#প্রেমের_সাতকাহন
#পর্ব_২৫(ধামাকা_১) 🥳
#সুমাইয়া_জাহান
কাল পর্যন্ত খুব কনফিডেন্স ছিলো কিন্তু আজ তার বিন্দু পরিমানও নেই আমার মাঝে। এখন শুধু ভয় নামক বস্তুটাই রয়েছে ঘিরে! ভিষণ ভয় করছে এখন!কি হবে আজ আমার সাথে? ঠিক থাকবে তো? নাকি সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে?আমি নীরের কথা না শুনে এই সিদ্ধান্ত টা নিয়ে অনেক বড়ো ভুল করলাম না তো?এসব ভাবতেই বারবার গলা শুকিয়ে আসছে।আরো এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে খেয়ে নিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে আছি আর ভাবছি কি থেকে কি হয়ে গেলো!
কাল বিকেলে রিমিদের ওখান থেকে এসে বাড়িতে ঢুকতেই সারপ্রাইজড হয়ে গেলাম।বাবা হাসি মুখে আমার দিকে একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে বললো,
—- মামনি তোমার জন্য একটা ছোট্ট সারপ্রাইজ!
আমিও খুশিমনে খাম টা নিলাম কিন্তু খামে যা ছিলো তা দেখে আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে।কারণ এটা আমার আর নীরের ডিভোর্স পেপার যেখানে নীরের সাইনও আছে।আমি খামের দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ রেখে খাম টা হাতে নিয়ে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম তখন বাবা আবারও বললেন,
—- কেমন দিলাম সারপ্রাইজ! মামনি তুমিও চটপট সাইন টা করে ফেলো।
—- নীর সত্যি সত্যি সাইন টা করে দিয়েছে?
খামের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বাবার দিকে অবাক নয়নে বললাম।বাবা আমার এমন আচরণ দেখে একটু অবাকই হলেন।অবাক নয়নেই বললেন,
—- কেনো মামনি এতে তুমি খুশি হওনি?তুমি তো নিজে ওই ছেলেটার থেকে মুক্তি চেয়েছো।তাহলে আজ কেন এমন করছো।এখনো কি ওর জন্য তোমার মধ্যে মায়া রয়ে গেছে।মামনি ও খারাপ ছেলে মুখোশের আড়ালে মাফিয়া গিরি করে।আমি নিশ্চয়ই এমন একটা ছেলের হাতে তোমাকে তুলে দিতে পাারিনা!তাই বলছি ওর জন্য সব মায়া ত্যাগ করে সাইন টা করে দেও।
এখন যদি বলি আমি সাইন না করি তাহলে বাবার মনে সন্দেহ হবে।নীর কেন এমন একটা কাজ করলো।তবে কি সেই শপিং মলের কথা গুলো সিরিয়াস ভাবে বলেছিলো?আমি মনে করেছিলাম রাতুল কে দেখানোর জন্য ওগুলো বলেছিলো।কেন করলো ডিভোর্স পেপারে সাইন?এর পিছনে কি কোনো কারণ আছে?তারপরও আমি ডিভোর্স পেপারে সাইন না করার জন্য অনেক অযুহাত দেওয়ার চেষ্টা করেছি কিন্তু কিছুতেই সাইন করাটা আটকাতে পারিনি।বাবা নানা রকম যুক্তি দিয়ে একপ্রকার জোর করেই আমাকে দিয়ে সাইন টা করিয়ে নিয়েছে।কাঁপা কাঁপা কাঁপা হাতে সাইন টা করেই দৌড়ে নিজর রুমে এসে পরলাম।নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলাম না।কান্নায় ফেটে পরলাম।আমি কি তাহলে আজ থেকে আর নীরের সাথে আমার সম্পর্ক টা শেষ?আজ থেকে কি আর আমি মিসেস তূবা চৌধুরী নেই!কেন করলো নীর এইটা তার উত্তর ওকে দিতেই হবে!চোখের পানি মুছে ফোন টা হাতে নিয়ে নীরের নাম্বারে ডায়াল করলাম।কিন্তু ওর নাম্বার বন্ধ! তাও বারবার ফোন করতে লাগলাম এই আশায় একবার যদি রিসিভ করে!কিন্তু না বারবার শুধু বন্ধই পেলাম।টানা দুই ঘন্টা যাবত পাগলের মতো ওর নাম্বার ফোন দিয়প গেছি।কিন্তু ওকে পাইনি।শুধু ওর ফোনেই না মামনীর ফোনে আবার বাড়ির ল্যান্ড লাইনেও দিয়েছি কিন্তু কোথাও ওর খোঁজ পাইনি।হঠাৎ করে কেন এমন করছে ও।এইতো সকালেও তো ওর সাথে কতো কথা হলো কই তখন তো কিছু বলেনি?তাহলে এখন কেন এমন করছে?ভাবতে ভাবতেই ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম।এইভাবে কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি বুঝতেই পারিনি।আমি বেলকনিতে ছিলাম যার দরুন সকালে সুর্যের আলো চোখে পরতেই ভোরের প্রথম প্রহরের জেগে উঠলাম।আড়মোড়া ভেঙ্গে রাতের কথা মনে পরতেই আবারও ফোন টা নিয়ে নীরকে কল দিলাম।প্রতিবারের মতো এবারও বন্ধই আসলো।তাও আরো কয়েকবার ট্রাই করলাম।হঠাৎই ভাইয়ুর কথা মনে৷ পরতেই চটজলদি উঠে পরলাম।নীর আর ভাইয়ু তো সব সময় যা করে একসাথেই করে। তাই ভাইয়ু হয়তো সব জানে!সেই আশায় ভাইয়ুর রুমের দিকে গেলাম।
ভাইয়ুর রুমে এসে ভাইয়ুকে না পেয়ে পুরো বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজলাম। কিন্তু কোথাও ভাইয়ুকে পেলাম না।পরে একজন সার্ভেন্টের থেকে জানতে পারি ভাইয়ু ভোর বেলাতেই কোথায় একটা বেরিয়েছে।তারপর ভাইয়ুকেও ফোন করলে ভাইয়ুকে ফোনে পাই না।কি হচ্ছে টা কি আমার সাথে? এতো গোলকধাঁধা মধ্যে কেন আমি?
দুই ঘন্টা পরই বাবা আমার রুমে আসলেন।
—- মামনি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নেও রাতুল রা ঘন্টা খানেকের মধ্যেই এসে পরবে।তারপরই বিয়ে!
বাবার কথাটা শুনে আমি আরো চমকে উঠলাম।
—- কিন্তু বাবা বিয়ে তো রাতে হওয়ার কথা ছিলো তাহলে এখন কেনো?
বাবা হাস্যজ্বল চেহারা নিয়ে আমার পাশে বসলেন।তারপর একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বলতে লাগলেন,
—- হুম মামনি রাতেই বিয়ে হওয়ার কথা!কিন্তু রঞ্জনের হঠাৎ করে কাজ পরে গেছে তাই আজ রাতের ফ্লাইটে ওকে যেতে হবে।তাই বিয়ের কাজটা রাতের বদলে এখনই সেরে ফেলতে চায়।ছেলের বিয়েতে বাবা না থাকলে কেমন দেখায় তাই আমিও ওদের কথায় রাজি হয়ে গেছি।মন খারাপ করো না মামনি রাতেই তো ও বাড়িতে চলে যেতা না হয় কয়েক ঘন্টা আগেই গেলা।আর ওরা কিন্তু এলেই বিয়ের কাজ শুরু হয়ে যাবে।তাই একটুও সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে যাও!
তারপর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বাবা চলে গেলেন।আমি তো এখনো ঘোরের মধ্যে আছি।হাতে কয়েক ঘন্টা যাও সময় ছিলো এখন ওরা তাও শেষ করে দিলো।কি করবো আমি এখন?আচ্ছা এগুলো সব ওই রঞ্জন লোকটাার প্লান না তো?সব কিছু ওই লোকটাই করলো না তো?এসব ভাবতে ভাবতেই হাতের শেষ চুড়িও পরে নিলাম।তারপর ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে উঠে একবার শাড়ির কুঁচি গুলো দেখে নিলাম ঠিক আছে কিনা!
আজও শাড়িই পরেছি তবে আজ নিজেই পরেছি।সেদিনের পর থেকে মামনীর কাছে শাড়ী পরার ট্রেনিং নিয়ে শাড়ি পরা শিখেছি।এখন নিজে নিজেই শাড়ি পরতে পারি।কিন্তু এখন কুঁচিতে গিয়ে আটকে যাই কোন দিক কুঁচি টা দিতে হয় তা বারবার ভুলে যাই।একটা অরেঞ্জ কালারের হালকা কাছের বেনারসি পরেছি।সঙ্গে হালকা পাতলা কিছু সাজ বলতে গেলে মোটামুটি হালকা পাতলা কনে সাজ।আমার বরাবরই হালকা জিনিস বেশি প্রিয়। তবে অরেঞ্জ কালার টা আমার মোটেও পছন্দের না। তাও কেন জানি আজ এই রঙয়ে নিজে মোড়াতে ইচ্ছে করছিলো।
হঠাৎ করেই একটা গাড়ির আওয়াজ কানে এলো এতে আরো বেশি চমকে উঠলাম।ওরা মনে হয় চলে এসেছে।এবার কি হবে?নীর বা ভাইয়ু কেউই তো নেই এখন!এরমধ্যেই কয়েকজন মেয়ে এসে আমাকে জোর করে নিচে নিয়ে গেলো।
💗💗
নিচের ঘরটাতেই বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে।এখানে তেমন কোনো মানুষ নেই ওদের পরিবারের কয়েকজন আর আমাদের বাড়ির লোকেরা।সেইবার যেই কাজী লোকটা বিয়েতে এসেছিলো আজও সেই লোকটাই এসেছে।আমাকে নিচে নামতে দেখে কাজী লোকটা বলে উঠলেন,
—- মা এখানে এসে বরের পাশে বসো।বিয়ের কাজ শুরু করতে হবে!
নাহ্ আর চুপ থাকা যাবে না!এখনো যদি আমি চুপ থাকি তাহলে তো আমি অন্য কারো বউ হয়ে যাবো।আমি শুধু মাত্র আমার নীরেরই বউ হতে চাই আর কারো না!আমাকে ধরে রাখা মেয়ে গুলোর থেকে জারা মেরে হাত সরিয়ে নিয়ে জোরে চিৎকার মেরে বললাম,
—– কিসের বিয়ের কাজ? এখানে কোনো বিয়ের হবে না!সবাই চলে যান এখান থেকে!
আমার এমন আকস্মিক কাজে সবাই হতবাক হয়ে গেছে।যে যার জায়গায় কথেকে দাড়িয়ে আমার দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে।সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছে বাবা।তাই বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—– কি বলছো মামনি এসব?তুমি ঠিক আছো তো
—- বাবা আমি ঠিকই বলছি।আর আমি একদম ঠিক আছি।কথাটা আমার আরো অনেক আগেই বলা উচিৎ ছিলো তাহলে আর জল এতো দূর গড়াতো না।বাবা তুমি কি জানো ওই রঞ্জন নামের লোকটা আমাকে তার ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে তোমার সব সম্পত্তি দখল করার চেষ্টা করছে।এরজন্য ওই লোকটা আমার মাকেও খুন করেছে এমনকি দাদা দাদুকেও!
চোখ মুখ শক্ত করে এক শ্বাসে কথা গুলো বলে একটা শ্বাস নিলাম।আমার কথা শুনে বাবা মুহুর্তে মুখটাকে গম্ভীর করে বললেন,
—– মামনি তুমি কিছু জানো না তাই এসব নিয়ে কথা বলো না।রঞ্জন তোমার গুরুজন হয় তাই সম্মান দিয়ে কথা বলো মামনি!
একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম,
—- সম্মান আর উনি?যার পাপের কোনো সীমানা নাই তাকে তুমি সম্মান দিতে বলছো বাবা?যে তোমার পরিবার কে ধ্বংস করার চেয়েছে এবং করেছে তাকে তুমি সম্মান দিতে বলছো?আর যারা নিরস্বার্থ ভাবে তোমার পরিবারের পাশে ছিলো সারাজীবন তাদের তুমি অপরাধী বানিয়ে দিলে এক বিশ্বাসঘাতকের কথায়?তুমি জানো না বাবা আসল অপরাধী এই লোকটাই।আশরাফ আংকেল সম্পুর্ন নির্দোষ ছিলেন!
আঙুল দিয়ে রঞ্জন কে দেখিয়ে দিয়ে কথাটা বললাম।রঞ্জন এবার হাই তুলতে তুলতে বললো,
—- বাপ বেটির অনেক নাটক দেখেছি এবার চুপ চাপ বিয়ে করতে বসে পর!এটাই তোর জন্য এখন মঙ্গল! ওই পোলার সাথে থেকে থেকে বেশি চালাক হয়ে গেছিস!
বাবা রঞ্জনের কথা শুনে প্রচন্ড অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
—- রঞ্জন!!!!!
শান্ত ভঙ্গিতে সোফায় পায়ের উপর পা তুলে রঞ্জন বললো,
—– আরে ভাইজান আর কিছুক্ষণ পর তো এমনিতেই পর্দা সরে যেতো!না হয় আপনার এই অতিচালাক মাইয়া একটু আগেই পর্দাটা উঠাইয়া দিলো!হো ভাইজান আপনার এই মাইয়া যা বলতেছে সবই সত্যি! সব কিছুর পিছনে আমিই ছিলাম।নেহাৎ আপনার অর্ধেক সম্পত্তি আপনার এই মাইয়া নামে লেইখা দিছেন যে ওরে বিয়া করবো সে সম্পত্তির মালিক হইবো। তাই এতো মেহনত কইরা আমার পোলার লগে ওর বিয়ার ব্যবস্থা করছি।নাইলে কবেই আপনার ওই সম্পত্তি নিজের নামে কইরা নিতাম।
—- আপনি বললেই আমি বিয়ে করতে বসে যাবো ভাবলেন কি করে?
তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম আমি। তখন রঞ্জন একটা লোককে ইশারা করলো।তারপর লোকটা গিয়ে পিছন থেকে বাবার মাথায় পিস্তল ঠেকালো।এতে বাবাসহ আমি চমকে উঠলাম।রঞ্জন এবার বাঁকা হাসি দিয়ে বললো,
—- এইবার বসবি তো?নাকি বাকি সবার মতো বাবাও লাশ দেখতে চাস?
—– না না না বাবাকে কিছু করবেন না প্লীজ!
কাঁদতে কাঁদতে বললাম আমি।সাথে সাথেই পাস থেকে জোর গলায় বাবা বলে উঠলেন,
—- মামনি আমার যা খুশি হয়ে যাক তুমি কিছুতেই ওর মতো নরপশুর কথা শুবে না!মামনি পালিয়ে যাও এখান থেকে!
—- তো কি তূবা মনি কি সিদ্ধান্ত নিলা আমার কথা শুনবা নাকি বাবার লাশ দেখবা!
কথাটা বলে বিশ্রী এক হাসিতে ফেটে পরলো রঞ্জন।আর যাইহোক একটা মেয়ে বাবার এমন অবস্থায় কখনো দেখতে পারবে না।আমি তেমনই নিজের কথা ভেবে বাবাকে চিরতরে হারাতে চাই না।একবার মাকে হারিয়েছি কিন্তু বাবাকে আর হারাতে চাই না।পরের কথা পরে ভাবা যাবে কিন্তু এখন এই লোকটার কথা শোনা ছাড়া কিচ্ছুটি করার নেই।যেই হাতে কাল ডিভোর্স পেপারে সাইন করেছি সেই হাতে দিয়ে আজ আবার কাবিননামাও সাইন টা করলাম।নীর কি জানে আজ থেকে আমি আর তার নেই!কোথায় আছে নীর তার তূবা যে অন্য কারো হয়ে গেলো!
চলবে,,,,,,,