যে গল্পের নাম ছিলনা পর্ব-৩৫+৩৬

0
486

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা
-Farhina Jannat

৩৫.
বুবুর গল্পঃ
আমি তখন ইন্টার্নি করছি ডিএমসিতে। মাত্র আর এক মাস পরেই পরিপূর্ণ ডাক্তার হয়ে বের হব। মেডিকেলে পড়ার শুরুর দিক থেকেই একটা ছেলে আমাকে খুব ডিস্টার্ব করত। যাওয়া আসার পথে দাঁড়িয়ে থাকা, প্রেম নিবেদন করা এসব যা করে আরকি বখাটে ছেলেরা। আমি কোনদিন পাত্তা দিইনি কিন্তু এ ছেলে হাল ছাড়েনি, এতদিন ধরে লেগেই ছিল। আমরা তখন পুরান ঢাকার এক ভাড়াবাড়িতে থাকতাম। আমরা বলতে আমি, আব্বা-আম্মা আর ভাইয়া-ভাবী। আব্বা রিটায়ার্ড করেছে, ভাইয়ার টাকায় পুরো সংসার চলে। সবাই তাকিয়ে আছে আমি কবে ডাক্তার হয়ে ভাইয়ার বোঝা হালকা করব। কিন্তু আল্লাহ বোধহয় সেটা চাননি, তাঁর ইচ্ছে অন্যরকম ছিল।

এমনিতে তো বাসা কাছে হওয়ায় যাওয়া আসা করেই পড়াশোনা শেষ করেছি। কিন্তু গলিঘুপচির মধ্যে বাসা বলে ইন্টার্নি করার সময় বেশি রাত হয়ে গেলে কখনো ফিরতামনা আমি, হোস্টেলে থেকে যেতাম। কিন্তু সেদিন আম্মু হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে যায়, ভাইয়া আমাকে ফোন করে ওষুধ নিয়ে আসতে বলে আম্মুর জন্য। আমিও নিজের চিন্তা না করে রাত একটার সময় বের হয়ে যাই হাসপাতাল থেকে। রাস্তায় আমার পথ আটকায় ওই ছেলেটা, বরাবরের মত প্রেম নিবেদন করে, আমাকে নাকি বিয়ে করতে চায়।

এমনিতে আম্মুর জন্য টেনশনে মাথার ঠিক নেই, তার মধ্যে এই উটকো ঝামেলা, মাথা ঠিক রাখতে পারিনা আমি। ছেলেটাকে অনেক আজেবাজে কথা বলে অপমান করি। ছেলেটাও রেগে গিয়ে আমাকে তুলে নিয়ে যায় কোন এক গুদামঘরে। সেখানে তিন দিন আটকে রেখেছিল আমাকে। না না, তুই যেটা ভাবছিস তেমন কিছু না, ওর একটাই কথা ছিল, আমাকে বিয়ে করো। কিন্তু আমি ছিলাম প্রচণ্ড জেদি, একবার কোন কিছুতে না বললে কারও সাধ্য ছিলনা আমাকে হ্যাঁ বলাবে। জানিস, একটা কাজীকেও ধরে এনেছিল ও। কিন্তু আমার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়েও আমার মুখ দিয়ে কবুল বলাতে পারেনি। আমার মাথায় ঘুরছিল শুধু, মরে যাবো কিন্তু ওকে বিয়ে করবোনা। কিন্তু আজ মনে হয় বিয়ে করলেই বেঁচে যেতাম! বুবুর চোখ দিয়ে টপ করে এক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল।

শেষমেশ ও হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেয় আর আমাকে বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে আসে। তারপর আমি ওকে আর কোনদিন ওই তল্লাটে দেখিনি।

আমাকে ফিরিয়ে তো দিয়ে গেল, কিন্তু জীবনটা আমার নরক হয়ে গেল। এক বখাটে ছেলে তুলে নিয়ে গিয়ে তিনদিন ধরে আমাকে আটকে রেখেছিল, ব্যবহার করে ফিরিয়ে দিয়ে গেছে, এমন কথা পাড়াময় চাউড় হয়ে গেল। পাড়ায় মুখ দেখানোর উপায় থাকলোনা আমার গোটা পরিবারের। বাড়িতে চরম অশান্তি শুরু হল। ভাইয়া তো মুখের ওপর বলে দিল, এমন অসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার থেকে মরে যাওয়া ভাল। হোস্টেলে চলে গেলাম বাধ্য হয়ে, কিন্তু সেখানেও স্বস্তি ছিলনা। আমাকে দেখলেই কানাঘুষা শুরু হয়ে যেতো, নিজের রুমমেট আর ক্লাসমেটেরা পর্যন্ত এমন ব্যবহার করতে লাগল যেন আমি অচ্ছুত হয়ে গেছি।

মেন্টাল প্রেসারে কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম, ফিরে এলাম বাসায়। তাতে বাসায় টেকা আরো দুঃসহ হয়ে উঠলো। ভাবী রাতদিন আমাকে আর আব্বা আম্মাকে কথা শোনাতে লাগল। মা আমার দিকে মাঝেমাঝে এমন অসহায় দৃষ্টিতে তাকাত, মনে হত ধরণী, তুমি দ্বিধা হও। একদিন ভাইয়া ভাবি মিলে চরম সিনক্রিয়েট করল বাসায়। আমি ঠিক করলাম মরব, মরে গিয়ে সবাইকে শান্তি দিয়ে যাব। কিন্তু মরার আগে একটা ইচ্ছা পূরণ করার সাধ জাগল আমার। কলেজের স্টাডি ট্যুরে কক্সবাজার নিয়ে গেছিল আমাদের ক্লাসকে, চাঁদার টাকা যোগাড় হয়নি বলে আমি যেতে পারিনি। সেই থেকে মনে সমুদ্র দেখার সাধটা থেকে গেছিল। আমি আমার ইন্টার্নির স্যালারি তুললাম। তারপর এক কাপড়ে বাসে চড়ে রওনা দিলাম কক্সবাজার।

সারাদিন সমুদ সৈকতে কাটিয়ে বিকেলবেলা নেমে গেলাম পানিতে। উদ্দেশ্য, সাগরের বুকেই এ জীবন বিসর্জন দিব। কিন্তু আল্লাহ্‌ ফেরেশতারূপে পাঠালেন বাবাকে মানে ভাইটুর বাবাকে। আমি প্রায় হাবুডুবু খেতে শুরু করেছি এমন অবস্থায় উনি আমাকে উঠিয়ে নিয়ে আসেন। বাবা ভেবেছিল আমি ডুবে যাচ্ছিলাম, কিন্তু পরে যখন জানল যে আমি মরতে যাচ্ছিলাম, বাবা আর মা মিলে যা একটা বকা দিয়েছিলোনা, আমি আজও ভুলতে পারিনা। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস দেখ, বাবা অন্যের মেয়েকে আত্মহত্যা থেকে বাঁচিয়েছিল, অথচ আজ তাঁর নিজের ছোট ছেলেই সেই কাজ করেছে।

তারপর? জানতে চাইল সিদ্রা।

তারপর আর কি, বাবা মা আমাকে বুঝাল, তোমাকে আর ফিরতে হবেনা, আমাদের সাথে চলো, নতুন জীবন শুরু করবে। ওঁদের তো কোন মেয়ে ছিলনা, আমাকে মেয়ে করে নিল আর ওরা দুই ভাই তো এত বড় বুবু পেয়ে মহাখুশি। আমিও নরক থেকে বেরিয়ে এমন একটা বেহেস্তের মত জায়গায় আসতে পেরে আল্লাহ্‌র শুকরিয়া আদায় করলাম। আমি তো সাথে করে কিছু নিয়ে আসিনি, বাবা নিজের প্রভাব খাটিয়ে আমার সমস্ত সার্টিফিকেট আর মার্কশিট তুলে আনার ব্যবস্থা করে। অনেক বলেছিল বিসিএস দিয়ে কোন একটা হাসপাতালে জয়েন করতে। কিন্তু যারা আমাকে নতুন জীবন দিয়েছে, আমি তাদের জন্য কিছু করতে চাইলাম। তাই তাদের এ প্রিয় মানুষগুলোর চিকিৎসা করার দায়িত্ব নিয়ে নিলাম সারাজীবনের জন্য। বিসিএস দিয়েছি, অন্যান্য ডাক্তারি ডিগ্রীও নিইয়েছে বাবা আমাকে দিয়ে, কিন্তু হাসপাতালে যোগদান করাতে পারেনি।
ওঁদের মৃত্যুর পরও সেই ঋণ শোধ করে যাচ্ছি, আল্লাহ চাহেতো মৃত্যুর আগ পর্যন্ত করে যাবো। ব্যস, এই ছিল আমার গল্প।

***
সিদ্রা সেই কখন থেকে চোখের পানি ফেলছে, এবার বুবুকে জড়িয়ে ধরে ভেউভেউ করে কাঁদতে লাগল। বুবু তো অবাক, “আরে পাগলী কাঁদছিস কেন?”

বুবু তো আর জানেনা, সিদ্রা বুবুর সাথে সাথে নিজের কথা ভেবে কাঁদছে। বুবুর কাহিনী থেকে ও বুঝে গেছে, যদি, জাস্ট যদি কোনদিন ও মুক্তিও পায়, ওর জীবন কখনওই আর আগের মত হবেনা। বুবুর মতই ভয়ংকর কিছু অপেক্ষা করবে ওর জন্য।

বুবুর বাসা থেকে চলে আসার সময় আরেকটা কথা মনে হল সিদ্রার, “কিন্তু বুবু, তুমি কখনও বিয়ে করনি কেন?”

“বিশ্বাস কর বা না কর, যার জন্য আমার জীবনের এই দুর্গতি, তারই জন্য”

“কি? ওই বখাটে ছেলের জন্য? কি বলছ কি তুমি?”

“হুম, ওর চাওয়ার মধ্যে কোন লালসা ছিলনা রে, শুধুই ভালবাসা ছিল, শুধু ওর পন্থাটা ভুল ছিল। নাহলে ওই তিনটা দিন ও আমাকে বিয়ে করার জন্য জোর না করে নিজের লালসা ঠিকই মিটিয়ে নিতে পারতো, কি পারতো না বল?”

“হুম, সেটা ঠিকই বলেছো, কিন্তু তবুও”

“তবে সেটাই একমাত্র কারণ না, আমি আসলে এই বেহেস্তের মত জায়গা আর আমার ভাইদের ছেড়ে কোথাও যেতে চাইনি”

***
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে রাইয়্যান, ক্যালেন্ডারের দিকে তাকাল ও, আজ সোমবার। সবে জ্বর থেকে উঠেছে তবুও সিদ্রার রোজা রাখার ব্যত্যয় ঘটবেনা জানে ও। ফোন করে সেক্রেটারিকে বলল, “নেক্সট ফ্লাইটে ব্যাক করতে চাই আমি, ব্যবস্থা করো”

মাগরিবের আজানের মাত্র পনেরো মিনিট আগে বাসায় ঢুকল রাইয়্যান। সময় নেই দেখে বড় একটা ফাস্টফুড শপে ঢুকে যা চোখে পড়েছে তুলে নিয়ে চলে এসেছে। খালার হাতে খাবারের ব্যাগগুলো ধরিয়ে জলদি টেবিলে সাজিয়ে সিদ্রাকে ডাকতে বলল।

সিদ্রা ড্রয়িংরুমেই বসে ছিল, ওকে ডাকতে বলছে শুনে বেরিয়ে এল। খালা ওর সামনে দিয়ে মুখে একটা হাসি নিয়ে চলে গেল। সিদ্রা কনফিউজড হয়ে তাকাল রাইয়্যানের দিকে। রাইয়্যানের মুখটা সিদ্রাকে দেখে হাসিহাসি হয়ে গিয়েছিল, সিদ্রা তাকাতেই স্বাভাবিক করে ফেলল।

“ডাইনিং এ চল” গম্ভীর মুখে বলল রাইয়্যান।

কোন কথা না বলে হুকুম তামিল করল সিদ্রা। ডাইনিং এ ঢুকে টেবিলের দিকে তাকিয়ে ওর চোখদুটো বড় বড় হয়ে গেল। অনেকগুলো বার্গার, স্যান্ডউইচ, বিশাল একটা পিজ্জা, কয়েক রকমের পেস্ট্রি কেক আর আরও কিছু নাম না জানা ফাস্টফুড আইটেম, পাশে একটা কোল্ড কফির প্লাস্টিক কাপও দেখা যাচ্ছে।

“এসব কি?” মুখ দিয়ে বের হয়ে গেল সিদ্রার।

“তোর ইফতার আর আমাদের নাস্তা” হাসিমুখে বলল রাইয়্যান। এখন তুই বলতে অনেক খারাপ লাগছে ওর, কিন্তু হঠাৎ করে তুমি বললে সিদ্রা কি না কি মনে করবে তাই আর চেঞ্জ করলনা।

“আপনি কি কোন জিনিস কম কিনতে পারেননা? এতকিছু দিয়ে মানুষ ইফতার করে?”

“কেন? সারাদিন খাসনি, ক্ষুধা লেগেছে তো। আর একা কেন খাবি, আমরাও তো খাবো। শুনেছি, রোজাদারকে বসিয়ে ইফতার করালে অনেক নেকী হয়”

আরও কিছু বলতে মুখ হা করেছিল সিদ্রা কিন্তু আজান দিয়ে দিল। রাইয়্যান তখন ওর হা করা মুখে কি একটা ঢুকিয়ে দিল। ঘটনার আকস্মিকতায় সিদ্রা নড়তেও ভুলে গেল। কি করছে লোকটা এসব? উনার মাথাটাথা খারাপ হয়ে যায়নি তো?

কোনমতে মুখটা বন্ধ করল সিদ্রা। চকলেট কেকের মত টেস্ট, কিন্তু ঠিক কেক না, তবে স্বাদটা ভালই।

“নে, এবার বসে ধীরেসুস্থে ইফতার কমপ্লিট কর” বলে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল রাইয়্যান।

“কিন্তু আমি তো রোজাই রাখিনি আজকে!” মুখেরটুকু গিলে উত্তর দিল সিদ্রা।

আয়েশ করে বার্গারে কামড় বসাতে যাচ্ছিল রাইয়্যান, হাতটা মাঝমথেই থেমে গেল। হায়রে, একদিনে আর কতগুলা টাশকি খেতে হবে আমাকে! জীবনে একদিন মেয়েটার জন্য ইফতারি নিয়ে আসলাম, আর ও রোজাই রাখেনি। একেই বলে কপাল! কোনমতে নিজেকে সামলে নিল ও।

“রোজা নাইবা রাখলি, নাস্তা করতে তো আর অসুবিধা নেই, বসে পড়”

বসল সিদ্রা, “আসলে আমি তো রোজা রাখতেই চেয়েছিলাম, কিন্তু খালা কিছুতেই রাখতে দিলনা” মিনমিন করে বলল সিদ্রা। বুঝতে পারছে, লোকটা অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছে। চুপচাপ একটা স্যান্ডউইচ নিয়ে কামড় বসাল ও।

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা
-Farhina Jannat

৩৬.
পরদিন সন্ধ্যার পর আদেশজারি করল রাইয়্যান, রেডি হতে হবে, ওরা নাকি বাইরে ডিনার করতে যাবে। সিদ্রাও শর্ত দিল, যদি বুবু আর খালা যায়, তাহলেই শুধু ও যাবে, নাহলে না। বেচারা রাইয়্যান, আগে ওকে হুমকি ধামকি দিয়ে কত কিছু করিয়েছে, কিন্তু এখন যেন আর কিছুতেই পারছেনা, বাধ্য হয়ে রাজি হল।

“ঠিক আছে, আমরা রেডি হয়ে বুবুর বাসায় গিয়ে বুবুকে নিয়ে তারপর যাব”

কিন্তু বুবুর বাসায় গিয়ে দেখা গেলো বুবুর মাথা ধরেছে, বাইরে যেতে পারবেনা, ওদের দুজনকে যেতে বলল। কিছুতেই রাজি হলনা সিদ্রা, শেষমেশ চাইনিজ রেস্টুরেন্ট থেকে হোম ডেলিভারি আনার সিদ্ধান্ত হল।

দেড় ঘণ্টা পর ডেলিভারি দিয়ে গেলে সবাই মিলে খেতে বসল ওরা। যথারীতি গল্পগুজবের মধ্য দিয়ে খাওয়া দাওয়া চলছিল। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো যখন বুবু শুনল যে সিদ্রা এখনো রাইয়্যানকে আপনি করে বলছে।

“তুই এই মুহূর্ত থেকে ওকে তুমি করে বলবি, নাহলে তোর সাথে কোন কথা নাই আমার” মুখ ঘুরিয়ে বলল বুবু।

“ছাড়োনা বুবু, আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি, কিছুই মনে হয়না আমার। ডাক দিয়ে কি এসে যায় বলো, ভালবাসাটাই তো আসল” সিদ্রা হা করে তাকিয়ে রইল রাইয়্যানের দিকে। ঠিক শুনছি আমি? উনি বুবুকে সাপোর্ট না করে আমাকে সাপোর্ট করছেন!

“উঁহু, তুই মাঝখানে ঢুকবিনা, এটা আমার আর ওর মধ্যের ব্যাপার। আমি দেখতে চাই আমার কথার কোন গুরুত্ব ওর কাছে আছে কি নেই!”

বুবুর সিরিয়াস কথা শুনে ভয় পেয়ে গেল সিদ্রা, বুবু সত্যি সত্যি রাগ করে ফেললে তো মুশকিল হয়ে যাবে, তার থেকে সামান্য একটা তুমিই তো, কি আর হবে!

“আচ্ছা আচ্ছা, রাগ করোনা বুবু প্লিজ, বলো, কি বলতে হবে?”

“কি বলতে হবে মানে? যা খুশি বল, যেমন ধর, আমি তোমাকে ভালবাসি” চোখ টিপল বুবু।

নিজের অজান্তেই গাল দুটো টকটকে লাল হয়ে গেল সিদ্রার, কেন যে এত লজ্জা পেল নিজেও বুঝতে পারলনা, মাথা নিচু করল ও। হাসল বুবু,
“আচ্ছা বাবা ঠিক আছে, লজ্জা পেতে হবেনা, ওইসব পার্সোনাল সময়েই বলিস, এখন অন্যকিছু বল”

কিছুক্ষণ পর মুখ খুলল সিদ্রা, “আচ্ছা, বলছি” এখনো মুখ নিচু করে আছে, যেন সাহস সঞ্চয় করছে। পিনপতন নিরবতা ঘরের মধ্যে, সবাই অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে কি বলবে ও। অবশেষে মুখ তুলল ও, রাইয়্যানের দিকে তাকিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে উচ্চারণ করলো পৃথিবীর সবথেকে সহজ তিনটা শব্দ।

“তুমি কেমন আছো?”

টেবিল কাঁপিয়ে হেসে উঠল সবাই, অবশ্যই সিদ্রা বাদে, বেচারি লজ্জায় মাথা নিচু করে ফ্রাইড রাইস ভর্তি চামচ মুখে পুরল। রাইয়্যানের তো হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে আসল, অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভাল আছি, খুব ভাল আছি এন্ড স্যরি এভাবে হাসার জন্য”

এরপর সিদ্রা খাওয়াদাওয়ার মাঝে ভয়ে আর কোন কথাই বললনা রাইয়্যানকে উদ্দেশ্য করে।

খাওয়ার পর গল্প চলতে লাগল সোফায় বসে। খানিকক্ষণ পর বুবু জিজ্ঞেস করলো, “খালিমুখে আড্ডা জমেনা, কি খাবি বল? চা না কফি?”

এদের যে কি বাজে অভ্যাস, রাতের বেলা চা কফি খাওয়া। রাতে ঘুমায় কিভাবে কে জানে, মনে মনে বলল সিদ্রা।

“বুবু তুমি ওর হাতের কফি খেয়েছো?” জিজ্ঞেস করলো রাইয়্যান।

মাথা নাড়লো বুবু, “নাতো, জানিইতোনা যে ও কফি বানাতে পারে”

“ইশ! কি মিসটাই না করেছো এতদিন! মিস সিদ্রাতুল মুনতাহা, আপনার হাতের টেস্টি কফি পান করার সৌভাগ্য কি আমাদের হতে পারে?” শেষের কথাটা সিদ্রার দিকে তাকিয়ে নাটুকে ভঙ্গিতে বলল রাইয়্যান। তুমি কান্ডের লজ্জাটা এখনো কাজ করছিল মনের মধ্যে, “আমি এক্ষুনি বানিয়ে আনছি” বলে কোনমতে ওদের সামনে থেকে পালিয়ে বাঁচল সিদ্রা।

সিদ্রা যাবার পর রাইয়্যানের মাথায় একটা চাটি মারল বুবু, “এই গাধা! নিজের মিসেসকে মিস বানিয়ে দিচ্ছিস?!”

“উপস! ভুল হয়ে গেছে” জিভে কামড় দিল রাইয়্যান। তবে ওর মুখটা একটু বিষণ্ণ হয়ে উঠল বলে মনে হল বুবুর।

“কিরে, ফুটো বেলুনের মত চুপসে গেলি কেন হঠাৎ?”

“উঁ! কি, কই নাতো? আচ্ছ কফি আসতে আসতে আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসি”

কেমন যেন মনে হল পালিয়ে গেল, কিছু কি হয়েছে ওদের মধ্যে? হুম্ম, মাঠে নামার সময় এসে গেছে, মনে মনে বলল বুবু।

***
কফি বানাতে বানাতে ভাবছে সিদ্রা, এহ! কত ঢঙ! সৌভাগ্য হতে পারে! বাসায় তো ডিরেক্ট হুকুম, কফি বানা। আর এখন বুবুর সামনে কি আহ্লাদ! কিন্তু স্বীকার তো করেছে যে আমার বানানো কফি টেস্টি, মুখ টিপে হাসল সিদ্রা।

কিন্তু লোকটা হঠাৎ এত অদ্ভুত ব্যবহার করছে কেন? আমাকে তো উনি এখানে বন্দী বানিয়ে রেখেছেন, তাহলে আজকে বাইরে খেতে যাওয়ার কথা কেন বললেন? আমি তো পালিয়েও যেতে পারতাম! নাকি উনি বুঝে গেছেন যে আমি পালাবনা? আর নাকি এটা উনার নতুন কোন প্ল্যান? অনেকদিন নতুন কিছু করেনি লোকটা। ধুর! এই লোকটা না একদম আনপ্রেডিক্টেবল, কখন যে কি করে!

এদিকে আবার বুবুর নতুন শর্ত! এদের ভাইবোনের অত্যাচারে আমি পাগল না হয়ে যাই! যাকগে, এমন কিছু একটা বলতে হবে যাতে বুবু কনভিন্স হয়ে যায়, আর সন্দেহ না করে। নাহলে বাংলোয় ফিরে কি রুদ্রমূর্তি যে দেখতে হবে আল্লাহই জানে। মনে মনে কয়েকবার আউড়ে প্রস্তুত হয়ে নিল সিদ্রা।

হাসিমুখে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এল ও, ট্রে থেকে একে একে সবার হাতে মগ ধরিয়ে দিল। রাইয়্যানকে দেয়ার সময় বলল, “এই নাও, এটা তোমার”

রাইয়্যান এতটাই চমকে গেল যে, আরেকটু হলে কফির মগ মিস করে ফেলছিল। ভাগ্যিস সিদ্রা ওর রিএকশন খেয়াল করে মগটা ছাড়েনি। কোনমতে মগটা নিয়ে বলল, “থ্যাংকস”

সিদ্রা নিজের মগ নিয়ে বুবুর পাশে গিয়ে বসল আর মনে মনে বলল, এখন কেমন লাগে মিস্টার! অপ্রস্তুত শুধু আপনি না, আমিও করতে পারি!

বুবুর চোখে খুশি ঝিলিক দিয়ে উঠল, “এবার একদম ঠিক আছে” সিদ্রার দিকে তাকিয়ে বলল বুবু।

আর রাইয়্যান, কফিতে চুমুক দিতে দিতে ভাবছিল, সামান্য কয়টা শব্দও যে কানে এতটা মধু বর্ষণ করতে পারে, আগে তো জানা ছিলনা!

“তোদের হানিমুনের কোন প্ল্যান নেই?” একসময় বলে উঠল বুবু।

সিদ্রা আর রাইয়্যান দুজনেই একসাথে বিষম খেলো, ভ্রু কুঁচকাল বুবু।

“বিয়ের পর হানিমুনে যাওয়া তো নরমাল ব্যাপার। এমন রিএকশন কেন তোদের?”

“কিসের রিএকশন! দুজন মানুষ একসাথে বিষম খেতে পারেনা?” সামলে নিয়ে বলল রাইয়্যান।

“আচ্ছা! তাহলে উত্তর দে আমার কথার। বিয়ের এতদিন হয়ে গেল, হানিমুনে যাচ্ছিসনা কেন?” চোখ গরম করে বলল বুবু।

সিদ্রার বুকে হাতুড়িপেটা শুরু হয়ে গেল, এই লোকের সাথে আমি একা রেস্টুরেন্ট এ গেলামনা, আর বুবু কি বলছে এসব!

“যাবো তো ভেবেইছিলাম, কিন্তু ব্যস্ততা কমছেইনা, একটার পর একটা ঝামেলা সামাল দিতে হচ্ছে, হানিমুন প্ল্যান করার ফুরসৎই পাচ্ছিনা। এখানে আসলেও সারাদিন কাজ নিয়ে থাকি, এর জন্য তো ওর অভিযোগের শেষ নেই” সিদ্রার দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করলো রাইয়্যান।

“হ্যাঁ বুবু, সারাদিন মোবাইল আর ল্যাপটপ নিয়ে পড়ে থাকে, আসলেই অনেক ব্যস্ততা যাচ্ছে” ইশারা বুঝে তাল মেলাল সিদ্রা।

“ব্যস্ততা তো থাকবেই, কিন্তু এ দিনগুলো কি আর ফিরে পাবি তোরা! হানিমুনে কোথায় যাবি সেটা তোদের ব্যাপার, কিন্তু এ সপ্তাহের মধ্যেই যেতে হবে। এর নড়চড় হলে না, বুবুর রাগ কি জিনিস হাড়েহাড়ে টের পাবি! হাতে পায়ে ধরেও কোন কাজ হবেনা।”

***
পরদিন রাতে খাওয়া দাওয়ার পর রাইয়্যানের জন্য কফি বানাতে সিদ্রা রান্নাঘরে ঢুকলে পেছন পেছন রাইয়্যানও ঢুকলো।

“একি, আপনি এখানে কেন?”

“উম্ম, আমি হেল্প করতে এলাম”

সিদ্রার মনে হল ও ভুল শুনেছে, “কি বললেন আপনি?”

“কিছুনা, আমারও কফি বানাতে ইচ্ছে করছে” কফি মেকারে পানি ভরল রাইয়্যান।

“তাহলে আমি যাই?” কফি ফেটান বন্ধ করে বলল সিদ্রা।

“না না, আমি তোরটাই খাব”

“তাহলে আপনারটা কি হবে?”

“তুই খাবি” সিদ্রার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল রাইয়্যান। হতভম্ব হয়ে গেল সিদ্রা, স্বপ্ন দেখছি নাকি আমি? হাতে জোরে চিমটি কেটে উহ! করে উঠল।

“কি হল? গরম পানি ফেলে দিয়েছিস? সাবধানে কাজ করবি তো!” সিদ্রা কিছু বলে ওঠার আগেই ওর হাতদুটো ধরে সিংকে নিয়ে পানি ছেড়ে দিল রাইয়্যান।

“আমার হাত পুড়েনি, পানিই তো এখনো ফুটেনি” বলল সিদ্রা।

অপ্রস্তুত হয়ে গেল রাইয়্যান, “ইয়ে মানে, তাহলে উহ করলি যে?”

“ওইটা…… এমনি” চোখ নামাল ও।

“ও” রাইয়্যান বেচারাও এত লজ্জা পেয়েছে, আর কথা বাড়ালনা। এরপর আর কোন কথা না বলে দুজনে কফি বানিয়ে মগ এক্সচেঞ্জ করল। রাইয়্যান বলল, “চল, বাগানে যাই”

“এ্যাঁ?” লোকটার মাথায় কোন প্রব্লেম হয়ে যায়নি তো? হঠাৎ একটু বেশিই অদ্ভুত আচরণ করে ফেলছেনা? ভাবলো সিদ্রা।

“কি? কোন সমস্যা আছে?” চোখ নাচাল রাইয়্যান।

“না মানে, এত রাত হয়ে গেছে তো” মাথার মধ্যে নানান চিন্তার ঘুরপাক শুরু হয়ে গেল সিদ্রার।

“আমার বেলায় রাত হয়ে গেছে, খালার সাথে তো খুব রাত বিরাতে বাগানে বসে বসে গপ্প মারিস”

খালা আর আপনি এক হলেন নাকি, মনে মনে বলল সিদ্রা, কিন্তু মুখে বলল, “আচ্ছা চলেন” আগের সেই অস্বস্তিকর ভয়টা আর পাচ্ছেনা সিদ্রা, জ্বরের সময়কার ঘটনা লোকটার প্রতি ওর মনোভাব চেঞ্জ করতে বাধ্য করেছে, লোকটা আর যাই হোক, চরিত্রহীন না। কিন্তু এর আগে লোকটা ভালো ব্যবহার করার পরপরই একটা করে ভয়ংকর কিছু করেছে। তাই প্রচন্ড টেনশন কাজ করছে ওর মধ্যে।

চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে বাগান, ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। একেবারে মন ভালো করে দেয়া পরিবেশ। বেতের চেয়ারগুলোতে এসে বসল ওরা। রাইয়্যানের মন তো আজকাল একটু বেশিই ফুরফুরে থাকে। কিন্তু এই সুন্দর পরিবেশ সিদ্রার মনে কোন প্রভাব ফেলছেনা। অস্বস্তিকর নিরবতা বিরাজ করছে দুজনের মধ্যে। তাড়াহুড়ো করে কফিতে চুমুক দিয়ে জিভ পুড়িয়ে ফেলল সিদ্রা।

“আগামীকাল সকাল সাতটায় রেডি হয়ে থাকবি” কফিতে চুমুক দিল রাইয়্যান।

“কেন?”

“আমরা ঘুরতে যাব”

বিষম খেল সিদ্রা, “ঘুরতে যাব? কে কে?”

“তুই আর আমি”

“অসম্ভব! আমি আপনার সাথে কোথাও যাবনা”

“কেন? আমি বাঘ না ভাল্লুক?”

“সে আপনি যা ইচ্ছে মনে করেন, আমি যাবনা”

“ভুলে গেছিস বুবু কালকে কি বলেছে! বেশ কিছুদিন হল এসব শুরু করেছে বুবু, পুরো পিছে পড়ে আছে আমার। আমি নাকি তোকে ভাগিয়ে এনে এখন কষ্ট দিচ্ছি। কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাচ্ছিনা, সারাদিনরাত ঘরে আটকে রাখছি ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন যদি আমরা কাছেপিঠে কোথাও ঘুরতে যাই, অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও হানিমুনের ভুত বুবুর মাথা থেকে নামানো যাবে”

হুম, লোকটা খারাপ বলেনি, ভাবল সিদ্রা। হানিমুনে যাওয়ার থেকে দিনেদিনে ঘুরে আসা ঢের নিরাপদ। কিন্তু সেই উনার সাথে একা যেতে হবে! গলা শুকিয়ে এল ওর। কিন্তু লোকটা হুকুমজারী না করে এতো নরম সুরে কথা কেন বলছে? আবার কফি বানিয়ে খাইয়ে পটাচ্ছে। এত কাহিনী না করে একবার শুধু মুনিরার ক্ষতি করার ভয় দেখালেই তো রাজি হয়ে যেতাম।
আচ্ছা, কালকে রেস্টুরেন্টে যাইনি, তার বদলে এটা করছেনা তো? দূরে কোথাও নিয়ে গিয়ে মেরে টেরে ফেলবে নাকি আমাকে? ফেললে ফেলল, এখনই বা কি এমন বেঁচে আছি! হানিমুনে যাওয়া থেকে বাঁচতে যদি লাইফ রিস্ক নিতে হয় তাও ভাল।

“এতো কি ভাবছিস?” ভ্রু নাচাল রাইয়্যান।

“আচ্ছা ঠিক আছে, যাবো আমি”

চাঁদের আলোটা যেন একটু বেশি উজ্জ্বল হয়ে গেল, বাতাসে যেন নতুন সুবাস ভেসে আসতে লাগল, আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল রাইয়্যান। চাঁদকে পেছন করে বসে থাকার জন্য রাইয়্যানের মুখে ফুটে ওঠা বিজয়ের চওড়া হাসিটা দেখতে পেলনা সিদ্রা।

চলবে।