#প্রিয়_প্রহর
লেখনীতে: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-১০
শুভ্র আরোহীর ভয় কমানোর জন্য নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়। আজ একটা অঘটন ঘটতে ঘটতে আরোহী বেঁচে গেছে, এটা ভেবেই আরোহী কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয় কিন্তু তারপরেও সে কেঁপে কেঁপে উঠছে। এখনো ভয়টা কাটে নি। মিনিট দুয়েক পর আরোহী শান্ত হয় কিছুটা। এখনো সে শুভ্রর বুকে লেপ্টে আছে। এবার আরোহী শুভ্র হৃদস্পন্দনের শব্দ শুনছে। এতক্ষন তো ভয়ে সে ভরসা স্বরূপ শুভ্রর বাহুডোরে আবদ্ধ ছিল কিন্তু এখন তার অস্বস্তি ও অন্যরকম এক অচেনা অনুভূতি হচ্ছে।
এবার শুভ্র আরোহীকে বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত করে নরম স্বরে আরোহীর নমিত মুখের আদলে চেয়ে বলে,
–রিলেক্স। ওরা তোমার সাথে কিছু করতে পারেনি। তুমি একদম সেফ আছো। ভুলে যাও তোমার সাথে কি হয়েছে একটু আগে! দুঃস্বপ্ন ভেবে সেটা ভুলে যাও। এটা মনে করলেই, তুমি নিজেকে শান্ত রাখতে পারবে না।
আরোহী খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলো শুভ্রর কথা। একটা ঢোক গিলে মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়। আরোহীর হঠাৎ আয়ানার কথা মনে পড়লে, শুভ্রকে হরবড়িয়ে জিজ্ঞাসা করে,
–আয়ু কোথায়?
শুভ্রর মনে পড়ে যায় সেই কন্দনরত ভীত মুখশ্রীর রমণীকে। এই দুই বোনের এক অপরের প্রতি ভালবাসাটা তার কাছে অসাধারণ লাগে। এক বোন আরেক জনকে ও নিজেকে বাঁচাতে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে বলে এবং কাউকে নিয়ে আসতে বলে আর আরেক বোন নিজের বোনকে একা ছেড়ে সেখান থেকে আসতে চায় না কিন্তু অবস্থা বেগতিক দেখে পরে বাধ্য হয় বোনকে এবং নিজেকে বাঁচাতে আসতে।
শুভ্র আরোহীকে বলে,
–একদম ঠিক আছে তোমার বোন। আমি নীড় ও মেঘকে ফোন করে বলে দিয়েছি।
শুভ্র আরোহীকে নিয়ে রিসোর্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে কারণ নীড় ও মেঘকে বলে দিয়েছে আয়ানাকে নিয়ে যেন রিসোর্টে ফিরে যায়।
ঐদিন ওদের দুই বোনের জন্মদিনটা মলিনতার মাধ্যমেই কেটে যায়। কত বড় দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে ফিরেছে তাদের দুই মেয়ে। জন্মদিনের জন্য এত আয়োজন, এত আনন্দ-ফূর্তি করার সব প্ল্যান যেন বিষাদের রূপ নিয়েছে।
এদিকে দুইজনের মনে একপাক্ষিক ভালোবাসার কলি এসেছে। শুভ্রর এসেছে আয়ানার প্রতি আর আরোহীর এসেছে শুভ্রর প্রতি।
” যারা একপাক্ষিক ভালবাসে, তাদের সবারই এক আলাদা কল্পনার জগত থাকে। সেই জগত সে তার প্রিয় মানুষটাকে নিয়ে সাঁজায়। একপাক্ষিক ভালোবাসায় এক আলাদা আনন্দ আছে! আর আছে তার সাথে অধিক পরিমাণ কষ্ট। ”
সেন্টমার্টিন থেকে ওরা ফিরে এসেছে অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গেছে। দুই দিকের দুইজনের মনে অনুভূতিরা ডানা মেলে উড়তে শুরু করেছে। কিন্তু আফসোস! এই অনুভূতিগুলো একে অপরের জন্য নয়।
সময় কাটে তার নিজস্ব গতিতে। আরো এক বছর পেরিয়ে গেছে। সময়ের চাকায় দুটি ভিন্ন হৃদয়ে প্রগাঢ় হয়েছে অনুভূতিরা, রূপ নিয়েছে তা ভালোবাসার। সবাই ভুলতে বসেছে এক বছর আগে হওয়া ওই দুর্ঘটনাটা। কিন্তু আয়ানা মাঝে মাঝেই ভয় পেয়ে উঠত। নিজের বাবা-ভাই বাদে অন্য কোন পুরুষের সংস্পর্শে গেলে সে শিউরে ওঠত ভয়ে। আরোহী সামলে নিয়েছে নিজেকে পুরোপুরি ভাবে কিন্তু আয়ানা পারেনি পুরোপুরিভাবে। কারন ওইদিন ওই লোকগুলো আয়ানার নরম মনে বেশি আঘাত দিয়েছিলো। আরোহীর সাথে বেশি খারাপ কিছু হতে চলেছিলো কিন্তু আরোহী শক্তভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলার চেষ্টা করেছিল।
পনেরো বছরের দুই কিশোরী তাদের জন্মদিন উদযাপন করে পরিবারের সাথে। শুভ্রর পরিবারও সেখানে উপস্থিত ছিল। এই এক বছরে আরোহী শুভ্রর পছন্দ-অপছন্দ জেনে নিয়েছে। কিন্তু সে তো শুভ্রর মনের খবরটা জানতে পারল না! জানবেই বা কি করে? শুভ্রতো কখনো নিজের অনুভূতি কাউকে বুঝতে দেয়নি। সামনে এইচএসসি পরিক্ষা তাই নিজের মনের অনুভূতিকে সামলিয়ে পড়ালেখা নিয়ে ব্যাস্ত শুভ্র।
পরীক্ষা শেষ হয় শুভ্রর। শেষ পরীক্ষার দিন শিলার সাথে ওই ভালোবাসা নিয়ে ঝামেলা হবার পর শুভ্র নিজের বাসায় এসে তৎক্ষণাৎ নিজের রুমে যায়। আরোহী ও আয়ানা সেইদিন ওই শুভ্রদের বাড়িতে ছিল কিন্তু শুভ্র তা জানে না। আয়ানা শুভ্রর বড় বোন রিয়ানার সাথে কথা বলায় মশগুল। আর এদিকে আরোহী যখন কলিংবেলের শব্দে, “শুভ্র এসেছে” এই ভেবে আড্ডা ছেড়ে উঠে কিন্তু তার আগেই বাড়ির কাজের লোক দরজা খুলে দেয়। আর আরোহী রিয়ানার রুমের দরজা থেকেই দেখতে পায় শুভ্র গটগটিয়ে নিজের রুমে চলে গেছে। আরোহী শুভ্রকে দেখেই বুঝতে পেরেছে শুভ্র প্রচন্ড রেগে আছে।
চঞ্চল কৌতুহলী কিশোরী শুভ্রর রুমের সামনে মৃদু পায়ে হেঁটে যায়, কি কারনে রেগে আছে সেটা জানতে। কিন্তু সে কি জানতো! আজকেই তার এই হৃদয়ে ভঙ্গ হবে!ক্ষতবিক্ষত হবে তার প্রগাঢ় অনুভূতিরা!
শুভ্র এতটাই রেগে ছিল যে, সে নিজের রুমে যেয়ে ঠাস করে দরজাটা ধাক্কা দেয়। কিন্তু দরজার লক হয় না। শুভ্র বিছানায় বসে মাথা নিচু করে নিজের চুলগুলো টেনে ধরে। দরজার আড়াল থেকে আরোহী সব দেখছে।
কিছুটা শব্দ করে শুভ্র বলে ওঠে,
–আমি তারা কে ভালোবাসি। আমার “শুভ্রতারা” সে। শুভ্রর মনের আকাশে একক এক “শুভ্রতারা” সে। আমার মনে তারার জায়গা কোনো শিলা নিতে পারবে না। ভয়ে ভীত মুখশ্রী, কাঁপাকাঁপা কন্ঠ, কন্দনরত রক্তিম তাকে দেখে আমি তার মোহামায়ায় পড়ে গেছি। যখন সে আমার বুকে ঢলে পড়লো, নিজের বোনকে বাঁচানোর আকুতি নিয়ে। ঠিক তখনি আমি অনুভব করেছি ওই কিশোরীর প্রতি এক সূক্ষ্ম অজানা অনুভূতির। আস্তে আস্তে সেই অনুভূতিগুলো উড়তে শিখেছে। এখন তা আমার ভালোবাসা। ভালোবাসি আয়ানা তোমায়! তোমার জন্য আমি শিলার সাথে বন্ধুত্ব ভেঙে দিয়েছি আজকে। বন্ধুত্ব ভাঙ্গাতে আমার কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু শিলা আমাদের বন্ধুত্বটাকে বন্ধুত্বর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পারল না।
দরজার আড়ালে দাঁড়ানো আরোহীর প্রতিটা কথা বোধগম্য হয়েছে। হৃদয় ভাঙ্গার কষ্ট সে অনুভব করতে পারছে। শুভ্র আজ জান্তে ও অজান্তে দুটো রমণীর হৃদয় চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছে।
নিজের ভালবাসার মানুষটার মুখ থেকে নিজের বোনের প্রতি ভালোবাসার কথাগুলো শুনে আরোহী বাকরুদ্ধ। তার কিশোরী মনে তখন একটাই প্রশ্ন। একই রকম দেখতে হয়েও কেন শুভ্র তাকে ভালোনাবেসে তার বোনকে ভালোবাসলো?
ভগ্নহৃদয় নিয়ে আরোহী যায় রিয়ানার রুমে। আবার আড্ডায় শরীরকে হয়েও আরোহী তাকিয়ে থাকে তার বোনের দিকে পলকহীন। না! হিংসা হচ্ছে না। শুধু নিজের অনুভূতি গুলোকে এখন তুচ্ছ মনে হচ্ছে। নিজেরই আরেক আত্মার প্রতি তার হিংসা হয় না। আরোহী ঠিকভাবে নিজের মনের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে না সবার সামনে ঠিক যতোটা আয়ানা পারে। আরোহী হয়েছে তার নীড় ভাইয়ের মতো অনুভূতি প্রকাশে আনাড়ি। আড়ালে তাদের প্রিয় অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে ভালোবাসে। আর মেঘ ও আয়ানা নিজেদের অনুভূতি নিজেদের ব্যবহারের মাধ্যমে প্রকাশ করে ফেলে।
আড্ডায় মশগুল রিয়ানা ও আয়ানার নজরে আসে আরোহী। তারা দুজনই ভ্রু নাঁচিয়ে আরোহীকে জিজ্ঞাসা করে, কি হয়েছে? আরোহী শত কষ্টের মাঝেও মুচকি হেসে তাদের জানান দেয়, তার কিছু হয়নি।
আয়ানার কাছে প্রথমে আরোহীর মুখশ্রী ভার দেখে কিছুটা সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু আরোহী নিজের অনুভূতিকে লুকিয়ে মুখে মুচকি হাসি ফুটিয়ে তোলায় সেই সন্দেহ দূর হয়ে যায়।
বলাবাহুল্য, আরোহী আয়ানার থেকে অনেকটা ম্যাচিউর।
আরোহী, আয়ানা ও রিয়ানা দুপুরের খাবার শুভ্র বাড়ি ফেরার কিছুক্ষণ আগেই খেয়ে নিয়েছিল। শুভ্র যে সেই দুপুর আড়াইটার দিকে বাসায় ফিরেছে এতোবার খেতে ডাকার পরেও খেতে আসেনি। দরজা বন্ধ করে মনকে শান্ত রাখার জন্য সে এখন ঘুমাচ্ছে।
ঘড়ির কাঁটা যখন মধ্যাহ্ন ৩:৩০ ছুঁইছুঁই তখন আরোহী ও আয়ানা দুই বোন তাদের ফুফির বাসা থেকে প্রাইভেটে পড়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। সেখান থেকেই বাড়ি ফিরবে দুই বোন।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। কার্টেসি ছাড়া দয়া করে কপি করবেন না। রিচেক করা হয়নি।