#লাভ_গেম
#ফাবিহা_নওশীন
১৬.
সন্ধ্যা বেলা। চারদিকে অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে। গাড়ি ছুটে চলছে দ্রুতগতিতে। আদ্রিশের মাথা রুশার কোলের উপরে। সারা মুখে রক্ত। সামনের সিটে সেজান। সেজান বারবার রুশাকে শান্তনা দিচ্ছে।
“সেজান ভাই, আর কতক্ষণ? গাড়িটা একটু তাড়াতাড়ি চালাতে বলেন। আদ্রিশের কষ্ট হচ্ছে।”
সেজান আদ্রিশের মুখের দিকে তাকাল। ওর চোখ বন্ধ। চোখের পাপড়ি আর ঠোঁট ক্ষনে ক্ষনে কেঁপে উঠছে। সেজান জিজ্ঞেস করল,
“ভাই, আপনি ঠিক আছেন?”
আদ্রিশ বন্ধ চোখে কাতর কন্ঠে বলল,
“আমি ঠিক আছি।”
রুশা আদ্রিশের গালে হাত রেখে বলল,
“আর একটু। আমরা চলে এসেছি।”
রুশা কাঁদছে। সেজান ওকে বলল,
“আহ ভাবি, কাঁদছেন কেন? নিজেকে শক্ত করুন। ভাই ঠিক হয়ে যাবে।”
সেজান নিজেও আদ্রিশের অবস্থা দেখে আহত। কিন্তু রুশার মতো ভেঙে পড়লে তো চলবে না।
রুশার তখন মনে পড়ল ওই স্পটের কথা। সেখানে ও একজনকে গুলি করেছে। এর জন্য ওকে সবার কাছে বিশেষ করে আদ্রিশের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। এ নিয়ে নিশ্চয়ই ওদের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। রুশা তাই আগেই নিজের দিকটা ক্লিয়ার করতে চায়। যাতে পরবর্তীতে ফেঁসে না যায়।
রুশা মাথা নিচু করে বলল,
“সেজান ভাই লোকটা কি মারা গেছে?”
সেজান অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,
“কোন লোকটা ভাবি?”
রুশা মাথা নিচু করে আছে। সেজানের দিকে একবার চেয়ে আবারও মাথা নিচু করে নিল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অপরাধী ভঙ্গিতে নিচু কণ্ঠে বলল,
“যাকে গুলি করেছি।”
তারপর কিছুটা জোরে দ্রুত বলল,
“বিশ্বাস করেন সেজান ভাই, আমি বুঝতে পারিনি। ভাবিনি সত্যি সত্যি গুলি বের হয়ে যাবে। আমি শুধু ভয় দেখানোর জন্য রিভলবার তাক করেছি। ওরা যাতে বিশ্বাস করে তাই এত কনফিডেন্ট দেখিয়েছি। বুঝতে পারিনি সত্যি সত্যি গুলি উনার পায়ে লেগে যাবে। এখন কি হবে? যদি মরে যায়? আমার খুব ভয় লাগছে।”
সেজান রুশার কাঁদোকাঁদো মুখের দিকে চেয়ে বলল,
“একদম ঠিক করেছেন। মরে গেলে যাবে।আপনি একদম গিলটি ফিল করবেন না।”
“আমার জন্য বিষয়টা এত সহজ না। সত্যিই যদি মরে যায়! ঘটনাটা আমি ভুলতে পারছি না।”
রুশা অস্থির অস্থির করছে তাই সেজান বলল,
“কিছু হবে না। পায়ে গুলি লাগলে মানুষ মরে না। ও ঠিক হয়ে যাবে।”
রুশা আদ্রিশের দিকে তাকাল। আদ্রিশ নড়ছে। ওর কানে সব পৌঁছেছে। কিন্তু কিছুতেই ওর কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। ওরা হসপিটালের সামনে এসে পৌছালো।
রুশা জারিফের মাথায় রিভলবার ঠেকিয়ে রাখার কিছুক্ষণ পরে সেজান দলবল নিয়ে পৌঁছে যায়। রুশা যেন প্রাণ ফিরে পায়। ওরা দ্রুত আদ্রিশকে উদ্ধার করে। তারপর সেজান ওর অবস্থা দেখে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসে।
রুশা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর চোখের পানি মুছছে। মনের অস্থিরতা কাটানোর জন্য দু’কদম আগাচ্ছে আবার আগের জায়গায় গিয়ে স্থির থাকছে। ওর মনের ভেতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কিছুই ভালো লাগছে না। অপেক্ষা করছে ডাক্তারের জন্য। কখন বের হবে আর একটা ভালো খবর দেবে।
সেজান দু-হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে। জারিফকে গিয়ে এখুনি পুঁতে দিতে ইচ্ছে করছে। আদ্রিশের এমন অবস্থা করবে ভাবতেও পারেনি।
ডাক্তার বের হতেই সেজান হাতের ভাজ খুলে ডাক্তারের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।
বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“ভাইয়ের কি খবর? কেমন আছেন তিনি?”
রুশাও ডাক্তারের মুখের দিকে চেয়ে আছে।
ডাক্তার যথাসম্ভব মুখ গম্ভীর করে বলল,
“আঘাতগুলো গুরুতর। শুকাতে সময় লাগবে। কিছুদিন আমাদের তত্বাবধানে থাকতে হবে। চিন্তার তেমন কারণ নেই।”
রুশা জিজ্ঞেস করল,
“আমরা ভেতরে যেতে পারি?”
“কিছুক্ষণ পরে দেখা করবেন। এছাড়া ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়েছি এক ঘন্টার আগে ঘুম ভাঙবে না।”
ডাক্তার চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে দু’জন নার্স বের হলো। রুশা সেজানের দিকে তাকাল। রুশা ভেতরে যাওয়ার জন্য অস্থির অস্থির করছে।
“ভাবি আরেকটু অপেক্ষা করুন।”
রুশা মাথা নাড়ায়। পাশের বেঞ্চিতে গিয়ে মাথা নিচু করে বসে পড়ল।
.
আদ্রিশের পুরো বডিতে ব্যান্ডেজ। রুশা ধীরে ধীরে ওর পাশে গিয়ে বসল। আদ্রিশ ঘুমিয়ে আছে। রুশা ওর পাশে গিয়ে বসল। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আলতো করে গালটা ছুয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু গালে কাটাছেঁড়া। ব্যান্ডেজ করা বিভিন্ন জায়গায়।
তবুও রুশা আলতো করে আদ্রিশের গালটা ছুয়ে দিল খুব সাবধানে। ওর হাত কাঁপছে।
কেমন অদ্ভুত ফিলিং হচ্ছে। বুকের ভেতরটা কেমন করছে।
.
আদ্রিশের জ্ঞান ফিরতেই রুশাকে ওর পাশে দেখে। রুশা সোজা হয়ে বসে। মিষ্টি কন্ঠে বলল,
“কেমন আছেন আপনি?”
“ভালো।”
আদ্রিশ চারদিকে তাকাল। তারপর জিজ্ঞেস করল,
“কয়টা বাজে এখন?”
রুশা চারদিকে চেয়ে ঘড়ি খোঁজল। না পেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি সেজান ভাইকে জিজ্ঞেস করছি।”
“ওকে ভেতরে আসতে বলো।”
রুশা সেজানকে ডেকে আনল। সেজান ভেতরে এসে প্রথমে আদ্রিশের খোঁজ খবর নিন। তারপর জানাল এখন রাত ১০টা ১৭ মিনিট।
আদ্রিশ সেজানকে বলল,
“রুশা একা বাড়িতে থাকতে পারবে না। আমি বাড়িতে যেতে চাই।”
রুশা আর সেজান চমকে একে অপরের দিকে তাকাল। তারপর আদ্রিশকে সেজান বলল,
“আপনাকে এই অবস্থায় ছাড়বে না।”
রুশা বলল,
“আপনি যাবেন কি করে? উঠেই তো বসতে পারবেন না।”
আদ্রিশ চেষ্টা করে দেখল ও আসলেই উঠে বসতে পারছে না। তারপর কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“রুশাকে আমি একা ছাড়ব না। ওর এখানে থাকার ব্যবস্থা করে দেও। ওর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এখানে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করো। আর হ্যা আমি অসুস্থ। রুশার সিকিউরিটির ব্যবস্থা করো।”
“জি ভাই, আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আমিও আজ এখানে থাকব।”
সেজান সব ব্যবস্থা করতে চলে গেল। আদ্রিশ রুশাকে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি ঠিক আছো?”
“হ্যাঁ ঠিক আছি।”
আদ্রিশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“তুমি রিভলবার চালানো কোথায় শিখলে?”
রুশার বুক ধুক করে উঠল। তখন আদ্রিশকে শুনিয়ে শুনিয়ে এতকিছু বলল তবুও কেন জিজ্ঞেস করছে? আদ্রিশ সব শুনেছে এটা শিউর। তারপরেও যেহেতু জিজ্ঞেস করছে
নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে।
“আমি রিভলবার চালাতে পারিনা। আমি তো মুভির মতো ভয় দেখানোর জন্য অভিনয় করেছিলাম কিন্তু গুলি বেড়িয়ে গেল। বিশ্বাস করুন আমার কাউকে মারার ইচ্ছে ছিল না। আমার মাথা কাজ করছিলো না। কি করব বুঝতে পারছিলাম না। তাই হুট করে যা মাথায় এলো তাই করেছি। রিভলবার হাতে নিয়ে ওসব বলে ফেলেছি। আর গুলি বের হয়ে গেছে।”
রুশা বলেই কাঁদতে লাগল।
“এর আগে তো আমি রিভলবার কখনো হাতেই নেইনি। কলেজে থাকতে মাঠে খেলা হতো, সেখানে আমরা ফ্রেন্ডরা যেতাম। বাজি ধরে বিভিন্ন খেলা খেলতাম। ওখানে ছোট ছোট বেলুন টানিয়ে রাখত। বন্দুক দিয়ে নিশানা করে ফোটাতে হতো। আমরা সেসব খেলতাম। তবে বন্দুকের বুলেট আসল ছিল না। আমি কখনো দশটার মধ্যে ছ’টার বেশি ফাটাতে পারতাম না। ওই বন্দুক ছাড়া কিছু চালাতে পারতাম না।”
আদ্রিশ চোখ বন্ধ করে বলল,
“ঠিক আছে।”
রুশা ঠিক বুঝতে পারছে না আদ্রিশ বিশ্বাস করল কি না। রুশা আজকের ঘটনাটা ভুলতে পারবে না। আর সিদ্ধান্ত নিল এই ঘটনা কিছুতেই ভাইয়ের কানে দেওয়া যাবে না। তাহলে আবারও রাগ করবে।
কিছুক্ষণ পরে সেজান চলে এল। আদ্রিশের কাছে এসে বলল,
“সব ডান ভাই।”
তারপর রুশার হাতে শপিং ব্যাগ দিয়ে বলল,
“ভাবি আপনার জামাকাপড়। ফ্রেশ হয়ে নিন।”
রুশা ওয়াশরুমে যেতেই আদ্রিশ জিজ্ঞেস করল,
“সব ঠিক আছে?”
“জি ভাই, অল সেট। অপেক্ষা আপনার সুস্থ হওয়ার। তারপর আসল খেলা। আমি বাইরে আছি। প্রয়োজনে ডাকবেন।”
সেজান ওর পাশে একটা মোবাইল রেখে বাইরে চলে গেল।
রুশা ফ্রেশ হয়ে আদ্রিশকে খাইয়ে দিল। তারপর নিজেও খেয়ে নিল। ওর মাথাটা কেমন করছে। খুব টায়ার্ড লাগছে। একটু ঘুমানো দরকার। ওকে ঝিমাতে দেখে আদ্রিশ বলল,
“শুয়ে পড়ো। আমার আর সেবা করতে হবে না।”
রুশা কিছুক্ষণ আদ্রিশকে দেখল। তারপর উঠে গিয়ে শুয়ে পড়ল। আদ্রিশ এভাবে কেন কথা বলছে জানে না। বুঝতে পারছে না কিন্তু অভিমান হচ্ছে। কান্না পাচ্ছে খুব৷ চোখে পানি ছলছল করছে। আদ্রিশের এই সামান্য কথায় কষ্ট হচ্ছে কেন বুঝতে পারছে না। কষ্ট পাওয়ার তো কথা না। তবুও পাচ্ছে।
চলবে…..
#লাভ_গেম
#ফাবিহা_নওশীন
১৭.
তিনদিন পরে আজ আদ্রিশকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে। শরীর কিছুটা ফিট হলেও পায়ে ব্যথা আছে৷ ডাক্তার বলেছে কমপক্ষে চার-পাঁচ দিন ফুল রেস্ট করতে। রুশা আদ্রিশের পিঠে বালিশ ঠিক করে দিল। আদ্রিশ আধশোয়া হয়ে আছে। শুয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত লাগছে। রুশা আদ্রিশের দিকে রিমোট বাড়িয়ে দিল। আদ্রিশ নিউজ চ্যালেন দেখছে। রুশা প্রেসক্রিপশন আর ওষুধ মিলিয়ে দেখছে। আদ্রিশ আড়চোখে ওর দিকে চেয়ে আছে। রুশার কপালে কিঞ্চিৎ ভাজ পড়েছে। ওষুধের পাতা এপিঠ ওপিঠ উল্টে পালটে দেখছে। ঠোঁট নাড়িয়ে নাড়িয়ে পড়ছে। একে একে ওষুধের বক্সে ওষুধ রাখছে। ওষুধ রেখে আদ্রিশের দিকে চেয়ে বলল,
“আমি আপনার জন্য খাবার নিয়ে আসি। ওষুধ খাওয়ার সময় হয়ে গেছে।”
আদ্রিশ টিভির দিকে চেয়ে বলল,
“সেজন্য বাড়িতে কাজের লোকের অভাব নেই। তুমি রিলেক্স থাকো।”
রুশা আদ্রিশের কথা শুনে অবাক হলো না। আর কষ্টও পেল না। কারণ এই কয়েকদিন আদ্রিশ ওর সাথে এভাবেই কথা বলেছে। রুশা চুপচাপ ঘর থেকে বের হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে ওর খাবার এনে ঠাস করে সামনে রেখে বলল,
“খেয়ে নিন।”
আদ্রিশ রুশার দিকে তাকাল। রুশা গাল ফুলিয়ে রেখেছে। অন্যদিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আদ্রিশ খাবারে হাত বাড়ালো কিন্তু হাত দিয়ে ঠিকমতো ধরতে পারছে না। হাতে তখনও ব্যথা আছে।
“আমি কি করে খাব? দেখছো না হাতে ব্যান্ডেজ করা? এখনো ব্যথা আছে।”
“আপনার আবার ব্যথা আছে? শুনে অবাক হলাম। যাইহোক, আপনার সব কাজের জন্য কাজের লোক তো আছেই। দাঁড়ান, ওদের ডেকে দেই। ওরা মুখে তুলে খাইয়ে দেবে। কেমন?”
আদ্রিশ রুশার কথা শুনে চোখ বড়বড় করে তাকাল।
“কি আমি কাজের লোকের হাতে খাব?”
“তাহলে কে খাইয়ে দিবে?”
“তুমি। এতদিন তো তুমিই দিতে।”
রুশা কোমড়ে হাত দিয়ে বলল,
“পারব না। আমি আপনাকে খাইয়ে দিতে পারব না। আমি আপনার কাজের লোক নই। এতদিন ধরে অনেক কথা শুনিয়েছেন। রোজ রোজ খাইয়ে দিচ্ছি এখন কাজের লোক দেখাচ্ছেন? তাদের হাতেই খান। আমি পারব না।”
রুশা কথা শেষ করে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে ঘর থেকে চলে গেল। আদ্রিশ ওর যাওয়ার দিকে চেয়ে রইল আর আপসোস করতে লাগল নিজের কথার জন্য। এখন নিজের হাতে খেতে হবে। ভালোবাসার মানুষের হাতে খাওয়া আর নিজের কাটাছেঁড়া হাতে খাওয়া কি এক কথা?
.
রাত দুইটা। রুশা গভীর ঘুমে। ওর সারাদিন কাটে আদ্রিশকে নিয়ে। আদ্রিশ হঠাৎ করেই মাঝরাতে জেগে যায়৷ ভাবতে থাকে রুশার কথা। অনেক কিছু বুঝে, জেনেও না জানার ভান করে থাকা কতটা কষ্টকর সেটা টের পাচ্ছে। আদ্রিশ ধীরে ধীরে শোয়া থেকে বিছানায় বসে। কিছুক্ষণ বসে থেকে বিছানা থেকে নামে। দু পা আগাতেই অন্ধকারে টেবিলে পা বেঁধে হোচট খেয়ে পড়ে যায় আদ্রিশ। কিছু পড়ার শব্দে রুশা জেগে যায়। পাশে আদ্রিশকে না পেয়ে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে। ডিম লাইটের আলোতে আদ্রিশকে দেখে বেডসাইড লাইট অন করে বিছানা থেকে নামে। আদ্রিশকে দেখে বুঝা যাচ্ছে ও ব্যথা পেয়েছে।
“কি অদ্ভুত আপনি! ডাক্তার বারবার সাবধানে থাকতে বলেছে। পায়ের খেয়াল রাখতে বলেছে। আপনি এই অন্ধকারে একা একা উঠে গেলেন? আমাকে ডাকতে নাহয় সমস্যা। অন্তত লাইটটা অন করে নিতে পারতেন। এত কেয়ারলেস কেন আপনি?”
“তোমার ঘুম যেন না ভাঙ্গে তাই অন করিনি। ধন্যবাদ লাইট জ্বালানোর জন্য।”
আদ্রিশ ওয়াশরুমে চলে গেল। রুশা ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত দুইটা তেরো মিনিট। বেশি রাত হয়নি। রুশা গিয়ে বারান্দায় দাঁড়াল। আশেপাশের অনেক বিল্ডিংয়ে এখনো আলো জ্বলছে। এখনো অনেক পরিবার জেগে আছে। আদ্রিশ ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে রুশাকে না দেখে এদিক সেদিক খুঁজতে লাগল।
“রুশা!”
রুশা বারান্দা থেকে সাড়া দিল।
“আমি বারান্দায়।”
“এত রাতে বারান্দায় কি করছো? দরজা বন্ধ করে শুতে এসো।”
রুশা শেষ বার আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে জ্বলজ্বল করা তারাগুলো দেখল। মনের ভেতরে প্রশান্তি বয়ে যাচ্ছে। মুচকি হেসে ভেতরে এলো। আদ্রিশ শুয়ে আছে। রুশাকে ঘরে দেখে নিশ্চিত হয়ে চোখ বন্ধ করল। রুশা এসে ওর পাশে শুয়ে পড়ল।
.
সেজান এসেছে আদ্রিশের সাথে দেখা করতে। ড্রয়িংরুমে বসে অপেক্ষা করছে। কথা রান্নাঘর থেকে ট্রে করে নাস্তা এনে সেজানের সামনে রাখল। সেজান কথাকে দেখে চমকে গেল। বসা থেকে দাঁড়িয়ে বলল,
“তুমি!”
কথা মুচকি হেসে বলল,
“এটা আপনার বসের বাড়ির পাশাপাশি রুশা আপুর বাড়ি। তাই নিশ্চিত থাকুন আপনাকে ফলো করছি না।”
সেজান ওর কথা শুনে হেসে বলল,
“তা কখন বললাম?”
“মজা করলাম। নিন খেয়ে নিন। আমি যাচ্ছি।”
“কোথায় যাচ্ছো?”
কথা আবারও হেসে বলল,
“আশ্রমে চলে যাচ্ছি না। রান্নাঘরে যাচ্ছি। রুশা আপুর জন্য তার পছন্দের কেক বানাচ্ছি। আপনি চাইলে খেয়ে যেতে পারেন।”
“ধন্যবাদ। আমি বেশিক্ষণ থাকব না। ভাইয়ের সাথে কথা বলে চলে যাব।”
কথা আর কিছু বলল না। রান্নাঘরে চলে গেল।
রুশা আদ্রিশের ওষুধ খাইয়ে নিচে আসবে তখন সার্ভেন্ট এসে জানাল সেজান এসেছে। ও আদ্রিশের সাথে দেখা করতে চায়। আদ্রিশ সেজানের আসার কথা শুনে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়।
“আপনি এই পা নিয়ে নিচে যাবেন?”
“কিছু হবে না। আমি যেতে পারব।”
“আপনি সিড়ি ভেঙে যেতে পারবেন না। আমি নিচে যাচ্ছি। সেজান ভাইকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
“সেজান বেডরুমে আসবে?”
“আপনার ভাই-ই তো। সমস্যা কি? আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
রুশা নিচে চলে গেল। সেজানকে ঘরে আসতে বলে রুশা রান্নাঘরে গেল। কথা কেক বানাচ্ছে। রুশা ওর সাথে টুকটাক কথা বলছে আর ওর কেক বানানো দেখছে। রুশা রান্নাবান্না কিছুই জানে না।
সেজান ঘরে যেতেই আদ্রিশ উঠে বসে।
“কেমন আছেন ভাই?”
“এই তো ভালো আছি। জারিফের কি খবর?”
সেজান মৃদু হেসে বলল,
“খাঁচায় বন্দী পাখির মতো ছটফট করছে।”
“আর কিছুদিন ছটফট করুক। বন্দী জীবনটা অনুভব করুক। তারপর একবারে খালাস করে দেব। কেউ হদিস পাবে না। জানোয়ারের বাচ্চাটা এতবড় মাফিয়া হয়ে আমার মতো বিজনেসম্যানের হাতে মরবে। কেন যেচে মরতে এলি?”
“আপনার হাতে মরবেই বলে দেশে এসেছে।”
“সাপের লেজে পা দিয়েছে কামড় তো খেতেই হবে। আচ্ছা, রুশার গুলি করার ব্যাপারে তোমার কি মতামত?”
সেজান ঠিক বুঝতে পারল না আদ্রিশ কি মিন করেছে।
“ভাবি একদম ঠিক করেছে। যদিও বুঝে করেনি। এ নিয়ে উনি বেশ আপসেট।”
আদ্রিশ ওর কথা শুনে মৃদুস্বরে হাসল।
“আর তিনদিন, তারপর জারিফের খেলা শেষ। ওর ঠিকঠাক যত্ন করো কিন্তু সেজান।”
সেজান বাকা হেসে বলল,
“জি ভাই ওর বেশ যত্ন চলছে।”
।
তিনদিন পর। রুশা ঘরে এসে আদ্রিশকে না পেয়ে ওয়াশরুমে খুঁজে দেখল। সেখানেও নেই। রুশা আদ্রিশের নাম ধরে কয়েকবার ডেকে ঘরের বাইরে দেখে আবারও ঘরে এলো। আদ্রিশ বারান্দা থেকে এসে বিরক্তি নিয়ে ওর দিকে চেয়ে আছে। রুশা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। আদ্রিশকে না দেখে বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিল।
আদ্রিশ বিরক্তি ফুটিয়ে বলল,
“এভাবে চেঁচাচ্ছো কেন?”
“তো কি করব? আপনি কোথায় চলে গিয়েছিলাম?”
“আমি ছোট বাচ্চা নই।”
“আমি জানি আপনি ছোট বাচ্চা নন। কিন্তু আচরণ ছোট বাচ্চাদের মতো করছেন। এই রাতের বেলায় আপনার গায়ে বাইরে যাওয়ার পোশাক কেন? এত রাতে কোথায় যাচ্ছেন?”
“কাজ আছে।”
আদ্রিশ ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আয়না দেখে চুল ঠিক করছে।
রুশা ওর সামনে গিয়ে বলল,
“মানলাম আপনার পা আগের চেয়ে ভালো তাই বলে বাইরে বেরিয়ে পড়বেন? আর কিছুদিন….
” উফফ! রুশা! এত ঘ্যানঘ্যান করো না। তোমাকে এত ভাবতে হবে না।”
রুশা ত্যাড়া ভাবে উত্তর দিল,
“তাহলে কে ভাববে? অন্য মেয়ে?”
“তুমি কেন ভাববে?”
“আমি আপনার স্ত্রী।”
“সো হোয়াট?”
“স্ত্রী তার স্বামীকে নিয়ে ভাববে এটা স্বাভাবিক। আপনি এখন কোথাও যাচ্ছেন না। এই মুহুর্তে মারামারি, গুলাগুলি করা উচিত হবে না।”
আদ্রিশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“মারামারি, গুলাগুলি? তোমাকে কে বলল?”
“বলতে হবে? আপনার এই অবস্থা যে করেছে তাকে এমনি এমনি ছেড়ে দিবেন? আপনি প্রতিশোধ নিবেন স্বাভাবিক।”
“তাহলে বাঁধা দিও না লাভ হবে না।”
আদ্রিশ রিভলবার গুজে নিল। রুশার নিজেকে অসহায় লাগছে। এই অবস্থায় আদ্রিশকে যেতে দিতে চায় না। না জানি আবার কোন বিপদ হয়।
রুশা অসহায় মুখ করে আকুতি মিনতি করে বলল,
“আমার কথাটা রাখুন প্লিজ। আর দুটো দিন পরে যাবেন।”
আদ্রিশ এইবার প্রচন্ড রেগে গেল।।
“রুশা, বাড়াবাড়ি করছো তুমি। বেশি অধিকার খাটাতে আসবে না। এসব আমার একদম পছন্দ না।”
“আমি আপনার ভালোর জন্য বলছি।”
আদ্রিশ রুশার দুবাহু চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“কে ভালো ভাবতে বলেছে? আমাকে তো তোমার পছন্দ না। আজ আমি মরে গেলে তুমি বেঁচে যাবে সারাজীবনের মতো বেঁচে যাবে। নতুন করে জীবন শুরু করতে পারবে। তাই রিলেক্স থাকো। বসে বসে আমার মৃত্যু কামনা করো। আমার লাশ তোমাকে শান্তি দেবে। তাহলেই তোমার মুক্তির পথ সুগম হবে।”
রুশার গাল বেয়ে পানি পড়ছে। ওর বুকের ভেতরটা ভেঙেচুরে যাচ্ছে। আদ্রিশের দিকে অপলক নয়নে চেয়ে আছে। আদ্রিশকে যে ও ভালোবাসে সেটা অনুভব করতে পেরেছে অনেক আগেই। আদ্রিশ ওকে জিজ্ঞেস করল,
“কাঁদছো কেন?”
রুশা আরো জোরে কাঁদতে লাগল। কাছের মানুষের মৃত্যু সহ্য করার মতো শক্তি আর অবশিষ্ট নেই ওর মাঝে। আদ্রিশ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল ওর কান্না দেখে। রুশা আচমকা ওকে জড়িয়ে ধরল।
কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমি আর কারো মৃত্যু সহ্য করতে পারব না।খুব কষ্ট হয় আমার। আপনাকে আমার পছন্দ না কিন্তু আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি।”
‘ভালোবাসি’ শব্দটা শুনে আদ্রিশের পুরো পৃথিবী এলোমেলো হয়ে গেল। মুহুর্তেই সব রাগ পড়ে গেল। চারদিক যেন আলোকিত হতে লাগল। মনে হচ্ছে শূন্যে ভাসছে।
আদ্রিশ রুশাকে বুক থেকে সরিয়ে দাঁড় করিয়ে চোখের পানি মুছে বলল,
“কি বললে তুমি?”
” যা শুনেছেন তাই বলেছি। আর বলতে পারব না।”
আদ্রিশ যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। মনে হচ্ছে ভুল শুনেছে।
“ভালোবাসো তুমি? আমাকে?”
রুশা মাথা নামিয়ে শীতল কণ্ঠে বলল,”হুম।”
আদ্রিশ রুশাকে জড়িয়ে নিল। ওর বুকের ভেতর ঢোল তবলা সব বাজছে। মোবাইল বের করে সেজানকে কল করল। সেজান বাইরে অপেক্ষা করছিল। ও আদ্রিশের বাড়ির দিকে একবার চেয়ে কল রিসিভ করল।
“সেজান, আজকে যাব না। শরীর ভালো লাগছে না। তুমি চলে যাও।”
সেজান কিছুই বুঝতে পারল না। জি বলে কল কেটে চলে গেল।
রুশা মাথা তুলে আদ্রিশের দিকে চেয়ে মৃদু হাসল। আদ্রিশ রুশার দিকে তাকাতেই রুশা চোখ নামিয়ে নিল। আদ্রিশের দৃষ্টি অনেক কিছু বলছে। আদ্রিশ ওর কপালে ঠোঁট ছুইয়ে দিলে রুশা আবেশে চোখ বন্ধ করে নেয়। ওর সারা শরীরে শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। আদ্রিশের গলা জড়িয়ে ধরে। আদ্রিশ ওর ঠোঁটযুগল নিজের আয়ত্তে নেয়। ভালোবাসার ছোঁয়ায়
হারিয়ে যাচ্ছে দুজন ভালোবাসার মানুষ।
চলবে…..