডক্টরের বলা সব কথাও মিথ্যে ছিল। আর আমি বুদ্ধু একটা, একবার বুঝলামও না। নিজেও কষ্ট পেলাম আর জয়কেও কষ্ট দিলাম।

হঠাৎ আমি পড়ে যেতে নিলেই আমার দুপাশ থেকে মিরাজ আর ডক্টর নিখিল ধরে ফেললো। বাপি ব্যস্ত হয়ে আমায় জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো,
—মালিশা, মাই ডিয়ার। আর ইউ ওকে?

আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
—বাপি, আমি ভুল ছিলাম। আমি ভুল করেছি, বাপি। আমি জয়কে ভুল বুঝেছি। কী করে পারলাম আমি নিজের ভালোবাসার মানুষকে অবিশ্বাস করতে? জয় নির্দোষ ছিল, ওর কোনো দোষ নেই।

মিরাজ আমায় একপাশ থেকে ঝাপটে ধরে বললো,
—আমরা বুঝেছি, তুই এবার শান্ত হ। এটা আমি আগেও বলেছিলাম, শুনিসনি। এখন যখন সব সত্যি জেনেছিস, তাহলে নিজেকে শক্ত রাখ।

ডক্টর নিখিলও বললো,
—এখন বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠলে অসুস্থ হয়ে যাবে তুমি। নিজেকে শান্ত করো, তুমি কখনো হারবে না।

মিরাজ নিখিলের সাথে তাল মিলিয়ে বললো,
—হ্যাঁ, নিখিল ভাইয়া একদম ঠিক বলেছে। আর তাছাড়া তোর এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না। এখনো অনেক কাজ পড়ে আছে। তোর কাজ তো শুরুই করিসনি এখনো।

আমি অবাক চোখে মিরাজের দিকে তাকাতেই ও একটা রহস্যময় হাসি দিলো। আমি কিছুক্ষণ ভাবতেই মিরাজের চোখের ইশারা বুঝে ওর দিকে চোখ বড়বড় করে তাকালাম। সাথেসাথেই আমার ঠোঁটের কোণে অন্যরকম একটা হাসি ফুটে উঠলো, যার সাথে শুধু বাপি আর মিরাজই পরিচিত।

—বাপি, আমি আসছি।

আমার কথা শুনে বাপি বলে উঠলো,
—এতো তাড়াহুড়োর কী আছে? নিজের শরীরের কন্ডিশনটাও একটু বোঝার চেষ্টা করো।

আমি আসিফ আর রনিকে ইশারায় আমার সাথে নিয়ে যেতে যেতে বললাম,
—ইউ নিডেন্ট টু বি গেট ওয়ারিড, বাপি। আম এবসোলিউটলি ফাইন।

মিহাদ চৌধুরী হতাশ হয়ে বললেন,
—যাহ, চলে গেল। যদিও আমি আগেই জানতাম, ও আমাদের কারোর কথাই শুনবে না।

হঠাৎ জয় নিজের শার্টের হাতা ফোল্ড করতে হবে সিঁড়ি দিয়ে নেমে বললো,
—এবার আমাদেরকে বলুন, আংকেল। কীভাবে মুনকে আপনাদের মালিশা বানালেন।

মাঝখান থেকে মিরাজ বলে উঠলো,
—সেটা না হয়, আমিই বলি।

সবাই মিরাজের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। মিরাজ বলতে শুরু করলো,

আজ থেকে পাঁচ বছর আগে,,,
মিরাজ নিজের বাংলাদেশী কিছু ফ্রেন্ডস আর রিলেটিভসের সাথে গেট টুগেদারে অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশে এসেছিলো। অস্ট্রেলিয়া ব্যাক করার দিন বিকেলে মিরাজ প্লেনে নিজের সিটে বসে ছিল। তার পাশের সিটে হঠাৎ একটা মেয়ে এসে বসে। মিরাজ একবার তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে যায় আর মিরাজ জোরপূর্বক মুচকি হাসি দেয়। কিন্তু মেয়েটার তেমন কোনো রেসপন্স নেই। দেখতে বেশ সাধারণ ধাঁচের হলেও মিরাজের কাছে তাকে বেশ ভালোই লাগে। তার ওপর মিরাজ অনেক মিশুক আর ফ্রেন্ডলি একটা ছেলে। তাই নিজেই কথা বলা শুরু করে।

—হ্যালো, দিস ইজ মিরাজ। আই মিন, মিরাজ চৌধুরী।

—আ’ম ফাহমিদা আহমেদ মুন।

—নাইস টু মিট ইউ।

—সেইম হেয়ার। (মুচকি হেসে)

—বাংলাদেশী? রাইট?

—ইয়াহ।

মিরাজ হেসে দিয়ে বললো,
—তাহলে তো আমরা বাংলায়ই কথা বলতে পারি। যদিও আমি বাংলায় তেমন ফ্লুয়েন্ট না।

—আচ্ছা, সমস্যা নেই।

—জানেন, আপনি না দেখতে অনেকটা আমার বড় বোনের মতো। স্পেশালি আপনার স্মাইলটা। আপুমনিও এমন করেই হাসতো।

মুন শকড হয়ে তাকিয়ে বললো,
—হাসতো মানে? সে এখন কোথায়?

মিরাজ মলিন হেসে বললো,
—তিন বছর আগে আমায় একা করে দিয়ে চলে গেছে। ইভেন, আমার পুরো ফ্যামিলিকেই ছেড়ে না ফেরার দেশে হারিয়ে গেছে সে। বড্ড বেশি জেদি ছিলো। রাত দুটো বাজে আমার কাছে এসে বলেছিল, ওকে নিয়ে লং ড্রাইভে যেতে। কিন্তু আমি যাইনি। এতে জেদ করে ও একাই চলে যায়। মাঝরাস্তায় ওর গাড়ি স্টার্ট হচ্ছিল না বলে ও গাড়ি থেকে নেমে গেলই ঝড়ের গতিতে গুলি বর্ষণ শুরু হয়েছিল।

মিরাজের চোখের কোণে জল জমে গেছে যেন পলক ফেললেই তা গড়িয়ে পড়বে। মুন আবার জিজ্ঞেস করল,
—কিন্তু কারা এমনটা করেছিল? একটা নিষ্পাপ মেয়েকে অকারণে কেন মারলো?

—ড্যাডের সাথে বিজনেস রিলেটেড শত্রুতা ছিল। পরবর্তীতে আমরা জানতে পেরেছিলাম যে, পুরোটাই ওদের প্ল্যান ছিল। আমাদের দুজনকেই একসাথে মারতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি ভাগ্যের খেলায় বেঁচে যাই। বাই দ্য ওয়ে, আপনার বয়স কত?

—টোয়েন্টি ফোর।

—হ্যাঁ, হ্যাঁ। তিন বছর আগে, আপুমনির বয়স টোয়েন্টি ওয়ান ছিল। আজ বেঁচে থাকলে আপনার মতোই হতো অনেকটা।

—আপনার বয়স তাহলে কত?

মিরাজ ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে দিয়ে বললো,
—ওনলি টোয়েন্টি।

—ওহহ আচ্ছা।

প্লেন জার্নিতে মিরাজের সাথে মুনের অনেক ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়। অনেক কথাবার্তাও হয় নানা বিষয় নিয়ে। কিন্তু বিপত্তি ঘটে অস্ট্রেলিয়া পৌছানোর পর। এয়ারপোর্ট থেকে বের হবার সময় হঠাৎ করে মুন অজ্ঞান হয়ে যায়। এয়ারপোর্টে মিরাজের বাবা মাও এসেছিল মিরাজকে রিসিভ করার জন্য। সবাই দ্রুত মুনকে হসপিটালে নিয়ে এডমিট করায়। ডক্টর নিখিলই মুলত ট্রিটমেন্ট করায় তার।

সব চেকাপ শেষে ডক্টর নিখিল এসে জানায়,
—মেয়েটা প্রায় চারমাসের প্রেগন্যান্ট। এই ফিজিক্যাল কন্ডিশন নিয়ে কেউ এতোদূর জার্নি করে? তার ওপর ওর শরীরের যে অবস্থা, সেটা দেখে এজ ফার এজ আই এজিউম, ও নিজের প্রতি প্রচুর কেয়ারলেস। আই থিংক, কোনো কারণে ও ভেতরে ভেতরে ডিপ্রেসড।

মিহাদ চৌধুরী চিন্তিত হয়ে বললেন,
—তাহলে তো আমাদের মেয়েটার সাথে কথা বলা উচিত।

মালিহা চৌধুরীও আবেগাপ্লুত হয়ে বললেন,
—আমার তো মেয়েটাকে দেখেই মায়া লেগে গেছে! আজ আমার মেয়েটা বেঁচে থাকলে হয়তো এমনটাই হতো!
বলেই নিজের চোখ মুছলো।

মুনের জ্ঞান ফেরার পর মিরাজ ওকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। সবাই মিরাজের মতোই মিশুক। মুহুর্তের মধ্যে আপন করে নিতে জানে।

মিহাদ চৌধুরী মুনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন,
—আমাদের কাইন্ডলি এটা বলো যে, তুমি কেন এই অবস্থায় দেশ ছেড়ে অস্ট্রেলিয়া এলে? কোনো সাধারণ দরকারে মানুষ এমন রিস্ক নেয় না।

মুন একথা শোনার পর চুপ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর আমতাআমতা করে বললো,
—আসলে আমি এখানে স্টাডি ভিসায় এসেছি। তাই বাধ্য হয়ে এসময়ে আসতে হলো।

মিরাজ মাঝে থেকে বলে উঠলো,
—মিথ্যা কেন বলছেন? পুরো জার্নিতে আমি আপনার সাথে ছিলাম। আমি ইমিগ্রেশনে থাকা কালীন স্পষ্ট শুনেছি, আপনার ট্রাভেলিং ভিসা ছিল।

মুন নিজের মাথা নিচু করে ফেললো। মালিহা চৌধুরী মুনের গালে হাত রেখে বললো,
—দেখো মা, হয়তো তোমার পারসোনাল কোনো কারণে তুমি আমাদের সাথে তোমার সমস্যা শেয়ার করতে চাইছো না। আমরা জোর করবো না। কিন্তু আমারও তোমার মতো একটা মেয়ে ছিল। তোমার যদি কোনো প্রয়োজন হয়, তাহলে আমাদের নির্দ্বিধায় বলতে পারো।

মুন অনেকক্ষণ যাবৎ ঠোঁট কামড়ে নিজের কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে মালিহা চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। হঠাৎ কান্নায় সবাই অনেক অবাক হলো। মুন কাঁদতে কাঁদতে তাদেরকে সবকিছু খুলে বললো।

মালিহা চৌধুরী মিহাদ চৌধুরীর দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকালো। মিহাদ চৌধুরীর মনও সায় দিল। তাই তিনি আবদারটা করেই ফেললেন।
মুনের দুই হাত নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন,
—আমাদের একটা আবদার আছে, মা। তুমি প্লিজ আমাদের ফিরিয়ে দিও না। আমাদের সব থাকতেও কিছুই নেই। যেদিন থেকে আমার মেয়েটাকে হারিয়েছি, সেদিন থেকে নিজেদের নিঃস্ব মনে হয়। এই বুকের ভেতর চাপা হাহাকার কেউ বুঝতে পারে না। কিন্তু আজ আমার মনে হচ্ছে, শুধু আমার না আমাদের সবার মনে হচ্ছে, এই তিন বছরের ঘা শুকানোর সময় এসেছে। তোমার মধ্যে আমরা মালিশার ঝলক দেখতে পেয়েছি। তুমি কি আমাদের মেয়ের জায়গাটা নিয়ে আমাদের একটু শান্তি দিবে? আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, আমরা তোমায় কখনো বাবা, মা আর ভাইয়ের অভাব বুঝতে দিব না।

মুন সবার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এতো কিছু থাকার পরেও, তাদেরকে কতো অসহায় দেখাচ্ছে! কিন্তু তার কি রাজী হওয়া উচিত? যতো যাই হোক, এ পরিবারের প্রতিটা মানুষ অনেক ভালো। আর তারও নিজের একটা পরিবারের দরকার। একা একা কীভাবে ফাইট করবে এই অপরিচিত দেশে? সবদিক বিবেচনা করলে দেখা যায়, রাজী হওয়াটাই ওয়াইজ।

—আমি রাজী আছি, তবে একটা শর্তে।

সবাই মুনের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। মুন মুচকি হেসে বললো,
—আমি ফাহমিদা আহমেদ মুন হয়ে আপনাদের সাথে থাকতে চাই না। আমি পুরোপুরি মালিশা চৌধুরী হয়ে উঠতে চাই। আমার জীবনে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে আর সেখানে ভালোবাসার অনেক অভাব ছিল। যাদেরকে আঁকড়ে ধরে আমি বাঁচতে চেয়েছি, দিনশেষে তারাই আমায় ধোঁকা দিয়েছে। আমি আপনাদের আঁকড়ে ধরে আবার নতুন করে বাঁচতে চাই, আপনাদের মেয়ে হয়ে। পারবেন আমার জীবনের ভালোবাসার অভাব গুলো পুরণ করতে?
মিহাদ চৌধুরী, মালিহা চৌধুরী আর মিরাজ একসাথে মুনকে ঝাপটে ধরলো।

মিরাজ নিজের চোখ মুছে বললো,
—এরপর থেকে আপুমনিই আমাদের প্রাণ। আমাদের লাইফে আলো হয়ে এসেছে ও। প্রথম দিকে তেমন সমস্যা হয়নি। আপুমনি প্রেগ্ন্যাসির সময়ই একটা ভালো ভার্সিটিতে চান্স পায় এম. বি. এ. করার জন্য। সাথে সাথে ড্যাডের কাছে নিজের একটা বিজনেস খোলার কথা বলে। আমরা সবাইও চেয়েছিলাম ও নিজেকে ব্যস্ত রাখুক। পড়াশোনা, বিজনেস সব মিলিয়ে ভালোই চলছিল। কিন্তু বিপত্তি ঘটে ডেলিভারির পরে। ডেলিভারিতে ওর ফিজিক্যাল কন্ডিশনে তেমন ইফেক্ট পড়েনি, তবে মেন্টালি অনেক কমপ্লিকেশনস দেখা দেয়। হঠাৎই ও হ্যালুসিনেশনের শিকার হতো, ঘরের ভেতর ভাংচুর করতো, সেন্সলেস হয়ে যেত। পরবর্তীতে ডক্টর নিখিলের এডভাইস অনুযায়ী আমরা ওর লাইফস্টাইলে পরিবর্তন আনি। পোশাক-আশাক, খাবার আরো অন্যান্য সব কিছু চেঞ্জ করে দেই যাতে ওর অতীতের কথা তেমন মনে না পড়ে। এতে সমস্যা কমে আসলেও পুরোপুরি সলভ হয়নি। এরই মধ্যে ড্যাডের মনে আতঙ্ক তৈরি হয়, তিনি আগের মতো এবারেও যদি মালিশাকে হারিয়ে ফেলেন? তাই আপুমনির প্রটেকশনের জন্য আসিফ আর রনিকে আনা হয়। এছাড়াও সেল্ফ প্রটেকশনের জন্য ড্যাড আর আমি নিজ হাতে ওকে বন্দুক চালানো শেখাই। প্রথমে আপুমনি মানুষের ওপর গুলি চালাতে পারতো না, কিন্তু বিজনেস ওয়ার্ল্ডে মানুষের প্রতারণা, বিশ্বাস ঘাতকতা দেখে এখন আর ওর হাত কাপে না।

সবাই অবাক হয়ে শুনছে। এই পাচ বছরে এতো কিছু হয়ে গেছে? আর তারা এসবের কিছুই জানতো না।

আহিল অবাক হয়ে তাকিয়েই প্রশ্ন করলো,
—কিন্তু সেই প্লেন অ্যাকসিডেন্ট? ওর তো ইউকে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ও অস্ট্রেলিয়া গেল, আর ইউকে যাওয়ার পথে প্লেন অ্যাকসিডেন্টে আমরা খবর পেলাম ফিহু বেঁচে নেই। আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

মিরাজ হেসে দিয়ে বললো,
—ওটা আমাদের দেখা হওয়ারও দুমাস আগের কাহিনী।

—মানে?

—বলছি, বলছি।

-চলবে………..