প্রিয় প্রহর পর্ব-০৯

0
547

#প্রিয়_প্রহর
লেখনীতে: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-৯
আরোহীর কথায় আয়ানা বলে,
–চুপ! বেশি বুঝিস তুই। আর তুই যে নিজে গবেট সেটা! এখনো কিন্তু বললি না আমাকে পুরো কাহিনী। আমার কাছ থেকে কেনো লুকালি বল!

আরোহী হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলতে লাগে,

“ফ্লাসব্যাক______________________________________
আয়ানা ও আরোহী তখন চৌদ্দ বছরের কিশোরী। আর কয়েকদিন পর পনোরো বছর পূর্ণ হবে ওদের। দুই ভাইয়ের আদরের ছোট বোন।
সময়টা তখন ফেব্রুয়ারী মাস,,

মিস্টার মুনতাসির তার পুরো পরিবার ও তার বোনের পরিবার নিয়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপে এসেছে। উদ্দেশ্য তার আদরের দুই মেয়ের জন্মদিন এই “নারিকেল জিঞ্জিরা” খ্যাত প্রবাল পাথরে সমৃদ্ধ দ্বীপে উদযাপন করতে এসেছেন। আয়ানা ও আরোহীর ফুফি মিসেস কায়রা ও তার দুই ছেলে-মেয়ে ও তার স্বামী এসেছেন।

শুভ্রর মনে তখনো আয়ানাকে নিয়ে ফিলিংস তৈরি হয়নি। কারন সে এদের মধ্যে পার্থক্য করতে পারত না। শুভ্রর বয়স যখন ১২ তখন শুভ্রর পরিবার দিনাজপুরের শিফট হয়ে যায়। তখন শুভ্র ক্লাস ফাইভে পড়ে। এরপর শুভ্র যখন দশম শ্রেণীতে উঠে তখন শুভ্রর বাবা আবার ঢাকাতে ট্রানস্ফার হয় এরপর তাকে ঢাকাতে একটা স্কুলে ভর্তি করে দেয় দশম শ্রেণীতে। শুভ্রর বাবা এবার ঢাকাতে নিজের সম্বন্ধির বাসার কাছেই নিজের ফ্ল্যাট কিনে।

আরোহী ও আয়ানার জন্মদিনের দুই দিন আগে সবাই সেন্টমার্টিন দ্বীপে আসে। এরপর জন্মদিনের দিন আয়ানা ও আরোহীর দুই বোন সবার অগোচরে সমুদ্র সৈকতে যাবার উদ্দেশ্যে একা বেরিয়ে যায়। আর সেটাই ছিল ওদের সবচেয়ে বড় ভুল!

পুরো সমুদ্র সৈকত তখন প্রায় ফাঁকা ছিল। দুই বোন নিজেদের মতো করে সমুদ্রের পানিতে লাফালাফি করছিল। ঘন্টা পেরিয়ে গেছে আর এখন দুপুরের সময় তাই লোকজন নেই। আর ওরা দুই বোন কিছুটা দূরে চলে এসেছে।
হঠাৎ তিনজন লোক এসে ওদের দুই বোনের সাথে খারাপ ব্যবহার শুরু করলো। লোকগুলো নানারকম কুরুচিপূর্ণ কথা বাত্রা বলতে লাগলো। আয়ানা ইতিমধ্যে ভয়ে কেঁদে দিয়েছে। আরোহী নিজেকে ও নিজের বোনকে ওদের থেকে সেফ রাখার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করে যখন অবস্থা বেগতিক তখন আরোহী আয়ানাকে বলে,

–তুই জলদি করে এখান থেকে হোটেলের উদ্দেশ্যে যা।আশেপাশে আমি কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। যদি কাউকে পাস তো নিয়ে আয়।

এদিকে সবাই আরোহী ও আয়ানাকে খুঁজে না পেয়ে ভয় পেয়ে আছে। নীড়, মেঘ ও শুভ্র তিনদিক দিয়ে খুঁজতেছে আর বাকি বড়রা আরেকদিক দিয়ে।

আরোহীর কথায় আয়ানা প্রথমে যেতে চায় না। সে তার বোনকে ছেড়ে যেতে চাচ্ছেনা। আরোহী অনেক জোর করে ওকে কোনরকমে সেখান থেকে দৌড়ে যেতে বলে।লোক গুলো ইতিমধ্যে গায়ে হাত দেওয়া শুরু করেছে। আয়ানার কান্না স্বরে লোক গুলো যেন আনন্দ পায়। তাই তারা আরও বেশি করে উত্তক্ত করতে থাকে। কোনোমতে আয়ানা দৌড়ে সেখান থেকে লোকালয়ের উদ্দেশ্যে যেতে থাকে। তিনজন লোকের থেকে একজন আয়ানার পিছু নেয় আর বাকি দুজন আরোহীর সাথে বাজে ব্যাবহার করছে। আরোহী লোকগুলো থেকে নিজেও পালানোর রাস্তা খুঁজছে কিন্তু পারছে না। আয়ানাকে এক ফাঁকে পালিয়ে যেতে বলেছে কারন আয়ানা এখানে থাকলে আরোহী কোনো কিছুই করতে পারবে না।

আরোহী লোকগুলোর থেকে বাঁচতে সমুদ্রের পানি তাদের চোখের দিকে মারছে। সমুদ্রের পানিতে গড় লবণাক্ততা প্রায় ৩.৫%। ১ কিলোগ্রামে ৩৫ গ্রামে দ্রবীভূত লবণ আছে। চোখে গেলে কিছুটা জ্বালাপোড়া করবে তাই আরোহী সেটা করছে। দুই জন লোকের যখন চোখ জ্বালাপোঁড়া করছে তখন আরোহী সেখান থেকে পালিয়ে যেতে নিলে, একটা লোক আরোহীর হাত চেপে ধরে। আরোহীর হাত চেপে ধরাতে সেখান থেকে পালাতে পারে না আরোহী। ওরা আরোহীকে নির্জন জায়গায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আরোহী প্রাণপনে চেষ্টা করছে নিজেকে ছুটানোর জন্য।

আয়ানা দৌড়ে যেতে যেতে পথিমধ্যে শুভ্রকে দেখে। শুভ্র এদিকটায় ওদের খুঁজতে এসেছে। আয়ানা শুভ্রকে দেখে দৌড়ে শুভ্রর সামনে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে হিচকি তুলে কাঁদতে থাকে। শুভ্র নিজের সামনে কন্দনরত মেয়েটা কি আয়ানা নাকি আরোহী সেটা বুঝতে পারছে না।

কাঁদতে কাঁদতে আয়ানার বেহাল দশা! যেকোনো সময় সে সেন্সলেস হয়ে যেতে পারে ভয়ে। হিচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে আয়ানা শুভ্রকে এটা বলে,
— ভাইয়া। আরু! আরু!

শুভ্র এমনিতে দুটি মেয়েকে এতক্ষণ ধরে খুঁজতে খুঁজতে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল আর এখন একটি মেয়েকে কাঁদতে দেখে আর আরেকটি মেয়েকে আশেপাশে না দেখে আরো বিচলিত হয়ে পড়ে। আয়ানার মুখ থেকে “আরু” নামটা শুনে বুঝতে পারে মেয়েটা আয়ানা আর আরোহীর কিছু হয়েছে। শুভ্র আয়ানাকে জিজ্ঞাসা করে,

–কি হয়েছে আরোহীর?
–আরুকে ওওই ললোকক গুলো কিছু ককরে ফেলবে!

আয়ানা ভয়ে ও নার্ভাস হয়ে তোতলিয়ে কথাগুলো বলে।
–কারা আরোহীকে কিছু করবে? বলো আমাকে? আর তুমি একা কেনো? তোমাদের দুই বোনকে আমরা কখন থেকে খুঁজতেছি? আরোহী কই?

আয়ানা কোনমতে ঢোক গিলে বলে,
–আমরা সমুদ্রের তীরে খেলছিলাম। তারপর তিনটা লোক এলো আর আমাদের সাথে খারাপ ব্যবহার শুরু করল। আমাদের গায়ে হাত দিচ্ছিল। আরু আমাকে কোনমতে বলেছে ওখান থেকে যেতে আর কাউকে ডেকে আনতে। আরু ওখানের রয়ে গেছে। আমি আসতে চাই নাই। আমাকে জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন আরুর কি হবে? আপনি প্লিজ আমার আরুকে বাঁচান!

কথাগুলো বলে আয়ানা শুভ্রর বুকের ওপর ঢলে পড়ল। কাঁদতে কাঁদতে আয়নার চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। শুভ্র এক কন্দনরত রমণীর রক্তিম মুখ দেখে প্রথমবারের মতো কিছু একটা অনুভব করলো।
কিন্তু এখন তার হাতে সময় নেই। সে আশেপাশের কোন এক মহিলা টুরিস্টকে দেখে বলল, আয়ানাকে একটু খেয়াল রাখতে। সে ফোন করে ওর ভাইদেরকে আসতে বলছে।
শুভ্র আয়ানাকে ওখানে রেখে, দৌড়ে আয়ানা যেদিকে হাত দিয়ে ইশারা করে কথাগুলো বলছিল সে দিকে যায়। সেদিকে যেয়ে দেখে সমুদ্র তীর পুরো ফাঁকা। আশেপাশে কেউ নেই। এখন শুভ্র নিজে বুঝতে পারছে না কোন দিকে যাবে! আর আরোহীকে ওরা কোন দিকে নিয়ে গেছে!

হঠাৎ কিছুটা দূরে বালির মধ্যে কাউকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাবার মতো চিহ্ন দেখে। শুভ্র সেই চিহ্ন অনুসরণ করে সেদিকে দৌড়ে যায়। এরপর দেখে একটা নির্জন ঝোপের কাছে একটু শোরগোল শোনা যাচ্ছে।

————তিনজন আরোহীকে এক নির্জন ঝোপের কাছে নিয়ে এসেছে। তৃতীয় ব্যক্তি ফিরে এসেছে কারণ সে যখন দেখে, সে যেই মেয়েটার পিছু নিয়েছে সেই মেয়েটা মেয়েটা লোকালয়ের ভিতরে ঢুকে গেছে তখন সে আর রিস্ক নিয়ে সে দিকে গেল না।
আরোহীকে বালির মধ্যে ফেলে তারা ওর দিকে আগাতে থাকে। আরোহী ভয়ে পেছাতে পেছাতে মুঠোভর্তি বালি নিয়ে ওদের দিকে বারবার ছুড়ে মারছে। বারবার বালি ছুড়ে মারার দরুন, একজন লোক এসে ওর চুলের মুঠি ধরে আর আরেকজন লোক ওর দুহাত ধরে। আরোহী নিজেকে বাঁচানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছে। সে শুধু দোয়া করছে কেউ যেন আসে আর তাকে বাঁচায়।

একজন লোক যখন আরোহীর জামার এক হাতের দিকের কাপড় ছিড়ে ফেলে তখন আরোহীর চোখ দিয়ে নোনা জল গড়াতে থাকে। যেই ব্যক্তি ওর চুলের মুঠি ধরেছে সে আরোহীর মুখ চেপে ধরেছিলো কারণ আরোহী চিল্লাচ্ছিল জোরে জোরে। মুখ চেপে ধরার দরুন আরোহীর মুখ দিয়ে শুধু গোঙ্গানির আওয়াজ আসছে। তৃতীয় ব্যক্তি আরোহীর দুইপা চেপে ধরে আর ঠিক তখনই শুভ্র এসে দেখে আরোহীকে তিনজন লোক মিলে চেপে ধরে রেখেছে।
আরোহী নিজের সামনে শুভ্রকে দেখে যেন প্রাণ ফিরে পায়। ওই লোক গুলো এখনো শুভ্রকে দেখেনি। কিন্তু আরোহী শুভ্রকে দেখে আরোহীর চোখে যেন খুশির ঝিলিক খেলে যায়।

যেই ব্যক্তি আরোহীর পা ধরে রেখেছে, শুভ্র সেই লোকটাকে একটা লাথি মেরে সরিয়ে দেয় এরপর বাকি দুজনকেও। লোকগুলো হতভম্ব হয়ে যায় এই নির্জন জায়গায় কাউকে আসতে দেখে। লোকগুলো আরোহীকে ছেড়ে দিয়েছিল শুভ্রর হঠাৎ আক্রমণে। লোক গুলো এরপর শুভ্রর সাথে মারামারি করতে গেলে শুভ্র একমুঠো বালি একজনের চোখে ছুড়ে মারে। যেই লোকটার চোখের শুভ্র বালি ছুড়ে মারে, সে নিজের চোখে হাত দিয়ে বালিতে বসে পারে কারন তার চোখ অনেক জ্বালাপোড়া করছে। অপর দুজন শুভ্রর দিকে আগাচ্ছে। আর আরোহী এদিকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। আরোহী বুঝতে পারছে যে, শুভ্র একা তিনজনের সাথে পারবে না তাই আরোহীও একমুঠো বালি নিয়ে একটু উঠে আরেকজনের চোখে বালি ছুড়ে মারে।

দুইজনের অবস্থা বেগতিক। আরেকজন একা শুভ্রর সাথে পারবে না আর সেই আরেকজন কম বয়সি। তাই সেই জন পালিয়ে যায়। শুভ্র গিয়ে আরোহীকে ধরে। আরোহী নিজের সাথে ওই অবস্থায় সম্মুখীন হয়ে তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছিল। শুভ্র বুঝতে পারে আরোহী অনেক ভয়ে আছে তাই সে আরোহীকে নিজের বুকে জড়িয়ে নেয় আশ্বাসের সাথে যাতে আরোহীর ভয় কমে। যেকোনো মেয়ে এরকম পরিস্থিতিতে প্রচন্ড ভয় ও শক পায়।

চলবে ইনশাআল্লাহ,