#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৪১
____________
সূর্য ডুবে যাওয়ার পথে। প্রকৃতি তার কালো রঙের বিস্তর ছড়াচ্ছে ক্রমে ক্রমে। গাছের পাতা ঝিরিঝিরি বাতাসে হালকা দুলে উঠে একটা দুটো ঝরে পড়ছে। মিতুল অনেকক্ষণ হলো সটান হয়ে বসে আছে। একটু পরিমাণও নড়েনি। কোনো কথাও ফোঁটেনি ওর মুখে। শুধু যে ও নিশ্চুপ ছিল তা নয়, জোহানও আর একটা কথা বলেনি। পরিবেশ তাই বড়ো নিস্তব্ধ। এই নিস্তব্ধ পরিবেশে মিতুল শুধু ওর হৃদয়ের চলন উপলব্ধি করতে পারছে। ধিকিধিকি একটা বাড়ন অন্তরে।
প্রকৃতিতে ঝাপসা অন্ধকারের বিরাজ খেয়াল হতে মিতুল নিজের জাগতিক হুঁশে ফিরে আসে। বাড়ি ফিরতে হবে ওর। মিতুল জোহানের দিকে তাকালো। বন্ধ আঁখির জোহানকে খুব শান্ত, নিষ্পাপ মনে হলো ওর কাছে। মিতুলের ইচ্ছা হলো না জোহানকে ডেকে বিরক্ত করে। জোহানের বন্ধ আঁখি জোড়া খুলে যাক ও চায় না। কিন্তু ওর তো যেতে হবে। মিতুল চাইলেই সহজ ভাবে বলতে পারলো না জোহানকে। ওর গলার কাছে কিছু যেন একটা আটকে আছে। যা ওর মুখ থেকে একটি বর্ণ বের হতেও শক্তির অভাব বিলাচ্ছে। ওর কণ্ঠ বড়োই নিশ্চেষ্ট। মিতুল মনে মনে অনেক চেষ্টা করে ইতস্তত ভাবকে কিছুটা সামাল দিলো। শেষমেশ কোনো রকম কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
“আ…আমি যাব এখন?”
জোহানের ঘুম ঘুম কণ্ঠ ভেসে এলো,
“না। আরও কিছুটা সময় থাকো।”
জোহানের কথার পর মিতুল আর কিছু বলতে পারলো না। জেদ দেখাতে পারলো না যাওয়ার। জোহানের কথাকে মেনে নিলো ওর মন। ও থাকলো। কতক্ষণ থাকলো তার হিসেব নেই। ওর কোলে মাথা রেখেই তন্দ্রাচ্ছন্নতার গহীনে হারিয়ে গেল জোহান। বাইরে অন্ধকার। সন্ধ্যা কেটে গিয়ে রাত নেমে গেছে। এবার মিতুলের উৎকণ্ঠা বাড়লো। বাড়ি ফিরতে হবে ওকে। কিন্তু ওর মন তীব্র প্রতিবাদ জানালো জোহানের ঘুম না ভাঙ্গানোর। মিতুল সাহস করতে পারলো না জোহানের ঘুম ভেঙ্গে দেওয়ার। মিতুল জোহানের মাথা দুই হাত দিয়ে যতটা সম্ভব আলতো করে ধরার চেষ্টা করলো। হাত দিয়ে জোহানের মাথা ধরে রেখে উঠে গেল ও। পাশ থেকে একটা কুশন এনে দিয়ে দিলো জোহানের মাথার নিচে। জোহান এখনও তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায়ই আছে। যাক জোহানের ঘুমটা ভাঙ্গেনি। এতক্ষণে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো ও। বাড়ি ফিরতে হবে ওর। এখনই।
মিতুল টি টেবিল থেকে ট্রে উঠিয়ে নিলো হাতে। দরজার কাছে গিয়ে ওর টনক নড়লো।
এই অন্ধকারে কী করে যাবে? মোবাইল তো সাথে করে আনেনি। মিতুলের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো। বাইরে শুধুই ধূ ধূ অন্ধকার। দেখেই বুকের ভিতর ভয় দপদপ করে জেগে ওঠে। আলো ছাড়া কি এই জঙ্গল পেরোনো সম্ভব? জোৎস্না থাকলে না হয় অনায়াসেই আলো ছাড়া জঙ্গল পেরোনো যেত। কিন্তু এখন?
মিতুল জোহানের দিকে তাকালো। জোহানকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা ঘোরতর অন্যায় মনে হচ্ছে ওর কাছে। না ও জোহানকে জাগাবে না। মিতুল বেডরুমের ওয়ার্ডোবে আলোক জাতীয় কিছু পাওয়ার আশায় খোঁজ চালালো। লাভ হলো না। কিচ্ছু নেই। জোহানের প্রতি ভারী রাগ হলো। একটা ছোট টর্চ রাখলে কী এমন ক্ষতি হতো? এখন বাড়ি যাবে কী করে?
হঠাৎ করে জোহানের ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো দ্রুত। পুরো লিভিং রুমে একবার চোখ বুলাতে গিয়ে মিতুলকে ফ্রিসিয়াস ফুলের উইন্ডোর কাছে দাঁড়ানো দেখলো। উইন্ডোর বাইরে তাকিয়ে দেখলো, অন্ধকার হয়ে গেছে পরিবেশ।
“তুমি এখনও যাওনি?”
জোহানের কণ্ঠ কানে আসতেই মিতুল চকিতে ঘুরে তাকালো।
“উঠে গেছো তুমি?”
“হুম উঠলাম।”
জোহান কাউচ থেকে উঠে মিতুলের কাছে এলো।
মিতুল বললো,
“বাড়ি যাব কীভাবে? দেখো তাকিয়ে, বাইরে কী অন্ধকার! আমার কাছে মোবাইলও নেই।”
জোহান আর কথা বাড়ালো না। বললো,
“বাড়ি চলো।”
“তুমিও যাবে?”
“হুম। চলো।”
মিতুলও আর কথা বাড়ালো না। জোহানের পিছন পিছন টাইম হাউজ থেকে বের হলো। জোহান দরজা লক করে আগে আগে চললো। মিতুল চললো পিছন পিছন। কয়েক পা হেঁটে আসলো ওরা। এর মধ্যে কেউ কোনো কথা বলেনি। প্রথম কথা বললো জোহান,
“হেই তুলতুল, ভয় করছে তোমার?”
মিতুল পিছনে হাঁটতে হাঁটতে উত্তর দিলো,
“না।”
“ভয় করলে আমার হাত ধরে হাঁটতে পারো। অনুমতি দিলাম তোমায়।”
“দরকার নেই। আমার ভয় করছে না। আমাকে কি তোমার ভীতু মনে হয়?”
“ও আচ্ছা, ভীতু নও তুমি। সাহসী মেয়ে, তাই না? তাহলে একদিন পিছন ঘুরে আমাকে দেখেই ভয়ে চিৎকার করে রাস্তায় পড়ে গিয়েছিলে কেন?”
“কবে?”
“মনে পড়ছে না?”
“না পড়ছে না। এমন কিছু ঘটেছে? মনে পড়বে কী?” মিতুল সরাসরি অস্বীকার করলো জোহানের কথাটি।
“ঠিক আছে, এখন মনে না পড়লে সমস্যা নেই। পড়ে যাবে ধীরে ধীরে।”
জোহান কথা শেষ করে দাঁড়িয়ে গেল।
জোহানকে দাঁড়াতে দেখে মিতুলও দাঁড়ালো।
জোহান বললো,
“হাত না ধরো, আমার সামনে এসে হাঁটো।”
“কেন?”
“জানতে হবে না তোমার। যা বলছি তাই করো।”
মিতুল আর কিছু না বলে জোহানের পাশ কাটিয়ে সামনে এলো। আবার চুপচাপ হাঁটতে লাগলো দুজনে।
বাড়ি ফিরে ওদের প্রথম দেখা হয়ে গেল রেশমীর সাথে। রেশমী হলরুমে বসে হিসাব নিকাশ করছিলেন শপ সম্পর্কিত। ওদের এক সাথে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি।
মিতুলের মাঝে ভয় ভয় একটা ব্যাপার জেগে উঠছে। রেশমী আন্টি আজ হলরুম ছাড়া আর কোনো জায়গা পেল না বসার?
“তোমরা দুজন একসাথে কোত্থেকে আসলে?”
মিতুল জানতো রেশমী আন্টি এই প্রশ্ন করবে। আর এই প্রশ্নেই যত ভয় ওর। জোহানের সাথে ছিল কথাটা বলতে গেলেই ভয়, সংকোচ সব পেয়ে বসে ওকে। কী করে বলবে এখন, ও জোহানের সাথে ছিল এতক্ষণ! জোহানের টাইম হাউজ থেকে এসেছে! মিতুল আমতা আমতা করে বললো,
“আসলে আন্টি, আমরা…”
“গার্ডেনে ছিলাম।” মিতুলের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বললো জোহান।
মিতুল অবাক হয়ে তাকালো জোহানের দিকে। গার্ডেন?
রেশমী বললেন,
“গার্ডেনে ছিলে?”
“ইয়েস মম। আমি গার্ডেনে দাঁড়িয়ে মনে মনে গান ভাবছিলাম। সেই সময় ও গার্ডেনে গিয়েছিল লেবু আনতে।”
গার্ডেন! লেবু! এসব কী বলছে জোহান? এমন একটা মিথ্যা কথা বললো কেন? আর কিছু পেল না বলার? রেশমী আন্টি যদি একটু আগেও গার্ডেনে গিয়ে থাকে, তখন? তখন কী করবে? কী জবাব দেবে রেশমী আন্টিকে? ইশ, মিথ্যা বলতেও জানে না ছেলেটা।
“লেবু এনেছো মিতুল?”
রেশমী আন্টির কথায় সম্বিৎ ফিরলো মিতুলের।
“হ্যাঁ? লেবু? না লেবু তো আনিনি আন্টি। লেবুগুলো দেখে মনে হলো এখনও খুব ছোট, তাই না নিয়েই চলে এসেছি।”
“ও, ঠিক আছে। রুমে যাও তোমরা।”
মিতুলের বুক চিরে স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো ফোঁস করে। যাক, বিশ্বাস করেছে রেশমী আন্টি।
মিতুল আগে আগে পা বাড়ালো।
রুমের দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই শুনতে পেল জোহানের কণ্ঠ।
“তোমার জন্য মিথ্যা বললাম মমকে।”
মিতুল জোহানের দিকে তাকালো। জোহান নিজের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে। মিতুল বললো,
“মানে?”
জোহান আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে মিতুলের কাছে এগিয়ে এলো। গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললো,
“মানে হলো, তুমি তো মমকে আমার কথা বলো না। আমার সাথে থাকলে সেটাকে অন্যরকম ভাবে উপস্থাপন করো মমের কাছে। যার প্রমাণ, ওই যে আতশবাজি দেখিয়ে ছিলাম তোমাকে, সেদিনই পেয়েছি। আমি চাইলেই বলে দিতে পারতাম মমকে, যে তুমি আমার সাথে টাইম হাউজে ছিলে। কিন্তু বললাম না শুধু তোমার জন্য। যেহেতু তুমি মমকে বলো না তুমি আমার সাথে ছিলে। তাই আমিও আজকে বললাম না।”
জোহান কণ্ঠটাকে কিছুটা অন্যরকম করে বললো,
“আর তাছাড়া, তুমি নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছিলে আমাকে, তোমার কোলে মাথা রেখে শুয়েছিলাম আমি, এসব কথা কি আর মমকে বলা যায়?”
একটু হাসলো জোহান। তারপর নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো।
মিতুলও নিজের অজান্তে হেসে রুমে ঢুকে গেল।
______________
মিতুলের ঘুম ভাঙলো মোবাইলে কল আসার শব্দে। মিতুল বিছানা হাতড়ে মোবাইলটা পেল। পিটপিট চোখে স্কিনে কার্লের নাম দেখে ঘুম উবে গেল ওর। গায়ের কম্বল এক টানে সরিয়ে উঠে বসলো ও। কার্ল! কার্ল কেন ফোন করেছে? মিতুল কী করবে বুঝতে পারছে না। কার্লের ফোন ধরা অসম্ভব ওর কাছে। কিছুতেই কার্লের কল রিসিভ করবে না ও। কার্লের গলা শুনলেই ওর বুকে ব্যথা হবে। না, পারবে না ও। প্রথম কলটা রিং বাজতে বাজতেই কেটে গেল। পরে আবার ফোন করলো কার্ল। উহ, কী করবে? মিতুলের অস্থির লাগছে। কল রিসিভ না করলে কার্ল কী ভাববে? মিতুল নিজেকে শান্ত করে কাঁপা কাঁপা হাতে কল রিসিভ করে কানে ধরলো।
“হ্য… হ্যালো!”
“হাই রাবা। হাউ আর ইউ?”
কার্লের কণ্ঠ মিতুলের ভিতরটা দগ্ধ করে দিলো। মনে হচ্ছে পুড়ে যাচ্ছে ওর হৃদয়। হ্যাঁ, এই তো। ও হৃদয় পোড়ার গন্ধ শুকতে পারছে। মিতুল কষ্ট চেপে রেখে স্বাভাবিক ভাবে বলার চেষ্টা করলো,
“ভালো আছি। তুমি?”
“আমিও ভালো। অনেক দিন হয়ে গেল তোমার কোনো খোঁজ নেই। ভাবলাম কিছু হয়েছে কি না। তাই ফোন করলাম।”
“না, কিছু হয়নি আমার। ঠিক আছি। আসলে তোমার রেস্টুরেন্টের ওদিকে যাওয়া হয় না। এসব ছাড়ো। বলো, অলিভার কেমন আছে?”
“হ্যাঁ, ভালো আছে। তুমি আজকে আসো না রেস্টুরেন্টে। গল্প হতো তোমার সাথে।”
“আমি স্যরি কার্ল। যেতে পারব না। জোহানের সাথে ক্যালগারি ঘুরতে যাব আমি। এখনই রেডি হতে হবে আমাকে। আমি রাখছি। পরে কথা হবে আবার।”
মিতুল কার্লকে মিথ্যা বলে ফোন কেটে দিলো। বুকের সাথে চেপে ধরলো মোবাইলটা। কতদিন পর কার্লের সাথে কথা বললো। কতদিন! বুকের ভিতর কেমন একটা চাপা কষ্ট হচ্ছে। কার্ল! ওর প্রথম প্রেম!
_______________
জোহানের সামনে পড়তেও মিতুলের লজ্জা লজ্জা লাগে। কেন এই লজ্জা লজ্জা লাগা, সেটা বুঝছে না ও। কালকের পর থেকেই কী যেন হয়েছে ওর। জোহানকে অন্যরকম লাগে এখন। কেমন লাগে সেটা বলতে পারবে না। ও নিজেই বুঝে উঠতে পারছে না সেটা। সকাল থেকে খুব একটা জোহানের সামনে পড়েনি। পড়লেও অল্পতে এড়িয়ে এসেছে।
সকালে কার্লের কল পাওয়ার পর থেকে মন একটু খারাপ ছিল। কিন্তু জোহানকে দেখার পরপরই ওর মন খারাপি রইল না আর। ভালো হয়ে গেছে ওর মন। কার্লের কথা মনেই পড়ছে না বলতে গেলে। আজকের পরিবেশটাও খুব ভালো লাগছে। বিকেলের এই মৃদুমন্দ বাতাস, বসন্ত ফুলের সুবাস, সব কিছুই ভারী মিষ্টি লাগছে। এই তো এখনই একটা প্রজাপতি ঠিক ওর সামনে দিয়ে উড়ে চলে গেল। নীল, কালো পাখনার প্রজাপতিটা দেখতে কী সুন্দর ছিল! আনমনে হেসে ফেললো মিতুল।
বারান্দার আর্ম চেয়ারের একটা দখল করে বসে আছে ও। বারান্দায় থাকা ফুলের টব থেকে নাম না জানা একটা ফুল তুলে কানে গুঁজেছে। ফুলটা লাল রঙা। দেখতে দারুণ। সুবাস নেই কোনো। সুবাসের কী দরকার? দেখতে যেমন তাতে সুবাসের প্রয়োজন পড়ে না।
“এই নাও।”
মিতুলের ভাবন ঘরে হানা পড়লো জোহানের, ‘এই নাও’ দুটি শব্দের বাক্যতে।
জোহান ওর দিকে কফির মগ বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ও তাকাতেই জোহান বললো,
“আনমনে কাকে ভাবছিলে?”
“কাউকে না তো।”
বলে মিতুল জোহানের হাত থেকে কফির মগটা নিলো।
জোহান ওর পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বললো,
“ভেবো না যে আমি কফি বানিয়ে এনেছি তোমার জন্য। ক্যামিলা দুই মগ কফি হাতে দিয়ে বললো, এক মগ তুমি খাও, আর এক মগ মিতুলকে দাও। তাই নিয়ে এলাম। শুধুমাত্র ক্যামিলার কথায়।”
মিতুলের একটু অভিমান হলো। কেন? জোহান নিজ হাতে ওর জন্য কফি বানিয়ে আনলে কী ক্ষতি হতো?
মিতুল মনে মনে এটা ভাবলেও, বাইরে এর বিন্দুমাত্র কিছু ধরা দিলো না। বারান্দা জুড়ে নিস্তব্ধতা ছেয়ে গেল। না মিতুল কোনো কথা বললো, আর না জোহান। মিতুল কথা বলবে কী? ওর মাথাতেই কিছু আসছে না। চুপচাপ কিছুক্ষণ কফির মগে চুমুক চললো।
হঠাৎ শুনতে পেল জোহান বলছে,
“তোমার সমস্যা কী তুলতুল? তুমি কফি পান করছো? না কি পানি? কফি আর পানির তফাৎ গুলিয়ে ফেলেছো তুমি? একটা ঘোড়ার মতো কফি পান করছো কেন তুমি?”
মিতুলের সারা শরীর অপমানে জর্জরিত হলো। ঘোড়ার মতো! এটাই বললো জোহান? আগুন জ্বলে গেল ওর মাথায়। ইচ্ছে করছে এই কফি জোহানের মুখে ছুঁড়ে মেরে কফি খাওয়া শিখিয়ে দিতে। কিন্তু সেটা তো পারবে না ও। মিতুল চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে তারস্বরে বলে উঠলো,
“ঘোড়ার মতো কফি পান করি আমি? আমি ঘোড়া? আমাকে ঘোড়া বলতে গলা কাঁপলো না তোমার? যখন ইচ্ছা তখন তুমি অপমান করো আমাকে! কেন? আমাকে কি তোমার মোমের তৈরি একটা পুতুল মনে হয়? আমার মন নেই? কষ্ট পাই না আমি? ভেবেছিলাম অপমান জিনিসটা আমার পিছু ছেড়ে দিয়েছে। না, ছাড়লো না। এই ইহজনমে অপমান জিনিসটা পিছু ছাড়বে না আমার। তুমি ছাড়তে দেবে না। টেনে ধরে বসবে তুমি। কেন? এত অপমান কেন করো তুমি আমাকে? কী শান্তি পাও আমাকে অপমান করে? আমাকে অপমান করবে বলেই কি জন্মগ্রহণ করেছো তুমি? আমাকে অপমান না করলে কি তোমার রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়?”
মিতুল হাতের মগটা রাগ, অভিমানে ছুঁড়ে ফেললো ফ্লোরে। তারপর হনহন করে হেঁটে চললো।
জোহান পিছন থেকে বললো,
“হেই, তুমি কফির মগ ছুঁড়ে মেরেছো কেন? যদি এটা ভেঙে যেত তাহলে কী হতো? কে জবাবদিহিতা করতো এর জন্য? আমি যেগুলো ভাঙবো, সেগুলোর ব্যাপারে জবাবদিহি করবো আমি। কিন্তু তুমি ভাঙলে সেটা দেখার বিষয় আমার না।”
জোহানের কোনো কথাই মিতুলকে থামাতে পারলো না। বরং ওর চলার গতি আরও বেড়ে গেল। ওর থেকে একটা মগের জন্য জোহানের দরদ বেশি? মিতুলের কান্না পেয়ে যাচ্ছে। হনহনিয়ে চলে গেল ও।
জোহান ফ্লোর থেকে মগটা উঠালো।
ওর মগে কফির যে অংশটুকু বাকি ছিল তা এক চুমুকে শেষ করে দৌঁড়ে এলো। মিতুল প্রায় নিজের রুমের কাছাকাছি।
জোহান পিছন থেকে দৌঁড়ে এসে পথ আটকে ধরলো ওর। থেমে যেতে হলো মিতুলকে।
জোহান শান্ত সহজ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কী পছন্দ করো তুমি সবচেয়ে?”
“এই মুহূর্তে কানাডা থেকে চলে যাওয়াটাই সবচেয়ে বেশি পছন্দ আমার।” জেদের সাথে বললো মিতুল।
“নো তুলতুল, এভাবে তো যেতে দেবো না তোমাকে। তোমাকে কিছু দেওয়ার আছে আমার। নেবে না সেটা? আমি মনে করি সেটা নিয়েই ফেরা উচিত তোমার।”
“এত এত অপমান করেও আর কী দেওয়ার বাকি আছে তোমার? কী দেবে?”
“সন্ধ্যায় রেডি হয়ে থেকো, দেখতে পাবে।”
বলে হাসলো জোহান। তারপর যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। কতক দূর গিয়ে থামলো আবার।
ফিরে এলো মিতুলের কাছে। মিতুলের কানে গুঁজে রাখা ফুলটা নিয়ে নিলো।
“এই ফুল আমার ব্রাদারের প্রিয়। আমার নয়।”
বলে ফুলটা নিয়ে চলে গেল জোহান।
মিতুল কিছুই বুঝতে পারলো না। কী বলে গেল জোহান? ওই ফুল ওর ব্রাদারের প্রিয়, কিন্তু ওর প্রিয় না! সেটা ওকে শোনালো কেন?
(চলবে)
#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৪২
____________
মিতুল রুমে এসে বসতে না বসতেই জোহানের থেকে ম্যাসেজ পেল। জোহান লিখেছে,
‘সন্ধ্যা নয়, এখনই রেডি হতে শুরু করো। রেডি হয়ে রুমেই অপেক্ষা করবে আমি না আসা পর্যন্ত।’
মিতুলের মন ঘোর বিরোধিতা জানাচ্ছে। জোহানের কথা শোনার কোনো দরকার নেই। জোহানের কথা মতো কেন রেডি হয়ে থাকবে ও? জোহান যখন তখন যা অর্ডার করবে, তাই মানতে হবে ওর? এমন কোনো কোনো আইন আছে? না, নেই তো। হবে না রেডি। যাবে না জোহানের সাথে।
পর মুহূর্তে আবার সায় দিয়ে মন বললো, যাওয়া উচিত জোহানের সাথে। জোহান কী দেবে সেটা দেখা উচিত। এর আগে কত দিনই তো গেল জোহানের সাথে, আজ না হয় শেষ বারের মতো একবার যাক। জোহান কী দেওয়ার কথা বললো সেটা অবশ্যই দেখা উচিত ওর।
জোহানের সাথে যাবে, কি যাবে না ভাবতে ভাবতেই রেডি হতে লাগলো মিতুল।
সাদার উপর গোলাপি রঙের ফ্লাওয়ার পেইন্টিং করা একটা কুর্তি পরলো। সাদা মাটা মেকআপ করলো সাথে। উঁচু একজোড়া হিল পায়ে পরা কালীন দরজায় নক হলো। নক করার সাথে সাথে জোহানের কণ্ঠও শোনা গেল।
“রেডি হয়েছো?”
“হ্যাঁ।” ভিতরে বসে কাঠ গলায় উত্তর দিলো মিতুল।
“ও কে ভালো। আমি নিচে যাচ্ছি। তুমিও ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যে এসে পড়ো নিচে।”
“ন্যানো সেকেন্ড মানে?” আবারও কাঠ গলায় বললো মিতুল।
“কথা না বলে নিচে আসো তাড়াতাড়ি।”
“কোথায় নিয়ে যাবে তুমি আমায়?”
“কোথায় নিয়ে যাব সেটা তো গেলেই দেখতে পাবে। অযথা প্রশ্ন করো কেন?”
মিতুলের মেজাজ বিগড়ে গেল। সহজ ভাবে কথা বলতে পারে না বদমাইশটা। প্যাঁচিয়ে কথা বলার স্বভাব। মিতুল আর কথা বললো না কোনো। কথা বাড়তে থাকলে ঝগড়া বেঁধে যাবে সেটা শিওর।
ওপাশ থেকেও আর কোনো সাড়া শব্দ আসলো না।
গ্যারেজের সামনে এসে দেখলো সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জোহান। সাইকেল দেখে মিতুলের মেজাজ আরও খারাপ হলো। এখন এই সাইকেলে করে নিয়ে যাবে ওকে?
জোহান মুখে হাসি ফুঁটিয়ে বললো,
“সাইকেল দেখে খুব খুশি হয়েছো তাই না? আমরা এটায় করেই যাব আমাদের গন্তব্যে।”
মিতুল রাগের সাথে বললো,
“সাইকেল কেন? তোমার গাড়ির কী হয়েছে?”
“কিছুই হয়নি গাড়ির। ইচ্ছা করেই সাইকেলে যাব আমরা।”
মিতুল জেদ ধরে বললো,
“আমি সাইকেলে যাব না।”
“তা হলে হেঁটে যেতে হবে। চলো, হাত ধরাধরি করে দুজনে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যাই।”
মিতুলের মেজাজ গুরুতর খারাপ হলো।
মিতুলের রাগে ফুলো নাক দেখে একটু হেসে সাইকেলে উঠে বসলো জোহান।
মিতুল অনিচ্ছাসত্ত্বেও সাইকেলের পিছনে উঠে বসলো।
“ধরে বসো আমাকে। নয়তো পরে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে তোমার। খুবই দ্রুত চালাবো আমি।”
মিতুল গলা যথা সম্ভব কঠিন রাখার চেষ্টা করে বললো,
“ধরবো না আমি তোমাকে। আস্তে চালাবে তুমি।”
“স্যরি আস্তে সাইকেল চালানোর কোনো হিস্টোরি নেই আমার।”
জোহান মুখে এটা বললেও, আস্তে সাইকেল চালালো। মিতুল ধরেই বসলো জোহানকে।
অনেকক্ষণ সাইকেল চালিয়ে অনেক দূরে আসার পর রাস্তার পাশে সাইকেল থামালো জোহান। সূর্যটার এখন নিভু নিভু ভাব। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই পশ্চিম দিগন্ত থেকে বিদায় নেবে সে।
মিতুল জানে না জোহান ওকে কোথায় নিয়ে এসেছে। শুধু বুঝতে পারলো ওরা বাড়ি থেকে অনেক দূরে কোথাও চলে এসেছে। দেখতে পাচ্ছে কোলাহলহীন একটি রাস্তা এটা। রাস্তার দুপাশে কিছু গোলাপি চেরি পুষ্পের গাছ। সংখ্যায় কয়েকটি হলেও এদের সৌন্দর্য বহুগুণ। অনেক ঝরা পাপড়ি পড়ে রয়েছে রাস্তায়। রাস্তার এক পাশে ঘন সবুজ ঘাসে ঘেরা বড়ো ফিল্ড। চেরি ব্লসমের মাঝে এসে মিতুলের রাগ একটু কমলো। আশপাশটা দেখতে দেখতে সাইকেল থেকে নামলো ও। জোহানও নামলো।
চেরি গাছের নিচে দাঁড়ানো ওরা। মাথার উপর চেরি সজ্জিত ডাল। মিতুল বললো,
“এটা কোথায় এসেছি আমরা?”
জোহান মিতুলের প্রশ্নের উত্তর দিলো না। কিছুটা নীরব থেকে বললো,
“কার্লকে এখনও পছন্দ করো তুমি?”
কার্লের নামটি মিতুলের মনের অন্তঃস্থলে কিছুটা ব্যথার উপস্থিতি জুড়ে দিলো।
“কার্ল? কার্লের কথা বলবে বলে এখানে নিয়ে এসেছো আমায়?”
মিতুল প্রথমে জোহানের কথাটি পুরোপুরি খেয়াল করেনি। কিন্তু যখন খেয়াল হলো, তখন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল ও। চোখ ছেয়ে গেল বিস্ময়বিমূঢ়তায়।
“তু…তুমি কীভাবে জানো আমি কার্লকে পছন্দ করি?” মিতুলের কম্পিত গলা।
“তুমি যে কার্লকে পছন্দ করতে সেটা দেখলেই বোঝা যেত। তুমি যেভাবে তাকাতে ওর দিকে, যে কণ্ঠে কথা বলতে ওর সাথে, তাতে এটা সুস্পষ্ট ছিল।”
জোহানের কথায় মিতুল আরও আশ্চর্যান্বিত হলো। তার মানে জোহান অনেক আগে থেকেই জানতো? মিতুলের কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকছে সব কিছু । কিন্তু ও নিজের দুর্বলতা দেখালো না জোহানের কাছে। ব্যাপারটাকে সহজ ভাবে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করলো। কণ্ঠকে স্বাভাবিক করে বললো,
“শুধু এই কথাটা জিজ্ঞেস করার জন্যই এখানে নিয়ে এসেছো আমায়? এ কথা তো বাড়িতেই জিজ্ঞেস করতে পারতে। এখানে আনার তো কোনো দরকার ছিল না।”
“এটা জিজ্ঞেস করবো বলে তো এখানে নিয়ে আসিনি। তোমাকে অন্য কিছু বলার আছে আমার।”
“কী বলবে?”
জোহান একটু সময় নিয়ে বললো,
“আমি…” বলতে গিয়েও কণ্ঠ আবার থেমে গেল। মিতুলকে ভালো করে দেখলো কিছু সময়।
মিতুল তাকিয়ে আছে।
জোহান যা বলতে চাইলো তা বললো না। হঠাৎ করে বললো,
“আমি অসুস্থ মিতুল!”
জোহানের প্রতি মিতুলের যে একটু রাগ অবশিষ্ট ছিল, তা নিঃশেষ হয়ে এবার ব্যাকুলতার সৃষ্টি হলো। মিতুল ব্যাকুল কণ্ঠে বললো,
“অসুস্থ! কী হয়েছে তোমার? জ্বর এসেছে?”
“না, সেরকম অসুস্থতা নয়।”
“তাহলে?”
জোহান আচমকা মিতুলের ডান হাত এনে নিজের বুকের বাম পাশে চেপে ধরলো।
চমকে উঠলো মিতুল।
জোহান বললো,
“হৃদয় অসুস্থ আমার।”
মিতুল বিস্ময়ান্বিত চোখে তাকিয়ে আছে জোহানের দিকে। জোহানের দ্রুত হৃদস্পন্দনের গতি টের পাচ্ছে ও। জোহানের সাথে সাথে ওর হৃদস্পন্দনও বেড়ে যাচ্ছে। ঝড় বইছে হৃদয়ে। তুমুল আকারের ঝড়। অশান্ত, বেপরোয়া।
জোহান শান্ত কণ্ঠে বললো,
“তোমার উচিত কার্লের প্রতি তোমার অহেতুক ভালো লাগার এখানেই সমাপ্তি ঘটানো।”
মিতুল নির্বাক। মাথায় তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। শ্বাস ভারী হচ্ছে ওর।
মিতুলকে এসব বলতে জোহানের হৃদয় কাঁপছে। হৃদয়ের এমন কাঁপন এর আগে কখনো উপলব্ধি করেনি ও। গলাও কাঁপছে একটু। জোহান নিজের শুকিয়ে যাওয়া গলাটা ঢোক গিলে ভিজিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বললো,
“আমি তোমাকে পছন্দ করি মিতুল!”
মিতুলের হৃদয়ে বয়ে চলা তুমুল ঝড় আরও সাংঘাতিক রূপ ধারণ করলো। হৃদয়ের এই ছটফটানি আর সহ্য তুল্য নয়।
একটু দমকা হাওয়া বইলো। সেই দমকা হাওয়ার সাথে গাছ থেকে উড়ে পড়তে লাগলো কিছু কোমল চেরি পাপড়ি। জোহান মিতুলের বিস্ময় ঘেরা আতঙ্কিত মুখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে হাত বাড়িয়ে একটা চেরি পাপড়ি মুঠো বন্ধি করলো।
মুঠো বন্ধি হাতটা মিতুলের সামনে এনে খুলে বললো,
“তুমি যতটা এই চেরি ব্লসম পছন্দ করো, তার থেকে অনেক অনেক বেশি পছন্দ করি আমি তোমাকে। ভালোবাসি! ভালোবাসি তোমায়!”
মিতুলের হাত পা সব দুর্বল হয়ে পড়ছে। শক্তি বিলুপ্ত হয়ে পড়ছে ক্রমে ক্রমে। কী করবে ও?
জোহান ওর হাতের চেরি পাপড়িটি মিতুলের হাতে গুঁজে দিলো। তারপর আবার মিতুলের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমি আমার কথা বলে দিয়েছি। তুমি কী করবে? তোমার কী মনে হয়? তুমি কি তোমার মনের আসল চাওয়াটা ধরতে পেরেছো? কী ভাবো তুমি? আমাকে পছন্দ তোমার?”
মিতুল যেন উত্থাল সমুদ্রের বুকে ঢেউয়ের সাথে পাক খাচ্ছে। কী করবে ও? কী করা উচিত? কিছু বলা উচিত জোহানকে? কী বলবে? মিতুল হাতের চেরি ব্লসম পাপড়িটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো,
“আসলে…আমি…”
কিছুই বলে উঠতে পারলো না মিতুল।
“কী? বলো।”
“আসলে…”
এবারও বলতে পারলো না কিছু।
জোহান মিতুলের এমন ইতস্তত ভাব দেখে হঠাৎ মিতুলের হাত ধরে টান দিয়ে মিতুলকে আরও কাছে এনে ফেললো।
ভীষণ ভাবে চমকে উঠলো মিতুল। মনে হচ্ছে ওর হৃদপিণ্ড গলার কাছে উঠে এসেছে।
জোহান মিতুলের দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বললো,
“আসলে কী, তা তুমি জানো না। আমি জানি। তুমি আসলে…পছন্দ করো আমাকে। আর সেটা অনেক আগে থেকে। যেটা বুঝতে পারোনি তুমি।”
মিতুলের মনে হলো ও ভুল শুনছে। অনেক আগে থেকে জোহানকে পছন্দ করে ও? কবে থেকে?
মিতুল একটু ভাবতে চাইলো ও কবে থেকে পছন্দ করে জোহানকে। কিন্তু ওর ভাবনা সেই পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছতে পারলো না। ওর ধ্যান, জ্ঞান, ভাবনা সবকিছু এখন এখানেই নিবদ্ধ। বর্তমানের এই ক্ষণ ছেড়ে কিছুতেই অতীত হাতড়াতে যেতে পারলো না ও।
মিতুল দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না আর জোহানের সামনে। পা তাল হারিয়ে ফেলছে। শরীর ঘেমে যাচ্ছে। মিতুল কোনো রকম বললো,
“বাড়ি ফিরি চলো।”
“বাড়ি ফিরতে তাড়া তোমার? না কি আমার থেকে পালাতে চাইছো?”
মিতুল দুই পাশে মাথা নাড়িয়ে বুঝালো, না ও পালাতে চাইছে না।
“ও তাই? পালাবে না তুমি? কী করে বুঝবো? প্রমাণ দাও। জড়িয়ে ধরো আমায়।”
মিতুলের হৃদয় ছ্যাত করে উঠলো। জড়িয়ে ধরবে মানে?
জোহান মিতুলকে স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা অভিমানী সুরে বললো,
“ওহ! বুঝেছি। তুমি আসলে মিথ্যা বলেছো আমাকে। তুমি ঠিকই পালাতে চাইছো।”
জোহান অভিমান করেছে এমন একটা ভঙ্গিতে মুখ ঘুরিয়ে নিলো অন্যদিকে।
কিছুটা সময় নীরব কেটে গেল।
জোহান হঠাৎ টের পেল কেউ একজন ওর বাম হাতের বাহু জড়িয়ে ধরছে। জোহানের বুঝতে বাকি নেই এটা মিতুল। মিতুল ছাড়া কেই বা আছে এখানে?
জোহান পাশে তাকালো। মিতুল হাত জড়িয়ে ধরে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। জোহান প্রশস্ত হাসলো। মিতুলের রাগহীন নাকটাকে আলতো করে টেনে বললো,
“আমার বোকা তুলতুল বোধহয় একটু বুদ্ধিমান হবে এবার। তবে তুলতুলের রাগে ফুলো নাকটা যে আজীবন দেখতে পারব, সেটা কনফার্ম।”
বলে আবারও হেসে ফেললো জোহান।
মিতুল মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে জোহানের দিকে। জোহানের হাসি এত মিষ্টি সেটা আগে কখনো খেয়াল করেনি কেন ও?
মিতুল জোহানের বাহু ধরেই হাঁটতে হাঁটতে সাইকেলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
প্ৰকৃতির এই সন্ধ্যা যে এত অনন্য মায়াময় হতে পারে, সেটা আগে জানা ছিল না মিতুলের। চেরি ব্লসমের সাথে কাটানো আজকের এই সন্ধ্যা, সারাজীবনের সবগুলো সন্ধ্যার থেকে শ্রেষ্ঠ হয়ে থাকবে। এই শুভ্র চেরি পুষ্প, এই সন্ধ্যা, এই ঝাপসা আলো আঁধারের পরিবেশ ওর মনের গাঢ় অনুভূতির সাক্ষী হয়ে থাকবে। এই অনুভূতি ফুরোবে না কোনো দিন। সেই সাথে ফুরোবে না এই সন্ধ্যার রেশ। সারাজীবন মনে থাকবে এই সন্ধ্যাকে। মনে থাকবে ওর জীবনের শ্রেষ্ঠ সন্ধ্যা ছিল, চেরি ব্লসমের সাথে এক সন্ধ্যা।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হলো। গ্যারেজে এসে সাইকেল থামাতেই মিতুল দ্রুত নেমে পড়লো সাইকেল থেকে। কোনো দিকে না তাকিয়েই দ্রুত পায়ে ছুটতে লাগলো ঘরের দিকে। কিছুদূর চলে এলেই পিছন থেকে বাতাসের সাথে সাথে দুটি শব্দ এসে কর্ণ কুহরের কড়া নাড়লো,
“হেই তুলতুল!”
মিতুলের পা অলৌকিক শক্তিতে থেমে গেল যেন। পিছন ফিরে তাকানোর সাহস নেই ওর। তবুও কীসের একটা টানে যেন ফিরলো।
জোহান হাত দিয়ে লাভের আকৃতি করে বাংলায় বললো,
“ভালোবাসি!”
তারপর আবার ইংলিশে বললো,
“এটাই তোমার পাওয়া বাকি ছিল। ভালোবাসা!”
বলে মিষ্টি হাসি ফোঁটালো মুখে।
মিতুলের মনে হলো ও পাগল হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত চোখ ফিরিয়ে আনলো জোহানের উপর থেকে। তারপর আবারও ছুটতে শুরু করলো।
___________
ঘুমাতে পারছে না মিতুল। একটু চোখ বন্ধ করলেই জোহানের মুখ ভেসে উঠছে। মিতুল এই শুয়ে পড়লেই, আবার এই উঠে যাচ্ছে। এবারও কম্বল সরিয়ে উঠে বসলো। আস্তে করে কয়েকটা কিল বসালো বুকে। কিন্তু এই কিল ওর অন্তর পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছলো না। হৃদয়ের ঝড় থামলো না। হেরফের হলো না কোনো কিছু। পাগলই হয়ে যাচ্ছে বোধহয়।
ইশ, কালকে কী করে মুখ দেখাবে জোহানকে? জোহানের সামনে পড়লেই তো লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছা হবে ওর। হায় আল্লাহ! কী করবে এখন? না, এই কানাডা শেষমেশ পাগল করেই ছাড়বে ওকে। উহ! কোথায় যাবে ও? জোহানের কথাগুলো কানে বেজে উঠছে ওর,
“তুমি যতটা এই চেরি ব্লসম পছন্দ করো, তার থেকে অনেক অনেক বেশি পছন্দ করি আমি তোমাকে। ভালোবাসি! ভালোবাসি তোমায়!”
মিতুল এবার উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে উত্তেজনায় কয়েকটা কিক বসিয়ে দিলো বেডে। রাতটা একটু তাড়াতাড়ি কেটে যাক।
______________
মেঘনা নদীতে আছে মিতুল। ছোট একটি নৌকাতে ও। নৌকার এক প্রান্তে মাঝি, অন্য প্রান্তে ও এবং জায়িন। জায়িনের বুকে মাথা রেখে জায়িনকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে ও। এখন গোধূলি লগ্ন। আকাশের রূপটা এখন দেখার মতো। আকাশের মনোরম প্রতিচ্ছবিটি থলথলে পানির উপর ভাসছে। মিতুল প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য এক পলক দেখে নিয়ে, বড়ো করে নিঃশ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করলো। নিশ্চিন্ত মনের নিঃশ্বাস বলে একে। জায়িনের শান্ত কণ্ঠ কানে ভেসে এলো,
“এখানে থাকতে ভালো লাগছে তোমার দিলরাবা?”
কথাটি সম্পূর্ণ শুদ্ধ বাংলায় বললো জায়িন।
জায়িনের মুখ থেকে দিলরাবা ডাকটি শুনে মিতুলের অন্তর জুড়িয়ে গেল। দিলরাবা! হ্যাঁ, জায়িন ওকে ভালোবেসে দিলরাবা বলে ডাকে। জায়িনের মুখ থেকে এই দিলরাবা ডাকটি শুনলেই ওর মনে হয় এটা ওর জীবনের সবচেয়ে পরম পাওয়া। মিতুল চোখ বন্ধ রেখেই বললো,
“হুম ভালো লাগছে। বিশেষ করে তোমার বুকে মাথা রাখতে ভালো লাগছে আমার।”
বলেই মিতুল হঠাৎ করে কেন যেন চোখ খুলে ফেললো। ওদের সামনা সামনি মাঝিটাকে দেখলো। মাঝি দূরে বসে থাকলেও ও স্পষ্ট মাঝির মুখ দেখতে পাচ্ছে। মাঝির পরনে লুঙ্গি, গায়ে সাদা গেঞ্জি। ঘাড়ের উপর থেকে একটা গামছা ঝুলিয়ে রেখেছে। চুলগুলো বাদামি রঙা, চোখের মণিও বাদামি। চেহারা দেখে প্রথমে মনে হয় সার্জারি করে এত সুন্দর বানানো। পর মুহূর্তে আবার মনে হয় সার্জারি করা নয়। সত্যিই এমন। নৌকাতে ওঠার পর এই প্রথম মাঝির চেহারা দেখলো মিতুল। এই মুখটা খুব চেনা চেনা লাগছে ওর। অনেক বার যেন দেখেছে এই মুখ। কোথায় দেখেছে? মিতুলের চোখে জোহানের হাস্যজ্জ্বল মুখ ভেসে উঠলো। বিস্ময়ে মিতুলের কপালে ভাঁজ পড়লো। মিতুল অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলো,
“জোহান!”
হঠাৎ করে একটা দমকা হাওয়া বইলো। সেই দমকা হাওয়া গায়ে লাগতেই জোহান কুয়াশার মতো হয়ে একসময় চোখের অদৃশ্য হয়ে গেল!
মিতুলের বুকটা কষ্টে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। জোহান কুয়াশা হয়ে গেল কেন? কোথায় গেল জোহান?
ঘুমন্ত মিতুলের চোখের কোণ বেয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো নিশ্চুপ। মিতুল একটু নড়েচড়েই জেগে উঠলো হঠাৎ। চোখ মেলতেই মিতুলের সব কিছু এলোমেলো লাগলো। এ কোথায় আছে ও? কোন জায়গা এটা?
মিতুল কম্বল গায়ে পেঁচিয়ে ফ্লোরে পড়ে আছে। ‘পড়ে’ না ঠিক। কালকে রাতে ঘুম আসছিল না দেখে বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়েছিল। কম্বল গায়ে জড়িয়ে পায়চারি করছিল কিছুক্ষণ রুমের ভিতর। মনের অশান্ত ছটফটানি কমছিল না কিছুতেই। তাই এই জ্বালা নিয়ে এক সময় অতিষ্ট হয়ে ফ্লোরেই শুয়ে পড়েছিল। হ্যাঁ, ফ্লোরে। মিতুলের সবটা মনে পড়তেই ধরফড়িয়ে উঠে বসলো। আশেপাশে উদ্বিগ্ন চোখ বুলালো। হ্যাঁ ও তো ওর রুমে।
“আহ্!” মাথার পিছনটা হঠাৎ ব্যথা করে উঠলো। মিতুল আলতো হাত রাখলো মাথার পিছনে। সারারাত এই ফ্লোরে পড়ে ছিল বালিশ ছাড়া?
মিতুল গায়ের কম্বলটা আঁকড়ে ধরে উঠে দাঁড়ালো। সারারাত ধরে তো ফ্লোরে ছিল না। ফ্লোরে শুয়েই তো ছিল একেবারে শেষ রাতের দিকে। তাহলে সারারাত হলো কীভাবে? শীতে হাত, পা কাঁপছে মিতুলের। এত শীত কেন? হঠাৎ জানালার দিকে চোখ পড়লো। জানালা খোলা! মিতুল দৌঁড়ে এসে জানালা বন্ধ করলো। জানালা খোলা রেখে ফ্লোরে এই শীতের মাঝে কীভাবে শুয়েছিল ও? জোহানের জন্য সত্যি সত্যিই কি মাথা খারাপ হয়ে গেল না কি ওর? হ্যাঁ, মাথা খারাপই হয়ে গেছে। তা না হলে এই শীতে কি কেউ জানালা খোলা রেখে ফ্লোরে ঘুমাতে পারে?
মিতুল শরীর থেকে কম্বলটা সরিয়ে একটা জ্যাকেট চাপিয়ে নিলো। জানালার কাছে এগিয়ে এলো।
বাইরে ঘন কুয়াশা। কুয়াশার আস্তরণ পেরিয়ে চোখ কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। মিতুল নিজের স্বপ্নটার কথা ভুলেই গিয়েছিল প্রায়। হঠাৎ মনে পড়ে গেল। নৌকা, জায়িন, ও এবং সেই মাঝি! ছি ছি ছি! কীভাবে এমন একটা স্বপ্ন দেখতে পারলো ও? জায়িনকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা রেখে…ছি! এ যে ওর ভাবনারও বাহিরে। আর মাঝি? জোহানকে মাঝি হিসেবে দেখেছে ও! জোহান মাঝি? হাহ! ওর ভাবনাতো দেখছে দিনকে দিন লিমিট ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
জায়িনের বুকে মাথা রাখার দৃশ্যটা আবারও মনে পড়লো মিতুলের। গা ঘিনঘিন করে উঠলো ওর।
(চলবে)