বাদামি চোখ পর্ব-১২+১৩

0
507

#বাদামি_চোখ [১২ এবং ১৩]

বরের সাথে পূর্বেই ভালো পরিচিতি থাকলে লজ্জা পাওয়ার মূহুর্তে লজ্জা পেতেও লজ্জা লাগে! এ এক অন্য রকম লজ্জাময় অনূভুতি।
এদিকে আমি ঘোমটা টেনে নেওয়ার পর নিজের হাসি থামাতে পারছিনা। সারাসময় স্বাভাবিকভাবে একে অপরের দিকে তাকিয়ে কথা বলে এখন কিনা আমি লুকাতে আসছি! নিশ্চয়ই তনয়ও আমাকে দেখে হাসছে, কিন্তু ওকে আমি দেখতে পারছিনা, চোখ বন্ধ করে কেবল একা হেসেই চলেছি।

কিছু সময় পার হতেই ধুরুম করে বিছানায় এলোপাতাড়ি হয়ে তনয় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো। তারপর আমার দিকে ফিরে নিচে দিয়ে আমাকে দেখার চেষ্টা করলো। যখন দেখা যায়না তখন হাত বাড়িয়ে ঘোমটা একটু টেনে তুলতে চেয়ে বললো,
‘ এটা আরেকটু উপরে তুলো না, মুখ তো দেখা যায়না।

ওর কথা শুনে আমি টেনে আরো নামিয়ে নিলাম। তনয় নিরাশ হয়ে হাত গুটিয়ে নিলো। বেশ খানিক সময় পেরিয়ে গেলো, নাহ সে শুয়েই আছে। এই মূহুর্তে ওর আলসেমি দেখলে সত্যিকার অলসতা ওর কাছে মাথা নোয়াবে। বেচারা শোয়া থেকে উঠতেই চাচ্ছেনা।
আমি এবার পুরোপুরি হাসি থামিয়ে বিরক্তবোধ করলাম,এতক্ষণ ঘোমটা টেনে বসে থাকা যায়?
জামাই ভালোবেসে নিজে থেকে এটাও সরাবেনা?
তাও অপেক্ষা করছি তুলে কিনা দেখতে।

কিন্তু না তনয় এখন সুন্দর করে শুয়ে হাত পা নাড়িয়ে গান গাইছে। আবার এর মধ্যে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ দেখো আমার কিন্তু ঘোমটা তুলতে লজ্জা লাগছে। তুমি এটা তুলে দাও।
আচ্ছা ঘোমটা দিতে কে বলেছে বলোতো? এতক্ষণ কি স্বাভাবিক ছিলাম, এখন এভাবে দেখেই বিভিন্ন নাটক সিনেমার দৃশ্যের কথা মনে পড়ছে আর লজ্জা লাগছে। না না আমি তুলবোনা, ভয় ভয়ও লাগছে, তুলতেই যদি তুমি আও করে চিৎকার মেরে উঠো?

ওর অদ্ভুত কথা শুনে বিরক্তির মধ্যে আবার হাসির মাত্রাটা বেড়ে গেলো। । নাহ সে উঠাবে বলে আশার সঞ্চার করতে পারলাম না। আর আমিই বা ভয় দেখাতে যাবো কেন? আজব ভাবনাচিন্তা ওর মধ্যে! আমার জায়গায় বেশি লজ্জা সে নিজেই পাচ্ছে। এখন নিজেই নিজের ঘোমটা সরাতে হবে দেখছি। আচ্ছা বেরসিক একখানা জামাই পেয়েছি তো আমি ! তাও ভাবলাম দেখি আরেকটু অপেক্ষা করে। নিজে নিজে লুকানো মুখ বের করতে অপমান বলতেও তো কিছু আছে!

এদিকে তনয় ফ্যানের দিকে তাকিয়ে হাত তুলে গান গাইছে,
‘ এ জীবনে যারে চেয়েছি, আজ আমি তারে পেয়েছি।

নাহ ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে আমার। ইচ্ছে করছে কান টেনে উঠে বসাতে! এতদিন ফোনে একটা গান গাওয়ার জন্য কতো অনুরোধ করেছি, কিন্তু বারবার বলেছে আমি গান গাইতে পারিনা।
আর এখন চাচ্ছিনা, আর গলা ছেড়ে গান গাইছে। দরজার আশেপাশে কেউ থেকে থাকলে অবশ্যই এসব শুনতেছে। ভাবিরা কেউ থাকলে জানি হাসাহাসিও করছে এই বলে যে, জামাই ভেতরে এসেই তার বউকে গান শুনাচ্ছে।

হঠাৎ সে কনুই ভর করে মাথাটা একটু তুলে বললো,
‘ তোমার ফোনটা দাও। আমার ফোন তো নিখোঁজ!

আমি দাঁত কামড়ে রাগে ফোসফাস করে বালিশের দ্বার থেকে ফোনটা সামনে রাখলাম। তনয় হাত বাড়িয়ে এটা নিয়ে আবার শুয়ে যেতে চাইবে তখনি আমি ওর চুল টেনে মাথাটা আমার হাঁটু ভাঁজ পর্যন্ত এনে ঘোমটা দিয়ে ওর মাথা ঢেকে দিলাম। আর ভেতরে চোখ রাঙিয়ে বললাম,
‘ সমস্যা কি? আমার গরম লাগেনা? এটা তুলতে পারেন না আপনি? যান এখন আপনিও এটার ভেতর থাকেন!

তনয় হাতের ফোনটা পাশে রেখে আমার দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকালো । এটার ভেতর স্বল্প আলোতেই আমরা দুজন দুজনকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। আমার কথায় তনয় দাঁত বের করে হাসছে! অনেক্ষণ পর পর তার চোখের পলক পড়ছে। আর আমার একটা হাত ওর মাথায় অন্যটা এর গলা জড়িয়ে আছে।
তনয়ও এবার আস্তে আস্তে একটা হাত আমার গাল পর্যন্ত নিয়ে আলতো ছুুঁয়ে বললো,
‘ এইইই! তোমার চোখে বেশিক্ষণ তাকিয়ে তাকলে আমি পাগল হয়ে যাবো! ঢেকে নাও না মুখ!

আমি ধিরে ধিরে বললাম,
‘ ঢেকেই তো রেখেছি। দেয়াল থেকে, আলো থেকে, সাজানো ফুলেদের থেকে!

তনয় তার অন্য হাত দিয়ে ওর মাথার উপরে রাখা আমার হাতটা ওর গালে টেনে বললো,
‘ এসব ফুলেরা আজ গন্ধহারা হোক,
আলোরা নিজেই অন্ধকার টানুক।
আর,
আমার চোখ তোমাতেই খুঁজে বেড়াক মুগ্ধতা!
ভালোবাসার স্পর্শে আঁকুক পরম শুদ্ধতা।

আমি তনয়ের দিকে অপলক তাকিয়ে ওর কথাগুলো শুনছি। কি তীব্র আকর্ষিত মুখের ভঙ্গিমা তার!

কিন্তু ঠিক সেসময় সব অনূভুতিতে গোলমাল পাকিয়ে দিয়ে সশব্দে বিছানায় রাখা আমার ফোনটা বেজে ওঠলো। তনয় এখান থেকে না বেড়িয়েই ফোন হাত দিয়ে খুঁজে ভেতরে এনে বিরক্তির সাথে রিসিভ করলো।
স্পিকার অন করে এটাকে আমার উরুর উপর রেখে দিলো। আমি মাথা নেড়ে জানতে চাইলাম কে? তনয় তার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করে থাকতে ইশারা করলো।
কিছুক্ষণ পরে ওপাশ থেকে খুব হতাশার এক সুর ভেসে আসলো, ওই মেয়েটাই আবার ফোন দিয়েছে। মেয়েটা কান্নাজড়ানো গলায় বলছে,
‘ এখন তোমরা দুজন একসাথে তাইনা? প্লিজ একসাথে থেকোনা। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে !

তনয় গলা ঝেড়ে চাপা হাসিতে বললো,
‘ না না আমরা একসাথে না। ওই যে সিনেমার মতো আমি সোফায় শুয়ে আছি। আমার বউ ঘুমিয়ে গেছে। একদম কাছে যেতে দেয়নি বিশ্বাস করেন। হাতে ছুড়িও ছিল। বলেন বিয়ের রাতে বউয়ের থেকে দূরে থাকতে ভালো লাগে?

মেয়েটা ভাঙা কণ্ঠে বললো,
‘ সত্যি ? কিন্তু ওর ফোন তোমার কাছে কেন?

তনয় আমতা আমতা করে বললো,
‘ আসলে আমার ফোন তো নিখোঁজ। আমি জরুরী একটা কল করতে চেয়ে এনেছিলাম। দিতে মনে নেই।

ওপাশ থেকে আবার বললো,
‘ সত্যি তুমি সোফায়? আমার ভেতরটা একদম জ্বলে যাচ্ছে বিশ্বাস করো! কেন তাড়া করে বিয়েটা করে নিলে? নইলে এই রাত আমাদের হতো তাইনা বলো? আমি তোমাকে নিয়ে গিয়েও বিয়ে করতে পারিনি! তুমি এভাবে লুকিয়ে বিয়ে করে ঠিক করোনি তুমি।

তনয় মুখ চেপে হাসি কোনো রকম থামিয়ে বললো,
‘ অনুমতি ছাড়া বিয়ে করলে আমার বউ আমার নামে মামলা করে দিতো না ? তখন আমার চাকরিটাও হারাতাম। আচ্ছা কান্নাকাটি না করে ঘুমিয়ে পড়ুন।

মেয়েটা আবারও সেই একই কথা বলল,
‘ তোমার বউ আসলেই ঘুমিয়ে গেছে? তুমি আলাদা তো?

তনয় তার মাথা তুলে আমার কপালে নিঃশব্দে ঠোঁট ছুঁয়ে বললো,
‘ হ্যাঁ দেখা তো যাচ্ছে চোখ বন্ধ!

সে এটা বলতেই আমি চোখ খুলে তাকালাম, আসলেই তনয় স্পর্শ করাতে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম!
আমি এবার রেগে ফোন কাটতে ইশারা করলাম।
তনয় আবার আমাকে কিছু না বলতে ইশারা করে ফোনে বললো,
‘ ঘুমাচ্ছিলাম, ঘুমটা ভেঙে দিলেন। আর জাগিয়েন না ওকে? শুভ রজনী!

মেয়েটা হুমম বলে ফোন কেটে দিলো। আমি আমার মাথা থেকে পুরো ঘোমটাটা টেনে ফেলে দিলাম। মাথার উপরের পাখাটা চক্রাকারে ঘুর্নায়মানে যে বাতাস ছড়াচ্ছে সবটাই এখন গায়ে লাগছে! কিন্তু এখনো আমার নাকের ডগায় ঘাম জমে আছে, আর প্রচন্ড রাগে পুরো নাক লাল হয়ে কাঁপা কাঁপা হয়ে গেছে ! আমি ওর কলার টেনে ধরে বললাম,
‘ ওই মেয়ের সাথে সত্যি সত্যি খাতির করা হচ্ছে তাইনা? মতলব কি আপনার?

তনয় হাসতে হাসতে বললো,
‘ আরে শুনো আমার কথা! মানে উনি বলছিলো উনি নাকি আমার দ্বিতীয় বউ হবে। এটা জেনে অন্তত দ্বিতীয় বউকে এইটুকু সময় তো দিতেই পারি তাইনা?

এটা শুনতেই আমি তনয়কে আমার থেকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে যাবো তখন সে আমাকে এলোমেলো হয়ে ঝাপ্টে জড়িয়ে ধরলো!
আমাদের ভালোবাসার প্রথম শক্ত আলিঙ্গন! রাগ থামানোর সাথে সাথে নিশ্চুপ করে দিলো আমায়! আষ্টেপৃষ্টে দুটো শরীরই নয়, নিহিত হয়েছে দুটি হৃদয়। এখান এক হৃদয় অন্য হৃদয়ের অস্তিত্ব বুঝছে, তাদের কম্পন শুনছে, ভেতর জুড়ে তুমুল ঝড় উঠছে! আমরা মুখে উচ্চারণ না করলেও অনূভব করছি এই সময় আমাদের, আর প্রতিটি মূহুর্ত শুধু এবং শুধুই ভালোবাসার!

#বাদামি_চোখ [১৩]

সকাল ছয়টা তেরো মিনিট।
সূর্যও জেগে ওঠেছে বহু আগে, তবে পরিপূর্ণ তেজ ঢালতে শুরু করেনি। তাই পরিবেশটা হালকা বাতাসেই বেশ শীতল। তনয় ঘুমুচ্ছে, আর আমি বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে আছি।
ওর বারান্দাটা অনেক ফাঁকা, কোনো গাছ কিংবা ফুলের একটা টবও নেই। হয়তো তনয়ের এসবের প্রতি আগ্রহ নেই, তবে আমি ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম বারান্দায় কয়টা টব রাখা যাবে, আর কি কি গাছ লাগালে এটা সুন্দর, সতেজ এবং নির্মল হবে!

তখনি আমার চোখ গেলো এই বিল্ডিংয়েরই উপরের তলায় উত্তরদিকের একটা বারান্দায়। ওইটা মনে হয় লিয়নদের ফ্ল্যাট। বাহ ওদের বারান্দাটা বেশ সুন্দর। অনেক রকম গাছ গ্রিল জুড়েও ঝুলে আছে। এতো গাছ যে ভেতরে কেউ আছে কিনা সেটাই দেখা যায়না। হঠাৎ মনে হলো লিয়ন খুব সবুজপ্রিয় মানুষ, তার কাছে জগতের সব সবুজ রঙকেই সেরা মনে হয়। তাই সে ভীষণরকম বৃক্ষপ্রেমী। গাছ লাগানো, বাগান করা ওর একমাত্র শখ।
আমারও গাছ ভালো লাগে, তবে লিয়নের মতো এটাই যে একমাত্র শখ তা নয়।

আমি গ্রিলে হাত রেখে দেখছি কি কি গাছ ওই বারান্দায় আছে, আর আমাদের এখানে সেসবের কোনটা ভালো লাগবে!?
সেসময়ই ওখান থেকে মধ্যম আওয়াজে আমার কানে লিয়নের বউয়ের গলা ভেসে এলো। রাগী গলায় বলছে,
‘ না না আমি চাইনি এই সংসারে থাকতে। চেয়েছিলাম তো মুক্ত হতে, কিন্তু পারিনি আমি। বিরাটভাবে এখন আটকে গেছি । প্লিজ সকাল সকাল আপনার মুখও বন্ধ রাখুন, নইলে আমি জোরে জোরে চেঁচাতেই থাকবো।

কথাগুলো এতটাও জোরে বলছেনা, তবে সকালের চারদিক বেশ নিরব বলে আমি স্পষ্টই শুনতে পাচ্ছি।
মনে হচ্ছে উনি বারান্দায় কাপড় ঝাড়ছে, আর এসব বলছে।
আমি চুপ করেই দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ ভেতর থেকে তনয় বললো,
‘ নিবিতা কোথায় তুমি?

আমি ওর ডাক শুনে দৌঁড়ে দরজার কাছে গেলাম। তনয় চোখে হাত রেখে বললো,
‘ বাইরের আলোতে তোমাকে দেখা যাচ্ছেনা, দরজাটা বন্ধ করে দাও।
আমি পেছনে আঙুল দেখিয়ে বললাম,
‘ উপরের ভাবি কিসব জানি বলছে!

তনয় বিরবির করে বললো,
‘ বলছিলো, তোমার সংসারে থাকতে চাইনা আমি, হ্যাঁ চলে যাবো। খুব শীগ্রই চলে যাবো।

আমি দরজা বন্ধ করে ওর কাছে গিয়ে বললাম,
‘ আপনি কি করে জানেন? এখান থেকে কি শোনা যাচ্ছিলো?

তনয় হাই তুলে বললো,
‘ প্রতিদিন শুনি! ওরা টম জেরির মতো । বিয়ের পরেরদিন সকাল থেকে শুরু হয়েছে এসব, কিন্তু এখনো এভাবেই আছে। মাঝেমাঝে দেখলে বুঝা যায় ওরা আধুনিক যুগে প্রেমের অমরত্ব প্রতিষ্ঠা করবে, এতো প্রেম তাদের । আবার দেখা যায় শত্রুর চেয়েও মারাত্মক পরিসরে কলহ বিবাদ করছে। ওদেরকে আগামী ১০ বছরেও বুঝতে পারবেনা তুমি।

তনয়ের কথায় আমি ভেবাচেকা খেলাম পুরো। প্রতিদিন তারা ঝগড়া করতে পারে কিন্তু সম্পর্ক ছিন্ন করার প্রসঙ্গটা তোলা তো উচিত নয়। কি জানি হয়তো একেক সম্পর্ক একেক রকম!
তবে আমার জানামতে লিয়ন এরকম নয়, শেষবার কথা বলার আগে আমি ওর মুখে কখনো মজা করেও বিচ্ছেদ শব্দটা শুনতে পাইনি। সে একবার বলেছিলো আর সেটাই চূড়ান্ত হলো। আসলেই দুনিয়ার বহু কিছু মানুষভেদে প্রযোজ্য। কিছু জিনিস একবারের ধাক্কাতেই শেষ হয়ে যায় আর কিছু ধাক্কা হাজারবারেও অনড় থাকে!

তনয় আমাকে অন্যমনস্ক থাকতে দেখে উঠে বসলো। পেছন থেকে গলা জড়িয়ে কাঁধে থুতনি ভর করে বললো,
‘ আমাদের মধ্যে কখনো ছেড়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ মজা করেও আসবেনা। আমার পক্ষ থেকে অন্তত কখনোই আসবেনা, বিশ্বাস রাখো আমি এক কথার মানুষ।

আমি ঘাড় ফিরিয়ে ওর চোখে তাকালাম। কি সুন্দর করে বুঝে গেলো আমার ভেতরের কথাগুলো!
আমি তনয়ের গালে গাল ঘঁষে বললাম,
‘ আমার পক্ষ থেকেও কখনো এই শব্দ আসবেনা!

বাতাসে তনয়ের মুখের উপর উড়ে আসা চুলগুলো পেছনে সরিয়ে ফিসফিস করে কানের কাছে বললো,
‘ ভালোবাসি বউ!

আমি হাত দিয়ে তনয়ের সব চুলগুলি একসাথে এলোমেলো করে দিয়ে লজ্জা পেয়ে এখান থেকে উঠে গেলাম। তারপর পেছনে না তাকিয়ে দরজা খুলে সোজা বাইরে বেরিয়ে আসলাম!
এদিকে আমাকে বাইরে বেরুতে দেখে কয়েকজন বেশ আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলো,
‘ ঘুম হলো?

আমি কিছু না বলে ধির পায়ে সামনে অগ্রসর হলাম।
আর আরেকটু এগুতেই দেখি আমার শাশুড়ী ঘর ঝাড়ু দিচ্ছে, তিনি আমাকে দেখে হাতের ঝাড়ুটা রেখে মুখে মুচকি হাসি টানিয়ে আমার দিকে আসতে লাগলেন। আমিও উনাকে আসতে দেখে তাড়া করেই উনার কাছ পর্যন্ত পৌঁছে সালাম দিতে চাইলাম, কিন্তু আগেই তিনি আমার কাঁধ জড়িয়ে বললেন,
‘ আমার ঘরের লক্ষী! কতো স্বপ্ন ছিল সকাল সকাল আমার ঘরে এমন ফুটফুটে একটা মেয়েকে হেঁটে বেড়াতে দেখবো। অবশেষে চোখ জুড়ানো সে সময় আসলো! আচ্ছা চলো খেতে চলো,তোমার খুব খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই।

আমি মাথা নেড়ে বললাম,
‘ না না এখনো খিদে পায়নি। সকালে আসলে দেরিতে খাওয়ার অভ্যাস। তবে তার খিদে লাগতে পারে, আচ্ছা ও কি সকালে উঠে যায়?

আমার শাশুড়ী মা হাসতে হাসতে বললো,
‘ ১০ টায় ওর অফিস। সাড়ে নয়টায় উঠে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে ফ্রেশ হয়ে এক রুটি বসে খায় আরেকটা নিয়ে বেড়িয়ে যায়, গাড়ীতে বসে খায়। একদিন তো রুমের জুতো নিয়ে চলে গিয়েছিলো, মাঝ রাস্তায় দেখে ঘাপটি মেরে রইলো। দোকানপাটও নাকি ভালো করে খুলেনি তখন। কি আর করবে এটা নিয়েই অফিসে গেলো আর ওর কলিগদের হাসাহাসির শিকার হলো।

মা’র কথা শুনে আমি খুব হাসতে লাগলাম। তিনিও হাসছিলেন। তারপর আবার হাসির তীব্রতা কমিয়ে বললেন,
‘ তনয় অবশ্য আগে বেলা ১ অব্দিও ঘুমিয়ে থাকতো। এখন এটা শুক্রবার আর ছুটির দিন ছাড়া সম্ভব হয়না।

আমি হেসে হেসে মাথা ঝাকাচ্ছি। এরপর তিনি হাত ধরে বললেন,
‘ চলো তোমাকে তোমার এই সংসার চিনিয়ে দেই। এসবকিছুর দায়িত্ব তুমি নিয়ে আমাকে হালকা করো। বড্ড বিশ্রাম কাতর হয়ে পড়েছি। একটা মেয়ে না থাকার শূন্যতা খুব যন্ত্রণার জানোতো?

আমি উনার কথাকে সম্মতি দিলাম। আসলেই মেয়ে ছাড়া কোনো পরিবার ঠিক পরিপূর্ণ হয়না। এইতো উনার কোনো মেয়ে নেই, উনি হয়তো জানেন না মেয়েদের ভালোবাসা কতো অমায়িক হয়! মেয়ের মায়েরা যেমন ভেতরের সুখ দুঃখগুলো মেয়ে সন্তানের কাছে বসে অনায়েসে প্রকাশ করতে পারে, একটা ছেলের মা অতি সহজে সেটা পারে না।
বলতে গেলে পারেই না। তনয়ের মুখে আমি শুনেছি তার মা মেয়েদেরকে খুব ভালোবাসে। মেয়ে সন্তানদের প্রতি নাকি তার খুব টান। আসলেই আমি প্রথম থেকে খেয়াল করছি উনার মধ্যে শাশুড়ির কোনো বৈশিষ্ট্য নেই, উনি আমার মা হতে চান।
জীবন সংসারে আমি একটু বেশিই পেয়ে গেছি বোধহয়! উনার মতো একটা শাশুড়ীকে মা করে পেলে নিজেকে পুত্রবধূ প্রতিটা গৃহবধূ গর্ব করবে।

আমি মা’র হাত ধরে এগুতে থাকলাম। উনি আমাকে প্রতিটি জিনিস দেখাচ্ছেন আর এগুলোর পেছনে স্বরণীয় কিছু কথা খুব আবেগ নিয়ে বর্ণনা করছেন। পুরো সংসারটাই উনার হাতে একটু একটু করে গড়ে উঠেছে। উদাহরণটা এরকম হলে সহজবোধ্য হয়, এখানকার একটা ছোট্ট সুতোও উনার মাধ্যমেই বুনন হয়েছে। মানুষটার থেকে অনেক কিছু শেখার আছে, একজন সত্যিকার সংসারী নারীর প্রতিকী তিনি।

অতঃপর আমাকে নিয়ে রান্নাঘরের যাবতীয় জিনিসপত্র চেনালেন। আর সোজাসাপটা বলে দিলেন,
‘ আমি সব শিখিয়ে দিবো, আর তুমিই এখন থেকে রান্নাবান্না করবে। আমি শুধু টুকটাক সাহায্য করবো আর বসে বসে তোমার সাথে গল্পগুজব করবো।

আমি শুধু সায় দিতে থাকলাম। রান্নাঘরে উনি আমাকে একটা ছোট্ট টুলে বসিয়ে বললেন,
‘ কয়েকদিন আমাকে লক্ষ্য করো, আমি কীভাবে কি করি, হ্যাঁ?

তারপর তিনি আগেই বানানো রুটির তালাটা সামনে রেখে বললেন,
‘ তনয় পরোটা ছাড়া খায়না। আর তোমার বাবার লাগে শুকনো রুটি। আর আমি কি খাই জানো?

আমি প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে বললাম,
‘ কি খান?

তিনি হাসতে হাসতে বললেন,
‘ ওরা খাওয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকে!

আমি অবাক হয়ে বললাম,
‘ এতো কম খান?

তিনি মুখ ফিরিয়ে রুটি উল্টাতে উল্টাতে বললেন,
‘ হুহহ আমি না শুধু, সেগুলো রূপাও পেট ভরে খেতে পারে! ওদের একটা বদস্বভাব আছে, কম দেখলে চোখের তৃপ্তি পায়না। আবার বেশি দিলেও খায়না। হাহাহা!

এসব বলতে বলতেই তিনি অল্প সময়েই সবকিছু তৈরি করে ফেললেন। আর খাবার পাত্রে রেখে আমাকে ইশারা করে বললেন,
‘ এগুলো টেবিলে রেখে তনয় এবং তোমার বাবাকে ডেকে দাও।

আমি খাবারের বাটিগুলো নিয়ে টেবিলে রেখে বাবাকে ডেকে দিয়ে তনয়কেও ডেকে আসলাম। তারপর আবার সোজা চলে গেলাম মা’র কাছে। উনার কথা শুনতে আমার ভীষণ ভালো লাগছে।

আমার শাশুড়ী আমাকে উনার সংসারের শুরু এবং উনার প্রতি উনার রাগী বদমেজাজি শাশুড়ীরও ভালোবাসা গড়ে উঠার গল্প শুনালেন । এর ফাঁকে তাদের খাবারের খবরদারিও করেছি। মেহমান যারা সকালে উঠেছে তাদেরকে শাশুড়ী মা খাবার তৈরি করে আগেই খাওয়েছেন, অনেকে এখনো ঘুমিয়ে আছে তারা পরবর্তীতে উঠে খাবে।

এখন তিনি আমার জন্য খাবার বেড়ে নিয়ে আসলেন। আমিও উনার সাথেই খাবো বলে জেদ ধরেছিলাম। অতঃপর আমরা একসাথে রান্নাঘরে বসেই খেলাম। মাঝে মাঝে আমার মুখেও তুলে দিচ্ছিলেন!

খাওয়া শেষে তিনি আমাকে রুমে চলে যেতে বারবার অনুরোধ করতে থাকলেও আমি উনার সাথে সাথেই থাকলাম। অল্পস্বল্প সাহায্য সহযোগিতা করছি আর বিভিন্ন গল্প শোনার বায়না করছি। জানিনা একটা মানুষের কথা বলার ধরণ এতো সুন্দর কি করে হয়? উনাকে দেখলে অনায়েসেই বুঝা যায় অল্প বয়সে অনেক রূপবতী ছিলেন।
আমাদের গল্প করার মাঝে এসে ঢুকলেন লিয়নের মা। এসে আমাকে দেখেই লম্বা একটা হাসি দিয়ে বললো,
‘ ওমা বউ দেখি আজকেই রান্নাঘরে!

আমার শাশুড়ী চকচক চোখে উনাকে লক্ষ্য করে বললেন,
‘ কখন থেকে বলছি রুমে যেতে। কিন্তু যায়না, আমার কথা শুনতে বসে আছে। আর আমিও কতো কথা বলছি! হাহাহা, একটা মেয়ের অভাবে কতো কথা ভেতরে জমা তাইনা? ওকেই তো বলবো সব।

লিয়নের মা এটা শুনে হাসতে হাসতে আমার পাশে বসলেন। উনার পেছনে পেছনে লিয়নের বউ প্রবেশ করলো। আমি বুঝলাম তাহলে তারা সবাই-ই সকাল সকাল চলে আসছে। অবশ্য আসারই কথা, ওদের তো এখানেই নিমন্ত্রণ।

উনাকে দেখে আমি আশেপাশে তাকিয়ে দেখি এখানে বসতে দেওয়ার মতো আর কিছু নেই।
আমি উঠে উনাকে বসতে বললাম।
কিন্তু উনি না বসে আমাকে এখান থেকে বের হতে ইশারা করলেন। আমি পেছনে একবার তাকিয়ে এখান থেকে বের হলাম।
বের হতেই উনি আমাকে হাত ধরে বললেন,
‘ তারপর! বর কোথায়? আর কাল তোমাদের বিয়ে কখন হয়েছিল?

আমি উনার কথাকে সুন্দরমতো এড়িয়ে বললাম,
‘ সকালে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাইয়ার সাথে ঝগড়া করছিলেন বুঝি?

উনার হাসিমুখটা তৎক্ষনাৎ মলিন হয়ে গেলো।
আমাকে ছাড়িয়ে একটু সামনে গিয়ে বললেন,
‘ শুনেছিলে তুমি? আসলে আমাদের মধ্যে এসব প্রতিদিনই হয়। তবে এটা সত্যি আমরা একসাথে থাকতে চাচ্ছিনা অনেকদিন থেকে। এসব নিয়ে আলাপ আলোচনাও হয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু এখন আমি আমার অনাগত সন্তানের জন্য আটকে গেছি!

বলেই আমার দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসলেন।
কিন্তু এমন কথা শুনে আমার হাসিমুখটা মলিন হয়ে গেলো।

চলবে….

লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার