তোর প্রেমেতে অন্ধ হলাম পর্ব-১৭

0
659

#তোর_প্রেমেতে_অন্ধ_হলাম
#লেখিকাঃ Tamanna Islam
#পর্বঃ ১৭

সাগর চৌধুরী ঠিক থাকতে না পেরে সোফার ওপর ধপ করে বসে পরেন। আশ্চর্যের চরম সীমায় গিয়ে অর্নীলের দিকে তাকায় কপাল কুচকে। অর্নীলের মুখে মাত্রই কি শুনলো তা যেনো বিশ্বাসই করতে পারছে না।

সাগর;; অর্নীল বাবা দেখো…..

সাগর চৌধুরীর কিছু বলার আগেই অর্নীল এসে তার বাবার সামনে বসে। বেশ রাগান্বিত সুরেই বলে ওঠে….

অর্নীল;; বাবা জানো জন্ম দিলেই বাবা হওয়া যায় না। তুমি নিজেও বাবা হতে পারো নি, কোন দিন বাবার দায়িত্ব পালন করতে পারো নি৷ আর সবথেকে বড়ো কথা কি জানো! তুমি নিজেই আরেকটা মেয়ে কে পিতৃহারা করেছো।

সাগর;; অর্নীল তুমি আমার ছেলে। নিজেও এতো বড়ো একটা কোম্পানির ওনার। মেয়েরা তোমার পিছে লাইন লাগিয়ে থাকে। কিন্তু তুমি এতো শত মেয়েকে বাদ দিয়ে আর কোন মেয়ে পেলে না। শেষে কিনা, শেষে কিনা ওই রহমানের মেয়ে কেই।

অর্নীল তার বাবার কথায় তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে হাততালি দেয় কিছুটা।

অর্নীল;; বাহ বাবা, তুমি আজ সত্যি প্রমাণ করে দিলে যে তুমিই সেই মহান সাগর চৌধুরী। সত্যি তোমার মতো কেউ হতেই পারে না, তোমার মতো মন-মানসিকতার মানুষ হতেই পারে না। ইম্পসিবল। আজ তোমার পুরনো কাহিনী সামনে কি এলো তুমি তো পুরোই পল্টি খেয়ে গেলে। যেখানে নিজের ভূল স্বীকার করার কথা সেখানে তুমি আমাকে বলছো যে আমি কেনো সিয়াকে ভালোবাসলাম৷

সাগর;; ___________

অর্নীল;; বাবা একটা কথা বলবো! আমার না এখন তোমাকে বাবা বলে ডাকতে এক বিন্দু ইচ্ছেও করে না জানো। আর সত্যি বলতে আমার তোমাকে খুন করতেও এখন বাধবে না।

অর্নীলের কথায় সাগর চৌধুরী ফট করে মাথা তুলে তার দিকে তাকায়।

সাগর;; অর্নীল! ভুলে যেও না আমি তোমার বাবা।

অর্নীল;; ওহ র‍্যালি। তো শুনো আজ থেকে আমি তোমাকে আমার বাবা বলে জীবনেও পরিচয় দিবো না। তোমার কারণে, শুধুমাত্র তোমার কারণেই আজ আমার মা নেই। সব দোষ তোমার।
আর আজ তোমার জন্য আমার ভালোবাসা আমার কাছে থেকেও নেই। (চিল্লিয়ে)

সাগর;; অর্নী……..

অর্নীল;; শুনে রাখো আমি সিয়া কেই বিয়ে করে এই বাড়িতে আনবো। এই বাড়ির বউ করে আনবো। তাতে চাই তোমার মতামত থাকুক আর না ই থাকুক কিন্তু আমার জীবনে সিয়া তো থাকবেই। (প্রচন্ড রেগে)

এই বলেই অর্নীল দ্রুত সিড়ি বেয়ে ওপরে নিজের রুমে চলে যায়। আর এদিকে সাগর চৌধুরী চিন্তায় পাগল প্রায়। না, ছেলের মনে নিজেকে নিয়ে জন্মানো ঘৃণাকে নিয়ে না। অর্নীলের জীবন থেকে সিয়াকে কি করে সরানো যায় তা নিয়েই। তিনি গম্ভীর মুখে সোফার ওপরেই বসে ভাবতে লাগলেন।


আর ওদিকে সিয়া এখনো বাড়ি ফিরে নি দেখে দোলা যেনো চিন্তায় মরে মরে। বাড়িতে একে তো কারেন্ট নেই, তারওপর সিয়াও নেই। দোলা হলরুমে শুধু পায়চারিই করে যাচ্ছে। এরই মধ্যে হঠাৎ বাইরে দরজাতে কলিং বেলে চাপ পরে। দোলার মনে যেনো শান্তি ফিরে আসে। সে দ্রুত গিয়ে দরজা খুলে দেয়। দেখে সিয়া মাথার চুল থেকে শুরু করে পায়ের শেষ ভাগ পর্যন্ত পুরো গোছল করে এসেছে। চুল গুলো প্রচুর এলোমেলো হয়ে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। দোলা দরজা মেলে দাড়ালে সিয়া কিছু না বলেই মাথা নিচু করে সোজা ভেতরে এসে পরে।

শিউলি;; কিরে সিয়া! এভাবে ভিজলি কি করে? আরে দোলা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখছিস যা আগে টাওয়াল এনে আগে মেয়ে টাকে দে। ঠান্ডা-জ্বর আসবে তো।

দোলা;; হুমম হুমম।

দোলা গিয়ে সিয়াকে একটা টাওয়াল এনে দেয়। সিয়া আস্তে আস্তে করে নিজের মাথা মুছতে লাগে।

শিউলি;; হ্যাঁ রে, তুই কি কোন গাড়ি-ঘোড়া পাস নি৷ এই বৃষ্টিতে কেউ এভাবে ভিজে। এদিকে আয় দেখি মাথা মুছে দিচ্ছি আমি।

সিয়ার নানু গিয়ে তার মাথা মুছে দেয়। কিন্তু সিয়া যেনো নিজের মাঝে নেই। সে অবাক হয়ে এক দিকেই তাকিয়ে আছে। যেনো কারো কোন কথা তার কান অব্দিও পৌঁছাচ্ছেই না। দোলা সেটা খেয়াল করলো৷

দোলা;; সিয়া

সিয়া;;__________

দোলা;; সিয়া!

সিয়া;; হ হ্য হ্যাঁ বলো।

দোলা;; কি হয়েছে? সব ঠিক আছে তো?

সিয়া;; আব..হ্য হ্যাঁ সবই ঠিই আছে কি হবে। ঠিক আছে সব।

দোলা;; রুমে যা চেঞ্জ করে আয়। তারপর খেতে আয়।

সিয়া;; ক্ষিদে নেই আমার।

এই বলেই সিয়া টাওয়াল টা হাতে করে নিয়ে নিজের রুমে এসে পরে। দোলা তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। সিয়া যতোই না বলুক কিছু না কিছু তো হয়েছেই। সিয়া রাতে আর নিজের রুম থেকে বের হয় না। দোলাও আর ডাকে না। তবে গভীর রাতে শুধু একবার সিয়ার রুমে গিয়ে দেখে এসেছে। গভীর ঘুম। বৃষ্টি তে ভিজেছে ঠান্ডা ঠান্ডা একটা ভাব তাই ঘুম টাও গভীর৷ দোলা চলে আসে।

পরেরদিন সকালে সিয়া ঘুম থেকে উঠেই কলেজে যাওয়ার জন্য দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দেয়। সিয়া কলেজে চলে গেলে দোলা শিউলি কে মেডিসিন খাইয়ে দিয়ে নিজের রুমে রেস্ট নিতে পাঠিয়ে দেয়৷

হলরুমে দোলার আসতেই ল্যান্ডলাইনে ফোন আসে। দোলা গিয়ে ধরে ফেলে। তবে ওপর পাশে থাকা ব্যাক্তি টির কন্ঠ শুনতেই যেনো দোলা ভয় পেয়ে যায়। সে সাগর চৌধুরী ছাড়া আর কেউ না।

সাগর;; কেমন আছেন ভাবি?

দোলা;; ____________

সাগর;; অনেক দিন পর আপনার কথা মনে পরলো তো তাই ফোন না দিয়ে আর থাকতেই পারলাম না, কি করবো বলুন। এবার আসি সোজা সাপটা কথায়।

দোলা;; কেনো ফোন করেছেন আপনি? কি চাই? এখন সব শেষ হওয়ার পর আমাদের তো অন্তত বাঁচতে দিন।

সাগর;; হ্যাঁ হ্যাঁ বাঁচুন মন খুলে বাঁচুন। কেউ মানা করে নি। তবে হ্যাঁ তা নিজের মেয়ের দিকে খেয়াল রেখে। আপনার মেয়ের ওপর নজর দিন। আমি কিছুই লুকাতে চাই না। আর লুকায়িত নেই ও। আমার ছেলে অর্নীল আর আপনার মেয়ে সিয়া একে ওপরের প্রেমে নাক অব্দি ডুবে রয়েছে যা হয়তো আপনি নিজেও জানেন। কিন্তু আমি চাই না এমন হোক। সিয়া কে বলে দিবেন অর্নীলের থেকে দূরে দূরে থাকতে। এতে আপনার, আমার সবারই ভালো৷

এই বলেই সাগর চৌধুরী ঠাস করে ফোন কেটে দেয়। আর দোলা কিঞ্চিত চোখ কুচকে ফেলে৷ দোলা গিয়ে বসে পরে। সিয়া যে কাল রাতে চিন্তা মাখা মুখ করে বসে ছিলো অবশ্যই তাহলে কাল অর্নীলের সাথে সিয়ার কিছু একটা হয়েছে। এবার যেনো দোলার সন্দেহ টা আরো গাঢ় হয়ে গেলো। এভাবেই বেশ সময় চলে গেলো। শিউলি তার রুম থেকে বের হয়ে দেখে দোলা হলরুমেই চুপ চাপ বসে আছে। শিউলি গিয়ে দোলার পাশে বসে পরে।

শিউলি;; কিরে এভাবে বসে আছিস যে!

দোলা;; মা, সিয়ার বিয়ে দিয়ে দিলে কেমন হয়??

দোলার কথায় শিউলি অবাকই হয় বেশ। কেননা দোলা সবসময় বলতো যে আগে সিয়াকে দিয়ে পড়াশোনা শেষ করাবে তারপর তাকে বিয়ের পিড়িতে বসাবে। আর আজ কিনা দোলাই এই কথা বলছে।

শিউলি;; মানে, কিন্তু কেনো?

দোলা;; না এমনি, হুট করেই কথা টা মাথায় এসে বারি খেলো। হ্যাঁ মা এটাই ঠিক। আমি সিয়াকে বিয়ে দিয়ে দিবো। আজ থেকেই সব ব্যাবস্থা শুরু করে দিবো। আর হ্যাঁ সিয়াকে আগেই এইসব কিছুর ব্যাপারে কিচ্ছু বলবে না।

শিউলি;; সিয়া কি রাজি হবে?

দোলা;; আমি বুঝাবো ওকে, নিজের সবটুকু দিয়েই বুঝাবো। আর আমি জানি সিয়া বুঝবে। আর এখন কোন কিছুই সিয়ার অজানা নয়। ও কেনো বুঝবে না। আমিও তো চাইনি এমন কিছুর ডিসিশন হুট করেই নিতে কিন্ত এখন আমার আর কোন রাস্তা নেই। সিয়া কে যদি এখন একটা ভালো ঘরে বিয়ে দিতে পারি তাহলেই আমি চিন্তামুক্ত৷

শিউলি;; ঠিকআছে।

এই বলেই শিউলি উঠে চলে যায়। অন্যদিকে অর্নীল তার অফিসে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে এক হাত দিয়ে কপালের পাশে চেপে ধরে রেখেছে। সকাল হতে ইতোমধ্যে ৬ কাপ কফি খেয়ে ফেলেছে সে তবুও যেনো আজগুবি সব ভাবনাগুলো মাথা থেকে যেতেই চাইছে না। অর্নীল উঠে গিয়ে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। তার কেবিন থেকে বাইরের ওই ব্যাস্ত শহর টা দেখা যায়। সেইদিকেই তাকিয়ে ছিলো সে তখনই কারো ডাকে পেছন ঘুড়ে তাকায়, দেখে ম্যানেজার এসেছে।

ম্যানেজার;; স্যার..

অর্নীল;; কিছু বলবেন?

ম্যানেজার;; জ্বি আসলে স্যার বড়স্যার আপনাকে ডেকেছেন।

অর্নীল;; কেনো?

ম্যানেজার;; জ্বি স্যার তা তো আমি জানি না।

অর্নীল;; আচ্ছা ঠিকআছে।

ম্যানেজার চলে যায়। তবে সাগর চৌধুরীর এই সময়ে ডাকার মানে কি! অর্নীল নিজের কেবিন থেকে বের হয়ে পরে।


সিয়ার কলেজ শেষ, আজ মাত্র ত্রিশ মিনিটের দুইটা ক্লাস হয়েছে। সিয়া নিজের ব্যাগ টা নিয়ে ক্লাস রুম থেকে বের হয়ে পরে। গেটের বাইরে এসে ফ্রেন্ড দের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলেই আসতো তবে কারো ডাকে থেমে যায়৷

সায়ন;; সিয়া!

সিয়া;; আরে আপনি এখানে? কি মনে করে?

সায়ন;; না মানে আসলে তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো।

সিয়া;; আচ্ছা তাই, তো ডক্টর সাহেবের আমার সাথে কথা বলার এতোই তাড়া যে উনি নিজের সাথে স্টেথোস্কোপ টাও নিয়ে এসে পরেছে!

সায়ন নিজের দিকে খেয়াল করে দেখে যে আসলেই তার ঘাড়ের ওপর স্টেথোস্কোপ ঝুলছে। পেসেন্টের চেকাপ করে দ্রুত পায়ে বের হয়ে পরেছে। এটা যে ঘাড়ে রয়েছে তার দিকে কোন খেয়ালই ছিলো না। সায়ন হেসে দেয়৷ তারপর নিজের ওপর থেকে তা সরিয়ে দেয়।

সায়ন;; চলো একটা কফি শপে বসি।

সিয়া;; আচ্ছা চলুন।

সায়ন & সিয়া গিয়ে একটা কফি শপে বসে পরে।

সায়ন;; কি খাবে বলো?

সিয়া;; না না আমি কিছুই খাবো না। আপনি বলুন কি বলবেন।

সায়ন;; আব… আসলে সিয়া কথা টা মেইনলি আমার না।

সিয়া;; বুঝলাম না।

সায়ন;; আন্টি কেমন আছে?

সিয়া;; হ্যাঁ ভালোই।

সায়ন;; হুমমম। আন্টি তোমাকে কি কিছু বলেছে?

সিয়া;; কই, না তো।

সায়ন;; ওহহ আচ্ছা।

সিয়া;; কেনো কি হয়েছে?

সায়ন;; আন্টি যেহেতু এখনো তোমাকে কিছুই বলে নি তাহলে অপেক্ষা করি। আন্টি নিজেই তোমাকে বলবে।

সিয়া;; সিক্রেট নাকি?

সায়ন;; কিছুটা তেমনই৷

সিয়া;; হুমমম, আচ্ছা তো আমরা এখন উঠি।

সায়ন;; আচ্ছা।

এই বলেই তারা বাইরে বের হয়ে পরে৷ সিয়াকে সায়ন ড্রপ করে দিতে চাইছিলো কিন্তু সিয়া নিজে একাই এসে পরে। বাসায় এসেই দেখে দোলা বসে বসে সবজি কাটছে আর শিউলি টেবিল গুছাচ্ছে।

সিয়া;; মা

দোলা;; কিরে এসে পরেছিস। এতো জলদি যে?

সিয়া;; না আসলে ক্লাস তেমন একটা হয় নি তাই।

দোলা;; ওহহ আচ্ছা।

সিয়া;; আচ্ছা মা, আদিবা আপুর বাড়ি থেকে কি কেউ ফোন দিয়েছিলো?

দোলা;; না।

সিয়া;; ওহহ

দোলা;; কেনো?

সিয়া;; না এমনি, আমি রুমে গেলাম।

সিয়া নিজের রুমে চলে যাওয়ার ৫-১০ মিনিট পরেই দোলার ফোনে কল আসে। দোলা গিয়ে ধরে। আর এবার সত্যি সায়নের মা ফোন করেছেন।

রুমি (সায়নের মা);; আসসালামু আলাইকুম আপা।

দোলা;; ওয়ালাইকুম সালাম আপা। এত্তো দিন পর মনে পরলো। কেমন আছেন?

রুমি;; জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনারা সবাই কেমন আছেন? আর সিয়া কেমন আছে?

দোলা;; জ্বি সবাই ভালো।

রুমি;; আসলে আপা আপনার সাথে একটা জরুরি বিষয়ে কথা বলার জন্য ফোন করা আজ।

দোলা;; জ্বি বলুন।

রুমি;; কথা টা হয়তো দেখা করে বললে বেশি ভালো হবে।

দোলা;; এমা তাহলে তো সেটা আরো ভালো কথা। আরে সবাই কে নিয়ে সোজা এখানে চলে আসুন।

রুমি;; জ্বি আমিও তাই ভাবছি। আপনি বললে বিকেলে আসবো!

দোলা;; জ্বি জ্বি অবশ্যই।

রুমি;; জ্বি আচ্ছা তাহলে এখন রাখি।

দোলা;; আচ্ছা।

দোলা ফোন কেটে দিতেই শিউলি বলে…..

শিউলি;; কিরে কার ফোন ছিলো?

দোলা;; রুমি আপা জাবেদের মা মানে আদিবার শাশুড়ীর ফোন ছিলো৷

শিউলি;; কেনো?

দোলা;; আজ বিকেলের দিকে আসতে চায়। জরুরি কথা আছে।

শিউলি;; জরুরি কথা!

শিউলি আর দোলা কিছুক্ষন চুপ করে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকে।

শিউলি;; দোলা, আমি যা ভাবছি তুইও কি….

দোলা;; হ্যাঁ, আমিও তাই ভাবছি।

সিয়া কে তারা কেউই কিছুই বলে। তাকে তার মতো করে থাকতে দেয়। এদিকে সিয়াকে বারবার ফোন করে যাচ্ছে অর্নীল তবে সিয়া ফোন শুধু কাট করে দিচ্ছে৷ কলেজ থেকে এসেছে যাবত নিজের রুমে। দোলা গিয়ে জোর করেই খাইয়ে দিয়েছে কিছু। আস্তে আস্তে বিকেল হয়। হলরুমে বেশ মানুষের আওয়াজ পেয়ে সিয়া কপাল কুচকে দরজার দিকে তাকায়। অর্ধেক সিড়ি বেয়ে নেমেই থেমে যায়। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কেননা হলরুমে সায়নের মা-বাবা-বোন আর আদিবা নিজেও বসে আছে। দোলা & শিউলি তাদের সাথে কথা বলছে। সবাই কথা বলছিলো তার মাঝেই আদিবার চোখ যায় সিয়ার দিকে। সিয়া সিড়ির ওপরে দাঁড়িয়ে আছে, আদিবা সবাইকে বলে উঠে সিয়ার কাছে চলে আসে। সিয়ার হাত ধরে নিয়ে তার রুমের দিকে যেতে লাগে। সিয়া কিছু বলবে কিন্তু তার আগেই আদিবা তাকে নিয়ে এসে পরে। রুমে এনে দরজা ঠাস করে লাগিয়ে দেয়। সিয়ার আর বুঝতে বাকি নেই যে কেনো সায়ন সকাল বেলা সিয়াকে ওই কথা গুলো বলছিলো আর কেনোই বা এখন সায়নের মা-বাবা এখানে এসেছে। সিয়া অবাক স্তব্ধ হয়ে বিছানাতে বসে পরে৷ আর আদিবা সিয়ার পাশে বসে দ্রুত বলে ওঠে…..

আদিবা;; সিয়া কি হচ্ছে এগুলো?

সিয়া;; কি আর হবে?

আদিবা;; তোর সম্পর্ক অর্নীল ভাইয়ার সাথে আছে তাহলে এগুলো কেনো? তুই জানিস সায়নের বাবা-মা তোর আর সায়বের বিয়ের কথা বলতে এসেছে এখানে। ওরা চায় যে তোর যেনো সায়নের সাথে বিয়ে হয় আর আমরা দুই বোনও একই সাথে থাকি। কিন্তু এটা তো হয় না। অর্নীল কে তুই ভালোবাসিস। ভালোবাসিস একজন কে আর বিয়ে করবি আরেকজন কে। এটা কি সিয়া, তুই কাউকে কিছু বলছিস না কেনো? আর জেঠিমা না তোদের সম্পর্কে সবই জানে তাহলে কেনো এখন সায়নের সাথে…..

সিয়া;; আদি, আমরা যা চাই তা সবসময় পাই না।

আদিবা;; তুই বুঝতে পারছিস অর্নীল ভাই জানলে কি করবে?

সিয়া;; আমি কিছুই লুকাতে চাই না। না অর্নীলের থেকে, না তোর থেকে আর না ই চাচ্চুর কাছ থেকে।

আদিবা;; মানে?

সিয়া;; তুই যখন বাসায় যাবি চাচ্চু কে বলে দিস যে উনি যার সাথে কাজ করে মানে সাগর চৌধুরী সে আর কেউ না তারই আপন ভাই রহমান শেখের খুনি।

আদিবা যেনো কয়েক হাজার ভোল্টের ঝটকা খেলো। চোখ গুলো আপনা আপনিই বড়ো হয়ে কপাল ভাজ হয়ে আসে।

আদিবা;; মানে কি, কি বলিস তুই?

সিয়া;; আর সাগর চৌধুরীই অর্নীলের বাবা। এখন তো বুঝতেই পারছিস। অর্নীলের বাবা আমার বাবার খুনি এটা জানার পরেও কি করে আমি…..

সিয়া হঠাৎ তার বুকের মাঝে হাত দিয়ে চেপে ধরে। জোরে জোরে দম নিচ্ছে। যেনো কেউ তার গলা চেপে ধরেছে। চোখ থেকে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পরে। চোখ বড়ো বড়ো হয়ে আসে। আদিবা তা খেয়াল করে দ্রুত পানি নিয়ে এসে সিয়াকে খাইয়ে দেয়। আর পিঠে হালকা ভাবে চাপড় দিতে থাকে। কয়েক মিনিট পর সিয়া স্বাভাবিক হয়ে আসে।

আদিবা;; আস্তে, তুই জানিসই যে নিজের ওপর জোর খাটিয়ে কিছু করলে এমন সমস্যা হয় তোর। প্রেসার নিতে পারিস না তবুও কেনো নিস!

সিয়া;; কি করবো বল। উপায় নেই। ভেবে দেখেছিস তুই। মা কে কি করে না করি। ভাববে আমি স্বার্থপর। তাই নিজেই মায়া ত্যাগ করে দিলাম।

আদিবা;; হ্যাঁ ওই হিসেব নিয়েই বসে থাকো তুমি। অর্নীল ভাই জানলে না জানি কি করে, এসে যখন তুলকালাম কান্দ বাধিয়ে দিবে তখব বুঝিস।

সিয়া;; ছাড় না এইসব কথা এখন।

দোলা;; সিয়া আদিবা, নিচে নেমে আয়।

আদিবা;; ওই যে জেঠিমা ডাকে, চল।

আদিবা সিয়া কে নিয়ে নিচে চলে আসে। আর সিয়ার আসতেই রুমি সিয়াকে ডাক দিয়ে আদর করে নিয়ে নিজের পাশে বসায়। সিয়াও মুখে মেকি হাসি ঝুলিয়ে রাখে ভদ্রতার খাতিরে।

এভাবেই বেশ সময় কথা বার্তা বলে সায়নের বাবা মা বোন চলে আসে। আর আদিবাও সিয়া কে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে এসে পরে।

রাতে সিয়া ঘরের টুক টাক কাজ করছিলো তার মাঝেই ফোন আসে। সিয়া ভাবে অর্নীলের এই ভেবেই ফোন কেটে দিতে যাবে তখন খেয়াল করে দেখে আননোন বাম্বার। সিয়া রিসিভ করে।

সিয়া;; হ্যালো।

সায়ন;; হ্যালো সিয়া৷

সিয়া;; ওহ আপনি, জ্বি বলুন।

সায়ন;; এখন তো সবই বুঝে গেছো।

সিয়া;; জ্বি অনেক ভালো করেই বুঝেছি।

সায়ন;; আজ কাজের চাপের ফলে তোমার সাথে দেখা করতে পারি নি। মানে বিকেলে আসতে পারিনি। কাল দেখা করি??

সিয়া কিছুক্ষন ভেবে তারপর উত্তর দেয়।

সিয়া;; জ্বি আচ্ছা।


রাত বাজে ১ টা। তখন অর্নীল বাসায় আসে। সাগর চৌধুরীর চোখে পরে অর্নীল কে। তিনি পেছন থেকে অর্নীল কে বেশ কয়েকবার ডাক দিলেও সে না শোনার ভান করে এসে পরে। সিয়া কে আর কলও দেয় নি ভেবেছে একেবারে দেখাই করে নিবে।

আর আদিবা বাসায় গিয়ে পরে আরেক মহা চিন্তায়। সাগর চৌধুরী সিয়ার বাবা কে মেরেছে আর বিল্লাল অর্থাৎ তার বাবা-ই কিনা আবার এই সাগর চৌধুরীর সাথে কাজ করছে। তাহলে তো অবশ্যই বিল্লাল কিচ্ছু জানে না। কারণ যদি জানতো তাহলে জীবনেও কাজ করতো না তার সাথে। আদিবা ঘরের মাঝে পায়চারি করছে আর এগুলো ভাবছে। জাবেদ ওয়াসরুম থেকে বের হয়ে দেখে আদিবা নিজের ভাবনায় মগ্ন।

জাবেদ;; এতো কিসের ভাবনা-চিন্তা তোমার?

আদিবা;; না না এমনি।

জাবেদ;; না, কিছু তো হয়েছে। বলো

আদিবা;; আরে কিছু না।

জাবেদ;; সিওর?

আদিবা;; হ্যাঁ।

জাবেদ;; আচ্ছা।

আদিবা;; আচ্ছা জাবেদ, শুনো না।

জাবেদ;; হ্যাঁ বলো।

আদিবা;; সকালে আমাকে একটু বাবার বাসায় নামিয়ে দিবে যাবে!

জাবেদ;; আরে এটা কোন ব্যাপার, ধুর পাগলি। আচ্ছা আমি কাল অফিসে যাওয়ার আগেই বাবার বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে যাবো কেমন! এবার এই সব হাবিজাবি চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে ঘুমাও তো ঘুমাও।

আদিবা;; হুমমম।

এক একজনের মাথায় এক এক রকমের বুদ্ধি ঘুর পাক খাচ্ছে। সবাই নিজের পরিস্থিতি থেকে বুঝতে পারছে যে আসলে ব্যাপার টা ঠিক কতোটা কঠিন। সাগর চৌধুরী ভাবছে কীভাবে সিয়াকে অর্নীলের মন থেকে মুছে ফেলা যায়। দোলা চিন্তায় আছে নিজের মেয়ে কে নিয়ে। এই ভেবে যে সাগর চৌধুরী সিয়ার আবার কোন ক্ষতি যেনো করে না বসে। আদিবা ভাবছে সব ঠিক করতে হবে সবার আগে তার বাবার সাথে এই ব্যাপারে কথা বলতে হবে। সায়ন ভাবছে সিয়ার সাথে বিয়ে করে ঘর-সংসার করার বুদ্ধি। কেননা সায়ন মনে মনে সিয়া কে বেশ পছন্দ করে ফেলেছে। সিয়া ভাবছে নিজের পরিবারের ওপর যেনো কোন আচড় না আসে। আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে। তো যাই হোক না কেনো সব যেনো ভালোই হয়। নিজে যেনো ভেঙে না পরে ঠিক থাকতে পারে। আর অর্নীল ভাবছে দুনিয়া উল্টে যাক তবুও সিয়া তার হয়ে থাক। কিচ্ছু লাগবে না শুধু সিয়া কে চাই। অতীতে কার সাথে কি হয়েছে কি না হয়েছে তা দেখার বিষয় অর্নীলের না, ব্যাস সিয়া হলেই হবে। এ যেনো এক ভুল-ভুলাইল্লা তে সবাই ফেসে গেছে।





চলবে~~