সঞ্চারিণী
আফনান লারা
৫৫.
-‘ রিভলবারটা আমায় দিন।যে কাজ একবারে করতে পারিনি তা আজ করবো।ওকে আমি কিছুতেই বেঁচে থাকতে দেবোনা।আশাকে ও মেরেছে।উপযুক্ত শাস্তি তাকে আমি নিজ হাতে দেবো’
-“তোমার একটা কথাও আমি আর রাখছিনা।এই পথটা চেনা আছে তোমার?এত অন্ধকারে কোথা থেকে কোথায় যাব তাই ভেবে পাইনা।রেদোয়ান নির্ঘাত ধাওয়া করেছে।নিজের জীবন নিয়ে টানাটানি। আজ কেউ না কেউ মরবেই।’
অনেকটা পথ অন্ধকারে ছোটার পর শাওন কি মনে করে মেধাকে নিয়ে বনে ঢুকে পড়েছে।রোডে থাকলে রেদোয়ান খুব সহজে ধরে ফেলতে পারবে ওদের।তাছাড়া ওর কাছে তো জিপ ও আছে।
হেঁটে/দৌড়ে তারা দুজন বেশি দূর কখনওই যেতে পারবেনা তাই জেনেশুনে ভয়ঙ্কর জঙ্গলে তারা ঢুকে পড়লো এক প্রকার বাধ্য হয়ে।ওদিকে রেদোয়ান নিজে জিপ নিয়ে রোড দিয়ে আসছে আর বন দিয়ে তার সাথের লোকদের আসতে বলেছে।
মেধা পায়ের কারণে দৌড়াতে পারছেনা ঠিকমত,পথে পথে থেমে যাচ্ছে।মাটিতে বসে পড়ছে।
শাওন ওকে কোলে তুলে নিতে চাইলে ও বাধা দেয়।ওকে কোলে নিয়ে শাওন নাকি দৌড়াতে পারবেনা।তাই ভেবে বারবার বাধা দিচ্ছে।
পাঁচ মিনিট বসলেই দূর থেকে আলো দেখা যায়।রেদোয়ান খুব কাছে এসে গেছে।রক্ষা পেতে হলে পালাতে হবে।কিন্তু পালানোটা হয়ে উঠছেনা মেধার চোটের কারণে।মেধা বারবার করে বলছে শাওন যেন চলে যায়।মেধাকে এত সহজে রেদোয়ান মারবে না।কিন্তু শাওনকে মারতে সে দেরিও করবেনা।বরং সবার আগে শাওনকেই মারতে আসবে।
শাওন নাছোড়বান্দা।সে মেধাকে ফেলে কিছুতেই যাবেনা।কি করে যাবে?মেধাকে সে ভালোবাসে।তাছাড়া ভালোবাসার কথা দূরে থাকুক।সবার আগে হলো মনুষত্ব।একটা মেয়েকে বিপদের মুখে একা ফেলে যাওয়া কোনো ভালো পুরুষের কাজ হতেই পারেনা।মেধা এমন ভাবে শাওনকে চলে যেতে বলছে যেন শাওন না গেলে সে ধাক্কা মেরে তাড়াবে ওকে।বারবার ধমকাচ্ছে।
কোনদিকে গেলে একটু প্রশান্তি মিলবে তা ওদের দুজনের জানা নেই।শেষে মেধা শাওনের হাত থেকে রেদোয়ানের রিভলবারটা কেড়ে নিলো।পিছিয়ে যেতে যেতে বললো,’আমি আর পালাবোনা।আমি এর শেষ দেখে ছাড়বো’
-“মেধা একবার ভুল করেছো সেই ভুলটা ভুলে পরিণত হয়নি।এখন আবার সেই ভুলকে নাম দেওয়ার জন্য তুমি এমন করছো?ওটা ফেলে দাও।আমাদের জন্য একটা সুন্দর জীবন অপেক্ষা করছে’
-‘না!আজ যদি আমি রিভলবার ছেড়ে দিই তো আমাদের দুজনকেই মরতে হবে।আমি নিজে মরলে মরবো কিন্তু আপনার কিছু হতে দেবোনা।’
শাওন মেধার হাত থেকে কৌশলে পুনরায় রিভলবারটা ছিনিয়ে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে মারলো।অনেকদূরে আওয়াজ হলো।কোথায় গিয়ে পড়েছে তা বুঝতে পারলেও এই অন্ধকারে সেটা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।ভোর হয়ে আসবে কিছুক্ষণ পরেই।তাও সেরকম আলো চারিদিকে ছড়ায়নি যে রিভলবার খুঁজে পাওয়া যাবে।
মেধা চেঁচিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে বললো,’এটা আপনি কি করলেন?কেন করলেন?’
-‘আইন হাতে নিতে পারিনা আমরা’
ঠিক সেসময়ে রেদোয়ানের লোকজন এসে চারিদিক থেকে ওদের ঘিরে ধরেছে।তারা অপেক্ষা করছে রেদোয়ান আসার।সবার হাতের ফোনের আলো জ্বলছে।আলোর কারণে মেধা তাকাতেও পারছেনা।মুখের সামনে হাত রেখে চুপ করে আছে সে।একসময়ে শক্ত হয়ে শাওনকে বললো সে যেন চলে যায়।’
শাওন সেদিকে খেয়াল না করে মারপিট শুরু করে দিলো হঠাৎ।
সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লো শাওনকে থামাতে।মেধা পায়ের কারণে উঠে দাঁড়াতে পারছেনা।
তারা একটা পাহাড়ের চূড়াতে আছে এখন।সেটা কেউই জানতোনা।উঁচু নিচু পথে ছুটে তারা পাহাড়ের উপর চলে এসেছে।
রেদোয়ান এসে উপস্থিত হলো কিছু সময়ের ব্যবধানে।মেধাকে আহত দেখে সে বললো,’অনেক হয়েছে।রকির জন্য আর আমি অপেক্ষা করবেনা।তোমাকে তো আমি মারবোই মারবো।তাও এই মূহুর্তে।এই তোরা এই অফিসারটাকে আটকে রাখ।আমার আসল কাজটা আমি নিজেই সম্পূর্ন করছি।’
কথাটা বলে রেদোয়ান মেধার হাত শক্ত করে ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেলো পাহাড়ের কিণারার দিকে।উদ্দেশ্য ছিল ফেলে দেবে ওকে নিচে।
শাওন দেখেছে কিন্তু লোকগুলোর কারণে নিজেকে ছাড়াতে পারছেনা।মেধাকে বাঁচাতে যেতেও পারছেনা।
বারবার মেধাকে বলছে শক্ত হতে।কিন্তু মেধা এতটাই দূর্বল হয়ে পড়েছে সে তার হাতটাও ছাড়াতে পারছেনা রেদোয়ানের হাত থেকে।শেষ কিণারায় এনে রেদোয়ান মেধাকে ধাক্কা দেবে ঐ সময় তার ফোনে কল আসলো।রকির কল।সাজিদ আর মিলন ওকে দিয়ে ফোন করিয়েছে তা রেদোয়ান জানতো না।
বিরক্ত হয়ে মেধার পায়ের উপর তার এক পা রেখে ওকে আটকে মেধার হাত ছেড়ে ফোন ধরলো সে।
মেধা ব্যাথায় চিৎকার করছে।রকি জানালো সে আসছে।লোকেশান যেন বলে। রেদোয়ান তাচ্ছিল্য করে হেসে বললো,’তোর আর আসতে হবেনা।আমি ওকে মারবো এখন।তোকে আরও সুন্দর মেয়ে এনে দেবো।এর কথা ভুলে যা’
.
লোকগুলো থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে আজ শাওন রশ্নিকে দেখলো হঠাৎ।ঠিক তার সামনে।
সেই রুপে যে রুপে রশ্নিকে সে শেষবার দেখেছিল।ও মারা যাবার আগে।রশ্নি আজ অভিমান করে নেই।তার মুখে হাসি।অথচ চোখে পানিতে টলমল করছে।
শাওন মারামারি থামিয়ে রশ্নির দিকে তাকিয়ে থাকলো।রশ্নি এগিয়ে এসে শাওনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো,’আমাকে হারিয়ে যেতে দেখেছো।মেধাকে হারিয়ে যেতে দেখোনা।আমি জানি তুমি মেধাকে বাঁচাতে পারবে যদি তুমি চাও।মেধা আজ অসহায়।ওকে আমার মতন হারাতে দিওনা শাওন!ওকে বাঁচাও।যা করতে হয় করো তাও ওকে বাঁচাও।যদি ওর কিছু হয়ে যায় তুমি আর নিজেকে শক্ত রাখতে পারবেনা।ভেঙ্গে যাবে।ঐ শাওনকে আর কোনো সঞ্চারিণী এসে জোড়া লাগাতে পারবেনা।শাওন আর সময় নষ্ট করোনা!!মেধাকে বাঁচাও’
শাওন ততক্ষণে সবগুলো মেরে নিজেকে মুক্ত করে দৌড় লাগিয়েছে।মাথায় কি পরিমাণ রাগ ছিল তা শুধু সে জানে।ওর চোখের সামনে মেধাকে কষ্ট দিচ্ছে রেদোয়ান তা এতক্ষণ সহ্য করেছে সে।কি ভেবেছিল কে জানে!!
একটা বড়সড়ো ধাক্কা দিয়ে সে রেদোয়ানকে ফেলে দিলো ছুটে এসে।সঠিক সময়ে মেধাকে আঁকড়ে ধরে মাঝখানে নিয়ে আসলো।রেদোয়ান পড়ে গেছে পাহাড় থেকে।
পাহাড়ের কতটা উঁচুতে তারা তা তো কাল সকালেই জানা যাবে।
মেধা মুখে হাত দিয়ে শাওনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।শাওন হাঁপাতে হাঁপাতে নিচে বসে গেলো।রেদোয়ানের সঙ্গীরা সব অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।কেউ দেখলোনা রেদোয়ানকে কে ধাক্কা মেরেছে।
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে শাওন মেধার দিকে তাকিয়ে জয়ের হাসি হেসে বললো,’আমাদের জন্য একটি সুন্দর জীবন অপেক্ষা করছে মেধা’
-‘আপনি এটা কেন করলেন?’
-‘প্রথমে তুমি করলে।এরপর আমি।আমি সফল।আমাদের দুজনের জীবন বাঁচাতে ওকে যেতে হতো।ও থাকলে আমরা কখনও এক হতাম না।ও আমাদের বিচ্ছেদ ঘটিয়ে তারপর ছাড়তো।ভালে করলাম না?’
মেধা শাওনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে বললো,’আমি রশ্নিকে দেখেছি তখন।সে বলেছে আপনাকে এমনটা করতে তাও জানি’
শাওন ও চোখ বন্ধ করে ফেললো।মেধাকে খুব শক্ত করে সে নিজেও ধরলো।কেঁদে ফেলে বললো,’একজনকে হারিয়ে যেতে দেখেছি, আরেকজনকে হারাতে দিতে পারি কি করে??তুমি যে আমার সঞ্চারিণী।’
সাজিদ আর মিলন ততক্ষণে এসে গেছে সাথে রকিকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এসেছে।
রকি এদিক সেদিক চেয়ে বললো,’সে কোথায়?’
সাজিদ আর মিলন ওর হাত শক্ত করে ধরে রেখে বললো,’কে কোথায়?’
-‘না মানে কেউনা।যাকে কল করেছিলাম আর কি।মিঃA সে কোথায়?’
সাজিদ শাওনের কাছে এসে বললো,’মিঃA কে পেয়েছো?’
শাওন মাথা তুলে বললো,’মিঃA কে পেলাম না।ঐ যে তার লোকেরা আহত হয়ে পড়ে আছে।তাদের জিজ্ঞেস করে।আর হ্যাঁ রেদোয়ানের কেস সলভড্।কাল আশা আর রেদোয়ানের লাশ তাদের পরিবারের কাছে পাঠানো হবে।আশার পরিবার বলতে তো কেউ নেই।তার লাশের ব্যবস্থা আমরা করবো।মিডিয়াতে খবর দিয়ে দাও’
রকি বারবার রেদোয়ানকে খুঁজে যাচ্ছে।
পাহাড় থেকে নেমে সাজিদ আর মিলন ওকে ধরে গাড়ীতে ওঠালো।সাথে পাঁচ ছয়জন যত লোক ছিল তাদের ও উঠালো।ড্রাইভিং সিটে তারা বসে চললো কারাগারের দিকে।
মেধা আর শাওন রেদেয়ানের জিপে করে আসবে বলেছিল।
পথে রকি ষড়যন্ত্র করে কার থেকে বেরিয়ে পালিয়ে গেছে।সাজিদকে রেখে মিলন ওকে খুঁজতে বেরিয়েছিল।রকি ছুটতে ছুটতে পাহাড়ে উঠে পেছনে তাকিয়ে জয়ের হাসি দিলো।হঠাৎ একটা পাথরের সঙ্গে হোচট খেয়ে সে নিজেও পড়ে গেলো পাহাড় থেকে।দুই ক্রিমিনালের শেষ পরিণতি।
মিলন অনেক খুঁজেও ওকে কোথাও না পেয়ে আবার কারের কাছে ফিরে আসলো।এই আসামীগুলোকে একা রেখে রকির খেঁজে যাওয়াও সম্ভব না।একটার জন্য সবগুলো পালাবে শেষে।
——
শাওন মেধাকে নিচ থেকে তুলে নিয়ে হেঁটে হেঁটে জিপ অবধি এসে ওকে ভেতরে বসালো।মেধার পায়ের সঙ্গে লেগে জিপের একটা বক্স খুলে গেছিলো।তাতে একটা ছবি।এ্যামিলির ছোট বোন আর রেদোয়ানের।
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে মেধা ছবিটা ফেলে দিলো বাহিরে।
চলবে♥