#সবটাই_তুমিময়
#লেখনিতে-মিথিলা মাশরেকা
পর্বঃ২৫
হানিমুন!!!শব্দটা কয়েকবার কানে বাজলো আমার।সকাল সকাল ঘুম ভাঙার পরপরই এতোবড় একটা কথা শুনে মোটামুটি শকে পরে গেছি।বিয়েটা স্বাভাবিক হলে,এ শব্দটাও স্বাভাবিক লাগতো আমার।কিন্তু বিয়েটাই তো চুক্তির বিয়ে।দু বছরের।বেবির জন্য শুধু।বেবির কথা মাথায় আসতেই নিস্তেজ হয়ে গেলাম।বেবির জন্য হলে কেনো এখনো অঙ্কুর কাছে আসেননি আমার?কেনো আমার সমর্থন জেনেও এমন অদ্ভুত ব্যবহার করছেন উনি?আকাশকুসুম ভাবতে ভাবতেই ওয়াশরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন অঙ্কুর।চিকন স্লিভস্ গেন্জি আর ট্রাউজার পরে।মাথা মুছতে মুছতে ব্যাগ,লাগেজ,জামাকাপড় নামাতে শুরু করলেন উনি।আমি বেডেই বসে।উনি ব্যস্ততা থামিয়ে আমার দিক তাকিয়ে বললেন,
-এভাবে বসে আছো কেনো?প্যাকিং করো!হানিমুন যেতে হবে তো!
-মানে?ক্ কোথায়?
-হানিমুন!হানিমুন!বাংলা মানে মধুচন্দ্রিমা!এন্ড ইটস্ ইন সিডনে।সুইডেন যাচ্ছি আজ আমরা।
-আমরা মানে?
অঙ্কুর থেমে গেলেন।তোয়ালেটা চেয়ারের উপর রেখে বেডের দিকে এগোলেন।আমার সামনে খানিকটা ঝুকে দাড়িয়ে বললেন,
-মানলাম তুমি জেনে গেছো বিয়েটা এগ্রিমেন্টাল,তবুও তুমি আমার বউ।দু বছরের হলেও বউ।রাইট?
…..
-তো কোথাও শুনেছো,হানিমুনে বর বউকে ছাড়াই চলে যায়?হানিমুনে আমরা দুজনেই যাবো।
নির্বাক হয়ে শুনছি শুধু তার কথা।এবার শব্দ করে হেসে দিলেন উনি।সোজা হয়ে দাড়িয়ে আলমারী থেকে কিছু একটা বের করতে করতে বললেন,
-ডোন্ট প্যানিক।আমার নেক্সট ম্যাচ সিডনিতে।জায়গাটা সুন্দর।তাই ওখানে তোমাকেও সাথে করে নিয়ে যাবো ভাবছি।
বুঝলাম।হানিমুন কাকে বলে।কিছুটা কড়া গলাতেই বললাম,
-ম্যাচ আপনার,আমি গিয়ে কি করবো?
উনি শার্টের হাতা গুটাচ্ছিলেন।একটু থেমে ঠিকঠাকমতো পরে আমার দিকে ফিরে শান্ত গলায় বললেন,
-তোমাকেই তো আগে প্রয়োজন অদ্রি।
-মানে?
-মানে তুমিও যাচ্ছো।বললাম না?জায়গাটা সুন্দর।ঘুরে আসলে ভালোলাগবে তোমার।এমনিতেও তোমাকে এভাবে বাসায় রাখা নিয়ে মনেমনে অভিশাপ দাও হয়তো।এ সুযোগে বেরোনোও হবে আর তুমি তোমার বান্ধবী,বন্ধু,মনিমাকে বলতে পারবে,হানিমুনে গিয়েছিলে তুমি।আমার মনে হয় দ্বিতীয় কারনটা এনাফ।
আমি কিছু বলার আগেই অঙ্কুর সেই ফাইলদুটো বের করলেন।আটকে গেলাম আমি।উনি কোনোদিক না তাকিয়ে ফাইলদুটো ব্যাগে পুরতে পুরতে বললেন,
-এনাফ!তাইনা?
ফাইলদুটো রেখে এবার আমার দিক তাকালেন উনি।চুপ রইলাম।উনি বললেন,
-এখন যদি তুমি না যাও,এখানে একা একা থাকো,তোমার মনিমা ভাববে না,তার দেখা আর সব ছেলেদের মতো আমিও আমার বউকে ভালোবাসি না।শুধু টাকা ভালোবাসি।ক্যারিয়ার ভালোবাসি।এইসব।তোমার ভালোলাগবে সেটা?
মুচকি হাসলাম।সবগুলো উল্টো নয়কি অঙ্কুর?ভালোবাসেন?আপনার দু বছরের চুক্তির বউকে?টাকা ভালোবাসেন না আপনি?আপনার ক্যারিয়ারকে ভালোবাসেন?তাহলে ম্যাচ ডিল করতে পারতেন?এ প্রশ্নগুলোর উত্তর কি অঙ্কুর?হাহ্!প্রশ্নতাক করবো না আপনাকে।বলেছি তো!এসব প্রশ্ন আমার মনেই থাক!ছোট একটা শ্বাস ফেলে বললাম,
-আপনি তো টিমের সাথে যাবেন।সেখানে আমি কিভাবে…
-তুমি যাবে?
-ঠিকই বলেছেন আপনি।যাওয়ার কারনটা এনাফ।মনিমাকে বলতে চাই হানিমুনে গিয়েছিলাম।তাকে বোঝাতে চাই,বিয়েটা করে অনেক খুশি আমি।পাব্লিক না করার বিষয়টা নিয়ে এখনো আমার উপর রাগ তার।কারন পুরো বিষয়টা আমি নিজের উপরই নিয়েছি।
ওনার বাকা হাসিটা বলে দিলো,তোমার যাওয়ার কারন আমি জানি অদ্রি।মুখে বললেন,
-একচুয়ালি,ইটস্ আ ডিফারেন্ট প্লান।আমি টিমের সাথে কাল সকালে রওনা হবো।এমনটাই ডিসিশন হয়েছে।আর রোহান এক বিজনেস ট্রিপে আজই যাচ্ছে।তো তুমি রোহানের সাথে যাবে।আজ বিকেলেই।বলতে পারো,আমার সাথে তোমার ম্যাচের আগে দেখা হবার সম্ভবনা খুব কম।তবে রোহানকে বলা আছে,ইট উড বি সেইম হোটেল।সো,টেনশন করতে হবে না তোমাকে।
সেইম ঘর না,সেইম হোটেল!আমি আজ রোহান ভাইয়ার সাথে বেরোবো,উনি পরদিন সকালে টিমের সাথে যাবেন।কি দুর্দান্ত প্লান তার!যাকে বলে,সাপও মরবে,লাঠিও ভাঙবে না!আমাকে তার সাথে নিয়ে যাওয়াটাও হবে,কেউ জানতেও পারবে না,এএসএ কাউকে নিয়ে দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়েছেন!কিন্তু আমাকে সাথে নিয়ে যাওয়ার কি কারন?
-ওভাবে আর কতোক্ষন বেডে বসে থাকবে অদ্রি?ফ্রেশ হও?প্যাকিং শেষ করো জলদি!
চুপচাপ উঠে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম।এরমাঝেই অঙ্কুর ফাইলের ব্যাগটা কোথাও সরিয়ে ফেলেছেন।আমাকে বেরোতে দেখে উনি বললেন,
-তোমার কি কিছু শপিংয়ের দরকার আছে?মানে,বাইরে যাচ্ছো,কিছু….
-হ্যাঁ।
-ফাইন।এক কাজ করো তুমি,রেডি হয়ে,মাস্ক পরে,মুখ ঢেকে চলে যেও।ড্রাইভার নিয়ে যাবে তোমাকে।উম্…চাইলে তানহা,আস্থা ওদেরকেও ডেকে নিতে পারো।
মাথা নাড়লাম।এটা বোঝার আর কোনো অবকাশ নেই যে উনি চাননা আমি স্বাভাবিক জীবনযাপন করি।তাকে আর প্রশ্ন করবো না বলেছি,তাই তার কথামতোই সবটা করবো।বেরোবো মুখ ঢেকে।উনি বললেন,
-তোমার মনিমার সাথে দেখা করতে যাবে আরেকবার?
মনিমার কথা মনে পড়তেই চোখ ভরে উঠতে লাগলো আমার।অনিক আফতাব মারা গেছেন।যার সাথে মনিমা নয় বছর সংসার করেছে,সে মানুষটা আর নেই।তিনি যেমনটাই ছিলেন,মনিমার বর ছিলেন।মনিমা তার মৃত্যুর খবর মানতে পারবে?কষ্ট হবে না তার?অঙ্কুরের সবটা জেনেও তার চোখের জল দেখে আমার যে তীব্র কষ্ট অনুভব হয়েছে,সেখানে মনিমার তো…..
-বাবার মৃত্যুর বিষয়টা এখনই কাউকে জানিও না অদ্রি।
অবাক চোখে তাকালাম।অঙ্কুর আবারো বললেন,
-চার চারটে বছরে কাউকে জানতে দেইনি।আমি চাইনা তুমিও কাউকে জানাও।ইটস্ আ রিকুয়েস্ট।
আমার বিস্ময় বাড়লো।কাকে জানাতে মানা করছেন উনি?কোনোভাবে মনিমাকে নয়তো?কিন্তু কেনো?উনি বললেন,
-অনুরোধটুকো রাখবে না?
-আজ প্রথমবার আমাকে বাধ্য না করে অনুরোধ করছেন আপনি অঙ্কুর।কি করে ফেলনা করে দেই বলুন?আপনাকে বললাম না কাল?এবার থেকে আর আমার প্রশ্ন আপনাকে কষ্ট দেবে না।আমার অবাধ্যতার জন্যও আর কষ্ট পেতে হবে না আপনাকে।তেমনটাই হবে,যেমনটা আপনি চান।
কথাটুকো বলেই পেছন ফিরলাম।অনেকটা সময় নিয়ে উনি বললেন,
-আমি বেরোবো।মিটিং আছে।
কোনো সাড়া না দিয়ে ব্যালকনির সামনে দাড়িয়ে আনমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছছিলাম।হুট করেই পেছন থেকে হাতে টান লাগালেন অঙ্কুর।তার সামনে দাড় করিয়ে সামনের কয়েকটা ভেজা চুল কানে গুজে দিয়ে বললেন,
-জীবনের সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজের জন্য তৈরী হও অদ্রি।সব প্রশ্নের জবাব দেবো তোমাকে।সময়…আসন্ন।
অঙ্কুর আমাকে ছেড়ে আমারই সামনে পকেটে হাত গুজে দাড়ালেন।বেশ অনেকক্ষন মৃদ্যু হাসি নিয়ে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে।আর আমি ওই হাসিটার দিকে।উনি আমার দিক তাকিয়ে হাসিটা রেখেই পেছোতে লাগলেন।বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে।বেডে বসে পরলাম আমি।নিজের শরীরকে প্রচন্ড ভারী লাগছিলো।ফোনটা বেজে উঠলো এরমধ্যেই।তানহার ফোন।রিসিভ করলাম।ও উৎফুল্লভাবে বললো,
-কেমন আছিস আন্নু?
-ভালো।তুই?
-ভালো।জানিস আন্নু?আজ আবারো তিহান ফোন করেছিলো আমাকে।
কিছুটা নড়েচড়ে বসলাম আমি।আগ্রহ নিয়ে বললাম,
-সত্যি?ক্ কি বললো রে?
-বেরোতে বলছে।বেতন এডভান্সড্ পেয়েছে কাল।বলছে আঙ্কেল আন্টি আর ত্বোহার জন্য কিছু কেনাকাটা করবে।আমাকে…আমাকে বলছে আমাকে নিয়ে যাবে শপিংয়ে।চুজ করে দেওয়ার জন্য।
খুশিতে চোখ ভরে উঠলো আমার।তানহা বললো,
-এটাও বন্ধুত্ব।তাইনা আন্নু?
-হ্যাঁ।তবে খুব স্পেশাল বন্ধুত্ব।যা খুব তাড়াতাড়িই ভালোবাসার নাম নেবে।দেখিস!
কোনো সাড়া নেই।কাদছে ও।জানি।বললাম,
-তান্নু?সিডনে যাচ্ছি আমরা।
-সিডনে?আর আমরা মানে?
ওকে অঙ্কুরের সুইডেন যাওয়া,আমাকে নিয়ে যাওয়া,সবটা খুলে বললাম।শুধু অঙ্কুরের বাবার বিষয় বাদে।সবটা শুনে তানহা বললো,
-দু বছরের কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ?এটা কি বলছিস তুই?
-এটাই ঘটেছে।আর আমিও মেনে নিয়েছি।এখন শুধু অপেক্ষায় আছি অঙ্কুরের স্বীকারোক্তির।
-এতো সহজে সবটা….
-হ্যাঁ।আপাতত এতো সহজেই ছাড় দেবো অঙ্কুরকে।
-আপাতত?
-ও কিছু না।রাখছি।
-তুই কিছু লুকোচ্ছিস আন্নু!
-তোর কাছে কেনো লুকাবো?
-সেটা তো তুইই জানিস।তবে আমি বলবো,এএসএ যখন বলেছে সবটা বলবে তোকে,আর তুইও ভেবেছিস একটু সময় দিবি তাকে,তবে তাই হোক।নিজের খেয়াল রাখিস।
-হুম।তুইও সাবধানে থাকিস।
কল রাখলাম।সত্যিই এই প্রথম অনেকটা লুকিয়ে গেলাম তোর থেকে তানহা।আমি নিরুপায়।বাবা মায়ের মৃত্যুর কারন আমাকে জানতে হবে,তাদের শাস্তি দিতে হবে।ঠিক খুজে বের করবো তাদের।আর তারপর ভয়ানক সাজা দেবো।অদ্রির কাছে যে তাদের জন্য এক ভয়ংকর মৃত্যুোৎসব সাজানো আছে।ঠিক যেমনটা ওরা করেছিলো,আমার বাবা মায়ের সাথে!
#চলবে….
#সবটাই_তুমিময়
#লেখনিতে-মিথিলা মাশরেকা
পর্বঃ২৬
সিডনি!শীতপ্রধান আবহাওয়ায় স্বল্প সময়ের অতিথি হয়ে আসা গ্রীষ্মটাকে এখানকার মানুষ একপ্রকার উৎসবমুখরভাবে উপভোগ করে।দিনের বেলায় আদুরে নম্র রোদের সাথে রাস্তাঘাটের কিছুটা দগ্ধতাই এখানকার লোকদের জন্য গ্রীষ্মের বিশেষত্ব।বাইরে থেকে,বিশেষত গ্রীষ্মপ্রধান জায়গাগুলো থেকে আসা মানুষজন এ রোদ্দুরে গ্রীষ্ম নয়,বসন্তের আমেজ খুজে পাবে।যেখানে হালকা রোদের সাথে শীতল বায়ুও শরীরমন ছুয়ে যায়।তবে রাতে এর চিত্র বেশ আলাদা।সুর্যের আলোর অনুপস্থিতি খানিকটা শীতের অনুভব এনে দেয়।অন্তত আমার কাছে রাতটা শীতশীত বলেই মনে হয়েছে।
বিলাসবহুল হোটেলের নবম তলার ব্যালকনিতে দাড়িয়ে আমি।সকালের মৃদ্যু রোদে নিজ নিজ কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরা ব্যস্ত শহরবাসীকে দেখছিলাম।সময়ের ব্যবধানে আমার ছোট্ট,স্বাভাবিক জীবনের সবটা অন্যরকম হয়ে গেছে।এখানে এসে পৌছেছি চারঘন্টা পেরিয়ে গেছে।আসার আগে মনিমার সাথে ফোনে কথা হয়েছে,কেনো যেনো দেখা করতে যাওয়ার সাহস হয়নি।বেরিয়েছিলাম আস্থার সাথে,তানহাকে ডাকিনি আর।আসার সময় অঙ্কুরের সাথেও কোনো কথা বলিনি।উনিও চুপচাপ শুধু আমার চলে আসাটা দেখেছেন।ও বাসা থেকে যাত্রাটা পুরোপুরি রোহান ভাইয়ার সাথে।তার পিএ হিসেবে।
রুমে পৌছে দিয়ে রোহান ভাইয়া বেরিয়ে গেছেন।তখন রাত প্রায় শেষের দিকে।এসেই ঘুমিয়ে পরেছিলাম।ঘুম ভেঙেছেও দেরিতে।হোটেল থেকে কিছুটা দুরে একটা সরু রাস্তা আছে।তার ওপাশে লেইক।সে সরু রাস্তাতে জগিং করতে থাকা নারীপুরুষ।কেউ সাইকেলিং করছে,কেউ পাশে দাড়িয়ে ব্যায়াম করছে,কেউ বসেছে আড্ডা দিতে,কেউ বা পাশের দোকান থেকে জুস কিনছে।সবাই যার যার জীবন নিয়ে ব্যস্ত।
আমার চোখ আটকে গেলো বেবিহোল্ডার গলায় পেচিয়ে বাচ্চা নিয়ে আসা এক বাবার দিকে।উনি হাটছিলেন আর গলার সামনে ঝুলানো মাস পাঁচেকের বাচ্চাকে আদর করছিলেন,কথা বলছিলেন।বাচ্চার মা হয়তো অফিসে বা অন্যকাজে গিয়েছে।তবে মাকে ছাড়াও বাবার কাছেই বাচ্চাটা বেশ খুশি।ভেতরটা নিমিষেই ধক করে উঠলো আমার।এরমধ্যেই দরজা খোলার শব্দ।ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম টিশার্ট,প্যান্ট পরে চিকন গরনের বেশিই ফর্সা একটা মেয়ে।হয়তো হোটেলের সার্ভ গার্ল।ও এসেই হাসিখুশিভাবে বললো,
-গুড মর্নিং ম্যাম।
-মর্নিং।
মেয়েটা মুভিং টেবিল টেনে রুমে ঢুকেছে।ওতে দুটো ফ্লাক্স,অনেকগুলো মগ।ইংরেজিতে বললো,
-চা নাকি কফি?
-কোনোটাই না।
ও এবার খাবারের মেনু এগিয়ে দিয়ে বললো,
-সকালে কি খাবেন ম্যাম?আপনার স্যার,মানে রোহান স্যার রিসেপশনে বলেছেন আপনার খাবার আগেআগে রুমেই পৌছে দিতে।
মৃদ্যু হেসে মেনু দেখে খাবারের নাম বলে দিলাম।মেয়েটা সৌজন্য হেসে চলে যাচ্ছিলো।পেছন থেকে ডাক লাগালাম।ও বললো,
-কোনো সমস্যা ম্যাম?
-আসলে এখানে পরিচিত কেউ নেই আমার।আর স্যারও তার বিজনেস নিয়ে ব্যস্ত।তাই…তাই আপনার সাথে পরিচিত হতে চাই।যদি আপনি কিছু মনে না করেন।
মেয়েটা আবারো হেসে এগিয়ে আসলো।গলার পাশের ছোট নেমপ্লেট দেখিয়ে বললো,
-আমি এলিনা।এখানকার স্থানীয়।আপাতত এ হোটেলের সার্ভগার্ল।তাছাড়া বিকেলে দু ঘন্টার আরো একটা চাকরি আছে আমার।টুরিস্ট গাইড।
-আমি আহানিতা।তুমি নাম ধরেই বলো আমাকে।যদি অনুমতি দাও,আমিও নাম ধরেই ডাকি তোমাকে?
-অবশ্যই।এরকম অনেকেই বেরাতে আসে এখানে।অনেকের সাথেই পরিচিত হতে পেরে ভালো লেগেছে।আশা করবো তোমারও এখানটা ভালো লাগবে আহানিটা।
ওর কাছে নামটা শুনে হেসে দিলাম।বললাম,
-হ্যাঁ,অবশ্যই।
-আমি এখন আসছি।দু ঘন্টা পর আমার ট্রিপ শেষ হবে,তারপর এসে বাকি কথা হবে কেমন?
-বেশ।অপেক্ষায় থাকবো তোমার।
ও চলে যাচ্ছিলো।তখনই রোহান ভাইয়া ভেতরে ঢুকলেন।এলিনা ওনাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো।রোহান ভাইয়া বললেন,
-ঘুম হয়েছে ঠিকমতো?কোনো সমস্যা হয়নি তো তোমার আহানিতা?
-না।ঠিকাছি আমি।
-অঙ্কুরের ফ্লাইট টেকঅফ করেছে।
কিছু বললাম না।উনি বললেন,
-তুমি চাইলে এখানটা ঘুরে দেখতে পারো।জায়গাটা সুন্দর।
তাচ্ছিল্যে হেসে বললাম,
-নিজের দেশে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরায় আপনাদের সমস্যা।আর এখানে বিদেশের মাটিতে এসে বলছেন,ইচ্ছামতো ঘুরতে পারি?আপনারা দুজনেই আজব মানুষ।
-অঙ্কুরের এমনটা করার অবশ্যই কারন আছে আহানিতা।
-আছে তো!কারনটা এই,যাতে আমার আর তার সম্পর্কে কেউ কিছু জানতে না পারে।
-এরও কারন আছে।জানোতো তুমি।
-হ্যাঁ।অবশ্যই।দু বছরের এগ্রিমেন্টের বউ আমি তার,পাব্লিক জানলে তার ইমেজ নষ্ট হবে না?
রোহান ভাইয়া চুপ করে গেলেন।বললাম,
-আমাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না।অঙ্কুর বলেন নি আপনাকে?আমি তো বলেছি,তার কথার অবাধ্য হবো না।তার সব কথা মানবো।নিশ্চিন্ত থাকুন।এমন কিছু করবো না যাতে আমার জন্য আপনাদের কোনো ঝামেলা হয়।
-আমার মিটিং আছে।আসছি আমি।টেক কেয়ার।
রোহান ভাইয়া বেরিয়ে গেলেন।নিজের উপর তাচ্ছিল্যে হেসে আবারো বাইরে দৃষ্টি ছুড়লাম।
.
মাঝে একটা দিন,দুটো রাত কেটে গেছে।মোটামুটি হোটেলের ঘরেই।নিজের ইচ্ছায় বেরোই নি।মনিমা,তানহার সাথে কথা হয়েছে।আস্থাও ফোনে ওর উদ্ভট কথায় রাগানোর চেষ্টা করেছে।স্বাভাবিক থেকে হ্যান্ডেল করেছি সবটা।রোহান ভাইয়া দিনে কয়েকবার এসে জানিয়ে গেছেন,অঙ্কুর এখানে পৌছেছেন,সেইম ফ্লোরে রুম তার,প্র্যাকটিস নিয়ে ব্যস্ত,ইত্যাদি ইত্যাদি।কেনো যেনো ক্ষনে ক্ষনে তাকে দেখার ইচ্ছা হয়েছে,তার আওয়াজ শুনতে ইচ্ছা করেছে,তার গভীর চাওনির সে চোখজোড়া দেখার ইচ্ছা করেছে,ভ্রুর পাশের ওই লালচে তিলটা যেনো কোনো অভ্যাস হয়ে দাড়িয়েছে আমার।
এলিনার সাথে অনেক ভাব হয়ে গেছে আমার।ওর সাথে দুবার বেরিয়েছিও।ও যেহেতু এখানকার টুরিস্ট গাইড হিসেবেও কাজ করেছে,তাই রোহান ভাইয়া কিছুই বলেননি।সকালের খাবারটা শেষ করে আবারো ব্যালকনি দিয়ে শহর দেখায় ব্যস্ত রাখতে চাইছিলাম নিজেকে।এরমাঝেই দরজা খোলার শব্দ।পেছন ফিরলাম।অঙ্কুর!পুরো দুদিন তিনরাত পর দেখলাম তাকে।একদম অগোছালো লাগছে মানুষটাকে।কিছু বুঝে ওঠার আগেই উনি একছুটে এসে জরিয়ে ধরলেন আমাকে।বললেন,
-আর কিছু মুহুর্ত।তারপর…তারপর আর কোনো বাধাই আটকাতে পারবে না আমাকে।
কিছুই বুঝিনি।কিন্তু ওইযে,প্রশ্ন করা বারন!ওনাকে ছাড়িয়ে দিলাম।অঙ্কুর একটু ভ্রুকুচকে তাকিয়ে আবারো মন খারাপ করে ফেললেন।কপালটা ডলে জিভ দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে বললেন,
-কেমন আছো?
-যেমন দেখছেন।
-আমি কেমন আছি জানতে চাইবে না?
-যেমন দেখছি,তেমনি আছেন।আলাদাভাবে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে হয়নি।আমার প্রশ্ন করাটা পছন্দ হবে না আপনার।
-আজ আমার ম্যাচ অদ্রি।
মৃদ্যু হাসলাম।ওনার আজ ম্যাচ এটা জানি।তবে এটাও জানতাম,ম্যাচের আগে উনি আসবেন একবার আমার কাছে।কেনো জানতাম,তা জানিনা।পেছন ফিরে বললাম,
-জানি তো।যে খবর পুরো পৃথিবীই জানে,তার খবর না হয় আমিও রাখলাম কিছুটা।
-কিছু বলার নেই তোমার?
-আমি কিছু বললে আপনি অবশ্যই জিরো রানের জায়গায় দুটো রান বেশি করে আউট হবেন না।
-অদ্রি?
-যতোদুর জানি,এই ম্যাচই হারবেন বলে আপনি ডিল করেছিলেন প্রদীপ সরকারের সাথে।তারপরও কতো শো অফ!প্র্যাকটিস!ব্যস্ততার অভিনয়!
-অভিনয় এতোটাও সোজা বিষয় নয়।তা তোমার থেকে ভালো কে জানে?
আবারো তারদিক ফিরলাম।বললাম,
-হ্যাঁ।তবে যে সৎ,অভিনয়ের চেয়ে কাউকে ঠকানোটা তার কাছে আরো বেশি কঠিন!আর আপনি ঠকাচ্ছেন।একজনকে নয়,হাজারজনকে।এতোগুলো মানুষের বিশ্বাস,ভরসা,নিজের ক্যারিয়ার,সবকিছু থেকে ওই কয়েকটা টাকাই বেশি আপনার কাছে অঙ্কুর।একটাবারও ওই মানুষগুলোর কথা ভাবেন নি,যারা এএসএ’র সেঞ্চুরী আর জয়ের পর সেলিব্রেশনের জন্য তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করছে।যারা ভরসা করে আপনাকে।ভালোবাসে আপনাকে।একবারও মনে করেন নি,কতোবড় পাপ করছেন আপনি।
-এই মুহুর্তে দাড়িয়ে এতো কঠিন কথাগুলো বলতে তোমার কষ্ট হলো না অদ্রি?অবশ্য ঠিকই আছে।এই মুহুর্তে তোমার এমনটাই মনে হবে।যাই হোক,যাদের ভালোবাসার কথা বলছো,তাদের ভালোবাসার দাম অঙ্কুর দিয়েছে,দেবে।কিন্তু আমার ভালোবাসা?তার কি?
অবাক হলাম।তার ভালোবাসা মানে?সে প্রশ্নের জবাবও তো উনি দেবেন না।তাই তাচ্ছিল্যে হেসে বললাম,
-ভালোবাসা কথাটা আপনাকে মানায় না।
-চাও না আমি মানিয়ে নেই?
আরো বিস্ময়ে তাকালাম।উনি উত্তরের জন্য অপেক্ষায়।বললেন,
-বলো অদ্রি?চাও না আমি মানিয়ে নেই এ শব্দটা আমার সাথে।এমনটা হোক,ভালোবাসা মানে অঙ্কুরকে বুঝতে শিখুক সবাই।তুমি শেখো।চাওনা এমন?
নিজেকে শক্ত করে বললাম,
-আপনার এইসব কাজের পর,চাই না।ভালোবাসা নিয়ে সত্যি কোনো কথা মানায় না আপনাকে অঙ্কুর।নাই বা বললেন কিছু,ভালোবাসা নিয়ে!
পানিতে ভরে উঠেছে আমার চোখ।একপলক অঙ্কুরের দিকে তাকালাম।তারও একই অবস্থা।নিজের হাতদুটো মুঠো করে নিয়ে উনি জোরে শ্বাা ছাড়লেন উনি।শান্ত গলায় বললেন,
-বেশ।বলবো না ভালোবাসি।
ভেতরের কলিজাটা যেনো আচড়ে ধরলো কেউ।অঙ্কুর আমার দিকে একপা এগিয়ে এসে বললেন,
-তুমিও বলবে না তো?
টুপ করে পানি বেরিয়ে এলো চোখ দিয়ে।চোখ সরিয়ে নিলাম।উনি আবারো বললেন,
-বলো?বলবে না তো,ভালোবাসো?
উত্তরটা না।কেনো বলবো ভালোবাসি?যখন শুধু অপমান ছাড়া কিছুই পাইনি,কেনো বলবো?যতই দুর্বল হই না কেনো,আপনার মতো কাউকে বলা যায় ভালোবাসি?অঙ্কুর বললেন,
-উত্তর দিতে পারলে না তো?
…..
-শুনে রাখো অদ্রি।আর অল্প কিছুক্ষন সময়ের ব্যবধানে তোমার সবটা পাল্টে যাবে।তখন কিন্তু তোমার এই নিস্তব্ধতা,এই মৌনতা মানবো না আমি!
….
-আপাতত অল দ্যা বেস্টও বলবে না?
চোখের পানি মুছলাম।বিছানার পাশে রাখা ব্যাগটা থেকে ছোট একটা গিফটবক্স বের করে এনে ধরিয়ে দিলাম তার হাতে।উনি বিস্ময়ে একবার আমার দিক,তো আরেকবার বক্সটার দিকে তাকাচ্ছেন শুধু।বললাম,
-খুলে দেখতে পারেন।
বিস্ময় নিয়েই উনি আস্তেআস্তে খুলে ফেললেন র ্যাপিং পেপার।ওটা দেখে একরকম আটকে গেলেন অঙ্কুর।আঙুলের সমান দুটো ছোটছোট মুর্তি।কাপল।কোটসুট পরা ছেলেটা ব্যাকলেস গাউন পরা মেয়েটার দুগাল ধরে কপালে চুমো দিচ্ছে।ধীর গলায় অঙ্কুরকে বললাম,
-অল দ্যা বেস্ট।হেরে আসুন।
অঙ্কুরের চেহারায় খুশির ঝলক।উনি বললেন,
-আমি অলরেডি জিতে গেছি অদ্রি।আর আমার বিশ্বাসও জিতে গেছে।আসছি।
উনি বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে।উচ্ছাসিতভাবে চলে যাওয়া দেখলাম তার।পরপরই চোখ বন্ধ করে নিজেকে শক্ত করে নিলাম।আপনি জিতুন বা হেরে যান,সত্যিটা সামনে আসবেই অঙ্কুর।আর এবার হয়তো সেটা আপনি স্বীকার করার আগেই!
#চলবে…