সবটাই তুমিময় পর্ব-২১+২২(বোনাস পর্ব)

0
852

#সবটাই_তুমিময়
#লেখনিতে-মিথিলা মাশরেকা
পর্বঃ২১

-বাবা মাকে পালিয়ে,ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো বলে দাদু তাকে
ত্যাজ্য করে দিলো?শুধুমাত্র তার পছন্দে তোমাকে বিয়ে করেনি বলে এতোটা রাগ তার মনিমা,যে আমাকেও গ্রহন করলো না সে?

মাথায় হাত বুলাচ্ছিলো মনিমা।তার হাত থেমে গেলো।ভোরের আলো ফোটার আগেই অঙ্কুরের ড্রাইভার এ বাসায় পৌছে দিয়ে গেছে আমাকে।ব্যালকনিতে দাড়িয়ে কফি মগে চুমুক দিতে দিতে নিরবে আমার চলে আসাটা দেখেছেন অঙ্কুর।আমি এখানে আসাতে মনিমা অবাক হলেও,খুশিও হয়েছিলো।তার চোখজোড়া খুজে চলছিলো অঙ্কুরকে।

উনি আসেননি বলাতে উচ্ছাসটা মুহুর্তেই বেরঙ হয়ে গেলেও,হাসিমুখে মনিমা বুকে জরিয়ে নিলো আমাকে।নিজহাতে খাইয়ে দিলো।তারপর হাতে ধরিয়ে দিলো দুটো ফটোফ্রেম।একটাতে মা বাবার বরকনে সাজ,আরেকটাতে আমাকে কোলে রেখে,তিনজনে।ফ্যামিলি ফটো।মনিমার কোলে মাথা রেখে ছবিদুটো বুকে জরিয়ে শুয়েছিলাম।আমার মাথায় হাত বুলাচ্ছিলো মনিমা।প্রশ্নটা শুনে একপ্রকার আটকেই গেলো সে।উঠে বসে আবারো বললাম,

-বলোনা মনিমা?কোথায় থাকে আমার দাদু,দাদীমা?আমার সাথে কেনো এমনটা করছে?আমি কি দোষ করেছি?কোনোদিনও কি মানবে না তারা আমাকে?

মনিমা একটা জোরে শ্বাস ফেলে আমার গালে হাত রেখে বললো,

-ওনারা গ্রামে থাকেন।দুটো ছেলেই শুধু।তোর বড় চাচ্চু লেখাপড়া করেননি।গ্রামেই বাবার জমিজমা দেখাশোনা করেন।তোর দাদুভাই খুব শখ করে শহরে পাঠিয়েছিলো তোর বাবাকে।পড়ালেখা করে তার নাম উজ্জল করবে বলে।হচ্ছিলোও তাই।কিন্তু এই বিয়েটা…আমার উপরও রাগ তার।তোর বাবা মায়ের মৃত্যুসংবাদ শুনেছে তারা।কেদেছেও।আমার এখন মনে হয়,আমি তোর দায়িত্ব নিয়েছিলাম বলেই হয়তো তোকে মানতে চায়না তারা।

-তোমার কোনো দোষ নেই মনিমা।তুমিতো নতুন জীবন দিয়েছো আমাকে।দাদু,দাদীমা বোঝেনি।কিন্তু আমার নানুবাড়ির লোকজন?ওরা কেমন?

-পরবর্তীতে আর তাদের খবর নেই নি আমি আন্নু।তোকে আকড়ে স্বার্থপরের মতো বাচতে চেয়েছিলাম।

-না মনিমা।তুমি স্বার্থপর নও!নিজেকে এটা বলে আমার গ্লানি বাড়িও না প্লিজ!

মনিমা মৃদ্যু হেসে বললো,

-তোর বাবা মার ফ্লাটে গিয়েছিলাম আমি।ওখান থেকেই তোর মায়ের শাড়ি গয়না পেয়েছিলাম।ওদের বিয়ের ছবি আর তোর সাথের এই ছবি দুইটা।ভেবেছিলাম ওখানেই থেকে যাই তোকে নিয়ে।কিন্তু অঙ্কুরের বাবা সেদিনই ফোন করে জানালো ও বাসাটাও পুড়িয়ে দেবে কেউ।কে,বা কারা জিজ্ঞাসা করেছি।বলেনি।শুধু বলেছিলো নয়বছর এক ছাদের তলায় থেকেছি তোমার সাথে।জেনেশুনে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে চাই না।তাই ওখান থেকে চলে যাও।চলে আসি তোকে নিয়ে।তারপর সত্যিসত্যিই কেউ আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিলো ওই ফ্লাট।

মনিমা চোখ মুছলো।সাথে আমিও।এরমাঝে আস্থা,তানহা হাজির।মনিমা ফোন করেছিলো ওদের।তিহান অফিসে বলে আসবে না বলেছে।ওর চাকরিটা নিয়ে মনিমাও খুশি,তাই জোর করেনি।নিজেকে সামলে উঠে দাড়ালাম।ওরা এসে জরিয়ে ধরলো আমাকে।এক অদ্ভুত খুশির ঝলকানি দুজনের চেহারাতেই।নিমিষেই মনটা তৃপ্তিতে ভরে উঠলো।তানহার খুশির কারন তিহানের চাকরিটাতে জয়েন করা,আর আস্থা খুশি একদিন রোহান ভাইয়ার কাছে লিফট্ পেয়ে।যদিও রোহান ভাইয়া বলেছেন সে নাকি অঙ্কুরের জোরাজুরিতে বাধ্য হয়েছিলেন ওকে ড্রপ করতে,সেটা কানে তোলেনি ও তা বোঝাই যাচ্ছে।সারাদিন আড্ডা দিলাম তিনজনে।আস্থার বাবা এদিক দিয়েই যাচ্ছিলো,ওকে নিয়ে গেছে।তানহাও বেরোবে এখন।ওর গাড়ির কাছে দাড়ালাম দুজনে।তানহা বললো,

-কিছু পেয়েছিস?

-উহুম।

-এভাবে আর কতোদিন চলবে?

-জানিনা।তবে হাতে সময় নেই একদমই।তাছাড়া অনিক আফতাবকেও তার ডেরা থেকে টেনে বের করতে হবে।

তানহার ফোন বেজে উঠলো।রিসিভ করে ওপাশ থেকে কিছু শুনে তানহা বললো,

-ঠিকাছে পাপা।তুমি নতুন কেনো,তবে আপাতত এটা থাকুক।আমি সব ডিটেইলস্ চেক করে দেবো।মাম্মি তো বলেছে এ মাসে আসবে না।ল্যাপটপটাতে ইম্পর্টেন্ট কিছু ডকুমেন্টস্ আছে।ওগুলো চেক না করে….

আটকে গেলো ও।চকচকে চোখে আমিও তাকিয়েছি ওরদিকে।

-পরে কথা বলছি পাপা।

ফোন কাটলো তানহা।আমাকে বললো,

-বুঝেছিস?

মাথা দুলালাম।ও দু হাতের তালু এক করে বললো,

-ব্যস।তাহলে তো হলোই।এএসএ’র পিসিতে কিছু না কিছু তো থাকবেই।ওগুলো একবার হাতে পেলেই….

পরপরই চুপ করে গেলো ও।চিন্তিত স্বরে বললো,

-কিন্তু আন্নু?পাসওয়ার্ড?

একটু থেমে গেলাম আমিও।তানহা বললো,

-এতো সহজে কি এএসএ কাউকে ধরতে দেবে ওটা?তার ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড অবশ্যই এমন কিছু হবে যা কেউ ধারনাও করতে পারবে না।

একটু ভেবে বাকা হাসলাম।তানহা সন্দেহ নিয়ে বললো,

-পারবি?

-পারবো।পারতে তো আমাকে হবেই।তুই আয়।

আবারো জরিয়ে ধরে গাড়ি করে বেরিয়ে গেলো ও।বাসায় ঢুকলাম।কিন্তু রাত কিছুটা গভীর হতেই আরেকটা গাড়ি থামলো আমাদের বাসায়।সাথে অঙ্কুরের ম্যাসেজ,গাড়ি পাঠিয়েছি,চলে এসো।মনিমাকে বিদায় জানিয়ে রাতের আধারে আবারো পাড়ি জমালাম সেই নন্দিত নরকে।

.

সকাল এগারোটা।অঙ্কুর বিছানায় বসে ল্যাপটপে মগ্ন।সকাল থেকে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করেছি।সফ‌লও ছিলাম।কিন্তু এবার আসল অগ্নিপরীক্ষা শুরু।একটা শুকনো ঢোক গিলে,জোরে শ্বাস নিয়ে শক্ত করলাম নিজেকে।অঙ্কুরের সামনে দাড়িয়ে বললাম,

-একটা হেল্প করবেন?

ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে অঙ্কুর বিস্ফোরিত চোখে তাকালেন আমার দিকে।শান্ত দৃষ্টি স্থির রাখলাম আমি।উনি ল্যাপটপ ছেড়ে এগিয়ে আসলেনচরম বিস্ময় নিয়েই বললেন,

-কি বললে তুমি?

-আ্ আমার আপনার একটা হেল্প চাই।

-মানেহ্?

-আই নিড ইওর হেল্প।

অঙ্কুর দুহাতে বুকের বা পাশ চেপে ধরলেন।তীব্র কষ্ট হচ্ছে তার এমন একটা ভঙিমা করে কি বুঝে আমার চোখ থেকে চশমা খুলে নিলেন।চশমাটা নিজের চোখে এটে দিয়ে বললেন,

-হোয়াট?আমি ঠিক শুনলাম তো?তুমি…আমার কাছে হেল্প চাইছো?আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না নিজের কানকে!অদ্রি?তুমি ঠিক আছো তো?এই নাও,চশমা পরেছি।এবার ঠিক শুনবো।তুমি আরেকবার বলো তো?কি বললে?

-যদি সাহায্য করার হয় করুন,নয়তো এসব কথা বলে শুধুশুধু নিজেকে হ্যাংলা প্রমান করবেন না।

উনি ঠোট টিপে হেসে চশমাটা ফিরিয়ে দিলেন।বুকে হাত গুজে হেসে‌ বললেন,

-কিডিং!বলো কি হেল্প লাগবে?

-আসলে,চুলে একটু লেবুর রস দেবো।নিজে নিজে হ্যান্ডেল করতে পারছি না।ও বাসায় থাকতে মনিমাই দিয়ে দিতো।এখানে আসার পরে তো….

অঙ্কুর বড়বড় চোখে তাকিয়ে থেকে শব্দ করে পেট ধরে হাসতে লাগলেন।চুপচাপ হাসিটা দেখলাম শুধু।কেমন এক শীতল হাওয়া অনুভব করলাম মনপ্রান জুড়ে।অনেকক্ষন পর উনি কোনোমতে হাসি থামিয়ে বললেন,

-লাইক সিরিয়াসলি?অলরাউন্ডার এএসএ এখন তোমার চুলে লেবুর রস দিয়ে দেবে?

উনি আবারো হাসতে লাগলেন।কিছু না বলে চলে আসবো বলে পা বাড়ালাম।পেছন থেকেই চুলে টান পরলো।ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখি অঙ্কুর আমার চুল আঙুলে পেচিয়ে রেখে বাকা হাসছেন।বললাম,

-সাহায্য করবেন না,চুল ধরেছেন কেনো?লাগবে না আপনার হেল্প!ছাড়ুন!

উনি একটান লাগালেন।ব্যথা পেয়েছি,তবে টাল সামলাতে না পেরে তার বুকে পিঠ ঠেকেছে আমার।উনি ফিসফিসিয়ে বললেন,

-একবারও বলেছি?লাগিয়ে দেবো না?রাগ সবসময় নাকের ডগায় এসেই থাকে আপনার তাইনা মিস পর্বতশৃঙ্গ?

অঙ্কুর চুল ছেড়ে আমাকে ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসিয়ে দিলেন।খুব যত্ম সহকারে বাটিতে থাকা লেবুর রস নিয়ে চুলে হাত বুলাতে লাগলেন উনি।দেওয়া শেষে আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন,

-এসবের প্রয়োজন হয়না তোমার।এমনিতেও….

কথা শেষ না করে চুলে নাক ছুইয়ে,চোখ বন্ধ করে,জোরে শ্বাস নিয়ে,মুচকি হাসলেন উনি।আয়নায় পুরোটাই দেখলাম।অঙ্কুর ওয়াশরুমের দিকে যাচ্ছিলেন হাত ধোয়ার জন্য।তাড়াতাড়ি উঠে দাড়িয়ে বললাম,

-কোথায় যাচ্ছেন?

উনি ভ্রুকুচকে তাকালেন।মুখে হাসি ফুটিয়ে তারদিক এগোলাম।ওড়নায় তার হাত মুছিয়ে দিতে দিতে বললাম,

-থ্যাংক ইউ।

অঙ্কুর এতো বড়বড় চোখে তাকিয়েছেন যেনো চোখজোড়া বেরিয়ে আসবে তার।অনেকটা সময় পর উনি ফু দিয়ে শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বললেন,

-ইটস্ গেটিং কমপ্লিকেটেড।মানতে পারছি না।

-মানতে বাধ্য করিনি আপনাকে।নিজের কাজ করুন।

এটুক বলেই সরে আসলাম।উনি আবারো কপাল কুচকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষন।তারপর মাথা নাড়তে নাড়তে গিয়ে ল্যাপটপ কোলে তুলে বসলেন।আমি গুটিগুটি পায়ে ব্যালকনির থাই গ্লাসের দরজার কাছে গিয়ে দাড়িয়েছি।যেইনা ল্যাপটপে উইন্ডোজ ওপেন হওয়ার শব্দ,আর্তনাত করে উঠলাম।দরজা লাগাতে গিয়ে আঙুল চাপা পরেছে।অঙ্কুর তৎক্ষনাৎ ল্যাপটপ ফেলে ছুটে এসে আঙুল ধরলেন আমার।বেশ খানিকটা কেটে গেছে।উনি আমার আঙুল নিয়ে ব্যস্ত।আর আমি আড়চোখে দেখলাম ল্যাপটপের সুইচ অফ।

-কি করো কি তুমি?সাবধানে কাজ করতে পারো না?কে বলেছে এখন দরজা লাগাতে?

ধমকাতে লাগলেন অঙ্কুর।তারপর আমার হাত ছেড়ে হন্ন হয়ে এদিকওদিক ছুটতে লাগলেন।বুঝলাম ফার্স্ট এইড বক্স খুজছেন উনি।বললাম,

-কাল মাথাব্যথা করছিলো,ওষুধের জন্য ফার্স্ট এইড বক্সটা পুরোটা ধরে ওই রুমে নিয়ে গিয়েছিলাম।আনার কথা মনে নেই।

বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকালেন উনি।তারপর বেরিয়ে গেলেন।তাড়াতাড়ি ল্যাপটপটার দিকে এগোলাম।অন করতেই লেখা এগারো ডিজিটের পাসওয়ার্ড।কিবোর্ডের প্রতিটা অক্ষরের উপর লিটমাস পেপার ছড়াতে লাগলাম আমি।লেবুর রস লেগে থাকা হাতে সবেমাত্র এই কিবোর্ড ছুয়ে পাসওয়ার্ড দিয়েছেন উনি।এবার যে যে বর্ন উনি ছুয়েছেন,সে বর্নগুলোর উপর রাখা লিটমাস পেপার কালার চেন্জ করবে।ঘটলোও তাই।একে একে অল্পবিস্তর রঙ বদলাতে লাগলো কিবোর্ডের উপরের লিটমাসের কাগজগুলো।E,Y,U,O,A,L,V,M,আর স্পেস বাটন।আরেকটা কাগজে টপাটপ লিখে নিলাম বর্নগুলো।

গুনে দেখলাম ওখানে নয়টি বাটন ব্যবহার করা হয়েছে।কিন্তু পাসওয়ার্ড এগারো ডিজিটের।তারমানে বাকি দুটোও এগুলোর মধ্যেই।যেকোনো দুটো বর্ন,দুইবার ব্যবহার হয়েছে।একটা শুকনো ঢোক গিললাম।অঙ্কুর আসার আগেই তাড়াতাড়ি সরিয়ে ফেললাম কাগজগুলো।ইচ্ছে করেই ফার্স্ট এইড বক্স এমন জায়গায় রেখেছিলাম যাতে খুজতে সময় লাগে তার।

অঙ্কুর ফার্স্ট এইড বক্স হাতে ভেতরে ঢুকলেন।দরজায় দাড়িয়ে শান্তভাবে চারপাশটা দেখে নিলেন উনি।যদিও ততক্ষনে এদিকের সবটা আগের মতোই করে ফেলেছি,তবুও কেমন যেনো ভয়ভয় করছিলো।উনি এগিয়ে এসে চুপচাপ ওষুধ লাগাতে লাগলেন আমার হাতে।ওষুধ লাগানো শেষে একবার আঙুলে ফু দিয়ে বললেন,

-নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রাভঙ্গ বোঝো অদ্রি?

বিস্ফোরিত চোখে তাকালাম আমি।কোনোভাবে উনি কি কিছু আন্দাজ করেছেন?কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব?অঙ্কুর আমার আঙুলেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ছিলেন।মাথা তুলে হেসে দিয়ে বললেন,

-আরে আরে?এমন করে কেনো রিয়্যাক্ট করছো?তারমানে সত্যিই এমনটাই প্লান তোমার তাইনা?

-মানে?ক্ কি‌সব আবোলতাবোল বলছেন এসব?

-আবোলতাবোল?আমার তো মনে হলো তুমি ইচ্ছে করেই হাতে লাগালে।যাতে আমি বাসার বাইরে না যাই,তোমার সেবায় নিয়োজিত থাকি,বরের এটেনশন পাও।এটসেট্রা,এটসেট্রা!মুলত হাত কাটার বাহানায় আমাকে পাশে চাও তুমি!

শ্বাস নিলাম আমি।অতপর তারদিক চোখ তুলে তাকিয়ে বললাম,

-হাত কাটা কেনো?মৃত্যুমুখেও আপনাকে পাশে চাইনা আমার!

উনি মুচকি হেসে আমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে বললেন,

-সেটাতো সময়ই বলবে।

আবারো ল্যাপটপ কোলে নিয়ে বিছানায় বসে গেলেন উনি।বিশ্বজয়ের হাসি ছিলো আমার চেহারায়।আপনার ম্যাচের এখনো চারদিন বাকি অঙ্কুর।আর এ চারদিনে,এই নয়টা বর্নের সবরকমের বিন্যাস আমি বের করে নেবো।ঠিক বের করে নেবো,পাসওয়ার্ডটা কি!যে করেই হোক,আপনার ওই ল্যাপটপ তো আমি খুলবোই!আর একইভাবে আপনার মুখোশও টেনে খুলে দেবো সবার সামনে।জাস্ট ওয়েট,এন্ড ওয়াচ মিস্টার আরিয়ান সার্ফরাজ অঙ্কুর!

#চলবে….

#সবটাই_তুমিময়
#লেখনিতে-মিথিলা মাশরেকা
বোনাস পর্ব🎇🎇

মাঝে পুরো একটা দিন কেটে গেছে।অঙ্কুর বাসায় ছিলেন না।সে সুযোগে আমার সারাটা দিন কেটেছে খাতাকলমে।সারাদিনে ওই নয়টা বর্নের হাজারটা বিন্যাস বানিয়ে ফেলেছি।লাভ হয়নি।কোনোভাবেই কোনো শব্দ মেলাতে পারি নি।আরো বেশি ঝামেলায় পরেছি কোন দুটো বর্ন দুইবার ব্যবহার হয়েছে এ নিয়ে।

শেষমেষ সিদ্ধান্ত নিলাম এবার বুদ্ধিটাই কাজে লাগাতে হবে।অঙ্কুরকে দিয়েই তার ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড বের করাতে হবে।এইসবই ভাবছিলাম ব্যালকনিতে দাড়িয়ে।হঠাৎই কোথথেকে একটা বল এসে সামনে পরলো আমার।ভাবনায় এতোটা মগ্ন ছিলাম,বলটা ব্যালকনিতে পরায় আতকে উঠেছি একপ্রকার।লাফিয়ে পিছিয়ে গেলাম।কেউ হাক লাগিয়ে বললো,

-তুমি ভয়ও পাও?

এগিয়ে এসে রেলিং ধরে নিচে তাকালাম।অঙ্কুর!উনি কখন আসলেন?কোটসুট পরে ফর্মাল ড্রেসে বেরিয়েছিলেন উনি।এখন ওটা ছেড়ে একটা খয়েরি টিশার্ট আর গ্রে প্যান্ট পরে আছেন।তারমানে রুমে ঢুকে চেন্জও করেছেন উনি।কখন?খেয়ালই করিনি।আমাকে ডাকেন নি কেনো?উনি মুখে হাত দিয়ে গলা উচিয়ে বললেন,

-বলটা পাস করো!

হাতে নিলাম বলটা।এটা বাস্কেটবল খেলার বল।উকি দিতেই দেখলাম নিচে একটু দুরেই পোলে বাস্কেট আটকানো।যা আগে কখনো চোখে পরেনি আমার।হয়তো চাইনি দেখতে।ব্যালকনি থেকেই বাস্কেট লক্ষ্য করে বলটা ছুড়লাম।ওটা সোজা বাস্কেট হয়েই পরলো।অঙ্কুর দেখে বললেন,

-বাস্কেটবলটা ভালোই পারো মনে হচ্ছে?

চুপ রইলাম।অনেক খেলেছি বাস্কেটবল।জিতেছি।তাকে কেনো বলবো?উনি বললেন,

-ইফ ইউ ওয়ান্ট?হয়ে যাক কম্পিটিশন?মানে মেইনটার আগে একটা ট্রায়াল?দেখি,আমাকে ওপোনেন্টে তোমার জেতার সম্ভবনা কতো!

যদিও জানি,উনি স্পোর্টম্যান,খেলাধুলায় পারদর্শীই হবেন,তবুও তার প্রকাশ্য চ্যালেন্জকে মানা করতে পারলাম না।জীবনে চুড়ান্তবার হারানোর আগে একবার এই খেলাতেই হারিয়ে দেখাই আপনাকে মিস্টার অঙ্কুর!ডেমো দিতে তো দোষ নেই কোনো।বাসা থেকে বেরিয়ে এসে তার সামনে এসে দাড়ালাম।উনি বাকা হেসে বললেন,

-সত্যিই চলে এলে চ্যালেন্জ নিতে?

-হ্যাঁ।আসলাম…জিততে।

-হুম?তারমানে তুমি বলতে চাইছো আমাকে হারাবে?এএসএ’কে?

-আগেই বলেছি তো,আপনিও জানেন,আপনাকে হারাবো বলেই এখানে আসা আমার।

-নট ব্যাড!আই লাইক ইওর স্পিরিট!বেশ।তবে হয়ে যাক?তিনবার বাস্কেটের জন্য বল ছুড়বো।প্রথম দুবার ট্রায়াল,তৃতীয়বার ফাইনাল।

-ডান!

বাস্কেট থেকে বেশ কিছুটা দুরে মুখোমুখো দাড়ালাম দুজনে।বল উপরে ছুড়ে মারলেন উনি।লাফিয়ে উনিই আগে ধরেছেন।বাউন্স করাতে করাতে এগোচ্ছিলেন উনি।এক পর্যায়ে ছো মেরে নিয়ে নিলাম বলটা।উনি পথ আগলানোর চেষ্টা করতে করতে বললেন,

-নাইস প্লে!তবে আমার কাছে এখনো শিষ্য তুমি অদ্রি।আর আমি খুব ভালো গুরু ট্রাস্ট মি।একদম হাতে ধরে শেখাবো তোমাকে ওয়েট!

উনি কেড়ে নিলেন বলটা।বাউন্স করিয়ে বললেন,

-লেসন নাম্বার ওয়ান,কনফিডেন্স ভালো,তবে ওভারকনফিডেন্স ভালো না।

তার এ কথার মাঝেই আমি ছিনিয়ে নিয়েছি বল।উনি তখনো বলছেন,

-ওভার কনফিডেন্সের জন্য হারতে হতে পারে তোমাকে অদ্রি।কাউকে আন্ডারেস্টিমেট করো না।এমনটা না হয়,সেখানটাতেই তোমার হারের শুরু।শেষ মুহুর্তে তোমার সাজানো প্লানটা ভেস্তে দেওয়ার ক্ষমতা রাখতে পারে সে।

বাস্কেট অবদি পৌছে গেছি।বাস্কেটের জন্য সবে বল ছুড়বো,কথাগুলো শেষ করেই আমার হাত থেকে অঙ্কুর ছিনিয়ে নিলেন বলটা।মুহুর্তেই কি হয়ে গেলো বুঝে উঠিনি।রীতিমতো বল বাস্কেট করেছেন উনি।রাগে পা ছুড়লাম।এমন হার প্রত্যাশিতো ছিলো না আমার।একটা শ্বাস নিয়ে তবুও এসে দাড়ালাম দ্বিতীয় বাস্কেটের জন্য।অঙ্কুর মাথায় আঙুল ঠেকিয়ে তার কথাগুলো মাথায় রাখতে বোঝালেন আমাকে।বল উপরে ছুড়লাম আমিই।এবার বলও আমিই ধরলাম।বাউন্স করিয়ে বাস্কেটের দিকে এগোচ্ছিলাম খুব সাবধানে।অঙ্কুর বল কাড়ার চেষ্টায়।আগেরবারের রাগটার জন্য বল ছুতেও দেইনি এবার তাকে।উনি বললেন,

-লেসন নাম্বার টু,রাগ সবসময় সফলতার অন্তরায়।রাগকে জয় করে মন দিয়ে লক্ষ্য নির্ধারন করতে হয়।যা মন থেকে করার চেষ্টা করবে না,তা কখনোই পারবে না তুমি।

এটুকো বলে আবারো প্রথমবারের মতো বল কেড়েছেন উনি।বাস্কেটেও ফেলেছেন।কিন্তু এবার বাস্কেট করেছেন আমার দিক তাকিয়ে থেকে।পুরোই উল্টোদিক ফিরে।অঙ্কুর একটা বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে বললেন,

-টোল্ড ইউ!আমার সাথে কম্পিট করতে এসো না!

-লাস্ট আর ফাইনাল রাউন্ড এখনো বাকি অঙ্কুর।

উনি বাকা হেসে বললেন,

-হার মানো নি তবে?

-আপনার লেসনের মধ্যে এটাও এড করুন অঙ্কুর।জয় তারই হয়,যে হার মানতে জানে না।

মুচকি হেসে তৃতীয়বার বল ছুড়লেন উনি।বল আমার হাতে ছিলো।এবার যথেষ্ট সতর্কভাবে খেলছিলাম আমি।বেশ অনেকটা সময় অঙ্কুর আটকেছিলেন আমাকে।কিন্তু সুযোগ বুঝেই একসময় তাকে পাশ কাটিয়ে বল বাস্কেটে ছুড়ে মারলাম।এটা একটা বাস্কেট ছিলো।এবার জয়ের খুশিটা আমার হাজারগুন ছিলো।কারন এটাই ফাইনাল রাউন্ড ছিলো।অঙ্কুর কোমড়ে হাত দিয়ে বড়সড় হাসি ঝুলিয়ে বললেন,

-এন্ড লেসন নাম্বার থ্রি,কখনো কখনো হেরে যাওয়ার মধ্যেই জিতে যাওয়ার চেয়ে হাজারগুন বেশি প্রশান্তি অনুভব হয়।যা পৃথিবীর বাকি সবরকমের জয়ের খুশির উর্ধ্বে।তাই হার মানতেও শিখতে হয়।

তীক্ষ্মচোখে তাকিয়ে হেরে যাওয়ার পরও তার চেহারার ওই খুশির হাসিটা দেখছিলাম আমি।পাশেই একলোক গাছে পানি দিচ্ছিলো।উনি বললেন,

-স্যার হেরে গেলেন?আপনি তো বরাবরই জিততে ভালোবাসেন।

অঙ্কুর হেসে বললেন,

-ভালোবাসা?এই শব্দটা অঙ্কুরের সাথে যায় না।তাইনা অদ্রি?

চোখ সরিয়ে নিলাম।হুট করেই মনে পরলো সত্যিই তাই।এটা তার সাথে যায় না।এটা তার বিপরীত।এটা যে তার পাসওয়ার্ড হবে তা কেউ কল্পনাও করবে না।চোখ চকচক করে উঠলো আমার।পরপরই নিজেকে সামলে বললাম,

-আপনি হেরে গেছেন।যাবেন।আসছি।

অঙ্কুর মাথা নিচু করে হাত বাড়িয়ে বাসারদিক ইশারা করলেন।মোটামুটি একছুটে রুমে চলে এসে দরজা লাগিয়ে দিলাম।বর্নগুলোতে চোখ বুলালাম আরেকবার।E,Y,U,O,A,L,V,M,আর স্পেস বাটন।একটা শ্বাস নিয়ে আগে প্রথম শব্দটাই লিখলাম।অঙ্কুরের বিপরীত।LOVE!হাত কাপছে আমার।স্পেস ব্যবহার করে আর বাকি থাকে U,Y,A,M.
Y আর U দেখে চোখ বন্ধ করে LOVE এর পর স্পেস রেখে YOU লিখে দিলাম।ধক করে উঠলো ভেতরটা।A আর M শুধু বাকি আছে।আর যা দিয়ে একটা শব্দই সম্ভব।মা।কাপাকাপা হাতে পুরোটাই লিখে নিলাম আমি।এগারো ডিজিটের পাসওয়ার্ডটা ছিলো LOVE স্পেস YOU স্পেস MA.অঙ্কুরের ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড,লাভ ইউ মা!

এটা কি করে সম্ভব?উনি তো মনিমাকে ঘৃনা করেন!হ্যাঁ।এজন্য সম্ভব!কেউ ধারনাও করতে পারবে না তার পাসওয়ার্ড লাভ ইউ মা হতে পারে।শতভাগ নিশ্চিত হলাম আমি,এটাই তার পাসওয়ার্ড।দরজা খোলার শব্দে তাড়াতাড়ি আড়াল করলাম কাগজগুলো।অঙ্কুর এসেছেন।চেন্জ করে একপ্রকার রেডি হয়ে এসেছেন উনি।যেনো কোথাও যাচ্ছেন।উনি দরজাতে দাড়িয়ে বললেন,

-আজ বাইরে ডিনার করবো।ফিরতে দেরি হবে।তুমি খেয়ে নিও।

উত্তর দেয়নি কোনো।উনি বেরিয়ে যাচ্ছিলেন।দরজা লাগাতে গিয়ে আবারো থেমে গিয়ে বললেন,

-বি হোয়াট ইউ আর অদ্রি।জোর করো না নিজেকে অন্যকিছু সাজানোর জন্য।জোর করো না।

উনি বেরিয়ে গেলেন।চুপচাপ পিছনপিছন এসে ব্যালকনির একটু আড়ালে দাড়িয়ে দেখলাম গাড়িতে করে বেরোচ্ছেন উনি।একদৌড়ে তার রুমে আসলাম।দরজা লাগিয়ে কাপাকাপা হাতে ধরলাম ল্যাপটপটা।পাসওয়ার্ড দিতেও হাত কাপছে প্রচন্ড।ভয় লাগছে।আর সবচেয়ে অদ্ভুত অনুভুতি!দ্বিধায় পরছি বারবার।বারবার মনে হচ্ছে কোথাও ভুল করছি আমি।যেখানে আমি জানি,অঙ্কুর দোষী।উনি নিজে স্বীকার করেছেন।একটা জোরে শ্বাস নিয়ে পাসওয়ার্ড টাইপ করলাম।LOVE YOU MA.

ল্যাপটপের লক খুলে গেলো।নিজেকে সামলে একে একে সমস্ত ডকুমেন্ট,ফাইল ওপেন করে দেখতে লাগলাম।কিন্তু সেখানে যা যা দেখলাম,তার অনেক কিছুই মানতে পারছিলাম না।অবিশ্বাস্য লাগছিলো।তব্দা মেরে বসে রইলাম।মাথা কাজ করছিলো না।এরমধ্যেই কেউ বলে উঠলো,

-লেবুর রসে থাকা সাইট্রিক এসিড নীল লিটমাসকে লাল করে।সাইন্সটা বেশ ভালোই কাজে লাগিয়েছো তুমি অদ্রি।হ্যাটস্ অফ টু ইউ!তবে এই সাইন্স আমিও কিছুটা জানি।আর তার সাথে তোমার মতো ট্রিকস্ও!

#চলবে…