#লাভ_গেম
#ফাবিহা_নওশীন
৩৭.
রুশার শাস্তি না হলেও রুশা মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সারাদিন একা একা চুপচাপ বসে থাকে। কারো সাথে কথা বলে না, ঠিক মতো খায় না এমনকি আর্দ্রের যত্নও নেয় না। আদ্রিশ এইজন্য রুশার উপর রেগে আছে কিন্তু কিছু বলতে পারছে না। কথার কাছে সারাক্ষণ আর্দ্র থাকে।
রুশা বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে রেলিঙে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে৷ একটা দোয়েল পাখি বারবার রেলিঙের উপরে এসে বসছে আবার উড়ে যাচ্ছে। মৃদুস্বরে শিষ বাজাচ্ছে। রুশা সেদিকে কান পেতে রেখেছে। আদ্রিশ ঘরে এসে রুশাকে না পেয়ে বারান্দায় এসে ওকে দেখল। আদ্রিশ বারান্দায় আসতেই দোয়েল পাখি উড়ে চলে গেল। আদ্রিশ কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করল,
“কী সমস্যা তোমার রুশা? ছেলেটা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ল। ওকে ছুয়েও দেখছো না। খাওয়াচ্ছো না ঠিকমতো। কথার কাছে থাকে সারাক্ষণ। বাচ্চাটা কার? কথার না তোমার? ওর কীসের দায়? কিছুদিন পরে ওদের বিয়ে, ওর স্পেস প্রয়োজন। তাছাড়া বিয়ের পর নিজের লাইফ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে। তখন আর্দ্রের কী হবে?”
রুশা আদ্রিশের কথায় কোন জবাব দিল না। যেভাবে ছিল সেভাবেই বসে আছে। ওর ভাবাবেগ না দেখে আদ্রিশের প্রচন্ড রাগ হলো। দরজায় সজোরে একটা লাথি মারল। রুশা কেঁপে উঠে। মাথা উঁচু করে আদ্রিশের দিকে তাকায়।
আদ্রিশ রাগান্বিত কন্ঠে বলল,
“কীসের শোক পালন করছো? একটা নিচ, খুনীকে মেরেছো। ও তোমার বড় ভাইয়ের খুনি। তার জন্য কীসের এত দরদ?”
রুশার চোখ ছলছল করছে। গলা ধরে আসছে। যেমনই হোক ছোট থেকে এক সাথে বিশ্বাস, ভালোবাসার স্পর্শ নিয়ে বড় হয়েছে।
আর সে ভাইদের নিয়ে নতুন রহস্য সামনে এসেছে। তার উপর নিজের হাতে নিজের ভাইকে মেরেছে৷ এসব ওর জন্য চারটে খানি কথা না। এখন মনে হচ্ছে নিজের হাতে না মেরে আইনের মাধ্যমে ওকে শাস্তি দিলে ভালো হত। নিজের হাত রক্তাক্ত হত না। আর মা সেই ঘটনা ওকে কুড়ে কুড়ে খেত।
“কী চাও আর? তোমার করা অন্যায়গুলো মাফ করেছি। তোমাকে ভালোবেসেছি। তোমার বড় ভাইয়ের খুনিকে খুঁজে বের করতে সাহায্য করেছি। তাকে শাস্তি দিতে সাহায্য করেছি। সাজ্জাদ চৌধুরীর মৃত্যুর রহস্য সবার কাছে তুলে ধরেছি। তোমাকে জেল যাওয়ার থেকে বাঁচিয়েছি। এর জন্য আমাকে কত কী করতে হয়েছে তুমি জানো? কিভাবে কেস সাজিয়েছি আমি জানি। সব করেছি। আর কী করব? তোমার যেমন কেউ নেই তেমনি আমারও কেউ নেই। আমি দুঃখ করি না তবে তুমি কেন?”
রুশার গাল বেয়ে পানি পড়ল। চোখের পানি মুছে বলল,
“আমি চেষ্টা করছি স্বাভাবিক হতে কিন্তু পারছি না।”
আদ্রিশ চেঁচিয়ে বলল,
“হুয়াই ডেম ইট?”
রুশা ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। আদ্রিশ নিজেকে শান্ত করে ওর পাশে বসে ওকে বুকে টেনে নিল।
“আমি তোমার জন্য আছি। তুমি আমার জন্য আছো। তোমার দুঃখ কষ্ট সবকিছু আমার। তোমার আমার দুজনের একটা পরিবার আছে। আমাদের ফুটফুটে একটা ছেলে আছে। ওর কথা ভেবে আমাদের স্বাভাবিক হতে হবে। তুমি ওর মা। তোমাকে স্ট্রং হতে হবে। ওর ভবিষ্যতের কথা ভাবো। ওর আমরা ছাড়া আর কে আছে?”
আদ্রিশ রুশার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
“হ্যা, আমাকে পারতে হবে। আর্দ্রকে মানুষের মতো মানুষ করব। কোন কিছুর অভাব বুঝতে দেব না। ওর সব চাওয়া পূরণ করব।”
আদ্রিশ রুশার মাথায় ঠোঁট ছুয়ালো। আদ্রিশ ভেবে পায় না ও এত বদলে গেল কি করে। আগে হলে এতক্ষণে তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে দিত। আর এখন নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে শিখে গেছে৷ নরম গলায় বুঝিয়ে কথা বলে। রুশার অদ্ভুত ব্যবহারগুলো সহ্য করতে পারছে। হয়তো ভালোবাসা ওকে এত বদলে দিয়েছে। হয়তো সন্তানের প্রতি দায়িত্ববোধ সৃষ্টি হয়েছে। স্ত্রী সন্তানের কথা ভেবে সংসারে শান্তি বজায় রাখা জরুরি সেটা বুঝে গেছে। আদ্রিশ মুচকি হাসল।
.
আজকে কথার গায়ে হলুদ। রুশা শপিংয়ের কথা বলে বেরিয়েছে। উদ্দেশ্য রকির সাথে দেখা করা। রুশা সরাসরি ওর অফিসে চলে যায়৷ রকি একটা মিটিংয়ে ছিল। রুশার আসার কথা শুনে মিটিং রেখে ওর সাথে মিট করতে চলে এসেছে। রুশাকে দেখে মৃদু হেসে বলল,
“আরে তুমি! কী মনে করে?”
রুশা ওর হাসিকে পাত্তা না দিয়ে কাঠ গলায় বলল,
“খবর পেয়েছো নিশ্চয়ই?”
“পাব না আবার? এত বড় ঘটনা ঘটিয়েছে আর কিছুই জানব না?”
“তুমি সব জানতে তাই না? শান ভাইয়ার সাথে তুমিও যুক্ত ছিলে তাই না?”
রকি কপাল কুঁচকে বলল,
“পাগল তুমি? শান আমাকে কেন বলবে? আর আমি ওর সাথে কেন থাকব? একদম শেষ সময়ে আমি জেনেছি তবে পুরোপুরি নয়। সাজ্জাদ চৌধুরী আমাকে তোমার জন্য পছন্দ করেছিল। তোমার দেশে আসার নিউজ শুনে শানের সাথে কথা বলতে গেলে জানায় আদ্রিশ সাজ্জাদ চৌধুরীকে খুন করেছে। আর তুমি তার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছো। তুমি প্রতিশোধ না নিয়ে বিয়ে করবে না। তাই তোমাকে যদি বিয়ে করতে চাই তাহলে তোমাকে যেন তোমার কাজ শেষ করতে সাহায্য করি। যত দ্রুত কাজ শেষ হবে তত তাড়াতাড়ি আমাদের বিয়ে হবে। তাই সাহায্য করেছি। নয়তো কেউ জেনেশুনে নিজের হবু বউকে অন্যের লাইফে পাঠায়। তাকে বিয়ে করতেও সাহায্য করে? পাগল নাকি?”
“তুমি কখন জেনেছো সত্যিটা?”
“শপিংমলে দেখা হওয়ার কয়েকদিন আগে।”
রুশার কপাল কুঁচকে এল। ইচ্ছে করছে ওকে এখানেই গুলি করে ঝাঁঝরা করে দিতে কিন্তু অফিসের মধ্যে এত মানুষের মধ্যে খুন করলে সমস্যা হয়ে যাবে। নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে।”
রুশা চোখ বন্ধ করে দু’হাতে মাথা চেপে ধরল। রকি ওকে পর্যবেক্ষণ করে বলল,
“হঠাৎ আমার কাছে আসার কারণ জানতে পারি?”
রুশা চোখ খুলে ওর দিকে তাকাল। লাল টকটকে চোখে ওর দিকে চেয়ে চোয়াল শক্ত করে কিছু বলতে যাবে তখন একটা মেয়ে এল। রকি মেয়েটিকে দেখে আহ্লাদী হয়ে পড়ে। তার দিকে দু’পা এগিয়ে গিয়ে হাগ করে। রুশা বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। রকি রুশার দিকে চেয়ে বলল,
“পরিচয় করিয়ে দেই। আমার ওয়াইফ অন্তরা।”
রুশা রকির কথা শুনে কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকাল। অল্প বয়সী সুন্দরী মেয়ে।
“কতদিন হয়েছে বিয়ের?”
“এক মাস হয়নি।”
রুশা মেয়েটির দিকে আরেকবার চেয়ে মনে মনে বলল,
“এই মেয়েটার জন্য বেঁচে গেলি। একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়েকে বিধবা করতে চাই না।”
রুশা অন্তরার সাথে টুকটাক কথা বলে বিদায় নিল। রকির চ্যাপ্টার এখানেই শেষ করে দিল। নিজের রিভলবারটা নদীতে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। ফেরার পথে সাজ্জাদের কবরে গিয়ে দোয়া করে বাড়িতে ফিরেছে।
পুরো বাড়ি সাজানো হয়েছে। আলোয় ঝলমল করছে। রুশা কথার রুমে গিয়ে উঁকি দিল। ও সাজগোজের জন্য ব্যস্ত। রুশা ওর ঘরে আর গেল না। আর্দ্রকে কোলে নিয়ে চুমু খেয়ে উপরে চলে গেল। আদ্রিশ কোন পাঞ্জাবি পরবে সেটা দেখছে৷ রুশা আর্দ্রকে দোলনায় শুইয়ে দিল। ও খেলছে একা একা। রুশা মেরুন রঙের একটা পাঞ্জাবি আদ্রিশের দিকে দিয়ে বলল,
“এটা পর। যেমন করছো মনে হচ্ছে তোমার বিয়ে।”
আদ্রিশ নিজেকে আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলল,
“আরেকটা বিয়ে করা যায়। কি বলো?”
রুশা চোখ ছোট ছোট করে আদ্রিশের দিকে তাকাল। আদ্রিশ হেসে ফেলল। ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে চলে গেল।
রুশা বাসন্তি রঙের লেহেঙ্গা পরেছে। গা ভর্তি গয়না, দুহাতে কাচের চুড়ি, চুলে বিনুনি করে ছোট ছোট অর্কিড ফুল গুজে দিয়েছে। হলুদের উপযোগী মেক আপ। আদ্রিশ আর্দ্রকে তৈরি করে দিয়েছে। রুশা আদ্রিশের সামনে এসে বলল,
“আমাকে কেমন লাগছে?”
আদ্রিশ আর্দ্রকে রেখে ওর দিকে ঘোরলাগা চোখে তাকাল। রুশা ওর চাহুনি দেখে ঢোক গিলল। এই ছেলে কোন পাগলামি করে না ওর মেক আপ নষ্ট করে দেয়৷ রুশা ওর সামনে থেকে সরে যেতে নিলে আদ্রিশ ওর হাত ধরে ফেলে।
রুশা চোখ মুখ খিঁচে বলল,
“আমার মেক আপ নষ্ট করবে না।”
আদ্রিশ ঘনঘন পলক ফেলে বলল,
“আমি মেক আপ কেন নষ্ট করব? আমি তো তোমাকে দেখছি।”
“তোমাকে দিয়ে বিশ্বাস নেই। আমার হাত ছাড়ো।”
আদ্রিশ রুশাকে আরো গভীরভাবে জড়িয়ে ধরল। নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলল,
“শুধু শুধু অপবাদ দিচ্ছো আমায় তাই না? তাহলে সত্যি করে দেই।”
রুশা চোখ বড়বড় করে না করল। আদ্রিশ ওর ঠোঁটে ঠোঁট স্পর্শ করল। রুশা ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকাল। আদ্রিশ মিটমিট করে হাসছে। রুশা নিজের হাই হিল দিয়ে ওর পায়ে জোরে আঘাত করল। আদ্রিশ ব্যথা পেয়ে “আহ” শব্দ করে ওকে ছেড়ে দেয়। রুশা মুখ ভেংচি কেটে আয়নার সামনে গিয়ে লিপস্টিক ঠিক করে আবারও আদ্রিশকে মুখ ভেংচি কাটল। আদ্রিশ হেসেই যাচ্ছে। রুশা নিচে চলে গেল রাগে গজগজ করতে করতে।
কথা আর সেজানকে স্টেজে আনা হয়েছে। ওরা পাশাপাশি বসে আছে। এক সাথেই ওদের হলুদের অনুষ্ঠান হচ্ছে। সেজান সুযোগ বুঝে বারবার কথাকে ইরিটেট করছে। কথা কিছুক্ষণ পর পর বিরক্তি নিয়ে ওর দিকে তাকাচ্ছে আর সেজান হাসছে। সেজানের হাসি দেখে কথাও হেসে ফেলল।
রুশা ওকে হাসতে দেখে গলা ঝেরে বলল,
“কী ব্যাপার কথা? হাসছিস কেন? ব্যাপার কী হা?”
“কিছু না আপু।”
“সবই বুঝি। সেজান ভাইয়া সবার আড়ালে রোমান্স করছে বুঝি?”
সেজান খুকখুক করে কাশতে লাগল।
“কি জামাই মিয়ার যক্ষা নাকি? যক্ষা রোগীর কাছে বোন বিয়ে দেব না।”
কথা রুশার কথা শুনে বলল,
“একদম। আমিও যক্ষা রোগীকে বিয়ে করব না।”
সেজান বলল,
“কী বললে? আমি যক্ষা রোগী হলে এই যক্ষা রোগীকেই বিয়ে করে যক্ষায় যক্ষিত হতে হবে।”
কথা আর রুশা দুজনেই হেসে ফেলল ওর কথা শুনে। রুশা তারপর কথার মাথায় হাত রেখে বলল,
“দোয়া করি সব সময় ভালো থাকো। জীবনে অনেক সুখী হও। সেজান ভাইয়া আমার বোনটাকে দেখে রাখবেন। কখনও চোখের পানি ফেলতে দিবেন না।”
“আপনি চিন্তা করবেন না। আমি ওকে অনেক ভালো রাখব। কোন অভিযোগ করতে দেব না।”
হলুদের অনুষ্ঠান শেষ করে, ফ্রেশ হতে হতে রাত তিনটা বেজে গেছে। আর্দ্র আর আদ্রিশ ঘুমিয়ে পড়েছে। রুশা ফ্রেশ হয়ে মাত্র বের হলো। ওর অনেক ক্লান্ত লাগছে। বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দিল। গা এলিয়ে দিতেই আদ্রিশ শোয়া থেকে উঠে ওর দিকে ঝুঁকে পড়ল। রুশা কিছু বোঝার আগেই আদ্রিশ ওর ঠোঁট নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিল। রুশা প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও পরবর্তীতে আদ্রিশের ডাকে সাড়া দিল। দীর্ঘদিন পরে ভালোবাসার আরেকটা রাত পেল দুজন।
.
সকাল থেকেই তোরজোর আয়োজন চলছে। রুশা আজ শাড়ি পরেছে,আদ্রিশ স্যুট। কথা সিলভার রঙের ভারী লেহেঙ্গা পরেছে। লেহেঙ্গার গায়ে সাদা রঙের দামী পাথরের কাজ। সেজান ওর সাথে ম্যাচিং করে সেরোয়ানী পরেছে। ধুমধাম করে কথা আর সেজানের চারহাত এক করে দিল আদ্রিশ। সবাই প্রাণভরে দোয়া করল ওদের সুখী দাম্পত্য জীবনের জন্য।
চলবে….