সবটা অন্যরকম পর্ব-২৭+২৮

0
4098

সবটা অন্যরকম♥
#পর্ব_২৭
Writer-Afnan Lara
.
কথা কাটাবেন না একদম,,আমাকে সত্যিইটা বলুন নয়তো আমি গিয়ে খালামণিকে সবটা বলে দেবো
.
আমি মোটেও কথা ঘুরাচ্ছি না,,মাকে যা বলার বলতে পারো তুমি
মা তোমার কথা বিশ্বাস করবে না একটুও,এখন নামো
.
কেন?
.
কারণ আমরা সাদাত স্যারের বাসার সামনে এসে গেছি
.
ওমা,এত বড় এই দালানটা?কত তলায় থাকে স্যার?
.
আজ্ঞে না,,তার পিছনের সাইডে যে এক তলা বাড়িটা আছে সেটাতে স্যার থাকে,তার নিজের বাসা সেটা
.
ওহ!
.
দিবা বাইক থেকে নেমে ওড়না মাথায় দিয়ে চললো,,আহনাফ বাইক এক পাশে করে রেখে সেও চললো সেদিকে,,একটু হেঁটেই তারা স্যারের বাসাটা দেখতে পেলো
সবুজ রঙ করা একটা এক তলা বাড়ি,সামনে থাই গ্লাস করা জানালা দুটো,,আর দরজা খোলা,ওদের আগেই বাকি স্টুডেন্টরা এসে পড়েছে মনে হয়
দিবা তো বাড়িটা দেখে এক্কেবারে মুগ্ধ হয়ে গেছে,এত মুগ্ধ হয়েছে যে তার পা থেমে গেছে
বাড়িটার চারপাশে সব ফুল গাছ,এত সুন্দর ও কারও বাসা হতে পারে,,স্যারকে দেখে কেউ বলবে না যে স্যার এত বড় গাছপ্রেমিক
হরেক রকমের ফুল গাছ,,কি ভাবে প্রকাশ করবো এই মুগ্ধতা, গোলাপ,বেলি,জুঁই,রক্তজবা,গন্ধরাজ,আরও কত কি
.
আহনাফ দরজা পর্যন্ত এসে পিছনে তাকিয়ে দেখলো দিবা ইয়া বড় হা করে ফুলগাছ সব দেখছে
.
স্যারকে দেখতে আসছো নাকি স্যারের বাগান দেখতে আসছো?সব এক নৌকার মাঝি,গাছ ছাড়া কিছু বুঝে না
.
কথাটা বলে আহনাফ ভেতরে চলে গেলো
দিবা মুচকি হেসে গাছগুলো দেখতে দেখতে সেও ভেতরে চলে আসলো,মন চাচ্ছিলো আরও কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকতে ওখানে
গাছগাছালির সৌন্দর্য নিয়ে ভাবতে ভাবতে দিবা বাসার ভেতর পা রাখলো,,শুরুতেই ওর চোখে পড়লো সোফার রুম,,সোফার রুমে কিছু স্টুডেন্ট বসে কথা বলছে বাকিরা মনে হয় স্যারের রুমে
দিবা ওদের দিকে এক নজর তাকিয়ে স্যারের রুম খুঁজতে ভেতরের রুমগুলোর দিকে গেলো,,সোফার রুম পার হলেই বামে একটা রুম আছে সেটা রান্নাঘর,,আর ডানে দুটো রুম,দুটোই বেড রুম,,সোফার রুমে দিয়ে ডাইনিংয়ে একটা রুমে যাওয়ার দরজা দেখেছিলো দিবা
যাই হোক এক রুমে কোলাহল শুনা যাচ্ছে তার মানে ওখানে সাদাত স্যার
দিবা সোজা সেদিকেই গেলো,রুমে এসে সে দেখলো স্যার বিছানায় শুয়ে আছেন গায়ে কাঁথা দিয়ে,,তার পাশেই একজন বয়স্ক মহিলা বসে আছেন,চোখে চশমা আর হাতে তফসি,তিনি গম্ভীর হয়ে বসে সাদাত স্যারকে দেখছেন,,দেখে মনে হয় স্যারের আম্মু
পরনে সাদা শাড়ী তার,,সাদাত স্যার ক্লান্ত চোখে আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছেন
দিবা এগোতে যেতেই আহনাফ ওর হাতের কব্জি ধরে আটকে ধরলো ওকে,দিবা প্রশ্নসূচক চোখে তাকিয়ে থাকলো আহনাফের দিকে
আহনাফ ফিসফিস করে বললো”স্যারের ছোঁয়াছে রোগ হয়েছে আমাদের কাছে আসতে মানা করলো,যেও না”
.
কি রোগ??
.
জিজ্ঞেস করলাম তো,কিন্তু ঐ দাদির চাহনি দেখে আমার প্রশ্ন মাঝপথেই আটকে গেছে
.
স্যারের মা মনে হয়
.
হুম,চলো চাই
.
যাই মানে,সবেই তো এলাম,স্যারের সাথে তো কথাই হলো না,আবার স্যারের আম্মু ও আছেন,উনার সাথেও তো কথা বলতে হবে
.
পাগল হইছো?ছোঁয়াছে রোগ নিজের করে এবার আমার আর মিনির গায়েও দিবা তুমি
তোমার তো খালি দেওয়ার শখ তাই খালামণি তোমার নাম দিবা রাখছে
.
এই সময়েও আপনার আমাকে খোঁচা মেরে কথা বলতে হবে?
.
স্যারের পাশে বসে থাকা বয়স্ক মহিলা যিনি ছিলেন তিনি তফসি রেখে ঘাঁড় ঘুরিয়ে বললেন”মেয়েরা তো কজন এলে,,কেউ একটু রঙ চা বানাবে?আমার অন্তিক সেই কখন চা খেতে চাইলো,আমি তো বানাতে পারবো না হাঁটুর ব্যাথার কারণে,,ঠিকমত হাঁটতেও পারি না,রান্নাঘরে সব আছে
এই এক জ্বালা,,কাজের বুয়া রাখে না ব্যাটা!অসুখে মরতাছে!এবার কাজের বুয়া কই পাবো?আমি এসেছি বিশ মিনিট হলো
বানালে সবার জন্য বানাইও
.
দিবা আহনাফের দিকে তাকিয়ে বললো”আমি বানাই?বানালে তো আর রোগে ধরবে না”
.
আহনাফ জ্যাকেটটা টেনে একটু সামনের দিকে এনে বললো”জলদি করে বানাও,বাসায় ফিরতে হবে,আমার আবার ডিউটি আছে”
.
কথাটা বলে আহনাফ চলে গেলো সোফার রুমের দিকে,,দিবা গেছে রান্নাঘরের দিকে,,যে চার পাঁচজন মেয়ে ছিলো ওরা আগ বাড়িয়ে বানাতে বলেনি,দিবাই রাজি হলো বানানোর জন্য
রান্নাঘরে এসে দিবার মাথা তো ব্যাকা হওয়ার উপক্রম,,ছেলেদের বাসাও এত গুছালো হতে পারে?
স্যার তো শুনলাম একা থাকে,,বাগান সামলিয়ে আবার রান্নাঘর ও গুছাতো?এই জন্যই বুঝি স্যার নিজের খেয়াল রাখার সময় পেতেন না,,তার দাঁড়ির তাই এই অবস্থা”
.
চা বসিয়ে দিবা জানালা দিয়ে একবার বাহিরের দিকে তাকালো,,এপাশের দিকে সব ফল গাছ,আম কাঁঠাল জাম গাছ,পেয়ারা সব,,পেয়ারা গাছ দেখে দিবার মাথায় বুদ্ধি আসলো,সে ছুটে গেলো সেদিকে
আহনাফ জিসান আর পিয়াসের সাথে কথা বলছিলো দিবাকে এরকম ছুটতে দেখে সে ভয় পেয়ে সেও গেলো দেখতে
দেখতে এসে দেখলো দিবা লাফিয়ে লাফিয়ে পেয়ারা গাছ থেকে পাতা ছিঁড়ছে
.
এই মেয়েটা আস্ত একটা পাগল!
.
আহনাফ মুক বাঁকিয়ে আবার চলে আসলো,
দিবা কিছু কচি পাতা নিয়ে ফিরে আসলো রান্নাঘরে,সবার কাপে রঙ চা ঢেলে তার উপর লেবু এক পিসের রস দিয়ে দিলো সে,,বাকি মেয়েরা এসে কাপগুলো নিয়ে সার্ভ করতে গেলো
দিবা সাদাত স্যারের জন্য রাখা কাপের উপর পেয়ারা পাতা ধুয়ে ছোট ছোট করে কুচি করে দিয়ে দিলো,,সে মাঝে মাঝে রঙ চা বানালে এমনটা করে,তার ভাল্লাগে খেতে
সবে পাতাটার রঙ পালটে গেলে চামচ দিয়ে ফেলে দেয় সে,,রসটাই জরুরি
কাপ দুটো নিয়ে সে স্যারের রুমে ঢুকে হাত বাড়িয়ে স্যারের পাশে দুটো কাপ রেখে আবার দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো
স্যারের মা খুশি হয়ে পিছনে তাকালেন ধন্যবাদ দিবেন বলে
কিন্তু দিবার মুখ দেখে তার মুখের কথাই হাওয়া হয়ে গেছে
এটা কি করে হতে পারে,মনে হচ্ছে মেয়ের বেশে সাদাত দাঁড়িয়ে আছে আলমারির সামনে
স্যারের মা চশমা ঠিক করে স্যারের দিকে এক নজর তাকিয়ে আবারও দিবার দিকে তাকালেন
কিছুতেই মানতে পারছেন না এমনটা,,চেহারায় এত মিল তো বাপে মেয়ের হয়,কিংবা ভাই বোনের হয়,তবে???
.
দিদুমণি চা খান,,ঠাণ্ডা হয়ে গেলে ভাল্লাগবে না
.
দিবা?এদিকে আসো জলদি!!
.
দিবা আহনাফের কথা শুনে ছুটে চলে গেলো,,সাদাত স্যার তার মায়ের হাত ধরে অনেক কষ্টে শোয়া থেকে উঠে বসলেন,শরীরটা ম্যাচম্যাচ করছে,হাত পা প্রচণ্ড ব্যাথা করে,,
চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে স্যার তার চশমাটা খুঁজে চোখে দিলেন,,মা এখনও ঘোরের মধ্যে আছেন
স্যার চায়ের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠেছেন,,মুখ দিয়ে আম্মা কথাটা বের হলো তার
মা ঘোর থেকে বেরিয়ে স্যারের কাঁধে হাত রেখে বললেন”কিরে?শরীর খারাপ লাগে?”
.
আম্মা এই চা কে বানিয়েছে?
.
ঐ তো তোর ভার্সিটির একটা স্টুডেন্ট,সবেমাত্র দিয়েই তো চলে গেলো
.
নাম কি ওর?
.
একটা ছেলে মনে হয় দিবা বলে ডাকলো ওকে
.
দিবা?
.
কেন?কি হয়েছে?
.
নাহ,কিছু না,এমনি জানার ইচ্ছা হলো
(এটা কি করে হয়,,এরকম করে চা বানায় তো মৌসুমী,,রঙ চায়ের উপর পেয়ারা পাতা দেওয়া ওর স্বভাব,ওর হাতের এমন চা আমি কতবার খেয়েছি তাহলে কি এমনটা অন্য কেউ করতে পারে??কি করে পারে,,
হয়ত কো-ইন্সিডেন্ট হতে পারে,,মানুষের স্বভাব তো আর এক্সট্রা অর্ডিনারি না যে আর কারোর হতে পারবে না
কিন্তু হুট করে এত বছর পর এরকম চা দেখে সবার আগে ওর কথা মাথায় আসলো,এমন একজন মানুষ ছিল আমার জীবনে যাকে আজও ভুলার ক্ষমতা খোদা আমায় দেয়নি,ছোট ছোট জিনিস পর্যন্ত অক্ষরে অক্ষরে মনে আছে আমার)
.
চা খা, কি এত ভাবিস তুই??
.
নাহ,কিছু না,চা কেমন?
.
বেশ ভালো,তবে তোর চায়ের উপর ওসব কি?
.
সাদাত স্যার হাসলো,,হেসে চামচ দিয়ে পাতা সরাতে সরাতে বললেন”এরকম বাচ্চামো মৌসুমী ছাড়া কেউ করতো না মা,,আর আজ আরেকজন করলো”
.
মৌসুমীর নাম শুনে মা চায়ের কাপটা রেখে দিলেন,খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে চলে গেলেন রুম থেকে
সাদাত স্যার তৃপ্তি নিয়ে চোখ বন্ধ করে ফিল করে চা শেষ করলেন,এত ভালো লাগলো মনে হলো চা মৌসুমী বানিয়েছে,নিজের অজান্তেই হেসে ফেললেন তিনি

ডাকলেন কেন?স্যারকে চা দিতে গেছিলাম আমি
.
পাতা ছিঁড়ছিলা কেন?
.
আমার বাসায় গরু আছে তারে খাওয়াবো বলে
.
আহনাফ মুখ বাঁকিয়ে বললো”বাই দ্যা ওয়ে চা ভালো হয়েছে,স্যার তোমাকে পরীক্ষার খাতায় নাম্বার ভালো দেবে দেখো”
.
দিবা আহনাফের পাশে বসে টেবিলের উপর থেকে এক কাপ চা নিয়ে বললো”আমার বারতি মার্ক্স লাগবে না আমার এমনিতেই নাম্বার বেশি আসে,হুহ”
.
ভালো!এখন চলো যাই,অলরেডি আড়াইটা বেজে গেছে,স্যারকে বাই বলে চলে যাব আমরা
.
দিবা আর আহনাফ উঠে গেলো স্যারকে বাই বলবে বলে সেদিকে যেতেই স্যারের মায়ের সামনে পড়লো দুজন
স্যারের মা দিবাকে দেখে আবারও থমকে গেলেন,,দিবার দিকে তাকালেই মনে হয় সাদাত দাঁড়িয়ে আছে
দিবা মুচকি হেসে বললো”দিদুমণি আমরা আজ আসি,,স্যারকে বলে আসছি”
.
স্যারের মা তাকিয়ে থাকলেন এক দৃষ্টিতে,,আহনাফ দিবাকে সাথে নিয়ে স্যারের রুমে ঢুকলো,স্যার চায়ের কাপটা সবেমাত্র বিছানার উপর রাখলেন,,দিবাকে দেখে মুচকি হেসে বললেন”এরকম করে চা বানানো কে শেখালো তোমায়?”
.
দিবা মাথা চুলকিয়ে বললো”আসলে এরকম করে আমার মা মাঝে মাঝে চা বানাতো,,তার থেকেই শেখা,,ভালো লেগেছে আপনার?”
.
সাদাত স্যার মুখটা ফ্যাকাসে করে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষন তারপর বড় করে নিশ্বাস ফেলে বললেন”ওহ,,আসলে আমার খুব কাছের একজন মানুষ এমন করে চা বানাতো,,তুমি আজ তার কথাই মনে করিয়ে দিলে,ধন্যবাদ এত মিষ্টি একটা অনুভূতি আবারও মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য”
.
ওয়েলকাম,স্যার আজ আসি তাহলে আমরা
.
ঠিক আছে,সাবধানে যেও
.
আহনাফ চলে গেলো,দিবা পা টিপে টিপে এগিয়ে এসে বললো”স্যার আপনার বাগানে কালো রঙের গোলাপ দেখলাম কয়েকটা টব সমেত আছে,আমি একটা নিয়ে যাই?প্লিস স্যার,আমার অনেক শখ ফুল গাছের বাগান করার
.
স্যার মুচকি হেসে বললেন”আচ্ছা নাও”
.
দিবা ছুটে গেলো আহনাফের আগেই,বাগানে ঢুকে পাগলের মতন কালো গোলাপ গাছটা খুঁজতেছে সে
আহনাফ বাইকে বসে ভ্রু কুঁচকে বললো”এমন করে দেখো যেন স্যার তোমাকে এই বাগানটা উঠিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব দিছে?”
.
আরেহ না, চা খাওয়ানোর বদলে স্যার আমাকে একটা ফুলের টব ফ্রিতে দিলো
.
কিহ!
.
আহনাফ তব্দা খেয়ে দিবার টব নেওয়া দেখছে,,স্যার এত সহজে মেনে গেলো?তাও কালো গোলাপ গাছ,এটার তো অনেক দাম হবে,স্যার মানলো কেন,তাই বুঝি নিজ থেকে চা বানাতে গেলো এই মেয়েটা
মাঝে মাঝে এমন কাজ করে আমি একসের বোকা বনে যাই
.
দিবা টবটা নিয়ে বাইকে উঠে বসে বললো”নিন চলুন”
.
মানুষকে পটানো কেউ তোমার থেকে শিখুক
.
আমার তারিফ করলেন,আচ্ছা আপনার বিয়েতে আমি আমার ফুল গাছের একটা ফুল দিবো গিফট হিসেবে,বাসর রাতে বউকে দিয়ে বলবেন”গিফট ফ্রম মাই বোন”
.
আমার বউরে দিলে লাল গোলাপই দিবো,কালো গোলাপ দিয়ে তার মন খারাপ করতে চাই না আমি
.
অবশ্য তাও ঠিক,,সবাই তো আর কালো গোলাপের মর্ম বোঝে না,আমি তো আমার হাসবেন্ডকে বলবো আমায় কালো গোলাপ দিতে
.
আহনাফ ঘাঁড় ঘুরিয়ে বললো”তোমার আবার বিয়ে করার ও শখ আছে??বাট আমি তো জানতাম তুমি বিয়ে করবে না বলে খুলনা ছেড়ে আসছো”
.
একদিন না একদিন তো বিয়ে করতেই হবে
চলবে♥

সবটা অন্যরকম♥
#পর্ব_২৮
Writer-Afnan Lara
.
মিনি বারান্দার গ্রিলের সাথে লেগে গাঁদা ফুল গাছটার তলায় বসে নিচের রোডের ব্যস্ত যানবাহন দেখছে
এই ধরো সাইকেল,,বাইক,,রিকশা এরকম
কলোনিতে তো আর বাস ট্রাক চলবে না,,দুপুরের রোদ শেষ হতে চললো বৈকি,এখন বিকালের শোভাযাত্রা তো তাই রোদ ঢলে পড়েছে সবখানে,দূরের গাছগুলোতে কিছু কিছু রোদের দেখা পাওয়া যায়,,চারিদিকে এখন বিকেলে ঘ্রান,বড় করে শ্বাস নিলেই টের পাবেন বিকেল হতে চললো,,তবে এখন বিকেল বললেই চলে কারণ চারটা বাজতে চললো তো…
মিনির এরকম উদাসীন হয়ে বসে থাকার কারণ হলো দিবা এখনও আসছে না,সাথে আহনাফ ও না,,ওরা এরকম দেরি আর কখনও করেনি,মিনির মন খারাপ তাই
কিছুক্ষণ বাদে একটা বাইক দেখলো বাসার নিচে থেমেছে,দূর থেকে দেখা যায় দিবার মতন,মিনি বুঝে গেছে দিবা এসেছে,সে ছুটে দরজার কাছে এসে বসলো,,
কলিংবেল দুবার বাজার পর আরিফ এসে দরজা খুললো,,দিবা ভেতরে ঢুকতেই মিনি ওর পায়ের কাছে এসে দাঁড়ালো সাথে সাথে,দিবার হাতে টব বলে ও মিনিকে ছুঁতে পারলো না,টব নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে বললো”মিনি চল আজ বাগানটায় আরেকটা ফুলগাছ বাড়লো,দেখবি চল”
.
কিন্তু মিনি গেলো না,কারণ তার এখনও আহনাফকে দেখা বাকি,,দিবা টব নিয়ে চলে গেছে,,আহনাফ মিনিট পাঁচেক পর বাইকের চাবি নিয়ে বাসায় ঢুকতে নিতেই দেখলো মিনি ওর দিকে তাকিয়ে আছে,,সে কিঞ্চিত মুচকি হেসে আরেকদিকে মুখটা ঘুরিয়ে মিনিকে না দেখার ভান করে চলে গেলো নিজের রুমের দিকে
আহনাফকে দেখা শেষ হলো বলে মিনি চলে গেলো দিবার কাছে,,দিবা ওড়না কোমড়ে বেঁধে টবটা সব ফুলগাছগুলোর মাঝ বরাবর সেট করছে,,মাটি কিছু টব ছেদ করে উপচে পড়েছে বলে সেগুলোকে তুলে দিবা ভেতরে রাখছে এখন
গরমে কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ছে দিবার,জলদি করে গোসলটা সেরে ফেলতে হবে
মাটির কাজ সারতেই কলিংবেল বেজে উঠলো,বরাবর কয়েকবার বাজার পরেও কেউ খুলছে না দেখে দিবা ছুটে গেলো খুলবে বলে,,আদনান এসেছে,,হাতে পাঁচ ছয়টা প্যাকেট
মুচকি হেসে সে বললো”মামি কোথায়?”
.
দিবা ওকে ভেতর আসতে বলে একটু পিছিয়ে গিয়ে বললো” খালামণি মনে হয় ঘুমায়,আমি ডেকে আনছি”
.
না থাক তাহলে,আমি এগুলো দিতে এসেছিলাম তোমায়
.
আমায়?কি এগুলো?
.
আদনান সোফায় বসতে বসতে বললো”এগুলো তোমার জন্য কিছু জামাকাপড়”
.
মাথার ছোট ছোট অবাধ্য চুলগুলোকে কানের পেছনে গুজে দিয়ে দিবা মলিন চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো” হঠাৎ আমাকে কেন জামাকাপড় দিতে গেলেন,কি দরকার ছিলো,ঠিক বুঝতে পারলাম না”
.
আসলে মণির শ্বশুর বাড়ির লোকেরা ওকে ঢের জামাকাপড় দিয়েছে,মা তার থেকে কিছু তোমায় দিতে বললো,তোমার হয়ত তেমন জামাকাপড় নেই আর তাছাড়া মনির বিয়েতেও তো নতুন জামা পরতে হবে তাই না?
.
দিবার খুব খারাপ লাগলো,কেন জানি না তার বুকের ভেতরটা খালি খালি লাগা শুরু হয়ে গেছে,ঢোক গিলে মুখটা ফ্যাকাসে করে সে বললো”বসুন,আমি পানি আনছি”
.
আদনান প্যাকেট গুলো টেবিলের উপর রেখে টাই টা একটু টেনে ঢিল করলো,সরাসরি অফিস থেকে এসেছে সে,এগুলোকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়েছিলো একেবারে,,অফিসে কেবিনের এক কোণায় রেখে দিয়েছিল আর এখানে আসার সময় নিয়ে আনলো সে
আহনাফ গোসল করে বেরিয়ে মাথার চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে মুছতে মুছতে ড্রয়িং রুমে এসে দেখলো আদনান সোফায় বসে ম্যাগাজিন পড়ছে মনোযোগ দিয়ে
.
কিরে তুই,কখন এলি?
.
আরে আহনাফ যে,ঘুমাস নি?তোর তো এটা ঘুমানোর সময়
.
আজ ভার্সিটি থেকে আসতে দেরি হয়ে গেলো,ঘুমানো হয়ত হবে না,লাঞ্চ করে একেবারে ডিউতে চলে যাব,আয় বস লাঞ্চ করবি আমার সাথে
.
নাহ,,আমি অফিসে লাঞ্চ করেছি,আর এটা কি লাঞ্চের সময়??বিকেলবেলা এখন
.
তাহলে দাঁড়া চা খাওয়াবে তোকে
.
দিবা গেছে পানি আনতে
.
আমি ওকে বলছি চা বানাতে,ওয়েট এ মিনিট
.
আহনাফ তোয়ালেটাকে ডাইনিংয়ের চেয়ারের উপর ওলটপালট করে রেখে চুলগুলোকে হাত দিয়ে ঝাড়তে ঝাড়তে রান্নাঘরের দিকে গেলো
দিবা নিঃশব্দে কাঁদছিলো সেখানে
হাতে পানির গ্লাস নিয়ে সে কেঁদেই যাচ্ছিলো এতক্ষণ ধরে
আহনাফ রান্নাঘরে ঢুকতেই দিবার কান্নার আওয়াজটা স্পষ্ট শুনতে পেলো
দিবা কেন কাঁদছে তার কারন ওর মাথায় আসলো না,দিবা কেঁদেই যাচ্ছে শুধু
আহনাফ চা বানানোর কেটলিটা হাতে নিয়ে হালকা কাশ দিয়ে বললো”চা বানাবো সরো”
.
দিবা হাতে থাকা গ্লাসটা রেখে দিয়ে তড়িগড়ি করে ওড়না দিয়ে মুখ মুছে ফেলে কোনোরকম গ্লাসটা নিয়ে বেরিয়ে চলে গেলো
সোজা হেঁটে আদনানের দিকে গ্লাসটা বাড়িয়ে ধরলো সে
আদনান মুচকি হেসে ম্যাগাজিন টা রেখে দিয়ে পানির গ্লাসটা নিলো,দিবা মুখ নিচু করে রেখেছে
.
অনেক ক্লান্ত লাগছে তোমায়,যাও ফ্রেশ হয়ে আসো
.
দিবা কিছু না বলেই চলে গেলো নিজের রুমের দিকে
নিজের রুমে ঢুকেই দরজাটা লাগিয়ে ফেললো সে
আহনাফ চা বসিয়ে দিয়ে দিবার রুমের দরজাটা বন্ধ দেখলো,এর মানে সে বুঝছে না,কেন দিবা কাঁদছিলো সেটাই ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়,বিসকিটের বোয়াম নিয়ে সোজা আদনানের কাছে গিয়ে বসলো সে,,ওর দিকে বোয়ামটা ছুঁড়ে মেরে বললো”নে,নিজে নিয়ে খা,আর এসব কি?”
.
এসব ঐ যে মা পাঠিয়েছে দিবার জন্য,মনির শশুর বাড়ির থেকে পাঠানো,মামি তোকে বলেনি?
.
ওহ আচ্ছা,,দিবাকে বলেছিস??
.
বললাম তো,কোনো রিয়েক্টই করলো না,,ও কি গিফট পাওয়া পছন্দ করে না?খুলে দেখলো ও না,দেখলে হয়ত বলতে পারতাম পছন্দ হয়নি
.
আহনাফ প্যাকেটগুলোর দিকে চুপচাপ চেয়ে রইলো এরপর দিবার রুমের বন্ধ দরজার দিকে তাকালো সে,বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেলো দিবার কান্নার কারণ আসলে কি ছিলো
.
দিবা বারান্দায় গিয়ে সেখানে ফ্লোরে বসে আছে চুপচাপ,,হাতে মাটি শুকিয়ে আছে,,আজ আর গোসল করেনি সে
ইতির বলা কথাটা আজ সত্যি হয়ে গেলো
খুলনা থেকে এখানে আসার সময় ইতি দাঁত কেলিয়ে বলেছিলো”দেখিও আপু,আজ তো অন্যের বাসায় আশ্রয়ের জন্য যাচ্ছো,এরপর যা পাবা সব ভিক্ষা,,তোমাকে মানুষ দান করবে,রোজা রমজান আসলে যখন দান করার সময়ে মাথায় গরীব দুঃখীদের কথা মাথায় আসে ঠিক তেমনি কেউ কিছু ফ্রিতে দেওয়ার হলে তোমায় দেবে,কারণ সবাই জানবে তুমি অসহায়,আহারে
.
ঠিক তেমনটাই হলো আজ,,জিনিসগুলো নিতে গা কাঁপছে দিবার,তার তো জামা আছে যথেষ্ট,তাহলে কেন তাকে এমন করে অন্য একটা পরিবার জামাকাপড় দিতে চায়
তারা দিতে চায় এটা সমস্যা না,কিন্তু আমার যে নিতে কষ্ট হচ্ছে অনেক
মা আমাকে জীবনের একটা সময়ে এমন একটা সিচুয়েশনে ফেলে দিলো মনে হয় গলায় কাঁটা বিধে থাকে সারাক্ষণ, না পারছি মুখ দিয়ে বের করতে আর না পারছি গিলতে
আমার কষ্ট হয়,সেই দিন থেকে যেদিন থেকে শুনেছি মা আমাকে ঢাকায় পাঠাতে চলেছে চিরজীবনের জন্য
আর আজ আমায় কারোর দয়া নিতে হচ্ছে,উনারা নিজে কিনে দিলেও হয়ত এত খারাপ লাগতো না আমার
এখন না নিলে খালামণি যদি রাগ করে??ঠিক আছে নেবো,,ইতির কথাই উপরে রইলো,আমি হেরে গেলাম
ঠিকই তো,যার মা বাবা থেকেও নেই তার জীবনে এসব হওয়া তো একদমই স্বাভাবিক একটা বিষয়,আমিও না!খাপ খাওয়াতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছি
খালামণি আমার কথা ভাবে বলেই তো আমাকে এতগুলো জামাকাপড় পাওয়ার সুযোগ করে দিলো,পজিটিভ না ভেবে কেন নেগেটিভ ভাবতে গেলাম
.
দিবা চোখ মুছে ফেললো হাতের ওপিঠ দিয়ে,,ভেসিনে গিয়ে হাত ধুয়ে মুখটাও ধুয়ে ফেললো সে,,তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে দরজা খুললো সে
আদনান টিভি দেখছে,দিবা এগিয়ে এসে মুচকি হেসে বললো”ধন্যবাদ এগুলো দেওয়ার জন্য,সরি এগুলো নিতে ভুলে গিয়েছিলাম তখন”
.
ইটস ওকে,,সবগুলো পরে দেখিও কেমন?
.
দিবা মাথা নাড়িয়ে হাত বাড়িয়ে প্যাকেটগুলো নিতে যেতেই আহনাফ এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে আটকালো
দিবা ওর দিকে তাকিয়ে আছে,চোখ দুটো লাল বর্নের হয়ে আছে ওর
আহনাফ ওর চোখে চোখ রেখে প্যাকেটগুলো গুছিয়ে আদনানের দিকে বাড়িয়ে ধরে বললো”এসব মনুকেই দিয়ে দিস,মনুর তো একটা জামা দুদিন ও টেকে না,ওর পরে লাগবে,ওর জিনিস ও রাখুক”
.
দিবা আহনাফের দিকে তাকিয়ে আছে শুধু,,আহনাফ কেন এমন করলো সে বুঝলো না,বুঝার চেষ্টা করছে মাথা খাটিয়ে
.
আদনান কপাল কুঁচকে বললো”সেকি!এগুলো তো দিবার জন্য আনলাম,আবার ফেরত নেবো কেন?দিবা তো নিচ্ছিলোই”
.
না ও নেবে না,কারণ ওকে আমি কাল নতুন জামাকাপড় কিনে দেবো,ওর পছন্দের
.
এগুলোতে কি সমস্যা?
.
আহনাফ কথা কাটাতে আদনানের ঘাঁড়ে হাত রেখে ওর পাশে বসে পড়ে বললো”আরে ভাই এগুলো নতুন বউয়ের,নতুন বউয়ের জিনিস কি আবিয়াতি মেয়েরা পরে,কিংবা পরতে পারে??কেমন দেখায় বল?”
.
দিবার ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটলো,আহনাফকে সেই হাসিটা দেখালো সে,আহনাফ দেখলো না,সে আপাতত আদনানকে ভুলভাল বোঝানোয় ব্যস্ত
দিবা হাসিটাকে বরাদ্দ রেখেই নিজের রুমে ফিরে আসলো,,আহনাফ এভাবে সিচুয়েশনটাকে হ্যান্ডেল করবে সে জানত না,তবে যা করেছে ভালো করেছে,তিনি বুঝিয়ে দিলেন আমি কি চাইতেছিলাম
.
ঠিক আছে তাহলে ফেরত নিচ্ছি আমি,কিন্তু আরিফ কোথায়,ও নাকি যাবে আমার সাথে?
.
ও বাসার বাইরের পার্কটাতে,,তুই বের হয়ে ওকে কল দিস,এসে পড়বে
.
ঠিক আছে,তাহলে যাই আমি
.
আদনান উঠে চলে গেলো প্যাকেটগুলো নিয়ে,,আহনাফ দরজা লাগিয়ে দিবার রুমের দিকে আসলো,দিবা মিনিকে জড়িয়ে মিটমিট করে হাসছে
.
আহনাফ দরজার উপর দুবার বাড়ি দিয়ে বললো”এরকম পেত্নির বেশে থাকো বলেই মিনির পশমে আমার হাঁচি আসে,,তুমি পরিষ্কার থাকবে তো মিনির পশমেও আমার এলার্জি আসবে না আর,বিকাল পাঁচটা বাজতে চললো আর এখনও গোসলই করলে না
হাসি দিয়েই দিন পার করবেন উনি,আমার যে খাওয়া হয়নি সেদিকে খবর আছে তোমার??তুমি খাবে না বলে কি আমিও খাবো না?দশ মিনিটে গোসল করে খাবার টেবিলে দাও নয়ত গোসল না করে খাবার দিয়ে যাও,আমার ডিউটি আছে,,আমি এত আজাইরা না”
.
আহনাফ চলে গেলো ধমকিয়ে টমকিয়ে
দিবা তাও হেসে দিলো,,মিনিকে চুমু দিয়ে সে ছুটে গেলো গোসল করতে,,
আহনাফ চেয়ারে বসে গালে হাত দিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে,,বোরিং লাগছে,দিবাকে দেওয়া দশমিনিট শেষই হচ্ছে না,এদিকে খিধায় মরে যাব মনে হয়
মা আজ টেবিলে খাবার রাখেনি,ঘুম থেকেও উঠছে না,আমি একা একা এসব পারি নাকি,রাতে একা একা খেতে আমার কত বিরক্ত লাগে,এখন আবার দুপুরেও একা খাব?
ঐ আজাইরারে ডাকবো?তাহলে সময়টা জলদি চলে যাবে,ঐ মিনি!!আজাইরা বেড়াল!!হাড্ডি খাবা?
.
মিনি দরজা দিয়ে উঁকি মেরে চেয়ে আছে,আহনাফ হাত বাড়িয়ে বললো”এদিকে আসো,তবে বেশি কাছে আসবে না,দূরত্ব বজায় রেখে আসো”
.
মিনি বুঝলো না আহনাফের কথা,তবে হাত বাড়িয়ে ডাকা দেখে বুঝলো তাকে ডাকছে
সে তো চোখে সর্ষে ফুল দেখছে
এক ছুটে আহনাফের সামনে চলে আসলো সে
আহনাফ উঠে গিয়ে তাকের উপরে থাকা ক্যাট ফুডের প্যাকেটটা খুলে ফ্লোরে ঢেলে দিলো কিছু,মিনি তো এত কেয়ার নিতে পারছে না,ড্যাব ড্যাব করে শুধু আহনাফকেই দেখছে সে
আহনাফ আবারও হাত বাড়িয়ে বললো”আমাকে না দেখে নিচে খাবারগুলো দেখো,, বেকুব!!”
.
মিনি এক পা দু পা করে এসে খাবারে মুখ দিলো,আহনাফ পাশেই চেয়ার টেনে বসে ওর খাওয়া দেখছে
কি কিউট বিড়ালটা,, জাস্ট এই এলার্জি!হাইচ্ছু!!এলার্জি না থাকলে আমিও আদর করতাম এরে,এত ঝাড়ি খাওয়ার পরেও আমার ডাকে ছুটে আসলো,মিনি দেখো তোমায় কত আদর করি,তোমার এই ক্যাটফুট কিনেছি আমার চা খাওয়ার টাকা বাঁচিয়ে,,মানে আগে দিনে দু কাপ খেতাম বাসার বাহিরে,এখন এক কাপ খাই
হিসেবি মানুষ,,নতুন খরচ যোগ হলে নিজের খরচ থেকে একটা পদ বাদ দিতে হয় বুঝলে??
তবে সমস্যা না,,চা খেয়ে কি বা লাভ হয়,তোমাকে খাওয়ানোতে লাভ আছে,,সওয়াব আসবে এটা থেকে,খাও আরও বেশি করে খাও বাট আমার থেকে একটু দূরে দূরে থেকো কেমন?
চলবে♥