#প্রেমের_সাতকাহন
#পর্ব_২২
#সুমাইয়া_জাহান
তূর্য কাঁদো কাঁদো মুখ করে বেঞ্জে বসে ঝাল মুড়ি খাচ্ছে। আর ওর সামনেই চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে রিমি।ওর এখন তূর্যকে আবিরের মতো পিটিয়ে হসপিটাল পাঠাতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু সেইদিন আবিরের থেকে ক্ষমা চাওয়ার পর থেকেই নিজের এই মাত্রাধিক রাগ কে কন্ট্রোল করা শুরু করেছে।এমনকি একজন সাইকোলজিস্টও দেখিয়েছে ওর বাবা মা যার ফলে এখন আর আগের মতো তেমন রাগ হয় না।আর চার-পাঁচটা মানুষের যতোটুকু রাগ হয় ঠিক ততটুকুই রাগ হয়।আর রাগ নিজেরর মধ্যেই রাখার চেষ্টা করে।কিন্তু আজকে তার মাত্রা পেরিয়ে গেছে।কিছুতেই নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারছে না।পারবেই বা কি করে এমন কথা শুনলে সবারই তো এমন রাগ হয়।আজকে তূর্য রিমি কে একটা পার্কে ডাকে রিমিও খুশি মনে চলে আসে পার্কে। রিমি আসতেই তূর্য বলে উঠে,
—– বাবা আমার জন্য একটা মেয়ে দেখেছে। আর বলেছে সেই মেয়েটার সাথেই আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। তাও আবার সামনের মাসের দশ তারিখে! মেয়েটাকে দেখতে মাশাআল্লাহ! কিন্তু আমি তো তোমাকে বিয়ে করতে চাই! এখন কি হবে আমার? আমি তো বাবার মুখের উপর কথাও বলতে পারি না।সব সময় বাবার হ্যাঁ তেই হ্যাঁ মিলিয়েছি।একেবারে বাবার বাধ্য ছেলে আমি! কখনো বাবার কথা অমান্য করতে পারিনা।বলনা এবার আমার কি হবে?
কাঁদো কাঁদো মুখ করে কথা গুলো বলে একটা ঝালমুড়ি হাতে নিয়ে বসে পরলো একটা বেঞ্জে।আর রিমি তো তূর্যের এমন কথাগুনে রেগে আগুন হয়ে গেছে।সেই থেকেই চোখ বন্ধ করে এইভাবে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে।কিন্তু লাভ হলো না রাগ বেশিক্ষণ কন্ট্রোল করে রাগতে পারলো না।চোখ খুলেই খপ করে তূর্যের শার্টের কলার চেপে ধরলো। এমন আকস্মিক ঘটনায় তূর্য হকচকিয়ে উঠলো।আর হাতের ঝালমুড়ি টাও নিচে পরে গেলো।তবে ওদের আশেপাশে কেউ নেই তূর্য আগে থেকেই একটা নির্জন জায়গা দেখে বসেছে।ও জানতো এমন কিছু একটা ঘটবে।তবে রিমি এমন হঠাৎ করে আক্রমণ করে বসবে তা বিন্দু মাত্রও টের পায়নি তূর্য।তাহলে আগে থেকেই এলার্ড থাকতো আর বেচারা ঝালমুড়ি টাকেও আর এইভাবে নিচে পরে গড়াগড়ি খেতে হতো না।ইসস কি টেস্টই না ছিলো ঝালমুড়ি টার সব এখন মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে । বেচারা ঝালমুড়ি টার এমন করুন অবস্থা দেখে তূর্যের চোখে জল চলে আসার উপক্রম। কিন্তু রিমির ঝাঁঝালো কণ্ঠে বেচারা ঝালমুড়ি গুলোর থেকে চোখ সরিয়ে রিমির দিকে তাকালো।
—- যখন বাবার সামনে আমার কথা বলতেই পারবি না তখন আমার পিছনে এতোদিন ঘুরেছিস কেন?
—– এমা তুমি তো আমাকে ভুলবুঝতেছো।আমি বাবাকে অবশ্যই তোমার কথা বলতাম কিন্তু তার আগেই তো বাবা ওই সুন্দরী মেয়েটার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেললো!
তূর্যের এই ইনোসেন্ট ফেইস করে কথাগুলো আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করলো রিমির উপর।রেগে কলার ছেড়ে দিয়ে আবারও চোখ বন্ধ করে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করলো।দু সেকেন্ড ওইভাবেই থেকে মুখ ঘুরিয়ে তূর্যের দিকে তাকিয়ে যথাসম্ভব গলার সর শান্ত রাখার চেষ্টা করে বললো,
—- লিসেন তূর্য তোমার থেকে এটা একদম আশা করিনি।আমি ভাবতেও পারিনি আর পাঁচ টা ছেলেদের মতো তুমিও আমাকে ভালোবাসার নাম করে এভাবে ঠোকাবে।তোমাকে আমি অন্যদের থেকে আলাদা ভাবতাম। কিন্তু আজ তুমি আমাকে ভুল প্রমানিত করে দিলে।তোমার ভালোবাসা টা মিথ্যে হতে পারে কিন্তু আমার টা না।আমি তোমাকে সত্যি মন থেকে ভালোবেসেছিলাম। ইভেন এখনো বাসি আর ভবিষ্যতেও বাসবো।কারণ আমার ভালোবাসা টা তোমার মতো ঠুনকো ছিলো না যে অন্য কাউকে পেয়ে শেষ হয়ে যাবে।
—– না না না তুমি আমাকে আবারও ভুল বুঝতেছো।আমিও সত্যিই ভালোবেসেছিলাম তোমাকে কিন্তু বাবার একান্ত বাধ্য ছেলে তো তাই বাবার মুখের উপর কথা বলার সাহস নেই। একইটুকুই!
তূর্য আবারও ইনোসেন্ট ফেইস করে বললো।রিমি এতোক্ষণ নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখেছে কিন্তু এখন আর সহ্য করা যাচ্ছে না।
—- থাক তুই বাপের বাধ্য ছেলে হয়ে!
ঝাড়ি মেরে কথাটা বলেই হনহন করে চলে গেলো রিমি সেখান থেকে।রিমি যেতেই তূর্যের পেটে জমা হওয়া সব হাসি গুলো একসাথে বেরিয়ে এলো।এতোক্ষণ বহু কষ্টে রিমির সামনে হাসি আটকে রেখেছিলো।হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে খেতেই বললো,
—– তোমায় রাগলে না আরো বেশি কিউট লাগে।
তারপর ফোন বের করে কাউকে একটা ফোন দিয়ে চওড়া হাসি দিয়ে বললো,
—– প্লান সাকসেসফুল!
💗💗
সকাল হতে না হতেই রঞ্জন আর তার ছেলে এসে আমাদের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে গেছে।যদিও বা প্রথমবার দুজন একসাথে এসেছে।আগে কখনো ওদের একসাথে আমি এ বাড়ি আসতে দেখিনি।তাই জানতাম না এই রঞ্জন নামের লোকটার ছেলেই রাতুল।আর এসেই রঞ্জন নামের লোকটা বাবার সাথে আষাঢ়ে গল্প শুরু করে দিয়েছে।আর বাবাও লোকটার সাথে হেঁসে হেঁসে কথা বলছে।বাবা তো আর জানে না এই ব্যাটার পেটে সারাক্ষণ শয়তানি বুদ্ধি বুদ্ধি গুড়গুড় করে।আমাদের সব থেকে বড়ো শত্রু এই লোক!উনারা ড্রয়িং রুমের বসে গল্প করছে আর আমি ওই লোকটার উপর নজর রাখার জন্য ডাইনিং টেবিলে বসে খাবার নাড়াচাড়া করছি।আমাদের ডাইনিং আর ড্রয়িং রুম একসাথে হওয়াতে উনাদের কথা শুনতে আমার বেশ সুবিধাই হলো।গল্প করতে করতে রঞ্জন লোকটা বললেন,
—- ভাইজান অবশেষে ওই খুনী পরিবারের থেকে আমাদের মেয়েটা রেহাই পেলো এটাই অনেক। এখন আমরা আবার আমাদের ছেলেমেয়ে দুটোকে এক করে দিতে পারবো।আর ভাইজান শুভ কাজ ফেলে রাখতে নাই। আমি চাইছিলাম কি সামনের শুক্রবারই বিয়েটা সেড়ে ফেলতে।আসলে শুক্রবারের পরই আমি আমি আবার বিজনেস এর কাছে একটু দেশের বাইরে যাবো তো!
লোকটার কথায় আমি একটুও চমকালাম না বরং স্বাভাবিক ভাবেই খাবার খাচ্ছিলাম।কারণ আমি জানতাম এই ধরনের কথাই বলবে এই লোক।আমার রিয়াকশন একইরকম থাকলেও বাবার কপালে ঠিকই চিন্তার ভাজ পরলো।
—– কিন্তু রঞ্জন শুক্রবার আসতে দুইদিন বাকী। এতো তাড়াতাড়ি কি হবে।তারথেকেও বড়ো কথা তূূবার এখনো ওই ছেলের সাথে ডিভোর্স টা হয়নি।তাহলে কি করে কি?
—– আরে ভাইজান চিন্তা করেন না।ডিভোর্স হইতে আর কতক্ষণ সময় লাগে আপনি তো আগেই রেডি করে রেখেছেন সব পেপার এখন শুধু তূবা মামনির একটা সাইন আর ওই ছেলেটার।
বাবাকে আস্বস্ত করে বললো রঞ্জন লোকটা।ডিভোর্স এর কথা শুনেই বুকের মধ্যে ধক করে জ্বলে উঠলো।এরা আবার সত্যি সত্যিই আমার ডিভোর্স করিয়ে দেই।নীরকে এই ব্যাপারে জানাতে হবে।আমার ভাবনার মধ্যেই বাবা আবারও বলে উঠলেন,
—- তা না হয় বুঝলাম।কিন্তু আমার একমাত্রের বিয়েটা এতো হালকা ভাবে হবে?
—- আগের বার তো অনেক ধুমধামে বিয়েটা দিলেন কি হলো তাতে?শেষ পর্যন্ত বিয়েটা কি হতেই পারলো? আর ভাইজান আপনাকে কে বলছে বিয়েটা হালকা ভাবে হবে?আমরা এখন থেকেই বিয়ের জন্য লেগে পর দেখবেন খুব ভালো ভাবেই সব হবে।কিরে বল?
পাশে বসা রাতুলের দিকে তাকিয়ে শেষের কথাটা বললো লোকটা।রাতুল চওড়া হাসি দিয়ে আমার বাবার পানে তাকিয়ে বললো,
—- হ্যা আংকেল!আমি আর তূবা গিয়ে বিয়ের শপিং টা এখুনি সেড়ে ফেলতে পারি। যদি আপনার অনুমতি থাকে!
—- এহহহহহ্ এইছে কোথাকার কে?আমার বয়েই গেছে তোর লগে শপিং করতে!শপিং করলে আমার জামাইয়ের লগে করমু।তোর লগে কেন করতে যামু?আমার জামাইয়ের টাকা কম পরছে নাকি?আবার ঢং কইয়া অনুমতি চাইতে আইছে!মরণ দেখলে গা জ্বলে যায়! সক্কাল বেলা সং সাইজা অন্যের ঘর ভাঙ্গতে আইছোস লজ্জা করে না!কান কাটা কোথাকার!খাড়া শয়তান তোগো বাপ বেটারে সুযোগ পাইলে আমার জামাইয়ের গান দুইডা দিয়া গুলি কইরা মারমু!নইলে আমিও আমার জামাইয়ের বউ না!
কথাগুলো ওই ব্যাটার সামনে বলতে পারলে একটু হইলেও শান্তি পেতাম।কিন্তু আফসোস তা এখন সম্ভব না।তাই বিড়বিড় করেই বললাম।কিন্তু বাবা রাতুলের কথা খুব খুশি হলেন।
—– আরে বাবা তোমার আবার কিসের অনুমতি! দাঁড়াও তূবাকে ডেকে দিচ্ছি!
তারপরই বাবা আমাকে ডাকলো।হাজার অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওদের কাছে গেলাম।
—– তূবা মামনি তোমার আর রাতুলের বিয়েটা আমরা আবার দিতে চাই। এই শুক্রবারেই!তাই এখন তুমি আর রাতুল গিয়ে বিয়ের শপিং টা করে আসো। তাই তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আসো।
আমি ছোট্ট করে “ওকে বাবা” বলেই নিজের রুমে এসে কোনোরকমে রেডি হয়ে নিচে নেমে আসলাম।তারপর ওই বদমাশ রাতুলের সাথে শপিং এর জন্য বেড়িয়ে পরলাম।আর আগে ভাইয়ুকেও সব জানিয়ে দিলাম।ভাইয়ু নিশ্চয়ই নীরকে জানাবে।
💗💗
মেয়েকে কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে ঢুকতে দেখে আহসান সাহেব ঘাবড়ে গেলেন।তড়িৎ গতিতে জিজ্ঞেস করলেন,
—– রিমি মা কি হয়েছে তোর?আমরা কি তোকে বিয়ের জন্য জোর দিয়েছি?শুধু ছেলেকে দেখতে বলেছি পছন্দ না হলে না বলে দিবি।ঠিক আছে তোর কি কোনো পছন্দের কেউ আছে তাহলে বল!আমরা তার সাথেই তোর বিয়ে দিবো।এভাবে কান্না কাটি করিস না প্লীজ! তোর চোখের পানি সহ্য করার ক্ষমতা আমাদের নেই রে মা!
রাইসা বেগম কিচেনে কাজ করতে ছিলেন।মেয়েকে এইভাবে বাড়িতে ঢুকতে দেখে তিনিও এগিয়ে এসে বললেন,
—- আমরা কি তোকে কখনো জোর করেছি?তুই শুধু একবার বল তোর পছন্দের ছেলের নাম টা আমরা আজই গিয়ে তার বাড়ি গিয়ে কথা বলে আসবো।তারপর কান্না করিস না মা!
আসলে কয়েকদিন আগে রিমির জন্য একটা ছেলে পছন্দ করেন আহসান সাহেব। ছেলের ছবি নিয়ে রিমিকে মতামত জানাতে বলেছেন।তাই উনারা ভাবছে ন রিমি সেইজন্য কান্না করছে।রিমি আজ তূর্যের দেখা করে ভেবেছিলো তূর্যের কথা বাবা-মাকে বলবে।কিন্তু তা আর বলতে পারলো কই তার আগেই তো তূর্য সব কিছু শেষ করে দিলো।তূর্যের সামনে তখন রাগ দেখালেও সারাপথে রিমি কাঁদতে কাঁদতে এসেছে।বাড়িতে এসেও কান্না আটকে রাখতে পারলো না।তূর্য যখন এমন একটা কাজ করতে পারলো তাহলে রিমি পারবে না কেন?চোখের পানি মুছে মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে বললো,
—– চোখে কি যেন পরেছিলো তাই চোখ থেকে পানি পরছিলো।আর বাবা তুমি যাকে আমার জন্য পছন্দ করেছো আমি তাকে বিয়ে করতে রাজি।
—- ভেবে বলছিস মা!
বিস্ময় নিয়ে বললো আহসান সাহেব। রিমি তার বিনিময়ে মাথা নেরে কোনোরকমে হ্যাঁ বলেই নিজের রুমের দিকে ছুটে চলে আসলো।রুমে এসেই বিছানার উপর ধপ করে শুয়ে একাধারে কাঁদতে লাগলো।
আমি আর রাতুল শপিং মলে এসেছি ঘন্টা খানিক।কিন্তু ওই বেটার একটা কিছুও পছন্দ হয়না।বুঝিনা এ কোন দিক দিয়ে ছেলে হলো?সব সময় দেখে এসেছি মেয়েরা বেশি বাছা বাছি করে কিন্তু ছেলেরাও যে এতো বাছাবাছি করতে পারে তা একে না দেখলে জানতে পারতাম না।আমি চারিদিকে চোখ বোলাতে বোলাতে হঠাৎ করে একটা জায়গায় গিয়ে থমকে যায়।আমি আমি হা করে সেইদিকে তাকিয়ে থাকি।
চলবে,,,,,,