#আমি_তোমার_গল্প_হবো🍁
লেখিকা- মাহিয়া তাহসীন মেরিন
পর্ব:::১৭
অনুরিমা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে,
— ” সেদিন শাহিন এসে আমাকে জানায় রবিবার সকালে আকাশ বিজনেসের এক কাজে লন্ডনে যাবে। আর এই সুযোগে আমাদের বিয়ে করে ফেলা উচিত। আমিও তখন কোন কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে যাই।
আমার বাবা তখন অনেক বার আমাকে এমন ভুল করতে নিষেধ করেছিলো। কিন্তু আমি শুনিনি। আসলে, পারিবারিক ভাবেই আমার সাথে আকাশের বিয়ে হয়, বলতে পারো অনেকটা জোর করেই। কিন্তু বিয়ের পর আকাশের ব্যাবহার, তার সব কেয়ারগুলো আমার মনে ভালোবাসা সৃষ্টি করেছিলো ঠিকই। কিন্তু শাহিনের মিথ্যা ভালোবাসার অভিনয়ের সামনে আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। ”
” সব কিছু প্ল্যান মতোই হচ্ছিল হঠাত আকাশ জেনে যায় আমাদের বিয়ের কথা। সে তখনি ফ্লাইট মিস করে আমাদের কাছে চলে আসে। সত্যি বলতে আমি কখনো ভাবিনি আকাশ এভাবে চলে আসবে। তাই তখন আকাশকে দেখে আমি অনেকটাই চমকে গিয়েছিলাম। ”
— অধরা অনুরিমার দিকে তাকিয়ে, ” তারপর? ”
— ” আকাশ এসে আমাকে অনেক অনুরোধ করে কথাই বলে। আশ্বিন জন্য হলেও আমাদের সাজানো সুন্দর সংসারটা এভাবে ভেঙে দিতে না করে।
আকাশ বলেছিলো, একজন স্ত্রীর দায়িত্ব তার স্বামীর কোন বিপদে তার পাশে থেকে তাকে সাপোর্ট করা। এভাবে দায়িত্ব থেকে পালিয়ে নিজের জীবন নিজের মতো করে সাজিয়ে গুছিয়ে নেওয়া না।
সত্যি বলতে, সেদিন আকাশের কথাগুলো আমার মনে দাগ কেটেছিলো। তখন বুঝতে পেরেছিলাম, সত্যিই আমি স্বার্থপরের মতো, নিজের কথা ভেবে কতো বড় ভুল করতে যাচ্ছি।
কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে যায়।
শাহিন আকাশের উপর রেগে যায় আর তাদের মাঝে এই নিয়ে কথা কাটাকাটি শুরু হয়। এক পর্যায়ে আকাশ বলে ওঠে,
” অনুকে নিয়ে যাওয়ার সম্পূর্ণ অধিকার আমার আছে। কারণ আমাদের ডিভোর্স এখনো হয়নি। সেই হিসেবে অনু এখনও আমার স্ত্রী। আমি বেঁচে থাকতে আমার অনুকে কখনোই ছেড়ে যাবো না।
আর, আমার আশ্বিনেরও তার মাকে খুব প্রয়োজন। এই পৃথিবীতে তার কাছে তার মা সবচেয়ে আপন। আমি পারবো না আমার ছেলেকে মা ছাড়া রাখতে।
কাল রাতেও আমি আশ্বিনকে কথা দিয়েছি, বলেছি বাবা যেভাবেই হোক মাকে নিয়ে আসবে। আর আমি আমার দেওয়া কথা রাখবো। ”
সেই মূহুর্তে আমি আকাশের বলা কথাগুলো শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমি কখনো একজন ভালো মা হতে না পারলেও, আকাশ একজন ভালো বাবা হয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলো। আশ্বিন ঠিকই বলতো ড্যাড আমার সুপারম্যান, আর আমি তার সুপারহিরো। ”
অনুরিমা কথাগুলো বলে একটু থামলো। জানালার বাইরে এক নজর তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে,
— ” আকাশ কথাগুলো বলে কোন কিছু না ভেবে আমার কাছে এসে আমার হাত ধরে চলে আসতে নিতেই শাহিন তার সামনে আসে। শাহিন কোনভাবেই আমাকে যেতে দিবে না আর আকাশ আমাকে না নিয়ে যাবে না। আমি সম্পূর্ণ একটা ঘোরের মাঝে ছিলাম। হঠাত শহিন আমাকে জিজ্ঞেস করলো আমি কি চাই? আমি কিছুক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়ে অনেক ভেবে বলেছিলাম, আমি আশ্বিনের মা আর আকাশ চৌধুরীর স্ত্রী হয়েই ফিরে যেতে চাই।
আমার উত্তরে আমার বাবা আর আকাশ খুশি হলেও শাহিন খুব রেগে যায়। সে কোন কিছু না ভেবেই একটা গান বের করে আকাশের দিকে তাক করে গুলি করে বসে। পর পর দুটো গুলি, আর সব শেষ। ঘটনাটা এতো জলদি হয়েছিলো যে আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আকাশ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পুরো ফ্লোর রক্তে ভেসে যাচ্ছিলো, আমি এসব দেখে স্তব্ধ হয়ে যাই। দৌড়ে আকাশের কাছে গিয়ে বাবাকে চিৎকার করে বলেছিলাম এম্বুলেন্স ডাকতে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়, আকাশ…আকাশ আমাদের ছেড়ে চলে যায়। আমি তার নিথর দেহ দেখে নিজেকে সামলে রাখতে পারিনি তাই সেখানেই জ্ঞান হারাই। ”
কথাগুলো বলে চুপ হয়ে যায় অনুরিমা।
— অধরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ” তারপর? আপনি পুলিশকে জানানি কেনো? আর সবটা জানার পরে কিভাবে এখনও শাহিন হাসাদের সাথে থাকছেন আপনি? ”
— ” সব বলবো।
আমার জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে একটা বদ্ধ ঘরে আবিষ্কার করি। আকাশের কথা মনে হলেই যখন আমি বাসা থেকে বের হতে চাই তখন দেখি শাহিনের লোকেরা পুরো বাসা ঘিরে ফেলেছে। যেনো কোন ভাবেই আমি বাসা থেকে বের হতে না পারি।
কিছুক্ষণ পর শাহিন তার ছোট্ট সাহিলকে কোলে নিয়ে আমার কাছে আসে। শাহিনের কাছে জানতে পারি সে দুদিন আগেই আকাশকে দাফন করেছে কিন্তু কোথায় সেটা আমাকে বলেনি। মানে আমার দুদিন পর জ্ঞান ফিরে এসেছিলো। আমি তাকে ভয় দেখিয়ে বলেছিলাম,
” আমি সবাইকে বলে দিবো যে আপনি আমার আকাশকে হত্যা করেছেন। পুলিশকে সব জানিয়ে দিবো আমি। ”
কিন্তু শাহিন আমাকে অবাক করে দিয়ে বলেছিলো, ” তোমার কি মনে হয় আমি তোমাকে সেই সুযোগ দিবো? একবারও কি ভেবে দেখেছো তোমার বাবা এখন কোথায় আছে? ”
সত্যি বলছি অধরা, আমি ভাবতেও পারিনি শাহিন আমার বাবাকে….। ”
কথাগুলো বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ মুছে অনুরিমা। অধরা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে,
— ” আপনার বাবা? আপনি তো বলেছিলেন আপনার বাবা আপনার ভাইয়ের কাছে থাকে। ”
— ” হ্যা বলেছিলাম। আমার কাছে কোন উপায় ছিলো না। এতোগুলো বছরেও আমি জানি না আমার বাবা কোথায় আছে কেমন আছে। শহিনকে লুকিয়ে আমি বাবাকে অনেক খুঁজেছি কিন্তু কোন লাভ হয়নি। আমার একার পক্ষে কোনকিছু করাই সম্ভব ছিলো না, সবাই আমাকে পর করে দিয়েছিলো।
অল্প বয়সের একটা ভুল এতোটা প্রভাব ফেলবে বুঝতে পারিনি।
ভেবেছিলাম আকাশের মা হয়তো আকাশকে নিখোঁজ হওয়ার কথা পুলিশকে জানাবেন। কিন্তু পরে জানতে পারি শাহিন প্ল্যান করে সবকিছু ধামাচাপা দিয়ে দিয়েছে। সবাইকে জানিয়েছে আকাশ লন্ডনে থাকে তার বিজনেস সামলাতে কিন্তু লন্ডনের সবাই জানে আকাশ দেশেই আছে। আমার বাবার কথাও সেই বলেছে। সেদিন আকাশকে গুলি করা, তার কবর এই সবকিছু যারা সাক্ষী হয়ে ছিলো তাদেরকেও সে সরিয়ে দিয়েছে। কোন প্রমাণ নেই শাহিনের বিপক্ষে। আমি চাইলেও কিছু করতে পারিনি। একটা মিথ্যা সম্পর্কের পরিচয়ে আমি সেখানে পরে আছি।
আমি আশ্বিনকে কখনোই বলতে পারিনি তার বাবার কথা। আমি জানি এই কথাগুলো যদি আশ্বিন কোনদিন জানতে পারে সে আমাকে ঘৃণা করবে। আমি এই ভয়ে সব সময় আশ্বিনের থেকে দূরে দূরে থেকেছি। আমি যে নিজের কাছেই অপরাধী। ”
অনুরিমা কথাগুলো বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। অধরা কিছুক্ষণ চুপ থেকে কথাগুলো শুনে। বেশ কিছুক্ষণ পর অনুরিমা শান্ত হয়ে,
— ” আমার এখান যেতে হবে। বেশি দেরি করলে শাহিন আমাকে সন্দেহ করবে।
অধরা, আমি জানি তুমি আশ্বিনকে কথাগুলো বলবে। কিন্তু সাবধান, শাহিন জানতে পারলে অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, এতোগুলো বছর পর মনে আটকে রাখা কথাগুলো তোমাকে কথাগুলো বলে নিজেকে অনেকটা হালকা লাগছে। এখন আমি অনেকটাই নিশ্চিন্ত। ”
অনুরিমা কথাগুলো বলে ধীরে ধীরে চলে যায়। অধরা এখনো সেখানে মাথা নিচু করে বসে আছে। তার এই মুহূর্তে কি করা প্রয়োজন? হঠাত জনি এসে তার পাশে বসে,
— ” ছোট মনি কি হয়েছে? উনি কি কি বলেছেন? ”
— অধরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ” আমরা যা ভেবেছিলাম তাই। অনুরিমা মামুনীকে বাধ্য করা হয়েছে মুখ বন্ধ রাখতে। কারণ শাহিন হাসাদের কাছে উনার বাবা এখনো জিম্মি হয়ে আছেন। ”
— ” এখন কি করবে? পুলিশকে জানালে কেমন হয়? ”
— ” আমার মনে হচ্ছে আগে আশ্বিনকে সবটা বলা উচিত। আমি আজই আশ্বিনকে সব সত্য বলে দিবো। তারপর আশ্বিন যা বলবে তাই হবে। ”
অধরা কথাটা বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে যায়।
🌻বিকেলে🌻
আশ্বিন আজ তারাতারি অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে ল্যাপটপে কাজ করছিলো। হঠাত অধরা তার পাশে এসে বসে পড়ে।
— আশ্বিন ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে, ” কিছু বলবে? ”
— অধরা একটা বড় শ্বাস নিয়ে, ” আশ্বিন আমি আপনাকে একটা সত্যি বলতে চাই। এই সত্যটা আপনার জানা অনেক প্রয়োজন। ”
— আশ্বিন ল্যাপটপ রেখে অধরার দিকে তাকিয়ে, ” কি হয়েছে? বলো আমাকে…। ”
— ” আশ্বিন, আপনার বাবা….। ”
— অধরাকে থামিয়ে দিয়ে, ” উফ অধরা! আবার শুরু করে দিয়েছো? কাল রাতেও না বলেছি উনার কথা আমার কাছে বলবে না। ওই লোকটার নামও শুনতে চাই না আমি। উনাকে নিয়ে কোন কথা বলবে না তুমি, বুঝতে পেরেছো? আমি চাই না….। ”
— অধরা আশ্বিনের কথার মাঝেই চিৎকার করে, ” আপনার বাবা আর নেই আশ্বিন। ”
হঠাত কথাটা শুনে আশ্বিন চুপ হয়ে যায়। তারপর অবাক হয়ে,
— ” নেই মানে? কোথায় আছে? কি উল্টো পাল্টা বলছো তুমি? ”
— অধরা শান্ত কণ্ঠে, ” আশ্বিন, আপনার বাবা আমাদের সবাইকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন। ”
— আশ্বিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত কণ্ঠে, ” কি বললে? ড্যাড ম..মারা গিয়েছে? ক..কবে? কে বলেছে তোমাকে? কই আমার কাছে তো কোন খবর আসেনি। তুমি মজা করছো তাই না অধরা? ”
— ” না আশ্বিন, আমি সত্যি কথাই বলছি। এই যে সকল প্রমাণ। আর এটা…। ”
অধরা তার ফোনের রেকর্ড প্লে করে যেখানে আজকে অনুরিমার বলা সব কথা অধরা রেকর্ড করে রেখেছিলো।
আশ্বিন সবটা শোনার পর স্তব্ধ হয়ে যায়। সে প্রমাণগুলো একবার হাতে নিয়ে দেখে তারপর চুপ করে মাথা নিচু করে বসে থাকে।
— ” আশ্বিন, আমি কথাগুলো আপনাকে কালই বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনি…। ”
— আশ্বিন স্তব্ধ হয়ে বসে শান্ত কণ্ঠে, ” অধরা, আমাকে একবার বাবার কাছে নিয়ে যাবে? আমি শুধু ড্যাডের কবরটা একবার দেখতে চাই। প্লিজ, অধরা। ”
আশ্বিনের এমন কষ্ট মেশানো শীতল কণ্ঠে শুনে অধরার বুকের ভেতর কেপে ওঠে। সে চোখের পানি ছেড়ে মাথা নেড়ে আশ্বিনকে হ্যা বোঝায়।
—চলবে❤