#আঁধারিয়া_অম্বর
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
১২।
পিটপিট করে চোখ খুললো শ্যামা। মাথায় আর শরীরে প্রচন্ড ব্যাথা করছে তার। চারিদিকের ধপদপে সাদা আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। হসপিটালেরক উটকো গন্ধে নিশ্বাস নিতে পারছে না সে।ডান পাশে তাকালো একবার। পাশের সোফায় ছোট্ট বোন জান্নাত গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। সে উঠতে চাইলো। ঠিক তখনি বুঝতে পারলো কেউ একজন তার পা আঁকড়ে ধরে আছে। শ্যামা বড্ড অবাক হয়ে হালকা একটু মুখ তুলে দেখতে পেলো একটি পুরুষালী দেহ। মানুষটি তার পায়ের উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে।মুখটা দেখতে না পেলেও বুঝতে পারলো এটি আর কেউ না ইজহান। শ্যামার মনের মাঝে অদ্ভুত অনুভূতি হলো। ঠোঁটের কোনে দেখা গেলো এক চিলতে হাসি। তখন মহিলা গুলো এলো পাথরি মারছিলো, শ্যামা ব্যথায়, যন্ত্রণায় নিজেকে রক্ষে করতে ভুলে গেছিলো। শ্যামা এক পর্যায় যখন মাটিতে পরে গেলো, তখন তার পিঠ, বুক, পেটে একের পর এক লাথি পড়ছিলো। শ্যামা ব্যথায় কাতরাছিলো। এক পর্যায় যখন আর সইতে না পেরে চোখের পাতা ভাড়ি হয়ে আসছিলো? ঠিক তখনি একটি পরিচিত মুখ আর তার কন্ঠ কানের বাড়ি খেলো। শ্যামা ঢুলুঢুলু চোখে শুধু ইজহানের মুখটুকু দেখলো। ইজহান তার কাছে এসে বলিষ্ঠ হাতে তাকে তুলে নিয়েছে কোলে। আর চিৎকার করে বলে যাছিলো,
“শ্যামা ভয় পেয়ো না.. আমি.. আমি আছি… সব ঠিক করে দিবো। শ্যামা.. শ্যামা…”
শ্যামা ততখনে ইজহানের বুকে শান্তি ছোঁয়া পেয়ে মাথা হেলিয়ে দিলো। না চাইতেও তার মনে হলো,ইজহানের বুকটা বড্ড বড্ড শান্তির স্থান।
শ্যামা নিচের ঠোঁট কামড়ে ইজহানের ঘুমন্ত মুখটা দেখে ভেবে যাচ্ছিলো হাজার টা ভাবনা। তার মাঝেই জান্নাতের কন্ঠে ভবনার ফোয়ারাটা ছিকে পড়লো।
“বড়পু তুমি উঠে গেছো?”
হাসি হাসি মুখে জান্নাত বলতেই শ্যামা সতর্কের সাথে মুখে আঙ্গুল দিয়ে চুপনথাকতে বলল। জান্নাত কিছুই বুঝলো না। কেন তার বোন তাকে চুক করতে বলছে?
মূলত ইজহানকে সে জাগাতে চায় না। ইজহানের ঘুমন্ত মুখটি দেখতে অনেকটা ছোট বাচ্চাদের মতো লাগে। যদিও জান্নাতের কথায় হালকা হয়ে আসে ইজহানের ঘুম। ইজহান মাথা তুলে তাকাতেই শ্যামাকে দেখে ব্যস্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে,
“আর ইউ ওকে? এখন কেমন লাগছে তোমার?”
শ্যামার জন্য এভাবে বিচলিত হতে দেখে অবাক হলো খুব। কিন্তু কিছু বলল না। শুধু হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ালো। ইজহান আবার বলল,
” আমি ডাক্তারকে ঢেকে আনছি!”
শ্যামা আবারো মাথা নাড়লো। আর ইজহান উঠে দাঁড়িয়ে শ্যামার কাছে এসে কঁপালে ঠোঁটের স্পর্স করে বেড়িয়ে গেলো। শ্যামা বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে তার যাওয়ার দিক তাকিয়ে রইলো পলকহীন ভাবে। এক অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগলো শরীরের শিরায় উপশিরায়। শ্যামা সাথে এ-ও লক্ষ করলো নিট এন্ড ক্লিন থাকা ছেলেটি আজ বড্ড অগোছালো। এসব দেখে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জান্নাতের মনে খচখচ করতে লাগলো। ইজহান দরজার আড়ালে হারিয়ে যেতেই জান্নাত প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
“বড়পু? তুমি বিয়ে করে নিয়েছো? আর ইজহান ভাইয়াকে পেলে কই তুমি? বাবা না বলতো, ইজহান ভাইয়ার আব্বুর সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই? তাহলে?”
জান্নাতের ছোট মাথায় থাকা এত এত প্রশ্ন সব করে বসলো আর না পেরে। শ্যামা বলল,
“জান… এখানে বস…! বলছি..”
একে একে সব ঘটনা বোনকে বলল সে, চেপে গেলো শুধু রক্ষিতার টপিকটি। জান্নাত সব শুনে হেসে বলল,
“ইজহান ভাইয়াকে ছোট থেকেই ভালো লাগতো আমার। আমি খুব খুশি হয়েছি তোমার তার সাথে বিয়ে হয়েছে। সে খুব ভালো।কষ্ট তখন হতো, যখন ওই রিদের সাথে তোমার বিয়ে হতো, সে তো তোমাকে কন্ট্রোল করতে চাইতো সব সময়!”
শ্যামা দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। ফ্যাকাসে হেসে বলল,
“হ্যাঁ মি. ইজহান খুব ভালো,৷ উনি না থাকলে হয়তো আমাদের এই হাল হতো না…!”
জান্নাত বুঝতে পারলো না তার কথা। চেয়ে রইলো বোনের দিকে। ঠিক তখনি স্ব শব্দ হুড়ডকরে ঘরে ঢুকলো অধিরাজ। পাশেই একজন নার্স। তার হাতে একটি ট্রে, গরম ধোঁয়া উঠা স্যুপের বাটি। অধিরাজ চাপা হেসে বলল,
“শ্যামা এটি খেয়ে নাও ইজহান পাঠিয়েছে।”
শ্যামা আশেপাশে তাকাতেই অধিরাজ আবারো বলল,
“ইজহানকে খুঁজছো? সে তো চলে গেছে!”
“চলে গেছে?”
“হ্যাঁ, আর বললো না, বুঝলে তার দাদিজান ফোন করলো বলল কি জরুরি কাজ আছে। তুমি চিন্তা করো না চলে আসবে, এমনিতেও সারা রাত এখানে বসে ছিলো সে। ঘুমটা টিক মতো হয়নি, বিশ্রাম করা দরকার। কি বলো?”
ইজহান সারা রাত এখানে বসে ছিলো শুনে শ্যামার মনের কোনে এক রাশ ভালো লাগা কাজ করতে লাগলো। এমন একটি গম্ভীর মানুষ যে কিনা তাকে ঘৃণা করে, সেই তার জন্য বসে ছিলো পাশে, তাউ সারা রাত? এটি কি আদো সম্ভব???
———–
এয়ারপোর্টের বাহিরে গাড়ির ভিতরে বসে অপেক্ষা করছে ইজহান। বাসায় গিয়ে ফ্রেস হয়ে বেড় হতেই তার দাদিজানের কড়া আদেশ শুনতে পায়,
“মেহরিনকে নিয়ে সোজা বাসায় আসবি, কে মরলো, কে বাঁচলো তাতে তোর কিছু যায় আসে না। ভুলিস না.. সে তোর শুধু রক্ষিতা। সমাজে যাকে খারাপ দরজা দিয়ে থাকে!”
ইজহান সঙ্গে সঙ্গে হাত মুঠ করে ফেললো। দাদিজানের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“দাদিজান ভুলে যেয়ো না সে আমার স্ত্রী।
দাদিজান তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বললেন,
” রক্ষিতা কখনো স্ত্রী হয় না..!”
ইজহান হাত দুটি মুষ্টি বদ্ধ করে নিলো। রাগে গা রি রি করে উঠলো। ঠিক তখনি তার ফোনটা বেজে উঠলো। ইজহান ফোনটি হাতে নিতেই জ্বল জ্বল করে উঠলো একটি নাম। কিঞ্চিৎ হেসে ফোনটি দুলতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো একটি মেয়েলীর উৎকন্ঠা,,
“দাদা ভাই? আম ব্যাক…..!”
ইজহান তার গম্ভীর কন্ঠে হেসে বলল,
“আসছি আমি!”
তার পরেই ফোনটি পকেটে ভরে ইজহান চলে এলো এয়ারপোর্টে। গাড়ি কাচের টুকা পড়তেই ইজহানের ভাবনার ছেদ পড়লো। হেসে দরজা খুলতেই একটি ২০,২১ বছরের মেয়ে ভিতরে ঢুকে জড়িয়ে ধরলো। খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
“কেমন আছো দাদা ভাই!”
“ভালো!”
“তো কেমন কাটলো সফর? ”
চকিতে বলল আয়ানা,
“খুব ভালো, মেহরিন আপুর সাথে সময় কিভাবে কেঁটে গেলো বুঝতে পারিনি!”
ইজহান তা শুনে হাসলো শুধু। তার অন্য পাশে ততক্ষণে মেহরিন বসে পড়েছে৷ সে বলল,
“কেমন আছো ইজহান? ”
ইজহান ইগনোর করলো। যেন শুনেই নি কিছু। এক রাশ দুঃখ নিয়ে জল ছেড়ে দিলো চোখের। এতে বিরক্তি লাগলো ইজহানের। এ মেয়েটি বড্ড গায়ে পড়া। তার উপর কিছু হলেই আগে তার চোখের জল কথা বলবে, অসহ্য।
গাড়ি চলতে শুরু করলো। আধঘন্টার মাঝে ইজহানের বাড়ির সামনে এসে পড়লো। ইজহান তাদের নামিয়ে দিয়ে বিদায় নিলো। তাকে এখন শ্যামাকে দেখতে যেতে হবে, না জানি কি অবস্থা মেয়েটির। ভেবেই আবার গাড়িতে উঠে পড়তে নিতেই আয়ানা বাঁধা দেয়। ছল ছল চোখে বলে উঠে,
“দাদা ভাই, তুমি আমাকে ছেড়ে তার কাছে চলে যাচ্ছো? আমার থেকে ওই মেয়েটি বেশি ইম্পর্টেন্ট?? ”
ইজহান স্তম্ভিত হলো। আমতা আমতা করে বলল,
“সে অসুস্থ আয়ানা, আমার যেতে হবে!”
আয়ানা হুহু করে কেঁদে দিলো। বলল,
“দাদা ভাই তুমি সব ভুলে গেছো? সব… ওই মেয়েকে তুমি আবারো ভালোবেসে ফেলেছো? ভুলে গেছো? তাদের জন্য আমরা আমাদের মাকে হারিয়েছি? আমি আমার ছেলে-,বেলা হারিয়েছি?”
ইজহানের বুকে মাঝে একটা ধাক্কার মতো লাগলো। সে বিনা বাক্য ব্যয় করে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে গেল সে।
————-
এদিকে সাত দিন কেঁটে গেলো ইজহানের দেখা পাওয়া গেলো না আর। সেদিনের ঘটনার পর শিফনকে জেলে ভরা হয়েছে, পর পর৷ কেশ ঠুকেছে ১০ টা। তার বাবার কমিশনার পদ চলে গেছে। ধরা পরেছে অবৈধ সব কিছু। শ্যামা না চাইতেও ইজহানের এই সব করা কাজে মুগ্ধ হয়েছে, এবং এক প্রকার মিস করতে শুরু করে দিয়েছে। একা একা সময় গুলো অনেক কষ্টকর হয়ে গেছে। জান্নাতের ছুটি শেষ, সেও চলে গেছে। আজ দু দিন যাবত শ্যামা ইজহানের একটি বাড়িতে গিফট হয়েছে। তার আগের বাড়ি থেকে এ বাড়িটি আরো প্রকন্ড। শ্যামার মাঝে মাঝে ভয় ভয় করে এই বাড়িটিতে একা থাকতে। এখন রাত দুটো বাজে, আধাঁরিয়া অম্বরে সুক্ষ সুক্ষ তারকামন্ডল। শ্যামা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো আকাশের দিকে। এই পৃথিবীতে সে একা। এক সময় ছিলো, নিশাচর রাতের সঙ্গী হতো একজন সুফিয়ান দ্যা সিক্রেট বয়। হাসলো শ্যামা। এখনো মনে আছে প্রথম এই ছেলেটিকে সে মিসড কল দিয়ে ছিলো। তিন বারের মাথায় যখন কল ব্যাক করে, ও পাশ থেকে থমথমে কন্ঠে বরে উঠে কেউ,
” হ্যালো?”
শ্যামা ভয়েই কল কেটে দিলো। বুকের মাঝে ধীম ধীম করছিলো তখন। অথচ রিদের সাথে কথা বলার সময় নরমালি কথা বলতো। তবে এমন কেন হয়েছিলো? আজো জানে না শ্যামা।
শ্যামা ছোট শ্বাস ছাড়লো। রাতে একাকিত্ব কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে লাগলো ওকে। সে না পেরে ফোন তুলে ইজহানকে কল করলো। এবং ঠিক সঙ্গে সঙ্গেই কল রিসিভ করলো ইজহান….
ওপাশ থেকে ইজহানের গম্ভীর কন্ঠ ভেসে আসতেই, একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো দেহে। চিরচেনা সেই বুকে ধুকপুক শুরু করলো। বুকের বা পাশটা জোরে চেপে ধরে রাখলো। আর তখনি….
চলবে,