#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_২২
জানুয়ারির শুরুতে হিমেল হাওয়া দিন দিন যেন বাড়ছে।সকাল শেষে মিহি রোদ জানলা ভেদ করে রুমে প্রবেশ করলেও হিমেল হাওয়ায় আবারো সারা শরীর শিউরে উঠছে।ধবধবে সাদা পাঞ্জাবির সঙ্গে গায়ে কাশ্মীরি শাল জড়িয়ে নেয় আফীফ।আজ বাড়িতে বৈঠক বসবে।গ্রামের প্রত্যাক সদস্যদের সুবিধা-সুবিধা,চাওয়া-পাওয়া ,অন্যায়-অবিচার,আবদার নিয়ে আলোচনায় বসা হবে।প্রতি সাপ্তাহের মঙ্গলবার দিনটিতে আফীফ বৈঠকে বসেন।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দশটা পঞ্চাশ মিনিট বাজতে দেখে দ্রুত আয়নার সামনে দাঁড়ায়।গালে কামড়ের দাগটা একদম সেঁটে গেছে।এই দাগের কারনে আজ তিনদিন রুম বন্দি সে। বাইরে কাজের প্রয়োজন হলে মাক্স পরে বের হয় কিন্তু পরিবারের সকলের সামনে মাক্স দিয়ে মুখ ঢাকা বেমানান।বরং তখন সন্দেহ সবার বাড়বে।আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আফীফ নিজের গালে হাত ছোঁয়ায়।উপরে নিচের তিন দাঁতের দাগ একদম স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।বিষটি নিয়ে আফীফের মাঝে মোটেও খারাপ লাগা কাজ করছে না বরং ভালোলাগা এবং ভালোবাসার সংমিশ্রণে অনুভূতি তৈরি হয়েছে।সেহেরিশের ভালোবাসা জড়িয়ে আছে এর মাঝে।আচ্ছা মেয়েটা যে না চাইতেও আফীফকে তার ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে দিচ্ছে সেটা কি সে যানে?
আফীফের ভাবনার ছেদ ঘটে মুনিফের কলে। পকেট থেকে ফোন বের করে গম্ভীর সুরে বলে,
– হ্যা মুনিফ বল।
– ভাই অনেকেই চলে এসেছে তুমি দ্রুত আসো।
– হুম অপেক্ষা কর আমি আসছি।
আফীফ চাবি এবং মোবাইল হাতে রুম থেকে বের হতেই সেহেরিশের সঙ্গে চোখাচোখি হয়।সেহেরিশ নিজেও এই মাত্র তার রুম থেকে বের হচ্ছে।আফীফকে দেখেই লজ্জায় মাথা নুইয়ে দ্রুত আবার রুমে ঢুকে যায়।আফীফ তার কান্ডে ঠোঁট কামড়ে হাসতে থাকে।চাবির গোছাটা উপরের দিকে ছুড়ে আবার ক্যাচ নিয়ে বলে,
– ইসস আমার লজ্জাবতী বউটারে!
.
দরজার সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সেহেরিশ।আফীফকে দেখলেই লজ্জায় লালভাব ছড়িয়ে যায় তার মুখে।সেদিনের কান্ডে আজও ইতস্তত বোধ করে সে।আফীফ মুখের ব্যান্ডেজ খুলে একবারের জন্য সেহেরিশকে কামড়ের দাগটা দেখাতেই সাত আসমান থেমে ধম করে যেন নিচে পড়ে সে।নিজের কান্ডে নিয়েই লজ্জায় মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকে।কিন্তু চতুর আফীফ সেহেরিশকে লজ্জায় ফেলতে তাকে দেখলেই “সেদিন রাত” শব্দটি মুখ বিড়বিড় করে বলতে থাকে।কিন্তু সেই রাতে কি হয়েছিল তা আফীফ তাকে বলে নি কিংবা তার তিলার্ধেক পরিমানেও মনে পড়ছেনা তার।সেহেরিশ দরজা খুলে বাইরে উঁকিঝুঁকি মারছে আফীফ আছে কি না তা দেখার জন্য।কাউকে না দেখে সে বাইরে বের হতে নিলেই আচমকা আফীফ হুড়মুড় করে তার রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়।আফীফের কান্ডে সেহেরিশ নিজেও হতবাক।
সেহেরিশকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে আফীফ এক গাল হাসি দেয়।মুখের মাক্সটা খুলে হাসিটা স্থির করে।
– দেখো তুমি গালের দাগটা।আজ আমার বাড়িতে বিশেষ বৈঠক কিন্তু এই দাগ নিয়ে সবার সম্মুখে আমি হই কি করে বলতো?
– আপনি মাক্স খুললেন কেন?মাক্স পড়ে বৈঠকে যান।
– তা যাবো কিন্তু গালের দাগটা দেখো দিন দিন কেমন কালচে হয়ে উঠছে।
সেহেরিশ একপলক তাকিয়ে মাথা নুইয়ে নেয়।আফীফ যে তাকে লজ্জায় মারতে এইসব ছল কৌশল করছে তা খুব ভালো করেই যানে সে।
– সরি বললাম তো।তবুও কেন এমন করছেন?
– উহহ সরি বললে হবে না ফুলপরী আমি রিভঞ্জ চাই!রিভেঞ্চ মানে রিভেঞ্জ।
শেষ কথাটা আফীফ বেশ দৃঢ় সুরেই বললো।সেহেরিশ তৎক্ষনাৎ তার দু-গালে হাত দিয়ে মাথা নামিয়ে বলে,
– ছিহহ এইসব করে আমার গায়ে কলঙ্ক মাখবেন না।আমি আবারো দুঃখ প্রকাশ করছি এবারের মতো মাফ করে দিন।সেদিন রাতে কি হয়েছিল তা ভেবে আমি মরছি আপনি আবার এইসব করে আমাকে জানে মেরে দেবেন না প্লিজ।
– আরে চাপ নিচ্ছো কেন?সেদিন রাতে যা হয়েছে বেশ ভালোই হয়েছে।
– মানে?
– না কিছু না।বাই দা ওয়ে তোমার মতো নাকি আমি।একা একটা মেয়েকে পেয়ে এইসব করবো?আমি আমার বৈধতা নিয়ে করবো।তখন তোমার গায়ে কলঙ্ক লাগুক আর কালি লাগুক তুমি আমারি থাকবে।রিভেঞ্জ তোলা রইলো।আল্লাহ হাফেজ ফুলপরী।
আফীফ দরজা খুলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।এদিকে সেহেরিশ রাগের মাথায় শব্দ করে দরজাটা বন্ধ করে বিড়বিড় করতে থাকে,
– বৈধতা মাই ফুট।
সহসা সেহেরিশের নাম্বারে একটি কল আসে।নতুন ফোন নতুন সিম হওয়ায় কারো নাম্বার সেভ নেই তার কাছে তাই নাম্বারটি কার ঠিক ঠাহর করতে পারছে না সে।ফোন রিসিভ করতেই কানে আসে সেই চিরচেনা কন্ঠ।
– অন্তত রিভেঞ্জ নেওয়ার জন্য হলেও তোমায় বিয়ে করবো ফুলপরী।আমার ভালোবাসা বড্ড তেতো।
সেহেরিশ থমকে যায় এই লোকটা যে তাকে লজ্জায় মারার জন্য তার পিছু নিয়েছে সেটা সে ভালো করেই বুঝতে পারছে।
__
শক্ত মুখ করে বেশ রাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রৌঢ় ব্যাক্তিটির দিকে তাকিয়ে আছে আফীফ।গ্রামে বাল্যবিবাহ,যৌতুক প্রথা সে দূর করলেও কিছু কিছু মানুষের মন থেকে তা দূর করতে পারেনি।আফীফ গ্রামের প্রত্যাকটা মেয়ের জন্য মেট্রিক পরিক্ষা পর্যন্ত পড়াশোনা বাধ্যতামূলক করেছে।এবং দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের পড়াশোনার খরচ তার নিজের।তবুও কিছু কিছু লোক তার অজান্তে আঠারো বছরের আগেই আড়ালে বিয়ে দেওয়ার সিধান্তে নেয়।ফল স্বরূপ আফীফের কানে ঠিকি পৌছে যায় বিয়ের সংবাদ।
– এত লুকোছাপা করে লাভ কি হয় চাচা।যে গ্রামটার মানুষগুলো আমার ইশারায় চলে আর আপনি সেই গ্রামের মানুষ গুলোকে আমার নিষিদ্ধ নিয়মে রাজি করাতে উতলা হয়ে উঠেছেন?
– ভুল হইয়া গেসে বাবা মাফ কইরা দাও।মাইয়াডার মা অসুস্থ তাই চাইছি বিয়া দিয়া চিন্তা দূর করতে।
– কোন ক্লাসে পড়ে সে?
– এইটে পড়ে।
– বাহ ক্লাস এইটের মেয়েকে বিয়ে দিতে এত উতলা হয়ে উঠলেন।আজকেই আপনাকে ফাস্ট এবং লাস্ট ওয়ার্নিং দিলাম আর যেন এমন ভুল করতে না দেখি।
– শুকরিয়া বাজান শুকরিয়া।
লোকটি দ্রুত তার হাত গুটিয়ে পালায়।মুনিফ ইশারা করলে একটি ছেলে এসে আফীফের সামনে দাঁড়ায়।তৎক্ষনাৎ সবাইকে অবাক করে দিয়ে আফীফ ছেলেটাকে ঠাস ঠাস করে চার থাপ্পড়ে মাটিতে বসিয়ে দেয়।শ্যামলা মুখমন্ডল ছেলেটির লালচে হয়ে গেছে।আফীফ দ্রুত ছেলেটির কলার টেনে আবার দাঁড় করায়।
– তোর সাহস কি করে হলো আমার নির্দেশ অমান্য করার?নিজের বউকে যৌতুকের জন্য নিয়মিত মারধোর করিস।কিন্তু কাল সহসা গরম পানি ছুড়েছিস।মেয়েটাকে যেমন কষ্ট দিয়েছিস তোর শাস্তিও তেমন হবে।মুনিফ জানোয়ার টাকে নিয়ে যা।ভালোভাবে গরম পানি দিয়ে গোসল করাবি।
– ভাইজান মাফ কইরা দেন এমন দুঃসাহস আমি আর দেহামু না।ভাইজান মাফ কইরা দেন আমারে।
– চুপ!তোকে মাফ করলে আরো দশজন একই অন্যয় করতে সাহস পাবে।কি হলো মুনিফ নিয়ে যাচ্ছিস না কেন?
মুনিফ দ্রুত ছেলেটাকে নিয়ে যায়।এদিকে এতক্ষণ যাবৎ আফীফের কান্ড দেখছিল সেহেরিশ,মৌ এবং আমান।আফীফের ধমকে,চাহনী, সব কিছুতে সেহেরিশ ভীতিগ্রস্ত।এটা তো সেই আফীফ না যে আফীফ তাকে বারংবার লজ্জায় ফেলে।হুটহাট ধমক দেয় আবার আদুরে সুরে কাছে টেনে নেয়।এটা তো রাগান্বিত, ক্রুদ্ধ, তেজি আফীফ।এই আফীফের মুখমন্ডল সেহেরিশ সেই আট বছর আগে শুরুতে দেখেছিল আর সেদিন বন্দি রুমে।এই একটা লোক কতটা রূপ নিয়ে চলে ভাবা যায়।
– ইসস জামাল চাচা আপনার কথাটা দ্রুত বলুন প্লিজ!আমি আর অপেক্ষায় থাকতে পারছি না।
আমানের বিড়বিড় কন্ঠে ধ্যান ভাঙ্গে সেহেরিশের।
– কি হয়েছে এমন বিড়বিড় করছো কেন আমান?
– আপু জামাল চাচার মেয়ের বিয়ে।
– তো?আর জামাল চাচা কে?
– ওই যে পাঞ্জাবি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে ওই আঙ্কেল টা।তার মেয়ের বিয়ে শুক্রবার।আমাদের সবাইকে দাওয়াত করতে এসেছে।কিন্তু দেখবে আফীফ ভাইয়া সবার দাওয়াত ক্যান্সেল করে শুধু মাত্র নানাজান,তার এবং মুনিফ ভাইয়ার দাওয়াত গ্রহন করবে।আফীফ ভাইয়া সবসময় আমাদের দাওয়াতের কিসমত মেরে দেয়।
আমানের রুষ্ট কন্ঠ।সেহেরিশ ভ্রু কুচকে আমানের হাতটা আলতো ভাবে ধরে বলে,
– একটা বিয়ে মিস করলে কি হয় আমান?
– তুমি জানো গ্রামের বিয়েতে কতটা মজা হয়।গায়ে হলুদের দিন রঙ ছোড়াছুড়ি।সবাই কাঁদা পানিতে গড়াগড়ি করে কত আনন্দো করে।বিয়ের দিন বরের জুতা চুরি,গেট আটকে টাকা নেওয়া,গান বাজনা,ভোজন, উফফ এইসব মজা তুমি কখনো ফিল করোনি সেহেরিশ আপু।
– এহহ বিয়েতে এইসব করে?আজ শুনলাম আমি।গ্রাম্য বিয়ের আনন্দ আমি এর আগে ফিল করিনি।
– তুমি পারবে আপু ভাইয়া দাওয়াত ক্যান্সেল করলে তুমি বলবে তুমি সবাইকে নিয়ে বিয়েতে যেতে চাও।প্লিজ আপু প্লিজ।
– আরে না তোমার ভাইয়ার সাথে আমি রাগ করেছি আমি কথা বলবো না।
সেহেরিশের কথায় মৌ এবং আমান দুজনে রুষ্ট হয়।কিছুক্ষণ পর জামাল আফীফের দিকে এগিয়ে আসে।
– আফীফ বাবা তোমার কাছে আবদার নিয়ে এসেছি।
– কী আবদার চাচা?
– আমার মেয়েটার পড়াশোনা যথেষ্ট পরিমান শেষ।এখন ভালো ঘর এবং বর দেখে বিয়ে দেওয়ার সিধান্ত নিয়েছি।বিয়েটা ঠিক করে ফেলেছি বাবা।
– আলহামদুলিল্লাহ! শুনে খুশী হলাম চাচা।
– এবার আমাকে যে খুশি করতে হবে তোমার।দেওয়ান মঞ্জিলের সকলের দাওয়াত আমার মেয়ের বিয়েতে।বাড়িতে নতুন মেহমান এসেছে দেখেছি তাদের সহ দাওয়াত রইলো।আমাকে ফিরিয়ে দিও না বাবা।
– চাচা আপনার দাওয়াতে আমি খুশি হলাম এবং গ্রহণ করলাম।কিন্তু উপস্থিত আমি মুনিফ আর দাদাজান থাকবো।
– সে কি কথা আমি তো সবাইকে দাওয়াত করেছি।তোমাদের সবাইকে যেতে হবে।
– চাচা দেখা যাক কে যায় আর কে না যায়।তবে আমরা তিনজন অবশ্যই যাবো।আর বিয়েতে কোন প্রয়োজনে অবশ্যই আমাদের জানাবেন
– শুকরিয়া বাবা।আমি তবে আসি।তোমার নানাজানকে সালাম জানাবে।
– অবশ্যই।
আফীফের কথায় আবারো রেগে যায় আমান এবং মৌ।
– দেখলে সেহেরিশ আপু।কি পরিমান বেয়াদবি করছে ভাইয়া।আমাদের হক’টা মেরে দিচ্ছে।
– তাই তো দেখছি আমান।তবে আমি বিয়েতে যেতে চাই যে করেই হোক তুমি ব্যবস্থা কর।
– আমার কথার চাইতেও ভাইয়া তোমার কথার দাম বেশি দেবে।তাই বলছি কি একবার তুমি বলে দেখো।
– শুনো তুমি গিয়ে বলবে জামাল চাচার বিয়েতে সেহেরিশ আপু যেতে চায়।দেখবে তোমার ভাইয়া রাজি হবে।একবার চেষ্টা করে দেখো।
– ওকে।
আফীফের বৈঠক শেষে মুনিফের সঙ্গে আলাপচারিতা করতে করতে বাগানের দিকে হাটা শুরু করে।তখনি তার সামনে দাঁড়ায় আমান।
– ভাইয়া।
– কি রে কিছু বলবি?
– হ্যা সেহেরিশ ভাবী পাঠিয়েছে একটি আবদার নিয়ে।
– কোথায় তোর ভাবী?
– ওই যে তালগাছটার পেছনে।
এতক্ষন আমান আর আফীফ ফিসফিসিয়ে কথা বললেও বর্তমানে আফীফ বেশ জোরেই উওর দেয়।
– কি বলবি বল।
– আসলে সেহেরিশ আপু চাইছে জামাল চাচার মেয়ের বিয়েতে অংশগ্রহণ করতে।আপু সবাইকে নিয়ে বিয়েতে যেতে চায়।
– তোর আপুকে বল সেকি বিয়ে করতে চাইছে নাকি খেতে চাইছে?
আফীফ কথাটি বলেই সহসা হাঁটা শুরু করলো।এদিকে সেহেরিশ স্তম্ভিত হয়ে তার পানে তাকিয়ে আছে।আমান ঘুরে তাকিয়ে সেহেরিশের উদ্দেশ্য প্রশ্ন ছুড়ে দেয়।
– সেহেরিশ আপু তুমি কি বিয়ে করতে চাও নাকি খেতে চাও?
আমানের প্রশ্নে অপ্রতিভ অবস্থায় পড়লো সেহেরিশ।রাগ নিয়ে উলটো দিকে হাটা শুরু করে বিড়বিড় করে বলে,
– যেমন বর তেমন দেওর।দুইটাই বাদর!ইসস কি সব বলছি আমি।কে আমার বর কে আমার দেওর?এদের মাঝে থেকে সেহেরিশ তুই পাগল হয়ে গেছিস।
#চলবে….
#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_২৩
বসার ঘরে দেওয়ান বাড়ির সকলের আজ হইচই জমে গেছে।আফীফ অবশেষে বাড়ির সবাইকে নিয়ে বিয়ে বাড়ির দাওয়াতটা গ্রহণ করতে রাজি হয়েছে।তারপর থেকেই মৌ,আমানের মাঝে হইচই বিরাজমান।কিন্তু মুখ গোমড়া করে বসে আছে সেহেরিশ।কি পরবে সে বিয়ে বাড়িতে!হাতে তিনটে জামা।তিনটাই ভারী কাজের গর্জিয়াস ফ্লোর টার্চ গাউন।কিন্তু কোনটা পড়বে?জামা গুলো হাতে নিয়ে দম করে চন্দনার সামনে বসে যায়।এতক্ষন যাবৎ আফীফ চুপচাপ ল্যাপটপে মুখ গুজে সেহেরিশের কান্ড দেখছে।
– আন্টি প্লিজ হেল্প মি আমি কোন জামাটা পড়বো?
– সবগুলো জামা সুন্দর।এবার আমি কি বলি বলতো? আচ্ছা তুমি মিষ্টি রঙের জামাটা পড়ো।
– হাহ এটাই তো আমি ভাবছিলাম।এই জামাটা পড়লে আসলেই আমাকে কিউট লাগে।
সেহেরিশ জামাটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়।গায়ের সাথে মাপ দিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখতেই কানে আসে আফীফের গমগমে সুরের কথা,
– এখানে বিয়ে খেতে যাওয়া হবে ঝাড়ু দিতে নয়।গ্রামের রাস্তায় কাদামাটি,থাকবেই এইসব ঝাড়ু ওয়ালা জামা না পরাই বেটার।
আফীফ ল্যাপটপটা হাতে নিয়ে উঠে চলে যায়।এদিকে আফীফের এমন কথায় ঠোঁট টিপে হাসে চন্দনা,আমান। সেহেরিশ রাগ দেখিয়ে জামাটা ছুড়ে মারে মেঝেতে,
– আন্টি আপনি বলুন এই জামাটা খারাপের কি হলো?
– না মানে এটা তো গ্রাম সেহেরিশ।বিয়ে বাড়িতে এই জামাটা পড়ে তুমি আরাম পাবেনা।
– থাক আমি বিয়েতেই যাবো না তোমরা সবাই যাও।
সেহেরিশ জামা গুলো রেখেই নিজের রুমের উদ্দেশ্য চলে গেলো।
রাতের খাওয়ার শেষে আফীফের রুমে প্রবেশ করে সেজুঁতি।তার মুখটা গম্ভীর নিরবতা বিরাজ মান।
– আমায় কেন ডেকেছিস?
– আম্মা তুমি এইভাবে মুখ ভার করে রেখেছো কেন?
– না কিছু না।
– আব্বার সাথে ঝগড়া করেছো?
– না।
– তবে?
– বললাম তো কিছুনা।
আফীফ নিজের মায়ের রেগে থাকাটা বুঝতে পারে কিন্তু কেন রেগে আছে তার মোটেও আন্দাজ করতে পারছে না।
– আমার সাথে ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বলবে না আম্মা।এমন ত্যাড়ামো আমার মোটেও ভালোলাগে না।
– তোর ভালোলাগেটা কি?
সেঁজুতির ঝাঝালো কন্ঠে আফীফ চমকে যায়।মায়ের দুবাহু জড়িতে ধরে অনুনয় সুরে বলে
– আম্মা কি হয়েছে তোমার।কেউ কিছু বলেছে?
সেজুঁতি এবার ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই দিলেন।তার চোখের নোনাজল আফীফের
শাল ভিজিয়ে দিচ্ছে সেদিকে তাকিয়ে রুষ্ট হলো আফীফ।
প্রিয় মানুষ গুলোর চোখের জল মোটেও সহ্য হয় না।তাদের একএকটা চোখের নোনাজল আমাদের বিষ গেলার মতো অবস্থা হয়।
সেখানে আফীফ তার মায়ের চোখের জল সহ্য করবে কি করে?তার তো ভেতরটা মুষড়ে যাচ্ছে।
– আম্মা কি হয়েছে বলো আমায়। তোমার চোখে পানি কেন?
– তোর দাদী আজো আমার সাথে রাগারাগি করেছেন।
– কিন্তু কেন?
– তোর বিয়ে নিয়ে।তোর কারনে সে তার সন্তানকে কাছে পাচ্ছে না।এদিকে তোর বয়সটাও কম হয়নি।বিয়ের উপযুক্ত সময় বিয়ে দেওয়াটাই উচিত।
– দাদীজানের কি আর কাজ নেই সুযোগ পেলেই এইসব বিষয় নিয়ে তামাশা শুরু করেন।দেখো আম্মা তুমি কেঁদে কেঁদে আবার বেহুশ হইয়ো না।আমাকে আমার প্লানিং মাফিক কাজ করতে দাও।
আর প্যাকেট গুলো নাও।সেহেরিশকে জামা গুলো দেবে।বেচারিকে রাগিয়ে দিয়েছি তাই বিয়েতে যাবে না বলেছে।
সেজুঁতি প্রত্যুত্তর করলো না পেকেট গুলো হাতে নিয়ে সহসা রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
বাবরি চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে হালকা সাজসজ্জায় তৈরি হয়ে নিলো সেহেরিশ।তার চোখে মুখে আজ আনন্দের আভাস।কাঁচা হলুদ রঙের জামাটায় তাকে অপূর্ব লাগছে।এক রাশ মুগ্ধতায় গ্রাস করছে তাকে বারংবার।দুপুর শেষে বিকেলের ঠান্ডা শীতল আবহাওয়ায় জানান দিচ্ছে অন্যরকম অনুভূতির।রুম থেকে বের হতেই আফীফকে সামনে দেখে ভড়কে যায় সে।
– কি হলো এখানে কি করছেন?
– তোমায় দেখতে এসেছি ফুলপরী।
– দেখা হয়েছে এবার যান।
– উহুহ।আমি গেলে থাকবে কে?বাই দা ওয়ে তোমার লং গাউন থেকেও এই থ্রি-পিস টা বেশ মানানসই।
সেহেরিশ প্রত্যুত্তর করলো না।সোজা করিডোর পেরিয়ে নিচে নেমে গেলো।
বিয়ে বাড়িতে আজ গায়ে হলুদের হই হুল্লোড়ে চমকে আছে কেইন,তুন্দ্র,সেহেরি।ভরা মজলিশে সবাই তাদের দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে।সবার ভাব গম্ভীর এমন যেন চিরিয়াখানার তিনটে প্রাণী বিয়ে বাড়িতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে তাই সবাই অবাক হয়ে শুধু দেখছে।কেইন তুন্দ্রের হাত টেনে ক্রুদ্ধ স্বরে বলে,
– হোয়াটিস দিস ব্রো?আমার ভালো লাগছে না।এখানে মানুষ গুলো এত অদ্ভুত কেন?এভাবে তাকিয়ে থাকার মানে কি?
– আহ কেইন এটা গ্রাম।প্রত্যাকটা অঞ্চলের মানুষের ব্যবহার একই হবে এটা আশা করা মোটেও ঠিক না।
সেহেরিশ, তুন্দ্র, এবং কেইন এক সাইডে এসে চিপকে দাঁড়িয়ে আছে।নানান বাচ্চারা রঙ ছোড়াছুড়ি করছে।কিছু ছেলে সেহেরিশের দিকে আছে আড় দৃষ্টিতে।কেউ সরাসরি তাকানোর
সাহস ভুলেও করছে না।কেননা ইতিমধ্যে সবার জানা হয়ে গেছে মেয়েটি দেওয়ান বাড়ির অতিথি।
হঠাৎ দুইজন মহিলার কানাঘুষা সেহেরিশের কানে এলো।
– মাইডার চুলডি এত ছোড কিল্লাইগা।এরুম হইলে কেরুম লাগে?
– হ ঠিক কইছো। হুনছি বিদেশে থাহে।বিদেশী মাইয়া গুলার চুল এমনেও ছুড হয়।
সেহেরিশ হতভম্ব হয়ে মেঝেতে দৃষ্টি নিমজ্জিত করে সব কিছু কেমন যেন খাপছাড়া লাগছে তার কাছে।অদ্ভুত সবার আচরণ।সন্ধ্যার পর সবদিকে লাইটিং ব্যবস্থা।সাউন্ড বক্সের জোরে জোরে গানের তালে পরিবেশটা জমজমাট।তুন্দ্র সুযোগ পেলেই সবার ছবি তুলতে ব্যস্ত কিন্তু কেইন আর সেহেরিশ মন মরা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক কোনায়।আমান, মৌ, সামী সবাই এদিক থেকে সেদিক ছোটাছুটি করছে।সেহেরিশ ভেবেছিল বিয়ে বাড়িটায় হইচই আনন্দ করবে কিন্তু তার ভাবনার মিথ্যা প্রমান করে দিয়ে সব অনুভূতি সাদামাটা হয়ে গেছে।আফীফ দূর থেকে সেহেরিশকে ভালোভাবে পরখ করছে। সেহেরিশের মনমরা অবস্থা দেখে তার ভ্রু কুচকে যায়। যে মেয়েটি বিয়ে বাড়িতে আসতে এতটা এক্সাইটেড ছিল হঠাৎ তার কি হলো?
আফীফ ইশারায় আমানকে কাছে ডাকে।আমান ভাইয়ের ইশারা বুঝতে পেরে ছুটে চলে আসে,
– এই তোর ভাবীর সঙ্গে দেখা করবো নিরিবিলি জায়গা খুজে দে।
– এখানে নিরিবিলি জায়গা কোথায় পাবো আমি? সব দিকেই মানুষজন।
– আরে ব্যবস্থা কর।তুই না তোর ভাবীর একমাত্র দেওর।
– ব্লাকমেইল করছো?
– আরে না রে ভাই দ্রুত ব্যবস্থা কর।
– ওকে ঘরের পেছনটায় চলে আসো।
– গুড বয়।
আমান এক ছুটে সেহেরিশের সামনে দাঁড়ায়।ফসফস করে শ্বাস ছেড়ে একগাল হাসি দিয়ে বলে,
– আপু তোমার কি হয়েছে এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন?
– আমার ভালো লাগছে না আমান।বাড়ি যেতে চাই।
– এই ভাবে চিপায় চিপকে থাকলে ভালো লাগবে কি করে?এসো আমার সাথে এসো।
আমান সেহেরিশের হাত টেনে বাড়ির পেছনে নিয়ে যায়।
– সেহেরিশ আপু দাঁড়াও তুন্দ্র ভাইয়াকে নিয়ে আসি এখানে নিরিবিলি লাইটিং ব্যবস্থা ছবি ভালো আসবে।
– ওকে যাও।
আমান দ্রুত চলে যায়।সেহেরিশ একা চারিপাশটা পরখ করছে।নিয়ন বাতির হালকা আলোতে উজ্জ্বল হয়ে আছে চারিদিক।অন্ধকারের মাঝে লম্বা লম্বা তাল গাছ গুলোর দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠলো সেহেরিশ।মনের মাঝে কেমন কু ডাকছে।পেছনে ঘুরতে দম করে ধাক্কা লাগে কারো সাথে।
– আরে’হ
– এই মেয়ে এখানে একা কি করছো তুমি?
আফীফের ঝাঝালো কন্ঠে চমকে তাকায় সেহেরিশ।আমতা আমতা করে কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়।মিহি বাতাসে সারা শরীর চনমনিয়ে উঠছে তার।
– মুখে কি তালা এঁটে দিয়েছো নাকি?আমি কিছু প্রশ্ন করছি।
– আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই দাঁড়িয়ে আছি।
– বাহ ভালো উওর।বিয়ে বাড়িতে আসার জন্য এত দৌড় ঝাপ দিলে অথচ এখানে এসে থেমে গেলে কেন?
– কিছু না।
সেহেরিশের ত্যাড়া জবাবে রুষ্ট হয় আফীফ।দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে আলতো করে সেহেরিশকে কাছে টেনে আনে।
– কাজি রেডি চলো বিয়ে করে ফেলি।
– আপনার ইচ্ছে হলে করে ফেলুন আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন?
– তুমি রাজি থাকলে এখনি কবুল।
সেহেরিশ মুখ ভেংচালো কিন্তু কোন জবাব দিলো না।আফীফ ডান হাতটা উপরে তুলে এক থাবা রঙ সেহেরিশের গালে লেপ্টে দিলো। অন্ধকার মিশ্রিত হালকা আলোতে টকটকে লাল রঙ সেহেরিশের মাঝে অন্য রকম সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে।
– বাহ!
– গালে রঙ লেপ্টে দিলেন কেন?আমার এত সুন্দর স্কিনটা এবার নষ্ট হয়ে যাবে।
– উহুহ কিচ্ছু হবে না ফুলপরী।খুব শীঘ্রই আমরা বিয়ে করছি।
– কখনো না। আপনি জেগে জেগে সপ্ন দেখুন।
সেহেরিশ গাল মুছতে মুছতে দ্রুত চলে যায়।আফীফ চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়তেই তার কানে আসে খচখচে কাগজের মাঝে কারো হাটার শব্দ।আফীফ চমকে যায়।এতক্ষণ সেহেরিশের কাছ থেকে নিজেকে দূরে দূরে রেখেছে একমাত্র কেউ যেন সন্দেহ না করে আফীফ আর সেহেরিশের গভীর সম্পর্কের কথা।আশেপাশে হাসিখুশি ভালো মুখোশধারী অনেকেই আছে।যারা আড়ালে দিন শেষে আফীফের ক্ষতি করতে উঠে পড়ে লেগে আছে।
______
কান্নার শব্দে ভারী হয়ে উঠছে দেওয়ান বাড়ি।অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে ভারী মাথাটা নিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাড়ালো আফীফ।দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে ঠোঁট কামড়ে তাকিয়ে আছে সেহেরিশের ছবি গুলোর দিকে।তার চোখের কোনে পানি।এক পা দু পা করে এগিয়ে যায় দেয়ালের সামনে।সেহেরিশের ছবিগুলোতে হাত বুলিয়ে বিড়বিড় করে বলে,
– গত দুইদিন থেকে তুমি নিখোঁজ ফুলপরী।কোথায় আছো?তোমার অভাবে এই বাড়ির মানুষ গুলো যন্ত্র মানব হয়ে গেছে।দেখো তোমার ভাষ্যমতে নিষ্ঠুর স্বার্থপর আফীফ দেওয়ানের চোখে আজ জল।এই চোখের জল আজ থেকে আট বছর আগে ঝরেছে একমাত্র তোমার কারনে আর আজ আবার!আমি আর পারছি না।আমার সকল চেষ্টা বৃথা যাচ্ছে।
আফীফের চোখের পানি টপটপ করে ঝরে পড়ছে। সেহেরিশের ছবিগুলোয়ে হাত বুলিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়।সেন্টার টেবিলের সামনে লালচে কাগজটা হাতে তুলে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।সেদিন পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিতেই আফীফ কাগজটা পায় যেখানে লেখা ছিল,
” প্রিয় মানুষটা হারিয়ে যাওয়ার কষ্ট বড্ড ভয়াবহ!”
আফীফ তখনি থমকে যায়।তার মস্তিষ্কে বার বার জানান দেয় সেহেরিশের কিছু হলো না তো।তার ভাবনাকে সত্যি করে দিয়ে আজ দুইদিন সেহেরিশ নিখোঁজ। দরজায় কারো করাঘাতে চোখ মুছে দরজা খুলতে এগিয়ে যায় আফীফ।দরজা খুলতেই অস্থির মুনিফকে দেখে থমকে যায়।অস্থির মুনিফ হড়বড়িয়ে বলতে থাকে,
– ভাই তাড়াতাড়ি আয়।সেহেরিশের আব্বা ঘুরে পড়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলেছে।ভীষণ রক্ত ঝরছে। কি করবো এখন আমার মাথায় আসছে না।
#চলবে…..