নেশাক্ত তোর শহর পর্ব-১০

0
720

#নেশাক্ত_তোর_শহর
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব::১০

এক দৌড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে শাড়ির অর্ধ আঁচল ভিজিয়ে ফিরে এলো আয়াতের কাছে। অতি সাবধানে সময় নিয়ে আয়াতের চিবুকে লাল হয়ে যাওয়া অংশে ভিজিয়ে নিচ্ছে। হালকা ঠান্ডা হতেই নিজের অধর ছুয়ে দিল চিবুকে।
আয়াত গভীর দৃষ্টিতে তৃষ্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আজ তার পিয়াসু পাখি তার ব্যাথায় ব্যথিত হচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে চোখজোড়া ফুলে গেছে, নাকের ডগা বেশ খানিকটা লালচে হয়ে আছে। একদম অগোছালো লাগছে। মনে হচ্ছে একদম ছোট একটা পিচ্চি। যার থেকে পুতুল নিয়ে গেছে। যাকে বলে পুতুল বউ। তৃষ্ণার এই অগোছালো অবস্থা আয়াতের বড্ড বেশি ভালো লাগছে। হুট করে তৃষ্ণার স্পর্শের জন্য প্রস্তুত ছিলো না সে। নিজের অজান্তেই হাত চলে গেল চিবুকে। এই প্রথমবার তৃষ্ণার কাছ থেকে আঘাত আর ভালোবাসা দুটোই একসাথে পেল।
তৃষ্ণার হাত ধরে আয়াতের পিঠে রেখে তৃষ্ণার মাথা রাখলো নিজের বুকে। মৃদু শব্দে বলল..

— “তৃষ্ণা কেঁদো না। আমি জানি, তুমি কখনো আমাকে ইচ্ছে করে আঘাত দিবে না। ভুলবশত দিয়ে ফেলেছ? তার বদলে ভালোবাসার চিহ্নও দিয়েছ!
শুধু তোমার ভালোবাসা পাবার জন্য আমি বারবার নিজেকে আঘাতে জর্জরিত করতে পারি। ট্রাস্ট মি”।

মুখ তুলে তাকালো না তৃষ্ণা। আয়াতের বুকের ধুকপুকানির শব্দগুলো কান পেতে শোনার চেষ্টা করছে। আয়াতের ভালোবাসা তার কাছে কতোটা গভীর সেটা বুকে কান পেতে জানার চেষ্টা করছে। একটা মানুষ কতোটা স্বার্থহীন ভাবে ভালোবাসতে পারে, সেটা জানার চেষ্টা করছে। এমন ভাবে জড়িয়ে ধরে আছে যেন, একবার ছেড়ে দিলেই চিরতরে হারিয়ে যাবে।

— “আ’ম সরি। আপনার কষ্ট হচ্ছে তাই না। আই প্রমিস, আমি আর কখনো এমন করব..

তৃষ্ণার কথার মাঝে দরজায় নক পড়লো। সাথে সাথে আয়াতকে ছাড়িয়ে সরে গেল সে। দরজা খোলা। তার ভাই ভাবী এসেছে। তৃষ্ণা অস্বস্তি নিয়ে বলল..

— “ভাইয়া ডাক্তারকে ফোন করেছ”?

— “সামান্য তরকারি পড়েছে, ডাক্তার দিয়ে কি হবে। জাস্ট মলম লাগালেই ঠিক হয়ে যাবে”।

দুজনের কথোপকথন শুনে তাহসান হেঁসে বলল..

— “তোরা দুজনেই বাচ্চা। আমি যে একটা ডাক্তার, সেটা কি ভুলে গেছিস”।

সেই মুহূর্তে কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছিল তৃষ্ণার। নিজের এমন বোকামোর জন্য সবাই কি-না কি ভাবলো।

___________________
অন্ধকারের কালো মেঘে ঢেকে গেছে নীল আকাশ। ঝিরিঝিরি ধারায় বৃষ্টির ফোঁটা ঝরে পড়ছে। বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির ফোঁটা গুলো পানির উপর পড়তেই চারপাশে ঢেউয়ের আঁকার ধারণ করছে। বৃষ্টির পানির সাথে তাল মিলিয়ে আয়াতের চুলের থেকে টপটপ করে পানি ঝরছে। বৃষ্টির ঝুমঝুম আওয়াজের কাছে সেই শব্দ গুলো হারিয়ে যাচ্ছে। এক দৃষ্টিতে পুলের পানির দিকে তাকিয়ে আছে। নিজেকে কেমন ছন্নছাড়া লাগছে আয়াতের কাছে। দুচোখে ঘুম আসছে না। একদম অসহায় একজন মানুষ। কালকে তৃষ্ণাকে ছেড়ে যাচ্ছে। কাজের চাপ ক্রমশ বাড়ছে। কবে ফিরতে পারবে জানা নেই তার। যখন তৃষ্ণা পাশে ছিল না, তখন না পাওয়ার কষ্ট আর এখন দূরে থাকার কষ্ট। ইচ্ছে করছে ছোট একটা চড়ুই পাখির সংসার সাজিয়ে দূরে বহুদূরে চলে যেতে। কিন্তু বাস্তবতার কাছে কিছুই সম্ভব হচ্ছে না আয়াতের।

রাত তখন তিনটে ছাড়িয়েছে। বৃষ্টির ধাঁচ আগের চেয়ে অনেকটা বেড়ে গেছে। সাথে দমকা হাওয়াও দিচ্ছে। হঠাৎ বৃষ্টির ছিটে শরীর স্পর্শ না করতেই অস্বাভাবিক হয়ে গেল আয়াত। ভ্রু কুঁচকে পাশে তাকাতেই তৃষ্ণার ঘুম ঘুম মুখটা ভেসে উঠলো। হাতে কালো হাতল যুক্ত লম্বা ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। হাই তুলে আয়াতের পাশে বসে পড়লো। আধো আধো কন্ঠে বলল…

— “এখানে চুপ করে বসে আছেন কেন? ঘড়ির কাঁটা দেখেছেন? কতো রাত হয়েছে ? ঘুম পাচ্ছে”।

তৃষ্ণার কথার উত্তর দিল না আয়াত। উঠে সামনে দিয়ে হাঁটা ধরল। পেছনে না তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল..

— “তৃষ্ণা তোমার পাচ্ছে, তুমি গিয়ে ঘুমাও। মানুষের মন সবসময় এক ধরনের থাকে না। ধরে নাও আজ আমার মনটাও ভালো নেই”।

শুনলো না তৃষ্ণা। ছাতাটার ডগা গলায় চেপে ধরলো। কয়েকপা আয়াতের দিকে এগিয়ে গেল। পেছন থেকে বাহুতে হাত রেখে আয়াতকে ঘুরিয়ে নিল। দুহাত কাঁধে রেখে চোখ ছোট ছোট করে বলল..

— ‘আয়াত ওয়েদারটা কি সুন্দর, তাই না। একদম পারফেক্ট ফর কাপল। যদি আপনি চান, তাহলে আমাদের মধ্যেও কিছু হতে পারে”।

তৃষ্ণার কথাটা মস্তিষ্কের প্রবেশ করতেই হতবাক হয়ে গেল আয়াত। মাথা থেকে পা পর্যন্ত স্ক্যান করে নিল তৃষ্ণার। গলার ভাঁজে চেপে রাখা ছাতার ডগাটা নিজের হাতে বন্দী করে নিল। হাতের প্রতিটি ভাঁজ সমান করে উপরে তুলে নিল ছাতাটাকে। দমকার হাওয়ার সাথে ছুঁড়ে ফেললো সামনের দিকে। হাওয়ার তালে কতোটা দূরে গিয়ে ছাতাটা মাটি স্পর্শ করলো, জানা নেই আয়াত তৃষ্ণার।
সাথে সাথে দুহাত উপরের তুলে মাথা বৃষ্টির থেকে আড়াল করে নিল তৃষ্ণা। তাতে কোনো ভাবাবেগ দেখা গেল না বৃষ্টির ভেতরে। তারা সমান তালে ঝড়ে পড়ছে। সামান্য সময়ের ব্যবধানে খানিকটা ভিজে গেল তৃষ্ণা। ওরনার আঁচলটা টেনে মাথায় দিতেই টেনে নিয়ে গেল আয়াত। এক কোণ আয়াতের কাছে বাকিটা তৃষ্ণার কাছে। হাতের বাজে পেঁচিয়ে ধীরে ধীরে তৃষ্ণার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ঘনঘন পলক ফেলে আয়াতের কদম অনুযায়ী পিছিয়ে যাচ্ছে তৃষ্ণা। বুকে হাত রেখে করুন চোখে আয়াতের দিকে তাকিয়ে বলল..

— “কি করছেন টা কি প্লীজ ছাড়ুন। লোকে দেখলে কি বলবে।
আচ্ছা আপনার মাথায় আবার শেওলা গাছের পেত্নিটা ভর করে নি-তো। জানেন, মতি ভাইকে পেত্নিতে ধরেছিলো। যাকে চোখের সামনে পেত, তাকেই কামড় দিতো। একবার আমাকেও দিয়েছিলো। এই দেখুন..

কথাটা বলেই ওরনার ফাঁক থেকে আয়াতের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল তৃষ্ণা। আয়াত দেখলো না। হাতটা ধরে তৃষ্ণাকে নিজের একদম কাছে নিয়ে এলো। দু’জনের মাঝে দুই ইঞ্চির মতো ফাঁক রয়েছে। মুহুর্তের মাঝেই ফাঁক গুছিয়ে দিল আয়াত। আয়াতের নিঃশ্বাস ছড়িয়ে পড়ছে তৃষ্ণার মুখে। ভেতরে ভেতরে কম্পিত হতে লাগল সে। দুহাত দিয়ে নিজেকে ছাড়ানো চেষ্টা করছে। কিন্তু আয়াতের মতো শক্তপোক্ত পুরুষের সংস্পর্শে থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে না তৃষ্ণার দ্বারা। আয়াত নিজের অধর যুগল তৃষ্ণার গলায় স্লাইড করতে আরেকপা পিছিয়ে গেল তৃষ্ণা। আরেকপা পেছনে ফেলতেই আয়াতের শার্টের কলার চেপে ধরলো সে। কোনো রকম ফসকে গেলে সোজা পুলের ভেতরে।
আয়াত তৃষ্ণাকে ছেড়ে দিল। একহাতে চুল ঠিক করে পূর্ণরায় তৃষ্ণাকে ব্যালেন্জ করে নিল। তৃষ্ণা রক্তচোক্ষু নিয়ে আয়াতের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু তাতে কোনো প্রভাব পড়ছে না আয়াতের উপর।
আয়াত হাত ছাড়তেই তুমুল শব্দে পুলে পড়ে গেল তৃষ্ণা। দুহাতে মুখ ঢেকে বিরবির করে বলল…

— “ও নো।( তৃষ্ণাকে শুনিয়ে) আমি তোমার কথা রাখতেই রোমান্টিক ওয়েদারকে কাজে লাগাতে চেয়েছি। কিন্তু তুমি তোমার কথা শুনলে না। এবার বুঝো। আমার সাথে যখন রোমান্স করতে চাইছ না। আমার তাতে সমস্যা নেই।
এখন মাছের সাথেই না-হয় ওয়েদার শেয়ার করো”।

উল্টো ঘুরে দুকদম ফেলতেই পানি ঝাপটানোর শব্দ কানে এলো আয়াতের। তৃষ্ণা সাঁতার জানে না, ভাবতেই পারেনি আয়াত। সময় অবিলম্ব না করে পানিতে ঝাঁপ দিলো সে। তৃষ্ণাকে ধরার আগেই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল সে। ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে চুলগুলো ঝাড়া দিয়ে আয়াতের মুখে পানি ছিটিয়ে দিল। হাত ঝাড়া দিয়ে বলল..

— “অযথা আমার সাথে লাগতে আসবেন না। তাহলে নিজেকে আর চিনতে পারবেন না”।

–“দেখা যাক”
কিছুক্ষণ মৌন্যতা অবলম্বন করলো আয়াত। ঠোঁট উল্টে বেবী ফেস করে তৃষ্ণার কোমর জড়িয়ে কাছে নিয়ে এলো। নিজেকে সামলাতে হাত রাখলো আয়াতের কাঁধে। হাঁটু ভাঁজ করে তৃষ্ণাকে নিয়ে পানির নিচে ডুব দিল।
অন্ধকারে ঘেরা পানির তলদেশে শ্বাস আঁটকে আসছে তৃষ্ণা। তার মাঝে আয়াত করে বসলো অনাকাঙ্ক্ষিত কাজ। তৃষ্ণার দুগালে হাত রেখে ওষ্ঠজোড়া এক করে দিল। বারি ধারার মাঝে চলতে রইলো ভালোবাসার আদান প্রদান। বেশিক্ষণ স্থায়ী রইলো না সেই সুন্দর লগ্ন। তার আগেই আয়াতকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে চড় বসিয়ে দিল তৃষ্ণা।

অম্বুর মাঝে চড়ের আঘাত অনুভব না হলেও তার গভীরতা ছিল ব্যাপক। শারীরিক ক্ষেত্রে কোনো রুপ প্রভাব না ফেললেও মানসিক ক্ষেত্রে ভেঙে দিয়েছিলো আয়াতকে। নিজেকে তৃষ্ণার কাছে ছোট মনে হচ্ছিল। তৃষ্ণার অনুমতি না নিয়ে, তার হয়তো এমন কাজ করা উচিত হয়নি।‌

(চলবে)