সঞ্চারিণী
আফনান লারা
২৭.
সামনের মানুষটাকে দেখে মেধার মুখের কথাই হাওয়া হয়ে গেছে।চুপ করে তাকিয়ে দেখছে শুধু।
সেই মানুষটা আর কেউ না,সে হলো শাওন।চেয়ার একটা টেনে হিঁচড়ে মেধার সামনে রেখে তাতে বসলো সে।মেধা ঠিক হয়ে বসে এদিক ওদিক তাকিয়ে ভয়ার্ত চোখে চেয়ে বললো,’বাকিরা কোথায়?আর আমি এখানে কেন?’
শাওন শান্ত হয়ে মেধার কথা শুনছে।মেধা আবারও বললো তাকে কেন এভাবে এখানে ফেলে রাখা হয়েছে।তার হাতের ব্যাথা গাঢ় এখনও।তাকে হসপিটালে হওয়া উচিত এই মূহুর্তে।
শাওন আর সহ্য করতে না পেরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,’রেদোয়ানকে কেন মেরেছো?’
মেধা উঠার চেষ্টা করতে করতে বললো,’আশ্চর্য! আমি কেন রেদোয়ানকে মারতে যাবো?অহেতুক কথা কেন বলছেন?বাকিরা কোথায়?আর আমাকে এভাবে বদ্ধ ঘরে নিয়ে আসার কারণ কি?আমরা এখন কোথায়?’
-‘মালদ্বীপ। ‘
মেধা উঠে দাঁড়িয়ে গুলি লাগা হাত চেপে ধরে বলো,’আমি এখানে থাকতে চাইনা’
কথাটা বলে সোজা হেঁটে দরজার কাছে এসে দেখলো ভেতর থেকে লক।আলতো করে নিশ্বাস ফেলে পেছনে তাকিয়ে বললো,’দরজা খুলুন’
-“আমি না চাইলে এই দরজা খুলবেনা।আর আমি আজকে চাইবোনা’
মেধা রেগে এগিয়ে এসে শাওনের হাত থেকে চাবিটা কেড়ে নিতে চাইতেই শাওন ওর রক্তমাখা হাতটা টেনে ওকে নিচে ফ্লোরের উপর বসিয়ে দিলো ধপ করে।মেধা একটা চিৎকার করে থেমে গেছে শাওনের লাল টুকুটকে চোখদুটো দেখে।
গলা শুকিয়ে আসছে তার।শাওন হাত ছাড়লোনা।ধরে রাখা অবস্থায় বললো,’আশার সাথে তোমার কি সম্পর্ক?আশাকে মারার কথা শুনে তখন ওরকম বিহেভ করেছিলে কেন?’
-‘আপনি অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ছেন।একজন অফিসারকে আপনি আন্দাজে মার্ডারার নাম দিতে পারেননা।আমি রেদোয়ানকে মারিনি।কেনোই বা মারবো?’
শাওন হাতটা চেপে ধরে ওকে কাছে টেনে এনে কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,’যদি তাই হয় তাহলে রকি তোমাকে বাঁচানোর চেষ্টা কেন করে?কেন তোমাকে রেখে সবসময় আমাদের উপর হামলা করে্একজন অফিসার হিসেবে এক পলকে এই টুকু বোঝার ক্ষমতা রাখি মিস মেধা’
মেধা চোখ বন্ধ করে রেখেছে।শাওনের মনে হলো তার হাতের তালু ভিজে আসছে আস্তে আস্তে।
সঙ্গে সঙ্গে মেধার হাত ছেড়ে দিলো সে।মেধার হাতের ক্ষতটা থেকে রক্ত বের হচ্ছে।শাওন চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজার লক খুলতে গিয়ে এখন নিজেই পারলোনা।মেধা হাত ধরে কাতরাচ্ছে। এরকম জঘন্য আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা তার নেই।মনে হচ্ছে বুলেটে বিষ মাখানো ছিল।অসহ্যকর যন্ত্রনা তাকে মেরে ফেলছে।সইতে না পেরে চিৎকার করে কাঁদছে সে।
শাওন ফোন বের করে রুম সার্ভিসের লোকদের ফোন করে নিচে বসে মেধার হাত থেকে রক্ত মাখা ব্যান্ডেজটা খুলে ফেললো।রুম সার্ভিসের লোকদের আসতে দেরি হচ্ছে এদিকে রক্ত আটকে রাখা যাচ্ছেনা।শাওন বাধ্য হয়ে নিজের কোট খুলে ফেলে ভেতরের শার্টটা খুলে সেটা দিয়ে চেপে মেধার হাতটাকে আঁটসাঁট করে বেঁধে রক্ত পড়া থামালো।রুম সার্ভিসের লোকেরা আরও দেরিতে এসেছে।দরজা খুলতে আধ ঘন্টা লাগলো তাদের।
মেধা নিচে বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছে।শাওন নুহাশ আর সাজিদের থেকে খবর পেলো মালদ্বীপে রকিকে কোথাও পাওয়া যায়নি।কিছু সময়ের ব্যবধানে তারা মালদ্বীপ ছেড়ে পালিয়েছে।এ্যামিলি আরও কিছু জানতো যার কারণে সে মুখ খোলার আগেই মেরে ফেললো ওকে।শাওন ওদের কাউকেই বললোনা মেধাকে সে এখানে আটকে রেখেছে। সে বললো এই জায়গায় মেধাকে নিয়ে আছে হয়ত রকিকে অথবা তার দলের কাউকে পেতে পারে।আপাতত ওদের বললো এয়ারপোর্টের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ চেক করে ইনফরমেশন বের করতে তারা ঠিক কোন ফ্লাইটে গেছে।
রাত দশটা পনেরো মিনিটে মেধা যখন চোখ খুললো আবারও আগের জায়গায় পেলো নিজেকে।এবারও শাওন ওর সামনে বসে আছে যেন এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিল ওর চোখ খোলার।
মেধা একটু পিছিয়ে নিজের হাতে শাওনের শার্টটা দেখে বললো,’এত দরদ কিসের?নিজের শার্ট দিয়ে আমার হাত বেঁধেছেন কেন?
-‘তুমি সত্যিটা বলবেনা?’
-‘আমি সত্যিটাই বলেছি।রেদোয়ানকে আমি মারিনি।আপনি ভাবুন।আমি কেন রেদোয়ানকে মারবো?’
কথাটা বলতে বলতে মেধা হাত থেকে শাওনের শার্টটা খুলে ফেলা শুরু করে দিয়েছে।শাওন উঠে দাঁড়িয়ে দরজা খুলে দিয়ে একজন ডাক্তার নিয়ে আসলো।ডাক্তার বাহিরে অপেক্ষা করছিল।শাওন ডাকলে তারপর আসতেন
ডাক্তার মেধার পাশে চেয়ারে বসে ব্যাগ থেকে ইনজেকশান বের করলেন দেওয়ার জন্য।মেধা পিছিয়ে যেতে যেতে বললো,’এটা কিসের ইনজেকশান?খবরদার আমার গায়ে হাত দিবেন না বলছি।’
শাওন ডাক্তারকে ইংরেজীতে বললো হাতে ভালো করে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিতে।রক্তক্ষরণ বন্ধ হচ্ছেনা।’
ডাক্তার ইনজেকশান রেডি করছিলেন।রেডি করা শেষে বললেন মেধার হাতে ইনফেকশান হয়ে গেছে।ড্রেসিং করতে হবে।
শাওন জিজ্ঞেস করলো,’ ইনজেকশান কখন দিবে’
ডাক্তার বললেন,’যদি দেওয়ার আগে ড্রেসিং করে তো ব্যাথাটা নিজের চোখে দেখবে মেধা।আর যদি এখন দেয় তো ব্যাথাটা অনুভব হবেনা’
শাওন মুচকি হেসে ডাক্তারকে থামতে বলে মেধার কাছে বসলো ফ্লোরের উপর তারপর ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো,’বলো রেদোয়ানকে কেন মেরেছো নাহলে আমি বলবো ড্রেসিং করার পরে ইনজেকশান দিতে’
মেধার চোখে পানি।সে বিরক্ত শাওনের এমন অহেতুকীতে।একটা কথাও সে বললোনা।মেধার ত্যাড়ামি দেখে শাওনের প্রচণ্ড রাগ হলো।নিজেকে শক্ত করে নিয়ে ডাক্তারকে ইশারা করে রুম থেকে চলে গেলো সে।
ডাক্তার ড্রেসিং করার বন্দোবস্ত করছেন।
মেধা হাতে ব্যাথা পেয়ে বারবার চিৎকার করেছে তাও শাওনের প্রশ্নের জবাবে কিছু বলেনি সে।
শাওন বাহিরে থেকে ওর চিৎকার শুনছিল।
পাঁচ দশ মিনিট ধরে এভাবে ওকে কষ্ট পেতে দেখে তার খারাপ লাগলো।তাই ভেতরে এসে ডাক্তারকে বললো ইনজেকশান দিয়ে দিতে।মেধা তখন দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে চোখের পানি মুছছিল।শাওনের কথায় ডাক্তার ইঞ্জেকশানটা দিয়ে দিলেন।
সেই রাতে মেধা ঘুমের ঘোর থেকে বের হতে পারেনি।পরেরদিন ভোরবেলায় তার চোখজোড়া খুললো।নিজেকে এবার ফ্লোরে নয় বরং বিছানায় পেলো সে।হাতের ব্যাথাটা কড়া হয়ে আছে।মনে হয় যেন হাতের উপর বিশাল বড় পাথর।যার তলায় হাত চাপা পড়ে গেছে।তাও কষ্ট করে উঠলো সে।শাওন নেই কোথাও।বিছানা থেকে নেমে আবারও দরজাটা খুলার ব্যর্থ চেষ্টা করলো।
কিন্তু পারলোনা।শেষে রাগ করে দরজায় লাথি মারতে যেতেই সেই সময়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো শাওন।মেধা চেঁচিয়ে বললো,’আপনি কি চান??’
-‘আমার সেই প্রশ্নের উত্তর চাই যেটা কাল থেকে তোমাকে জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছি’
মেধা কিছু না বলেই শাওনকে টপকে রুম থেকে বেরিয়ে পালাতে চেষ্টা করলো এবারও পারলোনা।শাওন ধরে ফেলেছে।ওকে রুমে আনতে আনতে বললো,’তোমার সেই আগের শক্তি নেই যে তুমি আমার সঙ্গে লড়তে পারবে।যতদিন না সত্য কথা বলছো ততদিন তুমি এই রুমের বাহিরের জগৎ দেখতে পাবেনা’
শাওন মেধাকে রুমে ঢুকিয়ে দরজা ভেতর থেকে লাগিয়ে দিলো আগেরমতন।মেধা বিছানায় এসে বসে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।শাওন এগিয়ে এসে জানালার সামনে থেকে পর্দা সরিয়ে দিলো।বিশাল থাই গ্লাসের দরজা।এটা খুললে নিচে সাগরে নামা যায়।শাওন গ্লাসটা খুলে নিচে সিঁড়িতে পা রেখে বললো,’অবিবাহিত হয়েও রিসোর্টে এসে থাকতে হচ্ছে।এই কেসের জন্য পানির আর কত গভীরে নামতে হবে তা জানিনা।এখন আর রশ্নিও আমার সামনে আসেনা।সে আমার উপর অভিমান করেছে।জানি না কেন সে এমনটা করছে।আগে দিনে সবসময় তাকে সামনে দেখতাম আর এখন একবারও দেখিনা।’
মেধা দরজার কাছে গিয়ে চাবি একটা একটা করে ঢুকিয়ে খোলার চেষ্টা করছে।শাওন সিঁড়িতে বসে পেছনে তাকিয়ে বললো,’তোমার শক্তি খরচ করার জন্য নকল চাবি রেখেছি।খুলতে থাকো।ওখানে পনেরোষোলোটা চাবি আছে।একটা দিয়েও দরজা খুলবেনা।তুমি চেষ্টা করতে থাকো আমি সাঁতার কেটে আসি।ভোরে গোসল করার মজাই আলাদা’
শাওন ঝাঁপিয়ে পানিতে নেমে গেছে।মেধা চাবি ছুঁড়ে মেরে থাই গ্লাসটাকে ভেতর থেকে আটকে দাঁড়িয়ে থাকলো।শাওনকে সে ভেতরে ঢুকতে দেবেনা।
শাওন পানিতে থেকে ওর এই কান্ড দেখে হাসলো,মেধা বাচ্চামি করছে এই ভেবে।অনেকক্ষণ সাঁতার কেটে পানি থেকে উঠে এসে গ্লাসে হাত রেখে ইশারা করলো।মেধা না দেখার ভান করে মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে। শাওন সিঁড়ির উপর থেকে চাবি নিয়ে মূহুর্তেই গ্লাসটা খুলে ফেলেছে।মেধা চমকে তাকিয়ে রইলো ওর মুখের দিকে।
ভেজা শরীরে হেঁটে এসে হাত দিয়ে চুলগুলোকে মাথার সাথে লেপে দিতে দিতে,ঠোঁটে বাঁকা হাসি নিয়ে শাওন মেধার কাছে আসা ধরতেই মেধা বিছানা থেকে উঠে রুমের কোণায় চলে গিয়ে বললো,’কি চান আপনি?’
শাওন চুপচাপ বিছানার উপর থেকে তোয়ালেটা নিয়ে মাথা মুছতে মুছতে আবারও সিঁড়িতে গিয়ে বসলো।মেধার কথার উত্তর দিলো না।মেধা কাঁপা কাঁপা পায়ে হেঁটে বিছানায় এসে বসেছে।মাথা কাজ করছেনা তার।নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে।
-‘একজন আসামির সঙ্গে লড়াই করা সম্ভব কিন্তু নিজের মতন অন্য অফিসারের সাথে লড়াই করা খুব কঠিন।
শাওন আমাকে প্রতি পদে পদে টর্চার করছে।এমন করে এই রুমে একদিনের বেশি থাকলে বিরক্ত হয়ে এমনি মরবো আমি।কামানের প্রয়োজন পড়বেনা।’
চলবে♥
সঞ্চারিণী
আফনান লারা
২৮.
হোটেল ম্যানেজমেন্টের লোকেরা ভেবেছিল শাওন আর মেধা নিউ কাপল।তাই তারা হানিমুন প্যাকেজে স্পেশাল ডিস্কাউন্ট দিয়ে রুম সার্ভিসের লোকের হাতে কার্ড পাঠালো।নক হওয়ায় শাওন উঠে আসলো দরজা খুলবে বলে।মেধা বিছানার স্ট্যান্ডের সঙ্গে মাথা হেলান দিয়ে বসে ছিল।শাওন লোকটার হাত থেকে কার্ড নিয়ে চেয়ার টেনে বসলো।কার্ডের লেখা পড়া মেধার দিকে তাকিয়ে বললো,’ওরা আমাদের হাসবেন্ড ওয়াইফ মনে করছে।হাস্যকর!’
মেধা চুপ করে থাকলো।শাওন কার্ডটা ছেলেটার হাতে ফেরত দিয়ে ক্যানসেল করে নাস্তার অর্ডার দিয়ে আবারও দরজা লাগালো।এবার সে মেধার পাশে এসে বসলো।মেধা পা ভাঁজ করে একটু সরে বসে বললো,’আমি বললাম তো রেদোয়ানকে আমি মারিনি,যদি মারতাম তাহলে রকি আমাকে কেন বাঁচাতে চাইবে বলুন?তার ভাইকে মেরেছি আমি, তার তো আমাকে দেখলেই মেরে ফেলার কথা।’
শাওন মেধার বুলেট লাগা হাতটা ধরে বললো,’হুম সেটাই।শুধু শুধু কেউ কাউকে এত ইম্পরট্যান্স দেয় না।নিশ্চয় তোমার সঙ্গে জড়িত এমন কিছু আছে যেটা কিনা রকির দূর্বলতা।আর তাই সে তোমাকে রেখে আমাদের সব অফিসারের উপর হামলা চালাচ্ছে’
মেধা নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,’তো দেখুন আমার কাছে কি আছে।খুঁজুন!আন্দাজে কাউকে ব্লেম করার আগে ভেবে দেখুন দোষারোপ করাটা আদৌ ঠিক হচ্ছে কিনা।’
শাওন আবারও হাতটা ধরে ফেলেছে।মেঝের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,’শুরু থেকে আমার মনে ঘটকা লেগে ছিল।তোমার প্রথমে বোকা হওয়ার নাটক।তারপর একের পর এক তোমার রুপ সম্পর্কে জেনে যাওয়া।হঠাৎ করে বোকাসোকা মেয়েটার নাম বদলে সঞ্চারিণী হয়ে উঠলো।এই সঞ্চারিণীকে আমি নিজে বোকা,সব চেয়ে দূর্বল ভাবতাম।অথচ আমার ধারণার বাহিরে ছিল, কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে আসবে।হয়ত রেদোয়ানের সঙ্গে তোমার পুরোনো শত্রুতা ছিল,আর নয়ত আশা তোমার কাছের কেউ ছিল।যার কারণো প্রতিশোধ নিতে তুমি রেদোয়ানকে মেরেছো।আমি জানি তুমি স্বীকার করবেনা।ঐ কোণাটা দেখছো?ঐ যে সামনের দরজার উপরে কালো করে একটা বক্সের মতন দেখছো?ওটা আসলে বক্স না।একটা ক্যামেরা।যতদিন না তুমি স্বীকার করছো তুমি রেদোয়ানকে মেরেছো ততদিন তুমি এই ক্যামেরার সামনে নজরবন্দি থাকবে।ভাবছো তুমি উঠে ক্যামেরা সরিয়ে নিতে পারবে?এত সহজ না।তা হচ্ছেনা।’
কথাটা বলে শাওন রুমটার যে টেবিল ছিল তার ড্রয়ার থেকে রশি বের করে খাটের সঙ্গে বেঁধে মেধার এক হাতকে সেই রশি দিয়ে বেঁধে ফেললো।তারপর ওর পাশে বিছানায় উঠে বসে বললো,’এই রশির প্রতিটি গিট্টু এক হাতে খুলতে তোমার পাক্কা বিশ মিনিট সময় লাগবে।আর আমি তোমায় এই রুমে বিশ মিনিটের বেশি সময় ধরে একা রাখবোনা।তাছাড়া ক্যামেরা দিয়ে দেখতে পাবো তুমি রুমে কি করছো।আর এই দড়িটা নিয়ে তুমি নিচে পানিতে যেতে পারবে,ওয়াশরুমে যেতে পারবে কিন্তু দরজা অবধি গেলেই তোমার রশির আয়তন কমে যাবে।তুমি দরজা অবধি পৌঁছাতে পারবেনা।তাই ক্যামেরাও স্পর্শ করতে পারবেনা’
মেধ হাতের বাঁধনের দিকে তাকিয়ে থেকে হাসলো তারপর শাওনের দিকে ফিরে বললো,’আমাকে দমিয়ে রাখতে এত কিছু?ভয় পান আমাকে?’
-‘তোমায় আমি ভয় পাইনা।পেলে কাজটা সাজিদকে দিতাম।বাট আমি নিজে আগে জানতে চাই রেদোয়ানকে কে মেরেছে।তাছাড়া সাজিদ আমার মতন রিমান্ড নিতে পারেনা।
তোমার এই চোখজোড়া দেখলে ও এক নিমিষে গলে পানি হয়ে যাবে।ও পারবেনা তোমার চেখের নেশা কাটিয়ে তোমার মুখ থেকে কথা বের করতে’
মেধা ভ্রু নাচিয়ে বললো,’তো আপনি নেশা কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন?নাকি দেখা গেলো কদিনে আপনিও নেশায় লেপটে গেলেন’
শাওন বিছানা থেকে নেমে চেয়ারের উপর থেকে অফিসের কোটটা নিয়ে গায়ে দিতে দিতে বললো,’আমি তোমার দুচোখের দিকে একসাথে তাকাইনা।মেয়েদের চোখ ডেঞ্জারাস। যদি একসাথে তাদের দুচোখ এক মিনিট ধরে দেখা হয় তাহলে নেশায় লেপটে যাবার চান্স ৯৫%।আর আমি রিস্ক নিতে চাইনা’
শাওন চলে গেলো রুম থেকে।সাথে সাথে মেধা বিছানা থেকে নেমে দরজা অবধি যাওয়ার অনেক চেষ্টা করেও পারলোনা।এক বিঘের জন্য যেতে পারছেনা।রুমটার শেষ কোণায় খাট।আর শাওন ওকে খাটের সঙ্গেই বেঁধেছে।রাগ করে ফিরে এসে দড়িটাকে খোলার চেষ্টা করলো সে।কিন্তু হাতের ব্যাথার জন্য একটা গিট্টু ও খুলতে পারলোনা।
শাওন আবারও ফেরত এসেছে হাতে খাবার নিয়ে।মেধা ফ্লোরে বসে থেকে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,’খাবো না কিছু’
-‘কে বললো তোমার জন্য এনেছি এগুলো?আমি আমার জন্য এনেছি। তোমাকে তো না খাইয়ে রাখবো।খাওয়ার জন্য কাঁতরাবে তুমি।’
শািন মেধার সামনে এসে মেঝেতে বসে খাওয়া শুরু করেছে।মেধাকে দেখিয়ে দেখিয়ে।কাল সকালে নাস্তার পর থেকে মেধার কিছুই খাওয়া হয়নি।ক্ষুধার্ত চোখে তাকিয়ে আছে সে।শাওন দেখিয়ে দেখিয়ে পুরো খাবারটা খেয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো বিছানার উপরে গিয়ে।মেধা মাথা উঁচু করে দেখলো শাওনের চোখ বন্ধ
তাই সে নিচে বসা অবস্থায় একটু একটু করে গিট্টু খুলা শুরু করে দিয়েছে।অনেক কষ্টে একটা গিট্টু সে ছুটাতে পারলো।আরেকটা ছুটাতে গিয়ে মাথা উঁচু করতেই দুটো চোখ জোড়া দেখা নড়ে উঠলো সে।ভয় পেয়ে গেছে শাওনকে এমন করে তাকিয়ে থাকতে দেখে।একটু পিছিয়ে গিয়ে চুপ করে রইলো চোরের মতন মুখ করে।শাওন পুনরায় গিট্টু লাগিয়ে দিতে দিতে বললো,’আমার থেকে পালানো এত সোজা না।’
—-
সারাদিন গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেলো।
মেধা খিধায় মনে হয় মরে যাবে।গলা শুকিয়ে কাঠ তার।নিজেকে তার সব চেয়ে বেশি অসহায় মনে হচ্ছে।শাওন দুপুরের খাবারটা খায়নি।মেধার সামনে খেতে বসলে ওর খাওয়া আর হয়না।সকালে অনেক কষ্টে খেয়েছিল।আজ দুদিন রশ্নি তার সামনে আসেনা সেই বিষয়টা একেবারে মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে তার।
মেধা ঘুম থেকে উঠে সামনে দেখলো শাওন ফোনে কথা বলছে।মনে হলো নুহাশের সঙ্গে।মেধা চেঁচিয়ে বললো,’নুহাশ হেল্প মি’
শাওন সঙ্গে সঙ্গে লাইন কেটে দিয়ে মেধার কাছে এসে হাত ভাঁজ করে বললো,’আমাকে টপকে নুহাশ তোমায় বাঁচাবে??অনেক বার বেড়েছো।জানতাম, না খেলে শক্তি অপচয় হয়।কিন্তু এখন দেখছি তোমার শক্তি আরও বাড়ছে।’
পকেট থেকে টেপ বের করে শাওন মেধার মুখে টেপ মেরে দিয়ে ঐ হাতের সঙ্গে এবার বাকি হাতটাও বেঁধে দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো ফোনে কথা বলতে বলতে।নুহাশকে কোনো মতে বুঝালো যে ওটা মেধার ভয়েস ছিলনা।মেধা ভাবছে তার এখন কি করা উচিত।এভাবে তো দিন চলতে পারেনা।শাওন যে নাছোড়বান্দা।রেদোয়ানের খবর বের করতে যদি মেধাকে নিয়ে এক বছরও এখানে তাকে থাকতে হয় তাও সে থাকবে।
-‘এদিকে আমি না খেয়ে থাকলে নির্ঘাত জ্ঞান হারাবো।তাকে যাই বলি বিশ্বাস করেন না।’
শাওন রুমে ফিরে এসে বললো,’কি ভাবছো?সত্যি কথা বলে দিবে নাকি আমার হাতে আরও অত্যাচারিত হতে চাও?’
মেধা কাঁচুমাচু করতে করতে ইশারা করলো ওর মুখ থেকে টেপ সরাতে।শাওন এগিয়ে এসে টেপ সরিয়ে দিয়ে বললো,’খাবে কিছু??কিন্তু তার আগে তো সত্যি কথা জানাতে হবে’
মেধা মুখ ঘুরিয়ে নিলো রাগে ক্ষোভে।পরে মনে আসলো রাগ দিয়ে শাওনকে দমানো যাবেনা তাই আবারও ওর দিকে ফিরে বললো,’আপনি সোজা করে বলুন আমার থেকে কি শুনতে চান?’
-‘তুমি তো বলছো রেদোয়ানকে মারোনি।তাহলে আমি জানতে চাই রকির লোকেরা তোমাকে কেন মারতে গিয়েও মারেনা?তোমাকে কিডন্যাপ করার পেছনে তাদের কি ইচ্ছা ছিল?কিডন্যাপ করে তারা তোমাকে মারেনি কেন?’
-‘আমি জানি না কেন কিডন্যাপ করেছে।আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল রেদোয়ানের সম্পত্তি কার নামে লেখা’
-“এটা তো সাধারণ মানুষ ও জানবে।বেছে বেছে তোমাকে কিডন্যাপ করে জিজ্ঞেস করতে গেলো কেন?’
মেধা ভ্রু কুঁচকে বললো,’আমি কি জানি?তাদের জিজ্ঞেস করেন গিয়ে’
-‘তাদের অবশ্যই জিজ্ঞেস করবো কিন্তু তার আগে তুমি আমার প্রশ্নের জবাব দাও।নাহলে এক ফোঁটা পানিও পাবেনা’
-“যেই প্রশ্নের জবাব আমার কাছে নেই সেটা বারবার জিজ্ঞেস করে কি পাচ্ছেন আপনি?’
শাওন বিরক্ত হয়ে মেধার মুখে আবারও টেপ লাগিয়ে দিয়ে গ্লাস সরিয়ে সিঁড়িতে গিয়ে বসলো পা পানিতে চুবিয়ে রেখে।মেধা শুয়ে শুয়ে মুখ থেকে টেপ সরানোর চেষ্টা করে অনেকক্ষণ বাদে পারলো খুলতে।তারপর চেঁচিয়ে বললো,’আপনি আমাকে শুধু শুধু টর্চার করছেন।এর মাশুল আপনাকে দিতে হবে’
শাওন পানিতে হাত রেখে মুচকি হাসলো।মেধাকে নিয়ে এখানে আসায় একটা লাভ হয়েছে আর তা হলো এত সুন্দর ভিউ দেখার সুযোগ হয়ে গেলো।
-‘অফিসের কাজ,রহস্যের সন্ধানে ছুটতে ছুটতে কখন যে জীবনটা স্বাদবিহীন হয়ে গিয়েছিল বুঝতেই পারিনি।এখন জীবনটাকে চাঙ্গা মনে হয়।মন চায় এখানেই থেকেযাই।’
মেধা হাত নড়াচড়া করতে করতে বললো,’হাত খুলে দিন।আমার বমি পাচ্ছে’
শাওন পেছনে তাকিয়ে বললো,’হাত খুলে দিলেও পালাতে পারবেনা।নাটক করতে হবেনা।তোমার নাটক দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত।একটু শান্তি দাও আমাকে’
মেধা রেগে বললো,’সত্যি আমার বমি আসছে।বিছানায় করে দেবো’
শাওন উঠে এসে মেধার একটা হাত খুলে দিলো।ও ছুটে ওয়াশরুমে গিয়ে সত্যি সত্যি বমি করছে।শাওন রুম থেকে বের হবার দরজা খুলতে খুলতে বললো,’আসামিকে এনেছি নাকি একটা রোগীকে তা ভেবে পাইনা।কিছুক্ষন পরেই ডাক্তার ডাকতে হয়।’
দরজা খুলে বের হবার সময় শাওন কি ভেবে পুনরায় ওয়াশরুমের কাছে এসে দেখলো মেধা ফ্লোরে বসে মাথা দেয়ালে ঠেকিয়ে রেখেছে।শাওন ওর হাত ধরে উঠিয়ে দাঁড় করিয়ে বললো,”তাও বলবেনা রেদোয়ানকে কেন মেরেছো?’
মেধার মুখে কথা নেই।শাওন বাধ্য হয়ে ওকে কোলে তুলে বিছানায় এনে নামিয়ে দিয়েছে।তারপর গেলো ডাক্তার আনতে
চলবে♥