#আমার_হৃদয়ে_সে
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-১৮
২৬.
পরদিন সকালে মা-বাবা আসেন।এসে বাবা থমথমা মুখে বেশ খানিক্ষন বসে থাকেন।আমি সোফার দিকে যেতে বাবা আমার দিকে তাকিয়ে চোখজোড়া সরু করে ফেলেন।মা না।মা স্বাভাবিক ই বসে।আমি একপাশে দাঁড়াই।আর দুইহাত সোঁজা করে বাবার দিকে তাকাই।।খালামণি বাবার চোখমুখের ভাব দেখে বুঝতে পারলেন বাবা আমার উপর মোটামুটি রেগে।বলেন,
“ভাইজান?যা হবার হয়ে গেছে তা নিয়ে আমার মনে হয় আর ঘাটাঘাটি করার দরকার নেই।”
“ডিভোর্সটা তোমার কাছে খুব ঠুনকো মনে হচ্ছে,রাহেলা?”সাথে সাথে বাবার জবাব।অত্যন্ত ক্রোধান্বিত প্রতিটি কথার শব্দ!খালামণি নিজেকে ধাতস্থতার সহিত বলেন,
“তা কেন ভাইজান?আসলে পারিসা অভির সাথে সুখে ছিল না।আপনিই তো পরে সব জানতে পেলেন অভি আঁটটা মাস কি ব্যবহার টাই না তার সাথে করেছে।”
“মাত্র আঁটমাস, আঁট বছর তো নয়!”
খালামণি আরো কিছু বলতে গেলেন।আমি চোখের ইশারায় খালামণিকে থামালাম।এবার আমি বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম,
“যে আঁটমাসে মিসবিহেভ করতে পারে সে আঁটবছরেও যে করবে না এমন কোনো কথা নেই!বাবা,গত আঁট আঁটটা মাস আমি অভিকে দেখে এসেছি।ওর সব বিহেভিয়ার ই মোটামুটি মুখস্ত আমার।ওর সাথে সংসারে গেলেও খুনসুটি লেগেই থাকতো।সন্দেহ,অবিশ্বাস সবসময় করে আসতো।ভালোভাবে ওর সাথে সংসার জীবন কাঁটতো না!’
” এতটা সিউর কীভাবে তুমি যে ও পরেও তোমার সাথে ওরকম ব্যবহার করবে?”
“যে আগে করতে পারে সে পরেও করতে পারবে বাবা।”
“এই ধারণায় ওকে তুমি ডিভোর্স দিয়েছো?শুধুমাত্র এটুকু ধারনায়?শুনতেছো শাহেলা তোমার মেয়ের কথা?”
মা চুপ হয়ে থাকেন।বাবা জেদ ভরা প্রসঙ্গে আবার বলে উঠেন,
“এই আঁটটা মাসে অভি যা করেছে সে তারজন্যে অনুতপ্ত হয়েছে।এবং ক্ষমাও চেয়েছে তোমার কাছে।সে তার ভুল বুঝতে পেরেছে।মানুষ ভুল করে!ভুল শুধলেও নিতে পারে।ভুল সবসময় করে না মানুষ!অভিও তাই হতো।কিন্তু তুমি সেই সুযোগটা দিলে না।এরজন্যে সামনে কঠিন পশ্তাবে পারিসা!কঠিনভাবে পস্তাবে!
বলে খানিক থামেন।তারপর আবার বলেন,
“এখন কি করবে নাউ জাস্ট ডিসিশন ইউরস!তোমার ব্যাপারে আমি আর কোনো জানি না এবং জানতেও চাই না।শাহেলা উঠো?বাসায় যাবো!উঠো!”
মা বাবার কথায় অপ্রস্তুত হয়ে যান।এবং অপ্রস্তুত চোখে আমার এবং খালামণির দিকে তাকান।খালামণিও চুপ হয়ে থাকেন।মা বাধ্য হয়ে এবার উঠে দাঁড়ান।আমাদের দিকে তাকিয়ে,
“আসি।”
বলে চলে যান।তাকিয়ে থাকি উনাদের চলে যাওয়ার দিকে।
এভাবে দেখতে দেখতে আরো সাতদিন শেষ হয়।এই সাতদিনে আমার প্রচন্ড মুড অফ ছিল!খালামণির সাথে কথা বলি নি।আঙ্কেলের সাথে কথা বলিনি।এবং ফাহিমের সাথেও না।অভিকে ডিভোর্স দেওয়ার ব্যাপারে আমার মা-বাবার রিয়াকশনটা খুবই কষ্টদায়ক ছিল।সন্তানের বিপদ-আপদে কাছের মানুষ থাকে মা-বাবা।আর আমার বিপদে কেউই নেই।খুবই নিরীহ,তুচ্ছ প্রাণি আমি।এই সাতদিনেট ভেতর মা মাত্র দুবার আমাকে কল করেছে।তাও প্রয়োজনে।এর বাড়তি একটা খুচরো কথাও আমার সাথে বলেন নি।একবার মুখ ফুঁটে বলেন নি,
“বাসায় আসবি?”
আমার আসলেই এখন আর কোনো বাড়ি নেই।পরিবার নেই।কেউ নেই।আমি বাউণ্ডুলে!এমন সময় ফোনে একটা মেসেজ টোন বেজো উঠে।অচেতন পাশ থেকে ফোনটা হাতে তুলে নিই।স্ক্রিন ওপেন করি।তাঁকিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে কারো “সেন্ট আ ফটো”। আমি আগ্রহ নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকি।ঢুকার পর যেই নাম্বার থেকে ফটো টি পাঠানো হয়েছে তাতে টাচ করি।ফটোটা সো হতে যা দেখি তা দেখতে আমি আদৌ প্রস্তুত ছিলাম কি ছিলাম না নিজেও জানি না।আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ফটো তে অভি এবং পাশে লালরঙ্গা লেহেঙ্গা পড়া নববধূ! বিয়ে করেছে সে!এই সাতদিনের ভেতরে বিয়ে করে ফেলেছে?ভাবনার মাঝে টোন করে ফোটের নিচে বাংলা অক্ষরে লেখা একটা মেসেজ এসে জমা হয়।মেসেজে লেখা-” Pray for us! We live together!Ar dekhle?Ovi 1 week er moddhe biyeo kore feleche!Korbei na ba kno!Se vul koreche tmr moton ekta meyeke deserve kore!”
আমার কেনজানি মনের অজান্তে মুখে খুব হাসি ফুটে উঠলো!ঠোঁট চড়ানো সেই হাসি।মনে মনে আশ্বস্ত হলাম,
“যাক একটা লম্পটকে লাইফ থেকে সরালাম!”
বলার মাঝে মুখটা আবার মলীন হয়ে গেল।আফসোস একটা দীর্ঘশ্বাস টানলাম,
“জীবনে একজন প্রকৃত ভালোবাসার মানুষ পাওয়া খুব কঠিন!”
এরমাঝে খালামণি ঢুকলেন।খুব উৎফুল্লতা স্বরে বললেন,
“পারিসা?পারিসা?একটা কথা বলতে তোমাকে ভুলে গিয়েছি।তুমিতো জানো না আগামী পরসু আমাদের ফাহিমের ব্রার্থ ডে।এবারের ব্রার্থ ডে নিয়ে আমাদের অনেক বড় ইচ্ছে আছে।”
খালামণি ভাবলেন আমার থেকে তার প্রত্যাশিত উত্তরটা এবাট পাবেন।কিন্তু তা হলো না।তিনি খুব করে খেয়াল করলেন আমি আনমনা মনে ফোন হাতে অন্যদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি!তিনি আরো এগিয়ে এলেন। বললেন,
“কত আর এভাবে মন খারাপ করে থাকবি?লাইফ এভাবে চলে না পারিসা?এভার একটু মুভ অন হ।লাইফ এনজয় করে।আগের কথা যত ভাববি তত কষ্ট পাবি।প্লিজ সব ভুলে যা!”
এবার আমি চেতনে ঢুকলাম।খালামণির দিকে তাকালাম।বললাম,
“কিছু বললে?”
খালামণি মাজায় হাত রাখলেন।হালকা রাগ নিয়ে বললেন,
“এই দ্যাখো মেয়ে,আমি এতক্ষণে যা বললাম কিছুই কানে গেলো না!”
“সরি খালামণি আবার বলো।আসলে খেয়াল করি নি।”
খালামণি আগের কথাগুলো পুনরাবৃত্তি করলেন।আমি হাসলাম।ফাহিমকে অগ্রিম হ্যাপী ব্রার্থ ডে জানালাম।খালামণি বললেন,
“এখন জানিয়ে লাভ নেই।পরসু ভালো করে জানালেই হবে।এখন বহুৎ কাজ।প্যান্ডেল,ডেকোরেশন,খাওয়া,দাওয়ার সবকিছুর একটা প্লানিং ছক বানাতে হবে।এখন ডাইনিং এ আসো আমার সাথে।”
আমি মাথা নাড়লাম।বিছানা থেকে নামলাম।খালামণি দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।পেছন থেকে ডাকলাম,
“খালামণি শুনো?”
“হু?”
“দাঁড়াও একটু।”
খালামণি ঘুরে দাড়ালেন।বলেন,
“তাড়াতাড়ি বল কি বলবি।”
“অভি অলরেডি এনগেজড!”
খালামণি আমার কথায় ভ্রু যুগল কুঁচকে ফেললেন।মানে আমি কি বললাম কথা ঠিক বুঝলেন না তা বুঝালেন।আমি হেসে দিয়ে ফোনের স্ক্রিনটা উনার সামনে তুলে ধরি,
“অভি বিয়ে করেছে।”
খালামণি যেন আকাশ থেকে পড়লেন।এক মিনিট লাগলো খালামণির সৎবিৎ আসতে।তারপর বললেন,
” কিছু হুজুগে টাইপের মানুষ চিনিস তুই?”
প্রশ্নবোধক চোখে তাকালাম।খালামণি বলেন,
“হুজুগে টাইপের মানুষ হলো মানে সময়েতে উদ্দীপনা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।চরমভাবে ঘুরে বেড়ায়।সময়েতে এই এই জিনিসটা ভাল্লাগে,আবার ভাল্লাগে না।এটা প্রয়োজন, ওটা প্রয়োজন না।মানে এরা স্থির না কিছুতে!এক কথায় এরা ছলনাময়ী!মিথ্যাবাদী!বেয়াদব!জঘন্য বেয়াদব!এদের থেকে দূরে থাকাই ভালো!এখন একটা কাজ কর এই ছবি এবং মেসেজটা তোর বাবাকে পাঠিয়ে দে।পাঠিয়ে দিয়ে বল আপনার ভালোবাসার জামাই বাবাজী!ও সরি অন্ধ বিশ্বাসের সোনায়া সোহাগা!আপনার মেয়েকে এক সপ্তাহের মধ্যে ভুলে যেয়ে নতুন আরেকরা বিয়েও করে নিয়েছে!দেখছেন?তাও কতটা এটিটিউড দেখিয়ে বিয়ে করেছে!বাহ বিয়ে করাও আবার এটিটটউড হয়!হায়রে দুনিয়া!”
শেষ দুটো কথাতে খালামণি খুব আপসেট হয়ে যান।আমি ধাতস্থ করি।বলি,
“বাদ দাও খালামণি।এ আজ থেকে আমার মন থেকে মুছে গেছে।ভুলে গিয়েছি একে!একদম ভুলে গিয়েছি।ইনশাআল্লাহ এখন সামনের দিকে মুভ অন করবো।দ্যাখো তুমি।”
খালামণি হেসে দিলেন।বললেন,
“থ্যাংকস পারিসা।এটাই চাই।তুই সহজ-সাবলীলভাবে জীবনটা শুরু কর আবার। আর হ্যাঁ ফোনটা আমাকে একটু দে।”
বলে খালামণি আমার হাত থেকে মুহূর্তে কেড়ে নেন।তার কিছুক্ষণ ফোনে ঘুটঘুট করে আবার আমায় ফেরত দেন।ফেরত দিয়ে বলেন,
“অভি এবং অভির ওয়াইফের ছবি তোর বাবার হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দিয়েছি।”
“দরকার কি ছিল খালামণি?”
“চুপ একদম।দেখুক না তার জানপ্রাণের জামাই বাবাজীকে।”
২৭.
আজ ফাহিমের ব্রার্থ ডে।মোটামুটি সব গেস্টদেরই ইনভাইট করা হয়েছে।অনেক গেস্ট ইতোমধ্যে এসেও পড়েছে।আর একটা কথা জানেন আপনারা?আজ আমার মাও কিন্তু ফাহিমের ব্রার্থ ডে তে এসেছে।খালামণি মা এবং বাবাকে দুজনেই ইনভাইট করে আসার জন্যে।বাবা সাথে সাথে নাঁখোশ করে দেন।মা যে আসবেন ফোনে খালামণিকে বলেননি।আজ সকালে হুট করে এসেই আমাদের অবাক করে দেন। এসে মা প্রথমে যেটা করেন তা হলো মা সোঁজা আমার রুমে ঢুকে আমাকে জড়িয়ে ধরেন।আর সাথে সাথে কেঁদে উঠেন।কান্নারত গলায় বলেন,
“তোকে খামোখা তোর বাবার সাথে থেকে কতটা ভুল বুঝেছি!ওই অভি ছেলেটা আসলেই ভালো না।ভালো হলে কেউ এত তাড়াতাড়ি একটা বিয়ে ভাঙ্গার শক না কাঁটিয়ে উঠতে আরেকটা বিয়ে করে ফেলে?ও না পারিসা?সত্যি তোকে কখনো ভালোবাসে নি। তুই ঠিক ই করেছিস ওকে ডিভোর্স দিয়ে!সত্যি মা এখন বুঝতেছি ওর ঘরে গেলে তুই সুখে থাকতিস না!”
বলে মা আরো কাতর জড়ানো কন্ঠে কেঁদেকুটে আকুল হয়ে যান।আমি বুঝলাম অভির ছবিটা দেখার পর মা
মোটামুটি আমাকে বুঝতে পেরেছেন।খুব করে বুঝেতে পেরেছেন!মার মতন বাবাও যদি বুঝতেন!তারপর মার সাথে অনেকক্ষণ যাবৎ কথাবার্তা বলি।খালামণিও তার কিছু কাজকর্ম ফেলে যোগ দেন আমাদের সাথে।দুপুর পর্যন্ত এভাবেই যায়।তারপর খালামণি মাকে নিয়ে আবার বাইরে চলে যায় কি কাজটাজ নাকি বাকি আছে।
সময় নেই তেমন।আর মাত্র দশ মিনিটস পর ফাহিমের কেক কাঁটা হবে।আমি রুম থেকে দরজার ঠেলে বাইরের দিকে আলতো উঁকি দিই।পুরো ডাইনিং এ,হলরুমে গেস্ট ভরে গেছে!আমি মাথার ওড়নাটা আরেকটু সামনে টেনে এনে রুম থেকে বেরিয়ে কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলাম। হুট করে কোথা থেকে ফাহিম এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে।আর লাফিয়ে লাফিয়ে কাউকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“এই যে ভাইয়া?এই যে আমাদের পারিসা আপু!আপু খুব খুব ভালো ড্রয়িং পারে!”
চলবে..