অল্প থেকে গল্প পর্ব-২২+২৩

0
621

অল্প থেকে গল্প🍁
অরিত্রিকা আহানা
পর্ব:২২

সকালবেলা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লো মিলাদের আয়োজন নিয়ে।প্যান্ডেল করে আত্মীয়স্বজন গরিব দুঃখিদের খাওয়ানো হবে।গতকাল রাত থেকেই আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।মাঝে মাঝে তীব্র আলো চিলিক দিয়ে উঠছে।বাই এনি চান্স বৃষ্টি হলে সমস্যা হয়ে যাবে।তাই ওপরে ওয়াটার প্রফ তেরপাল টাঙ্গানো ব্যাবস্থা করা হচ্ছে।পুরুষেরা সবাই প্রায় কোন না কোন কাজে ব্যস্ত!

তিনতলা বিল্ডিং এর সামনের আঙ্গিনায় প্যান্ডেল করা হচ্ছে।সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়েছে,শুদ্ধ পুরোটা সময় প্যান্ডেলের দিকেই ব্যস্ত ছিলো।দশ বছরের ছোট্ট জারা এসে হঠাৎ ওর গেঞ্জির কোনা ধরে টান দিলো। ঘাড় ফিরিয়ে ওর দিকে তাকালো শুদ্ধ।জারা এইবাড়ির একমাত্র ছোট সদস্য।ফুটফুটে পুতুলের মত দেখতে।মেজোমামার বড় ছেলের একমাত্র মেয়ে।বাকি মামাতো ভাইয়েরা দুএকজন বিয়ে করলেও বাচ্চাকাচ্চা হয় নি।শুদ্ধ মিষ্টি হেসে বলল,
—তুমি খালি পায়ে কেন মামনি?
জারা গুরুগম্ভীর কন্ঠে জবাব দিলো,
—মা তোমাকে ডাকছে চাচ্চু,ছোটচাচি মাথা ঘুরে পড়ে গেছে।
শুদ্ধ প্রথমে বুঝতে পারলো না।কিছুক্ষন জারার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।এই বাড়িতে অন্য বউদের সে মা বলে ডাকে,যেমন বড়মা,মেজোমা,সেজোমা,ছোট মা ইত্যাদি।তাই অনুকে বড় চাচী আর ছবিকে ডাকে ছোট চাচি ।ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই আর এক সেকেন্ডও দেরী করলো না।জারার হাত ধরে ঘরের দিকে ছুটলো।

রুমের ভেতর শুদ্ধর মামিরা, মামাতো বোনেরা সবাই ছবিকে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে।খবর পেয়ে বড়মামা,ছোটমামাও ছুটে এসেছেন।ঘরের দরজায় শুদ্ধকে দেখে সরে দাড়ালো সবাই।
আনোয়ারা বেগম ছবির মাথার কাছে বসে আছে।হুঁশ এসেছে ওর,তবে চোখ বন্ধ করে আছে।
শুদ্ধ ব্যাগ থেকে স্টেথো আর প্রেশার মাপার যন্ত্র বের করলো।ছবির পাশে চেয়ার টেনে বসে বলল,
—দেখি হাত সোজা করো!

যা ভেবেছিলো তাই।প্রেশার ফল করেছে।আনোয়ারা বেগম ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলেন কি হয়েছে? শুদ্ধ কান থেকে স্টেথো খুলে বলল
—তেমন কিছু না প্রেশার একটু কমে গেছে!
অনু পাশ থেকে বলল,
—সকাল থেকে দুবার বমিও করেছে।দুপুরের খাবারও খায় নি,নিয়ে আসবো?
শুদ্ধ হাতের তালু দিয়ে থুতনির ঘাম মুছে বলল,
—খাবার পরে দিও,আগে একগ্লাস সেলাইন গুলে খাইয়ে দাও!
অনুপলাকে আনোয়ারা বেগমের কাছে দিয়ে অনু মেজোমামির সাথে ছবির জন্য খাবার আর সেলাইন আনতে ছুটলো।
শুদ্ধ আনোয়ারা বেগমের দিকে ফিরে বলল,
—আসো মা তোমার প্রেশারটাও চেক করে দেই!

আনোয়ারা বেগমের প্রেশার চেক করা শেষ হতেই অনু খাবার আর সেলাইন নিয়ে ঢুকলো।ছবি আস্তে আস্তে চুমুক দিয়ে সেলাইন শেষ করলো।অনু ভাত মাখিয়ে মুখের কাছে লোকমা ধরতেই মুখ ফিরিয়ে নিলো।নাকমুখ কুঁচকে বলল,
—খাবো না আপু বমি আসছে!
আনোয়ারা বেগমের অগ্নিদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালেন।সাথে সাথেই ছবি ভয়ে পুরো লোকমাটা মুখে পুরে নিলো।
শুদ্ধ উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেলো।ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো ইতোমধ্যেই ছবির খাওয়া শেষ।সবাই বেরিয়ে গেছে।
টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছে ছবির পাশে বসলো সে,
—এখন কেমন লাগছে?
—ভালো!
—কেমন ভালো?
—মাথাটা সামান্য ঘুরছে!
—এইজন্যই কালকে ঘুমাতে বলেছিলাম।একে তো জার্নি করে এসেছো তারওপর কাল সারারাত একফোঁটাও ঘুমাও নি! বাহানা বানিয়েছো।আমার কথা তো কানেই নিলে না।আমি তো ভালো করেই জানি কার শরীর কতটুকু স্ট্রেস নিতে পারবে? এবার হলো? এখন থাকো বিছানায় শুয়ে।

গতকাল রাতে একফোঁটাও ঘুমায় নি ছবি।শুদ্ধকেও ঘুমাতে দেয় নি।একটুপর পরই ঘুম আসছে না,মশা কামড়াচ্ছে,মাথা ব্যথা করছে অজুহাত দিয়ে সারারাত জেগে ছিলো।শুদ্ধ নিজেও ঘুমাতে পারে নি।তবে মেডিকেল লাইফ থেকেই ওর যেমন না ঘুমিয়ে থাকার অভ্যেস আছে তেমনি সুযোগ পেলেই যে কোন সময় ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যেসও আছে।তাই ওর তেমন সমস্যা হলো না।কিন্তু ছবিকে বিপাকে পড়তে হলো।না ঘুমানোর ফলে সকাল থেকেই মাথা ঘুরছিলো সেই সাথে বমিও।
শুদ্ধকে ওর দিকে চেয়ে থাকতে দেখে বলল,
—আপনাকে অনেক কিউট লাগছে!
বলে ছবি কুটিকুটি হাসছে।
—মাইর চিনো?
—চিনি!আপনি দিবেন?
—দুপুরে খাও নি কেন?
—খেতে ইচ্ছে করে নি।
—মাইর দিলে ঠিক খেতে ইচ্ছে করবে!
—আচ্ছা সরি!
—সরি,ফরি বাদ।এখন চোখ বন্ধ করে একটা ঘুম দাও!
—ঘুম আসছে না।
—আসবে,ঘুমের ট্যাবলেট দিয়েছি।তুমি চোখ বন্ধ করো দেখবে ঘুম এসে যাবে।
শুদ্ধ আরো কিছুক্ষন বসে উঠে দরজার দিকে পা বাড়ালো।ছবি দুর্বল কন্ঠে বলল,
—আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
—প্যান্ডেলের কাছে।বড়মামা বারবার করে বলে গেছেন,প্যান্ডেলের কাছে থাকতে।কোনরকম গন্ডোগোল যাতে না হয়।

গতবছর শুদ্ধর বড়মামা আফতাব আহমেদের বড়ছেলে মাহমুদের বিয়েতে জায়গা থাকা সত্বেও প্যান্ডেল ছোট হয়ে গেছিলো।কি বিশ্রী অবস্থাটাই না হয়েছিলো!খাওয়া দাওয়া শেষ করতে করতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেছিলো।তাই এবার তিনি বারবার সাবধান করে দিয়েছেন প্যান্ডেলের কাছে যেন অবশ্যই কেউ না কেউ থাকে।যদিও মিলাদে বিয়ের মত মানুষজন হচ্ছে না,তবে একেবারে কমও নয়।ভাইবোনেরা সবাই শরীক হয়েছেন তাই বেশ বড়সড় আয়োজনই করা হচ্ছে।
শুদ্ধ বেরিয়ে গেছে।ছবি চোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে দিলো।বাস্তবিকই তার প্রচন্ড ক্লান্তি লাগছে!
খানিকবাদেই পায়ের আওয়াজ পেয়ে চোখ খুলো।শুদ্ধ ভেতরে ঢুকছে। ওকে ফেরত আসতে দেখে বলল,
—চলে এলেন যে?
—ফোন ফেলে গেছি!
শুদ্ধ ফোন পকেটে ঢুকিয়ে নিলো।ছবি চুপচাপ ওকে পর্যবেক্ষণ করছে।ওর জন্য কাল সারারাত এই মানুষটা একটুও ঘুমাতে পারে নি তবুও চেহারায় কোন ক্লান্তিবোধ নেই।নেই অবসাদের কোন ছায়া।কি সুন্দর!নিষ্পাপ চাহনি!

শুদ্ধকে নিয়ে ভাবনায় ব্যস্ত থাকায় সে বুঝতেই পারে নি শুদ্ধ কখন ওসে ওর দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ ওর ভ্রুঁ জোড়ার সন্ধিস্থলে শুদ্ধর ঠোঁটের স্পর্শ পেতেই ঝিমঝিম করে উঠলো সমস্ত শরীর।হৃদপিন্ডে একধরনের সুড়সুড়ি দিয়ে উঠলো,মিষ্টি সুড়সুড়ি!
হাতে দুটো মুঠো করে চোখ বন্ধ করে ফেললো সে।সমস্ত হৃদয় দিয়ে ভালোবাসার শুদ্ধতম স্পর্শ অনুভব করলো!
শুদ্ধ উঠে দাঁড়িয়ে গেঞ্জি ঠিক করে নিলো।
—আমার বেশিক্ষণ লাগবে না।পেন্ডেলের কাজ শেষ হলেই চলে আসবো।আমি না আসা পর্যন্ত একদম উঠবে না ঠিক আছে?…কিছু লাগলে ভাবিকে বা আমাকে ফোন দিও কেমন?
ছবি মাথা কাত করে সায় জানালো।

শুদ্ধ বেরিয়ে গেছে,ছবি চোখ বন্ধ করতে পারছে না।লজ্জা মিশ্রিত শিহরণ বইছে!শুদ্ধ যখন ঝুঁকে ওর কপালে চুমু খেয়েছিলো সেই মুহূর্তে বোতামের ফাঁক দিয়ে যেই দুর্ভেদ্য প্রাচীর ওর দৃষ্টিপটে উঁকি দিয়েছিলো তাতে ওর সমস্ত শরীরে কালবৈশাখী ঝড়ের মাতম লাগিয়েছে!শুদ্ধর ফর্সা উন্মুক্ত বক্ষ!যার পিঞ্জিরায় অবস্থায় করছে ওর সমুদ্রের মত বিশাল হৃদয়!
ইসশ!ভাবতেই ছবি লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে।উনি কি জানে ছবি কেমন নির্লজ্জের মত উনার দিকে তাকিয়ে ছিলো? উনি বোধহয় তখন একটু হাসছিলেন,দুহাতে মুখ ঢেকে হেসে ফেললো ছবি!

শুদ্ধ যাওয়ার দশমিনিটের ভেতরই ঘুমের ট্যাবলেটের ইফেক্ট শুরু হয়ে গেলো।চোখ ফেটে ঘুম আসছে ছবি।কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে সেই খেয়ালও নাই।
শুদ্ধ সন্ধ্যের দিকেই ফিরে এলো।ক্লান্ত শরীর নিয়ে রুমে ঢুকে দেখলো ছবি গভীর ঘুমে অচেতন।শুদ্ধ পকেট থেকে ফোন বের করে টেবিলের ওপর রাখলো।হাতঘড়িটা খুলে ফ্রেশ হতে ঢুকে গেলো।তার নিজের শরীরও ম্যাজম্যাজ করছে।একে তো রাতে ভালো ঘুম হয় নি তার ওপর সারাদিন ছুটোছুটি!বিছানায় শুলেই দারূণ ঘুম হবে।ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো অনু কফি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ফোন চার্জে লাগিয়ে বিছানায় ওঠে বসলো শুদ্ধ।
কফি খেতে খেতে একটা বই খুলে বসলো।কখন যে চোখ লেগে এসেছে বলতে পারবে না।ঘুম ভাঙলো অনুর ডাকে।
রাতে খাবার জন্য ডাকতে এসেছে অনু।শুদ্ধকে খাটের ওপর আধশোয়া হয়ে ঘুমাচ্ছিলো।ডানহাতটা কপালের ওপর রাখা,বুকের ওপর বই বামহাত দিয়ে সেটাই আকঁড়ে ধরে আছে।অনু ভেবেছিলো সে সজাগ!
ছবিকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে ডাকাডাকি শুরু করে দিলো,
—এই ছবি ওঠ!আর কত ঘুমাবি? ছবি? এই ছবি? কি রে খাবি না?
ছবি বিরক্তভাবে নড়েচড়ে উঠলো।বিড়বিড় করে কি বলল শোনা গেলো না।
শুদ্ধ হাই তুলতে তুলতে বলল,
—ও ঘুমাক ভাবি।ঘুমের ওষুধ দিয়েছি তো কড়া ঘুম দরকার।
—-তোমাদেরকে তো খেতে ডাকছে।
—বিকেলে ভালোমত খাইয়েছিলে না ওকে?
—হ্যাঁ,আম্মা থাকাতেই তো খাওয়াতে পারলাম।
—চলবে।এখন আপাতত ঘুমাক!
—তুমি খাবে না?
—সবাই কি খেতে বসে গেছে?
—না,এখনো বসে নি।বড়মামা আমাকে পাঠালেন তোমাদের দুজনকে ডেকে নিয়ে যেতে
—ঠিক আছে আমি আসছি।
শুদ্ধ ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নিলো।বেরিয়ে দেখলো বিছনায় মামাতো বোন তমা এসে ঢুকলো।অনুর দেরী দেখে ওকে ডাকতে পাঠানো হয়েছে।শুদ্ধকে দেখে বলল,
—ছোটভাবি এত ঘুমাচ্ছে কেন?
—ঘুমের ওষুধ দিয়েছি।তোর খাওয়া দাওয়া শেষ?
—হ্যাঁ আমি সবার আগেই খেয়ে নিয়েছি।
তমা বেশ আহ্লাদী টাইপ মেয়ে।চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যাথ নিয়ে পড়ছে।পড়ালেখা নিয়ে দারূণ সচেতন।শুদ্ধ টেবিলের ওপর থেকে চশমা নিয়ে সেটা চোখে দিতে দিতে বলল,
—তুই তোর ভাবির কাছে কিছুক্ষন বোস।ভাইয়া খেয়ে আসি।পারবি?
—পারবো তুমি যাও!

পরেরদিন সকাল বেলা ছবির ঘুম ভাঙ্গলো বেশ দেরীতে।ভালো ঘুম হওয়াতে শরীর অনেকটাই ফুরফুরে লাগছে।আড়মোড়া ভেঙ্গে বিছানা ছাড়লো সে।শুদ্ধ অনেক আগেই উঠে গেছে।ঘড়ির দিকে ভীষণ লজ্জা পেলো ছবি।এতবেলা হয়ে গেলো অথচ সে পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছে।
ফ্রেশ হয়ে চেইঞ্জ করে নিলো সে।রাতে যেই থ্রিপিস পড়েছিলো দলামোচড়া হয়ে আছে।
ওকে দেখেই মামিরা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।কোন কাজেই হাত লাগাতে দিলেন না।অনুর ছোট বাচ্চা আছে তাই তাকেও কাজ করতে দেওয়া হচ্ছিলো না।
আনোয়ারা বেগমও সবার সাথে কাজ করছিলেন।ছবি বারণ সত্বেও উনার পেছন পেছন এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছিলো।
আগামীকাল মিলাদ।তাই আজকে অন্যদিনের তুলনায় বেশি ব্যস্ত সবাই।
বিকেলের দিকে শুদ্ধ নিচতলার ডাইনিং এ বসে নাশতা করছিলো।আনোয়ারা বেগম মুখ গোমড়া করে ওর পাশে এসে দাঁড়ালেন।গম্ভীরকন্ঠে বললেন,
—তোর বউ এমন আমার লেজে লেজে ঘুরছে কেন?
শুদ্ধ নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দিলো,
—সেটা তাকেই জিজ্ঞেস করো!
যদিও সে জানে আনোয়ারা বেগম মুখে প্রকাশ না করলেও ভেতরে ভেতরে অসম্ভব খুশি হয়েছেন।বাইরে যতই শক্ত দেখানোর চেষ্টা করুক ভেতরে ভেতরে উনি খুবই নমনীয়,কোমল স্বভাবের।মায়ের চোখের দিকে তাকালো শুদ্ধ,সি লুকস হ্যাপি!অতএব চুপচাপ খাওয়ায় মনোযোগ দিলো সে।
.
.
চলবে

অল্প থেকে গল্প🍁
অরিত্রিকা আহানা
পর্ব:২৩

শুদ্ধর নানুর বাড়ি থেকে ফেরার পরপরই ছবির ক্যাম্পাসে খোলা পড়লো।তারপর আবার শুরু হলো সবার নিয়মতান্ত্রিক জীবনধারা।ছবি নিয়মিত ক্লাস করে,শুদ্ধ তার রেগুলার চেম্বার, হস্পিটাল নিয়ে বিজি।অনু সংসারের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত।আনোয়ারা বেগমের সময় কাটেন নাতনীর আধোআধো বুলিতে।ঢাকায় আসার পর প্রায় দুমাসের মত হয়ে গেছে শুদ্ধর সাথে দেখা হয় নি ছবির।ক্যাম্পাসে পুরোদমে ক্লাস চলছে।ছুটি না থাকায় বাসায় যাওয়ারও সুযোগ নেই।শুক্রবার ছুটি থাকলেও স্যার ম্যামরা বুদ্ধি করে তার পরপরই সিটি ফেলে দেন।যার ফলে শুক্রবারেও বাসায় যাওয়া সম্ভব হয় না।অনেকদিন বন্ধ থাকায় সেটা পুষিয়ে নিতে চাইছেন স্যার ম্যামরা।কোন ভাবেই সেশনজটে ফেলা যাবে ছাত্রছাত্রীদের।বাকিরা খুশি হলে ছবি মনে মনে বিরক্ত।একদিন দুইদিন বন্ধ দিলে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়? অবশ্য সেমিস্টার তাড়াতাড়ি শেষ হলেও ওর জন্য আরেকটা লাভ আছে।সেমিস্টার ফাইনাল এর পরপরই ওর আর শুদ্ধর রিসেপশন এর ডেইট ঠিক হয়েছে।তাই একদিক দিয়ে রেগে গেলেও অন্য দিকে দিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দেয় সে।

শুদ্ধর নানুর মৃত্যুবার্ষিকীর মিলাদের আয়োজন শেষ হওয়ার পরেরদিনই সিদ্ধান্ত হলো আনোয়ারা বেগম রাশেদ সাহেবের সাথে দেখা করতে যাবেন।এবার উনার সবকিছু জানা দরকার।অভিভাবক হিসেবে আনোয়ারা বেগমের সাথে শুদ্ধর বড়মামা আফতাব আহমেদ যাবেন।
সেদিন বিকেলবেলাই উনারা রওনা হলেন।সব শুনে রাশেদ সাহেব প্রথমে শারমিন বেগম আর অনুর ওপর রেগে গেলেও পাত্র হিসেবে শুদ্ধকে উনার পছন্দ হলো।

সেদিন সন্ধ্যের দিকে বড়মামির ঘরে সবাই ছবিকে নিয়ে ঠাট্টা জুড়ে দিলেন।ছবি আগামাথা কিছুই বুঝলো না।বোকার মত চেয়ে রইলো।মেজোমামি ছবিকে টেনে খাটের ওপর বসিয়ে দিয়ে বলল,
—তোমার শ্বাশুড়ি গেছেন তোমার আর শুদ্ধর রিসেপশন এর দিন তারিখ ঠিক করতে।
ছবি আঁতকে উঠলো।সর্বনাশ!রাশেদ সাহেব তো বিয়ের ব্যাপারেই কিছু জানেন না।রিসেপশন তো বহুত দূর!
ছবি ফ্যাকাসে মুখ দেখে মেজোমামি বুঝলেন।হেসে উঠে বললেন,
—তোমার শ্বাশুড়ি আর বড়ভাইজান মিলে উনাকে সব বুঝিয়ে বলেছেন।তিনি রিসেপশন এ সম্মতি দিয়েছেন।তোমার সেমিস্টার ফাইনাল এর পর পরই অনুষ্ঠান এর দিন তারিখ ঠিক করা হয়েছে।
অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষন চেয়ে রইলো ছবি।মেজোমামি হেসে উঠে বললেন,
—তোমার শ্বাশুড়ি রওনা দিয়েছেন।এলেই সব জানতে পারবে।
বুকের ওপর থেকে ভার কমে গেলো ছবি।যাক!রাশেদ সাহেবকে সব জানানো হয়েছে।লজ্জায় ছবি মাথা নিচু করে ফেললো।ভাবিরা ছবিকে নিয়ে নানারকম দুষ্টু ঠাট্টামশকরা শুরু করে দিলো।

তারপর দিন তারা ঢাকা ফিরে এলো।তার দুদিন পর ছবি ক্যাম্পাসে চলে গেলো।তারপর থেকে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে সবকিছু চললেওছবির ভীষণ মন খারাপ লাগে।কি নিষ্ঠুর শুদ্ধ!চেম্বার আর রোগী পেয়ে ওকেই ভুলে গেছে। শুদ্ধর ওপর খুব অভিমান হলো।

বৃহস্পতিবার দিন ক্লাস শেষে হলের যাচ্ছিলো সে।গেট দিয়ে ঢুকতেই হল প্রভোস্টের ডাক!কাঁচাপাকা গোঁফের অধিকারী রফিক সাহেব চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন।ছবি পর্দা সরিয়ে বললো,
—আসবো স্যার?
জবাব দিলেন উনার সহকারী নাজনীন ম্যাম।বয়স পঁচিশ ছাব্বিশ হবে।সুন্দরী এবং স্মার্ট।চালচলন,কথাবার্তায় আধুনিকতার ছাপ স্পষ্ট।ছবিকে দেখে হাসিমুখে বললেন,
—এসো!
ছবি ভয়ে ভয়ে ভেতরে ঢুকলো।রফিক সাহেবকে সে বরাবরই ভয় পায়।গুরুগম্ভীর স্বভাব!কথা বললেই মনে হয় যে ধমকাচ্ছে।তবে আজকে উনার গলার স্বরটাও কেন যেন মোলায়েম লাগছে।শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
—এত দেরী হলো যে?
—আজকে পুরো ক্লাস হয়েছে।
—ও আচ্ছা!..তোমার হাজবেন্ড দেখা করতে এসেছে।

মিনিট খানেক কোন কথা বলতে পারলো না ছবি।ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো।বন্ধুবান্ধব মহলে কয়েকজন ছবির বিয়ে হয়ে গেছে জানলেও ক্যাম্পাসে শিলা ছাড়া আর কাউকে শুদ্ধর কথা জানায় নি ছবি।রফিক সাহেবের মুখে হাজবেন্ড কথাটা শুনেই পেটের ভেতর কেমন কেমন শুরু করলো,মুখে হাসি ফুঁটে উঠলো তার। ম্যাজিকাল ওয়ার্ড!হঠাৎ করে ছবির সমস্ত শরীরে শিহরণ ছড়িয়ে দিচ্ছে!
ঘোর ভাঙলো নাজনীন ম্যামের গলায় আওয়াজে।ঠাট্টা করে বললেন,
— লুকিয়ে লুকিয়ে বিয়ে করে ফেললে অথচ একটা দাওয়াত পর্যন্ত দিলে না।এটা কি ঠিক হলো?
ছবি সলজ্জিতভাবে হাসলো।লাজুক কন্ঠে বলল,
—ম্যাম আসলে এখনো রিসেপশন হয় নি,ঘরোয়া ভাবে সব কিছু হয়েছে।রিসেপশন হলে অবশ্যই দাওয়াত পেয়ে যাবেন।
ছবি বেরোনোর জন্য পা বাড়াচ্ছিলো,নাজনীন ম্যাম ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে রফিক সাহেবকে উদ্দেশ্য করে চোখ টিপে বললেন,
—ছবির হাজবেন্ড কিন্তু দারূন হ্যান্ডসাম তাই না স্যার? ড্যাশিং ইয়াং ম্যান!
তারপর ছবির দিকে তাকিয়ে হাসলেন।ছবি লজ্জায় আবারো ঘাড় নিচু করে ফেললো।নাজনীন ম্যাম হাসি থামিয়ে বললেন,
—কিছু মনে করো না ছবি।মজা করেছি। আসলে উনাকে আমি আগে থেকেই চিনি।আমার বোনের মারফতে। এত অমায়িক,বিনয়ী মানুষ আমি খুবই কম দেখেছি।অসাধারণ একজন মানুষ!জাস্ট ব্রিলিয়ান্ট!
রফিক সাহেব উনাকে সমর্থন করে বললেন,
—হি ইজ রিয়েলি আ জেম ছবি!ইউ আর সো লাকি টু হেভ সাচ আ পারসন লাইক হিম!
ছবি মনে মনে অবাক হলেও মুখে লাজুক হাসি দিলো।নাজনীন ম্যাম তাড়া দিয়ে বললেন,
—তুমি যাও ছবি উনি অনেক্ষনযাবত বসে আছেন।

ছবি পর্দা সরিয়ে ওয়েটিংরুমে ঢুকলো। পায়ের ওপর পায়ের পা তুলে সোফায় বসে আছে শুদ্ধ।দৃষ্টি ফোনের দিকে নিবদ্ধ! ক্লান্তিতে মুখটা কালো হয়ে আছে।ঠোঁট দুটো বাচ্চাদের মত মিলিয়ে রেখে ফোন স্ক্রল করছে।
—কখন এসেছেন?
ছবির গলার আওয়াজ পেয়ে মুখ তুলে তাকালো শুদ্ধ।ছবির মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে।কতদিন পর শুদ্ধকে দেখলো সে।শুদ্ধর ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠেছে।কপালে কুঁচকানো ভাঁজটা কোমল হয়ে উঠেছে।
—এসেছি অনেক্ষন হয়েছে।..কেমন আছো তুমি?
—ভালো।
শুদ্ধ উঠে দাঁড়ালো।ওর পরনে ছাই রংয়ের একটা ফুলহাতা শার্ট এজ ইউজুয়্যাল হাতাটা ফোল্ড করে রাখা।কালো পেন্টের সাথে ইন করে পরেছে।হস্পিটাল থেকে এসেছে মনে মনে ধারণা করে নিলো ছবি।শুদ্ধ ফোন পকেটে ঢুকিয়ে বলল,
—লাঞ্চ করেছো?
—না।
—ঠিক আছে তুমি ব্যাগ রেখে রেডি হয়ে আসো আমি অপেক্ষা করছি।
ছবির মনে মনে ভেংচি কাটিলো।এতদিনে বাদে উনার বউয়ের সাথে লাঞ্চ করার শখ হয়েছে!মুখে বলল,
—আপনি বসুন আমি আসছি।

ছবি দুপদাপ তিনতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠলো।ঝটপট রেডি হয়ে নিচে নেমে এলো।আসার সময় শুদ্ধর জন্য একগ্লাস শরবত গুলে নিয়ে এসেছে।
ওয়েটিংরুমে ঢুকে শুদ্ধর দিকে শরবতে গ্লাসটা বাড়িয়ে দিলো সে।
শুদ্ধ ঘাড় ঘুরিয়ে কিছুক্ষন চেয়ে রইলো ওর মুখের দিকে।নিশ্চুপ চাহনি! হাত বাড়িয়ে শরবতের গ্লাস নিয়ে আন্তরিক সুরে বলল,
—থ্যাংক ইউ!
তিন চুমুকে শরবত শেষ করেছে সে।খাওয়া শেষে খালি গ্লাসটা টেবিলের ওপর রেখে দিলো।
—আপনি বসুন আমি চট করে গ্লাসটা রেখে আসি।
—যাও।
ছবি ওয়েটিংরুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় গ্লাসে থাকা অবশিষ্ট শরবতে চুমুক দিয়ে খেয়ে নিলো।ততক্ষনে বাইরে শুদ্ধ এসে দাঁড়িয়েছে ছবি সেটা খেয়াল করে নি।শুদ্ধর গলার আওয়াজ পেয়ে ভুত দেখার মত চমকে উঠলো।
ছবির দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
—ভালোবাসার অভাব মনে হচ্ছে?
নিঃশব্দে হাসছে শুদ্ধ।শুকনো ঢোক গিলো ছবি।বিব্রত ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টা করলো।অপ্রতিভ হাসি!
শুদ্ধ একেবারে কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে তার। নিজের দুহাতের মুঠোয় ছবির দুহাত নিয়ে আঙ্গুলে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিলো।আঙ্গুলে আঙ্গুক ডোবানো হাত দুটো তুলে তার পৌরষদীপ্ত বুকের ওপর রাখলো।মুখের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল,
—ভালোবাসিতো!খুব ভালোবাসি।এঁটো খাওয়া লাগবে না!
ছবির ওষ্ঠদ্বয় ক্রমাগত কাঁপছে।লজ্জায় সারা শরীর সংকুচিত হয়ে আসছে।সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পেয়ে শুদ্ধ ওকে ছেড়ে দিয়ে গাড়ি দিকে হেঁটে গেলো।ছবি হাঁ করে কিছুক্ষন নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো। ফাঁকা গ্লাস দিয়ে নিজের মাথায় দুই তিনটা বাড়ি মেরে সেটা ওয়েটিংরুমে রেখেই শুদ্ধর পেছন পেছন ছুটলো।

শুদ্ধ ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে ছবিও এসে বসলো।ভার্সিটি গেট থেকে বেরোতেই ছবি হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলো,
—নাজনীন ম্যাম আপনার এত প্রশংসা করলো কেন?উনার সাথে কি আপনার আগে থেকেই পরিচয় আছে?
অনেকক্ষণ যাবত প্রশ্নটা মনের ভিতর পুষে রেখেছিলো ছবি।করবে কি করবে না ভাবছিলো।শুদ্ধর দৃষ্টি সামনের দিকে।ছবির কথা শুনে হেসে উঠে বলল,
—প্রশংসা করেছে বুঝি?
—করেছো তো।উনি নাকি আপনাকে চেনেন?আপনি চেনেন উনাকে?
শুদ্ধ রহস্যজনক ভাবে হাসলো।বলল,
—চিনি তো।উনার কাছ থেকেই তো তোমার সম্পর্কে সব খোঁজখবর নিই।এই যে তুমি পড়াশোনা বাদ নিয়ে ফাঁকিবাজি করছো সেটাও আমি জানি।
ওর দুষ্টুমি ছবি ধরে ফেললো।বাচ্চাদের মত অনুযোগ করে বলল,
—কেন এমন করছেন? বলুন না?
—কি করেছি আমি?
ছবি চোখ পাকালো।বলল,
—আপনি বলবেন কি না?
ওর চোখ পাকানো দেখে শুদ্ধ আবারও হেসে ফেললো।তাতে ছবির রাগ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।শুদ্ধ হাসি থামিয়ে বলল,
—বলতেই হবে?
—হ্যাঁ বলুন!
শুদ্ধ কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল,
—মানে ঘটনাটা হচ্ছে যে…
এটুকু বলেই ছবির দিকে ফিরলো সে।চোখেমুখে দুষ্টুমির ছাপ!
ছবির প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা।নাক টেনে বললো,
—আপনি বলবেন?
—আচ্ছা বলছি, বলছি!আগে তুমি শান্ত হও।তোমার নাজনীন ম্যাম এর বড় বোন আমার পেশেন্ট ছিলেন।মাসখানেক আগে একবার আমার চেম্বারে উনার বোনকে নিয়ে আসেন।কিছুদিন অবজারবেশনে রেখেছিলাম,তারপর আর দেখা সাক্ষাৎ হয় নি।আজকে আমাকে দেখে উনিই পরিচয় দিলেন।প্রথমে মনে করতে পারি নি।পরে ডিজিজ হিস্ট্রি শুনে মনে পড়লো।রেয়ার ডিজিজ!ক্রুজফেল্ড জ্যাকব ডিজিজ।বাংলাদেশে এটি ম্যাড কাউ নামে পরিচিত।গরুর পঁচামাংস খেলে এই রোগ হয় বলে ধারণা করা হয়!
—এখন কেমন আছেন উনার বোন?
—বললো তো ভালো আছে।
তারপর কিছুক্ষন ছবি চুপ করে রইলো।শুদ্ধর প্রশ্ন শুনে ওর দিকে তাকালো।
—আপনার কি আর কিছু জানার আছে মিসেস ইফতেখার?
শুদ্ধর মুখে মিটিমিটি হাসি, দৃষ্টি ছবির দিকে। লজ্জা সামলাতে বাইরের দিকে দৃষ্টি দিলো ছবি।সত্যি সে কেন এমন বাচ্চামো করলো?নাজনীন ম্যাম তো শুদ্ধর পরিচিত হতেই পারে!এমন রিয়েক্ট করার কি আছে?
.
.
চলবে