#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_২৫
প্রিয় যখন মিথিলাকে তার ডিপার্টমেন্টের সামনে নামিয়ে দিলো তখন আশেপাশের সবাই যারা মিথিলাকে চিনে তারা বেশ চোখ বড় বড় করে প্রিয়কে দেখছিল। মিথিলার সাথে কয়েকটি কথা শেষ করে চলে যাবার জন্য গাড়ির গেইট খুলল তখনই চোখ পড়ল গাড়ির পেছনের সিটে রাখা একটা ফাইলের ব্যাগের দিকে। মিথিলা বলেছিল কী একটা রেজিস্ট্রেশন চলছে! এর জন্যই এত তাড়াতাড়ি করে আসা। প্রিয় বুঝতে পারল মিথিলা মনের ভুলে হয়তো ফাইলটি ফেলে রেখে গেছে । প্রিয় তড়িঘড়ি করে ফাইলটি নিয়ে মিথিলার পিছে ছুটতে লাগল।
ততক্ষণে মিথিলা বেশ খানিকটা সামনে এগিয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখনো তাকে দেখা যাচ্ছে।
প্রিয় বেশ চড়া গলায় মিথিলাকে পেছন থেকে ডাকছে। কিন্তু চারপাশের শোরগোলে সেদিকে খেয়াল নেই মিথিলার সে আপন মনে এগিয়ে চলছে। মিথিলার নাম ধরে এতো জোরে জোরে ডাকছে দেখে আশেপাশে কয়েকজন মিথিলার দিকে খেয়াল করলেও মিথিলার সেদিকে কোন হুশ নেই সে তার কোন এক ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলতে বলতে বেশ জোর পায় অফিস রুমের দিকে যাচ্ছে।
প্রিয়র মেজাজটা গরম হয়ে গেল ফোনটাও সে গাড়িতেই রেখে এসেছে ।ওকে যে ফোন করবে সেই উপায়ও নেই। বিড়বিড় করে আপন-মনে বলেই যাচ্ছে, “ মহারানী রেজিস্ট্রেশন করতে যাচ্ছে অথচ ফাইল নেওয়ার খোঁজ নেই । ওখানে গেলেই হুঁশ ফিরবে । আমার উচিত এখন গাড়িতে ফিরে যাওয়া। ফোন করলে নিজে যেয়ে নিয়ে আসবে। আমি যে কেন পাগলের মত পিছু পিছু ছুটছি? যখন হাঁটে পেছনের দিকে কোন খেয়াল থাকে না। “
প্রিয় হঠাৎ করে মিথিলাকে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে ফেলল । এতক্ষণ চোখে চোখেই ছিল। চোখের পলকেই মিথিলাকে আর দেখছে না। ভিড়ের মধ্যে এদিক-সেদিক তাকাতে তাকাতে খেয়াল হলো এক কর্নারের দিকে একটা ছেলে মিথিলার হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ছেলেটা মিথিলার অচেনা কেউ না হলেও তার মতের বিরুদ্ধেই তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। প্রিয়র চোয়াল হঠাৎ করে শক্ত হয়ে এল। সে আর এদিক সেদিক না তাকিয়ে বেশ দ্রুতগতিতে দু’হাতে ভিড় ঠেলে সামনের দিকে এগুতে লাগল। ছেলেটার শরীরের আড়ালে মিথিলাকে একদম দেখাই যাচ্ছে না। দেয়ালের সাথে পিঠ ঘেষে ছেলেটার হাতের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে মিথিলা। প্রিয় বিদ্যুৎবেগে এগিয়ে যে হ্যাঁচকা টানে ছেলেটাকে সরিয়ে দিল।
এত জোরে টান দিল ছেলেটা হয়ত ব্যথাই পেয়েছে। ব্যথায় কিছুটা কুঁকড়ে যেয়ে মেজাজ খিচড়ে সে প্রিয়র দিকে তাকিয়ে বলল,
– হোয়াট ননসেন্স! হু আর ইউ?
– আগে বল তুই কে?
– হ্যালো মিস্টার, সংযত হয়ে কথা বলুন! আপনি তুই-তোকারি কেন করছেন?
– এর থেকেও কোনো নিচু ভাষা জানা থাকলে সেটা তোকে বলতাম! এখন বল তুই মিথিলাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছিস?
প্রিয়কে দেখে মিথিলারও চোখ বড় বড় হয়ে গেল। খানিকটা অবাক হয়ে ভাবছে প্রিয় এখানে কী করে এল?
পরে প্রিয়র হাতে ওর ফাইল দেখে ব্যাপারটা পরিস্কার হলো।
প্রিয়কে দেখে খানিকটা সাহস পেয়ে সে ভীতসন্ত্রস্তভাবে যেয়ে প্রিয়র পাশে দাঁড়ালো। প্রিয় ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মিথিলার ডান হাতটা তার বাম হাতের মধ্যে চেপে ধরল। মিথিলা অবাক হয়ে প্রিয়র মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এ যেন অন্য প্রিয়কে দেখছে । তার প্রতি এতটা কেয়ারিং আচরণ করতে এই দু’বছরে একদিনও দেখেনি সে।
– মিথিলাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছিস? ছেলেটা নিশ্চুপ দেখে সে আবারো বলল, কিরে কথা কানে যাচ্ছে না? ওকে এভাবে টানতে টানতে এখানে কেন নিয়ে এসেছিস ? উত্তর দে!
মিথিলাকে যে প্রিয় হাত চেপে ধরে প্রায় বুকের কাছে সেঁটে রেখেছে ব্যাপারটা ভালো লাগল না আইমানের।
– আমিতো আপনাকে উত্তর দিতে বাধ্য নই। আগে আপনি বলুন আপনি কে? মিথিলার আশিক?
– ইয়েস, আ’ম হার আশিক! ডু ইউ হ্যাভ এনি প্রবলেম?
– বিড় বিড় করে আইমান বলল, মাই গড! তার মানে আশিক জোগাড় করে ফেলেছ? এতদিন ধরে তো খুব সতী-সাধ্বী সাজার ভান করলে! তুমি নাকি জীবনে প্রেম করবে না? বড়দের পছন্দে বিয়ে করবে ব্লা… ব্লা.. ব্লা…! নীতিকথাগুলো তবে সবই ছিল তোমার ঢং, তাই না? রাবিশ! আসল চেহারা তাইলে এটা। খুব তো বাহাদুরি করে বলতে এসব কথা ! আসল মুখোশ তবে খুলে গেল।
প্রিয় বা মিথিলা কিছু বলার আগেই রাগে গজগজ করতে আইমান সেখান থেকে চলে গেল।
প্রিয় মিথিলার হাত ধরে টেনে নিয়ে বাইরের দিকে বেরিয়ে এলো। প্রিয়র এমন আচরণ দেখে মিথিলা ভয় কিছুটা কাঁপছিল। এমনিতেই এই প্রথম প্রিয় তার হাত ধরেছে। প্রিয়র সেদিকে খেয়াল আছে কিনা মিথিলার জানা নেই। কিন্তু তার তো ঘাম ছুটে যাচ্ছে।
– কে এই ছেলে, মিথিলা? ঝাঝের সাথে জিজ্ঞেস করল প্রিয়।
– ওর নাম আইমান! আমাদের ডিপার্টমেন্টেই পড়ে। তবে আমার এক ব্যাচ সিনিয়র।
– তোকে এভাবে বিরক্ত করছে কেন? আর তুই বা চুপ ছিলি কেন? একদম সত্যি কথা বলবি। একটা মিথ্যে কথা বলবি তো তোর খবর আছে! আমি এক্ষুনি আম্মুকে ফোন দিব।
– বিশ্বাস করো, ভাইয়া । আমার কোন দোষ নেই। ও এমনই।সবসময় আমার উপরে অধিকার ফলাতে চাই। আইমান আমার ছোট চাচির বড় ভাইয়ের ছেলে। ওকে আমি ছোটবেলা থেকেই চিনি। আম্মু বেঁচে থাকতেই সেই ক্লাস এইট নাইন থেকে আমার পিছু লেগেছে। একথা আম্মুও জানত। ওদের পরিবারের কাউকেই কখনোই আম্মুর পছন্দ ছিল না। তাই আম্মু আমাকে বারবার ওর থেকে দূরে থাকার জন্য সাবধান করেছিল। আমি আজও আম্মুর কথা ভুলিনি। আগে প্রায়ই আমাদের বাসাতে আসত। মাঝেমাঝে ক’দিন করে থাকতও। তিনতলায় ওর ফুফুর বাসাতে থাকত। আমরাই বা কী বলব? ছোট চাচিদের বাসায় বেড়াতে আসলেও আমি তো বুঝতাম যে ও আসলে এত বারবার আসে কেন? কিছুদিন চুপচাপ থাকলেও ভার্সিটিতে আসার পর আবার আমাদের দেখা। আগের মতোই আমাকে আবার বিরক্ত করা শুরু করেছে।
– ওহ আই সি! তাহলে এতদিন কেন বলিস নি?
– বলিনি কারণ আইমান ততটা খারাপ ছেলে নয়। ও আমাকে পছন্দ করে। এজন্য এমন পাগলামি করে। এমনিতে আমার সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করেনি। লেখাপড়ায়ও খুবই ভালো।
– খারাপ ব্যবহার করে না ভালো ব্যবহার করে তা তো দেখতেই পাচ্ছি! নাকি তুইও পছন্দ করিস ওকে?
– ছিঃ ছিঃ, ভাইয়া। এসব কি বলছ? আমি ওকে কেন পছন্দ করতে যাব? পছন্দ যদি করতাম তাহলে তো সেই শুরুর দিক থেকেই ওর কথা শুনতাম!
– এতই ভালো বলছিস তবে ওকে পছন্দ করিস না কেন সেই কারণটা একটু বলতো! কিছুটা স্থির মেজাজে জিজ্ঞেস করল, প্রিয়!
– কেন পছন্দ করি না সেটা জানি না। এটা সেও আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করেছে কিন্তু আমি কোনো সদুত্তর দিতে পারিনি। শুধু জানি ওকে আমি পছন্দ করি না। তাছাড়া আম্মু ওকে পছন্দ করত না। মানুষের পছন্দ-অপছন্দ মন থেকে আসে। যেটা মন থেকে আসেনি সেটা জোর করে কী করে হবে বলো? কালকে কি জোর করে ভালোবাসা যায়?
– বুঝলাম! ভালোবাসার সম্পর্কে দেখছি অনেক কিছুই জানিস। বড় হয়েছিস তাহলে। কিন্তু ও তোর সাথে যেভাবে বিহেভ করে তাতে তো তোকে নিয়ে ভয় হচ্ছে । উলটাপালটা কিছু করে না বসে! আমি কি ওর গার্ডিয়ানের সাথে কথা বলব?
– না না! গার্ডিয়ান পর্যন্ত পৌঁছিও না। তাহলে এটা আমার চাচীর কানে যাবে। আর চাচীর কানে গেলে দোষটা সম্পূর্ণ আমার দেবে। তখন আব্বু আর চাচার কাছে না জানি বানিয়ে বানিয়ে আরো কত কী নালিশ করবে? আমি দেখছি ওর সাথে কথা বলে কি করা যায়! যদি আসলেই আরো বেশি সমস্যা করে তাহলে আমি তোমাকে বলবো। প্লিজ, আপাতত আর কাউকে জানিও না। রুম্পা মাকেও না।
– দেখিস নিজে সামলাতে যেয়ে আবার কোন অঘটন যেন ঘটে না যায়!
– ইনশাআল্লাহ! তবে কোন সমস্যা হবে না আশা করছি। হলে প্রথমে তোমাকে জানাব। আমি মনে হয় গাড়িতে ফাইল ফেলে এসেছিলাম ভুলে।
– হুম। ফেলে এসেছিলি বলেই তো এই সিন দেখতে পেলাম। না হলে তো কোনদিনও বলতি না। একা একা এসব সাফার করেই যেতি। আচ্ছা, এরপর যদিও তোকে বিরক্ত করে আমাকে জানাস কিন্তু। ওকে শায়েস্তা তবে আমি করব।
– থ্যাংক ইউ, ভাইয়া। তোমার মিটিংয়ে দেরি হয়ে যাচ্ছে মনে হয়!
– দেরি হয়ে যাচ্ছে না, আ’ম অলরেডি লেইট। ওকে বাই। টেক কেয়ার! যাওয়ার সময় ট্যাক্সি বা সিএনজি ডেকে চলে যাস।
প্রিয়র চলে যাওয়ার দিকে একনাগাড়ে তাকিয়ে আছে মিথিলা। এই তাকিয়ে থাকার যেন শেষ নেই। প্রিয়র কথাটা শুধু তার কানে বাজছে, ” ইয়েস আ’ম হার আশিক! ডু ইউ হ্যাভ এনি প্রবলেম? ” প্রিয় তাকে এত কেয়ার করে জানা ছিল না। ভাবতেই চোখ দু’টি ভিজে এল মিথিলার।
এদিকে আমি ঘন্টাখানেক ধরে নানান ভাবে চেষ্টা করছি হেলেনের পেট থেকে কথা বের করার। হেলেনের বড় ছেলে আসিফকে দেখার পর আমি নিজেকে বড় কষ্টে এখনো নিয়ন্ত্রণে রাখছি। আমি চাইলে সরাসরি আসিফের ব্যাপারটা ওকে জিজ্ঞেস করতে পারি কিন্তু আমি সেটা চাচ্ছি না। নানান ভাবে কৌশলে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বের করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমার বিশ্বাস ও নিজে থেকেই সব কিছু বলবে। খুব বেশি ভয়-ভীতি দেখাতে শুরু করলাম। এবং এমনভাবে কৌশলে ওকে বোঝানোর চেষ্টা করছি যাতে সব দোষ সেলিমের ঘাড়ে গিয়েই চাপে। য়ার আমিও যে সেলিমের উপর প্রচণ্ড বিরক্ত সেটাও বোঝাচ্ছি। এতটুকু বিশ্বাস আছে যে নিজের স্বামীর চেয়ে নিশ্চয়ই সে সেলিমকে প্রাধান্য দিবে না। স্বামীকে বাঁচাতে আমার কাছে সত্য সে নিশ্চয়ই স্বীকার করবে। অবশেষে আমার কৌশল কাজে লাগল। হেলেন ভয় পেয়ে মুখ খুলল।
– আমি আপনাকে সবই বলছি আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা সেটা আমি জানি না। বিশ্বাস অবিশ্বাস আপনার কাছে। তবে আমি আমার সন্তানদের কসম করে বলছি আমার কথার মধ্যে একবর্ণ মিথ্যে পাবেন না।
– কোন কথাটা বিশ্বাস করা যায় আর কোনটা বিশ্বাস করা যায় না সেটা বোঝার মত বয়স এবং অভিজ্ঞতা দুটি আমার আছে। তুমি বলতে পারো। তবে আমার এতটুকু বিশ্বাস আছে আছে তোমার প্রতি যে তুমি আপন পরের তফাৎ টা এতদিনে নিশ্চয়ই বুঝেছ। মিথ্যে বলে শুধু শুধু নিজেকে বিপদে ফেলবে না। অন্ততপক্ষে তোমার বাচ্চা দুটির কথা ভেবে কথা বলবে তুমি। আর আমিও তোমাকে কথা দিচ্ছি তোমাকে বিপদে ফেলবো না। আমি জানি তুমি আমার মত একটা মেয়ে। একজন মেয়ে হয়ে যদি আরেকজন মেয়ের কষ্ট বুঝতে না পারি তাহলে মেয়ে হয়ে জন্ম নিলামই বা কেন? আমি অলরেডি অনেক কিছুই জেনে ফেলেছি। এখন শুধু তোমার মুখ থেকে শোনার অপেক্ষা। একটা কথাও যদি লুকাতে চেষ্টা করো তবে মাহাতাবের সাথে সাথে তোমার ভাগ্যেও খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে। বিশেষ করে আসিফের ব্যাপারে একটা কথাও লুকাবে না আশা করছি।
আসিফের নাম নিতেই চোখ দু’টি বেশ সতর্ক হয়ে উঠল হেলেনের। আমি আসিফের নামটা এ জন্যই উল্লেখ করলাম যাতে সে এটাকে অন্য কোনো কাহিনী দিয়ে ধামাচাপা দিতে না পারে। আমার কাছে এটাই এখন মুখ্য বিষয়। মাহাতাব কি চুরি করল সেলিমের আর না করলো তাতে আমার কিছু আসে যায় না।
– সেলিম আমাকে সবই বলেছে । এখন শুধু তোমার মুখ থেকে শোনার অপেক্ষা। জানোই তো একমুখে শোনা কোনো ঘটনার তদন্ত কখনোই নিরপেক্ষ হয় না।
– হেলেন বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে আছে। চোখদুটি ছলছল করছে। কিছুটা বিরতি নিয়ে সে মুখ খুলল, বর্তমান সম্মন্ধে বলতে গেলে অনেক আগে থেকেই বলতে হয়। না হলে ক্লিয়ার বোঝাতে পারব না। আমি সবকিছু আপনাকে সংক্ষেপে বলছি। সব শুনে আপনি আমাকে দোষ দিবেন। কিন্তু কিছুই করার নেই আমার।
– বলো! আমার সমস্যা নেই। দোষ-গুণের চিন্তা করে কথা বলবে না যা সত্য তাই বলবে।
– কিন্তু মাহাতাবকে যদি এরমধ্যে এরেস্ট করে নিয়ে যায়?
– আমি না যাওয়া পর্যন্ত কিছুই হবে না নিশ্চিত থাকতে পারো। মাহাতাবকে নিয়ে খুব চিন্তায় আছ মনে হচ্ছে?
সংসারটা তবে মনোযোগ দিয়েই করছ?
– আপনার চিন্তা হয় না আপনার স্বামীর জন্য? হয় বলেই হয়ত আজ আমার দুয়ারে এসেছেন !
– কাজের কথায় আসো।
– হুম! মাহাতাব আর আমি একই কলেজে পড়াশুনা করেছি। দু’জনেই সাদামাটা পরিবার থেকে এসেছি। মাহাতাব আর আমি একজন আরেকজনকে পছন্দ করতাম সেই কলেজ লাইফ থেকেই। কিন্তু সে ভাবে কাউকে কখনো ব্যাপারটা প্রকাশ করিনি। আমি যখন আপনাদের কোম্পানীতে সেলিম সাহেবের পিএস হিসেবে জয়েন করলাম তারপরে সেলিম সাহেবকে বলে ওর একটা চাকরীর ব্যবস্থা করেছিলাম আপনাদের পুরাতন সিমেন্ট ফ্যাকটরীতে। তখন শুধুমাত্র কমিশনের বিনিময়ে ও কাজ করত। মোটামুটি ওর ভালোই চলে যেত। আমার পরিবারের মতই ওর পরিবারও ওর উপার্জনের দিকে তাকিয়ে থাকত। সেলিম সাহেবের সাথে আমার সখ্যতার ব্যাপার মাহাতাব বুঝতে পারে। ধীরে ধীরে আমরা দূরে সরে যাই। তবে ওকে একটা কাজ পাইয়ে দেবার জন্য ও সবসময়ই আমার প্রতি কৃতজ্ঞ ছিল। এরপরের কাহিনী তো আপনি জানেন । আপনি আমাকে সেলিম সাহেবের জীবন থেকে দূরে সরিয়ে দিলেন। আমিও ভয় পেয়ে গ্রামে চলে গেলাম। সেখানে যাবার পরও মাহাতাবের সাথে মাঝেমাঝে যোগাযোগ হতো। ও সবই জানত । মাহাতাব তখনো এখানেই কাজ করত। আমি চলে যাবার কিছুদিন পর আপনিই আবার ফোন করে সেলিম সাহেবের জীবনে ফেরার জন্য অনুরোধ করেন। আমি খানিকটা অবাক হই। তবে আপনার কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারি আপনি আমার সাথে কোনো অভিনয় করছেন না আগের মতো। আমি তখন চাকরি বাকরি হারিয়ে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলাম একদম। ন্যায় অন্যায় ভুলে যেয়ে আবার সেলিম সাহেবের জীবনে ফিরে আসার প্রত্যাশায় ঢাকায় চলে আসি। সেলিম সাহেবের কাছে পৌঁছাতেই আমি বুঝতে পারি আমি যে সেলিম সাহেবকে রেখে গিয়েছি সেই সেলিম সাহেব আর এই সেলিম সাহেবের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ । আপনি তার জীবন থেকে চলে গিয়েছেন সে এটা মেনে নিতে পারছিল না। সে নিজের ভুল বুঝতে পারে। খালি হাতে ফিরতে হয় আমার। কোনো কাকুতি মিনতি দিয়ে তাকে গলাতে পারলাম না । ঢাকায় এক বান্ধবীর বাসাতে উঠলাম। চাকরি বাকরি নেই। হাতে তেমন পয়সা কড়িও নেই । খুব কঠিন সময় পার করছিলাম। এরমধ্যে আবার কিছুদিন ধরে চরম শরীর খারাপ চলছে। খাওয়া দাওয়া কিছুই করতে পারছিলাম না। একদিকে খাওয়া বন্ধ অন্যদিকে মানসিক অবস্থাও চরম খারাপ । সময় অসময় হরহড় করে বমি করছি। হেঁটে ওয়াশরুমে যাব সেই শক্তিও পাচ্ছিলাম না। কিভাবে দিন পার করব বুঝতে পারছিলাম না । মাহাতাব এর মাঝে একদিন ঢাকায় গিয়েছিল অফিসের কাজে। আমার সাথে দেখা করে আমার এমন অবস্থা দেখে সে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমার হাতে একটা পয়সাও ছিল না যে নিজের চিকিৎসা করব। মাহাতাবের প্রতি কৃতজ্ঞতায় নত হয়ে গেলাম।
ডাক্তার সব টেস্ট করে যা জানাল তাতে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতো অবস্থা। আমি তখন চার মাসের প্রেগন্যান্ট। আমার মতো মাহাতাবও বুঝে গেল এ বাচ্চার বাবা কে! মাহাতাবের রক্ত গরম হয়ে গেল। সে আমাকে নিয়ে সেলিম সাহেবের সাথে দেখা করল। সেলিম সাহেবকে প্রেসার দিল আমাকে বিয়ে করার জন্য। সেলিম সাহেব ভুল স্বীকার করে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে আমাদের বিদায় করে দিতে চাইলেন। বাচ্চা নষ্ট করে ফেলতে বললেন। কিন্তু আমি সেটা কেন করব? বাচ্চা তো অন্যায় করেনি। হোক সে অবৈধ , সমাজ বলুক তাকে জারজ। দোষ তো আমরা করেছি। নিষ্পাপ বাচ্চাটা কেন শাস্তি পাবে? কিন্তু যখন কিছুতেই আমরা মানছি না তখন সেলিম সাহেব ভাবার জন্য এক সপ্তাহ সময় নিলেন। মাহাতাব আর সিলেটে আসোল না। সে আমাকে নিয়ে খুব চিন্তিত। আমার একটা ব্যবস্থা করেই সে সিলেটে ফিরবে। নয়ত সবাইকে জানিয়ে দিবে সেলিম সাহেবের কুকীর্তির কথা! তাতে যা হবার হবে।
আমি কিছুটা আশায় বুক বেঁধেছিলাম হয়ত বাচ্চাটার একটা পরিচয় মিলবে। সাথে আমারও একটা উপায় হবে। কিন্তু ভাগ্যে ছিল অন্য কিছু। সেলিম সাহেব মাহাতাবকে আপনাদের নতুন ফ্যাক্টরির সেলস ম্যানেজার পোস্টে চাকরির অফার দিলো আর সাথে আমাকে বিয়ে করার। মাহাতাব রাজী হয়ে গেল। আমি হয়ে গেলাম জুয়ার গুটির মতো। সেলিম সাহেবের সাথে কথা বলে বুঝলাম যে আমার ভাগ্যে মিসেস সেলিম হওয়া নয় মিসেস মাহাতাব হওয়াটাই অপেক্ষা করছে। আমার কাছেও কোনো অপশান নেই। সেলিম সাহেবের কাছে আমিও শর্ত রাখলাম মাহাতাবকে বিয়ে করতে রাজী তবে আমার পক্ষে আমার সন্তান নষ্ট করা সম্ভব না। তখন উনার সাথে বেশ বাক বিতণ্ডা হলো আমার। আমি একদমই সিদ্ধান্ত থেকে নড়লাম না। পরে সে রাজী হলো তবে সেও শর্ত দিলো সন্তান জন্ম হলে কোনোদিনই যেন তার সামনে নিয়ে যাই। এমনকি আমার যাওয়াও নিষেধ। মাহাতাবের সন্তান পরিচয়েই সন্তানকে মানুষ করতে হবে । এবং এই সন্তানের ভালো ভবিষ্যতের জন্য তখন বিনিময়ে এই বাড়ির জায়গাটা আমার এবং মাহাতাবের নামে করে দেয়। এটা আপনাদেরই জায়গা। আপনি হয়ত জানেন না। সিলেটে এমন আরো অনেক জায়গা আছে আপনাদের। এত সম্পত্তি আপনার জানারও কথা না। এরপরে এখানে বাড়ি করার জন্য টাকাটাও তার কাছে থেকেই পাই। এ পর্যন্তই তার সাথে আমার দেখা সাক্ষাৎ । আসিফের মাঝে আমি ওর বাবার চেহারার ছাপ দেখতে পাই। মাহাতাব শুরুর দিকে কিছুদিন আমার সাথে খুব ঝামেলা করলেও ছোট ছেলে নাসিফের জন্মের পর সে এখন মোটামুটি ভালো ব্যবহারই করে। মাহাতাব দুই নাম্বারি কিছুটা করে এটা আমি অস্বীকার করছি না। ক্ষমতা পেয়ে অপব্যবহার করছে। আমি বারবার নিষেধ করেছি। কিন্তু সেলিম সাহেবের দুর্বল পয়েন্ট জানে বিধায় সে কিছুই পরোয়া করে না। এই তো ! এই আমার কাহিনী!
এতক্ষণ সব শুনছিলাম । কী বলব বুঝতে পারছি না। সেলিমের এমন একটা ভয়ানক অতীত আছে স্বপ্নেও ভাবিনি। এ কথা প্রিয় জানলে কী হবে ভেবে পাচ্ছি না।
– তোমার বাচ্চাকে কখনো সেলিম দেখেনি?
– নাহ! দেখতে চায়ও নি। পাষাণ জন্মদাতা শর্ত দিয়েছে যদি আমি বাচ্চা নিয়ে তার কাছে যাই তবে আমার বাচ্চাকে তখনই আমার থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হবে। এবং কোনোদিনই আর বাচ্চার চেহারা দেখার ভাগ্য আমার হবে না। আমি নিজের বাচ্চাকে খোয়াতে চাই না। তাই কখনই তার সামনে যাইনি। আর যাওয়ার ইচ্ছাও নেই। তাছাড়া মাহাতাবও ওকে এখন ভালোবাসে।
– ভালোবাসবেই না বা কেন? লটারি মিলেছে যে!
– এটা অবশ্য ঠিক বলেছেন ! আসিফ মাহাতাবের জন্য লটারী। তবে সে আসিফকে ভালোও বাসে। এটা আমি অস্বীকার করব না। আসিফের জন্মের মাসখানেক পরে আমরা বিয়ে করি। এরপর এখানে বাড়ি করে এখানেই থাকি। আমি আজ অবধি ওর অফিসের পাশের বাসায় পর্যন্ত যাইনি। খুব ভয় পাই। কেউ যদি আবার আমাকে চিনে ফেলে। আমার আসিফকে যদি কেড়ে নেয়! জানিনা সেলিম সাহেব আপনার কাছে কী বলেছে। তবে কাহিনী এটাই। এর মাঝে একবিন্দুও যদি মিথ্যে থাকে তবে আপনি আমাকে যে শাস্তি দিবেন মেনে নিব।
– বুঝতে পেরেছি। আচ্ছা, দেখছি কী করা যায়! তবে তোমার ভালোর জন্য একটা কথা বলি। রাখা না রাখা তোমার ব্যাপার!
– জি , বলেন।
– মাহাতাবকে এবারের মতো ক্ষমা করে দিচ্ছি। কিন্তু তুমি ওকে বোঝাও ওখান থেকে চলে আসতে। দেখা যাবে ও ওখানে থাকলে একদিন না একদিন ঠিকই তোমার সাথে বা তোমার ছেলের সাথে সেলিমের দেখা হয়ে যাবে। তখন কিন্তু তুমি আবার বিপদে পড়ে যাবে।
– হেলেন নিশ্চুপ।
– আমি তোমার ভালোর জন্য বললাম। রাখা না রাখা তোমার ব্যাপার।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে দেয়ালে টাঙ্গানো হেলেনের দুই ছেলের ছবির দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেখান থেকে চলে এলাম। এতটা মহান আমি না যে স্বামীর অবৈধ বাচ্চাকে টেনে বুকে নিবো। বুকের মাঝে শুকিয়ে যাওয়া পুরানো ক্ষতটাকে যেন এই ছবিটা আবার খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করে দিচ্ছে। দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
চলবে …..
#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_২৬
সেলিম আর হেলেনের একটা বাচ্চা আছে এটা জানার পর থেকে নিজেকে অনেক কষ্টে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। হঠাৎ কেন যেন খুব নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি মনে হচ্ছে। যদিও এর কোনো দরকার আছে বলে মনে হয় না। হেলেন এখন অন্য কারো বউ, দুই বাচ্চার মা। তাছাড়া সেলিম আজ অবধি জানেনা তার ছেলে হয়েছে কি , মেয়ে হয়েছে! বেঁচে আছে না মরে গেছে। তারপরেও খুব ভয় হচ্ছে ওই হেলেনকে ! কারণ আমিও যেমন সেলিমের সন্তান প্রিয়কে জন্ম দিয়েছি। ঠিক তেমনি হেলেনও তার আরেক সন্তান আসিফকে জন্ম দিয়েছে। এই সেলিমকে একদিন আমি পাগলের মতো ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। সেও আমাকে একইভাবে ভালোবাসত। হেলেন ইস্যুতে জীবনে সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত আমি নিয়েছিলাম । কিন্তু এই বয়সে এসে আবারও সেই হেলেন! যদিও এটা ভেবে কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছি যে সেলিম আর হেলেনের কাছে যায়নি। সে ভুল করেছে। ভুল থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছে। কিন্তু একই ভুল যদি আবার করত তবে এবার আমি হয়ত অন্য কোনো সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হতাম। সিদ্ধান্ত নিলাম কিছুতেই সেলিমের কাছে আমি ওর আর হেলেনের বাচ্চার ব্যাপারে কথা তুলব না। সে যেহেতু তার ভুল থেকে দূরে থাকতে চাইছে এটাই এখন একমাত্র সমাধান। তাছাড়া হেলেনও এটাই চাইছে। তাই আপাতত নিশ্চিন্ত থাকা যায়। কিন্তু মন থেকে কী করে মুছব সেটাই বুঝতে পারছি না। ভালোই হতো যদি ওই মাহাতাবের খোঁজখবর না নিতাম। জীবনের কিছু কিছু অজানা অধ্যায় অজানা থাকলেই বুঝি খুব ভালো হয় এটা আজ আমি বুঝলাম।
রাত আড়াইটা বেজে গেছে । অথচ এখনো পর্যন্ত প্রিয় আসার নামগন্ধ নেই। মিথিলা কয়েকবার ফোন দিয়েছে। ফোন বেজেই চলছে কিন্তু রিসিভ করার কোনো খোঁজখবর নেই। সে বাধ্য হয়ে ওর অফিসে ফোন দিয়েছিল সেখান থেকে জানিয়েছে প্রিয় নাকি রাত আটটার দিকে বেরিয়েছে। এতটা সময় কোথায় আছে , কী করছে, কোনো বিপদে পড়েনি তো! আরো কত চিন্তায় বুঁদ হয়ে আছে সে এর মধ্যে কলিংবেল বেজে উঠল। সে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলল। প্রিয় আজকাল আর এতরাতে মিথিলাকে দরজা খুলতে দেখে অবাক হয় না। সে জানে কেউ জেগে না থাকলেও মিথিলা তার জন্য ঠিকই জেগে আছে। মাঝেমাঝে মিলাতে পারে না কেন মিথিলা তার প্রতি এত কেয়ারিং! মিথিলার সাথে তার তো খুব বেশি কথাও হয় না। সে মিথিলার প্রতি কেয়ার করা থাক দূরের কথা!
মিথিলার সাথে কোনো কথা না বলে সোজা নিজের রুমে চলে গেল। মিথিলাও তার এমন আচরণে অবাক হলো না। এটা তার নিত্য আচরণ। তবে অবাক হলো আজ প্রিয়র শরীর থেকে সেই বাজে ঘ্রাণ নেই তার মানে সে আজ ড্রিংক করেনি। মিথিলা না খেয়ে বসে আছে অথচ ভদ্রলোক তাকে কিছু জিজ্ঞেসও করল না। আজকাল প্রায় রাতেই এমন মিথিলা না খেয়ে থাকে। সে নিজেও নিজের এমন আচরণের জন্য অবাক হয়। সে ভেবে পায় না সে কী তবে প্রিয়র প্রতি দুর্বল? কিন্তু না! এটা কী করে সম্ভব? প্রিয় আকাশের তারা হলে সে এই ধরিত্রীর ধূলা। সে প্রিয়দের বাড়ির আশ্রিতা। এর থেকে একবিন্দুও বেশি কিছু তাকে ভাবে না প্রিয় এটা সে ভালো করেই জানে। সে যে প্রিয়র খালাতো বোন এটাও হয়ত প্রিয় ভুলে বসে আছে। সে নিজের মনের এমন ঔদ্ধত্যতায় বিরক্ত হলো বেশ। কিন্তু মন বড় বেয়াড়া ! সে কারো শাসন বারণ মানার ধার ধারে না।
মিথিলা একবার নিজেকে থামাতে চাইলেও প্রিয়র রুমে যাওয়া থেকে নিজেকে আটকাতে পারল না। খাবে কি না সেটা জানার জন্য তার রুমে যেয়ে দেখল প্রিয় মাত্র প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটের আগায় পুরেছে। লাইটার দিয়ে জ্বালাতে হবে ঠিক তখন সে ঠোঁট থেকে সিগারেটটা টেনে ছুঁড়ে ফেলল। হঠাৎ করে মিথিলার এমন দুঃসাহসিক আচরণে প্রিয় যারপরনাই ক্ষেপে গেল। সাত পাঁচ কিছু না ভেবেই সে ঠাস করে মিথিলার গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। এত জোরে মেরেছে যে মিথিলাও অবাক! তার ঠোঁটের কোণ দাঁতের সাথে লেগে কেটে গিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। মিথিলার সেদিকে হুশ নেই। যেন এক ঘোরের মধ্যে আছে। সে ছলছল চোখে প্রিয়র দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে। মিথিলার চাহনি দেখে প্রিয়ও নিজের এমন ব্যবহারে হতবাক। কী করেছে সে? নিজের প্রতি একদম নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে বুঝতে পারল। একজনের রাগ আরেকজনের উপর এভাবে দেখানোর কোনো মানে নেই। মেয়েটা প্রতিদিন না খেয়ে জেগে বসে থাকে ওর জন্য। আর তাকেই কি না! উহ! কেন যে ?
মিথিলা রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল তখন সে হাত ধরে টেনে নিয়ে সোফায় বসায়। ফার্স্ট এইড বক্স থেকে তুলা বের করে মিথিলার ঠোঁটের কোণের রক্ত মুছে দিলো। মিথিলা নিষেধ করতেও পারছে না। বা নিষেধ করার জন্য ভেতর থেকে কোনো তাড়নাও অনুভব করছে না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে প্রিয়র দিকে।
বেশ কিছুক্ষণ পরে প্রিয় বলল, আ’ম ভেরি সরি! আই ডিড ভেরি রঙ উইদ ইউ। প্লিজ, ফরগিভ মি! প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ! বলে হাতজোড় করছে মিথিলার সামনে।
– নো, নো! আ’ম সো সরি । খুব বেশি অধিকার দেখিয়ে ফেলেছিলাম। মাঝেমাঝে কী হয় নিজেই বুঝি না! কাঁপা গলায় আস্তে করে বলল মিথিলা।
– আরে পাগল! তুই সরি বলছিস কেনো? তুই তো আমার ভালোর জন্য করেছিস। আসলেই আমার বাসার মধ্যে বসে এমন কাজ করা একদমই ঠিক হয়নি। তুই আগেও নিষেধ করেছিস। পাশেই দাদুর রুম । অথচ আমি এমন ইরেস্পন্সিবলের মতো বিহেভ করলাম। থ্যাংক ইউ, আবারো আমার ভুল ধরিয়ে দেবার জন্য। কী যে হচ্ছে! মাথাটা বিগড়ে যাচ্ছে দিনদিন।
– আচ্ছা, আমি রুমে যাই। তুমি ঘুমাও! বলেই মিথিলা চোখের পানি মুছতে মুছতে চলে যাবার জন্য উঠতে গেল।
– আরে বোস না! তুই মনে হয় কিছু বলতে এসেছিলি? না বসলে মনে করব তুই আমাকে মাফ করিস নি।
– না, এমনিতেই এসেছিলাম। আর ভাইয়া আমি কিছু মনে করিনি। তুমি আমার বড়। তোমার রাইট আছে।
মিথিলা ভেতরে ভেতরে খুব মুষড়ে পড়েছে প্রিয়র আচরণে। কিন্তু কিছুতেই বাহিরে সেটা প্রকাশ করছে না।
– বললেই হলো। কী বলতে এসেছিস তাড়াতাড়ি বল!
– কী বলব আমার মনে নেই।
– এক থাপ্পড় খেয়ে সব ভুলে গিয়েছিস? আরেকটা তবে দেই। দিলে দেখবি সব মনে পড়ে যাবে হেসে বলল, প্রিয়।
– মিথিলা মৃদু হেসে উত্তর দিলো , চেষ্টা করে দেখতে পারো ।
– এখন একদমই মুড নেই রে। পরের জন্য পাওনা রইল।
– আরেকটা গালও সবসময় বাড়ানো থাকল। যখন মন চায় দিও। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল।
প্রিয় বুঝতে পারছে মিথিলার ভেতরের অবস্থা। স্বাভাবিক করার জন্য নানান কথা বলছে কিন্তু কাজ হচ্ছে না।
– হুম, দেয়াটা অবশ্য এখন বেশিই জরুরী। একগালে থাপ্পড় মারলে বিয়ে হয় না জানিস তো! তাই আরেক গালে আসলেই দেওয়া দরকার। একটা মজার খবর আছে জানিস!
– কী?
– আমার ফ্রেন্ড সাজিদ আছে না! ওই যে আমাদের ফার্ম অডিট করে ! এখন সিলেটে আছে । সেদিন আমাদের বাসায় আসলো আম্মুর সাথে দেখা করতে।
– চিনতে পারছি না।
– আরে ওই যে ! যাকে তুই নাকি চা বানিয়ে খাইয়েছিলি । চিনির বদলে লবন দিয়ে দিয়েছিলি। মনে পড়ছে কিছু?
– ও হ্যা মনে পড়েছে। খুব লজ্জা লাগছে। উনি কি কিছু নালিশ করেছে তোমার কাছে? সচরারচর আমি তো চা বানাই না। কুলসুম খালা বানায়। উনার জ্বর থাকায় সেদিন আমিই তোমার ফ্রেন্ডকে চা বানিয়ে দেই। উনি নাকি চায়ে দুই চামচ চিনি খায় আমাকে বলল। আমিও চিনি ভেবে দুই চামচ লবণ দিয়ে চা বানিয়ে দিলাম। য়ামার পক্ষ থেকে সরি বলে দিও। আমিও কখনো সুযোগ পেলে বলব।
– সাজিদ কিছু বলল না তখন?
– কিছুই তো বলল না তোমার বন্ধু। আমি উনার সামনেই বসা ছিলাম। কেমন ক্যাবলাকান্তের মতো ভাব করে চা টা খেয়ে গেল। রূম্পা মা রেডি হচ্ছিলেন বের হবার জন্য। পরে একসাথে বেরিয়ে গেল দু’জনে।
– তুই পরে বুঝলি কিভাবে যে ওটা লবণ ছিল?
– রূম্পা মা আর তোমার বন্ধু বেরিয়ে যাবার পরে আমি নিজের জন্য এককাপ ব্লাক কফি করি। মুখে দিতেই টের পাই যে উনাকেও তবে লবণ দিয়েই চা দিয়েছি। আমি হাফ চা চামচ দিয়েই খেতে পারিনি আর উনি কী করে দু চামচ লবণের চা খেয়েছিল কে জানে? খুব লজ্জা হচ্ছিল এমন একটা কাজ করার জন্য। তোমাকে তবে নালিশ করেছে?
– নালিশ ঠিক না! ও হাসতে হাসতে বলেছিল গতকাল।
– ওহ! প্লিজ উনাকে সরি বলো আমার পক্ষ থেকে। আরেকদিন আসতে বলো । আমি সুন্দর চা বানিয়ে দিব । এবার অবশ্যই চিনি দিয়ে বানাব। আচ্ছা, আমি তবে উঠি ,ভাইয়া। সকাল হয়ে যাবে আরেকটু বাদেই।
– আরে তাতে কী! কাল তো ফ্রাইডে। সারাদিন ঘুমাস। মজার কথাই তো বলিনি। বোস আরেকটু। সিরিয়াস কথা তো বলাই হয়নি।
– আচ্ছা, বলো।
– সাজিদ মে বি তোকে পছন্দ করে ফেলেছে। আমার কাছে তো সেটাই মনে হলো।
– যাও! কীসব বলছ?
– সত্যি বলছি। তোর সম্পর্কে কত কত কথা জানতে চাইল। কোথায় পড়িস , কী সাবজেক্টে পড়িস, আমার কী হোস, ক’ ভাইবোন, আরো কত কী! ফোন নাম্বারটা মনে হচ্ছিল এই বুঝি চাইবে কিন্তু সাহস হয়নি হয়ত। হা হা হা।
– এই তোমার সিরিয়াস কথা?
– এটা তোর কাছে সিরিয়াস মনে হয় না?
– একদমই না।
– মনে হতো । যদি কাউকে ভালোবাসতি তবে! আচ্ছা, একটা কথা বলতো কাউকে কখনো নিজের চাইতে বেশি ভালোবেসেছিস?
– মিথিলা নিশ্চুপ দেখে সে আবার জিজ্ঞেস করল, কিরে কথা বলছিস না যে!
– মিথিলা একটু কেঁপে উঠে বলল, উহু! ওসব করার সময় কই?
– ভালো করেছিস। করতেও যাস না। ভালোবাসলে শুধু কষ্ট পেতে হয়।
মিথিলা খেয়াল করল কথাগুলি বলার সময় প্রিয় যেন খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। সে একবার চাইল কিছু জিজ্ঞেস করে আবার সাহস হলো না। এমনিতেই অনধিকার চর্চা করতে যেয়ে একবার অপমানিত হয়েছে আর ইচ্ছা হচ্ছে না। সে সবকিছু ভুলে গেছে এমন ভাব করে মৃদু একটা হাসি দিয়ে উঠতে গেল।
– কি রে উঠছিস যে! আচ্ছা, চল ছাদে যাই।
– না , মানে ভাইয়া! ঘুমাতে যাব।
– কাল সারাদিন ঘুমাস। চল তো!
–
কিছুটা জোর করেই মিথিলাকে ছাদে নিয়ে গেল প্রিয়।
– দেখছিস আজকের চাঁদটা কত সুন্দর!
– হুম!
– ভাইয়া, কিছু কী বলবে নাকি চাঁদ দেখাতে নিয়ে এসেছ? সত্যিই খুব ঘুম পাচ্ছে।
– হুম , বলব। আজ বলতে চাই। আমার মনে হয় কাউকে বলতে পারলে আমি খানিকটা স্বস্তি পাব। কিছুদিন ধরে ভেবেছি তোর সাথে কথা বলব কিন্তু হয়ে উঠেনি। তুই আমার জন্য খুব ভাবিস এটা আমি বুঝি। তাই মনে হলো তোকে বলা যায়।
– কিছু কী হয়েছে তোমার সাথে? কোনো কারণে কষ্ট পাচ্ছ?
– হুম। বলছি তবে! আমি বিন্দু নামে একজনকে খুব পছন্দ করি না মানে করতাম। আম্মুও ওর কথা কিছুটা জানে। আমাদের ভার্সিটিতেই পড়ত। এই দেড় বছর ধরে ওর সাথে বেশ ক্লোজ আমি।
কেন যেন মিথিলার গলাটা শুকিয়ে আসছে এ কথা শোনার পর। সে আস্তে করে বলল, তারপর?
– ওর জন্য আমি কী করিনি! একটা লোয়ার মিডল ক্লাস ঘরের মেয়েকে আমি লাক্সারিয়াস লাইফ দিয়েছি। ওর সাথে আমি কোনো অপবিত্র সম্পর্কে জড়াইনি। আমাদের সম্পর্কটাকে আমি পবিত্রতার চোখেই দেখেছি। ওকে সব ধরণের বিপদ আপদ থেকে প্রটেক্ট করেছি। এতদিন সব বেশ ভালোই চলছিল। ইচ্ছে ছিল যেহেতু আমার পড়াশুনার চ্যাপ্টার আপাতত শেষ ওকে বাসায় আম্মু আব্বুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিব। আম্মুও বেশ কিছুদিন ধরে ওর কথা বলছিল। কিন্তু হঠাৎ করে কিছু পরিচিত সোর্স থেকে বিন্দুর নামে বেশ আজেবাজে কথা কানে আসছিল। অবশ্য আমার কাছেও ওর চলাফেরা খানিকটা সন্দেহজনক লাগছিল। শেষে আমি ওর ব্যাপারে গোপণে তদন্তে নেমে পড়ি। ও এতদিন ধরে আমাকে যে পরিচয় দিয়েছে তা সম্পূর্ণই মিথ্যা। ওখানে ওর কোনো বাবা মা, বাবা, পরিবার নেই। ও একটা চক্রের সদস্য। ওদের কাজই হচ্ছে ভালো ভালো ভার্সিটিতে পড়াশুনার নাম করে ওই ভার্সিটির ছেলেদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে মোটা অংকের টাকা পয়সা হাতিয়ে নেওয়া।
– কী বলছ এসব!
– আমার অনেক টাকা ওর পেছনে নষ্ট হয়েছে। তাতে কোনো দুঃখ নেই। কিন্তু সবচেয়ে বড় কষ্ট ওকে তো সত্যিই ভালোবেসেছি। ওকেও আমার কাছে খুব ইনোসেন্ট মনে হয়েছে শুরুর দিন থেকে। কিছুতেই নিজের কানে শোনা আর নিজের চোখে দেখা ওর কুকীর্তিগুলিকে আমি এখনো মেনে নিতে পারছি না, বিশ্বাস করতে পারছি না মানুষ এত খারাপ হতে পারে। কত স্বপ্ন দেখেছি ওকে নিয়ে। সব তবে মিথ্যা?
– নিজেকে সামলে নাও, ভাইয়া। এই পৃথিবীতে কত জঘণ্য চরিত্রের মানুষ যে আছে! আরো বড় বিপদ হবার আগে নিজেকে সামলেছ এটাই সৌভাগ্য তোমার। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।
– বিপদ হতে আর বাকী কী! ও আমার সাথে ইনোসেন্ট ভাব নিয়ে চলে। এমন ভাব হাতখানা ছুঁলেও যেন অন্যায় হয়ে যাচ্ছে এমন ভাবে করেছে। আমি তো ওর ইনোসেন্ট লুক আর এই নিষ্পাপ চালচলনের প্রেমে পড়েই নিজেকে সম্পূর্ণরূপে ওর কাছে সমর্পণ করেছিলাম। অথচ আমি নিজেই দেখেছি এখন ওর কুকীর্তি। আমার সাথে ইনোসেন্ট ভাব দেখিয়ে আমার ইমোশান নিয়ে খেলা করেছে অথচ পেছনে অন্য ছেলেদের সাথে বিছানায় যাওয়া ওর নিত্য ব্যবসা। আমি জেনে গিয়েছি দেখে ওর চক্রের সহায়তায় ও এখন নতুন চাল শুরু করেছে।
– কী করেছে?
– সে বলছে সে নাকি আমার বাচ্চার মা হতে যাচ্ছে। হয় তাকে আমার বিয়ে করতে হবে নয়ত সে এ কথা আমার পরিবারের কানে , আত্মীয় স্বজন, আমার অফিসের সবার কাছে ছড়িয়ে দিবে। প্রয়োজনে থানায় মামলা দিবে আমার নামে। সাংবাদিক ডেকে সম্মেলন করবে।
– এসব কী বলছ? এ দেখছি ভারি বিপদ!
– আমি তো ওকে বিয়ে করতেই চেয়েছিলাম কিন্তু এভাবে তো নয়! আমি সব জেনে ওর থেকে দূরে সরে যাচ্ছি টের পেয়ে আমাকে ট্রাপে ফেলার জন্য এই নতুন নাটক সাজিয়েছে। কিন্তু আমি তো ওকে এ জীবনেও বিয়ে করব না। ও কার না কার বাচ্চা নিয়ে আমার ঘাড় মটকাতে চাচ্ছে।
– এত বড় অসভ্য!
– অসভ্যামির কথা তো তোকে বলিইনি। আর বলতেও চাই না। সব কথা বলার মতো না। আমি এতবার তাকে বলছি তার সাথে এমন কিছুই করিনি। কিন্তু সে বলছে আমি নাকি সব জেনেবুঝে অস্বীকার করছি যাতে বাচ্চার দায়িত্ব না নিতে হয়। আজ যদি সত্যিই ওর গর্ভের সন্তান আমার সন্তান হতো আমি অবশ্যই ওকে একসেপ্ট করতাম! ও আমাকে এভাবে কেন ট্রাপে ফেলছে আমি বুঝতে পারছি না। ওকে দেখলেও এখন আমার বমি আসে। এত চেষ্টা করছি ওর থেকে দূরে থাকার কিন্তু কি করে থাকব? ও তো আমার বাসা , অফিস সবই চিনে। আজ অফিসে পর্যন্ত এসেছিল। আমাকে আর তিনদিনের সময় দিয়েছে। এরমধ্যে যদি ওকে বিয়ে না করি তবে আম্মু আব্বুকে জানিয়ে দিবে, সম্মেলন করবে। বিচার চাইবে, জোর করে আমার বাসায় উঠবে। এখন তুই বল, আমি কোনো পাপ না করে কেন ওর পাপের ভাগীদার হবো? ওর সাথে আমার প্রেমের কথা মোটামুটি অনেকেই জানে। ও সেই সুযোগটাই নিচ্ছে। আর তাদের কাউকে বললে বিশ্বাসও করবে না যে এই বাচ্চা আমার না। আমি যে কী করব বুঝতে পারছি না। সময় তো চলে যাচ্ছে। আব্বু আম্মুর কানে পৌঁছালে আমি মুখ দেখাব কী করে? তারা যদি জোর করে আমার সাথে ওই বিচটার বিয়ে দিয়ে দেয়!
– এক কাজ করো সব ভাবনা ঝেড়ে ফেলে ওকে জানিয়ে দাও তুমি ওকে বিয়ে করছ। তাইলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়!
– পাগল হয়েছিস তুই?
চলবে…………