#বাদামি_চোখ [১১]
আব্বুর দিকে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি!
লিয়নের বউ সন্তান সম্ভবা কথাটা বিশ্বাসযোগ্য, কিন্তু তনয়কে ভাইয়া কীভাবে খুঁজে পাবে?
মাত্র কিছুক্ষণ আগেই না শুনলাম তনয় চিৎকার করে বলছিলো আমার চোখ খুলে দেন, আমাকে কেন আপনি বেঁধে রেখেছেন?
আমি জানিনা কি হচ্ছে এসব? আমার মাথার শিরা-উপশিরা স্বাভাবিক কাজ করা থামিয়ে দিয়েছে। সেখানে যানজট পাকিয়ে গেছে।
তবে এখন অপেক্ষা করে দেখা যাক সত্যিই তনয় আসছে কিনা? সে আসলেই তো সবকিছু পরিষ্কার হবে।
অতঃপর আমি পিছাতে পিছাতে গিয়ে একটা সোফায় বসে পড়লাম। কপালে একটা হাত ভর করে মাথা নিচু করে আছি! অবিশ্বাস্য আর অসম্ভব যা-ই হোক না কেন, শুধু তনয় ফিরে আসুক।
বেশ খানিক্ষণ পেরুনোর পর বাহির হতে বাইক থামার আওয়াজ এলো। আমি বধূবেশেই একা সবার আগে দৌঁড়ে বেড়িয়ে গেলাম। আমার পেছনে পেছনে এখন অন্যরাও আসছে!
আমি গেইটের কাছে গিয়েই হাঁফাতে হাঁফাতে থেমে গেলাম। মূহুর্তেই ঠোঁটের কোণে কিছু হাসি এসে জড়ো হয়েছে,তবুও আমার চোখে জল। তনয় একদম সুস্থ স্বাভাবিকই ফিরেছে।
ভাইয়ার পেছন থেকে নেমেই তনয় আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে আস্বস্তির পলক ফেললো।
ভাইয়া আর তনয় একসাথেই উপরে উঠে এলো, ভাইয়া আগে আগে ভেতরে যেতে থাকলো। আর তনয় এসে আমার হাত ধরে বললো,
‘ হাসছো আবার কাঁদছো যে! আরে দেখো আমি একদম ঠিক আছি।
আমি কোনো প্রশ্ন না করে তনয়ের সাথে ভেতরে গেলাম। ভেতরে গিয়েই আমার মনে হলো নিশি আপুর রক্তের জন্য বাবা পেরেশান করছেন খুব।
আমি তনয়ের হাত টেনে বললাম,
‘ নিশি আপার রক্ত..
বলার আগেই তনয় বললো,
‘ রক্তের সন্ধানেই একজনের সাথে রওয়ানা দিয়েছিলাম। হাসপাতালে পৌঁছে খোঁজ নিয়ে যখন জানলাম রক্ত লাগবে তখন আমি বাবার সাথে দেখা না করেই বেড়িয়ে পড়েছিলাম, তারপরই লোকটা আমাকে ভুলভাল রাস্তায় নিয়ে গেলো, আর বাইক থেকে নামিয়ে কিছু লোকজন আমাকে বেঁধে ফেললো।
আমি অবাকের সাথে তাকে বসতে বললাম। তনয় ক্লান্তির রেশ তুলে জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে বসে পড়লো।
আমিও পাশে বসলাম। এর মধ্যে মা ভাবি বাকিরা এসে জানতে চাইলো তনয় ঠিক আছে কিনা আর নিশির কি খবর?
তনয় মাথা নেড়ে সবাইকেই বললো নিশি আপার রক্ত জোগাড় হয়েছে চিকিৎসা চলছে, ইনশাআল্লাহ ঠিক হয়ে যাবে!
অতঃপর সব প্রশ্ন থেমে যাওয়ার পরে আমি বললাম,
‘ বাড়ি তো যাচ্ছি কিছুক্ষণ পরে। সবাই হয়তো যাওয়ার প্রস্তুতিই নিচ্ছে এখন৷ কিন্তু আপনাকে এভাবে ধরে নিয়ে যাওয়ার মানে কি? আর আমি ফোন করার ক্ষানিক পরেই আবার ছেড়ে দেওয়ারই কি কারণ?
তনয় আমার দিকে ফিরে বললো,
‘ সেই প্রশ্ন আমারও। আমি বুঝতেছিলাম তোমার ফোন রাখার পর পরেই আমাকে গাড়ীতে তুলে অল্প সময় কোথায় যেন নিলো, তারপর ধরে একটু হাঁটিয়ে নিয়ে হঠাৎ কে জানি কাঁচি দিয়ে হাতের বাঁধন কেটে দিলো। আমি তখন হাত দিয়ে ধিরে ধিরে চোখ খোলার চেষ্টা করলাম, খুব শক্ত করে বেঁধেছিলো, তারপর খুলে দেখি আমি মেইন রাস্তার পাশে একটা গাছপালায় ঘেরা জায়গা দাঁড়িয়ে আছি। আশেপাশে কেউ নেই! আমি চোখ খুলতে খুলতে সবাই চলে গেছে হয়তো। আর এই সময়টা খুব অল্প ছিল, তারা আমাকে এর আশেপাশেই নির্জনে নিয়ে গেছিলো। কোনদিকে নিলো আর আনলো কিছুই আঁচ করতে পারলাম না।
তারপর আমি মেইন রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে দেখলাম জায়গাটা অচেনা নয়, অসংখ্যবার এই রাস্তায় এসেছি আমি!
এর মধ্যেই তোমার ভাইয়া চলে আসলো, আমি জানিনা এটা কীভাবে সম্ভব ? আমি গাড়ীর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম,তখন হুট করেই উনি চলে আসলেন!
আর আমাকে উনার সাথে তুলে নিলেন।
এদিকে আমার ফোন আর আমার বন্ধুর বাইক কোথায় আছে তা এখনো জানিনা।
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে তনয় থামলো। সে ভালো করে দম নেওয়ার আগেই আমি আবার বললাম,
‘ কে ছিল একটুও বুঝতে পারেননি?
তনয় আমার দিকে ফিরে বললো,
‘ নাহ একদমই বুঝতে পারি নি। তবে বারবার বলছিলো কিসের যেন প্রতিশোধ নিতে চায়?! আমি নাকি তার সাথে অন্যায় করেছি। ওর চোখ যদি তোমার মতো বাদামি হতো তাইলে নাকি তোমার জায়গায় সে থাকতো! আর বারবার বলে যেভাবেই হোক সে আমাকে ঠিকি বিয়ে করবে! আমার বিয়ে হয়ে গেছে শুনেও বলে, সে নাকি তার পরবর্তী পরিকল্পনা শুরু করবে, আমাদের বিচ্ছেদ ঘটিয়ে হলেও সে আমার সংসারে আসবে! নিবিতা, মেয়েটা ভীষণ বিপদজনক। আমার জানামতে আমার কোনো শত্রু নেই, আমার কোনো মেয়ের সাথে কখনোই সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু আড়াল থেকে এমন কেউ কিভাবে উদ্ভব হলো, আমার মাথায় ধরছেনা।
আমি বুঝতে পারছি তনয় আমার চেয়েও বেশি হতবিহ্বল। আমি আর কথা বাড়ালাম না। তবে বাস্তব জীবনে একটা মেয়ে মানুষ কীভাবে এতোকিছু করতে পারে এসব শোনার আগে আমি কখনো আন্দাজ করতে পারিনি।
তনয় আমাকে বসতে বলে উঠে গেলো। এখানকার যাবতীয় কাজ শেষ করে সবকিছু গোছগাছ আছে কিনা দেখে নিলো।
কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা চলে যাওয়ার সম্পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করলাম।
সবাই সবার গন্তব্যে রওয়ানা দিলো, শুধু আমার গন্তব্য নতুন! শুরুতেই যে পরিমাণ বাঁধা বিপত্তির শিকার হয়েছি, জানিনা কপালে কি আছে? তার উপর কোনো কিছুরই সঠিক সমাধান পেলাম না।
আমার শ্বশুর শাশুড়ী হাসপাতাল থেকেই বাড়ি ফিরবে, তনয় আমার ফোন থেকে তাদের খোঁজ নিয়েছিলো। নিশি আপা নাকি এখন কিছুটা ভালো।
কিন্তু উনার জন্য খুব খারাপ লাগছে, বেচারা বিয়ে খেতে এসেছিল কিন্তু জায়গামতো আর পৌঁছাতে পারলোনা। তার আগেই জীবন যুদ্ধের লড়াই!
গাড়ীতে বসে আমি তনয়কে বললাম,
‘ আচ্ছা আপনি বলছিলেন আমাদের জন্য কেউ পরিকল্পিত দূর্ঘটনা ঘটিয়েছে, এটা কি আসলেই সত্যি?
তনয় বললো,
‘ এটা আমি নিজে থেকে বলছিলাম। আমার তো তাই মনে হচ্ছে। আর এটা বলার পরে ওই মেয়ে কোনো হাঁ কিংবা না সূচক কিছু বলেনি। তাহলে তো বুঝাই যায় এসব তার ইশারাতেই হয়েছে।
আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বললাম,
‘ জানেন মেয়েটার কণ্ঠস্বর আর কথার ধরন কেমন যেন চেনা চেনা। হয়তো বাস্তবে আমি শুনেছি কিন্তু ফোনে শোনা হয়নি। আবার জোর দিয়ে বলতেও পারছিনা।
আমার কথা শুনে তনয়ও বললো,
‘ একদম আমার সন্দেহের কথা বললে তুমি, এতদিন আমার তাই মনে হতো। কিন্তু আজকে সরাসরি শুনেও মনে হলো এই কণ্ঠস্বর অবশ্যই চেনা আমার, তবে কোনোভাবে মনে করতে পারছিনা কোথায় শুনেছি?
তনয়ের কথাটা বেশ অবাক করার ছিল। আমাদের দুজনেরই এমন মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক, কেননা সে চিনলে আমি কি করে চিনতে পারি?
তনয় আমাকে হাত বাড়িয়ে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে বললো,
‘ চিন্তা করো না, কিছুই করতে পারবেনা সে। আমরা একসাথে দুজনকে বুঝেশুনে থাকলেই সব জটিলতা সহজ হতে থাকবে।
আমি আমার একটা হাত তনয়ের বুকের উপর রেখে ওর কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিতমনা হলাম।
মাথা রাখার মতো এমন একটা বিশ্বস্ত কাঁধ পেলে দুনিয়ার যাবতীয় অশান্তি মাথায় চেপে বসলেও কি কিছু করতে পারবে? এই মূহুর্তে তা মনে হচ্ছেনা! এইতো জীবন সংসারের প্রথম অনূভুতিটা ভীষন সুন্দর!
‘
কিছুক্ষণের পর আমরা পৌঁছে গেলাম। সবাই বরণ করতে এগিয়ে আসছে।
আমার শ্বশুর শাশুড়ী ইতোমধ্যে বাড়িতে চলে আসছে।
এখানকার সবকিছুই ঠিকঠাক।
আর সবাই এখানে উপস্থিত আছে, তবে লিয়ন তার বউকে নিয়ে এখনো ফিরেনি।
সেখানে গিয়ে সারাদিনের বিরক্তিকর পরিস্থিতির কথা প্রায় ভুলেই গেলাম। আশেপাশের যারা অনুষ্ঠানে যায়নি তারাও এখন বউ দেখতে আসছে।
সবার মধ্যে আগের উৎফুল্লতা আবার জাগ্রত হয়েছে।
সবার সাথে আনন্দ গল্পগুজবে রাত ১১ টা প্রায়। লিয়ন এবং তার পরিবার মাত্রই হাসপাতাল থেকে ফিরেছে। তারা নিজেদের বাসায় না গিয়ে আমাদের এখানেই প্রথম আসলো।
লিয়নের বউ এসেই আমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
‘ রুম ঠিকঠাক সাজিয়েছে তো? দেখো আমি অসুস্থ হয়ে গেলাম হঠাৎ, এতক্ষণে ফিরলাম। এখন চোখে সবকিছু অন্ধকার অন্ধকার লাগছে।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,
‘ অন্ধকার আর যাই লাগে, বলেন মিষ্টি এনেছেন তো?
লিয়নের বউ জিব কামড়ে পেছন ঘুরে লিয়নকে বললো,
‘ একি আপনি মিষ্টি আনতে ভুলে গেলেন?
এখানকার উপস্থিত সবাই লিয়নের বউয়ের কথা শুনে বিষয়টা খেয়াল করলো আর চিৎকার করে বললো,
‘ তাইতো? মিষ্টি কোথায়?
লিয়ন ভেবাচেকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাত এগারোটা বাজে সে মিষ্টি আনতে যাবে এখন?
সে তার বউয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ তুমি এতো রাতেই কেন এটা মনে করলে? কাল সকালেই বলতে! এখন?
লিয়নের বউ সবার সামনে সমানতালে নাছোড়বান্দা হয়ে বললো,
‘ যেখান থেকে পারেন এখনি আনবেন। আর সবাই আজকেই মিষ্টি খাবে। বিশেষ করে নিবিতার জন্য বেশি করে আনবেন। যেন আমার সন্তানের চোখ ওর মতো বাদামি হয়!
আমি হেসে বললাম,
‘ আমি বেশি মিষ্টি খেলে আমার মতো চোখ হবে?
লিয়নের বউ আমতা আমতা করে বললো,
‘ মানে খেয়ে বেশি বেশি প্রার্থনা করবে আরকি,যেন হয়!
লিয়ন মুখ ফিরিয়ে বের হয়ে গেলো। লিয়নের বউ এসব বলছে আর খুব হাসছে, আমিও তার সাথে সাথে হাসছি।
ওদের সম্পর্কটা বুঝা যায় না, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সুন্দর। অথচ কাল থেকে দেখছিলাম কেমন যেন আলাদা আলাদা ছিল। লিয়নের বউ এখন হাসিখুশি কিন্তু লিয়নের মধ্যে খুশির মাত্রা ততটাও নেই।
আধা ঘণ্টা পরে সবাই একসাথে থাকতে থাকতেই লিয়ন বিরাট বড় মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে হাজির হলো।
আর লিয়নের বউ নিজ হাতে সবাইকে খাওয়ালো।
না চাইতেও আমাকে জোর করে দুইটা খাওয়ালো! আর লিয়ন চুপচাপ এক জায়গায় বসে রইলো।
মাঝে মাঝে লিয়নের বউ আমার সাথে কথা বলার সে আড়চোখে তাকায়, আমি তাকালেই সে আবার চোখ ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।
ওদের উপর থেকে আমার সন্দেহ পুরোপুরিই কেটে গেলো। আর লিয়নের বউকে এখন আমার অসহ্য লাগছেনা। যে আড়াল থেকে এসব করছে সে অন্য কেউ হবে। তাদের সাথে কোনো সম্পর্ক থাকতে পারেনা।
রাত বারোটা,
এখানকার কয়েকজন বলতে লাগলো, এবার আস্তে আস্তে সবাই ঘুমুতে যাও। আর বউকে তার বরের রুমে দিয়ে আসো।
এখানকার কয়েকজন আমাকে নিয়ে যেতে এগিয়ে আসলো, সবার আগে আগে লিয়নের বউ।
সে আমাকে রুমে বসিয়ে বললো,
‘ আচ্ছা আগে আগেই একটা কথা বলে রাখি, আমার পেটের বেবিটা যদি ছেলে হয়, আর তোমার যদি প্রথম মেয়ে হয় তাহলে আমি কিন্তু আমার ছেলেকে দিয়ে সেই মেয়ে নিয়ে যাবো। তোমার মেয়ে নিশ্চয়ই তোমার চোখ পাবে, আর সে আমার পরিবারে গিয়ে আমার বংশকেও বাদামি চোখে পরিণত করবে। শুধু বাদামি চোখের জন্য নিবো বুঝলে?
আমি হাসতে হাসতে বললাম,
‘ আচ্ছা আচ্ছা সে দেখা যাবে নে!
লিয়নের বউ যেতে যেতে বললো,
‘ মনে রেখো কিন্তু!
আমি অদ্ভুদভাবে হাসলাম। আর উনি আস্তে আস্তে দরজাটা একটু লাগিয়ে বেড়িয়ে গেলেন।
দুই মিনিটের মাথায় দরজা আবার খুললো, আমি খেয়াল করে দেখি তনয় আসছে।
ওকে দেখে আমি তড়িঘড়ি করে বিছানায় উঠে বড় করে ঘোমটা টেনে বসলাম।
চলবে…..
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার