পূর্ণতা পর্ব-৩২

0
517

#পূর্ণতা❤️
#তানজিলা_তাবাচ্ছুম❤️

৩২.

দরজা খুলতেই আলোক অবাক হয়ে গেল, হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে যেনো আজ সে প্রথম দেখছে। এ কি সেই তারা? আজ নতুন এক তারা যেনো আলোক দেখছে। আলোক তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। একপাশে সাইড সিঁথি করা চুল গুলো। কিছু চুল পিছনে কিছু সামনে। কাজলে লেপ্টে থাকা তার আঁখিযুগল। ঠোঁটে হালকা পিংক কালারের লিপস্টিক। পড়নে পার্পেল কালারের শাড়ি সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ। শাড়ি, ব্লাউজ চাঁদের। গায়ে ঠিক মত হয়নি তবুও যেমন তেমন করে পড়ছে তারা। তারা এখন পর্যন্ত আলোকের দিকে তাকানোর সাহস পায়নি। তারার খুব ভয় লাগছে আলোক যদি রাগ করে চাঁদের এইসব পড়ায় আর একদম তার মত করেই সাজায়। তারা ডায়েরীতে রাখা ছবি গুলোয় দেখেছিল চাঁদকে এইভাবে সাজতে তাই সেও সেম ভাবেই সেজেছে। আলোক তারা থেকে ‌চোখ নামিয়ে পুরো ঘর টাকে দেখছে তার লাগানো সেই পার্পেল কালারের পর্দা, বিছানার চাদর, বালিশের কভার পার্পেল কালারে, ঘরের ডিম লাইটটাও পার্পেল কালারের। আলোকের যেন পুরোনো সব গুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আলোকের মনে হচ্ছে সামনে থাকা মেয়েটা তার চাঁদপাখি। তারা মনে সাহস নিয়ে আলোকের দিকে তাকালো। আলোক ও সেই সময় তারার দিকে তাকালো। তারা আলোকের দিকে চেয়ে আছে। তারা ইশারা করে আলোক কে ডাকলো। কিন্তু আলোকের কোনো সাড়া না পাওয়ায় তারা কষ্ট লাগলো সাথে ভয় টাও বেড়ে গেল। পরিশেষে তারা মুখ দিয়ে ডাকলো কিন্তু কোনো আওয়াজ করলো না। আলোক কয়েক কদম এগোলো। তারার কিছুটা কাছে আসতেই তারা শাড়ি গুটিয়ে বসে বলতে শুরু করলো,

‘ ভালোবাসার সংজ্ঞা কিভাবে দিতে হয় আমার জানা নেই। শুধু এতটুকুই বলবো ভালোবাসি।নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসি। আমি নিজেও জানিনা কীভাবে, কেনো তোমাকে ভালোবেসে ফেললাম।‌ যেই ছেলেটাকে একদিন আগে আমি সহ্য করতে পড়তাম না, আজ আমি তাকে এতটা ভালবাসি। আসলে কি জানত যখন আমরা কাউকে অপছন্দ করি, তখন তার ভালো কাজ,ভালো কথা সবকিছুই আমাদের অসহ্য লাগে। তোমার ক্ষেত্রে তেমনি করেছিলাম আলোক। কিন্তু যখন আমরা তাকে খুব কাছ থেকে চিনে ফেলি,তখন তার প্রতি একটা অ্যাট্রাকশন জন্মায়, তখন তার সব কিছুই আমাদের ভালো লাগে, এমনকি আমাদের অপছন্দ কাজ গুলোও ভালো লাগে। তোমার স্নিগ্ধ হাসি, আমি এত আজেবাজে কথা বলার পরেও সব কিছু মুখবুজে সহ্য করে নেওয়া, তোমার ধৈর্য্য, আর তোমার স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকানো, তোমার চোখের চাহনী এইসবের প্রতি আমার ভালোলাগাটা গভীর হয়ে গেছে। আর তোমার ঠোঁটের কোণের হাসি আর তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকানো আমাকে আরো দুর্বল করেছে, আর করেই চলছে। আমি আজ তোমাকে কিছুই জিজ্ঞেস করছি না আর করবো না কারণ আমাদের বিয়ে হয়েছে আর আমি তোমাকে আমার ফিলিং গুলো জানিয়ে দিচ্ছি। শুধু এইটুকুই বলবো আমি আমার পূর্বের কাজকর্ম, আচার আচরণ, কথাবার্তার জন্য অনুতপ্ত।তোমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অসীম ক্ষমাশীল। আল্লাহর সেই মহান গুনের পরিপ্রেক্ষিতে তুমিও তোমার এই অপদস্ত স্ত্রীটাকে ক্ষমা করে দিও।’

প্রথমে কথা গুলো তারা আলোকের দিকে তাকিয়ে বললেও শেষের কথা গুলো বলার সময় তারা মাথা নিচু করে ফেলে। কারন তার চোখ বয়ে পানি আসছিল। তারা পিছনে ঘুরে টেবিলের উপরে রাখা পার্পেল কালারের প্লাস্টিক ফুলটাকে নিয়ে আলোকের দিকে মুখ ফিরে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

‘আই লাভ ইউ আলোক । তুমি কি হবে আমার তারার আলোক? আবদ্ধ হবে তারালোকে?’

বলে ফুল টাকে এগিয়ে দিল তারা। এই ঘরে অনেক ফুলদানি ছিল আর সবগুলোই পার্পেল কালারের।তারা সেখান থেকে ই নিয়েছে। ছলছলে চোখে আলোকের দিকে তাকিয়ে আছে। আলোক স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কেমন সব কিছু তার স্বপ্নের মত লাগছে। তারার বলা প্রত্যেক টি কথা আলোকের। আলোক যখন চাঁদ কে প্রপোজ করেছিল তখন এইভাবে করেছিল। তারাও হুবাহু সেভাবেই করেছে। কিন্তু তারা কি সব জেনে করেছে? করলে সে জানলো কিভাবে? আলোক ওখান থেকে দ্রুত পায়ে ব্যালকনিতে গেল। কারন পুরোনো সব স্মৃতি যে তার চোখের সামনে ভেসে আসছে। আলোকের কান্না পাচ্ছে। কিন্তু সে কান্না কে চেপে রেখেছে। আলোক যেতেই তারার চোখ হতে দুফোঁটা অশ্রু জল গড়িয়ে পড়লো। আলোক কি তাহলে রাগ করেছে? তাকে কি নিবে না? তবুও তারা হাল ছাড়লো না। তারাও গিয়ে আলোকের পাশে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ পর আলোক পিছিয়ে ধপ করে বসলো।তারাও পিছনে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সেও সেখানে বসলো। তারপর তারা হাসিখুশি মুখ করে উচ্ছ্বাস কন্ঠে বললো,

‘শোনো ছেলে আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর তুমি আমাকে ভালোবাসো আর না বাসো তোমাকে আমার সাথেই থাকতে হবে। কারণ এত সহজে তুমি তারার হাত থেকে ছাড়া পাবে না।’

‘ তুমি একটু বেশিই ইনোসেন্ট আর ভদ্র ছেলে তাই এর জন্য তোমাকে একটু দেখে শুনে রাখতে হবে।

অনেক হাসিখুশি নিয়ে তারা বললো কিন্তু আলোক কোনো রিয়েক্ট করলো না। তারার মনের ভিতর এক ভয় লাগছে আলোক তাকে ক্ষমা করবে তো? তারা চোখের কার্নিশের জলটুকু মুছে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে অনেক গম্ভীর কন্ঠে আলোক কে ডাকলো,

‘আলোক?’

তারা এতটা গম্ভীর ভাবে ডাকায় আলোক হকচকিয়ে গেল। তারা দিকে তাকালো। তারা ভীরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে। চোখযুগল ছলছলে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি কেঁদে দিবে। আলোক কিছু বলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করলো। তারার দিকে তাকিয়ে কিছু বলবে তার আগেই তারা নিজের পা দুটো মেঝেতে বিছিয়ে দিয়ে আলোকের বাহু ধরে নিজের কাছে এনে তার মাথা নিজের কোলে নিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে গাইতে শুরু করলো,

‘ঘুমাও তুমি ঘুমাও গো জান,
ঘুমাও আমার কোলে…..
ভালবাসার নাও ভাসাবো,
ভালবাসি বলে…

তোমার চুলে হাত বুলাবো,
পূর্ণ চাঁদের তলে …..
কৃষ্ণচূড়া মুখে তোমার,
জোসনা পড়ুক কোলে…..
আজকে জড়ায় ধরবে,
তোমার মনকে আমার মন….
গাইবে পাখি, গাইবে জোনাক ;
গাছ গাছালি বন….

এত ভালবাসা গো জান,
রাখিও আঁচলে….
দোলাও তুমি, দুলি আমি ;
জগত বাড়ি দোলে …..
শব্দ ঘুমের মূর্ছনাতে,
বাতাসও সুর তোলে…..
ভালবাসার শিশির কণা,
পড়বে ও আঁচলে….
এত ভালবাসা গো জান,

রাখিও আঁচলে….
দোলাও তুমি, দুলি আমি ;
জগত বাড়ি দোলে …..
ঘুমাও তুমি ঘুমাও গো জান,
ঘুমাও আমার কোলে…..
ভালবাসার নাও ভাসাবো,
ভালবাসি বলে……”

[বিঃদ্রঃ এখানে কোনো রকম বাদ্যযন্ত্র বা কোনরকম অশ্লীল ওয়ার্ড নেই।আর স্বামী স্ত্রীর একে অপরের জন্য এইরকম গান গাওয়া যেতে পারে।]

গাওয়া শেষ করতে করতে তারা কেঁদে ফেলল। সাথে আলোকের চোখ হতে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। তারপর তারা আলোকের গালের উপর
নিজের মাথাসহ চোখ রাখলো। তারার চোখের পানি আলোকের গাল ছোয়াচ্ছে বার বার। তারা কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,

‘ আই এম রিয়ালি সরি আলোক। আমি তোমাকে কয়েকদিন অনেক কষ্ট দিয়েছি। রাগের বশে কিনা কি বলেছি। জানি হয়তো তা ক্ষমার অযোগ্য! তবুও আমি ‌ক্ষমাপ্রাপ্তি তোমার কাছে। আমি জানি আমি তোমার মত ছেলেকে ডিজার্ভ করি না। তোমার স্ত্রী হওয়ার আমার যোগ্যতা নেই। জানি না এইকয়েকদিন আমার কি হয়েছিল!হয়তো শয়তান মাথয় চেপে বসছে। আমি_ আমি আমার পরিপ্রেক্ষিতে যেটা সঠিক ভাবছিলাম ,প্রকৃতপক্ষে ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে সেটা ছিল ভুল! কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি। শয়তানকে প্রশ্রয় দিয়ে তোমার সাথে যা করেছি তার জন্য আমি অনুতপ্ত।আমাকে মাফ করে দাও প্লিজ। নিজের করা পাপের জন্য প্রতিনিয়ত আমি ভিতরে শেষ হতে যাচ্ছি। আমি প্লিজ তুমি আমাকে মাফ করে দাও।’

এইসব বলে কাদঁছে তারা। তার চোখের পানি আলোকের মুখে পড়ছে। আলোক খুব অবাক হয়েছে। এইসব একদম সেদিনের মতই! শুধু আলোক ছিল তারার জায়গায় আর তার জায়গায় ছিল চাঁদ। কিন্তু তারা কিভাবে এইসব জানলো?‌প্রশ্ন হানা দিচ্ছে আলোকের মনে। তারাও আলোকের ওইদিনের মত করে ‌ক্ষমা চাচ্ছে। সেও সেইরকম ভুল করেছে যেরকম আলোক করেছিল।।মানুষ মাত্রই ভুল। আলোকের দ্বাড়াও ভুল হয়েছিল সেও ক্ষমা পেয়েছে। আলোক তারার দিকে তাকালো দেখলো তার চোখের কাজল কান্নায় চারিপাশে লেপটে গেছে। তারা কে আই মুহূর্তে দেখে আলোকের হাসি পেলো। আলোক হালকা হাসলো। আলোকের হাসিতে তারা বিস্মিত হয়ে গেলো। আলোক তারার কোল থেকে উঠলো। তারা হুহু করে কেঁদে কেঁদে আবার বলতে লাগলো,

‘ আম_ আমি জানি আমি তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছি। অনেক অনেক কষ্ট দিয়েছি। তোমার থেকে আলাদা হতে চেয়েছি!’

বলে একটু জোরে কাদলো তারা।

‘ কিন্তু এখন আম_আমি_আমি তোমার সাথে থাকতে চাই। প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও।

আলোক তারা দিকে তাকালো। ইচ্ছে করছে তার চোখ দুটো মুছে দিতে । আলোক শান্ত কন্ঠে বললো

‘আপনার প্রতি আম_____

তারা থামিয়ে দিয়ে মুখ ফুলিয়ে বললো,

‘আপনি না ‘তুমি’। ‘তুমি’ করে বলবে আমায়।আবার বলো।’

তারার কথায় আলোক হাসলো। কারণ এক সময় এটা সে-ই বলেছিল!

‘তোমার প্রতি আমার কোন রাগ, অভিযোগ, অভিমান নেই তারা। তাই এখানে ক্ষমা করার কোনো প্রশ্ন আসে না। আজ যদি আমি তোমার উপর রাগ, অভিমান করে থাকি তাহলে অন্য একজনের কাছে আমি অপরাধী হয়ে থাকব। আমিও একসময় একই ভুল করেছিলাম। তুমি আমার স্ত্রী মানে আমার পরিপূরক। আমার উপর নিজের রাগ,ভালোবাসা, অভিমান সব কিছু করার-ই তোমার অধিকার আছে। আমি তোমার উপর কখনোই রাগ করিনি,না করেছি অভিমান।তাই ক্ষমা করার কথা আসে না।আর আল্লাহ তাআলা মহান। তিনি তার বান্দাকে অতিসহজেই ক্ষমা করে দেন,যদি সে একবার মন থেকে তওবা করে।তাহলে সেখানে আমি কে যে তোমাকে ক্ষমা করার?আমি নিজেও একজন পাপী বান্দা। তাই ক্ষমার করার কোনো প্রশ্নই আসে না। আর তুমি

তারা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষন থেকে আমচমকা-ই সে আলোককে জড়িয়ে ধরলো। ধরে কাঁদতে লাগলো। হটাৎ করে এমন হওয়ায় আলোক একটু হকচকিয়ে গেল। কারণ আজ এগারো বছর পর কোনো মেয়ের ছোঁয়া পেল। কোনো মেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। লাস্ট বার চাঁদকে দাফনের সময় আলোক জড়িয়ে ধরেছিল। তারপর থেকে আজ তারা তাকে জড়িয়ে ধরলো।

‘সরি আলোক। সব সময় চেষ্টা করবো তোমায় খুশি রাখার। তোমার সব কথা শুনবো , তুমি যেমন চাও তেমন ভাবে থাকবো। তোমাকে হ্যাপি রাখার নিজের বেস্ট ট্রাই করবো।আল্লাহ্ আমার সাধ্যে যতটুকু দিয়েছে সবটা দিয়ে চেষ্টা করবো। শুধু প্লিজ তুমি আমাকে ডিভোর্স দিও না! আমাকে ছেড় না। আমি এটা বলবো না যে তোমাকে সব সময় হাসি খুশি রাখবো,কখনো তোমাকে কাদাবো না। কারণ এইসব শুধু কল্পনায় মানায় বাস্তবে নয়। বাস্তবে জীবনে সুখ,দুঃখ,কষ্ট,হাসি,কান্না সবই থাকবে। তবেই না এর নাম জীবন।’

বলে তারা হালকা হাসলো কিন্তু চোখ দিয়ে খুশির অশ্রু বয়ে যাচ্ছে। আলোক ও হাসলো। আলোক ভাবছে তারা বেশির ভাগ কথাই তার সব কথা কপি করে বলেছে। সে চাঁদকে যা বলেছিল সেগুলোই তারা বলছে। কিন্তু আলোকের মনে প্রশ্ন হানা দিচ্ছে তারা এইসব জানলো কীভাবে? তারা আলোককে ছেড়ে তার হাত ধরে বললো,

‘ আমাকে প্লিজ ছেড়ো না। আমি তোমার সাথে থাকতে চাই। তোমার তারা হয়ে থাকতে চাই। প্লিজ আমাকে রাখো।’

বলে আলোকের হাত ধরে বিজড়িত চোখে কাঁদতে শুরু করে জোরে জোরে। আলোকের দুর্বলতা অশ্রু। সে এমনিতেই এটা কে সহ্য করতে পারে না। তারার কান্না করাটাও তার ভালো লাগছে না। আলোক ইতস্তত হয়ে বললো,

‘ তার_ তারা!’

তারা মুখ তুলে বড় বড় চোখ করে বললো,

‘ তারা পাখি হয়না আলোক?’

আলোক মৃদু হাসলো। তারপর তারার চোখের চারিপাশে লেপ্টে থাকা কাজল গুলো মুছতে মুছতে বললো,

‘ হয়। তারা পাখিও হয়! আর তুমি যদি থাকতে চাও আমার এতে না নেই। কিন্তু প্লিজ কান্না থামাও।’

তারা খুশিতে আবার জাপটে ধরে আরো জোরে কেঁদে দিল।

#চলবে….🥴