প্রেমজাল পর্ব-৩৪ এবং শেষ পর্ব

0
2368

#প্রেমজাল
পর্ব ৩৪ [ অন্তিম পর্ব ]
জান্নাতুল মাওয়া মাহিমুন

-‘ এনাফ ইজ এনাফ!! কি মাধুরী? হ্যা? মাধুরী কে? মাধুরী আর আমি জাস্ট বিজনেস পার্টনার। আমি মাধুরীকে ড্রা’গস এনে দিতাম। সেটা মাধুরী ভার্সিটির ছেলে মেয়েদের কাছে সাপ্লাই দিতো। দেটস ইট!! আমি তোমাকে ঠকাতে চাইলে কখনো বিয়ে করতাম না,রিয়া। আর এতোক্ষণ আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেও না। আর রুহি? কে বলেছে রুহি আমার সন্তানের মা? আমার সন্তানের মা হওয়ার যোগ্যতা শুধু তুমি রাখো। কারণ আমি তোমাকে ছাড়া আর কাওকে কখনো আপন করে কাছে টানিনি!! আর ইউ হেয়ার রিয়া?….(একটু থেমে) যা আমার মার সাথে হয়েছে, সেটা কি করে আমার স্ত্রীর সাথে করতে পারি? আমি হয়তোবা রুহির সাথে প্রতারণা করেছি। ওকে আমার #প্রেমজাল এ টেনে এনেছি। তবে আমি কখনো ওর সাথে ইন্টিমেন্ট করি নি। আর যেখানে করিনি সেখানে আমার সন্তানের মা হয় কি করে? আমি শুধুমাত্র রুহির থেকে প্রমাণ হাতিয়ে নেয়ার জন্য মিথ্যা প্রেমের নাটক করি। তবে একটা সত্য যে, আমি রুহিকে ব্ল্যাকমেইল করার জন্য আমার সাথে বেড শেয়ার করতে বলেছিলাম। ভালোবাসার দোহাই দিয়ে ভালোবাসার প্রমাণ চেয়েছিলাম। কিন্তু ঘনিষ্ঠ হয়নি। ঘুমের ঔষধ খাইয়ে ক্যামেরা এংগেল চেঞ্জ করে অপ্রীতিকর ছবি তুলেছি। আই রিপিট আমি তাকে আপন করে কাছে টেনে নেয়নি। জানো রুহির সাথে শারীরিক সম্পর্ক কে করেছে? জানতে চাও সবাই? ( জোরে চিৎকার করে ) এই লোকটা’ বলে আদ্র ভাই তার থেকে দূরে থাকা হ্যান্ডকাপ পড়া লোকটার দিকে ইশারা করলো। লোকটা হেলে দুলে পরে যাচ্ছে। পুলিশ কন্সটেবল ধরে রাখতে রাখতে ব্যাকুল।

আদ্র ভাই আবার বলতে শুরু করলো,

-‘ এই হচ্ছে কাঙখিত আহনাফ আহমেদ!! অবাক লাগছে? সে তার মেয়ে বয়সির মেয়ের সাথে এমন করেছে? মানতে কষ্ট হয়েছে? কিন্তু এটাই ভয়ংকর সত্যি। এই লোককে এখন আমার বাবা বলতে ঘৃণা লাগে। এই লোক বাবা ডাক শুনার যোগ্যই নয়। এই লোক মদ্যপানে এতোই নেশাক্ত, যে সে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পরে। আমি ছবি তুলে বেরিয়ে আসার পর এই লোক মদ খেয়ে রুহির সাথে ঘনিষ্ঠ হয়। পরদিন এই লোক আমাকে ফোন করে আসতে বলে। সেদিন মনে হয়েছিলো আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে। পরে বাধ্য হয়ে এই আহনাফ আহমেদকে বাচাতে আমি রুহির পাশে শুয়ে পরি। তাই রুহির হয়তো মনে হয়েছে যে আমি তার সন্তানের বাবা। শুধু তাই নয় এই লোকই আমাকে অন্ধকার জগতে নিয়ে গেছে এবং সেই আমাকে রুহির কাছে যাওয়ার জন্য প্ররোচিত করে। এমনকি কানাডায় গেলে সেখানে ড্রা’গসের নেশা ধরায়। তখন আমার জীবনে রিয়া আসে। আমি ওকে বিয়ে করি। রিয়া আমাকে ড্রা’গস থেকে ফিরিয়ে আনতে পারলেও ড্রা’গস জগত থেকে পারি নি। আর পারার কথাও না। কারণ এই জগতে কেও একবার গেলে ফিরত আসতে পারে না। এখন কথা হচ্ছে রিয়া আমার বিবাহিত স্ত্রী হওয়ার পরও কেনো আমি তাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি। এই কারণটার পিছনেও আহনাফ আহমেদ দায়ী। সে আমাকে বাধ্য করেছে রিয়াকে দূরে সরিয়ে অন্যের হাতে তুলে দিতে। কারণ ড্রা-গ’স ব্যবসা করতে গিয়ে সে মোটা অংকের টাকা ব্যাংক থেকে মূলধন হিসেবে তুলে তার ভার আহনাফ আহমেদের সারাজীবনের পুজিপাত দিয়েও কুলানো সম্ভব নয়। দেশের কড়া আইনের কারণে ড্রা-গ’স ব্যবসা ডুবে গেছে। সাথে তার মূলধনও। আগেই বলেছি আনফিহা দাদাকে দিয়ে উইল করিয়েছিলো। যাতে কখনো আমার আর তার সন্তান অর্থাৎ আহানার মাঝে দ্বন্দ্ব না হয়। উইলটা ছিলো সম্পূর্ণ ভাগ্যের অপর। সব স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির মালিকানা হবে আমার বা আহানার সন্তান। যে কিনা সবার আগে এই দুনিয়া ভুমিষ্ঠ হবে। সেটাও সে যখন ১৮ বছর হয়ে যাবে। সেই সুবাদে মিস্টার আহনাফ আহমেদ কানাকড়িও পাবে না। আর আমাদের বংশধরের উপযুক্ত হওয়া পর্যন্ত, এত সময় তো আর ব্যাংক দিবে না। তাই এই আহনাফ আহমেদ আয়ান-রিয়ার বিয়ের চিন্তা ভাবনা করে। আয়ানের সাথে রিয়ার বিয়ে হলে রিয়ার নামে আয়ানের সম্পত্তি এসে যাবে। চৌধুরী বাড়ির সম্পত্তির মূল্য ব্যাংক থেকে তোলা টাকার কাছে কিছুই না। ………(একটু থেমে) যদিও আয়ান-রিয়ার বিয়ের কথা আহনাফ আহমেদ, রিয়া আর আমার মাঝে সীমাবদ্ধ ছিলো। আমি রিয়াকে কনভেনস করে দাদিমণিকে বলতে বলি যে সে আয়ানকে পছন্দ করে এবং তাকে বিয়ে করবে। রিয়া আমার কথা মতোই কাজ করে। কারণ ব্যাংকে টাকা ফিরত না দিলে আমিও ফেসে যেতে পারি। অনেকের কৌতুহল জাগতেই পারে যে এতোদিন বাবা…নাহ মিস্টার আহনাফ আহমেদ কোথায় ছিলো? সে তার তৃতীয় বার বিয়ে করা বউ এর সাথে থাকে। হ্যা সে আনফিহা আন্টির পর আরেকটা বিয়ে করেছে। হাহ!! এখন দীর্ঘ তাদের ১০ বছরের সংসার। যদিও আমি কিছুদিন আগেই জেনেছি। আশা করি সবার উত্তর পাওয়া শেষ’ বলে আদ্র ভাই রিয়ার আপুর দিকে এগিয়ে গেলো।

সবাই নিশ্চুপ!! একের পর এক ভয়ংকর সত্যের সম্মুখীনে উপস্থিত সবাই হতভম্ব। রিয়া আপুর মুখ উপচে পরছে চোখের পানি। আদ্র ভাই সন্তর্পণে তা মুছে দিলো। রিয়া আপুর গাল তার দু’ হাতে আকড়ে ধরে মোলায়েম কন্ঠে বলে উঠলো,

-‘ আমি অনেক খারাপ তাই না? হ্যা আমি অনেক খারাপ। আমার মতো খারাপ মানুষকে আর তোমার দেখতে হবে না। এই খারাপ আমিটাকে কি একটু জরিয়ে ধরবে?’

বলতেই রিয়া আপু তৎক্ষনাৎ জরিয়ে ধরলো আদ্র ভাইকে।

আদ্র ভাই রিয়া আপুকে শক্ত করে জরিয়ে ধরে বললো,

-‘ আমি নিজহাতে একটা খুন করেছি। হাজার ছেলে-মেয়ের জীবন নষ্ট করেছি। তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। আমার বেচে থাকার আর কোনো অধিকার নেই। আমাকে মাফ করে দিও। আর…..পারলে আমাকে ভুলে যেও। ভালো থেকো প্রিয়তমা। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি’

বলেই আদ্র ভাই তার কোমরের পিছনের দিকের থেকে গোজা রিভয়েলবার বের করে নিজেই নিজের মাথায় পর পর ৩টা গুলি করলো। চারপাশে তার রক্ত ছিটকে পরলো। রিয়া আপু কান্না করতে করতেই আদ্র ভাই এর লাশ নিয়ে মাটিতে বসে পরে।

কিছু মানুষ অনেকটা ঠান্ডা স্বভাবের হয়। তারা সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে ঠান্ডা মাথায় ধীরহস্তে কাজ করে। আগের থেকে নিজেদের মাথায় সবকিছু গুছিয়ে এটে রাখে। শীতল মস্তিষ্কের মানুষরা ভিতর ভিতর ভয়ংকর হলেও বাইরে থেকে একদম সাদামাটা সহজসরল মনে হয়। এরা অনেকটা মাইন্ড ড্রাইভার্টের ন্যায় হয়। সাইকোলজির অনুসারে, অনেক সময় অতিরিক্ত রহস্য বা সত্য লুকিয়ে রাখতে রাখতে মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্র কাজ করতে সক্ষম হয় না। পরিশেষে নিজেই নিজেকে শেষ করার পরিকল্পনা করে। সেরকম হয়তো আদ্র ভাইও ছিলো।

ঘটনা এতো দ্রুত গতিতে হয়েছে কে কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না।

মাধুরী ও মিস্টার আহনাফ আহমেদকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়। আদ্র ভাইকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

—————–

সকালের মৃদু আলোর সম্মোহনের এক ফালি রশ্মি আমার চোখে বিরাজমান হতেই আড়মোড়া দিয়ে উঠলাম আমি। উঠতে গিয়ে যেনো পারলাম না। কারোর বলিষ্ঠ বাহুদ্বয়ের বেষ্টনীতে আষ্ঠেপৃষ্ঠে নিবদ্ধ আমি। অনাবরত ‘দ্রিমদ্রিম’ শব্দ কর্ণপাত হচ্ছে। ঘুমের ঘোরেই আলসেমি ডিঙিয়ে আস্তে আস্তে মুখ উচু পিট পিট করে চোখ খুললাম। আয়ান ঘুমে নিমগ্ন!! আমার চোখ জোড়া যেনো থমকে গেসে তার মায়া ভরা মুখমন্ডলে। ইশস!! ঘুমালে কতটাই না নিষ্পাপ বাচ্চা লাগে। যেনো দুনিয়ার সমস্ত মায়া তার কাছে আবদ্ধ। আর জেগে থাকলে অনন্ত জলিলেরও বাপের বাপ, হুহ!! আজ প্রায় ৩ মাস হতে চললো আমাদের বিয়ে হয়েছে। এখনো ঠিক আগের মতোই কেয়ারিং। প্রতিদিন সকালে উঠে দেখি আমাকে জরিয়ে ধরে আছে। আমাকে কোনো অভাব বুঝতে দেয় না। সবসময় আগলে আগলে রাখে। কিন্তু আমি সবসময় ইচ্ছা করে ঝগড়া করি। তবুও উনি হাসি মুখে সহ্য করে নেয়। ইদানীং আমার শরীর বেশি একটা ভালো থাকে না। একটু কাজ করলেই ক্লান্ত হয়ে উঠি। এমনকি খেতেও তেমন একটা ভালো লাগে না। বলতে গেলে একদম অরুচি এসে গেছে। কিছু একটা খেলেও খানিক পরে গিয়ে বমি করে দেই। মাঝে মাঝে মাথাও ঘুরায়। আমি একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে উনার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম। আমি টুপ করে উনার গালে চুমু দিয়ে উঠতেই আচমকা আয়ান আমায় টান দিয়ে উনার বুকের অপর ফেলে দিলেন। আমি নিস্তব্ধ!! চোখ মুখে একরাশি মৃদু হাওয়া বইতে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম আমি। আমি ক্ষণিকের মধ্যেই চোখ সরিয়ে নিলাম।

-‘ কি ব্যাপার মিসেস আয়ান চৌধুরী?’

আমি উনার কথায় বিস্মিত!! হঠাৎ উনি ঘুম থেকে উঠে যাবে তা আমি মোটেও প্রত্যাশা করি নি। আনমনেই ঠোট কামড়ে শুকনো একটা ঢোক গিললাম।

-‘ এভাবে কি দেখছিলেন? আমার ঘুমের ফায়দা নিয়ে আবার আমার ইজ্জত টিজ্জত লুটে নেন নি তো?’

মানুষ কতোটা লাগামহীন হলে আমার মতো অবলা নারীকে এসব বলতে পারে,হুহ। খুবই বিপ’দ জনক লোক!!

আমি মুখ হাত দিয়ে হামি দিতে দিতে উনার সামনে থেকে সরে ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে বললাম,

-‘ আপনি কোন চকলেটের খনি শুনি? আমার কি খেয়ে আর কোনো কাজ নেই যে আপনার ফায়দা তুলে লুটে নিবো?’

আমি উঠে সরে আসতে দেরি আয়ানের আমাকে টান দিতে দেরি হলো না। আমি ধারাম করে বিছানা পরে গেলাম। উনি মুচকি হাসি আমার উপর উবু হলেন। আমি খানিকটা ভড়কে গেলাম। শুকনো একটা ঢোক গিলে চর্তুদিকে চাহনি চঞ্চল রাখলাম। নিশ্বাস আমার খুব দ্রুত গতিতে ওঠা নামা করছে।

-‘ আসো তোমাকে একটা কিস করি ৷ শুনেছি মেয়েদের কিসে নাকি মিষ্টি থাকে আর মিষ্টি খেলে শরীরে অনেক ক্যালোরি পাওয়া যায় সাথে এনার্জিও’

কথাটা শোনা মাত্রই আমি ফটাফট উনাকে ধাক্কা মেরে দূরে সরে এসে বললাম,

-‘ আপনি এতো লুইচ্ছা হলেন কবে থেকে? আপনার দিন কাল এতোই খারাপ চলে যে চেয়ে চেয়ে নিতে চান’ বলে মিটমিটিয়ে হাসতে লাগলাম।

আয়ান আমার দিকে আসতে আসতে বললো,

-‘ হ্যা গো বউ’

আমি চারদিকে চাহনি চঞ্চল রাখলাম। “বউ” শব্দটা শুনে কেমন জানি এক অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছে। সারা শরীর রীতিমতো কাপছে।

উনি আমার হাত উনার হাতে মুষ্ঠিবদ্ধ করলো। আস্তে আস্তে আমার মুখের দিকে এগোতে লাগলো। আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। আমার ঠোটের মাঝে উনার ঠোটের ছোয়া পেতেই শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল শিহরণ বয়ে গেলো।
.
.
.
.
.
.
৬ বছর পর ~~~

এক নয় দুই নয় গোটা ছয় ছয়টা বছর পেরিয়ে গেছে সেদিনের পর। বদলে গেছে অনেক কিছু। যে যার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে উপযুক্ত শাস্তি পাচ্ছে। মিস্টার আহনাফ আহমেদ গ্রেফতার হওয়ার কিছু সময় পর জানা যায় সে এই দুনিয়ার কিছুদিনের মেহমান। পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছে অনেক দূরে। তার লিভার ক্যান্সার হয়েছিলো। দিন রাত অতিরিক্ত মদ্যপানের ফল৷ সে আমার বাবা? ভাবতেও গা ঘিন ঘিন ধরে আমার। আর আদ্রিয়ান আহমেদ? তার ঠিকানা এখন অন্ধকার ছোট্ট মাটির ঘরটি। সেদিন হাসপাতালে নেওয়ার পথেই শেষ নিস্বাস ত্যাগ করে। তার সেই অন্ধকার ছোট্ট ঘরটিকে প্রতিনিয়ত পাহারা দিচ্ছে রিয়া। হাতে পায়ে তার লোহার শিকল। নেই তার আর আগের মতো লাবণ্যতা। চোখের নিচে কালো দাগে ঢাকা পরে গেছে। সোনালী চুলগুলো উশকো-খুশকো হয়ে ময়লার আস্তরণ জমেছে। রিয়া এখন একজন মানসিক রোগী। যখন জানতে পারে আদ্র এর সাথে সাথে তার মধ্যে থাকা ২ মাসের থাকা ছোট্ট প্রাণটাও তাকে একা করে ছেড়ে গেছে তখনি তার পাগলামির বেগ আরো বেড়ে যায়। আদ্র এর কবরের সামনে বসে কান্না করতে করতে বলে,

-‘ এমন কেনো করলে আদ্র? কতবার তোমাকে বলেছিলাম। কম কি আর বুঝিয়েছিলাম? কেনো আমাকে একা করে চলে গেলে? কথা দিয়েছিলে সারাজীবন আমার সাথে থাকবে। তাহলে কেনো চলে গেলে? আজ আমাদেরও সুখি একটা সংসার থাকতো। আমি, তুমি আর আমাদের সন্তান নিয়ে জীবনটা পার করে দিতাম অনায়সে। কেনো আল্লাহ আমার শেষ ভরসা, আমার সন্তানটাকেও কেড়ে নিলো বলতে পারো?’

বলতে বলতে আনমনে হেসে উঠে রিয়া। এমনি তার স্বভাব হয়ে ওঠেছে। হঠাৎ কেদে কেটে অস্থির হয়ে যায় আবার হাসিতে মেতে উঠে। মাঝে মাঝে সে তার পেটে হাত দিয়েও কথা বলতে থাকে।

অন্যদিকে মাহিন আর তিথি লন্ডন শিফট হয়ে গেছে। তাদের একটা ফুটফুটে মেয়েও আছে। ভারী মিষ্টি দেখতে। অহ হ্যা রুহিরও একটা মেয়ে আছে। রুহির কলিজার টুকরো তার মেয়ে। সে তার মেয়েকে নিয়েই নিজের জীবন গুছিয়ে নিয়েছে। এখন অনেক বড় পদে আছে। সুহানা আর নিলয়ের কোল জুড়ে এসেছে “নিহান”. খুব তাড়াতাড়ি তাদের মাঝে নতুন এক অতিথি আসছে। মানে তারা ৩ জন থেকে ৪ জনে পরিণতি হবে।

আর দ্যা গ্রেট আয়ান চৌধুরী? আজ আয়ানের ছোট্ট পরী আহানিয়ার যে জন্মদিন। তার মেয়ে মাশাল্লাহ অনেক বড় হয়ে গেছে। এবার তো তাকে স্কুলেও ভর্তি করানো হয়েছে। প্রতিদিন আয়ান ওকে সযত্নে রেডি করিয়ে স্কুলে নিয়ে যায়। নিয়ম করে দুই গালে-কপালে চুমু খায়। আহানিয়াও তার পাপা গালেও দিয়ে দেয়। আজ আহানিয়ার কাছে অনেক স্পেশাল দিন। শুধু তার জন্মদিন নয় বলে। তার পাপা তাকে বলেছে, আজ তাকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যাবে। গত ৫ বছর ধরে এই দিনটাতেই আয়ান একটা জায়গায় যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। আজ একটু হয়তো তাড়াতাড়ি যাবে। সাথে যাবে তার ছোট্ট রাজকন্যা আহানিয়া।

আয়ান আর আহানিয়া এগিয়ে আসছে। সবসময়ের মতো হয়তো আজও আয়ানের হাতে একগুচ্ছ বেলী ফুলের মালা। আহানিয়া তার ছোট্ট আঙ্গুল দিয়ে তার পাপার হাত ধরে রেখেছে। চারপাশে তার চোখ চঞ্চল। হয়তো বুঝে উঠতে পারছে না কোথায় এসেছে সে।

আয়ান সন্তর্পণে বেলী ফুলের মালা সামনে থাকা বেড়ার ছোট্ট বিছানায় জরিয়ে দেয়। তার চোখের কার্নিশ বেয়ে খসে পরে দু’ফোটা অশ্রুকণা। আয়ান মোলায়েম কণ্ঠে বিড়বিড় করতে বলতে থাকে,

-‘ আমার আহানিয়া একদম তার মায়ের মতো মায়াবতী দেখতে হয়েছে। কে জানতো এই মায়াবতী আহানিয়াকে জন্ম দিতে গিয়ে তুমি আল্লাহর এতো প্রিয় হয়ে যাবে? তুমি তোমার মায়ের মতো স্বার্থপরের ন্যায় সবাইকে একা করে চলে আসবে? এমন হলে জানলে আমি কখনো পিতৃত্বের স্বাদ নিতে চাইতাম না। তোমার মতো আমার ছোট্ট পরীটাও মাতৃহারা হয়ে গেছে। তবে তার পাশে তুমি ছাড়া বাকি সবাই আছে, আহি। তাকে আগলে রাখার জন্য তার পাপা আছে। মনে মনে কতো স্বপ্ন দেখেছিলাম সুখে শান্তিতে খুনসুটি ভালোবাসায় আমার প্রিয় মানুষটার সাথে আমার আহির সাথে সারাজীবন কাটাবো। আমার জীবনে যে সেই কাঙখিত মানুষটাই নেই, কাটাবো আর কি করে? জানো প্রিয়তমা? মনের প্রফুল্লয়ার হাসৌজ্জ্বল চাহনিতে একগাদা ভুলভাল অনুভূতি উগরে দিলেই প্রেম হয়না। বরং অব্যক্ত হাজারটা ছেড়া টুকরো খন্ড-বিখন্ড অনুভূতি বুকের ভেতর দম আটকে পড়ে থাকলেও প্রেম হয়। প্রেম অনুভব করার জিনিস, সবাইকে কৈফত দেওয়ার নয়। তাই হয়তো এই অনুভব করতে গিয়ে বলা হলো না কতোটা ভালোবাসি তোমাকে প্রিয়তমা। জানো প্রিয়তমা, প্রেম হলো অনেকটা জালের মতো। কখনো নিজে থেকে জরিয়ে যায় আবার কখনো অন্য কেউ এসে জরিয়ে দেয়। আমি যে তোমার প্রেমে, তোমার বুনন করা জালে, তোমারি #প্রেমজাল এ আটকে গেছি। সব ভালোবাসা পূর্ণতা পেয়েও যে পায় না। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা হয় আমার তোমাকে ~ “ভালোবাসি !! অনেক বেশি ভালোবাসি” কিন্তু সম্ভব না। ইহকালের সব মায়া ত্যাগ করে যে তুমি পরকালে পাড়ি জমিয়েছো অনেক আগেই। আমি নাহয় পরকালটা তোমার সাথে কাটালাম। তবে আমি এখনো তোমার #প্রেমজাল এ আবদ্ধ’

আর আহানিয়া? আহানিয়া তার পাপার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আধো আধো গলায় বলে উঠে,

-‘ পাপা তুমি অলেক পচা। তুমি লা বললে মাম্মালের কাচে নিয়ে যাবে। মাম্মাল কই?’

আয়ান তার চোখের জল সুক্ষ্মতার সাথে মুছে নিয়ে স্নিগ্ধ হাসি হেসে বলে,

-‘ তোমার মাম্মাম যে অনেক দুষ্টু মামনি। আমাকে তার #প্রেমজাল এ ফাসিয়ে এই যে এই মাটির নিচে লুকিয়ে শুয়ে আছে’

আহানিয়া কি বুঝলো কে জানে? আহানিয়া হেসে কুটি কুটি।

——-(সমাপ্ত)——