নিভৃতে যতনে পর্ব-২০+২১

0
1049

#নিভৃতে_যতনে
#Part_20
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

— আপনাকে দেখলে আমার কি মনে হয় যানেন? ছ্যাঁকা খাওয়া বিরহ প্রেমিক। মানে দেবদাসকেও হার মানাবেন আপনি। আচ্ছা আসলেই ছ্যাঁকা ট্যাকা খেয়েছেন নাকি?

শেষের কথাটা কৌতুকের সুরেই বললাম। কথাটা শুনে উনি ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দেন,

— হ্যাঁ খেয়েছি।

তাঁর এই এহেন স্বীকারোক্তি আমার কর্ণধার পর্যন্ত পৌঁছানো মাএ তা বজ্রপাতের ন্যায় প্রতিধ্বনিত হলো। পা যুগল স্থির হয়ে আসলো, চোখে মুখে ফুটে উঠলো অপার বিস্ময়। অধর দুইটির মাঝে সৃষ্টি হলো কিঞ্চিৎ দূরত্ব। বুকের বা পাশটা হুড়হুড় করে মুচড়ে উঠলো। বিষয়টা যে মোটেও আমার বোধগম্য ছিল না তা আমার চেহেরা দেখে সাফ বুঝা যাচ্ছে। আমি কথাটা নিচক ফাজলামো করে বলেছিলাম। এইটা যে বাস্তব হয়ে দাঁড়াবে তা মোটেও আশা করিনি। আমি স্তম্ভিত চাহনিতে রোয়েনের দিকে তাকিয়ে আছি। কিছু দূর যেতেই রোয়েন ঘাড় ঘুরিয়ে পিছে তাকালো৷ আমাকে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে এলো তার। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চার-পাঁচ কদম আমার দিকে এগিয়ে আসলো। শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

— কোন সমস্যা?

আমি কিছু না বলে আড়ষ্ট নয়নে তাঁর পানে তাকিয়ে থাকলাম। জোৎস্নার স্নিগ্ধ আলো হুমড়ি খেয়ে পড়ছে তাঁর উপর। সেই আলোয় তার মুখশ্রীর মুখভঙ্গি আমার নিকট স্পষ্ট। অতি ভাবলেশহীন তাঁর আকার ভঙ্গি। যেন কিছুই হয়নি। অথচ এইদিকে আমার মনের ভিতর দিয়ে বয়ে চলেছে ঝড়। আমাকে এইভাবে চুপ থাকতে দেখে রোয়েন আবার বলে উঠলেন,

— কি হলো?

এইবার আমি নিজেকে একটু স্বাভাবিক করলাম। বিষয়টার সত্যতা যাচাই করার জন্য রোয়েনকে জিজ্ঞেস করলাম,

— আসলেই কি তা সত্যি?

আমার প্রশ্ন শোনার পর রোয়েনের ভ্রুকুটি আরও কুঞ্চিত হয়ে আসলো। তাঁর অদ্ভুত দুইটি নয়নে ফুটে উঠলো একটুখানি বিভ্রান্তি। যা আমার নিকট স্পষ্ট। উনি সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,

— কোনটা সত্যি?

আমি অতি শীতল কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,

— ছ্যাঁকা খাওয়ার বিষয়টা?

কথাটা শোনার পর তার নয়নে বিদ্যমান বিভ্রান্তি দূর হলো। এক হয়ে আসা ভ্রুকুটি নিজ স্থানে ফিরে এলো৷ উনি শীতল চাহনি আমার উপর নিক্ষেপ করে পুনরায় স্বীকারোক্তি করলেন,

— হ্যাঁ।

তার স্বীকারোক্তিটি যেন আমার মধ্যে বিষন্নতা বয়ে আনে। বুকের কোন এক পাশে তীব্র ব্যথা অনুভব হলো। রোয়েন ছ্যাঁকা খেয়েছে, তাঁর আগে একটা রিলেশন ছিল, উনিও একদা কাউকে ভালোবাসতো কথাগুলো ভাবনার মাঝে আসতেই আমার মন বারংবার বিষিয়ে যাচ্ছে। আমার এমন অনুভূতি হওয়ার কারণ আমি জানি না। না আমি রোয়েনের প্রতি দূর্বল, না আমি তাঁকে ভালোবাসি। তাও আমার এমন অনুভূতি কেন হচ্ছে জানি না। শুধু জানি কোন এক চাপা কষ্ট আমায় তীব্রভাবে ঝাঁকড়ে ধরেছে। আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্থির করলাম। নিজেই নিজেকে বুঝ দিতে থাকলাম যে, ” সবারই একটা পার্সোনাল লাইফ আছে, প্রাইভেসি আছে। সেই সাথে একটা অতীতও আছে। অতীতটা হতে পারে তিক্ত অথবা সিক্ত। কিন্তু এর উপরে একটা সত্য হলো সেটা অতীত। যার এখন কোন অস্তিত্ব নেই। যেটা এখন একমাত্র সত্য তা হচ্ছে বর্তমান। আর এইভাবেও এখনকার দিনে রিলেশন করাটা কমন বিষয়। তাই এইটা স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।”

কথাগুলো আমার মস্তিষ্ক বিচরণ করতেই আমি শান্ত হয়ে যাই। মুখে ঝুলিয়ে নেই সরু হাসির রেখা। হঠাৎ মনের মাঝে একটা প্রশ্ন আসতেই আমি রোয়েনের দিকে তাকিয়ে শীতল কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,

— যদি কিছু না মনে করেন তাহলে একটা প্রশ্ন করতে চাই। চিন্তা নেই আপনার ব্রেকাপের কারণ জিজ্ঞেস করবো না। আমি শুধু জানতে চাই, আপনি কি ব্রেকাপের পরই এমন হয়ে গিয়েছিলেন?

রোয়েন আমার কথা শুনে স্থির চোখে তাকায়। স্বাভাবিক গলায় বলেন,

— আরেহ না! আমি ছোট থেকেই এমন। বলতে পারো ছোট থেকেই ইন্ট্রোভার্ট বা অন্তর্মুখী। আর এর পিছে স্পেসিফিক কোন কারণ নেই৷ আর রইলো আমার ব্রেকাপের কথা। সেটা এমন কোন বিষয় নেই যে প্রশ্ন করা যাবে না বা নিষেধাজ্ঞা আছে।

আমি মিনমিনে গলায় বলি,

— তো বলুন।

রোয়েন দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,

— ভার্সিটিতে পড়াকালীন বছর খানিক প্রেম ছিল। পরে একটা সময় এসে সে তিক্ত হয়ে উঠে এবং আমাকে জানিয়ে দে সে আর রিলেশন রাখতে চায় না৷

আমি কথার মাঝে ফোড়ন দিয়ে জিজ্ঞেস করি,

— কারণ?

— কারণ এইটাই আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে আর আমার বাবা গ্রামের স্কুলের সাধারণ একজন হেডমাস্টার। আমার সাথে তার লাইফ সিকিউর না। এই সম্পর্কের কোন নিশ্চিয়তা নেই। সব শুনে আমিও আর সম্পর্কটা ধরে রাখিনি। ব্যাস! হয়ে গেলো ব্রেকাপ।

— আর খোঁজ করেন নি?

— দরকার বোধ করি নি। কিন্তু পরবর্তীতে এক কমন ফ্রেন্ডের মাধ্যমে জানতে পেরেছিলাম যে,তার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে বিয়েও। বর প্রবাসী। অবস্থা ভালো। বিয়ের পর তাকেও বিদেশ নিয়ে যাবে। লাইফ একদম সেট। এইতো!

আমি বেশ কৌতহল নিয়ে জিজ্ঞেস করি,

— বিয়েটা কি আদৌ হয়েছিল?

উনি ভাবলেশহীন ভাবে বলেন,

— শুনেছিলাম তো হয়েছিল। বাকি আর জানি না।

— অহ আচ্ছা।

এরপর নিরবতা। কথা নেই কারো মুখে। কেটে যায় কিছু প্রহর। জোৎস্নার আলো গলিয়ে পড়তে থাকে ভূপৃষ্ঠের বুকে। স্নিগ্ধ পরশে ভরিয়ে দিতে থাকে আমাদের৷ আমি তাকিয়ে আছি রোয়েনের দিকে আর উনি তাকিয়ে আছে আকাশের পানে। পরিবেশটা যেন স্বাভাবিক হয়েও অস্বাভাবিক। আমার খুব করে ইচ্ছে হলো তাকে জিজ্ঞেস করতে,

— সে কি আপনার আবেগ ছিল নাকি ভালোবাসা?

কিন্তু মনের সংশয় আর আড়ষ্টতার জন্য প্রশ্নটা আর করা হলো না। প্রশ্নটা বেরিয়ে এলো দীর্ঘ নিঃশ্বাস হয়ে। রাতের অন্ধকার প্রগাঢ় হওয়ার সাথে সাথে হিম বায়ুর আনাগোনা বেড়ে যায়। যা ক্ষণেই গায়ের পশম দাঁড় করিয়ে দেয়। মৃদু কাঁপন ধরে যায় শরীরে। আমি গায়ের ওড়নাটা ভালো ভাবে জড়িয়ে নিয়ে নিজেকে একটু গুটিয়ে নিতেই রোয়েন বলে উঠেন,

— রাত হয়েছে অনেক। এখন ফিরা উচিৎ।

আমিও তার কথায় সাই জানালাম। পাশাপাশি দুইজনই রওনা দিলাম রিজোর্টের উদ্দেশ্যে। আমার শরীরের কাঁপনটা স্পষ্ট হয়ে আসতেই রোয়েন একটা টু শব্দও না করে তার গায়ের জ্যাকেটটা খুলে পিছন থেকে আমার গায়ে জড়িয়ে দেয়। এরপর নির্বোধ ভাবে হাটতে থাকে। ঘটনাক্রমে বুঝে উঠতেই আমার ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে স্নিগ্ধ হাসি। আমি গায়ে জ্যাকেটটা ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে আনমনে ভাবি,

— হোক না মানুষটি নিভৃতে গড়া, নির্মল প্রেমিক তো সে আমারই।

_______________________

চারদিকটা এখনো অন্ধকারে আছন্ন। ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই। হয়তো মিনিট পাঁচেকের মাঝেই রক্তিম এক গোলপিন্ডের দেখা মিলবে। হিম হিম ভাব চারদিকে। গোটা শহর এখনো কুয়াশায় ঘেরা। আমি কাঁথা মুড়ি দিয়ে শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছি। বেশ কিছুক্ষণ পর এক পুরুষালী কন্ঠ এসে বারি খায়। কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে। নিজের নাম শ্রবণ হতেই মস্তিষ্ক সচল হয়ে উঠে। সজাগ হই আমি। নিভু নিভু চোখে সামনে তাকাতেই বুঝতে পারি কেউ আমাকে মৃদু পরিমাণে ধাক্কাচ্ছে। সাথে সাথে আমার ঘুম উবে যায়। আমি উঠে বসি। সামনে তাকাতেই দেখি রোয়েন দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে তার গম্ভীরতা। আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই তিনি স্বগতোক্তি কন্ঠে বলে উঠেন,

— তারাতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এসো। বাইরে যাব আমরা।

আমি একবার কিছু বলতে গিয়েও বললাম না। বালিশের পাশ থেকে ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে ঢুলুঢুলু পায়ে এগিয়ে গেলাম ওয়াশরুমের। ফ্রেশ হয়ে আসতে না আসতেই রোয়েন বলে উঠেন,

— গায়ে মোটা কিছু জড়িয়ে নাও। বেশ ঠান্ডা বাইরে।

আমি তার কথা মত গায়ে একটা শাল জড়িয়ে নেই। অতঃপর উনার সামনে আসতেই আমার হাতের কব্জি ধরে বাইরে নিয়ে আসে। বাইরে আসতেই দেখতে পাই চারদিক ঘন কুয়াশায় ঘেরা। কোথাও কিছু দেখা যাচ্ছে না। এমনকি রোয়েনের পিছন দিকটাও আমার কাছে আবছা লাগছে। মাত্র আঁধার কাটছে। পুবাকাশে দেখা যাচ্ছে সরু আলোর রেখা। বুঝাই যাচ্ছে সূর্য উঠার সময় হয়ে গিয়েছে। হয়তো কয়েক প্রহর পেরুতেই গোল আকৃতির সূর্যটির দেখা মিলবে। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর রোয়েন আমায় নিয়ে এক উঁচু জায়গায় এসে স্থির হয়। আমি তার দিকে কৌতহলী চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি,

— আমরা এইখানে কেন এসেছি?

সে একটু নরম গলায় বলে,

— এখনই দেখতে পাবে। তুমি শুধু চুপচাপ সামনের দিকে তাকিয়ে থাকো।

আমি তার কথা মত তাকিয়ে রইলাম সামনের দিকে। খানিক বাদেই দেখা গেল, দূর পাহাড়ের ঘেষে বেরিয়ে আসছে সূর্যের রক্তিম লালচে আভা। যা মুহূর্তেই প্রগাঢ় নীল আকাশে ছড়িয়ে দিচ্ছে স্নিগ্ধতার ছোঁয়া। পাহাড় আর গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে সূর্য্যিমামা। সবুজের মাঝে লালাভ রক্তিম এক চাহনি। আমি মনোমুগ্ধ হয়ে দৃশ্যটা যখন দেখছি ঠিক তখনই রোয়েন আমার পিছে এসে দাঁড়ান। কিছু বুঝে উঠার আগেই উনি আমার সাথে ঘেষে দাঁড়ান এবং আমার ডান হাতটা চেপে ধরে উর্ধ্বে তা উপরে তুলে ধরেন। ঘটনাক্রমে আমি ভড়কে গেলেও হঠাৎ অনুভব করি শৈত্য কণার মত কিছু একটা আমার হাতের তর্জনী ছুঁয়ে যাচ্ছে। যা মুহূর্তেই গলে গিয়ে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে আমার হাতের তর্জনী আর তালু। সাথে সাথে আমি শিউরি উঠি। হাত সরিয়ে আনতে নিলে রোয়েন আমার কানের সামনে ফিসফিসিয়ে বলে,

— ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এইগুলো মেঘ।

কথাটা কর্ণপাত হতেই আমি বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছি শুধু সামনে। মুখের ভাষাই যেন হারিয়ে ফেলেছি। নিজের জ্ঞান শক্তি পর্যন্ত যেন লোপ পেয়ে বসে আছি। ঘোরের মধ্যে চলে যেতে থাকি আমি। মেঘদলের উপরে হাসছে সূর্য। রোদ ঠিকরে পড়ছে মেঘের গায়ে। এ যেন অপরুপ দৃশ্য। দ্বিতীয় বারের মত মেঘ আমার হাতের তর্জনী স্পর্শ করতেই ঘোর থেকে বেরিয়ে আসি আমি। খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাই। একের পর এক মেঘের গায়ে আঁচড় কেটে লিখতে থাকি আমার নাম। মোহনীয় দৃষ্টিতে দেখতে থাকি শুভ্র মেঘে রাঙ্গা পরিবেশ।

#চলবে

#নিভৃতে_যতনে
#Part_21
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

নীলাভ আকাশে ছড়িয়ে আছে সোনালী রৌদ্দুরের আলতো ছোঁয়া। সবুজ পাহাড়ের ধার ঘেষে দূর-দিগন্তে ছুটে চলেছে পেঁজো পেঁজো মেঘ। বাতাসে চষে বেড়াচ্ছে পাহাড়ি বুনোফুলের গন্ধ। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে গায়ে রোদ মাখছি আর চুলগুলো চিরুনী করছি৷ চোখের সামনে এখনো ভাসছে মেঘালয় সূর্যোদয়ের সেই দৃশ্য। অনুভূতিগুলো কড়া নাড়তে ভিতরটা বার বার শিহরণ দিয়ে উঠছে। মেঘ তো নয় এ যেন হাওয়াই মিঠাই। আলতো হাতে ছুঁয়ে দিতেই মিইয়ে যাচ্ছিল মূহুর্তেই। জলীয়বাষ্প হয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছিল হাতের তর্জনীসহ আরও অঙ্গ। উফফ! সে কি যে অনুভূতি। রোয়েন আজ আমায় যে অনুভূতির সাথে অবগত করিয়েছে তা ভুলার মত নয়। এর জন্য তাকে হাজার শুকরিয়া দিয়েও স্থির হওয়া যাবে না। আমি চিরুনী করা শেষে রুমে এসে পড়ি। ব্যাগ থেকে শুভ্র রঙ্গের একটা কামিজ বের করে তা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নেই। আমি যখন প্রায় তৈরি তখন রোয়েন রুমে এসে হাজির হন। আমি রুমে তাঁর অস্তিত্ব অনুভব করতে পেরে পিছে ঘুরে দাঁড়াই। তাঁকে দেখেই আমি সৌজন্যমূলক এক হাসি উপহার দেই। উনি একবার আমাকে ভালো মত পরক্ষ করে নিয়ে আমার দিকে ভ্রুকুঞ্চন দৃষ্টিতে তাকান। কিছু প্রহর অতিক্রম হতেই সে গম্ভীর গলায় বলে উঠেন,

— যাও চেঞ্জ করে আসো।

কথাটা শ্রবণ হওয়া মাত্র আমার হাসি মিইয়ে যায়। নয়ন যুগলে ফুটে উঠে বিস্ময়। আমি অস্ফুটস্বরে জিজ্ঞেস করি,

— কেন?

তিনি অকপটে জবাব দেন,

— আমি বলছি তাই৷

— কিন্তু এই ড্রেসে সমস্যা কোথায়? আমাকে কি বাজে লাগছে এই ড্রেসে?

উনি কিছু না বলে বেশ কিছুক্ষণ আমার মুখ পানে তাকিয়ে থেকে ধীর পায়ে আমার দিকে এগিয়ে আসেন। তিনি আমার একদম কাছে চলে আসতেই আমি আড়ষ্টতায় এক কদম পিছিয়ে যাই। উনি আমার দিকে একটু ঝুঁকে আমার কানের পাশে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলে,

— সে রঙকে প্রাণ দেয়, রঙ তাকে নয়।

কথাটা বলেই তিনি দুই কদম পিছিয়ে যান আর আমি কথাটার অর্থ বুঝতে না পেরে বেশ কিছুক্ষণ তাঁর দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। অতঃপর কথাটার অর্থ বোধগম্য হতেই আমি স্থির হয়ে যাই। কিছু প্রহর পেরুতেই আমার চর্বিযুক্ত গাল দুইটির মাঝে ফুটে উঠে লালাভ আভা৷ কেউ যে এইভাবেও কারো প্রশংসা করতে পারে তা হয়তো রোয়েনকে না দেখলে জানাই হতো না। তাঁর প্রশংসাও লুকানো কথার ভাঁজে। আমি যখন নিজের গায়ে লজ্জার চাদর মোড়াতে ব্যস্ত ঠিক তখনই রোয়েন নরম সুরে বলে উঠেন,

— চেঞ্জ করে কিন্তু গাঢ় রঙের ড্রেস পড়বে৷ শুভ্র রঙগুলো পাহাড়ের চূড়ায় মানায়, পাহাড়ের গহীনে নয়।

কথা বলেই সে রুম থেকে বেরিয়ে যান। বস্তুত, কথাটা আমার বোধগম্য না হলেও আমি রোয়েনের কথাটা ফেললাম না। চুপচাপ ড্রেস চেঞ্জ করে নিলাম। কেন না এতদিনে যতটুকু তাকে চিনেছি,বুঝেছি উনি কখনোই কোন কথা এইভাবে বলেন না। এর আড়ালে কোন এক পাকাপোক্ত কারণ অবশ্যই থাকে।

______________________

সকালের নাস্তা সাবাড় করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম কংলাক ঝর্ণার উদ্দেশ্যে। হ্যালিপেড পাহাড়ে যাওয়ার পথে ঠিক ডান দিকে নেমে গিয়েছে একটি ঢাল৷ সেই ঢালের শেষ প্রান্তেই অবস্থিত কংলাক ঝর্ণা। প্রথমে ইট সিমেন্টে বাঁধানো পাকা রাস্তা হলেও পরবর্তীতে জঙ্গলের ভিতরে প্রবেশ করতেই কাঁচা মাটির সরু রাস্তার দেখা যায়। জঙ্গলের এই সরু পথের ধার ঘেঁষে গতানুগতিক নিচের দিকে হেটে চলেছি আমরা। আমাদের পথ নির্দেশনা দেওয়ার জন্য সামনেই আছে একজন গাইড। তাকেই অনুসরণ করে হেটে চলেছি আমরা৷ সংখ্যায় আমরা খুব বেশি নই। বিশ থেকে ত্রিশজন বৈকি। বেশির ভাগ সকলেই যুবক-যুবতী আর নবদম্পতি। মধ্যবয়স্ক কেউ নেই বললেই চলে। এর মুখ্য কারণ কংলাক ঝর্ণা পর্যন্ত যাওয়া পথটি খুব কষ্টকর। তাই এইখানকার এলাকাবাসী পরামর্শ দেয়, হার্টের রোগী বা দূর্বল প্রকৃতি লোকেরা যাতে এই পথ পারি দেওয়ার চেষ্টা না করে। এতে দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। তো সেই ভয়ে বেশিরভাগ মানুষই কংলাক ঝর্ণা যাওয়ার জন্য নাকচ করে দেন আর থেকে যান রিসোর্টে। সরু পথের দুইধারে ঘন জঙ্গল। নাম না জানা অসংখ্য ঝোপঝাড়, লতাপাতা দিয়ে পরিপূর্ণ পরিবেশ। উপরে তাকালেই দেখা যায় আকাশ জুড়ে বিস্তৃত সবুজ রাঙ্গা প্রলেপ আর সেই প্রলেপ ভেদ করেই ভূপৃষ্ঠের মাটি ছুঁয়ে দিচ্ছে টুকরো টুকরো রোদ। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে বাহারি ফুলের সুবাস। আহা কি মনোরম পরিবেশ। আমি ডান হাতে বাঁশ নিয়ে গটগট করে নিচের দিকে নেমে চলেছি। যেহেতু পাহাড়ি পথ সেহেতু নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য সকলের হাতেই একটি করে বাঁশ। আমার পাশেই রোয়েন ভাবলেশহীন ভাবে হেটে চলেছেন। আমি নামছি আর আড়চোখে তাঁকে পর্যবেক্ষণ করছি৷ কাঁধে ছোট একটি ব্যাগ ঝুলানো। গায়ে ব্লু কালার টি-শার্ট আর ব্ল্যাক ট্রাউজার। লম্বা হয়ে আসা চুলগুলো কপালে এসে পড়েছে। মাঝে মধ্যে তার উপর দিয়ে সোনালী রোদেরা খেলা করে যেতেই তার মুখশ্রীতে উপচে পড়ছে মায়া। আমি নিজের চোখ সরিয়ে নিয়ে মনে মনে বলি,

— এই মায়াজালে না জানি আমি কবে আটকা পড়ে যাই৷

______________________

প্রায় চল্লিশ মিনিট হাটার পর যখন আমরা চোরাবালির পথটা অতিক্রম করি ঠিক তখনই কানে ভেসে আসে পানির থৈ থৈ শব্দ। পদচারণ করার সাথে সাথে প্রগাঢ় হয়ে আসছে ঝর্ণার ডাক। সকলের কর্ণধারে এই মধুর ধ্বনি পৌঁছাতেই সকলের মন যেন পুলকিত হয়ে যায়। নিমিষেই সকল ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। হারিয়ে যাওয়া জোশ ফিরে আসে আর দ্রুত হয় পায়ের গতি। মাত্র পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে আমরা গিয়ে পৌঁছাই কংলাক ঝর্ণায়। বিস্তৃত সবুজ পাহাড়ের বুক চিরে গড়িয়ে পড়ছে স্বচ্ছ জলের ধারা। যা ক্ষণে ক্ষণে তুলছে তীব্র ঝংকার৷ বড় বড় পাথরের বুকে আঁচড়ে পড়ে তৈরি করছে স্রোতধারা৷ এঁকেবেঁকে যাওয়া পথকে বানিয়ে নিচ্ছে নিজের রাস্তা। ঝর্ণার দেখা মিলতেই যুবকরা হামলে পড়ে সেখানে। গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে যায় স্বচ্ছ পানির ধারায়। ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় আরও অনেকে। যোগ দেয় যুবতীর দল। ক্ষণেই প্রকৃতির হাক মিলিয়ে যায় কয়েক জোড়া উৎফুল্ল কন্ঠের মাঝে। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে হৈ-হুল্লোড়ের নিরুক্ত শব্দ। আমি নিজের পায়ের জুতো জোড়া খুলে খুব আলতো ভাবে স্বচ্ছ পানির স্রোতে নিজের পা ডুবিয়ে দেই। অতি শীতল এর ছোঁয়া। যা ক্ষণেই সর্বাঙ্গে কাঁপন সৃষ্টি করে দিচ্ছে৷ আমি একটু সামনে এগোতে নিলেই কেউ আমার হাত আলতো ভাবে চেপে ধরে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে পিছে তাকায়েই দেখি রোয়েন মুখ চোখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তার দিকে কৌতহল দৃষ্টিতে তাকাতেই উনি শীতল কণ্ঠে বলে উঠেন,

— এখন না।

কথাটা বোধগম্য হতেই আমি তাঁর দিকে গোলগাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি,

— কিন্তু কেন?

— সামনে তাকাও বুঝে যাবে।

আমি রোয়েনের কথা মত সামনে তাকিয়ে সকলকে দেখতে থাকি। সকলে মিলে একদম গাদাগাদি পরিবেশ। কেউ কেউ ছবি তুলছে তো কেউ পানির নিচে দাঁড়িয়ে নিজেকে ঠান্ডা করছে। কেউ বা এদিক সেদিক সাঁতার কাটছে। কোথাও বিন্দু মাত্র জায়গায় নেই। তার উপর মেয়েদের চেয়ে ছেলের সংখ্যাই বেশি। এখন এদের মাঝে গেলে হয়তো অপ্রীতিকর কিছু ঘটতেও পারে। কথাটা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে আমার। আমি দমে গিয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়াতেই রোয়েন আমায় টেনে নিয়ে এসে একটা পাথরের উপর এসে বসে। আমিও স্থির হয়ে তার পাশে বসে থাকি৷ বেশ কিছু প্রহর অতিক্রম হতেই হঠাৎ টনক নাড়ে,” প্রকৃতির এত গহীনে এসেও কি এর স্বাদ নিবো না?” আমি রোয়েনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি,

— তাহলে আমাদের এইখানে আসাটাই কি বৃথা?

রোয়েন শীতল কন্ঠেই বলে,

— চুপচাপ বসে থাকো।

আমি আর কিছু না বলে গাল ফুলিয়ে বসে থাকি। ঝর্ণার এত কাছে এসে বলে একে একটু ছুঁয়েও দেখতে পারবো না। এইটা কোন কথা? আমার দুঃখে কষ্টে এই খাটাশ ব্যাটার মাথার ফাটাতে ইচ্ছে হচ্ছে। ঝর্ণার ধারেই যদি যেতে না পারি তাহলে এতটা পথ পারি দিয়ে আসার মানে কি? হুহ! আমি অসহায় চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ চোখ চলে যায় ঝর্ণার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু মেয়ের দিকে। গায়ে তাদের হালকা জমিন রঙ্গের জামা। পানিতে ভেজার ফলে গায়ের সাথে তাদের জামা লেপ্টে আছে যা দেখতে বরাবরই আপত্তিকর লাগছে৷ আমি পাশে চোখ ঘুরিয়ে নিতেই দেখি কিছু ছেলে এই মেয়েদের দিকে কেমন অপ্রীতিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দৃশ্যটা দেখা মাত্র আমার গা ঘিন ঘিন করে উঠে। আমি মুখ ঘুরিয়ে নিতেই ক্ষণেই সকালের ঘটনাটা আমার মস্তিষ্কে টনক নাড়ে৷ ধীরে ধীরে রোয়েনের হালকা রঙ পড়ার নিষেধাজ্ঞা জারি করার ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে আসে। আমি চটজলদি রোয়েনের দিকে তাকাতেই দেখি রোয়েন নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে আকাশের পানে তাকিয়ে আছে। তা দেখা মাত্র ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে প্রশস্ত হাসি। মনে মনে বলে উঠি,

— চাই না আমি প্রকৃতির স্বাদ, শুধু চাই তাঁর এই হাত।

___________________

বেশ কিছু প্রহর অতিবাহিত হতেই একেক করে সকলেই পানি থেকে বেরিয়ে আসে। যে যার মত গা থেকে ভেজা পোশাক ছাড়িয়ে নিয়ে শুকনো পোশাক পড়ে নেয়। এর মাঝে তাঁরা পানিতে থাকাকালীন অনেকেই আমাদের পানিতে নামতে বলেন এবং তাদের সাথে যোগ দিতে বলেন। কিন্তু রোয়েন প্রতিবারই খুব সুন্দরভাবে নাকচ করে কথা কাটিয়ে গিয়েছেন। অতঃপর আর কেউ আসেও নি। কিছুক্ষণের মাঝেই সকলে আবার ফিরে যাওয়ার জন্য রওনা হয়। আমিও রওনা হওয়ার জন্য নামতেই রোয়েন আমার হাত চেপে ধরে। নিজের ব্যাগ পাথরের উপর রেখে ছোট করে বলে,

— আসো আমার সাথে।

কথাটা বলে আমার হাত শক্ত করে ধরে নিয়ে যায় ঝর্ণার কাছে। আমি চারদিকে চোখ বুলাতেই দেখি এইদিকটা এখন প্রায় মানবশূন্য। কাউকে তেমন চোখে পড়ছে না। আমি রোয়েনকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাব তার আগেই উনি বলে উঠেন,

— নীরব পরিবেশেই নির্মল প্রকৃতির আসল স্বাদ পাওয়া যায়।

কথাটা বলেই তিনি আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরলেন। জায়গাটা পিচ্ছিল হাওয়ায় হয়তো তিনি আমার পরে যাওয়া নিয়ে চিন্তিত। তাইতো আমার হাত তিনি এইভাবে শক্ত করে ধরে রেখেছেন। আমি তাঁর চোখের দিকে তাকাতেই তিনি তাঁর নয়ন যুগল দিয়ে আমায় ইশারা করলেন ঝর্ণার মাঝে গিয়ে দাঁড়াতেই। কথাটা বুঝতে দেরি হলেও কর্মে দেরি নেই। ঝর্ণাধারার মধ্যে দাঁড়াতেই তা এক পলশা বৃষ্টির মত বর্ষিত হয় আমার উপর। পানির একেকটা ফোটা যেন আমার নিকট হয়ে উঠে শৈত্যকণার শীতল ছোঁয়া৷ সর্বাঙ্গে বয়ে যায় প্রশান্তির হাওয়া। আমি যখন এই শৈত্যকণার ধারায় নিজেকে বিলীন করতে ব্যস্ত তখন এক পুরুষালী কন্ঠ কম্পিত হয় প্রকৃতির বুকে,

— যার নীড় আমার তীরে সে কেন প্রদর্শিত হবে অন্যের তীরে?

কথাটার অর্থ আমি বুঝতে না পেরে রোয়েনের দিকে ঘুরে তাকাই। প্রশ্নবোধক চাহনি তার দিকে নিক্ষেপ করতেই তিনি বলে উঠেন,

— ব্যক্তিগত তাকে দেখার অধিকার শুধুই আমার। একান্তই আমার।

#চলবে