তোকে ঘিরে পর্ব-৩২+৩৩

0
1180

#তোকে_ঘিরে❤
#পর্ব_৩২
#ফাবিয়াহ্_মমো🍁

জানালা গলে বৃষ্টির অদম্য ছাটঁ প্রবেশ করছে রুমে। মৌসুমী বৃষ্টির সাথে মৌমৌ বাতাসের আলিঙ্গনে শীতলতার দারুণ এক পরিবেশ উদ্ভব হয়েছে চারপাশে। পূর্ব স্থবির দৃষ্টিতে পলকহীন চোখে পূর্ণতার দিকে কতটুকু সময় ব্যয় করেছে তা অনুমান করা কঠিন। পূর্ণতার চোখে দূর্বলতার ক্লেশ নেই! এ যেন অন্যরূপী কঠিনচিত্তের পূর্ণতা! এমন মানবীকে দেখে পূর্বের বুক ফুলে যেন গর্বের উচ্ছাস উন্মোচিত হচ্ছে। পূর্ব নিজের আত্মগর্ব ভেতরে চেপে বাহু দুদিকে প্রসার করে ইশারা করে ‘কাছে আসতে’। এ কাছে আসাটা যেন নিছক আসা নয় একেবারে বুকের মধ্যখানে লুকিয়ে রাখার যাতনা। পূর্ব উপরের ঠোঁট দিয়ে নিচের ঠোঁটটা চেপে প্রসারিত বাহুদ্বয় আরো খানিকটা প্রসার করতেই এবার দ্রুতগতিতে মাথা ঝাঁকিয়ে কাছে আসতে বলে। মুখ ফুটে শব্দ বেরুচ্ছে না, বলতে পারছেনা ‘ কাছে আসো পাগলী মেয়ে! আমার বুকটায় দহনের প্রলয় হচ্ছে! তুমি মাথা রেখে শান্তি দাও এতে!’ পূর্ণতার চোখে বীরাঙ্গনার মতো কাঠিন্য বিরাজ করলেও আচমকা এরূপ প্রকাশ্য আবেগ দেখে শূণ্য চিন্তায় ঝাঁপিয়ে পরে পূর্বের প্রসারণক্ষম বাহুর দূরত্বে। দুধারে মেলে ধরা বাহুদ্বয় এবার বুকের উপর আছড়ে পরা মানুষটাকে আকড়ে ধরে। মেঘের গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজের সাথে ঠান্ডা শীতল বাতাসের অদ্ভুত কলহাস্য যেন কারো কান্নাধ্বনি পেয়ে ব্যাপক তেজী হয়ে উঠেছে। প্রকৃতি তার বীভৎস লীলায় ঝড়ের তান্ডব শুরু করেছে। গাছপালা টিনের চালে আছড়ে পরছে, ধুমধাম বিকট শব্দ হচ্ছে, কোথাও যেন মানব মনে প্রকৃতির অপ্রকৃতিস্থ আচরণে বেশ ভয় ঠেকাচ্ছে।

পূর্ণতার হু হু করে ফোপানো কান্নার অশ্রুপাত জানান দিচ্ছে এতোক্ষন সে যথেষ্ট কষ্ট লুকিয়ে কথাগুলো বলিষ্ঠ কন্ঠে উচ্চারণ করেছিলো। কিন্তু পূর্বের খোলা আচরণ যতবার প্রকাশ হয়েছে ততবার সে নিজেকে সপেছে তন্মধ্যে। পূর্ব টিনের দেয়ালে পিঠ হেলিয়ে পূর্ণতাকে বুকের মধ্যে বাহুর আড়ালে লুকানোর সুক্ষ চেষ্টায় আছে। ঠিক কোথায় রাখলে পূর্ণতাকে নিজের মধ্যে আগলে রাখা হবে? সাহিত্যিক ভাষায় ‘বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখা’ দ্বারা যেটা বোঝায় সেটা কিভাবে ফলাবে পূর্ব? আপাতত জানা নেই। নিজের বুকের দিকে মাথাটা নুয়ে এলোমেলো চুলের পূর্ণতাকে একধ্যানে দেখতে থাকে সে। চুলের উপর নাক এনে ঘ্রাণের সুভাষ টেনে পূর্ণতার মুখ তুলে দেখে, চোখের অশ্রুধারা এখনো টলমল করছে। পূর্ণতা তার মায়াময় অশ্রুপূর্ণ ছোখ তুলে তাকালে পূর্ব গালে হাত রেখে ঠোঁটের ভাজে ঠোঁট মিলিয়ে দেয়। চোখভর্তি পানির পসরা টপটপ করে গাল বেয়ে যেন কারোর বুকে উপর পরে। এলোমেলো চুলগুলোতে আঙুলের চিরুনি দ্বারা মাথার মাঝখানে সিঁথি উঠে। পিঠের উপর চুলের বাহার ছড়িয়ে ঠোঁটজোড়া ছেড়ে দিয়ে পূর্ব শ্রান্তচিত্তে জোরে নিশ্বাস ছাড়ে। পূর্বের দুহাতের বৃদ্ধাঙ্গুলে চোখের শেষ পানিটুকু আশ্রয় নেয় পূর্ণতার। তার গর্তময় আর্কষিত থুতনিতে ঠোঁটের আলতো স্পর্শ বসিয়ে বলে উঠে পূর্ব,

– ঘটনাটা কোনোভাবে স্কিপ করা যায় না?ভুলে যাও কি হয়েছিলো। ভুলে যাও সেদিন আমিও এ বাড়িতে ছিলাম। আমার চাওয়াটা কি খুব অসম্ভব?
পূর্ণতা কিছু বলেনা। টলটল চোখে এখনো তাকিয়ে আছে।

– নামটা জানলে তুমি খুব কষ্ট পাবে পূর্ণ। আগেও বলেছি তোমার উপর সামান্য আঁচড় পরলে আমি শেষ। এই নামটা বললে তুমি যে কি করবে তা ভাবলে…

পূর্বের বুক ঠেলে হতাশার ভারি নিশ্বাস যেন ছিটকে আসে। আচ্ছা নামটা কি খুবই কাছের? কাছের মানুষের আঘাতগুলো যে কতটা ক্ষতবীক্ষত, চূর্ণবিচূর্ণ, ছিন্নভিন্ন করে দেয় তা যদি ওই মানুষটা জানতো? একটাবার জানতো কতটা দুঃখ হয় মনে, দগ্ধ হয়ে বুকে, জমাটবদ্ধ হয়ে আসে নিশ্বাস। তার সাথে কাটানো সুন্দর স্মৃতিগুলো একনিমিষে পায়ের তলায় মাড়িয়ে যায়, হারিয়ে যায়, বিলিন হয়ে যায় আজীবনের জন্য। চোখে দিয়ে যায় পানি হৃদয়ে রেখে যায় অসহনীয় কষ্ট। নোংরামি করা মেয়েটার কথা মোটেও বলতে সাহস পায়না পূর্ব। ঠিক কতটা কাছের মানুষ হলে পূর্বের মতো অ-মুখ মানুষও এমন অপ্রকৃতিস্থ ভাবে হাঁসফাঁস করতে থাকে? পূর্ব জানালাটা বন্ধ করে দেয়।বৃষ্টির পানি ঢুকে পূর্ণতার ব্লাউজের হাতা ভিজিয়ে দিয়েছে বেশ। পূর্ণতা তার উত্তরের হদিশ না পেলেও এইমুর্হূতে শীতল পরিবেশে পূর্বের উষ্ণ বুকে মাথা রেখে অদ্ভুত শান্তি অনুভব হচ্ছে ওর। পূর্ণতার চুলের ভেতরে হাত ডুবিয়ে ওর গালে হাত রেখে গাম্ভীর্য আভায় বলে উঠে পূর্ব,

– তোমাকে আমি ঠিক কবে দেখি? প্রথম দর্শন কোথায় হয়েছিলো মনে আছে? তোমার শাড়িটা একটু আধটু ছেড়া ছিলো আমি গায়ের একছত্র পোশাক খুলে তোমাকে ঢেকে দেই। তখন কিন্তু তোমার প্রতি কোনোকিছুই আমার ছিলো না। অন্য দশটা নরমাল মেয়ের মতোই তোমাকে দেখেছি। তোমার সাথে খুব অসভ্য কাজ করতে পারতাম, তোমার ঘুমের সুযোগ নিয়ে বহুবার বেখেয়ালে ছোঁয়াও কিন্তু ব্যাপার ছিলো না আমার জন্য। তুমি কি করে আমার নিয়মতান্ত্রিক জীবনে আগমন করলে আমি সেদিন বুঝতে পারিনি। শুধু এইটুকু আমার খেয়াল আছে, তুমি আমার এই হাতদুটোর উপর ঘুমিয়েছো। হাতদুটোয় আবদ্ধ করে তোমাকে নিজের শরীরের উষ্ণতায় সুস্থ করার চেষ্টা করেছি। বুকের ঠিক এই জায়গাটায় তুমি বালিশের মতো তোমার মাথাটা রাখতে আমি আজও সে স্মৃতি ভুলিনি। যেখানে আমার অনুমতি ছাড়া কেউ আমার রুমালটা পযর্ন্ত টাচ করতো না সেখানে তুমি আমার বুকের ভেতর স্পর্শ করেছো। তোমাকে বিশ্বাস না করলে আমার কাছে থাকার সুযোগ দিতাম? থাপ্পড় মেরে তোমাকে অপমান করতাম যেমনটা অন্য মেয়েদের এতোদিন করেছি। আয়মান সেদিন কলে যখন বললো তুমি রাজিবের কাছে ভিক্টিম হয়েছো শুনেই আমার ভেতরে যে কেমন পরিস্থিতি হয়েছিলো ভাবলেই গায়ের চামড়া এখনো দাড়িয়ে উঠে। জীবনে প্রথমবার ‘কি করবো?’ — প্রশ্নটা ভেবে আমি বাজেভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পরি। এখনো বাথরুমের সেই ‘তুমি’কে মনে পরলে আমার হুলস্থুল অবস্থা হয়ে যায়। যদি তোমাকে বিশ্বাস না করতাম তবে আমার মতো মানুষ কখনো তোমার সান্নিধ্যের জন্য মরিয়া হতো না। পলিটিক্সের জন্য না অন্যকিছুর জন্য জানিনা তবে মেয়েদের কাছ থেকে রিজেকশন কখনো পেয়েছি বলে মনেহয়না। আমি স্বল্পভাষী মানুষ। তুমি একমাত্র কারণ যার জন্য আমি এতো কথা বলতে ও জানাতে আগ্রহ খুঁজে পাই। এতোকিছু জানানোর একটাই মোটিভ ছিলো পূর্ণতা! প্লিজ আমার কাছ থেকে নামটা জানার জন্য আর ফোর্স করো না।

অতঃপর পূর্বের লম্বা বক্তব্যের আড়ালে আসল কারনটা বুঝতে পারলো পূর্ণতা। পূর্ব কোনোভাবেই যে নামটি উচ্চারণ করবেনা তা স্পষ্টাকারে ফের বোঝা যাচ্ছে। পূর্ণতা নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
– তুমি ভাবছো নামটা জানলে আমি ভেঙ্গে পরবো?
– ভাবছিনা। গ্যারান্টি দিচ্ছি।
– তুমি বলবেনা তাইতো?
– যদি নামটা বলার মতো হতো তোমার জানার আগেই আমি তার অস্তিত্ব মিটিয়ে দিতাম।

হঠাৎ রুমের কাঠদরজায় ঠকঠক শব্দ হতেই পূর্ব দরজার দিকে তাকায়। পূর্ণতাকে ছেড়ে দিলে পূর্ণতা বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলতেই আয়মান বাইরে দাড়িয়ে বলে,

– দোস্ত একটু দরকার। আসবি?

পূর্ণতা বিহ্বল দৃষ্টিতে মাথা ঘুরিয়ে পূর্বের তীক্ষ্ণদৃষ্টির দিকে তাকায়। পূর্ব নিশ্চয়ই সন্দেহ করছে। আয়মানের সাথে মিলে যে ও আসল ঘটনার জরিপে জড়িয়েছে তা আঁচ হয়তো করেছে। পূর্ব পরিস্থিতি ঠান্ডা রেখে চোখ দিয়ে ইশারা করলে পূর্ণতা দরজা চাপিয়ে চলে যায়। পূর্ব বালিশে মাথা রেখে জানালাটা খুলে বৃষ্টির পবিত্র কণায় ডুব দেয়। আজ তার প্রচুর ঘুম পাচ্ছে। কেন যেন শান্তির ঘুম হবে এমন বাদলা দিনে, টিনের ঘরে, আধো অন্ধকারে।
.
ধোয়া উঠা গরম কাপে চোখ বন্ধ করে তৃপ্তির চুমুক! আহ্, কি দারুণ অনুভূতি! বজ্রপাতের তালে তালে বৃষ্টির দিনে গরম চা ও ভুনা খিচুড়ি অমৃতের মতো স্বাদ লাগে! যেনো বেহেস্তি পসরা হুট করে এমন বাদলা দিনে আসমান থেকে নেমে এসেছে! রান্নাঘরে মাটির চুলোয় বড় হাড়িতে খিচুড়ি রান্নার ঘ্রাণ পুরো বাড়িতে ছড়িয়ে পরেছে। সবাই যার যার প্লেট হাতে নিয়ে পূর্বপ্রস্তুতি সেরে ফেলেছে। আনিশার মা সাজেদা ও পূর্ণতার মা খোদেজা দাওয়ায় বটি পেতে লেবু, শসা, পেঁয়াজ কাটছে। পূর্ণতার মামী দিলরুবা হাফ প্লেটের উপর কাটাকুটির জিনিস সুন্দর করে সাজাচ্ছে। একপাশে গোল করে কাটা শসা, এরপর লম্বা ফালি করে কাটা লেবু, এরপর স্থান পেয়েছে দেশী পেঁয়াজের টুকরা। তানিয়া উঠোনের কলপাড় থেকে কি যেনো ধুয়ে এনে দিলরুবার পাশে প্লেটে কিছু রাখলো। দিলরুবা চোখ ঘুরিয়ে তানিয়ার চন্ঞ্চলীভাব দেখে বিরক্ত হলেও তা যথাসাধ্য ভেতরে চেপে বলে উঠলো,
– মরিচ আনতে গেলি কেন? খিচুড়িতে মরিচ দিছে না?
তানিয়া মাথার উপর থেকে বৃষ্টির প্রলেপ ঝাট দিতেই বললো,
– আনাম মরিচ খাওয়ার স্বাদ আছে গো টুসটুসী মামী! খিচুড়ির লোকমায় মরিচ কামড় দিলে যে ঝাঁজটা লাগে উফ!

দিলরুবার মুখের অবস্থা এমন হলো যে এই অকালপক্কের সাথে কথা বলে নিজের রুচি বাধানোর কোনো শখ নেই। সে প্লেট নিয়ে খাওয়ার ঘরে চলে গেলো। তানিয়া হাত এগিয়ে টিনের চাল ধুয়ে পরা ঝর্ণার মতো বৃষ্টির পানি মুঠোতে পুড়ছে। আয়মান পূর্ণতাকে নিয়ে রুমের দরজা আটকিয়ে দুটো চেয়ার টেনে বসে পরে। সাগ্রতের বেলায় কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ করা গেলো। মাথার চুলগুলো ভিজে খাড়া খাড়া হয়ে আছে, গায়ের পোশাক পাল্টে নেভি ব্লু শার্ট ও ব্ল্যাক প্যান্ট পড়নে। একহাতে হাতে ধোয়া উঠা তপ্তকর কফির মগ, থেমে থেমে তাতে চুমুক দিচ্ছে। অপরহাতে মোবাইল, যা ক্ষনে ক্ষনে কিছু টাইপ করছে।

– আই উইল কিল ইউ!
সাগ্রত মেসেজ দেখে মুচকি হাসে রিপ্লায় করে,
– আই উইল কিস ইউ। ওয়েট ফর দ্যাট। আমি আসছি তো। দেখো কি করি।
– কি?মানে? আপনি না এক সপ্তাহের জন্য গিয়েছেন?
– কাজ যদি একদিনে শেষ হয় তো সমস্যা কি? এসে তোমাকে বাজাচ্ছি। ওয়েট

সাগ্রতের অন্যমনস্কের হাসি ও ফোনের বিপরীতে টাইপিং দুটো পূর্ণতার কাছে উদ্ভট লাগছে। আয়মান পূর্ণতার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জবাব রেখে বলে উঠে,
– ভাবির সাথে চলে বুঝোস না? স্নেহা ভাবি কিন্তু জোশ দেখতে! দেখবি ভাবিরে?
– হারামি! আমি এখানে ভাবি দেখতে আসছি?

হঠাৎ সাগ্রত কফিতে ছোট্ট চুমুক দিয়ে বলে উঠে,

– আমার কান সজাগ, সরি। সবকিছু শুনে ফেলেছি। আয়মান? তোমার ভাবিটা বুঝছো একা থাকে। বিশাল ফ্ল্যাটে এখন তার মন বসছেনা তাই কাজের টাইমে টেক্সট করেছে।
– ভাবি একা থাকে মানে? আপনার বাবা মা?
– নেই। পরপারে টপকে গেছে। স্নেহা ও অনাগত একজন ছাড়া বর্তমানে আমার কেউ নেই।
– অনাগত? ভাবী কি প্রেগনেন্ট ভাইয়া?

সাগ্রত সহজসাধ্য হাসিতে বলে উঠে,
– হ্যাঁ। সেভেন্থ মান্থ রানিং।

পূর্ণতা খবরটা শুনে এতো খুশি হলো যেনো নিজের মা হওয়ার সংবাদ শুনেছে। পূর্ণতা চট করে আয়মানের গালে থাপ্পড় মেরে দিলো। আয়মান যেন আকাশ থেকে ধপাস করে পরলো! পূর্ণতা ওকে মারলো কেন? এই খুশির সংবাদের চড় দিলো কি বুঝে? পরক্ষনে পূর্ণতা তাচ্ছিল্যের সাথে বললো,
– দেখ হাঁদা! তাড়াতাড়ি কর! তোর পোনাপুনি গুলোর সাথে আমার গুলো বিয়ে দিবো বুঝলি? তোর মেয়েকে তুলে এনে আমার ওয়াসিফ বাড়ির বউ বানাবো। বল বিয়ে করবিনা?

আয়মান গালে হাত দিয়ে ভিনগ্রহী প্রাণীর মতো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আছে! পূর্ণতার কি মাথায় সিট আছে নাকি? আয়মান বোকা দৃষ্টিতেই বলে উঠে,
– বইন তুই ঠিক আছোস? ভাদ্র মাসের পাগলা কুত্তা কামড় দিছে? যদি কামড়ানি খাস তো চল, তোরে দুটা টিটেনাস দিয়াই আনি।
সাগ্রত খিলখিল করে হাসতে থাকে। এই দুজনের কর্মকাণ্ডে রীতিমতো পেটের ভেতর হাসিতে ঝড় উঠে যাচ্ছে। বহু চেষ্টায় হাসি আটকে সাগ্রত বলে উঠলো,
– তোমরা দুজন কি ছোট্টকালের বন্ধু?
আয়মান ফট করে বলে উঠে,
– না ভাই। নেংটাকালের বন্ধু। আমি, পূর্ণতা, শ্রেয়া জন্মের পর থেকেই একে অপরকে চিনি।
– ওহ্ মাই গড! এতো পুরোনো সম্পর্ক টিকে কি করে?

হঠাৎ হাস্যোজ্জ্বল মুখ দুটো কালো আধারে মিইয়ে গেলো। নামের তালিকায় যে আরো একজন অন্তর্ভুক্ত ছিলো তার নাম নেওয়াও এখন হারাম। পূর্ণতা মাথা নিচু করে ফ্লোরে পায়ের নখ খোচাচ্ছে। আয়মান ভারাক্রান্ত মুখে একটুকরো হাসি ফুটিয়ে বলে উঠে,

– আমরা চার বন্ধু ছিলাম। আমি, শ্রেয়া, পূর্ণতা, রাজিব। আমি অবশ্য সবার থেকে আটমাসের বড়। আমরা চার পরিবার বিল্ডিংয়ের একই ইউনিটের চারটা ফ্ল্যাটে থাকতাম। বন্ধু, সহপাঠী, ভাইবোনের মতোই একে অন্যকে দেখে বড় হয়েছি। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটিতেও আল্লাহর রহমতে আমরা একসাথেই ছিলাম। কিন্তু আল্লাহ্ হয়তো ভালোর জন্যই আমাদের এক বন্ধুকে আড়াল করে দিলো। রাজিব খুব বড় ধরনের একটা খারাপ কাজ করলো। এরপর থেকে ও আমাদের সাথে নেই।
– তোমাদের পরিবার খুব ঘনিষ্ঠ?
– হ্যাঁ। যদি পূর্ণতা বা শ্রেয়া আমাদের বাসায় থাকতে চাইতো কখনো ‘না’ শব্দ উচ্চারণ করতো না। এতোটাই বিশ্বাস আর ভরসা করে আমাদের সবার পরিবার।
– মনে কিছু না করলে একটা কথা বলবো। আমি মানি যে, বেস্টফ্রেন্ড জিনিসটা বিপরীত ধর্মী ছেলেমেয়ের জন্য না। একসময় না একসময় তারা প্রেমে পরে। তোমাদের মধ্যে এমন হয়নি?
– আমাদের মধ্যে এমন হয়নি। রাজিবের বেলায় যেটা ছিলো ওটা ছ্যাঁচড়ামি।

সাগ্রত এবার পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে বলে,
– মিসেস পূর্ণতা? আপনার সামনে আয়মানের মতো সুন্দর একটা ছেলে ঘুরঘুর করতো, কখনো ফিল কাজ করতো না? ওকে দেখে তো আমারই মাথা ঘুরে গেছিলো।

শেষের কথাটা সাগ্রতের জন্য সত্য না হলেও মেয়েদের জন্য সত্য। আয়মানের চওড়া বুকের শেপের দিকে একবার হলেও রাস্তায় হাঁটা মেয়েদের সরু নজর পরবে। প্রাণখোলা হাসির দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি ছুড়বে হয়তোবা দৃষ্টিগোচরে কেউ সেই হাসির প্রেমেও পরে যেতে পারে। সুন্দর দেখতে আয়মান বন্ধুটা কখনো ভাইব্রাদার বা জিগারের দোস্ত ছাড়া পূর্ণতার জীবনে তেমন বেশি কিছু ছিলোনা। পূর্ণতা হেসে বলে,

– এই হারামিটা এতো সুন্দর দেখেই তো আমি ওর মেয়েকে আমার বাড়ির বউ বানাতে চাই। ও যদি ছেলে হয়ে দেখতে এতো লাজাবাব হয় তাহলে ভাবুন বাপকা বেটি কতো প্রিটি হবে?

আয়মান লজ্জাজনক হাসি দিয়ে বলে উঠে,
– তোর বাড়িতে মেয়ে পাঠায়া আমি দেদারসে তোর পোলার সাথে উইস্কি খামু। তোর জামাইরে বলবি একটা বার সেকশন খুলতে।

খিলখিল হাসিতে মেটে উঠে আয়মানের ঘর। সাগ্রত, পূর্ণতা ও আয়মানের হাস্য কলরবে মুখরিত হয়ে ওঠে বৃষ্টিময় পরিবেশ। কিন্তু পরবর্তীতে এই হাসিগুলো কি মিলিয়ে যাবে? ‘বেশি হাসলে কাঁদতে হয়’ — প্রবাদের মতো সত্য হবে? সাগ্রত চাপা ব্যথায় ব্যথিত হয়। কি মধুর সম্পর্ক ওদের মধ্যে! কি বিশ্বাস, ভরসা ও ভালোবাসা বিরাজ করে তিনজনের বন্ধুত্বে! কিন্তু নামটা জানার পর কি হবে এ দুজনের? হাসিগুলো কোথায় নিরুদ্দেশ হবে? ফিরে কি আর আসবেনা? সাগ্রত হুট করে মুখের হাস্য লালিমা হ্রাস করে পূর্ণতার হাসিখুশি চেহারায় তাকিয়ে থাকে। পূর্ণতা হঠাৎ সাগ্রতের দৃষ্টি দেখে বলে উঠে,

– কিছু বলবেন ভাইয়া?
– বলার অনেক কিছুই আছে। আপনার হাসবেন্ড কেন আপনাকে বলতে চাচ্ছেনা তা এখন পরিস্কার বুঝতে পারলাম।

পূর্ণতা চুপ করে তাকিয়ে আছে। আয়মানও এখন মুখ গম্ভীর করেছে। সাগ্রত কফিতে শেষ চুমুকটা দিয়ে টেবিলে মগ রেখে বলে উঠে,
– আপনার থুতনিতে যে ছোট্ট একটা গর্ত আছে তা অদ্ভুত সুন্দর। আপনার হাসিতে একটা নিষ্পাপের ছোঁয়া আছে। কেউ আপনার হাসিটা দেখলে শুধু দেখতেই চাইবে, তার মন ভরবেনা তাতে। আমরা একটা কোলের বাচ্চার হাসি দেখার জন্য আকুপাকু করি আপনার বেলাতেও এমনটা হয়ে থাকে। আপনি কাছের মানুষগুলোকে বুকটা উজাড় করে বিশ্বাস করেন তা দেখে কেউ চাইবেনা আপনার বিশ্বাসের ডোরটা ভাঙুক। পূর্ব আপনাকে এতোটা ভালোবাসে যা পরিমাপ করা দুঃসাধ্য। আপনার হাসিটা যখন কান্নায় মিলিয়ে যাবে সেই দৃশ্যটার জন্য উনি নিজের ঘটনাও মাটি করতে প্রস্তুত। এবং উনি সেটাই করছেন। আপনাকে কিচ্ছু বলেনি। আর মনেহয়না সে বলবে। আমি এখানে সত্য দেখাতে এসেছিলাম কিন্তু অনেক কিছুই শিক্ষা পেলাম। ভালোবাসার জন্য দিনক্ষন লাগেনা, লাগে শুধু মূহুর্ত। এই মূহুর্তগুলো উনি আপনার নামে করে দিয়েছেন। উনি একজন ব্যস্ত জীবনের মানুষ। তার উপর রাজনীতিতে জড়িত তবুও আপনাকে নিয়ে তার খুব স্বপ্ন। এমন স্বপ্নচারিনীর ঠোঁট ভেঙ্গে যখন কান্নার আর্তনাদ আসবে উনি সেটা সহ্য করতে পারবেন না। সত্যিকার অর্থেই ভেঙ্গে যাবেন।আপনি শক্ত হোন ছোটবোন। আপনি ভাঙ্গলে ওই মানুষটার শক্ত খোলসটা ভেঙে শত্রুর সাহসের পাল্লা ভারি করবে। একটা পুরুষ যেমন মেয়ের জীবনটা নরক বানাতে পারে। একটা মেয়ে চাইলে পুরুষের গোটা জগত ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে। পূর্ব কষ্ট পেলেও আপনাকে বলবেনা। হয়তো উনি এখন অমানুষিক যন্ত্রণায় আছেন সেটাও আপনাকে বুঝতে দিচ্ছেনা। শান্ত স্বাভাবিক মূহুর্তে আপনি যখন তার মুখের দিকে তাকাবেন তখন বুঝবেন তার যেন কিছুই হয়নি। যখন বুকের উপর হাত রাখবেন তখন ঠিকই বুঝবেন হৃৎপিন্ডের ধুকধুকানির সাথে উনি নিজের সকল তীব্র উৎকন্ঠা চেপে রেখেছেন। ‘যা দেখা যায় তা সত্যি হয়না, যা দেখা যায়না তাই সত্যি হয় ‘– কথাটা জানেন তো? নিজেকে সামলে ওই মানুষটাকেও সামলান। এভাবে ছোটোখাটো ব্যাপারে জীবনের গতি থামাবেন না। সময়, স্রোত, জীবন – কোনোটাই কারোর জন্য থেমে থাকেনা।

সাগ্রত জোরে নিশ্বাস ছেড়ে পকেট থেকে একটা কাগজের ভাজ বের করে। টেবিলের উপর মগের নিচে রাখতেই উঠে দাড়িয়ে পরে। পূর্ণতার দিকে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়ালে পূর্ণতা হতভম্ব দৃষ্টিতে দাড়িয়ে কাঁপা কাঁপা হাত এগিয়ে দেয়। আয়মানের মস্তিষ্কে বুদ্ধির চাকাটা কোথাও যেন জং ধরে আটকে গেছে, ঠিকমতো ঘুরছেনা, কিছুই বুঝতে পারছেনা সাগ্রত কি বলছে। সাগ্রত মিষ্টি হেসে পূর্ণতার সাথে হ্যান্ডশেক করে বলে,

– কাজের উছিলায় আবার দেখা হবে ইনশাআল্লাহ। আমি নতুনভাবে আপনাকে দেখতে চাই। অবলা, দূর্বল, লান্ঞ্চিত পূর্ণতা না। আল্লাহ্ হাফেজ ছোটবোন। আবার দেখা হবে।

সাগ্রত জানালার কপাট খুলে চামড়ার ব্যাগটা বাইরে ছুড়ে মারে। ঝপ করে বৃষ্টির মধ্যে মাটিতে পরার শব্দ হতেই জানালা দিয়ে লাফিয়ে পরে সাগ্রত। হাত ঝাড়া দিতেই পূর্ণতার উদ্দেশ্যে কপালে আঙুল তুলে ‘স্যালুট’ ইশারা করে মিলিয়ে যায় বৃষ্টিতে। নিরবচ্ছিন্ন বৃষ্টি যেন বাতাসে কুজন শব্দ ছেড়ে দিয়েছে, কানে প্রতিধ্বনির মতো লাগছে, ‘আল্লাহ্ হাফেজ ছোটবোন, আবার দেখা হবে’। ‘আবার দেখা হবে। ‘

আয়মান মগের দিকে তাকাতেই চিরকুটটা দেখে। মগ উঠিয়ে চিরকুট নিয়ে পূর্ণতার দিকে একপলক তাকিয়ে বলে,
– এটা তুই খুলবি না আমি খুলবো?
– তুই খোল।
– সিউর তো?
– হ্যাঁ সিউর।

আয়মান জানালা দিয়ে আকাশের পানে দৃষ্টি রেখে মনেমনে কিছু বললো। চিরকুটটা খোলার সাহস না হলেও পূর্ণতার জন্য খুলতে হবে। আয়মান ‘বিসমিল্লাহ্’ বলে চিরকুটটা খুলে ফেললো, কালো বলপেনের কালিতে যে নাম ছিলো তা জানার জন্য যতোটা উদগ্রীব ছিলো এখন উদ্ধৃতির জন্য একটুকুও গলা ভেদ করে শব্দ করতে পারছেনা। সাদা চিরকুটটা ধরে শোপিসের মতো স্থির হয়েছে গেছে। আয়মান পূর্ণতার দিকে পিঠ দিয়ে সাদা চিরকুটে আরো একবার চোখ বুলালো। পরিস্কার লেখায় দুটো অক্ষরমালা একত্রে সাজানো। কি সুন্দর নাম!! এই নামটা ঠোঁটের কোণায় উচ্চারণ করলে নিমিষেই মনটা প্রাণচাঞ্চল্য হয়ে উঠে। সাদা চিরকুটে একফোঁটা পানি পরে কালো কাজলের মতো কলমের কালিও যেন ছড়িয়ে পরতে লাগলো। পূর্ণতা ব্যাপক অস্থিরতায় ছটফট করতেই আয়মানের কাধ ঘুরিয়ে হাত থেকে চিরকুট নেয়। চট করে আয়মানের চোখ লুকানো দৃশ্য পূর্ণতা দেখে ফেলে। আয়মান চোখের পানি লুকাচ্ছে কেন? আয়মান চোখে হাত দিয়ে অনেকটা পালিয়ে যাওয়ার মতো দরজা খুলে বেরিয়ে যায়। পূর্ণতা সেদিকে কিছুক্ষন তাকিয়ৈ থেকে শেষমেশ হাতের ভেজা চিরকুট মেলে ধরতেই গোটা গোটা অক্ষরগুলো ভেসে উঠে, ‘শ্রেয়া’। আবার দেখে, ‘শ্রেয়া’। আরো কয়েকবার দেখে ‘শ্রেয়া’। পাগলের মতো বিছানার উপর থেকে মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে দেখে নাহ্…শ্রেয়াই লিখা আছে। কেন লিখা আছে? এই নাম কেন লিখেছে? শ্রেয়া ছিলো? অসম্ভব! কি করে হবে? শ্রেয়া হতেই পারেনা। হতে পারেনা।

#FABIYAH_MOMO 🍁

‘ চলবে ‘

#তোকে_ঘিরে❤
#পর্ব_৩৩
#ফাবিয়াহ্_মমো 🍁

ধপ করে বিছানার ধার ঘেঁষে ফ্লোরে বসে পরলো পূর্ণতা। হাতের চিরকুটটা ফ্লোরে বেহালভাবে পরে আছে। আচ্ছা বিশ্বাসঘাতকদের মুখ কি কখনো কালো হয়? কালি দিয়ে কালো করে দিলে কেমন হয়? অন্ততপক্ষে নোংরামি করার চিহ্নটা তার মুখের উপর ভেসে থাকবে। মানুষ জিজ্ঞেস করবে, কিরে? তোর মুখ ওমন কালো কেন? তখন লজ্জায় কিচ্ছু বলতে না পেরে অন্য আরেকজন তার হয়ে বলবে, নোংরামি করেছে। নোংরার চিহ্ন।পূর্ণতা নিশ্চল দেহের মতো স্তব্ধ হয়ে আছে। বুকের ভেতর যে প্রলয় হচ্ছে তা যেন বাইরের ঝড়কেও হার মানিয়ে ছাড়বে। এতো বড় ধোকা? এর চেয়ে মৃত্যুটা কি শান্তি না?

ঠান্ডা পায়ের আলতো পদচারনার শব্দ আসছে কানে। এইতো দরজার বাইরে কেউ হাঁটা থামিয়ে দিলো। কে বাইরে? কে দাড়িয়ে? দরজায় কেনো টোকা দিচ্ছেনা? পূর্ব বিছানা থেকে উঠতেই হারিকেনের পলতেটা বাড়িয়ে দিলো। গ্রামাঞ্চলে ইলেক্ট্রিসিটির দারুন সমস্যা। হালকা বাতাস ছাড়তে দেরি, কারেন্ট হাওয়া হতে দেরি করেনা। তানিয়া হাসিহাসি মুখে দুলতে দুলতে টেবিলের উপর হারিকেন দিয়ে যায় যার ফলে লুমটা এখন আধো অন্ধকারে ঠাসা।। পূর্ব নিজের ভেজা চুলগুলোকে লেফটসাইডে ঠেলতেই দরজার দ্বার খুলে দাড়ায়। মায়াদৃষ্টির চোখ দুটো কি ভার হয়ে আছে! সরু ঠোঁট দুটো যেনো শীতের কাপুনির ন্যায় কাঁপছে। পূর্ব দরজার বাইরে একহাত বাড়িয়ে পূর্ণতাকে ধীরেসুস্থে ভেতরে আনলো। দরজাটা ঠিক করে লাগিয়ে দিলো। পূর্ণতা যন্ত্রমানবের মতো থমকে আছে। আচ্ছা ও কাঁদছে না কেন? অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর ব্যাপারটা কি ফলে গেলো নাকি? পাথর হলে তো সমস্যা! বুকে ব্যথা দিবে! প্রচুর ব্যথা দিবে! পূর্ব তো নিজেকে ‘সদা প্রস্তুত’ কমান্ডের মতো তৈরি রেখেছিলো। যখন পূর্ণতা হুমড়ি খেয়ে কাঁদবে পূর্ব ওকে বুকে টেনে শান্ত করাবে। এ কি হলো?

পূর্ব কিছু একটা অতিদ্রুত চিন্তা করলো, খুবই সুকৌশলে দারুন একটা পরিকল্পনা সাজালো। মুষলধারে বেগতিক বৃষ্টির মধ্যে রুমের পেছনের দরজাটা পুরো খুলে দিলো এতে পূর্ণতা একচুলও নড়লো না। অন্যসময় হলে পূর্ণতা একটু ফুসে যেতো। পূর্ব হাত থেকে ঘড়ির হুকটা টেনে পূর্ণতার পাশ কাটিয়ে টেবিলের উপর খুলে রাখলো। এখনো পূর্ণতা লক্ষ করলো না পূর্ব ধীরেধীরে তৈরি হচ্ছে। আচ্ছা পূর্ব কি করবে? মারবে? মারার আগে হাত সাফ করা তো ফিল্মি ব্যাপার স্যাপার। সিনেমায় গুন্ডাদের পেটালে নায়করা পূর্বের মতো ভাবসাব নিয়ে হাতের ঘড়ি খুলে। এবার বাদামী পান্জাবীর হাতাটা উল্টো ভাঁজ করে ধবধবে কবজিটার একটু দূরে গুটালো। ইশ! মারাত্মক দৃশ্য! হাতের উপর বিছিয়ে থাকা পশমস্তরগুলো যেনো অতি লোভনীয়! পূর্ণতা কি একবার তার সুদর্শন পূর্বকে দেখবেনা? দেখলে নির্ঘাত চোখ ফেরানোর ক্ষমতা রাখতো না! গায়ের বাদামী পান্জাবীটা কি ভয়ংকর সুন্দর লাগছে, ভিজে উঠা চুলের এবড়ো থেবড়ো অবস্থা মাথার তালুতে খাড়া হয়ে কি চমৎকার লাগছে পূর্ণতা তো দেখলোই না। হঠাৎ পূর্ণতার হাতে টানশক্তির ফলে বুলেট গতিতে দরজার বাইরে বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে এলো। কি তুখোড় বৃষ্টি! মাথার তালুতে ঠান্ডার ঘাণিতে বেশ কঠিন অনুভূতি! কয়েক মিনিটের মধ্যে নাকানিচুবানি ভেজার মতো কঠিন দশা হবে এমন বৃষ্টি হচ্ছে পরিবেশে।।

বলা প্রয়োজন, পেছন দরজা দিয়ে বেরুলে ছোট্ট খোলামেলা একটা জায়গা দেখা সম্ভব। যেখানে বাগান করার জন্য পূর্ণতার নানাভাই শোলার বেড়ায় চর্তুপাশ ঘিরে দিয়েছেন। এরপর বিশাল বড় বিস্তৃত মাঠ যেটা ফসলী শষ্যবস্তু গাদা গাদা করে রাখা হয়। মূলত সে অর্থেই জায়গাটা নিরিবিলি এবং সেখানে পূর্বের নতুন গাড়িটা তেরপাল দিয়ে ঢাকা।

পূর্ণতা বৃষ্টির পানিতে ভিজে একাকার তবুও যেনো হুশহীন স্তব্ধ অবস্থা। অন্ধকারাচ্ছন্ন বৃষ্টিমুখর পরিবেশে চোখ সয়ে থাকাটাই যেন বিরাট ব্যাপার। পূর্ব সজাগ দৃষ্টিতে তবুও একবার আশেপাশে দেখে নিলো কেউ আছে কিনা। যাক কেউ নেই। পূর্ণতার দিকে ফিরে তাকাতেই দেখলো পূর্ণতা কাঁপছে। ও কি শীতে কাপছে না ব্যথায় কাঁদছে? বোঝা মুশকিল। পূর্ব কাছাকাছি হয়ে দাড়ালো। হালকাভাবে গাল ঝাঁকিয়ে ঠান্ডা সুরে জিজ্ঞেস করলো,

– তুমি কাঁদছো না কেনো পূর্ণ? কিজন্যে?

পূর্ণতা সৎবিৎ ফিরে পাওয়ার মতো গা ঝাঁকিয়ে চমকে উঠলো। চোখ তুলে ঠিক করে তাকাতেই বুঝলো সে এখন ভারি বর্ষনের নিচে! পূর্ব কপাল কুঁচকে আরো কিছু বলবে হঠাৎ পূর্ণতা ডুকরে কেদেঁ উঠলো। আকাশে জমা মেঘগুলো এখন বৃষ্টি হতে শুরু করেছে। পূর্ব এবার স্বস্তিতে নিশ্বাস ছেড়ে পূর্ণতার মাথায় হাত রাখলো। আকাশের দিকে চোখবন্ধ করে মনেমনে বললো, ‘আল্লাহ্ তুমি পূর্ণর কষ্ট লাঘব করো। পৃথিবীতে সরল সহজ মানুষদের এতো কষ্ট দিও না। যারা হামেশা পাপ করে বেড়ালো তাদের তুমি কঠিন শাস্তি না দিলে দুনিয়া ধ্বংস হতে বেশিদিন লাগবেনা। পাপের দুর্গন্ধে পূণ্যরা দূষিত হবে। আমার আকুল মিনতি, বিনীত অনুরোধ আমার পূর্ণতাকে তুমি কঠোর বানিয়ে দাও। ওকে এতোটাই কঠোর করো আজ থেকে ওর নবসূচনা হোক!’

কথা শেষ না হতেই কান্নার বেগতিকে পূর্ণতা শরীর ছেড়ে দিয়ে মাটিতে বসতে নিলে পূর্ব চট করে হাত ধরে ফেলে। পূর্ণতা কিছুক্ষণ হাত ছাড়াতে চাইলেও শেষে পূর্বের বুকে কপাল ঠেকিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। দেহের রক্তক্ষরণ সবাই দেখলেও মনের রক্তক্ষরন কেউ দেখেনা। মনের রক্তক্ষরন হলে মানুষের ছোট্ট সুন্দর মনটা স্বাভাবিক থাকেনা। পূর্ণতার নরম কোমল মনটা রাজিব, শ্রেয়া নামক দুজন মানুষ ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। রাজিবেরটা নাহয় বিপরীত ধর্মী আর্কষন ছিলো, কিন্তু শ্রেয়া তো ওর বোনের মতো বান্ধুবী ছিলো। বোনরূপী বান্ধুবী কখনো এমন আঘাত করতে পারে? এই নশ্বর দুনিয়ায় কি বান্ধুবী বলতে সত্যি কিছু নেই? কষ্ট হয়। প্রচুর কষ্ট হয়। কলিজার বান্ধুবী বা জিগার কা দোস্ত বলে যাদের মনের কোণে স্থান দেওয়া হয় দিনশেষে তারাই মনটাকে খুন করে চলে যায়। খুনিরা থাকে খুশিতে, ভিক্টিম মরতে থাকে ধুকে ধুকে।

বাঁধের সেই বিচ্যুত গাছের গুড়ির উপর বসে আছে আয়মান। গায়ের মাখন রঙের শার্টটা ভিজে জবজবা। চোখদুটোর সাদা অংশ লাল হয়ে চক্ষুকোটরে স্রোতস্বিনী নদীর মতো টলটল করছে। বাকরুদ্ধ হয়ে জ্বলছে বুকের কোথাও। কুড়ে কুড়ে লন্ডভন্ড হচ্ছে শরীরের আনাচে কানাচে। রাগ দমন হচ্ছেনা, কষ্ট নিবারণ সম্ভব না, দমটাও ছেড়ে যাচ্ছেনা এ কেমন যন্ত্রণা? এই যন্ত্রণা কেনো সহ্য হচ্ছেনা? কোত্থেকে উদয় হলো এই অসহ্যকর দহন? চক্ষুদৃষ্টি পুকুরের উপর বৃষ্টি জলধারায় তাক করতেই হঠাৎ গাছের গুড়ির উপর নির্লিপ্তে পাঁচ আঙ্গুলের মুঠোবন্দিতে ঘুষাতে লাগলো। এক,দুই,তিন,চার….আট নম্বর ঘুষিতে নেতিয়ে পরলো হাত। আয়মান নিজের চুল টেনে ধরলো দুহাতে। গুড়ি থেকে দাড়িয়ে পরলো ও। অস্থির লাগছে! শরীরে চামড়া যেনো ফেটে যাচ্ছে! পুড়ে যাচ্ছে! কি করবে? মরে যাবে? পুকুর পাড়ের অতি সন্নিকটে এসে চুল ছেড়ে তীব্র চিৎকার করলো আয়মান। ভেতরের সব কষ্টের আভাস বেরিয়ে গেলো না বুক থেকে, কোথাও যেনো গুটি পাকিয়ে লুকিয়ে গেলো ভেতরে। আজ ছেলেধর্মের একটা রুলস ভঙ্গ করবে? হাউমাউ করে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। আয়মান কি তা করবে? কিছুক্ষণ পর বৃষ্টির কঠিন ঝাপটায় কিছু করুণ আহাজারের শব্দ হলো। পরপর বহুবার। বড় ঘরের রুম থেকে আনিশার মা সাজেদা ও আয়মানের মা আফিয়া হঠাৎ কি যেনো শুনতে পেয়ে একসঙ্গে অবাক হলো। আফিয়ার সন্ধানী উদ্বিগ্ন মন আচমকা বলেই ফেললো,

– বাদলা দিনে কেউ কাঁদে নাকি? কেমন জানি চিৎকারের আওয়াজ শুনলাম। গ্রামে আবার যেই ঘটনা শুনি। ওইসব কিছু ডাকে নাকি আপা?
সাজেদা বিরসমুখে বললেন,
– আরে না গো, এখন কি ওই আগের যুগ আছে? আগে তো মাগরিবের আযান দিলে উঠোনে যাওয়াই নিষেধ ছিলো। এখন তো ঘরে ঘরে কারেন্ট।

আফিয়া আর কথা বাড়ালোনা। সাজেদা আপার কথাই ঠিক তবুও মনে যেনো ভারী শঙ্কার আভাষ অনুভূত হলো। মাতৃমনের সেই বিচলিত শঙ্কা। ছেলে কি উনার ঠিক আছে?

.

নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিলো আমার। কোনোভাবেই শ্বাস নেওয়ার জন্য নাকের ছিদ্রদুটো দিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় অক্সিজেন টানতে পারছিলাম না। পূর্ব আমার কঠিন দশা দেখে কিছুক্ষন অস্থির হলেও এখন আমাকে আবদ্ধ করেছেন উনার বাহুর কোলে। বৃষ্টির পানিগুলো মুখের উপর পরছে, আমি কাশতে কাশতে শ্বাস নেওয়ার জন্য ঠোঁটে খুলে হাপাচ্ছি। পূর্ব এই বৃষ্টির মধ্যে হেঁটে হেঁটে কোথায় নিয়ে এলো সেই হুঁশ আমার নেই। যখন একটু স্বাভাবিক হয়ে ভালো করে শ্বাস নিচ্ছিলাম তখন বুঝলাম ভূতুড়ে বটগাছের নিচে আছি। সামনে মাছ চাষের ছোট্ট খাল খানা । বাশেঁর বেন্ঞ্চির সাথে লাগোয়া বিশাল বটগাছটায় খুব খারাপ ঘটনা শুনেছি। পূর্ব আমাকে বেন্ঞ্চির উপর বসিয়ে পাশে ঘা ঘেঁষে নিজেও বসলো। আমাকে একটু ঠান্ডা হতে দেখেই আমার কপালে হাত রেখে বলে উঠলেন,

– আমার ইচ্ছে করছে তোমার গালে একটা থাপ্পর বসাই। মারি একটা?
ধীর কন্ঠে শক্তি জুগিয়ে বললাম,
– মারবা কেন?
– গ্রামে বৃষ্টিতে যদি ভিজতে না পারো জীবনে কি করেছো? মুখে ঘাস নিয়ে ছিলে এতদিন?
– মা আমাকে কখনোই বৃষ্টিতে ভিজতে দেয়নি। আমার তো নার্ভ…
– তোমার নার্ভ আমি কিভাবে নার্ভাস বানাই দেখো খালি! ফাজলামি পেয়েছো? ঢঙ করো? ঢঙ করো আমার সাথে? বৃষ্টিতে নিয়ে এসেছি দুমিনিটও হয়নি সে এখন এ্যাজমা…

হঠাৎ পূর্ব ভ্রু কুঁচকে কথা শেষ না করতেই পূর্ণতার শরীরে হাত রাখলো! ওমনেই চমকিত স্বরে বলে উঠলো,

– তুমি কাঁপছো? আমি ফাজলামি করে বলে…! ইয়া আল্লাহ্! এই মেয়ে? কথা বলো! আল্লাহ্! কি করলাম?

.

ধামধাম — করে দরজায় দু’বার কড়াঘাত করতেই চোখ কচলাতে কচলাতে দরজার একপাট খুললো শ্রেয়া। অন্যপাটে শরীর হেলিয়ে হাই তুলে ঘুমু চোখে বিরক্তির সুরে বলে উঠলো,
– এ্যাই ফাজিল! এইসময় আসলি কেন? ঘুমাচ্ছি না? কি সুন্দর বৃষ্টি, আমার মজার ঘুমটা…

বলতে বলতে আবার হাই ছাড়লো শ্রেয়া। আয়মান শ্রেয়ার পিছনে দৃষ্টিপাত দিয়ে ঘরে একবার লক্ষ করলো। পরক্ষনে ধাক্কা দিয়ে শ্রেয়াকে ভেতরে ঠেলে নিজেও ঢুকে পরলো। শ্রেয়া যেনো আশ্চর্যের চূড়ান্ত স্তরে! আয়মান দরজা লাগাতে থাকলে শ্রেয়া ভ্রু কুচঁকিয়ে বলে উঠলো,

– বদমাইশ দরজা লাগাচ্ছিস কেন?
– চুপ! একদম চুপ করবি ! আয়মানের রাগান্বিত কন্ঠ!

শ্রেয়া একটা ঢোক গিলে কন্ঠে কোমল ভাব এনে বলে উঠলো,
– কিছু হয়েছে দোস্ত? এনিথিং প্রবলেম?

আয়মান গম্ভীরভাবে তর্জনী তুলে বিছানায় বসতে ইশারা করলো। শ্রেয়া থতমত খেয়ে ঢোক গিলতে গিলতে বিছানায় বসলে আয়মান ওর পায়ের কাছে চেয়ার টেনে বসে। বাঁ পায়ের উপর ডান পা তুলে ভাবুক ভঙ্গিতে চোখ স্থির করলে শ্রেয়া অনেকটা চাপাকন্ঠে বলে উঠে,

– সমস্যা কি বলতো? এই রাতেরবেলা কাক ভেজা অবস্থায় কোত্থেকে এলি? এলি তো এলি তাও আমার রুমে কি জন্যে?
– কি দোষ ছিলো আমার? জবাব আছে তোর কাছে?
– কি বলছিস তুই? এগুলো কেমন কথা?
– তুই কি আমারে মূর্খ ভাবোস শ্রেয়া? উত্তরটা দে তো!
– তোর মূর্খতা দিয়ে আমার কি যায় আসে?
– ওহ্ হ্যাঁ তাইতো। আমি তো শালা আন্ঞ্চলিক মারাই। শুদ্ধ ভাষায় পেচাল পারিনা। কথাবার্তায় স্মার্ট না, তাইনা?
– ফাউল কথা বলবিনা আয়মান! রাতের ঘুম হারাম করে এখানে কোন ধানের আবাদ দেখতে আসছিস!
– তোর কি একটুও লজ্জা নাইরে শ্রেয়া? তুই কি মেয়ে না?
– মুখ সামলে কথা বল! কি ধরনের কথা এগুলো?
– তোর সাথে ঠিকই মুখ সামলায়া কথা বলতাম। এখন আর ছিড়িবিড়ি মানতাম না।
– তুই আমার রুম থেকে বিদায় হ! আই সেইড গো!
– কেন? পূর্ণতার ভাতারের দিকে তোমার নজর পরে? লজ্জা করেনা? শালা বারোভাতারি! কেমন পারলি পূর্ব ভাইয়ের সাথে ছ্যাঁচড়ামি করতে? ভাই তুই আমিরে খালি বুঝা কেমনে পারলি!
– জাস্ট শাট আপ আয়মান! এগুলো কেমন ফাজলামি? যেতে বলছি না? বেরিয়ে যা!
– তুই কি সোজাসুজি স্বীকারে আসবিনা? আমার টেকনিক কিন্তু খুবই ত্যাড়া! ভালোয় ভালোয় কথা বমি কর।
– কি জানতে চাস?
– পূর্ব ভাইয়ের সাথে ওইদিন কেন ওইসব করছিলি!

শ্রেয়া মুখ নিচু করে হাতের তালুতে আঙ্গুল ঘষতে থাকে। হঠাৎ নিরবতার চিত্রে পানি ঢেলে আয়মান বলে উঠে,
– তুই ভাইয়ের উপ্রে ক্রাশ খাইছিলি ঠিকনা? ভাই তোরে পাত্তাও দিতোনা। পূর্ণতার একসেস পাগলামির দিন ভাইরে যখন ডাকলাম আর ভাই যখন আসলো তখনই তোর মন ঘুরে গেছে। আরে শয়তান রে! তুই কতো বড় বাটপারি করলি ভাবছোস? ভাই কি তোরে একলা ইগনোর করতো? আনিশারে ইগনোর করেনাই? অন্য মেয়েরে ইগনোর করেনাই? তুই কেমনে পারলি রে ছ্যাঁচড়ামি করতে? পূর্ণতার কাছে কেমনে যাবি? ওর অবস্থা একটু ভাবছোস?

আয়মান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শ্রেয়ার দিকে। শ্রেয়া সেই যে মাথা নিচু করেছে সেই মাথা তোলার কোনো নামসূত্র নেই। আয়মান আবার বলে উঠে,
– তুই তো ভালো আছিলি শ্রেয়া, কেমনে এমন অশ্লীল কা..
হঠাৎ আয়মানের বাক্যে দাড়ি বসিয়ে শ্রেয়া বলে উঠলো,
– চুপ কর! তোর কাছ থেকে আমি আমার চরিত্রের সার্টিফিকেট চাইনা। হ্যাঁ আমার পূর্বকে খুব ভালো লাগতো। এখনো লাগে। অনেক চেষ্টা করেছি ওর সাথে একটু যোগাযোগ করার জন্য, ও কখনোই আমাকে ভেল্যূ দিতোনা। পূর্ণতার কাছ থেকে নাম্বারটা পযর্ন্ত চেয়েছি ও দেয়নি। মানুষের নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি প্রবল আর্কষন থাকে। আমার ক্ষেত্রেও সেটাই হইছে! আচ্ছা? তোর মতো ক্ষ্যাতের কাছে আমি আমার মনের কথা বলতেছি কেন? কে তুই? তোর মতো লাফাঙ্গা পোলাপান তো আমি এমনেতেই আঙ্গুলের ইশারায় নাচাতে পারি। শুধু পূর্ণতার কথা চিন্তা করে কখনো কিছু বলিনি। যা বের হ এখন।

শ্রেয়ার পরিবর্তিত রূপ দেখে আয়মান হতভম্ব দৃষ্টিতে হা করে আছে। মেয়ে মানুষের মধ্যে এতো পরিবর্তন? এটা না সেই শ্রেয়া যে পূর্ণতার সকল দুঃসময়ে পাশে ছিলো? পূর্ণতার জন্য তো কান্নাও করেছিলো বহুবার! কি করে এতো পরিবর্তন? হাউ পসিবল? হ্যাঁ শ্রেয়ার সাথে খুনশুটি হতো, বাড়াবাড়ি রকমের ঝগতো হতো, কথা কাটাকাটি চলতো তাই বলে আয়মান ক্ষ্যাত, লাফাঙ্গা? আয়মান নিজের চোখ দুটিকেও বিশ্বাস করতে পারছেনা। খুব কষ্টে একটা ঢোক গিলে শ্রেয়ার দিকে স্থির চাহনিতে বলে উঠলো,
– আমি কি ভুল মানুষরে পছন্দ করতাম?
– তোর পছন্দ মানে? তোকে কে পছন্দ করে যে তুই অন্যকে পছন্দ করবি? যোগ্যতা আছে তোর? মুখের ভাষাও তো ক্ষ্যাতমার্কা! কে তোর উপর ফিদা হবে? এহ্ আসছে আমার পছন্দটা! যা সর!

আয়মান ভিড়মি খাওয়ার মতো ধাক্কা খেলো। কি কঠিন কথাগুলো অর্নগল বলে দিচ্ছে শ্রেয়া! আয়মান তো ওকে কাছের মানুষ ভাবতো বলেই কখনো কথাবার্তা ভেবেচিন্তে মেপে বলতো না। নিতান্ত আপন মানুষের সাথেই আমরা দুনিয়ার জঘন্য ভাষায় কথা বলতে পারি যা আমরা বাবা মায়ের সাথেও অনেকক্ষেত্রে বলতে পারিনা। শ্রেয়ার তাচ্ছিল্যপূর্ণ চেহারা দেখে আয়মান নিজেকে সামলালো। বুকভর্তি নিশ্বাস টেনে নাসাপথে প্রশ্বাস ছাড়তেই তাচ্ছিল্য হাসিতে বলে উঠলো,

– শালা নিষিদ্ধ জিনিসের প্রবাদ মারায়! দুনিয়ার সবচেয়ে বড় জালিমের বাচ্চায় বলছিলো, এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার! নাহ্…আর কিছুই বলতাম না। কুত্তার কাছে গরুর ডাক শুনতে চাওয়া বোকামি!

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়াতেই চলে যাওয়ার জন্য দরজা খুললো আয়মান। যেতেই হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে ফের বলে উঠলো,

– আমরা যাদের জন্য নিয়ম ভাঙি, তারাই আমাদের ভেঙে দিয়ে যায়। আই ক্যান স্যা দিস ওয়ার্ড ইন ইংলিশ বাট ইউ থিংক আ’ম এ্যা ড্যামিশ গায়। হা হা, ম্যা আল্লাহ্ ব্লেস ইউ ইয়ার, আই হেভ নাথিং টু স্যা। আমি খুব শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারি যেমনটা আমার বাবা মার সাথে বলি। কিন্তু তোকে খুব আপন ভেবে বোকার কাজ করেছি শ্রেয়া। খুব দুঃখ দিলি। যদি আমি শিক্ষিত বাবা মায়ের সন্তান হয়ে থাকি আর কোনোদিন তোর সাথে যোগাযোগ রাখার মতো ভুল করবোনা।

ঝমঝম প্রখর বৃষ্টির মধ্যে আবার বেরিয়ে গেলো আয়মান। আজ কোনো পিছুটান নেই বুকে। সব ঝেড়ে মুছে শ্রেয়া নামক মানুষটার কাছে ফেলে এসেছে। যারা আমাদের মূল্য দেয়না তাদের কখনো কাছে রাখা ঠিক না। সময় আমাদের শেষ হাসিটার সুযোগ একদিন দিবেই। প্রকৃতি কখনো না-ইনসাফি করেনা। আচ্ছা পূর্ণতা এখন ঠিক আছে তো? হঠাৎ নিজের খেয়ালিপনা ছেড়ে পূর্ণতার জন্য ব্যতিব্যস্ত হলো আয়মান। সবচেয়ে বেশি আঘাত তো পূর্ণতা পেয়েছে ও কি এখন ঠিক আছে? আয়মান উঠোন পেরিয়ে বৃষ্টির পানিতে থপথপ পা ফেলে পূর্ণতার রুমের কাছে আসলো। দরজায় টোকা দেওয়ার কয়েক মিনিট পর দরজা খুললে সে দেখে পূর্ব কেমন অস্থির হয়ে আছে।

– ভাই কোনো সমস্যা? পূর্ণতা ঠিক আছে তো?
– ও সেন্সলেস হয়ে গেছে আয়মান।
– কি বলেন! ডাক্তার আনবো?
– না, প্লিজ। লাগবেনা। তুমি ঠিক আছো?
– আমার আবার কি হইবো? আমি তো বিন্দাস…
– আমার সামনে মিথ্যে বলো না। আমি চোরের মন ও মিথ্যার প্রবণ দুটোই টের পাই।
– আমি ঠিক আছি ভাই। কিছু হয়নাই। আসলে ভাই, আমরা ছেলেরা মনেহয় মেয়েজাতি দিয়াই আজীবন কষ্ট পাই ঠিকনা?
– হা হা হয়তোবা। মন খুব খারাপ? চাইলে ভেতরে এসে বসতে পারো।
– না ভাই কালকে আসি। আপনার পান্জাবী ভিজা ভাই। পান্জাবীটা পাল্টান। ঠান্ডা ধরবো।
– চিন্তা নেই, আমাকে এসব ঝড়বৃষ্টির অসুখ নাগাল পায়না। তুমি ভেতরে আসো,
– না ভাই। আপনে ঘুমান। সকালে আসবো।

আয়মান হাসি দিয়ে চলে যাওয়ার জন্য শরীর ঘোরাবে হঠাৎ কাধে হাত রেখে থামিয়ে দিলো ওকে। আয়মান মুখ ঘুরিয়ে পূর্বের দিকে তাকাতেই পূর্ব পিঠ চাপড়ে বলে উঠে,
– মেয়েরা ফুলের মতো। সঠিক ফুলটাকে বেছে তাকে আগলে ধরো। গুড লাক।

পূর্বের দুটি বাক্য আয়মান স্তব্ধ হয়ে শুনলেও হুট করে গা ভেজা পূর্বকে জাপটে ধরে আয়মান। কি ভেবে জাপটে ধরলো বোঝা না গেলেও পূর্ব মিচকি হেসে ওর পিঠে হালকা দুটো কিল বসিয়ে বলে উঠে,

– এভাবে থমকে যেতে নেই। কাটা উপড়ে, হাঁটা দিতে হয়। একদিন জীবন তোমাকে সুখ দিবেই। কষ্ট পেওনা আয়মান। এসব তুচ্ছ ঘটনাকে মনে রেখোনা।

আয়মান পূর্বকে ছেড়ে দিয়ে সম্মতিতে মাথা দুলিয়ে ঠোট জুড়ে একচিলতে হাসি আনলো। হাসির আভাষ রাখতেই আয়মান নিজের রুমের দিকে চলে গেলো। পূর্ব দরজা আটকিয়ে বিছানায় শোয়া পূর্ণতার দিকে একঝলক তাকিয়ে গায়ের পান্জাবীটা দুহাতে খুলে ফেললো। মাথা ঝাড়া দিয়ে একটা টিশার্ট আলনা থেকে তুলে গায়ে জড়ালো। প্যান্টটা চেন্জ করে একটা ট্রাউজার পরতেই পূর্ণতা কপালে হাত দিয়ে চোখ কুঁচকে নড়াচড়া করে উঠলো। পূর্ব টিশার্ট টেনে ঠিক করে বেডস্ট্যান্ডে পান্জাবী, প্যান্ট নেড়ে পূর্ণতার কপালে হাত ছুঁয়ে বললো,

– এই উঠোতো একটু। প্যারাসিটামলটা খেয়ে নেও। কি বললাম? কথা কানে যায়না? উঠতে বলছিনা?
– তুমি আমার কাপড় কখন বদলালে?
– তোমার কাপড় নিয়ে গবেষণা করতে হবেনা। মেডিসিন গিলতে বলেছি সেটা গিলো।
– তোমার চুলগুলো মুছো না কেন? ঠান্ডা লাগবে তো!!
– ট্যাবলেট ধরো আমি চুল মুছছি।
– তোয়ালে কই? আনো। আমি মুছে দিচ্ছি।
– আমি মুছতে পারবো। এগুলো ধরতে বলছি।
– সারা ফ্লোরে পানি ভাসিয়ে কি করেছো?
– সাগর বানাচ্ছি! হয়েছে? ট্যাবলেট ধরবে?
– এগুলো কিসের ট্যাবলেট? এতোগুলো কেন?
– একটা চড় মেরে মুখের কথা ছুটিয়ে দেবো! আমি ট্যাবলেট নিয়ে তোমার বকবক শুনতে চেয়েছি? না গিলতে বলেছি?

পূর্ণতা ক্যাপসুলগুলো খেতেই পূর্ব পানির গ্লাসটা ঢেকে পূর্ণতার কাথার ভেতরে ঢুকে পরলো। পূর্ণতাকে দুহাতে টেনে বুকে জাপটে ধরতেই বলে উঠলো,
– জ্বর বাধালে তোমার খবর আছে!
– বৃষ্টিতে নিয়ে গেলে কেন? আমার জ্বর আসবেনা তার গ্যারান্টি কিভাবে দিবো?
– ঔষুধ খাইয়ে দিয়েছি এখন চুপচাপ ঘুমাও। নাকি আরো কিছু করতে চাও?
– অতোগুলো ক্যাপসুল কিসের ছিলো?
– চড় চিনো চড়? ঘুমাও বলছি!

পূর্ণতা হুট করে বুক থেকে মাথা তুলে পূর্বের উপর উঠে গা ছেড়ে শুয়ে বললো,
– আমার সাথে রাগারাগী করলে ওইদিনের মতো ঠোঁটে কামড়ে খুন করে ফেলবো!

– আহা! কথাটা বলে খুব উপকার করলেন বিবি সাহেবা?এমনেই একব্যথায় কিছু খেতে পারছিনা। আপনিও দেন। ধন্য করেন আমায়।
– আমার সাথে ইয়ার্কি করো না বলছি।
– এক কাজ করুন নাহয় আমাকে কেটেকুটে নিলামে তুলে বিক্রি করে দিন।
– চুপ করো পূর্ব।
– বুকের উপর শুয়ে চুমু দেওয়া বন্ধ করো। আমার বুক পুড়ছেনা। আ’ম কুল এন্ড ফাইন।

পূর্ণতা চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পরতেই পূর্ব ডানদিকে হাত বাড়িয়ে টেবিলের উপর হারিকেনের পলতেটা কমিয়ে দেয়। কাথা টেনে পূর্ণতার মাথা পযর্ন্ত ঢেকে দিতেই কপালে ঠোঁট ছুয়িঁয়ে দেয় পূর্ব। শীতল পরিবেশে ওম করা গরমে পূর্ণতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই মনেমনে বলে উঠে,
– ঘুমাও ঘুমাও, কালকের জন্য এখনি ঘুমাও। দেখো না কালকে কি করি!

.

পাখির কিচিরমিচির শব্দে মিষ্টি রোদ্রের স্নিগ্ধ পরিবেশে ঘুম ভাঙলো পূর্ণতার। ঘুমের আড়ম্বর ভেঙে বিছানায় উঠে বসতেই শরীর টানা দিলো। হঠাৎ কি যেনো ভেবে চোখ খুললো, ওমনেই এক গগনস্পর্শী চিৎকার দিয়ে ককিয়ে উঠলো! আশ্চর্য! এটা কি! পূর্ব কই??

– ‘ চলবে ‘

#FABIYAH_MOMO