হৃদমোহিনী পর্ব-১২

0
682

#হৃদমোহিনী
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১২

গেস্টরুমের দিকে যাওয়া উচিৎ বলে গেলাম। কাজিনরা সবাই ওখানেই। কি সাজানো হচ্ছে দেখে আসা দরকার। কিন্তু ঘরে পা দিয়েই আমার চোখ ছানাবড়া। ওমা! এ আমি কাকে দেখছি? ধূসর! ও মাই গড। ওনি এখানে কীভাবে? আর কখন এলেন?
আমি ঘরে ঢুকতেই এক পল্টন মানুষ আমার দিকে তাকালো যেন ফিল্ম ইণ্ডাষ্ট্রির একজন আইকন আমি। আমি বিব্রত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন তোরা?’
সবাই সমস্বরে বলে উঠলো, ‘দুলাভাই অনি আপুর ফুলসজ্জার খাট সাজিয়েছে। কেমন হয়েছে এবার বলো!’
আমার মাথা ঘুরছে। মনে হচ্ছে অতলে তলিয়ে যাচ্ছি। একী শুনলাম আমি? আমি একটু পেছনে সরে দেয়ালে হাত রেখে নিজের ভরটুকু সামলে নিলাম। ধূসর! অনির ফুলসজ্জার খাট সাজাচ্ছে আর আমার বেলায় নেশাভাং করে কি না কি করেছে! ভাবা যায়?
-এই আপু? কী হলো তোমার?
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,’কিছুনা। আমি যাই।’
-আরে বসো তো।
বলে পুনম আমায় জোর করে চেয়ারে বসিয়ে দিলো। আমি বিরক্ত গলায় বললাম, ‘আমার এখানে কি দরকার?’
-বারে, ভাইয়া এতো সুন্দর সাজালো আর তুমি দেখবেনা?
-না দেখবোনা।
-সে তোমার বর। বরের প্রতি এতো নিষ্ঠুরতম আচরণ করা ভালো নয়।
পুনমের কথা শুনে আমার মাথা ঘুরছে। বলে কি এই মেয়ে? সেদিনের পুচকির কি কথা রে বাবা! ধূসর শয়তানটাকে দেখো আলাভোলা মানুষের মতো চেহারা করে বসে আছে। যেন সে এই দুনিয়ার সবচেয়ে নিরীহ প্রাণী। একটা মানুষ এতো ইনোসেন্ট ফেইস নিয়ে কীভাবে বসে থাকতে পারে? দেখে তো মায়া লেগে যাবে! আমার ভেতরে থাকা আরেকটা আরুণী বলে উঠলো এর দিকে ভুলেও তাকাবিনা। গিরগিটি কোথাকার। ভালো মানুষ সাজতে এসেছে। আমি বিরক্ত চোখে তাকাতেই ওনি হাত দিয়ে চুলগুলো পেছনে ঠেলে টাইয়ের নটটা ঢিলে করে পুনমকে সহজ গলায় বললেন, ‘গিভ মি ওয়াটার প্লিজ!’

দেখো না, কথার ছিরি দেখো। সারাদিন ইংরেজিতে কথা বলতে বলতে ঘরেও ইংলিশের বুলি ঝাড়ছে। গা পিত্তি জ্বলে যায় ন্যাকামি দেখলে। অর্নি তুই একে পছন্দ করেছিলি? একে? আর ঠ্যাকায় পড়ে আমাকেও পছন্দ করতে হলো। নইলে তো কোনোদিন এর দিকে ফিরেও তাকাতাম না। নেহাৎ বর বলে কথা। কিন্তু আমাকে কি তার চোখে পড়েনি? আমি কি পানিতে বিষ মিশিয়ে দেব? যত্তসব! পুনম হলো বাচ্চা মানুষ ওকে বলার কি দরকার ছিলো? বিয়েতে আনন্দ করছে সেটায় বাগড়া দিচ্ছে। আরে এতোই যদি তেষ্ঠা পায় তাহলে নিজে গিয়ে খেয়ে নে না। তোর তো শ্বশুরবাড়িই থাকবে আজীবন। আমি ডিভোর্স দিলেও অর্নির বর হিসেবে এই বাড়ির দরজা সবসময় খোলা, আমার পরিবারের লোকেরা এতোটাও নির্দয় নয়, বুঝলি! বিরক্ত হয়ে আমি পুনমকে বললাম তুই বস। আমি নিয়ে আসছি। সবাই আমার দিকে ‘হা’ করে তাকিয়ে থাকলো।

পানি এনে ওনাকে দিতেই দেখলাম ওনি মিটিমিটি হাসছে। ঢকঢক করে পানিটা খেয়ে আমাকে গ্লাসটা ফেরত দিলেন। রাত বারোটার কাছাকাছি। আড্ডা দেওয়া শেষে অনি, আরাফাতকে রেস্ট করার জন্য ধূসর সবাইকে বেড়িয়ে যেতে বললো। নিজেই হাসি-ঠাট্টা করলো। সবার সাথে কি ফ্রি ভাবে কথা বলছে দেখো! আমি শুধু দেখে যাচ্ছি! আমাকে একটু ফাঁক পেয়েই অসহায় কন্ঠে বললেন, ‘প্লিজ আরেক গ্লাস পানি দাও।’
-এক্ষুনি তো খেলেন।
-আবার লাগবে।
-কেন? আপনার কি ডিহাইড্রেশন হচ্ছে? পানি না পেয়ে মারা যাচ্ছেন?
-এতো বাজে কথা বলছো কেন? আমি মরে গেলে তো তুমি বিধবা হয়ে যাবে, তাইনা? সো এসব অপয়া কথা বন্ধ করো।
আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, ‘বিধবা হবো মানে?’
ওনি মুচকি হেসে বললেন,
-ওয়েল, বুঝিয়ে দিচ্ছি৷ এক্ষুনি তো তুমি বললে যে আমি পানি না পেয়ে মারা যাচ্ছি। আর আমি মারা গেলে আমার বউ হিসেবে তুমিই তো বিধবা হবে। আর দেশের একজন সচেতন নাগরিক হয়ে আমিতো আর তোমাকে বিধবা হতে সাহায্য করতে পারিনা। সো যাও পানি খাইয়ে আমাকে বাঁচাও।

এ কে? আদৌ ধূসর? ও আল্লাহ! কি বলছেন ওনি? এতো এতো রুপ ওনার? আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘আপনি আজ এতো কথা বলছেন কেন?’
ওনি আমার কথা যেন শুনতেই পেলেন না এমন একটা ভাব নিয়ে বললেন, ‘আমার ইচ্ছা।’
-আপনার ইচ্ছেই বা আমি শুনছি কেন? একটা নেশাখোর লোক!
ওনি টাইয়ের নটটা আরো ঢিলে করে আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালেন। আমি চুপচাপ পানি এনে ওনাকে দিলাম। ওনি পানি খেয়েই একটা মুচকি হাসি দিলেন। গ্লাসটা রেখে আচমকা আমাকে কাছে টেনে নিলেন। এলোমেলো চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিতে দিতে বললেন, ‘আহা! এরকম করে কথা বলে নাকি কেউ? স্বামীর সাথে বেয়াদবি আল্লাহ মাফ করবেনা। এখন থেকে সংযত হয়ে কথা বলবে কেমন?’

ভীষণ অবাকে আমি তখন কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। নিজেকে সামলে কথার উত্তর দিতে গিয়েই দেখি গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুচ্ছেনা। তোতলাতে তোতলাতে বললাম, ‘ছ ছাড়ুন ন…’
ওনি ছেড়ে দিলেন আমায়। অতঃপর বললেন, ‘আম্মু কোথায়?’
-ঘুমিয়ে আছে।
-উপস শিট….
-কোনো দরকার?
-হুঁ।
-আমাকে বলতে পারেন।
ওনি আমার দিকে চাইলেন। আমি থতমত খেয়ে বললাম, ‘বউয়ের অধিকার দেখাচ্ছিনা। ডিভোর্স তো দিয়েই দেবো। শত হলেও আমাদের গেস্ট আপনি, সুবিধা অসুবিধা দেখতেই হয়।’
ওনি প্রথমে রাগী তারপর শান্ত গলায় বললেন, ‘ওকে ওকে। তা তুমি যে আমায় ডিভোর্স দেবে তোমার ফ্যামিলির লোকেরা জানে তো? শুনেছি তোমার বাবা আই মিন আমার শ্বশুর নাকি এসব পছন্দ করেন না? ওনার নাকি দু’বার স্ট্রোকও হয়েছে? এইতো অর্নির নিউজ শুনেও একবার স্ট্রোক করেছে ক’দিন আগে। এখন যদি শুনে তার মেয়ে জামাইকে ছেড়ে দিতে চায় তাহলে ওনি নিশ্চয়ই চিন্তিত হবেন! আর চিন্তা করতে করতে আবার অসুস্থ হয়ে যাবেন। ডাক্তার বলবে এবার কিন্তু লাস্ট…. ‘

আমি ওনাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘আপনাকে কেউ এসব ভাবতে বলেনি!’
-দেশের একজন সচেতন জামাই হিসেবে এটা আমার দায়িত্ব কর্তব্যের মধ্যে পড়ে! আচ্ছা বাদ দাও।
তারপর হাই তুলতে তুলতে বললেন, ‘আমার অনেক ঘুম পেয়েছে৷ আমি ঘুমাবো। অফিস থেকে এসেছি তো খুব টায়ার্ড লাগছে।’
-ঘুমান। আমিতো আপনাকে ধরে রাখিনি।
-আহা, এতো ঝগড়া করো কেন তুমি!
এমন সময় আম্মু এদিক দিয়েই কোথাও একটা যাচ্ছিলো। হাতে দুটো বালিশ। আমাদের দেখে কাছে এসে বললেন, ‘কিরে এখনো জামাইকে নিয়ে ঘরে যাসনি? আরে তোর আব্বু দেখতে পেলে বকাবকি করবে। যা যা ওকে ঘরে নিয়ে যা। বাবা খেয়েছো?’
-জি খাওয়া হয়েছে।
আম্মু মুচকি হেসে চলে গেলেন। আমার রাগ উঠছে। সবাই ইচ্ছাকৃতভাবে এসব করছে কিনা বুঝতে পারছিনা। কিন্তু ওনাকে খেতে দিলো কে? তাহলে কি ওনি আরো আগেই এসেছিলেন? সন্দেহপ্রবণ মন নিয়ে আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-আপনাকে কে খেতে দিয়েছে?
-আমার কী হাত নেই? নিজে নিজেই খেয়েছি!
-আপনি কখন এসেছেন? আমিতো দেখতে পাইনি?
-সন্ধ্যের একটু আগে আগে। সব কাজটাজ তো আমিই করে দিলাম।

ওনার কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম। কী বলছে লোকটা। এত আগে এসেছে আর আমি ওনাকে দেখতেই পাইনি কি যে হলো আমার আজকাল চোখের মাথা খেয়ে বসে আছি৷ সব দোষ এই লোকটার। আমি রেগে বললাম, ‘আমার ঘুম পেয়েছে। আপনি কোথাও একটা গিয়ে শুয়ে পড়ুন। আমি যাচ্ছি।’
ওনি ভারী অবাক হওয়ার ভান করে বললেন, ‘কোথাও গিয়ে শুয়ে পড়বো মানে? শ্বাশুড়িমা তো তোমার ঘরে থাকতে বলে গেলো!

-বললেই আমি আপনাকে ঘরে জায়গা দিয়ে দেবো এটা ভাবা ভুল।
-বাহ! উপকারীর উপকারের এই প্রতিদান দিচ্ছো তুমি? আমার ঘরে কি তোমাকে জায়গা দিইনি? কয়েকটারাত আমার খাটে শোবার সুযোগ করে দিইনি? কাঁথা, বালিশ, মাদুরটা দিয়ে বুঝি তোমাকে হেল্প করিনি? আর আজ তুমি আমায় যেখানেসেখানে শুয়ে পড়তে বলছো, তুমি বেশ ভালো করেই জানো আমি কতোটা খুঁতখুঁতে, ওসিডি আছে।
-আমারও আছে। বাই।
বলেই আমি উপরে চলে এলাম। পেয়েছেটা কি উনি? আমি মগা? উহু একদমই না। ঘরে এসে দরজা আটকাতে গেলেই ওনি পা দিয়ে দরজা ঠেলে ধরলেন। আমি ওনার শক্তির কাছে হার মেনে সরতেই ওনি ঠুস করে ঘরে ঢুকে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিলেন। আমি সেই শব্দে কেঁপে উঠলাম। আমার সাথেই থাকবেন নাকি ওনি? বাড়ির লোকেরা এমন একটা ভাব করছে যেন আমাদের মধ্যে সব স্বাভাবিক। অসহ্য! ও মাগো..একা পেয়ে যদি এখন আমার টুটি চেপে ধরে! আমি দুআ ইউনূস পড়তে লাগলাম। ওনি বিছানায় ধপ করে শুয়ে পড়লেন। আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘এটা বুঝি তোমার ঘর?’
আমি উত্তর দিলাম না। ওনি উঠে ঘরের নানা জিনিসপত্র ঘেঁটেঘুঁটে দেখছে আর প্রশ্ন করছে। আমি রাগ আর বিরক্তি নিয়ে সব শুনছি আর কটমট করছি। একটা কথার উত্তরও দিলামনা। আমার বেয়াদবিতে একপর্যায়ে ধূসর রেগে গেলেন। আমাকে ধাক্কা দিতেই ওনাকেসহ বিছানায় পড়ে গেলাম আমি। ইশ, কি লজ্জা! ওনি সেই অবস্থায়ই রেগে আমার উপর চিল্লাচ্ছেন।

-কি কথা কানে যায়না? আমি কী বোকা? নাকি তোমার চাকর? এতো এতো প্রশ্ন করছি আর তুমি এটিটিউড দেখাচ্ছো? এই ধূসরকে এটিটিউড দেখাচ্ছো, ইডিয়ট চাশমিশ কোথাকার!
-আমি কোনো এটিটিউড দেখাইনি।
-একদম চুপ। আমার সাথে লাগতে আসলে বেশি ভালো হবেনা। তোমার এটিটিউড ভেঙ্গে তোমার গলায় ঝুলিয়ে দেবো। মিসেস ধূসর!
আমি বললাম, ‘মিসেস ধূসর হলো অর্নি। আমি আরুণী, শুনতে পাচ্ছেন আপনি? মিস্টার ধূসর? আমি আরুণী। আর আরুণীই থাকতে চাই।’
ধূসরের চোখ লাল। দেখে মনে হচ্ছে তার বুকে হাজারো ব্যথার বাস। ওনার চেহারার ওরকম সুরত দেখে আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম। তিনি হঠাৎ আমার নাকে নিজের নাক ঘষে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন, ‘আমার তো ওটাকেই চাই!’

চলবে…ইনশাআল্লাহ!