নিভৃতে যতনে পর্ব-৩০+৩১

0
998

#নিভৃতে_যতনে
#Part_30
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

প্রকৃতি আজ বৈশাখের রঙে মাতোয়ারা।বৈশাখ মানেই প্রকৃতিতে বিরাজমান সুন্দর সুবাসে ভারী হওয়া।নতুন রঙে মেতে উঠা হাজারো প্রেমিযুগলের ভীড়ে ঠাসা। আনন্দে উচ্ছ্বাসিত প্রাণবন্ত ঢাকার আনাচেকানাচে।কৃষ্ণচূড়ায় বিলীন হওয়া রাস্তা-ঘাটের নতুন রুপ। আমি তোয়ালে হাতে দাঁড়িয়ে বৈশাখের আগমণ বিভোর চোখে উপলব্ধি কর‍তে ব্যস্ত আর রোয়েন দূর থেকে আমাকে দেখতে ব্যস্ত যা আমার ষষ্ঠইন্দ্রীয় জানান দেওয়ার সাথে সাথেই লজ্জায় লালাভ হয়ে উঠি। দ্রুত তোয়ালেটা বারান্দায় মেলে তৈরি হওয়ার জন্য তোড়জোড় লাগিয়ে দেই। এমন ভাণ ধরি যেন রোয়েন নামক কোন ব্যক্তিকে আমি উপলব্ধিই করতে পারছি না। তাঁর অস্তিত্ব রুম জুড়ে কোথাও নেই। অনেকটা সময় চলে যাওয়ার পরও যখন আমার ষষ্ঠইন্দ্রীয় জানান দেয় রোয়েন এখনো আমার পানে তাকিয়ে আছে তখন আমি স্বগতোক্তি কন্ঠে বলি,

— আপনার পাঞ্জাবী বিছানায় রাখা আছে। রেডি হয়ে নিন।

কথাটা বলে আমি রোয়েনের উত্তরের অপেক্ষা না করে মেকাপ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ক্ষণেই ওয়াশরুমের দরজা লাগানোর আওয়াজ শ্রবণ হতেই হাফ ছেড়ে বাঁচি আমি। অতঃপর মনোযোগ দেই নিজের কাজে। আমি শাড়ির আঁচলটা টেনে নিতেই রোয়েন রেডি হয়ে বেরিয়ে আসেন। রোয়েনের দিকে তাকাতেই দুইজনের দৃষ্টি একে অপরের দিকে নিবদ্ধ হয়ে যায়। ক্ষণেই আমি দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে কুঁচি করার দিকে মনোযোগ দেই। কিছু প্রথর অতিক্রম হতেই রোয়েন ধীর পায়ে আমার দিকে এগিয়ে আসেন। কিছু না বলে চুপচাপ আমার সামনে এসে হাটু ভাঁজ করে বসেন আর আলতো হাতে আমার কুঁচিগুলোর দায়িত্ব নিয়ে নেন। তা দেখা মাত্র আমার ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে তৃপ্তির হাসি। মুখে প্রকাশ না করলেও আমি মন থেকে এইটাই চাইছিলাম আমি। শাড়ি পড়ার পিছনের মূল কারণ যে রোয়েনই।

শাড়ি পড়া শেষে আমি চটজলদি লিপস্টিকের প্রলেপ ওষ্ঠদ্বয়ের উপর ছড়িয়ে দিয়ে আয়নাতে একবার নিজেকে দেখে নেই। হলদেটে ফর্সা গায়ে লাল পাড়ের অফহোয়াইট জামদানী শাড়ি জড়ানো। মুখে কৃত্রিম সাজ আর চুলগুলো খোপা করা। দুই হাত ভর্তি রক্তিম লাল রেশমি চুড়ি। খারাপ লাগছে না। ভালোই লাগছে দেখতে। আমি পিছন দিয়ে শাড়ির আঁচলটা টেনে সামনে এনে রোয়েনের দিকে ঘুরে দাঁড়াই। পড়নে তাঁর সাদা আর লাল মিশ্রণের একটি পাঞ্জাবী আর সাদা পায়জামা। চুলগুলো ব্রাশ করে সাইড করা। উনি বিছানার উপর বসে নিজের হাতে সিলভার কালারের চেইন ঘড়িটা পড়ছেন। তাকে ঘড়ি পড়তে দেখে হঠাৎ টনক নাড়ে। আমি দ্রুত পায়ে নিজের কাবার্ডের দিকে এগিয়ে যাই। কাবার্ড খুলে ভিতর থেকে সেই কালো রঙের ঘড়ির বক্সটা বের করি৷ বক্সটা নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে যাই রোয়েনের দিকে। উনার সামনে এসে দাঁড়াতেই রোয়েন চোখ তুলে আমার দিকে তাকায়। আমি ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে বক্সটা তাঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলি,

— দেখেন তো, আপনার ভালো লাগে কি-না?

রোয়েন বক্সের দিকে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বক্সটা হাতে নেন। অতঃপর জিজ্ঞেস করেন,

— এইটা তুমি কবে কিনলে?

আমি ইতস্তত সুরে বলি,

— অনেক আগেই কিনেছিলাম।

রোয়েন আর কিছু না বলে মুহূর্তেই নিজের হাতের ঘড়িটা খুলে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলেন,

— দিয়েছ তুমি, পড়িও দিবে তুমি।

আমি তৃপ্তির হাসির হেসে বক্স থেকে ঘড়িটা বের করে সপ্তপর্ণে তাঁর বা হাতে ঘড়িটা পড়িয়ে দিলাম। সোজা নরম সুরেই বললাম,

— এইবার চলুন, আমি রেডি।

রোয়েন আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেন,

— কাজল পড়ো না তুমি?

আমি মাথা হেলিয়ে বলি,

— না। কখনো পড়া হয়নি আরকি।

রোয়েন উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলেন,

— মায়াবী চোখে কাজলের স্পর্শ হলে কাজল সার্থক হতো।

কথাটা বলে তিনি বেরিয়ে যান রুম থেকে। আমি কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে চলে যাই ডেসিং টেবিলের সামনে। কাজলের কোটা বের করে সপ্তপর্ণে তা চোখে লাগিয়ে নেই। তাঁর কথা ফেলার সাধ্য আমার নেই৷ একদমই নেই।

_______________________

“এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।
এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।”

ভার্সিটির প্রাঙ্গনে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে গানটি। চারদিকে আজ শুভ্র আর লাল রঙের ছড়াছড়ি। উচ্ছাসে পরিপূর্ণ পরিবেশ৷ রোয়েন আমায় ভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে চলে যান। তাঁর নাকি কিছু কাজ আছে সেটা শেষ করে তিনি পড়ে আসবেন। আমি তাতে সম্মতি জানিয়ে চলে আসি ভিতরে। ভিতরে এসেই ফোন দেই স্নেহাকে জানার জন্য ওরা কোথায়। স্নেহা জানায় তারা হাকিম চত্তরের পাশেই আছে আমিও যাতে সেখানেই এসে পড়ি। ক্ষণিকেরই মাঝেই হাকিম চত্তরে এসে হাজির হই আর বন্ধুমহলের মাঝে ঢুকে পড়ি। সবাই আজ আগে ভাগেই এসে পড়েছে। শুধু আমারই দেরি হয়ে গিয়েছে। যার ফলে সকলে মিলে আমার গায়ে ‘লেটলতিফ’ তকমা লাগিয়ে দেয়। আমি মুখ ভোতা করে বসে আছি তা দেখে ইফতি রসিকতা সুরে বলে উঠে,

— নাকের সাথে কি এখন চেহেরাও ভোতা বানানোর উদ্যোগ নিয়েছিস নাকি?

পাশ দিয়ে স্নেহা বলে উঠে,

— উদ্যোগ নিলেই কি আর উদ্যোক্তা হওয়া যায়? এর জন্য বুকের পাটা লাগে বুঝছিস।

আদিব স্নেহাকে খোঁচা মেরে বলে,

— চাইলেই কি আর মেকাপ ছাড়া বিশ্ব সুন্দরী হওয়া যায়? এর জন্যও বুকের পাটা লাগে বুঝেছিস?

আদিবের কাকে মিন করে কথাটা বলেছে তা বুঝতে পেরে মুহুর্তেই সকলে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে। তাদের সাথে তাল মিলিয়ে আমিও হেসে উঠি। স্নেহা মাত্রাতিরিক্ত মেকাপ করেই বলে আদিব কথাটা স্নেহাকে উদ্দেশ্য করে বলেছে। এইদিকে স্নেহা আদিবের কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে ধুপধাপ ওর পিঠে কিল বসিয়ে দিয়ে বলে,

— কুত্তা তুই কি বুঝবি মেকাপের মর্ম? মেকাপ একটা আর্ট বুঝেছিস, একে সম্মান করতে শিখ। নাইলে কপালে বউ জুটবো না।

আদিব নিজের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,

— এমন ডাইনি মার্কা বউ আমি চাইও না। হুহ!

সুরাইয়া রসিকতা করে বলে,

— তো কেমন বউ চাস তুই? পেত্নীর মত?

আদিব কিছুক্ষণ চুপ থেকে নূরের দিকে তাকিয়ে বলে,

— নূরের মতো।

নূর তখন কোক খাচ্ছিল। আদিবের এহেন কথা শুনে ও মুখ থেকে ফিক করে কোকটা মাটিতে গড়িয়ে পড়ে। অবাকে সে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। এইদিকে নূরের নাম শুনে সকলেই হই হই করে উঠি। নূর আর আদিবের লেগ পুল করতে শুরু করলে আদিব ভড়কে উঠে বলে,

— আরেহ আমি হূর বলেছি। হূর! নূর না। কানে বেশি শুনোস নাকি তোরা?

আদিবের এমন পল্টি খাওয়া দেখে সবাই হেসে ফেলি। এই বিষয় নিয়ে কেউ আর কথা বাড়াই না। অন্য এক টপিক নিয়েই আড্ডা আবার জমজমাট হয়ে উঠে৷ অডিটোরিয়ামে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চললেও বেশিরভাগ সকলেই এইদিক সেদিক ঘুরাঘুরি করছে আর আড্ডা দিচ্ছে।

________________________

ঘন্টা খানিক পর আমার মুঠোফোনটা বেজে উঠে। রোয়েন ফোন করেছেন। আমি সকলকে চুপ থাকতে বলে ফোনটা রিসিভ করি। নরম সুরে বলি,

— এসেছেন?

রোয়েন স্বাভাবিক কন্ঠেই বলেন,

— হুম। তুমি কোথায় আছো এখন?

— হাকিম চত্তরের পাশেই আছি। আপনি এইদিকটায় এসে পড়েন।

উনি ছোট করে “আচ্ছা” বলে ফোন কেটে দেন। আমি কান থেকে ফোন রাখতেই বুঝতে পারলাম কয়েক জোড়া উৎসুক চোখের দৃষ্টি আমার দিকেই নিবদ্ধ হয়ে আছে। আমি সকলের দিকে তাকাতেই ইফতি ক্যাবলা মার্কা হাসি দিয়ে বলে,

— কি ব্যাপার মামা? এই আপনিটা কে?

সুরাইয়া পাশ থেকে বলে উঠে,

— কাকে আসতে বলসোস তুই?

আমি ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করে বলি,

— আসলেই দেখতে পাবি।

নূর ফট করে জিজ্ঞেস করে উঠে,

— বিএফ তোর?

আমি কিছু বলার আগেই স্নেহা ফোড়ন দিয়ে বলে,

— এখনকার দিনে বিএফকে কেউ আপনি বলে? সিনিয়র কোন আত্মীয় হবে হয়তো।

ওদের কথা শুনে আমি ঠোঁট টিপে হাসতে থাকি। এরা সকলেই যে আজ চারশো বিশ ভোল্টের শখ খাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কেন না তাদের যে আমার বলা হয়নি আমি বিবাহিত। আমাকে এইভাবে মিটিমিটি হাসতে দেখে আদিব সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বলে,

— তোর কি কোন টিচারের সাথে সেটিং মেটিং চলতাসে দোস্ত? হইলে বল আমি তোরে সাপোর্ট করুম।

আমি আমার হাতে থাকা খালি পানির বোতল আদিবের দিকে মেরে বলি,

— ওই ইফতি আমার পক্ষ থেকে ওকে চার-পাঁচটা থাপ্পড় মার তো। নাইলে আজ ওই আমার হাতে খুন হইবো।

আদিব বোতল ক্যাচ করে বলে,

— হাইপার হোস কেন? মজা করতাসি শুধু।

আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই আমার মুঠোফোন বেজে উঠে। রোয়েন আবার ফোন করেছেন। ফোন রিসিভ করতেই তিনি বলে উঠেন,

— কোথায় তুমি?

আমি বসা দাঁড়িয়ে যাই। চারপাশে চোখ বুলিয়ে রোয়েনকে খুঁজতে থাকি। বেশ কিছুক্ষণ পর তাঁকে পেয়েও যাই। তাঁকে দেখা মাত্র আমার রাগ উবে যায়। ঘামের কারণে সাদা পাঞ্জাবী কিছুটা লেপ্টে আছে শরীরের সাথে। চোখে মুখে কিছুটা বিরক্তি। আমি শীতল দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে বলি,

— আপনার বাম দিকটায় তাকান।

কথাটা বলেই হাত উঁচিয়ে জানান দেই আমি এইখানে। রোয়েন আমাকে দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেন। অতঃপর ফোন কেটে দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতে থাকেন। আমাকে এইভাবে হাত উঁচিয়ে থাকতে দেখে সকলেই পিছনে তাকায়। শ্যাম বর্ণের এক যুবককে তাদের দিকে আসতে দেখে সকলের ভ্রু কুঁচকে আসে। সুরাইয়া আমার হাতের কব্জি টেনে বলে,

— এই ছেলেটা কে? আমি এর আগে বেশ কয়েকবার তাকে দেখেছি তোকে কচিং এ ড্রপ করে যেতে। জিজ্ঞেস করবো করবো আর করা হয়নি।

স্নেহা রোয়েনের দিকে তাকিয়ে বলে,

— এই ছেলে কি তোর কোন কাজিন ব্রাদার? মানে দূরসম্পর্কের কোন ভাই টাই? হলে একটু রাস্তা ক্লিয়ার করে দেয়। এর উপর বড়সড় মাপের ক্রাশ খাইসি আমি।

আদিব খোঁচা মেরে বলে,

— ক্রাশ ইকুয়াল টু লম্বা বাঁশ। সো বি কেয়ারফুল।

স্নেহা অগ্নি দৃষ্টিতে আদিবের দিকে তাকাতেই আদিব অন্য দিকে তাকিয়ে এইটা সেটা দেখতে থাকে। যেন সে কিছুই বলে নি। এইদিকে স্নেহার কথা শুনে আমি ফুঁসে উঠে। রাগে গা জ্বলছে আমার। আমার জামাইকে পটানোর জন্য আমার কাছেই সাহায্য চায়। মনটা তো চাচ্ছে ধরে বুড়িগঙ্গায় চুবিয়ে মারি। নিজেকে কোনমতে সংযত করতেই স্নেহা আবার বলে উঠে,।

— ওই বল না ছেলেটা তোর কি হয়?

আমি কটমট দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বলি,

— জামাই ভাই হয় আমার।

আমার উত্তর শুনে স্নেহার সাথে সবার মুখ হা হয়ে যায়। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সকলেই। বিস্ময় কাটিয়ে নূর বলে উঠে,

— চাচাতো,মামাতো,কাকাতো,পাতানো ভাইয়ের নাম শুনসি কিন্তু এই জামাই ভাই আবার কেমন ভাই?

আমি গম্ভীর কন্ঠে বলি,

— উনি আসুক বুঝতে পারবি।

কথাটা বল মাত্র রোয়েন আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। আমি তাঁর দিকে একবার তাকিয়ে সপ্তপর্ণে তাঁর হাত জড়িয়ে ধরি। অতঃপর সকলের দিকে তাকিয়ে বলি,

— মিট মাই হাসবেন্ড আদনাফ জুহায়র রোয়েন।

কথাটা শোনা মাত্র সকলে চোখ গোলগোল হয়ে আসে। বিস্ময়ে তাদের ঠোঁট যুগলের মাঝে সৃষ্টি হয় কিঞ্চিৎ ফাঁক। স্নেহার চেহেরা তো দেখার মত। বেচারি আসলেই ক্রাশের সাথে বাঁশ খেল। সকলের এমন প্রতিক্রিয়া দেখে আমি ফিক করে হেসে দেই। এইদিকে রোয়েন এত জোড়া চোখের কেন্দ্রবিন্দু হতেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। আমি কিছুক্ষণ হেসে সকলকের বিভ্রান্তি দূর করি। সব শুনে ওরা কিছুক্ষণ আমায় বকে টকে রোয়েনকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

____________________

আমি বিছানায় বসে ফিন্যান্সের থিওরেটিকাল চ্যাপ্টার গুলো পড়ছি। পাশেই রোয়েন ল্যাপটপে অফিসের কিছু কাজ করছে। হঠাৎ পড়তে পড়তে আমি আনমনা হয়ে যাই। আজ বৈশাখ মাসের সাত তারিখ হলেও মন গিয়ে স্থির হয় পহেলা বৈশাখের দিনটিতে। সারাদিন রোয়েনের বাইকের পিছে বসে ঘুরে বেড়ানো, তাঁর সাথে মাটির কাপে চা খাওয়া, রবীন্দ্রসরোবরে ভীড়ের মাঝে আমায় আগলে রাখা, সবকিছু যেন আবার উপলব্ধি করতে পারি আমি। অনুভব করতে পারি সেই সময়গুলো। আমি যখন আপন ভাবনায় বিভোর তখন রোয়েন বলে উঠেন,

— তোমায় একটা প্রশ্ন করার ছিল।

রোয়েনের কন্ঠে আমি নিজ ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসি। শীতল দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে বলি,

— কি প্রশ্ন?

রোয়েন আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,

— সেদিন তুমি হঠাৎ আমার প্রাক্তনের সাথে নিজের তুলনা করলে কেন? ওই প্রশ্নগুলো তোমার মনে আসলো কিভাবে? এইভাবে এইভাবেই তো সেই প্রশ্নগুলো মনের মাঝে আসার কথা না। তাহলে?

প্রশ্নগুলো শুনে আমি অপ্রস্তুত হয়ে যাই। আমতা আমতা করে বলি,

— না মানে…

রোয়েন আমার কথার মাঝে ফোড়ন দিয়ে বলেন,

— আমি সত্যিটা জানতে চাই। বানোয়াট কোন কাহিনী না।

আমি এইবার বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে ইতস্তত সুরে বলি,

— আপনার ডায়েরি পড়ে৷

রোয়েন ভ্রু কুঁচকে বলেন,

— কোন ডায়েরি?

আমি দৃষ্টি নত করে দুই হাত কচলাতে কচলাতে বলি,

— যেটাতে আপনার অনুভূতি ও আপনার প্রাক্তনকে নিয়ে লিখা৷ সেদিন আপনার কাবার্ড ঠিক করতে গিয়ে একটা ডায়েরি পেয়েছিলাম। কৌতূহলবসত সেটা পুরোটা পড়েছিলাম আমি। তখন প্রচন্ড কষ্ট হয়েছিল আমার আর সেই সাথেই ওই প্রশ্নগুলো মনে জেগেছিল। সরি, আপনার ডায়েরি আপনার অনুমতি ছাড়া পড়ার জন্য।

রোয়েন কিছুটা সময় চুপ থেকে জিজ্ঞেস করেন,

— ডায়েরিটা কোথায়?

— আপনার কাবার্ডেই।

— বের করে আনো।

আমি বিনাবাক্যে বিছানা থেকে নেমে কাবার্ডের ভিতর থেকে ডায়েরিটা বের করে রোয়েনের দিকে এগিয়ে দিলাম। রোয়েন ডায়েরিটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখেন। অতঃপর তিনি কিছু না বলে বিছানা থেকে নেমে রুম থেকে বেরিয়ে যান৷ ক্ষানিকটা সময় পর তিনি হাতে একটা বোতল নিয়ে রুমে ফেরত আসেন। কিছু বুঝে উঠার আগেই উনি আমার হাতের কব্জি নিজের হাতের মাঝে নিয়ে বেরিয়ে আসেন বাসা থেকে। আমায় নিয়ে চলে আসেন ছাদে। আমি তাঁর দিকে কৌতূহল দৃষ্টিতে তাকাতেই উনি আমার হাত ছেড়ে দেন। ছাদের মধ্যভাগে ডায়েরিটা রেখে তাঁর হাতে থাকা বোতলটির মুখ খুলে ধরতেই তরল পদার্থ জাতীয় কিছু গড়িয়ে পড়ে ডায়েরিটার উপর। বাতাসে তরল পদার্থটির উদ্ভট গন্ধ মিশে নাকে এসে বারি খেতেই বুঝতে পারলাম এইটা কেরোসিন। সাথে সাথে বিস্ময়ে আমার চোখ দুইটি বড় হয়ে আসে। আমি অস্ফুটস্বরে বলে উঠি,

— এইসব কি করছেন?

উনি আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলে,

— অতীতের অস্তিত্ব চিরতরের জন্য মিটিয়ে দিচ্ছি। যাতে বর্তমানে এর ছাপ দ্বিতীয়বার না পড়ে।

— দেখুন এর কোন দরকার নেই।

— সেটা আমি বুঝবো।

আমি বিনয়ী সুরে বলি,

— এমনটা করবেন না প্লিজ। আমি আপনার অনুভূতিগুলোকে অসম্মান করি নি। আপনাকে কষ্ট দেওয়ার উদ্দেশ্য আমার ছিল না।

— অতীত যে আবার বর্তমানে আসবে না তার কি গ্যারান্টি আছে?

— তখন অন্যকে নিয়ে লিখা আপনার অনুভূতিগুলো দেখে ক্ষাণিকের জন্য হিংসে হয়েছিল। নিজের অবস্থান জানতে চেয়েছিলাম শুধু আপনার জীবনে। যেটা আপনি সেদিনই আমায় বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর তো আর সেই বিষয় কোন কথা উঠার প্রশ্ন আসে না।

রোয়েন নির্লিপ্ত গলায় বলেন,

— আমি তোমাকে ভুল বলছি না। তোমার মনোভাব গুলো তোমার জায়গায় থেকে ঠিক। কিন্তু যে জিনিসটার এখন আমার জীবনের সাথে কোন সম্পর্ক নেই তা আগলে রেখে লাভ কি?

— কিন্তু..

— যার বর্তমান আর ভবিষ্যৎ এত সুন্দর তার কি দরকার অতীতের পাতাগুলো জমিয়ে রাখার?

কথাটার পিঠে আমি কিছু বলতে পারলাম না। রোয়েন আমার সামনেই পকেট থেকে দিয়াশলাই বের করে তা জ্বালিয়ে ডায়েরির উপর ফেলে দেন আর কয়েক কদম পিছিয়ে আসেন। মুহূর্তেই পুরো ডায়েরির উপর ছেয়ে যায় অগ্নিকন্যার দাপট। চোখের সামনেই দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে ডায়েরিটি। সেই সাথে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে আছে রোয়েনের সুপ্ত অনুভূতিগুলো,যতনে লিখা প্রত্যেকটা চরণ, তাঁর না বলা কথাগুলো, জীবনের নির্মলতা, পৃথিবীর তিক্ত সত্যগুলো। আমার থেকে এক হাত দূরেই রোয়েন ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন আর আমি ছন্নছাড়া হয়ে। ডায়েরিটার দিকে যতবারই তাকাচ্ছি ততোবারই চোখ জ্বালা করে উঠছে আমার। বুকের বা পাশটাই তীব্র ব্যথা অনুভব করছি। সেই সাথে উপলব্ধি হচ্ছে কারো সুপ্ত অভিমান। সহ্য হচ্ছে না এইসব। বার বার মনে হচ্ছে, প্রহরটা এইখানে থেমে যাক,ধ্বংস না হোক অতীতটা। থাকুক না দুই-একটা ভাসমান স্মৃতির কুন্ডলী।

#চলবে

#নিভৃতে_যতনে
#Part_31
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

জৈষ্ঠ্যমাসের তপ্ত গরমে তিক্ত হয়ে উঠেছে পরিবেশ। ভ্যাপসা গরম আর মাথাচাড়া দিয়ে উঠা রৌদ আড়াআড়ি ভাবে বিরাজমান। রৌদ্রতপ্ত দুপুরে ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে রোয়েন ছুটেছে আমায় নিয়ে। গন্তব্য আমার জানা নেই। তাজ্জবের বিষয় হলো, যে নাকি অসুস্থ শরীর নিয়ে অফিসে ছুটতে প্রস্তুত সেই আজ বিনা কারণেই অফিস থেকে ছুটি নিয়েছেন। সেই সাথে আমাকেও ক্লাস বাঙ্ক দিতে বলেছেন। আদৌ ভাবা যায়? এ তো ভূতের মুখে রাম রাম। আমি সন্দিহান কন্ঠে তাঁকে এই নিয়ে প্রশ্ন করেছি বহুবার। কিন্তু প্রতিবারই তাঁর দিক থেকে স্পষ্ট কোন উত্তর মিলে নেই। ব্যাট যে আস্ত ঘাড়ত্যাড়া তা যেম প্রতি পদে পদে প্রমাণ করা চাই তাঁর। হুহ!
বাইক ফ্লাইওভারে উঠতেই আমি শেষবারের মত উদ্যোগ নেই জানার আসলে আমরা যাচ্ছিটা কোথায়। আমি রোয়েনের কাধ থেকে হাত সরিয়ে সপ্তপর্ণে রোয়েনের কোমড় জড়িয়ে ধরে মিষ্টি সুরে জিজ্ঞেস করি,

— কোথায় যাচ্ছি আমরা?

রোয়েন গম্ভীর কন্ঠে বলেন,

— তোমার সতীনের কাছে।

আমি রোয়েনের কথায় ফুঁসে উঠি। মনে মনে কয়েকটা সুশীল বকা দিয়ে বলি, “এত সুন্দর করে জিজ্ঞেস করলাম তাও পাত্তা দিল না। এমন হার্টলেস মানুষের সাথে কেন সংসার করছি আমি? হুয়াই?” রাগে দুঃখে উনার কোমর ছেড়ে দিয়ে বাইকের পিছন দিকটা ভালো ধরে তাঁর থেকে দূরত্ব নিয়ে বসি৷ মুখ ঘুরিয়ে রাখি আকাশের পানে। হঠাৎ আমার ষষ্ঠইন্দ্রীয় জানান দেয় কারো শীতল দৃষ্টি নিবদ্ধ আমার মুখ পানে। ক্ষণেই লুকিং গ্লাসে নজর যেতেই দেখি রোয়েনের নির্মল চাহনি। দর্পণের মধ্য দিয়ে দুইজনের দৃষ্টি এক প্রান্তের মিলিত হতেই রোয়েন বাঁকা হাসে। তাঁর হাসির অর্থ বুঝার আগেই বাইকের স্পীড বেড়ে যায় শতভাগ। মুহূর্তেই আমি ভড়কে যাই আর নিজের ভারসাম্য ঠিক রাখতে আমি আঁকড়ে ধরি রোয়েনের কোমড়। আমি কিছু বলতে যাব তাঁর আগেই রোয়েন বলে উঠেন,

— নীড়হারা যেমন পাখি হয় না, আমার তীর ব্যতীত তার কোন নীড় হয় না।

_______________________

দুইপাশে সারি সারি গাছের মেলা। নীলাভ আকাশে ছড়িয়ে আছে সোনালী রৌদ্দুরের আলতো ছোঁয়া। হাইওয়ের মত সরু বিস্তৃত রাস্তায় চলছে বাইক। চারপাশে চোখ বুলাতেই নজরে পড়ে এক সাইনবোর্ড। তাতে গোটা অক্ষরে লিখা ‘পূর্বাচল’। আমার আর বুঝতে নেই আসলে আমরা কোথায়। কিন্তু রোয়েন আজ হঠাৎ আমায় এইখানে নেওয়ার আসার কারণটা বুঝে উঠতে পারলাম না৷ বেশ কিছুক্ষণ পর নীলা বাজারের রাস্তায় বাইক উঠে পড়ে। কিছু দূর যেতেই রোয়েন বাইক থামায়৷ আমায় নামতে বলে নিজেও নেমে পড়ে। আমায় এক ছাউনিতে দাঁড় করিয়ে দুইটা ডাব কিনে আনেন তিনি। একটা আমার দিকে এগিয়ে দেন। আমিও বিনাবাক্যে সেটা গ্রহণ করলাম।

ডাবক খাওয়া শেষে আবার বাইক চলতে শুরু করে। শহীদ মায়েজ উদ্দিন চত্তরের থেকে পুব দিকে মোড় নিতেই নজরে পড়ে বাবুইপাখি ও কুড়েঘরের মত খুটিগুলো। ভালো করে খেয়াল করতে বুঝা গেল এইগুলো রেস্টুরেন্ট। মূলত রেস্টুরেন্টের ভিতরটা আকর্ষণীয় করতেই এমন পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে৷ রোদের তীক্ষ্ণতা কমে এসেছে। শীতল হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাদের। আরও বেশ কিছুক্ষণ পথ অতিক্রম করার পর ‘পূর্বাচল ইকো পার্কের’ সামনে এসে বাইকটা স্থির হয়৷ আমি নেমে পড়তেই রোয়েন বাইক পার্ক করে আসতেই ভিতরে চলে যাই আমরা। ভিতরের পরিবেশ সুন্দর। রাস্তার দুই ধারে সারি সারি রঙিন লাইন,আশেপাশে কিছু ছোট ছোট রেস্টুরেন্ট,সামনে মস্ত বড় লেক,চারদিকে সুবজ রাঙ্গা গাছগাছালির মেলা। বেশ মনোরম আর নির্মল পরিবেশ। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় চারদিকে মানুষ তেমন নাই বললেই চলে। আমি রোয়েনের দিকে কৌতূহল দৃষ্টিতে তাকাতেই তিনি আমার হাতের মাঝে নিজের হাত গলিয়ে দিয়ে অগ্রসর হন সামনে। লেকের তীরেই আসতেই দেখতে পাই তীরেই বাঁধা আছে কিছু নৌকা। রোয়েন কোন দরদাম না করেই একটা নৌকায় উঠে পড়েন। অতঃপর আমার হাত শক্ত করে ধরে বলেন,

— উঠে পড়ো।

আমি কিছুক্ষণ শীতল দৃষ্টিতে রোয়েনের দিকে তাকিয়ে থাকিয়ে উঠে পড়ি নৌকায়। নৌকার মাঝে এসে বসতেই নৌকা চলতে শুরু করে। পানির থৈ থৈ আওয়াজ কানে আসতেই মন জুড়ে যায় আমার। রোদ্দুরে তীক্ষ্ণতা এখন আদুরে হয়ে উঠেছে। বেশ ভালো লাগছে পরিবেশটা। নৌকা লেকের মধ্যভাগে আসতে আমি রোয়েনের দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। বুঝার চেষ্টা করি রোয়েন আসলে আমরা এইখানে কেন এসেছি। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলি,

— হঠাৎ আজ আমরা এইখানে কেন এসেছি?

রোয়েন কিছুটা সময় আমার দিকে তাকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়ায়। নৌকা চালকের কাছে চলে যান। কি নিয়ে যেন কথা বলতে থাকেন। আমি কিছুটা সময় তাঁর দিকে তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে স্বচ্ছ পানির দিকে নিবদ্ধ করি। বেশ কিছুক্ষণ পর উনি ফিরে এসে আমার পাশে বসেন। আমি তাঁর দিকে তাকাতেই উনি হালকা হেসে আমার দিকে একটা ছোট রক্তিম লাল গোলাপের তোড়া এগিয়ে দিয়ে কানের কাছে এসে নমনীয় কন্ঠে বলেন,

— শুভ বিবাহবার্ষিকী!

কর্ণধারে কথাটা বারি খেতেই আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি রোয়েনের মুখপানে। মুহূর্তেই আমার নিকট সব পরিস্কার হয়ে আসে রোয়েনের আজকের কর্মকাণ্ডের অর্থ। হঠাৎ টনক নাড়ে, আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকী অথচ আমারই মনে নেই? বিয়ের প্রথম বার্ষিকীটা সকল মেয়েরই জন্য অন্যরকম অনুভূতি বয়ে আনে। এইদিনটা নিয়ে সকলের কত প্ল্যান থাকে, কত আশা থাকে। অথচ আমি বেমালুম ভুলে বসে আছি। এতটা বেখেয়ালি কবে হলাম আমি? হঠাৎ বুকের বাপাশে তীব্র ব্যথা অনুভব করি। গলা ধরে আসছে বার বার। দৃষ্টি নরম হয়ে আসতেই আমি মাথা নিচু করে ফেলি৷ ক্ষণেই নয়ন দুইটির কার্নিশ বেয়ে নীরবে গড়িয়ে পড়ে দুইফোটা নোনাজল। নীরবে কেঁদতে থাকি আমি। আমার কান্না দেখে হয়তো রোয়েন কিছুটা ভড়কে যায়। কেমন বিচলিত দেখাল তাকে। পরমুহূর্তে নিজেকে স্থির করে আমায় পিছন দিয়ে এক বাহু জড়িয়ে ধরে সিক্ত কন্ঠে বলেন,

— কি হয়েছে? কাঁদছো কেন তুমি?

আমি কিছু না বলে নীরবে কান্না কর‍তে থাকি। তা দেখে রোয়েন আর কয়েকবার একই কথা জিজ্ঞেস করেন। অবশেষে আমি ধরা গলায় বলি,

— কিভাবে পারলাম আমি ভুলতে আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকী?

রোয়েন আমায় আগলে নিয়ে বলেন,

— এইটা ব্যাপার না।

আমি করুন কন্ঠে বলি,

— আমার জন্য যে অনেক কিছু।

রোয়েন মিষ্টি হেসে বলেন,

— প্রকৃতির নিয়মই হচ্ছে, দুইজনের মধ্যে একজনের বিশেষ দিনের কথা মনে থাকবে আরেকজনের থাকবে না। এইবার না-হয় তুমি ভুলে গিয়েছ পরেরবার না-হয় আমি ভুলে যাব।

শেষের কথাটা শুনে আমার ঠোঁটের কোনে শ্লেষের হাসি ফুটে উঠে। আমি বিষাদময় কন্ঠে বলি,

— কিছু তো করতেও পারলাম না আপনার জন্য অথচ আপনি কত কি প্ল্যান করে বসে আছেন।

রোয়েন নির্লিপ্ত কন্ঠে বলেন,

— কোথায় কত কি প্ল্যান করেছি?

আমি কিছুনা বলে রোয়েনের বুকে মাথা চেপে বসে থাকি। রোয়েন স্বাভাবিক কন্ঠেই বলেন,

— ফুলগুলো কি পছন্দ হয়নি? নদীতে ফেলে দিব?

আমি কিছু না বলে আলতো হাতে ফুলগুলো নিয়ে নিলাম। এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকলাম ফুলগুলোর দিকে। কিভাবে যে মানুষটির সাথে একটি বছর পার করে ফেললাম বুঝতেই পারলাম না। যে মানুষটাকে প্রথমে দুই চোখে দেখতে পারতাম না আজ তাঁর জন্য মাতোয়ারা আমি। যাকে ঘিরে আমার চরম বিরক্তি, তাঁকেই ঘিরে এখন আমার সকল অনুভূতি। জৈষ্ঠ্যমাসের সেই অনাকাঙ্ক্ষিত দিনে আমাদের সাক্ষাৎ যে চিরকালের জন্য আমাদের একই বন্ধনে বেঁধে দিবে তা কে জানতো? হঠাৎই রোয়েন আমার বা হাত টেনে ধরতে আমি আমার ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসি। রোয়েন আমার অনামিকা আঙ্গুলে ছোট একটা সাদা আর নীল পাথরে কারুকাজ করা আংটি পড়িয়ে দিতেই বিস্মিত দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকাই। আংটিটা পড়ানো শেষে রোয়েন আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কোমল কন্ঠে বলে উঠেন,

— আমার জীবনের সকল জৈষ্ঠ্যমাস যেন তাকে নিয়েই শেষ হয়।

___________________

সময় যে কত দ্রুত গতিতে চলে যাচ্ছে তা পিছনের দিনগুলো গুনলে বুঝা যায়। এই যে সময় কাটা যে কখন বৈশাখ,জৈষ্ঠ্য পেরিয়ে শ্রাবণে গিয়ে ঠেকলো বুঝাই গেল না। রমজান মাসও যে এসে এখন শেষ হতো চললো৷ এইতো মাত্র আর একদিন বাকি। ইদের ছুটি কাটাতে মা-বাবা ঢাকাই চলে এসেছেন। কালকে ইদ বলে আজ বাসায় ঢেড় আয়োজন। পলি আন্টি সন্ধ্যা পর্যন্ত মায়ের কাজে সাহায্য করলেও তার যাওয়ার পর আমিই মাকে সাহায্য করতে থাকি। রাত যখন প্রায় এগারোটা ছুঁই ছুঁই তখন মা আর আমার কাজ শেষ হয়। খাওয়া-দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে রুমে আসতেই রোয়েন গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠেন,

— এইদিকে আসো!

কথাটা শুনে আমি তাঁর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাই। সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,

— কেন?

— প্রশ্ন করতে বলিনি। এইদিকে আসে বলেছি।

আমি আর কিছু না বলে তাঁর দিকে এগিয়ে যাই। তাঁর মুখ বরাবর গিয়ে বসতেই উনি আমার এক হাত টেনে বলেন,

— মেহেদী পড়োনি কেন?

আমি স্মিত হেসে বলি,

— আমার মেহেদী দেওয়ার তেমন অভ্যাস নেই। তার উপর দিতেও জানি না।

রোয়েন আর কিছু না বলে পিছন থেকে একটা কাভেরি মেহেদী বের করেন। মেহেদীটা দেখা মাত্র বিষ্ময়ে আমার ঠোঁট দুটো কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে আসে। রোয়েন পাশে মোবাইলের ডিসপ্লেতে মেহেদীর একটা ডিজাইন রেখে আমারটা তাঁর উরুর উপর নিয়ে চুপচাপ ডিজাইনটা দেখে মেহেদী দিতে শুরু করেন। আমি কিছু বলতে যাব তাঁর আগেই তিনি গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠেন,

— হুসসস!! ডোন্ট ডিস্টার্ব মি।

কথাটা শুনে আমার হাসি পেলেও হাসলাম না আমি। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসে রইলাম আর রোয়েন একধ্যানে মেহেদী দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ঘন্টাখানিক পর মেহেদী দেওয়া শেষ হতেই তিনি স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বলেন,

— ডান!

আমি কথাটা শুনে নিজের হাতের দিকে তাকাতেই মিষ্টি হাসি দেই। রোয়েন বেশ সুন্দর করেই মেহেদীটা পড়িয়ে দিয়েছেন। মেহেদীর এক কোনে লুকিয়ে থাকা ‘আর’ শব্দটি নজর বুলাচ্ছি বার বার। রোয়েন কৌশলে নিজের নামের প্রথম শব্দটি লিখলেও আমার নজরে তা ঠিকই ধরা পড়ে যায়। মাঝেমধ্যে মানুষটি এমন অপ্রকাশিত পাগলামো,অনুভূতি দেখলে সত্যি অভিভূত হই আমি। কিছু না বলেও অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ খুব ভালো করতে জানেন তিনি। আমি মিষ্টি হেসে বলি,

— আপনি তো দেখছি ভালোই মেহেদী দিতে জানেন।

রোয়েন নিজের চুলে হাত গলিয়ে বলেন,

— কষ্টের ফল মিষ্টি হলেই হয়।

কথাটা শুনে আমি মিটমিটিয়ে হাসি। রোয়েন যে মিষ্টি ফল বলতে মেহেদীর রঙ গাঢ় হওয়ার কথা বলছে তা ঢেড় বুঝতে পারছি। আমি আর কিছু না বলে উঠতে যাব তখনই আমার ফোন বেজে উঠে। আমি বা হাতে ফোনটা তুলে নিতেই দেখি হৃদিপু কল করেছেন। আমি ঘড়ি একবার দেখে নিলাম। রাত বারোটার বেশি বাজে। এইসময় হৃদিপু কেন ফোন করলো? কোন বিপদ হলো না তো? আমি চটজলদি ফোনটা রিসিভ করে হৃদিপুর কান্নামিশ্রিত কন্ঠ শুনতে পেলাম। ক্ষণেই বিচলিত হয়ে পড়ি আমি। অস্থির কন্ঠে কয়েকবার কি হয়েছে জানার চেষ্টা করি৷ অতঃপর হৃদিপুর উত্তর শুনে আমি একদম স্তব্ধ হয়ে যাই। মাথা ভনভন করে ঘুরতে শুরু করে। নিস্তেজ হতে বসে পড়ি বিছানায়।

#চলবে