প্রেমের সাতকাহন পর্ব-১৫+১৬

0
2334

#প্রেমের_সাতকাহন
#পর্ব_১৫_১৬
#সুমাইয়া_জাহান

রিমি নিজের সিটে বসে বসে অনুষ্ঠান দেখছিলো হঠাৎ একটা চিৎকারে দৌড়ে গেলো সেই আওয়াজের উৎস খুঁজতে। কিন্তুে আওয়াজের উৎস আবিস্কার করতে গিয়ে নিজেই ঘাবড়ে গেলো।কারণ চিৎকার টা ছিলো তূবার!আর তূবা হাত পা সব থরথর করে কাঁপছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে মারাত্মক কিছু একটা হয়েছে।তাই আর কিছু দ্রুত পায়ে হেঁটে তূবার কাছে গেলো।তূবার সামনে গিয়ে তূবার দুই বাহু ঝাঁকিয়ে চরম বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—- কি হয়েছে তূবা!এমন করছিস কেন?আcর চিৎকার কেন করলি?কি হলো বল!

ফোনের ওপাস থেকে যা শুনলাম তাতে আমার পুরো দুনিয়া অন্ধকার হয়ে এলো।একটা চিৎকার দিয়ে থ হয়ে গেলাম।পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। আমি কথা বলার ভাষাই হারিয়ে ফেলছি।কিছুক্ষন রিমি এসে আমার বাহু ঝাঁকিয়ে উক্ত কথা গুলো বললো।ও কথা গুলো বলেই অধির আগ্রহে আমার মুখ পানে তাকিয়ে আছে উত্তরের জন্য! কিন্তু আমি এতোটাই শকড এর মধ্যে আছি যে ওর দিকে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম।রিমি আমার এমন চাহনি দেখে আবারও আমাকে ঝাঁকিয়ে একটু জোরেই প্রশ্ন করলো,

—- কি হয়েছে বল!!!

এবার জোরে বলাতে আমার হুস ফিরলো। ফোনের কথা গুলো পুনরায় মস্তিষ্কে ডুকাতেই ওর কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,

—- ল লোক টা বললো ন নীর এ এক্সিডেন্ট করেছে তাও আবার খুব মারাত্মক এক্সিডেন্ট।

কথাটা কোনো রকমে বলেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম।রিমি আমার কথাটা শুনেই চমকে উঠলো।কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে দাড়িয়ে রইলো।তারপর নিজেকে একটু সামলে আমাকে এক হাত দিয়ে ধরে বললো,

—- ক কোথায় হয়েছে এক্সিডেন্ট? আর কে বললো তোকে একথা?

রিমির প্রথম কথাটা মস্তিষ্কে ডুকতেই মনে পরলো আমি তো লোকটাকে জিজ্ঞেসই করিনি কোথায় আছে নীর!তাই চটজলদি চোখের পানি গুলো কোনো রকমে মুছে নিয়ে ফোনটা থেকে ওই নাম্বারে ডায়াল করলাম।আশ্চর্যের ব্যাপার হলো আমার কলটা ঢোকার সাথে সাথেই রিসিভ করলো লোকটা যেন এতোক্ষণ আমার কলের অপেক্ষাই ছিলো।আমি আর ওইদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে চটজলদি লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম,

—- নীর এখন কোথায় আছে? জায়গাটা প্লিজ বলুন!

তারপর লোকটা আমাকে একটা ঠিকানা দেয়।ঠিকানাটা বুঝে নিয়েই সাথে সাথেই তড়িৎ গতিতে পা চালিয়ে ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে পরলাম।পিছন থেকে রিমি অনেকবার করে ডাক দিচ্ছিলো ওকে সাথে নেওয়ার জন্য! কিন্তু আমি আর এক সেকেন্ডও সময় নষ্ট করতে চাইনি তাই ওর কথা বাদ দিয়ে হেঁটে চলেছি।

💗💗

লোকটার ঠিকানা মতো আমি এসেছি কিন্তু এখানে কোনো লোকজনকেও দেখতে পাচ্ছি না।জায়গাটা খুব নির্জন আমার একটু দুরেই একটা বড়ো গোডাউন দেখতে পাচ্ছি। তবে অনেক পুরোনো গোডাউন বলে মনে হচ্ছে।আমি আবার ভুল ঠিকানায় চলে আসলাম না তো!এসব ভেবেই লোকটাকে আবার ফোন দিলাম আগের বারের মতো এবারও লোকটা কল ঢোকার সাথে সাথেই রিসিভ করে নিলো।আর বললো,

—- আপনি ঠিকানা অনুযায়ী পৌঁছে গেছেন?

—- হ্যাঁ! কিন্তু এখানে তো কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না।

—– আপনার সামনে একটা গোডাউন আছে দেখতে পেয়েছেন?

—- হ্যাঁ!কিন্তু নীর কোথায়?

—- সামনে যে গোডাউন আছে ওখানেই আপনার স্বামী নীর আছে।আসলে ওনার খুব আঘাত লেগেছে তো তাই আমরা কয়েকজন মিলে গোডাউনের ভিতরে নিয়ে এসেছি।আপনি এখানে আসলেই ওনাকে হসপিটালে নিয়ে যাবো।আপনি প্লীজ তাড়াতাড়ি আসুন!

লোকটার কথাগুলো আমার কেমন যেন সন্দেহ জনক লাগলো। কিন্তু এখন এসব নিয়ে ভাবার মানসিকতায় আমি একদম নেই।আমার এখন শুধু একটাই চিন্তা নীর ঠিক আছে তো! তাই আর কিছু না ভাবতে পেরে দ্রুত পায়ে গোডাউনে দিয়ে হাঁটা ধরলাম।

পুরো গোডাউনটার ভিতরে প্রবেশ করতে নীরকে দেখতে পেলাম।নীরকে সুস্থ অবস্থা চোখের সামনে খুশিতে আত্মহারা হয়ে কোনো দিকে না তাকিয়ে নীরের ছুটতে লাগলাম।তবে দুপা ফেলার পর আর এক পাও এগোতে পারলাম না।কারণ এখানে শুধু নীরই না এখানে কালো পোষাক পরিহীত আরো অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছে ।একটা লোক চেয়ারে বসা লোকটার অবস্থা খুব খারাপ। পুরো শরীর রক্তাক্য অবস্থায় আর অনেক গুলো আঘাতের চিহ্ন। আর নীর সেই লোকটার থেকে একটু দুরে অন্য দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।এখন ওর পরনে সকালের পরা সেই নীল পাঞ্জাবি টা আর নেই। তার পরিবর্তে এখন ওর পরনে একটা সাদা শার্ট গলায় টাই পরা।তার উপর কালো ব্লেজার কালো কোর্ট। কালো পেন্ট আর কাঁধে আরো একটা কালো কোর্ট । এক হাত পেন্টের পকেটে ঢুকানো আর আরেক হাত দিয়ে একটা সিগারেট মুখে নিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে।পুরোই গ্যাংস্টারদের মতো লাগছে।

এ আমি কোন নীরকে দেখছি নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছি না।এক ধ্যানে ওর দিকে তাকিয়ে আছি।একটু পরেই আধ খাওয়া সিগারেট টা নিচে ফেলে পা দিয়ে পিসে ফেললো।তারপর লোকটার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে পিছনের দিকে হাত উঁচু করতেই পিছন থেকে কালো পোশাক পরিহিত দুইজন লোক ওর দুই হাতে দুইটা গান ধরিয়ে দিলো।নীর গান দুটো হাতে পাওয়ার পর তড়িৎ গতিতে গান দুটো ঘুরিয়ে লোকটার দিকে তাক করে পরপর কয়েকটা গুলি করলো।আমি এই দৃশ্য দেখে কানে দুই হাত চেপে চোখ বন্ধ করে জোরে একটা চিৎকার দিলাম,

—- নায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়া!!!

তারপর সবকিছু দেখতে পেলাম না সব কিছু আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে আসছিলো।একসময় শরীরের ভর ছেরে দিয়ে জ্ঞান হারাই।

💗💗

নীর লোকটাকে গুলি করতেই একটা চিৎকার শুনতে পায়। চিৎকারের উৎস অনুযায়ী ওইদিকে তাকাতেই তূবাকে আবিষ্কার করে।তূবাকে দেখেই চমকে যায়।এতোক্ষণে তূবা আস্তে আস্তে জ্ঞান হারাতে দেখে দৌড়ে গিয়ে তূবাকে ধরে ফেলে।আর পাঁজা কোলে নিয়ে নেয়।তূবা কি করে এখানে আসলো? আর কেনই বা আসলো?এসব ভেবেই কপালে দৃঢ় ভাজ ফেললো নীর।তারপর তূবার ভয়ার্ত চেহারা টা দেখে আর কিছু না ভেবেই ভিতরে ঢুকে একটা রুমের দিকে পা বাড়ালো।আর যাওয়ার আগে কালো পোশাক পরিহিত গার্ড গুলোকে ইশারা করে ওই লোকটাকে সরিয়ে দিতে বললো।গার্ড গুলো এতোক্ষণ চরম বিস্ময় নিয়ে এখানে ঘটে যাওয়া ঘটানা গুলো দেখছে।ওরাও ভাবতে পারবে নি তূবা এখানে আসতে পারে।

রুমে এনেই তূবাকে বিছানায় শুইয়ে দিলো নীর।ওর মুখের দিকে কিছুক্ষন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।যেই সত্যি টা তূবার থেকে লুকিয়ে রাখতে এতো নাটক করলো আজ সেই সত্যির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে তার প্রিয়তমা। সব কিছু না জেনেই ভুল বুঝবে ভুল বুঝবে নাতো তাকে!এই নিয়ে ভিষণ চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলো নীর।কিন্তু এখন তো আর সত্যি টা না বলে উপায় নেই।ভেবেই একটা দীর্ঘ শ্বাস সারলো নীর।তারপর তূবার জ্ঞান ফেরানোর জন্য লেগে পরলো।পাশ থেকে পানি ভরা গ্লাস নিয়ে একটু পানি হাতে নিয়ে কয়েক ঝাপটা পানি তূবার চোখে মুখে ছিটালো।কিন্তু তাতেও তূবার জ্ঞান ফিরছে না।এবার বেশ ভয় পেয়ে গেলো নীর।কি করবে ভেবেই পাচ্ছে না।তূবার মুখে এক হাত দিয়ে ব্যস্ত গলায় ওকে ডাকতে লাগলো,

—- তূবা চোখ খোল প্লীজ!আমি তোকে সব বলে দিবো তুই শুধু একবার চোখ খোল!বিশ্বাস কর আমি আর তোর থেকে কখনো কোনো কথা লুকাবো না।তুই চোখটা খোল না প্লীজ!সবার মতো তুই আমাকে একলা করে চলে যাস না প্লীজ!নাহ্ তোর কিচ্ছু হবে না!কিচ্ছু না!

কথা গুলো বলে তূবাকে ছেড়ে চটজলদি উঠে দাঁড়িয়ে ফোন বের করে ওর এক বিশস্ত ডক্টর কে ফোন দিলো।ডক্টর কে ফোন করার পাঁচ মিনিট পরই ডক্টর চলে আসলো।ডক্টর এসেই তূবাকে চেক-আপ করতে লাগলো।কিছুক্ষণ চেকআপ করে তার ডাক্তারি কালো ব্যাগ টা থেকে একটা ইনজেকশন বের করে তূবার হাতে ফুস করলো।নীর পাশেই ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে দাড়িয়ে আছে। ডক্টরের ইনজেকশন দেওয়া শেষ হলেই ডক্টর উঠে দাড়িয়ে নীরের অবস্থা দেখে মুচকি হাসি দিয়ে বললো,

—- এতো ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই নীর!একটু বেশি ভয় পেয়েছিলো তাই তাই জ্ঞান ফিরছিলো না।আর মেয়েটা বেশ অনেকক্ষণ পর্যন্ত কিছু একটা নিয়ে আতংকের মধ্যে ছিলো।তারপর আবার এতোটা ভয় পেয়েছিলো তাই একটু সমস্যা হয়েছে।চিন্তার কোনো কারণ নেই।একটু রেস্টের প্রয়োজন আছে।তাই একটা ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছি কয়েক ঘন্টার ঘুমাবে।

ডক্টরের কথায় কিছুটা শান্ত হলো নীর।জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে স্রেফ মাথা নেরে বললো,

—- ওকে ডক্টর আংকেল।

ডক্টর আবারও একটা মুচকি হাসি দিয়ে তারপর চলে গেলো।ডক্টর চলে যাওয়ার পর নীর তূবার পাশে গিয়ে বসলো।তূূবার হাতটা নিজের বুকের মধ্যে নিয়ে নিয়ে নিজেও চোখ বুঝে নিলো।তবে নীর খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে তূবা এখানে আসার পিছনে শত্রুদের হাত আছে।সেসব নিয়ে পরে ভাববে এখন শুধু ওর একটাই ভাবনা তূবাকে বোঝাতে হবে!

💗💗

এদিকে তূবা ওইভাবে একলা চলে যাওয়াতে রিমি বেশ ঘাবড়ে গেলো। তাই তাড়াতাড়ি তূর্য কে ফোন করলো।একবার রিং হয়ে কেটে গেলে আবারও ফোন করলো। এবার সাথে সাথেই রিসিভ করলো তূর্য। আর বললো,

—- সরি একটা কাজের ভিতর ছিলাম তাই আগের বার রিসিভ করতে পারিনি।কিন্তু তুমি এই সময় হঠাৎ ফোন দিলে এখন তোমাদের অনুষ্ঠানে থাকার কথা!

রিমি হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,

—- আরে শোনে এখানে কি হয়েছে!

তারপর রিমি তূর্যকে সব বললো।তূর্য সব শুনে চরম বিস্ময় নিয়ে বললো,

—- হোয়াট!! কি বলছো এসব?

—- আমি ওকে অনেক বার আটকানোর চেষ্টা করেছি।ওর সাথে আমিও যেতে চেয়েছিলাম।ইভেন পর ওর পিছন পিছনও গিয়েছি কিন্তু আমার আগেই ও চলে গেলো তাই আর ধরতে পারিনি।তুমি প্লীজ তাড়াতাড়ি দেখো ও কোথায় গেলো।আর নীর ভাইয়ার কি সত্যি কোনো এক্সিডেন্টে হয়েছি কিনা!আমার মনে হচ্ছে কেউ তূবাকে মিথ্যে বলে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে।তুমি প্লীজ তাড়াতাড়ি ওকে খোঁজো!

—- হুম আমি দেখছি!

কথাটা বলেই তড়িৎ গতিতে ফোনটা কেটে দিলো তূর্য।তারপর আবার কাকে একটা ফোন করলো।আর সাথে সাথেই বেরিয়ে পরলো।

💗💗

আমি আস্তে আস্তে চোখ খুলে একহাত মাথা ধরে উঠে বসে নিজে একটা অচেনা রুমের মধ্যে আবিষ্কার করলাম।আর আমার পাশেই নীর আমার একটা হাত ওর বুকের মধ্যে নিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে।নীরকে দেখে প্রথমে খুশি হলেও পরক্ষণেই একটু আগের ঘটনা মনে পরতেই নিজের হাতটা নীরের থেকে তড়িৎ গতিতে সরিয়ে নিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাড়ালাম।এখনো মাথাটা জিম জিম করছে।তাই দুই হাত দিয়ে মাথাটা একটু ধরলাম।

নীরের থেকে হাতটা এভাবে সরিয়ে নেওয়াতে নীরও চোখ খুলে ফেললো।চোখ খুলে আমাকে এভাবে দেখে ঘাবড়ে গেলো তাড়াতাড়ি নিজেও উঠে আমাকে ধরতে গেলে আমি ওর থেকে অনেক টা দুরে সরে গেলাম।আর কড়া গলায় বললাম,

—- খবরদার নীর চৌধুরী আমাকে আপনার ওই নোংরা হাতে স্পর্শ করবেন না।

—- তূবা আমার সাথে এইভাবে কথা বলছিস কেন?

বিস্ময় নিয়ে আমার পানে তাকিয়ে বললো নীর।বিনিময়ে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম,

—- এখনো এই নাটক চালিয়ে যাচ্ছেন নীর চৌধুরী!কিন্তু এখন আর আপনার এই নাটকের কোনো প্রয়োজন নেই। আমি সব জেনে গেছি।সেদিন রাতুলের কথা গুলো আমি বিশ্বাস করিনি।কিন্তু আমার জানা ছিলোনা সেদিনের রাতুলের বলা প্রত্যেক টা কথাই সত্যি ছিলো!আপনি একদম ভালো মানুষ না।ভালো মানুষের আড়ালের আপনার এই ভয়ংকর নোংরা রুপ না দেখলে তো বিশ্বাসই করতে পারতা না।আপনি কতোটা খারাপ। আমাকে আপনার মিথ্যে জালে ফাঁসিয়ে বিয়ে করেছেন শুধুমাত্র আমার বাবার সম্পত্তির জন্য।তারথেকেও বড়ো কথা আপনার বাবাই আমার মায়ের খুনী। খুন করেছে আপনার বাবা আমার মাকে!

কথাগুলো বলেই আমি কাঁদতে লাগলাম।আর সাথে সাথেই আমার মুখে একটা চড় পরলো।

চলবে,,,,,,

[অবশেষে লিখতে পারলাম যদিও দেরি হয়েছে।আর হ্যাঁ কালকে থেকে কিন্তু অতীত জানতে পারবেন]

#প্রেমের_সাতকাহন
#পর্ব_১৬
#সুমাইয়া_জাহান

আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ টার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।এ আমি কাকে দেখছি?যেকিনা আমার সাথে কখনো উচ্চ সরে কথাও বলেনি সেই মানুষ আজ আমাকে সোজাসুজি চড় মেরে দিলো।হ্যাঁ সেইদিন বিয়ের আসরেও ভাইয়ু আমার সাথে রেগে কথা বলেছিলো কিন্তু সেটাতো নাটক করে বলেছিলো।কিন্তু আজ যা করলো তাতো নাটক নয়! চোখ জোড়া বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে ভাইয়ু।ভাইয়ু এই রুপের সাথে আমি পূর্বপরিচিত নই।একদৃষ্টিতে আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি।নীরও বেশ অবাক হয়েছে সেও ভাইয়ুর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।ওরও ধারনা ছিলো না ভাইয়ু এমন কিছু করতে পারে!তাই বিস্ময় নিয়ে বললো,

—- তূর্য ভাইয়া এটা কি করলে তুমি?

ভাইয়ু এবার ফট করে চোখ খুলে রক্ত চোখে তাকিয়ে বললো,

—- যা করেছি তা একদমই ঠিক করেছি।ও এর থেকেও বেশি কিছু ডিজার্ভ করে।আমার উচিৎ ছিলো আরো কয়েকটা চড় মারা!কিন্তু আফসোস তা আমি করতে পারলাম না!

—- ভাইয়ু!

আমি ছলছল চোখে ভাইয়ুর দিকে তাকিয়ে বললাম।
ভাইয়ুর কথা গুলো শুনে টপটপ করে গাল বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পরলো।ভাইয়ু অন্য দিকে ফিরে বললো,

—- খবরদার তূবা আমাকে ভাইয়ু বলে ডাকবি না।এই ডাক টা শুধু আমার পরীর।তুই তো আর আমার পরী না।আমার পরী হলে তুই কখনো এমন করতে পারতি না।আমি আমার পরীকে সেই শিক্ষা দেইনি।

—- ভাইয়ু তুমি কিচ্ছু জানো না! তুমি একবার শোনো তারপর বলবে আমি ঠিক করেছি কি-না!

—- আমাকে তুই কি জানাবি!সেই ছেলেটার ব্যাপারে যে কিনা নিঃস্বার্থ ভাবে তোকে ভালোবেসে গেছে তার ব্যাপারে?তার পরিবারের ব্যাপারে?কতোটুকু জানিস ওর ব্যাপারে?তুই নিজে জানিস ও কে?ওর পরিবার কারা?

—- ভাইয়া তুমি কিন্তু আমাকে প্রমিজ করেছো তূূবাকে তুমি কখনো এসব বলবে না!তুমি কিন্তু প্রমিজ ভাঙ্গতে পরো না!

ভাইয়ুর কথার মাঝেই নীর এসে বললো কথাটা।ভাইয়ু রাগী চোখে নীরের দিকে তাকিয়ে বললো,

—- এতোদিন তুই আমাকে এই প্রমিজের দোহাই দিয়ে কিচ্ছু বলতে দেস নি কিন্তু আজ আর আমি তোর কোনো কথাই শুনবো না।আমার সামনে থেকে সরে যা নীর!আমি কিন্তু একটা কথা দ্বিতীয় বলতে পছন্দ করি না তুই খুব ভালো করেই জানিস।

ভাইয়ুর রাগী চোখে কথা গুলো বলাতে নীর একরকম বাধ্য হয়ে সামনে থেকে সরে গিয়ে খাটে গিয়ে বসলো।ভাইয়ু আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে আবারও বলতে লাগলো,

—- তুই যাকে মামী বলে ডাকিস মানে নীলিমা চৌধুরীর আসল পরিচয় তুই জানিস!কে সে?কি তার পরিচয়? কে হন তিনি আমাদের?

আমি মাথা ডানে বামে নারালাম যার অর্থ আমি জানি না।আমি এখন এতোটাই শকড এর মধ্যে আছি যে কথা বলার ভাষাই হারিয়ে ফেলছি।শুধু আমার সাথে ঘটেছে তা নিরব দর্শেকের মতো দেখে যাচ্ছি। ভাইয়ুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি তার পরিবর্তী কথা গুলো শোনার জন্য। ভাইয়ু একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলতে লাগলো,

—- এখন সময় এসে গেছে তোকে সবটা বলার।সবটা শোনার!আর সব কিছু জানতে হলে যেতে হবে আমাদের সবার সেই পুরোনো অতীতে!

অতীত……….

—- কি করছিস আশরাফ? আমি কিন্তু হাতের কাছে পেলেই পিটিয়ে ভর্তা করে খাবো!তখন বুঝবি কতো ধানে কতো চাল!

কিন্তু আশরাফ তো থামার পাত্র নয়।ও তো শার্ট হাতে নিয়ে দৌড়াচ্ছেই দৌড়াচ্ছে।আর বেচারা আরমান তো নিজের সম্মান বাঁচানোর জন্য আশরাফের পিছনে ছুটছে।আর বারবার শার্ট টা পাওয়ার জন্য নানা রকম ভাবে হুমকি দিচ্ছে। কিন্তু কোনো হুমকি কাজ হচ্ছে না। কোনোভাবেই শার্ট টা নিতে পারছে না।এদিকে ভার্সিটির সব ছেলেমেয়েরাই আরমানের দিকে তাকিয়ে আছে।বেচারার এখন ইচ্ছে করছে একদম মাটির সাথে মিশে যেতে।
আসলে একটু আগে আশরাফের লেখা একটা কবিতা শোনাচ্ছিলো আরমান কে।আশরাফ মাঝে মাঝেই কবিতা লেখে।তবে কবিতাগুলো আদো কোনো কবিতার মধ্যে পরে কিনা বলা যাবে না।একদম আলতু ফালতু। কিন্তু আশরাফ মনে করে ওর কবিতা পৃথিবীর সবথেকে ভালো কবিতা গুলোর মধ্যে একটা।এমন কি নিজেকে সে একজন বড়ো মাপের কবিও মনে করে।প্রায় প্রতিদিনই একটা দুই টা কবিতা লেখবেই লেখবে।আর সবগুলোই আরমান কে জোর করে শোনাবে।সবাইকেই ওর কবিতা গুলো শোনাতে চায় কিন্তু ওর কবিতা শোনার ভয়ে কেউ ওর কাছে আসে না।ওকে দেখলেই পালিয়ে যায়।আরমান যেহেতু আশরাফের প্রানের বন্ধ তাই বাকি সবার মতো পালিয়ে যেতে পারে না।ইচ্ছে না থাকলেও শুনতে হয় ওর বিখ্যাত কবিতা গুলো।তেমনি আজও ওর একটা কবিতা শোনাচ্ছিলো,

“আম গাছে জাম
জাম গাছে আম
কাঁঠাল পাতায় লেখা আছে
বন্ধু তোর আর আমার নাম”

আজ কেনো জানি আরমানের কাছে আশরাফের কবিতাটা বড্ড বেশি বিরক্ত লাগছে। তাই আশরাফ এইটুকু কবিতা বলার পরই ওর হাত থেকে ওর কবিতা লেখা কাগজ টা ছিড়ে ফেললো।আর এতেই আশরাফ রেগে বোম হয়ে গেলো।যেন রাগে নাক কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে ওর এমন ভাবে তাকিয়ে আছে।আরমান ভেবেছিলো আশরাফ হয়তো এখন ওকে আচ্ছা মতো পিটুনি দেবে তাই নিজেকে প্রস্তুত করছিলো দৌড় দেওয়ার জন্য। কিন্তু ওর ধারনা ভুল প্রমানিত করে কিছুক্ষন ওর দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে ওর কাঁধে হাত রেখে বললো,

—- সমস্যা নেই তুই তো ছিঁড়েছিস।পরে না-হয় আবার লিখে নিবো।দোস্ত আজকে না আমার ইচ্ছে করছে তোর শার্ট টা পরার!আজ তুই আমার টা পর৷ আমি তোর টা পরবো।প্লীজ না করিস না!

খুব আবদারী গলায় বললো আশরাফ। বন্ধুর এমন আবদারে আর না করতে পারলো না। তাই ছোট্ট করে “ওকে” শার্ট টা খুলে আশরাফের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,

—- নে! এবার তোর টা খুলে আমাকে দে………

আর কিছু বলার সুযোগ পেলো না আরমান তার আগেই আশরাফ শার্ট টা নিয়ে এক ভো দৌড় দিলো।আরমান তো বেকুব বনে গেলো।আর আশরাফ দৌড়াতে দৌড়াতে বলতে লাগলো,

—– আমার এতো ভালো কবিতাটা ছিঁড়ার জন্য আজ তুই খালি গায়েই ভার্সিটিতে থাকবি।

বাঁকা হেসে কথাগুলো বলেই আবার দৌড়াতে লাগলো।আরমানও ওর পিছনে দৌড়াতে লাগলো।তখন থেকে এভাবেই দৌড়াচ্ছে।খুব হাঁপিয়ে গিয়ে হাঁটু হাত রেখে থেকে দম নিতে নিতে আরমান বললো,

—- ভাই আশরাফ এবার শার্ট দিয়ে দে প্লীজ! পুরো ভার্সিটির সবাই আমার দিকে কিভাবে তাকিয়ে আছে একবার দেখ! আমার মানসম্মান সব ধুলোই মিশে যাচ্ছে।

আশরাফ একটু থেকে চোখ টিপ মেরে বললো,

—- তোর মানসম্মান ধুলোই মিশানোর জন্যইতো শার্ট নিলাম।

—- তবে রে!

আরমান আবারও আশরাফ কে ধাওয়া করতে লাগলো।কিন্তু এবার বেঁধে গেলো এক বিপত্তি! আরমান দৌড়াতে গিয়ে একজনের সাথে ধাক্কা লেগে গেলো।ধাক্কা লেগে আরমান উপুর হয়ে কাঁদার মধ্যে পরে গেলো।মুখটা একদম কাঁদা মধ্যে পরে গেলো।খুব কষ্টে একটু বসতে পেরেছে।সামনের মানুষ টাকে না দেখেই বলতে লাগলো,

—- চোখ কি সপ্তম আকাশে রেখে আসেন নাকিনা!দেখতে পেলেন না আমি দৌড়াচ্ছি!আ…….

সামনের মানুষটার দিকে তাকাতেই আর কিছু বলতে পারলো না আরমান।একটা নীল থ্রি-পিস পরা মেয়ে ঠোঁট কামড়ে আছে।যাকে দেখে এতোটাই আঁটকে গেছে তার মায়াবি মুখের দিকে যে জ্ঞান শূন্য হয়ে মুখে একহাত রেখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।ওই দিকে মেয়েটা আরমানের দিকে ভালো ভাবে তাকাতেই ফিক করে হেসে ফেললো।হেঁসেই চলেছে মেয়েটা।মেয়েটার হাসি যেন আরো বেশি করে টানছে আরমান কে।তাই একদৃষ্টিতে মেয়েটার দিকেই তাকিয়ে আছে।

আশরাফ হঠাৎ খেয়াল করলো আরমান আর ওর পিছনে দৌড়াচ্ছে না।তাই ও দাড়িয়ে আরমান কে খুজতে লাগলো।একটু খুঁজতেই দেখতে পেলো আরমান কাঁদার মধ্যে পরে আছে।তাই আর কিছু না ভেবে আরমানের কাছে গেলো৷ কিন্তু আরমানের সামনে গিয়ে ও নিজেই হু হা করে হাসতে লাগলো।আরমান এতোক্ষণ এ বিষয়ে ভ্রুক্ষেপ না করলেও এবার আশরাফ কে হাসতে দেখে কপালে ভাজ ফেলে আশরাফ জিজ্ঞেস করলো,

—- এভাবে হাসছিস কেন?

—- পরে বলবো আগে একটু মন খুলে হেসে নেই।অনেক দিন পর এমন হাসির সুযোগ পেয়েছি।

পেট ধরে হাসতে হাসতেই বললো আশরাফ। এবার রেগে গেলো আরমান।একে তো এই কাঁদার মধ্যে পরে উঠতে পারছে না।তারউপর আবার আশরাফ এসে না উঠিয়ে হেঁসেই চলেছে।তাই রেগে বললো,

—- আমাকে কি তোর জোকার মনে হচ্ছে!

—- তার থেকেও বেশি কিছু।দাঁড়া দেখাচ্ছি!

কথাটা বলেই আশরাফ আসেপাশে তাকালো।পাশেই একটা মেয়েকে দেখতে পেলো।মেয়েটাও আরমান কে দেখে হাসছে।আশরাফ একটু হেসে মেয়েটার উদ্দেশ্য বললো,

—- আপু আপনার কাছে কোনো আয়না হবে?ওকে একটু দেখাতাম আমরা কেন হাসছি।

—- হ্যাঁ ভাইয়া আছে।

মেয়েটাও হাসতে হাসতে বললো।তারপর মেয়েটা একটা ছোট্ট আয়না বের করে আশরাফের দিকে বাড়িয়ে দিলো।আশরাফও মেয়েটার থেকে আয়না টা নিয়ে আরমানের সামনে ধরলো।আরমান আয়নার দিকে তাকাতেই কাঁদো কাঁদো মুখ করে ফেললো।কারণ কাঁদার মধ্যে পরে যাওয়াতে ওর মুখ টা একদম কাঁদা লেগে একাকার হয়ে গেছে।এর জন্যই ওরা দুইজন এইভাবে হাসছে।এমনিতে সমস্যা ছিলো না কিন্তু মেয়েটার সামনে এভাবে থাকতে খুব লজ্জা লাগছে আরমানের।তাই ইশারায় আশরাফ কে বললো ওকে এই অবস্থা থেকে বাঁচাতে।কিন্তু আশরাফ হেল্প না করে উল্টো হেসেই যাচ্ছে।এতে আরমান রেগে লাল হয়ে যায়।

💗💗

বাড়ি যাওয়ার পথে আরমান আশরাফের সাথে একটা কথাও বলেনা।আশরাফ অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করেই যাচ্ছে কথা বলার কিন্তু আরমান বলছে না।আশরাফ ইনোসেন্ট মুখ করে বললো,

—- আর রাগ করে থাকিস না প্লীজ। আমি তো তোকে পরে উঠাছি বল!তখন তোকে ওইরকম দেখে না হেসে থাকতে পারলাম না তাই একটু হাসছি।প্লীজ এবারের মতো ক্ষমা করে দে।তুই যা বলবি আমি তাই করবো শুধু একবার ক্ষমা কর ভাই।

আরমান এবার কি একটা ভেবেই বাঁকা হাসি দিলো।তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে আশরাফের দিকে তাকিয়ে বললো,

—- যা বলবো তা করবি?

—- হুম যা বলবি তাই! কিন্তু তুই শুধু কথা বলা বন্ধ করিস না প্লীজ!

—- তাহলে তখনকার সেই মেয়েটার সাথে আমার বিয়ে করার নোর দায়িত্ব তোকে দিলাম।

আরমানের কথা শুনে আশরাফের চোখ গুলো বেরিয়ে আসার উপক্রম।চরম অবাক হয়ে বললো,

—- চেনা নেই জানা নেই একটা মেয়েকে একবার দেখাতেই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলি।আবার সেই দায়িত্ব আমাকে দিচ্ছিস!এমন ভাবে বলছিস যেন মেয়েটা আমার বোন হয় যে আমি তার ভাই হয়ে তোর হাতে তুলে দেবো।ইয়ার্কি পেয়েছিস!

—- সে আমি জানি না!আমি শুধু জানি তুই আমাকে যে করেই হোক মেয়েটার সাথে বিয়ে দিবি।আর না পারলে আমার সাথে আর কখনো কথা বলতে পারবি না।অপশন দুইটা। এখন ভেবে দেখ এখন কোনটা নিবি!

—- তুমি বাপু আমায় ইমোশনালি ব্লাকমেইল করে বিয়ে করার ধান্দা করছো!

আশরাফের কথায় পাত্তা না দিয়ে বাইক স্টার্ট দিয়ে ভো করে চলে গেলো আরমান।ও খুব ভালো ভাবেই জানে এই বিষয়ে কিছু করতে পারলে একমাত্র আশরাফই করতে পারবে তাই ওকে এইভাবে ব্লাকমেইল করলো।আসলে আরমান বাবাকে অনেক ভয় পায় যার দরুন বাবার সামনে নিজের বিয়ের কথা বলতে পারবে না।তাই এই টেকনিক টা ইউজ করলো।ও জানে এতে একশো পার্সেন্ট কাজ হবেই হবে।

চলবে,,,,,,