সঞ্চারিণী পর্ব-১৯

0
559

সঞ্চারিণী
আফনান লারা

১৯.
-‘আমি আগে থেকেই বলে রাখি,আজ ক্লাবে আমি যাচ্ছিনা।ক্লাবে যাওয়া মানে রাত ১২টার পর ফেরা।আর আমি যদি ১২টার পর ফিরি, বাবা মা আমাকে সাথে করে কাল পটুয়াখালী নিয়ে যাবে।
তাছাড়া ওরকম পরিবেশে আমার যাওয়ার শখ বিন্দুমাত্র ও নেই’

শাওন মেধার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হোসে বললো,’কে রে এটা?কে চয়েজ করে এনেছে এরে??উনি কি আসলেই অফিসার নাকি একজন স্কুলে পড়ুয়া স্টুডেন্ট?যার এখনও ইন্টারে পড়া বাকি?আব্বুর ভয় কাজ করে আজও’

মেধা কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,’কি বুঝাতে চাইছেন আপনি?আমি কি ভুল কিছু বললাম?’

-“অবশ্যই।শুধু রাত বারোটা কেন?রাত ১/২টা অবধি তোমাকে ক্লাবে উপস্থিত থাকতে হবে।গিয়াস স্যার যদি মানাও করে তাও আমি তোমায় সাথে করে নিবোই নিবো।চাকরিতে জয়েন করেছে দুদিন ও হলোনা,উনি ফাঁকি দেওয়া শুরু করে দিছেন।তা হচ্ছেনা’

মেধার মনে পড়লো বাবার কাছে শ্যাওলার নাম নিলে হয়ত মানাতে পারবে তাকে।তাই সে আর কথা বাড়ালোনা।

নুহাশ কাঁচের টুকরো সব ল্যাবে পাঠিয়ে দিয়েছে ফিঙ্গারপ্রিন্ট সার্চের জন্য।
রেদোয়ানের খাটের বক্স থেকে কিছু কাগজপত্র বেরিয়ে এসেছে শুনে শাওন আপাতত সেখানে এসে হাজির।কাগজগুলো বিভিন্ন জায়গার জমির দলিল।রেদোয়ানের এত টাকা পয়সা ছিল আর সে মিডিয়ার সামনে শো অফ করতো এত কম?মানুষ টাকা অধিক থাকলে শো অফ বেশি করে আর রেদোয়ান দেখি তার উল্টো ভাবনার মানুষ।সে ইনকাম ট্যাক্সের ভয়ে এত এত টাকার কথা কিনা লুকিয়ে রাখলো।
প্রায় শো অফ করা সম্পত্তির দিগুণ সম্পত্তির মালিক ছিল সে।জেনেশুনে গরীব ঘরের মেয়েকে বিয়ে কেনোই বা করলো?আর তাকে টর্চারই বা কেন করত?তার কি পরকিয়া ছিল?আশার বাবার মতে রেদোয়ানের চরিত্র প্রকাশ্যে বিদঘুটে ছিল।রেদোয়ানকে চরিত্রহীন এওয়ার্ড দিয়ে গেলেন তিনি। তার মানে নিশ্চয় এমন ঘটনা ঘটেছে।তবে কার সাথে ঘটেছে?সেই নারীকে কই পাওয়া যাবে?’

-“পাওয়া গেছে’

রায়হানের কথা শুনে শাওন ঘাঁড় ঘুরিয়ে তাকালো।রায়হান বললো,’তার নাম এ্যামিলি।বাড়ি মালদ্বীপ।তবে স্থায়ী বাসিন্দা না।তাকে একবার একদেশে দেখা যায়।
বড়লোকের গার্লফ্রেন্ড হলে যা হয় আর কি!’

-‘নাইস!তা সেই এ্যামিলি এখন কোন রাষ্ট্রে বসবাসরত? ‘

-“তার টাকা দেওয়া বিবাহিত বয়ফ্রেন্ড মরে গেছে বলে সে এখন বাংলাদেশেই আছে।তবে পলাতক’

-‘পলাতক?তাহলে তো সন্দেহের তীর তার দিকে ছুঁড়তে হচ্ছে।নুহাশ আর নিতুকে পাঠাও ঐ পলাতক এ্যামিলিকে খুঁজতে।আমি বরং ক্লাবের ফুটেজ দেখে আসি।আর হ্যাঁ,
মিস অতিরিক্তকে বলো এবার একটু কাজ টাজ করে দেখাতে।একদিন শুট করে কি দশদিন ধরে তার প্রশংসা শুনে যাবে?বলো রেদোয়ানের গেস্ট রুম সার্চ করতে যেতে।টিম আকারে ভাগ হয়ে যাও।মেধার সঙ্গে মিলনকে পাঠাও’

-“স্যার আমি যাবো?’

-“না সাজিদ।তুমি আমার সঙ্গে চলো’
—-
মেধা আর মিলন রেদোয়ানের গেস্ট রুমে এসে হাজির।কত বড়লোক হলে আলাদা গেস্ট হাউজ বাহিরে একটা রেখে আবার বাসার ভেতরে গেস্ট রুমও রাখে।বাসার নিচ তলাতেই গেস্ট রুমটা।একেবারে পেছনের সাইডে বলে এতদিন কেউ এটা পরোক করে দেখতে আসেনি।তবে ওয়াশরুমের মিররে লেগে থাকা শুকনো সাবানের ফ্যানা বলে দেয় এটা ব্যবহার হয়েছে বেশিদিন হয়নি।

-‘মিলন তুমি বিছানা ওলটপালট করে দেখো।আমি আলমারি দেখছি আপাতত ‘

মিলন চশমা ঠিক করে বিছানার চাদরটা উল্টে দেখলো কিছু নেই।তারপর এক এক করে দুটো তোষক সরিয়ে ফেললো।বিছানাতে কিছুই নেই।মেধা আলমারি খুলে পুরোনো তোয়ালে ছাড়া কিছুই পেলোনা।মিলন বিছানার নিচ থেকে একটা লিপস্টিক খুঁজে পেলো সবার শেষে।
মেধা ওর হাত থেকে লিপস্টিকটা নিয়ে দেখে চোখ বড় করে বললো,’এটা তো Couture Beauty Diamond Lipstick।রেপ্লিকা না তো?’

-“রেপ্লিকা কেন হবে?এরকম হা করছো কেন?লিপস্টিক দেখলে মেয়েদের মাথার ঠিক থাকেনা আজ প্রমাণিত ‘

-“আরে কথা সেটা না মিলন।এই লিপস্টিকের দাম জানো তুমি?১৪মিলিয়ন!!!!
তার মানে কোটি টাকার উপরে।রেদোয়ান এত বড়লোক?
মাই গড!!এত দামি লিপস্টিক কিনা খাটের তলায় রেখে মরছে!’

-‘আশা লিপস্টিক ইউজ করত না।তার কোনো ছবিতেই আমরা লিপস্টিক দেখিনি।এমন কি যেদিন সে মারা গেছে সেদিনও তার ঠোঁটে লিপস্টিক ছিলনা’

-‘তাহলে এটা কার?’

-‘ল্যাবে পাঠিয়ে দিতে হবে।টেস্ট করলেই বোঝা যাবে এটা কার।আপাতত এটার কয়েকটা ছবি তুলি।১৪মিলিয়নের লিপস্টিকের পিক তুলে আপলোড করলে অন্তত ১৪হাজার লাইক তো পেয়েই যাবো’

মেধা লিপস্টিকটা মিলনের হাতে দিয়ে পুরো রুমটা আবারও ঘুরে দেখা শুরু করলো।এই রুমে লিপস্টিক বাদ দিয়ে আর কিছুই পেলোনা যেটা কিনা সন্দেহের আওতায় আনা যায়।শুধু ঐ ফ্যানা বাদে।
.
ফুটেজে রেদোয়ানকে দশ বিশটা মেয়ের মাঝে দেখা গেলেও সিওর হওয়া গেলোনা ঠিক কোনটা এ্যামিলি।কারণ সে একবার একটা মেয়ের সঙ্গে কথা বলছিল।শাওন ফুটেজ অফ করে রুম থেকে বের হতে গিয়ে মেধার সঙ্গে আবারও ধাক্কা খেয়ে গেলো।কপাল মুছতে মুছতে বললো,’আমাকে ধাক্কা দেওয়াতে মাস্টার্স পাশ করেছো?’

-“নাহ।স্নাতক সম্মান’

-“চুপ!কি জন্যে এখানে এসেছো?’

-“এই লিপস্টিকটা দেখাতে।ল্যাবে চলে যাবে তার আগে মিলন বললো আপনাকে দেখাতে’

-‘এটা সেই লিপস্টিক না যেটার দাম ১৩/১৪মিলিয়ন হবে?’

“-ওয়াও!আপনি জানেন কি করে?’

-‘তৃনা আপু আমাকে এই লিপস্টিকটা দেখিয়ে বলেছিলো কিনে দিতে।।’

মেধা ব্রু কুঁচকে বললো,’ঘুষ খান?’

-“আমার বামহাতটা দেখেছো?এটা দিয়ে চড় মারলে দাঁতের জায়গা নড়ে উঠে আসামিদের।তোমাকে এখন এই হাত দিয়ে চড় মেরে দেবো।
আমি ঘুষ খাবো কোন দুঃখে?বড় আপুরা ছোট ভাইদের সাথে এমন মজা করতেই পারে।নিজের বউ ও মাঝে মাঝে এসে বলে আকাশের চাঁদ এনে দিতে।সেটা তো সম্ভব হয়না।তারা বলতে পারে।কিন্তু আমরা যে কিনে দিব তা তো সচরাচর হয়না।১৪মিলিয়ন আমার ১৪ বছরের ইনকাম ও না।’

-‘তার মানে আপনার ১৫বছরের ইনকাম?’

-“তুমি যাও এখান থেকে।না এক মিনিট!তোমাকে সাথে নিয়ে ক্লাবে যাবো।অতিরিক্ত কথা বলতে তুমি শীর্ষে।তোমাকে নিয়ে গেলে লাভ হবে এই প্রথমবার’

-‘স্যার আপনি সিনিয়র বলে যাচ্ছেতাই বলতে পারেননা।গিয়াস স্যারের কাছে নালিশ করবো’

-‘করো।স্যার সোজা আমার কাছেই পাঠাবেন।’

মেধা বাধ্য হয়েই যাবে বলে কথা দিয়ে এখন মুখটা হাঁড়ি করে রেদোয়ানের পুরো বাড়িতে চক্কর দিচ্ছে।এত বড় লিপস্টিক নাকি এ্যামিলির জন্য কিনেছিলো রেদোয়ান।
-‘উক্তিটা শাওন স্যারের।হয়ত গিফট আর নয়ত গিফট দিয়ে ফেলেছে আর সে এই রুমেই ছিলো।তড়িগড়িতে লিপস্টিক নেওয়ার কথা ভুলে গেছে।
মানুষ গিফট হিসেবে গাড়ী দেয়,ডায়মন্ড দেয়,বাড়ি দেয়।আর রেদোয়ান কিনা কোটি টাকার লিপস্টিক কিনে দিলো।তার গার্লফ্রেন্ড মনে হয় লিপস্টিককে ডায়মন্ডের চেয়েও বেশি পছন্দ করতো।আইডিয়া!!!
ফুটেজে যে মেয়ের ঠোঁটে লিপস্টিক থাকবে সে হলো এ্যামিলি।পেয়েছি স্যার!’

শাওন ব্রু কুঁচকে কফিতে চুমুক দিলো।মেধার উল্লাসে কোনো পাত্তাই সে দিলো না।মেধা সামনে ঘুরে এসে বললো,’কি হলো স্যার?বুদ্ধিটা ভালো লাগেনি?’

-“তুমি নিজের চোখে ফুটেজ দেখে আসো তারপর নাচানাচি করিও”

মেধা এক রাশ আগ্রহ নিয়ে ফুটেজ দেখতে গেলো।রেদোয়ানের সঙ্গে যত মেয়ে ছিল সবগুলোর ঠোঁটে লাল টকটকে লিপস্টিক। আশ্চর্য!!
স্যার আমার মনে হয় রেদোয়ান ঐ একটা লিপস্টিক নিয়েছে তারপর ওগুলো ভাগ করে সবাইকে দেবে বলে ঠিক করেছে।ধরুন একজনে যদি এক চিমটি লিপস্টিক নেয় তার ভাগে লক্ষ লক্ষ টাকা পড়লো’

শাওন মেধার ভাঙ্গা হাতটা টেনে ধরে সামনে এনে বললো’তুমি বোকা না,অবুঝ ও না,পারফেক্ট ট্রেইন্ড্ একজন অফিসার।সকাল থেকে বোকা সেজে কি বুঝাতে চাও?আমি কালকের ঘটনা ভুলে যাবো?’

মেধা হাত টান দিয়ে ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,’বুদ্ধি গুলো কাজে লাগান।আপনার কাজে দেবে’

-‘রেদোয়ান ছেঁসড়া না।ও চাইলে পাঁচ ছটা গার্লফ্রেন্ডকে কোটি টাকার লিপস্টিক আলাদাভাবেই গিফট করতে পারতো’

-“রাইট শাওন স্যার!!লিপস্টিক আরেকটা পেলাম।’

মিলনের কথা শুনে মেধা চোখ কপালে তুলে বললো,’আমি সিওর এই বাড়ি মাটি থেকে উপড়ে তুললে স্বর্নের খনি পাওয়া যাবে।আমার কথা তোমরা সবাই মিলিয়ে নিও’

শাওন মিলনের হাত থেকে লিপ্সটিকটা নিয়ে বললো,’আর পাবোনা।এটাই লাস্ট লিপ্সটিক। এমনিতেও এইই দুটো কিনে ফকির হয়ে গেছে রেদোয়ান।ঐ এ্যামিলিকে আজকের মধ্যে খুঁজে পেতে হবে।২০% ক্লু তার থেকেই পাবো’

-“স্যার আমার মনে হয় ও খুনি।নাহলে পালাতো না’

-‘আরে না।সে কেন রেদোয়ানকে মারবে??রেদোয়ান তো আত্নহত্যা করেছে।তাই না মিস মেধা?’

মেধা লিপস্টিকটা রেখে চোরের মতন হেঁটে চলে গেলো।মিলন হাত ভাঁজ করে বললো,’স্যার ঐ মেয়েটার কথা কানে নিবেননা।না জেনেই বলেছে আত্নহত্যা।
এটা আত্নহত্যা কেস হতেই পারেনা।ইম্পসিবল ‘

-‘হুম তা তো শেষেই বোঝা যাবে’
চলবে♥
Afnan Lara