#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৩৯
____________
মিতুলের মন, মেজাজ দুটোই খারাপ। ও নিজ থেকে জোহানকে ঘুরতে যাওয়ার কথা বলেছে, আর জোহান ওর মুখের উপর না বলে দিলো? এই জোহান কোনো দিনই আসলে শুধরাবে না। কোনো চান্স নেই শুধরানোর।
চেরি ব্লসম ট্রির নিচে দাঁড়িয়ে আনমনে কথাগুলো ভাবলো মিতুল। চেরি গাছগুলো একেবারে স্থির। একটা দুটো পাপড়িও ঝরছে না। মিতুলের মনে হলো ওর মন খারাপ বলে, গাছগুলোও মন খারাপ করে রেখেছে। মিতুল নিচে পড়ে থাকা পাপড়ি থেকে একটা পাপড়ি তুলে নিলো। পাপড়িটা একেবারে শুকিয়ে কুঁচকে গেছে। মিতুল এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল পাপড়িটার দিকে।
পিঠে হঠাৎ কিছুর তীক্ষ্ণ আঘাতে ওর দৃষ্টি সরে গেল পাপড়িটার থেকে। মিতুল আশেপাশে তাকাতে লাগলো। কী এসে লাগলো ওর পিঠে? মিতুল নিচে খোঁজা খুঁজি করতে একটা ছোট আকৃতির মসৃণ পাথর দেখতে পেল। মিতুল তুলে নিলো পাথরটা। ওর বুঝতে বাকি নেই এই পাথরটা কীভাবে ওর পিঠে এসে পড়েছে। এটা নতুন কিছু নয়। মিতুল বারান্দার দিকে তাকালো। জোহান বদমাইশটা দাঁড়িয়ে আছে। মিতুলের ইচ্ছা করলো পাথরটা ছুঁড়ে মেরে জোহানের মাথা ফাটিয়ে দেয়। কিন্তু ওর হাতে যে জোর আছে তাতে এই পাথর বারান্দা পর্যন্ত উড়ে যেতে পারবে না। মিতুল জোহানকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করলো। আগের মতো নিজ ধ্যানে মনোযোগ দিলো।
কিছুক্ষণ পরই খুব কাছেই কারো হেঁটে আসার পদধ্বনি হলো। মিতুল তাকিয়ে দেখলো না কে এগিয়ে আসছে ওর কাছে। শুনতে পেল জোহানের গলা,
“দুই মিনিট সময় দেবো। এর মধ্যে গ্যারেজে উপস্থিত দেখতে চাই।”
মিতুল পাশ ফিরে তাকালো। জোহান ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছে ইতোমধ্যে।
মিতুলের মন খুশিতে নেচে উঠলো। তাহলে ঘুরতে নিয়ে যাবে জোহান?
মিতুল দৌঁড়ে রুমে চলে এলো। ক্লোজেট থেকে একটার পর একটা ড্রেস বের করে দেখতে লাগলো। কোনটা পরবে বুঝছে না। অনেক যাচাই বাছাই করে একটা ভায়োলেট কালারের গাউন সিলেক্ট করলো। জোহানের দেওয়া দুই মিনিট সময় অনেক আগেই অতিবাহিত হয়ে গেছে। মিতুল সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না। আরও সময় নিয়ে সাজলো। রুম থেকে বের হলো ত্রিশ মিনিটের মাথায়। সন্ধ্যা কেটে রাত নেমে গেছে। মিতুল খুশি খুশি মন নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এর মাঝেই রেশমী আন্টির কণ্ঠ ওর রক্ত হিম করে দিলো!
“মিতুল, কোথায় যাচ্ছ?”
মিতুল আর এক পা সামনে এগোনোর শক্তি পেল না। পিছন ফিরে তাকাবে সে সাহসও রইল না। তবুও ফিরলো।
রেশমী আন্টি সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আছে।
ভয়ে মিতুলের হৃদপিণ্ড কাঁপছে। রেশমী আন্টি রুম থেকে বের হয়েছে? এমন সময় কেন বের হলেন যখন ও জোহানের সাথে বাইরে যাবে? কী বলবে এখন রেশমী আন্টিকে? জোহানের সাথে ঘুরতে যাচ্ছে, কী করে বলবে সেটা?
রেশমী আন্টি সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আবারও জিজ্ঞেস করলেন,
“কোথায় যাচ্ছ?”
মিতুল এবার আর উত্তর না দিয়ে পারলো না। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
“আ-আসলে আন্টি…জোহানের সাথে বাইরে ঘুরতে যাচ্ছি। আমিই ওকে বলেছিলাম ঘুরতে যাওয়ার কথা। ও বলেনি।”
মিতুল আজ বানিয়ে মিথ্যা বলতে পারলো না। সত্যি কথাটাই মুখ ফুঁটে বেরিয়ে গেল। মিতুল ভয়ে ভয়ে আছে। রেশমী আন্টি নিশ্চয়ই এখন বলবেন, জোহানের সাথে ঘুরতে যাওয়ার দরকার নেই।
রেশমী আন্টি কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন।
মিতুল বুঝতে পারছে না, রেশমী আন্টি কী থেকে কী বলে ফেলে আবার।
রেশমী মিতুলকে অবাক করে দিয়ে বললেন,
“ঠিক আছে যাও।”
মিতুল সত্যিই অনেক অবাক হয়েছে। রেশমী আন্টি পারমিশন দিলেন? খুশিতে গদগদ হয়ে গেল ও। পুলকিত কণ্ঠে বলে উঠলো,
“থ্যাঙ্ক ইউ আন্টি।”
বলেই প্রায় দৌঁড়ে বের হলো ঘর থেকে।
গ্যারেজে এসে জোহানের গাড়ি না দেখে ভাঁজ পড়লো কপালে। জোহানের গাড়ি কোথায়? জোহান ওকে না নিয়ে চলে গেল না কি? দেরি করেছে বলে না নিয়েই চলে গেল?
মিতুল কল দিলো জোহানের কাছে। কল রিসিভ হতেই মিতুল বললো,
“তুমি এত খারাপ কেন বলো তো জোহান? আমাকে না নিয়েই চলে গেলে কী করে? না হয় একটু দেরিই করেছি, তাতে কী এমন হয়েছে? কীভাবে এটা করতে পারলে তুমি?”
জোহান ফোনের ওপাশে বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“প্রায় ত্রিশ মিনিট ধরে রাস্তায় গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি তোমার জন্য।”
“রাস্তায়? তুমি তো বললে গ্যারেজে আসতে।”
জোহান আর কোনো প্রতিউত্তর না দিয়ে কল কেটে দিলো।
মিতুল বাড়ি থেকে বের হতেই জোহানের গাড়ি দেখতে পেল। গাড়ির ভিতরে জোহান বসে আছে।
মিতুল কোনো কথা না বলে গাড়িতে এসে বসলো।
“কোথায় যাচ্ছি আমরা?” মিতুল হঠাৎ প্রশ্ন করলো।
“একটা ক্যাফেতে।”
“কেন? ক্যাফেতে কেন?”
“আমার ফ্রেন্ডসরা আছে সেখানে।”
“ও।”
মিতুলের মাথায় হঠাৎ একটা ভাবনা উদয় হলো।
“আচ্ছা, সেদিন ক্লাবে তো তুমি একা ছিলে না। তোমার বন্ধুরাও ছিল। তাহলে ওই চারজন তোমাদের এত জনের সাথে পেরে উঠলো কীভাবে?”
“আমরা সব বন্ধুরা ছিলাম না।”
“তাহলে?”
“আমি, রিকার্ডো এবং শ্যেন ছিলাম। তিনজন ছিলাম আমরা।”
“রিকার্ডো, শ্যেনও কি আহত হয়েছে তোমার মতো?”
“সেটা গিয়েই দেখো।”
ক্যাফেতে এসে রিকার্ডোর মুখ দেখে মিতুলের মুখ করুণ হয়ে গেল। জোহান যে আঘাত পেয়েছে, তার থেকে বেশি আঘাত পেয়েছে রিকার্ডো।
শ্যেনের অবস্থা রিকার্ডো এবং জোহানের থেকে ভালো। রিকার্ডোকে দেখে মিতুলের সত্যি সত্যিই খুব খারাপ লাগছে। ছেলেগুলো এভাবে মারতে পারলো? দয়া-মায়া নেই ওদের মাঝে?
রিকার্ডো মিতুলকে করুণ মুখ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো,
“ইট’স ওকে মিটুল। ওদের থেকে আমরা বেশি মেরেছি ওদের।”
“তাই?”
রিকার্ডো গর্বের সাথে মাথা নাড়লো।
জোহান নিজের গিটার নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ক্যাফেতে গান গাইবে ও। মিতুলের পিছন থেকে যাওয়া দিলেই মিতুল জোহানকে থামালো।
“জোহান…”
“কী?”
“একটা কথা বলি?”
“কী কথা? বলো।”
মিতুল ইতস্তত করে বললো,
“আজকে একটা স্যাড গান গাও।”
জোহানের ভ্রু কুঁচকে গেল।
“স্যাড সং?”
মিতুল মাথা নাড়লো।
“হুম, একটা স্যাড সং শুনতে ইচ্ছা করছে। গাও না।”
জোহান হঠাৎ একটু নুয়ে মিতুলের কানে কানে বললো,
“আমি আহত বলে তুমি কষ্ট পাচ্ছ তুলতুল? তোমার হৃদয়ে ব্যথা হচ্ছে?”
জোহানের কথা শুনে মিতুলের বুকে সত্যি সত্যিই একটা চিনচিনে ব্যথার উপদ্রব শুরু হলো।
মিতুল দ্রুত মাথা ঘুরিয়ে সোজা হয়ে বসলো। অস্থিরতা শুরু হলো ওর মাঝে। কী বলে জোহান?
___________
কয়েকটা দিন খুব ব্যস্ত ভাবে পার করলো জোহান। সারাদিনই গান নিয়ে থেকেছে। ঘুমাতে গিয়েছে গিটার নিয়ে, জেগেছেও গিটার নিয়ে।
মিতুল দেখতো জোহান বাড়ির ভিতরে হাঁটতে হাঁটতেও গান আওড়াতো মুখে। বাড়িতে ছিল না বেশি। বেশিরভাগ সময়ই বাইরে থেকে রিহার্সেল করেছে, আর টাইম হাউজে থেকেছে। নির্জন জায়গায় না কি গান বিষয়ক ব্যাপারটা বেশি ভালো জমে।
মিতুলও ভেবে দেখেছে কথাটা সত্যি। মিতুল এখন জোহানের রুমের দিকে হেঁটে চলেছে। আজকে এক বিশাল কনসার্টের আয়োজন করা হয়েছে এডমন্টন সিটিতে। সেখানে পার্টিসিপেট করবে জোহান। মিতুলও যাবে জোহানের সাথে। সকাল থেকেই বেশ উৎফুল্ল ও। কত শিল্পীরা আসবে কনসার্টে। কত কত গান হবে, ড্যান্স হবে। ভাবতেই ক্ষণে ক্ষণে উত্তেজনার ঘনঘটা শুরু হচ্ছে ওর মাঝে।
মিতুল জোহানের রুমের দরজা একটুখানি ফাঁক করে উঁকি দিলো।
জোহান আয়নার সামনে বসে নিজের রূপসজ্জায় ব্যস্ত। মিতুল ডিস্টার্ব করলো না ওকে। দরজা বন্ধ করে আবার চলে এলো।
মিতুলের হঠাৎ জানতে ইচ্ছা করলো কনসার্টে রেশমী আন্টি যাবে কি না। কনসার্ট যেহেতু এডমন্টনেই, যাওয়া তো উচিত তার। একবার ব্যাপারটা যাচাই করে দেখবে না কি? যেমন ভাবনা তেমন কাজ।
মিতুল রেশমী আন্টির রুমে এলো।
রুমে রেশমী আন্টি একা। বেডে হেলান দিয়ে বইয়ে মুখ ডুবিয়ে রেখেছে। মিতুল রুমে প্রবেশ করেছে সেটা বুঝতে পারলেন তিনি। বই থেকে মুখ উঠালেন। মিতুলকে দেখে একটু হাসলেন।
মিতুলের কুন্ঠাবোধ হচ্ছে। তবুও মুখে জোরপূর্বক একটু হাসি আনলো। এগিয়ে এসে বসলো রেশমী আন্টির পাশে।
রেশমী বললেন,
“কী খবর?”
মিতুল আবারও একটু হাসার চেষ্টা করে বললো,
“না তেমন কিছু নয়। ব্যাপার হলো…আজকে রাতে তো বিশাল কনসার্ট হচ্ছে এডমন্টন সিটিতে। জোহানও তো পারফর্ম করবে সেখানে। তুমি যাবে না?”
রেশমীর মুখে হঠাৎ একটা গাম্ভীর্যের ছাপ পড়লো। তিনি বললেন,
“না মিতুল, আমি যাব না। আসলে আমার কিছু কাজ আছে শপে।”
“শপ?”
মিতুল রেশমী আন্টির থেকে শুনলো রেশমী আন্টিদের নিজস্ব একটা গ্রোসারি শপ আছে। মিতুল ক্যামিলার সাথে একদিন গিয়েওছিল সেই শপে। অথচ তখন ও জানতোই না ওটা রেশমী আন্টিদের শপ ছিল। মিতুলের হঠাৎ রেশমী আন্টিদের আরও বেশি ধনী মনে হলো। একটা বড়ো গ্রোসারি শপের মালিক, কম কথা নয়! এত এত টাকা দিয়ে কী করবে তারা? মিতুল এ নিয়ে আর মাথা ঘামালো না। ওর ভাবনা এখন রেশমী আন্টিদের টাকা নিয়ে নয়। রেশমী আন্টি কনসার্টে যাবে না বলে একটু মনোক্ষুণ্ণ হয়েছে ওর। রেশমী আন্টি কনসার্টে গেলে জোহান নিশ্চয়ই খুব খুশি হতো। মিতুল বললো,
“তাহলে তুমি যেতে পারবে না কনসার্টে?”
“না মিতুল।”
“ঠিক আছে। তাহলে এখন যাচ্ছি আমি।”
মিতুল চলে এলো। দেখতে পেলো জোহান ওর রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
মিতুল দৌঁড়ে এলো জোহানের কাছে। বললো,
“তুমি রেডি?”
জোহান ওর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললো,
“মমের কাছে গিয়েছিলে তুমি?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
“জানতে গিয়েছিলাম উনি কনসার্টে যাবেন কি না তোমার পারফরম্যান্স দেখার জন্য।”
জোহান হাঁটতে শুরু করলো। মিতুলও ওর সাথে সাথে হাঁটছে। জোহান বললো,
“মম কখনোই কোথাও যায় না আমার কনসার্ট দেখতে। আমার গান তার পছন্দ নয়। আমার গান করার ব্যাপারটা ভালো লাগে না তার।”
“কেন? তুমি তো খুব ভালো গান করো। তাহলে আন্টি পছন্দ করেন না কেন?”
“জানি না। ছোট বেলা থেকেই গানের প্রতি ঝোঁক ছিল আমার। তখন আমার সাত বছর বয়স। মম, ড্যাডের ম্যারিজ অ্যানিভ্যারসারিতে গান গেয়েছিলাম আমি। মম-ড্যাডকে নিয়ে নিজে লিখেছিলাম গানটা। অ্যানিভ্যারসারির গিফট হিসেবে। গান শোনার পর মম আমার গানকে ‘অহেতুক’ বলে সম্মোধন করেছিল। বলেছিল, আমি কীসব গাইলাম। এসব অহেতুক ব্যাপার রেখে শুধু পড়াশোনায় ফোকাস করতে।”
মিতুলের মুখ কালো হয়ে গেল একেবারে। সেই সাথে মনও মিশে গেল কালো ঘোলাটে রঙে। মিতুল বললো,
“রেশমী আন্টির তোমাকে উৎসাহ দেওয়া উচিত ছিল। তুমি সেদিন খারাপ গাইলেও রেশমী আন্টি একটু মিথ্যা করে হলেও প্রশংসা করতে পারতো! তা না করে উনি…”
মিতুল আর কিছু বলতেই পারলো না।
“শুধু এটুকুই নয় মিতুল। আমার চৌদ্দ তম জন্মদিনে আমি ড্যাডের কাছে গিটার চেয়েছিলাম জন্মদিনের গিফট স্বরূপ। ড্যাড কিছুদিন পরই গিটার কিনে দিয়েছিল। এ নিয়ে মম রাগারাগি করে ড্যাডের সাথে। এবং এক মাস পরে আমি বাইরে থাকাকালীন সময়ে আমার রুম থেকে গিটারটি নিয়ে ভেঙ্গে ফেলে।”
জোহানের কথা শুনে মিতুল চলতে চলতেই দাঁড়িয়ে পরে।
“কী ভেঙ্গে ফেলেছিল?”
জোহানও দাঁড়িয়েছে মিতুলের সাথে। বললো,
“হ্যাঁ, ভেঙ্গে ফেলে। বাড়ি এসে আমি আমার ঘরে গিটার দেখতে পাইনি। পরে ক্যামিলার কাছ থেকে জেনেছিলাম, মম আমার গিটার ভাঙচুর করে গার্ডেনে ফেলে রেখেছে। আসলে সে বছর এক্সামে একটা সাবজেক্টে একটু খারাপ করেছিলাম আমি। এক্সামের এক মাস আগে ড্যাড আমাকে গিটারটি দিয়েছিল। মম তখনই বলেছিল গান বাজনা নিয়ে থাকলে আমার পড়া লেখার দুর্গতি হবে। এক মাস পর যখন এক সাবজেক্টে রেজাল্ট খারাপ করলাম, তখন মম সেটাকেই গিটার ভাঙ্গার কারণ হিসেবে দাঁড় করালো। আর বললো, গান বাজনা নিয়ে পড়ে থাকলে এরকমই হবে প্রতি বার। ভালো রেজাল্ট করতে পারব না আমি।”
জোহানের জন্য খুব কষ্ট লাগলো মিতুলের। মনে হলো কষ্টে হৃদয় চৌচির হয়ে যাচ্ছে ওর। রেশমী আন্টির প্রতি বিশাল আকারে একটা ঘৃণার পাহাড় তৈরি হলো ওর মনে। বললো,
“একটা মানুষ লেখাপড়ার পাশাপাশি শখের বশে কিছু একটা করতেই পারে। কত মানুষই তো লেখা পড়ার পাশাপাশি কত কী করে। কত মানুষ তো টিউশনির পেছনেও সময় ব্যয় করে। তাতে কী হয়। রেশমী আন্টির এমন করাটা মোটেই উচিত হয়নি।”
“তোমারও কিন্তু এমন করা উচিত হচ্ছে না তুলতুল।”
“কেন? কী করেছি আমি?”
“এখানে যদি এভাবে দাঁড়িয়ে থাকো, তাহলে আমার কনসার্টের কী হবে? এখানেই তো সময় পার করে দেবে তুমি।”
“ওহ হ্যাঁ, চলো।”
গ্যারেজে চলে এসেছে ওরা। ক্যামিলা আগে থেকেই উপস্থিত গ্যারেজে। মিতুল এবং ক্যামিলা যাবে জোহানের সাথে। ক্যামিলা পিছনের আসনে উঠে বসলো। মিতুলও পিছনের আসনে ক্যামিলার পাশে
বসার জন্য ওঠা দিলেই, জোহান ওর হাত টেনে ধরলো।
“কী ব্যাপার? তুমি কোথায় যাচ্ছ? তুমি তো আমার সাথে বসবে। আমার পাশেই থাকতে হবে তোমার সবসময়। আগে বা পিছনে থাকার সুযোগ দেবো না তোমাকে।”
(চলবে)
#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৪০
____________
জোহান এবং ওর মমের মাঝের মনোমালিন্যটা মিটে গেছে। সবকিছু আবার আগের মতো। সবার একসঙ্গে ডিনারের আয়োজন করা হয়েছিল। এরপর থেকেই সব মিটমাট। মিতুলের কাছে পরিবেশটা এখন একটু হালকা লাগছে। যতদিন জোহান এবং ওর মমের মাঝে গুমোট গুমোট একটা ব্যাপার ছিল, ততদিন ঠিক পরিবেশটা অন্যরকম লাগছিল। আজ সব স্বাভাবিক।
মিতুল জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ক্লান্ত সূর্যটা ঘুমোতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘের সাথে রুপালি, বেগুনি আর কমলা রঙের ঘনঘটা মিলেমিশে একাকার। সন্ধ্যার আকাশ এতটা ভালো করে এর আগে কখনো দেখা হয়নি মিতুলের। ইচ্ছে হচ্ছে আজকের এই আকাশের দৃশ্যটা রং তুলি দিয়ে আঁকে ক্যানভাসে। কিন্তু ইচ্ছা করলে কী উপায়!
ও তো আঁকতে পারদর্শী নয়। কোনো কালেই ছিল না। তাছাড়া ড্রইং করার জন্য ওর কাছে তো এখন কোনো সামগ্রী নেই। আঁকবে কীসে? মিতুলের মন একটা দু’টো কষ্টের আঁচড় টানলো।
আচ্ছা, জোহান আঁকতে পারে না? ও যদি এই সন্ধ্যার আকাশ এঁকে দিতে বলে, জোহান পারবে আঁকতে? ব্যাপারটা জানতে হবে তো।
মিতুল জোহানকে খোঁজাখুঁজি করে শেষে কিচেনে পেল।
ফ্রিজ থেকে সফট ড্রিঙ্কসের বোতল বের করে কয়েক ঢোক খেয়ে বোতলটা আবার ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখলো জোহান। মিতুল চুপিচুপি কিচেনে দাঁড়িয়ে আছে সেটা খেয়াল করেনি। হঠাৎই তাই পিছনে ফিরে ভয় পেয়ে গেল।
“উহ! তুমি তো আমাকে মেরে ফেলবে দেখছি!”
“আমি কোনো খুনি নই যে তোমাকে মেরে ফেলবো।”
“এখানে কী চাই তোমার?”
“আমাকে এঁকে দিতে পারবে?”
“মানে?”
“আঁকতে পারো তুমি?”
“কেন জিজ্ঞেস করছো? তোমার ছবি এঁকে দিতে হবে? যদি তোমার ছবি এঁকে দেওয়ারই ব্যাপার হয়, তবে আগেই বলে রাখি। তোমার ওই রাগে ফুলো নাক নিখুঁত ভাবে আঁকা সম্ভব নয়। আঁকতে পারব না আমি।”
“বেশি কথা বলো কেন? তোমাকে কে বললো যে আমার ছবি এঁকে দিতে হবে? আমি আকাশের কথা বলছি। সন্ধ্যার আকাশের কথা। এঁকে দিতে পারবে?”
“আকাশ কেন আঁকতে হবে? আকাশ তো আকাশের জায়গাতেই থাকবে। নিয়ম করে প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবে। কেউ তো নিষেধ করবে না তোমায়। ইচ্ছে হলে সারাদিনও তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে পারো।”
মিতুলের একটু রাগ হলো। জোহানের সাথে আর কথা বলার রুচি হলো না ওর। রাগ করে কিচেন থেকে চলে যাওয়া দিলেই জোহান কিচেনের দরজা বন্ধ করে ফেললো।
“কোথায় যাচ্ছ? শুধু এইটুকু বলবে বলেই কি এখানে এসেছো? না কি অন্য কোনো কারণ আছে এর পিছনে? যেমন, আমাকে দেখতে ইচ্ছা করছিল। যদি তাই হয় তবে আমাকে ভালো করে না দেখে চলে যাচ্ছ কেন? কী ভেবেছিলে? আকাশ আঁকানোর নাম করে আমাকে দেখতে আসবে, আর সেটা আমি বুঝতে পারব না? নো মিতুল। বোকা তুমি। আমি নই। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি তুমি আসলে আমাকে দেখতেই এখানে এসেছো।”
মিতুল ভেবে দেখলো, ও কি আকাশ আঁকানোর নাম করে জোহানকে দেখতে এসেছে?
না, এমনটা ভেবে তো এখানে আসেনি ও। জোহান আঁকতে পারে কি না সেটা জানার জন্যই এসেছিল। তাহলে ওর কেন এমন ফিল হচ্ছে? ভিতরে ভিতরে কেমন একটা চোর চোর ফিল হচ্ছে ওর। মিতুল খুব করে চাইছে জোহানের কথার প্রতিবাদ করতে, কিন্তু পারছে না। ওর এই ফিলিংসটা ওকে প্রতিবাদী করে তুলতে বাধা দিচ্ছে। আচ্ছা এমন কেন হচ্ছে? কোনো রকম ভাবে ব্যাপারটা এমন নয়তো যে, ও আসলেই জোহানকে দেখতে এসেছে?
জোহান মিতুলকে নিশ্চুপ দেখে বললো,
“তুমি আসলে আমাকেই দেখতে এসেছো। তোমার নীরবতা এটাই বোঝাচ্ছে।”
মিতুল এবার প্রতিবাদ করে উঠলো,
“কে বললো যে আমি তোমাকে দেখতে এসেছি? তোমাকে দেখে কী লাভ আমার? আমি মোটেই তোমাকে দেখতে আসিনি। তুমি আঁকতে পারো কি না সেটাই জানতে এসেছি শুধু। এর বেশি আর কিছু না।”
“সত্যিই তুমি শুধু এটাই জানতে এসেছো?”
“হ্যাঁ।” কণ্ঠে বিশেষ জোর দিলো মিতুল।
জোহান মুখ কালো করে ফেললো। কিচেনের দরজা খুলে দিয়ে বললো,
“যাও।”
মিতুল তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেল।
জোহান পিছন থেকে আবার ডাকলো,
“দাঁড়াও।”
মিতুল দাঁড়ালো ঠিক। কিন্তু পিছন ফিরলো না।
জোহান বললো,
“মুখে যাই বলো না কেন, তুমি আসলে আমাকেই দেখতে এসেছো। আমি খুব গভীর ভাবে টের পাচ্ছি সেটা।”
“তোমার ধারণা ভুল।”
বলেই দ্রুত পায়ে রুমের দিকে ছুটলো মিতুল।
___________
অপরাধ বোধ ঘিরে রেখেছে মিতুলকে। জোহান চেয়ারসহ নিচে পড়ে যাবে এটা ভাবেনি ও। ঘটনাটা ঘটেছিল ব্রেকফাস্টের সময়। ক্যামিলাকে কাজে সাহায্য করছিল ও। কিচেন থেকে খাবার এনে রাখছিল টেবিলে। খাবারগুলো জোহানের পাশে দাঁড়িয়েই সাজিয়ে রাখছিল। কিচেন থেকে জুস আনা বাকি ছিল। ও জুস আনার জন্য কেবল ঘুরেছে, এর মাঝেই কেমন করে যেন ওর পা তাল হারিয়ে ফেললো। ও হেলে পড়লো জোহানের দিকে। কিন্তু ও পড়লো না। টেবিল ধরে নিজের পতন ঠেকিয়েছে। কিন্তু ওর ধাক্কায় জোহান নিচে পড়ে যায় চেয়ার নিয়ে। দৃশ্যটা মনে হতে এখনও অপরাধ বোধ ওর ভিতরটা ছেয়ে ফেলে। এতটুকু জায়গা ছাড়ে না। জোহানের ডান হাতের তালুর এক পাশে কীভাবে যেন ছিলে গেছে সেই এক্সিডেন্টে। কোমরেও ব্যথা পেয়েছে। ব্রেকফাস্ট না করে জোহান রাগারাগি করে সোজা নিজের টাইম হাউজে চলে গেছে। এই ব্যাপারটা জোহান বাড়াবাড়ি করেছে। এরকম এক্সিডেন্ট তো হতেই পারে, তাতে এমন মেজাজ দেখানোর কী আছে? আজ ওর জায়গায় যদি জোহান নিজে থাকতো, তাহলে?
জোহান সেই যে সকালে টাইম হাউজে গিয়েছে আর আসেনি। বিকেল চলছে এখন। জোহান টাইম হাউজে বসে কী খেয়েছে কে জানে! রাগ দেখিয়ে চলে গিয়েছে, না খেয়ে থাকলেই ভালো। মিতুল কথাটা ভেবে শেষ করতে না করতেই জোহানের কল পেল।
রিসিভ করতেই জোহান বললো,
“তাড়াতাড়ি আমার জন্য খাবার নিয়ে এসো। তোমার জন্য আমার ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ মিস গেছে।”
“আমার জন্য মানে? তুমি নিজেই তো না খেয়ে চলে গেলে। আমি কি নিষেধ করেছি খেতে?”
“এত কথা বাড়াও কেন? যা বললাম তাই করো। খাবার নিয়ে টাইম হাউজে আসো।”
বলেই ফোন কেটে দিলো জোহান।
মিতুল পড়লো মহা মুসিবতে। কী খাবার নিয়ে যাবে জোহানের জন্য? মিতুল ক্যামিলার কাছে এসে বললো জোহানের কথা। দুপুরে খাওয়ার পরে ভাত এবং গোরুর গোশত ছিল। ক্যামিলা প্লেটে খাবার বেড়ে, ট্রে ধরিয়ে দিলো মিতুলের হাতে। মিতুল খাবার নিয়ে চললো জোহানের জন্য।
টাইম হাউজে এসে কড়া নাড়লো দরজায়।
ভিতর থেকে জোহান বললো,
“দরজা খোলা। ধাক্কা দাও।”
মিতুল ধাক্কা দিলে দরজা খুলে গেল। ভিতরে প্রবেশ করতেই জোহানকে দেখতে পেল কাউচের উপর শোয়া। জোহান শোয়া থেকে উঠে বসলো। মিতুল ওই পাশে থাকা টি টেবিলটা টেনে, কাউচের সামনে নিয়ে এসে, তার উপর ট্রে রাখলো।
“কী এনেছো?”
মিতুল ঢাকনা সরাতে সরাতে বললো,
“ভাত এবং গোরুর গোশ।”
জোহান বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে ফেললো,
“ভাত, গোরুর গোশ ছাড়া আর কিছু ছিল না?”
মিতুল সহজ ভাবে উত্তর দিলো,
“না। আর কী থাকবে? তোমার জন্য কি কেউ এই বিকেলে রান্না করে রেখেছে না কি? তেমন হলে রাতে বলতে। তোমার জন্য বিভিন্ন আইটেম রান্না করে রেখে দিতো ক্যামিলা। যা এনেছি এখন তাই খাও চুপচাপ।”
“খেতে পারব না।”
“খেতে পারবে না মানে? যখন নাই খাবে, তখন আমাকে দিয়ে খাবার আনালে কেন?”
“আমি খাবো না সেটা বলিনি। আমি খাবো। তবে নিজ হাতে না, তুমি খাইয়ে দাও।”
“আমি?” মিতুলের কণ্ঠে বিস্ময়ের ধারা ঝরে পড়লো।
“হ্যাঁ। দেখছো না তোমার জন্য আমার হাত আহত হয়েছে!”
মিতুল অন্য সময় হলে কখনও খাইয়ে দিতো না জোহানকে। কিন্তু এখন জোহানের প্রতি মায়া হচ্ছে ওর। আর তাছাড়া একটা অপরাধ বোধও তো আছে। যদিও ও ইচ্ছাকৃতভাবে করেনি কাজটা। কিন্তু ওর জন্যই তো এক্সিডেন্টটা ঘটলো আজকে।
মিতুল কিচেনে গিয়ে একটা চামচ নিয়ে এলো।
জোহান বললো,
“চামচ দিয়ে কী করবে?”
“চামচ দিয়ে খাইয়ে দেবো তোমাকে।”
“উহু, চামচ দিয়ে খাব না আমি। চামচ দিয়ে নয়, নিজ হাতে খাইয়ে দাও।”
“নিজ হাতে?”
জোহান মাথা নাড়লো।
“পারবো না আমি। কিছুতেই তোমাকে হাত দিয়ে খাইয়ে দেবো না।”
“তাই? তুমি কি চাও আমি আজকে সারাদিন না খেয়ে থাকি?”
মিতুল কোনো কথা বললো না। কেমন একটা লাগছে ওর। নিজ হাতে লোকমা তুকে খাইয়ে দেবে জোহানকে! ইশ, কেমন হবে ব্যাপারটা?
“কী হলো? দাঁড়িয়ে আছো কেন? খাইয়ে দাও।”
মিতুল কিচেন থেকে হাত ধুয়ে এলো আরও একবার। জড়তা নিয়ে বসলো জোহানকে খাইয়ে দেওয়ার জন্য। ট্রে থেকে প্লেট তুলে ভাত মাখিয়ে এক লোকমা তুলে দিলো জোহানের মুখে। টের পেল হাতটা কেমন কাঁপছে।
ধ্যাত্তেরি! মানুষকে খাইয়ে দেওয়ার মতো ঝামেলা আর দুটো নেই পৃথিবীতে। এর আগে একবার ওর ছোট ভাইয়ের হাড় কাঁপিয়ে জ্বর এসেছিল। নিজ হাতে খেতে পারতো না ওর ভাই। সেসময় ও খাইয়ে দিয়েছিল ভাইকে। এছাড়া ওর এক বছর বয়সের এক লিটল কাজিনকে খাইয়ে দিয়েছিল। ভাই এবং সেই লিটল কাজিনকে খাইয়ে দেওয়ার সময়ই বুঝে গিয়েছিল যে, মানুষকে খাইয়ে দেওয়ার মতো ঝামেলা আর দুটো নেই পৃথিবীতে। কিন্তু ভাই এবং সেই লিটল কাজিনকে খাইয়ে দিতে কী এমনই বা ঝামেলা হয়েছিল। তার থেকে অনেক বেশি ঝামেলা হচ্ছে এখন এই জোহানকে খাইয়ে দিতে! জীবনে কি কখনো ভেবেছিল, ও জোহানকে নিজ হাতে তুলে খাওয়াবে?
জোহানকে ছোট ছোট করে চার লোকমা খাইয়ে দেওয়ার পর মিতুলের হাত থেমে গেল। ওর হাত আর চলছে না।
জোহান বললো,
“কী হলো? থেমে গেলে কেন? খাইয়ে দাও। এমনিতেই সকাল থেকে না খাওয়া আমি। আর এখন একটু খেতে বসলাম, তাও তুমি একটুখানি খাইয়ে দিয়ে থেমে গেলে? কেন? এটা কোন ধরণের টর্চার?”
মিতুল আর কথাটা চেপে রাখতে পারলো না। বললো,
“তোমাকে খাইয়ে দিতে সমস্যা হচ্ছে আমার। আমি খাইয়ে দিতে পারব না।”
“কেন?”
“একটা মানুষকে অন্য একটা মানুষ খাইয়ে দেয় কীভাবে? আমি পারব না।”
“এটা কী কথা বললে তুলতুল! একটা মানুষকে একটা মানুষ খাইয়ে দেয় কীভাবে মানে? ছোট বেলায় তো সবাইকেই খাইয়ে দেওয়া হয়। আর শুধু ছোটবেলা কেন? কত মায়েরাই তো তাদের সন্তান বড়ো হওয়ার পরেও নিজ হাতে খাইয়ে দেয়।”
“মায়েদের ব্যাপার ভিন্ন। আমি কি তোমার মা?”
“উফ তুলতুল! শুধু যে মায়েরাই তাদের সন্তানদের খাইয়ে দেয় তা তো নয়। এছাড়াও অনেকে অনেককে খাইয়ে দেয়। যেমন…”
বলতে গিয়েও একটু থামলো জোহান।
মিতুল উদ্বিগ্নতা নিয়ে তাকিয়ে আছে জোহানের দিকে। কী উদাহরণ দেবে জোহান?
জোহান নিজের উদাহরণ শোনালো,
“যেমন অনেক ভাই-বোনও একে অপরকে খাইয়ে দেয়।”
জোহানের কথা শুনে মিতুল থ হয়ে গেল।
“বোন! আমাকে তোমার বোন মনে হয়? আমি তোমার বোন? এটাই ভাবো তুমি?”
“এটা তো জাস্ট উদাহরণ দিলাম। কেন এই উদাহরণে খুশি হওনি তুমি? কী রকম উদাহরণ আশা করেছিলে?”
মিতুল কিছুটা থতমত খেয়ে গেল। বললো,
“কোনো উদাহরণই শুনতে চাইনি আমি।”
বলেই দ্রুত আরেক লোকমা তুলে জোহানের মুখে পুরে দিলো।
জোহান মনে মনে হাসলো। তারপর মুখের খাবার টুকু গিলে বললো,
“অনেক লাভার্সরাও কিন্তু একে অপরকে খাইয়ে দেয়।”
জোহানের কথায় মিতুলের দম বন্ধ হয়ে এলো। ভিতরটা ছটফট করছে আবার।
মিতুল জোহানকে খুব কষ্টে খাওয়ানো সম্পন্ন করলো। তারপর প্লেট নিয়ে চলে এলো কিচেনে। প্লেট ধৌত করলো। বিকেল প্রায় শেষের পথে। একটু পরই বোধহয় সন্ধ্যা নেমে যাবে। মিতুল লিভিং রুমে ফিরে দেয়াল ঘেঁষে রাখা টি টেবিলের উপর প্লেটটা রাখলো।
টি টেবিলটা কাউচের সামনে থেকে এনে যথা স্থানে রেখে দিয়েছে আবার।
জোহান মোবাইলে কী একটা যেন দেখতে দেখতে বললো,
“মিতুল এদিকে এসো।”
মিতুল কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে এলো। কাউচে বসে উঁকি দিলো মোবাইলে। দেখলো জোহান অনলাইনে একটা গেস্ট হাউজের পিক দেখছে।
“আমরা ফ্রেন্ডসরা সবাই ঠিক করেছি ঘুরতে যাব পরের সপ্তাহে। ঘুরতে গিয়ে এই গেস্ট হাউজে উঠবো আমরা।”
“কোথায় এটা?”
“এটা গ্রামের ওদিকে। তুমি চিনবে না।”
“ও।”
মিতুল উইন্ডো দিয়ে বাইরে তাকালো। পরিবেশ ধীরে ধীরে অন্ধকার হতে শুরু করেছে।
মিতুল বললো,
“আচ্ছা, এখন আমি যাচ্ছি। রাত হয়ে যাবে কিছুক্ষণ পর।”
জোহান বললো,
“চলে যাবে?”
মিতুল মাথা নেড়ে বললো,
“হুম।”
বলে উঠে দাঁড়ালো। যাবে বলে এক পা বাড়াবে কি বাড়াবে না এর মধ্যেই জোহান ওর হাত ধরে টান দিলো। মিতুল আবারও বসে পড়লো কাউচের উপর। কিছু বুঝে ওঠার আগেই জোহান শুয়ে পড়লো ওর কোলে মাথা রেখে।
হঠাৎ করে এমন হওয়ায় গা শিউরে উঠলো মিতুলের। জোহান চোখ বন্ধ করে নিবিড় স্বরে বললো,
“আরও কিছুক্ষণ থাকো আমার সাথে। আমার এই টাইম হাউজে আমি খুব একা। আর কিছুটা সময় থাকো তুমি।”
মিতুল বিভোর চোখে তাকিয়ে আছে। হৃদস্পন্দন শিথিল। শুধু টের পাচ্ছে ওর মনের ভিতরে দমকা হাওয়ার সাথে সাথে, এক গাঢ় কোমল অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ছে আনাচে কানাচে। সেই অনুভূতি এতটুকু পরিমাণ জায়গা ছাড়েনি। সবটাই দখল করেছে। এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা দুষ্কর। এই অনুভূতি এতটাই তীব্র যে, ওর সব কিছু অবশ হয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে।
(চলবে)