#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-১২
উন্মুক্ত পিঠে ভার অনুভব হতেই নড়েচরে আরো আরাম করে শুয়ে পরলো আরাব। ঘাড়ের দিকটা বেশ অনেকটাই ব্যথা হয়ে আছে। তার যথেষ্ট কারনও আছে। আগের দু দুটো রাত ঘুমোয়নি। নিজের বাসায় চোরের মতো ঢুকেছে ভোরররাতের দিকে। এসেই ঘুম! বিছানার পায়ের দিকটায় মাথা দিয়ে উপুর হয়ে শুয়ে আছে ও। চোখ না খুলে ঘুম জরানো কন্ঠে বললো,
-কখন এসেছো টুইঙ্কেল?
-কিছুক্ষন আগেই।
সামনে থেকে টুইঙ্কেলের আওয়াজ পেয়ে চোখ মেললো আরাব। সামনেই দাড়িয়ে চকলেট খাচ্ছে টুইঙ্কেল। সাদা রঙের ফ্রক পরে আছে।মুখে একগাদা চকলেট লেগে আছে ওর। সকাল সকাল ছোট্ট শুভ্র পরীটাকে দেখে মনটাই ভালো হয়ে গেলো ওর। একটুপরেই মনে পরলো,টুইঙ্কেল তো সামনে দাড়িয়ে। তবে ওর কাধে ভারি লাগছিলো কি? ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালো আরাব। টুইঙ্কেলকে দেখে যতোটা মন ভালো হয়েছিলো,নিমিষেই গায়েব হয়ে গেলো সবটা।
ও ভেবেছিলো ওকে উপুর হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে বরাবরের মতো টুইঙ্কেলই উঠে দাড়িয়েছে ওর পিঠের উপর। কিন্তু না। তেমনটা একদমই না। বিছানার পাশেই জারা দাড়িয়ে। আরাবকে ফিরতে দেখে একটা হাসি দিয়ে বললো,
-গুড মর্নিং আরাব!
আরাবের বুঝতে বাকি রইলো না জারাই স্পর্শ করেছে ওকে। কড়া মেজাজে উঠে বসলো ও। রাগ হচ্ছে,কিন্তু প্রকাশ করার ইচ্ছে ওর নেই। বিছানায় থাকা টিশার্টটা পরতে পরতে বললো,
-তুমি এ ঘরে কেনো?
জারার দৃষ্টি আরাবের উন্মুক্ত বুকে। ঠোট কামড়ে হেসে বললো,
-কেনো মিস্টার? বারন বুঝি আমার এ ঘরে আসা?
আরাব বিছানা ছেড়ে নামলো। স্বাভাবিক গলায় বললো,
-একটা কথা বলো আমাকে জারা,আমি একটা ব্যাচেলর ছেলে। একটা বাঙালি মেয়ে হয়ে আমার ঘরে এভাবে বিনা অনুমতিতে ঢোকা,রুচিতে বাধে না তোমার?
জারা দমে গেলো। রাগ দেখায় না,কিন্তু প্রতিবারই মিষ্টিভাষায় জারাকে এভাবে অপমান করে আরাব। এদিক ওদিক তাকিয়ে রাগ সংবরন করলো ও। তারপর একটা জোর করে হাসি দিয়ে বললো,
-শোল্ডারে পেইন ছিলো তোমার? ম্যাসাজ করে দেবো?
-নো নিড। নিজের লিমিটগুলো ভুলো না জারা।
আরাব একটু শক্তভাবে বললো।তারপর তোয়ালেটা কাধে ঝুলিয়ে টুইঙ্কেলকে বললো,
-টুইঙ্কেল? আম্মু এসেছে তোমার? আব্বু?
-আব্বু আসেনি। আম্মুও আমাকে রংধনুতে রেখে হসপিটাল চলে যাবে বলে এসেছে। তোমার সাথে দেখা করবে বলে ওয়েট করছে।
-ফাইন,তুমি নিচে যাও,আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি হুম?জারা? তুমিও বেরোও রুম থেকে এখন। আর নেক্সটটাইম আমার পারমিশন ছাড়া এ ঘরে ঢুকবে না।
-কিন্তু তৌফিক আঙ্কেল যে বলে…
-রুমটা আমার। তোমার তৌফিক আঙ্কেলের নয়। তুমি আরেকবার জিজ্ঞেস করে নিও বাবাকে।
জারা মনটা ছোট করে ফেললো। বললো,
-আমি তো জানতাম তোমার স্টাডিরুমে যেতে বাসার বাকিসবার মতো পারমিশন লাগে। এই রুমে আসতেও পারমিশন লাগবে বলছো?
-মানুষের বেডরুম মানে স্টাডিরুমের চেয়ে আরো বেশি পার্সোনাল কিছু।ডাক্তারি পরছো,এটুকো কমন সেন্স তো রাখো জারা!
-সেন্স তো তোমার জন্যই হারিয়েছি।আর এ রুমটাও কয়েকদিন পর আমাদের হয়ে যাবে। এতো কমন সেন্স দিয়ে কি হবে তখন বলোতো?
বিরবিরিয়ে বলে জারা লাজুক ভঙিমায় কপালের কিছু চুল কানে গুজলো। আরাবের সবকথাতেই ওর ভালোলাগা কাজ করে। যেটাকে আপাতদৃষ্টিতে অপমান বকে মনে হয়,ওর কাছে যেনো তা শাষন। জারার বলা কথাটা পুরোপুরিই কানে গেছে আরাবের। ছেচড়ামো ছাড়া আর কোনো শব্দ আবিষ্কার করতে পারলো না ও জারার জন্য। বিরক্তির শ্বাস ফেলে তোয়ালে কাধে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে হাটা লাগালো ও। পেছন থেকে জারা বলে উঠলো,
-তোমাকে এই থ্রি কোয়াটার প্যান্ট আর খালিগায়ে অনেক হট লাগে আরাব!
-রুম থেকে বেরোও!
চেচিয়ে বলে ধরাম শব্দে ওয়াশরুমের দরজা লাগালো আরাব। শাওয়ার অন করে দেয়ালে একহাত রেখে দাড়ালো। মন পুরোটাই বিগড়ে গেছে ওর। আর সবটার জন্য ওর বাবা দায়ী। ওর জীবনে তৌফিক ওয়াহিদের ভুমিকা তেমনভাবে ছিলো না কোনোদিনই। সে তো চেয়েছিলো আরাবের নিয়ন্ত্রক হতে,এখনো চায়। কিন্তু হয়ে উঠতে পারেনি। হতে দেয়নি আরাব। মাধ্যমিক পাশের পর থেকেই নিজের স্কলারশিপের টাকায় পড়াশোনা শেষ করেছে। তৌফিক ওয়াহিদের বিশাল সম্পত্তির টিকিটার দিকেও ফিরে চায়নি। নিজেরমতো করে স্বাধীন জীবনযাপন করবে মাঝেমধ্য রংধনু থেকে চলে যাওয়ার কথাও ভেবেছে। মা বোনের কথা ভেবে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। আর তার সুযোগটা তৌফিক ওয়াহিদ ভালোভাবেই নিতে শিখে গেছেন। বড়লোক বাবার মেয়ে জারাকে ছেলের বউ করবেন বলে উনি মাতোয়ারাপ্রায়।
মাথার ভেজা চুলগুলো উল্টে চোখ বন্ধ করলো আরাব।হুট করেই দোয়ার সেদিনের হাসিমুখটা ভেসে উঠলো ওর চোখের সামনে। হাসি ফুটলো ওর চেহারাতেও। অশান্ত হৃদয়জুড়ে ক্রমশ নামলো শীতলতা।
বাইরে স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে জারা। টুইঙ্কেল এগিয়ে এসে চকলেটটা জারার সামনে ধরে বললো,
-আরাব মামা রাগ করেছে জারা আন্টি। তুমি নাও,চকলেট খাও!
এতোক্ষনে জারা টের পেলো। ঠিকই তো,আরাব রাগ করেই দরজা লাগিয়েছে,ওকে রুম থেকে বেরিয়েও যেতে বলেছে। টুইঙ্কেলের হাত থেকে চকলেটটা নিয়ে ফ্লোরে ছুড়ে মারলো ও। তারপর ফুসতে ফুসতে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। মেঝেতে পরে থাকা চকলেটের দিকে তাকিয়ে ঠোট উল্টালো টুইঙ্কেল। আরাব মামা বলেছে,যেদিন নানুভাই বাসায় থাকবে,সেদিন জারা আন্টির যে কাজেই রাগ হবে,নানুভাইকে বলে দিতে। এতে ও এক্সট্রা দুটো চকলেট পাবে। আর নানুভাই না থাকলে একটা চকলেট পাবে। আজ নানুভাই বাসায় নেই।তাই শর্তমতো আরাবের টেবিলের ড্রয়ার খুলে ওখানে একটা চকলেট নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো।
মাথা মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বেরোলো আরাব। রুমে বুকে হাত গুজে তৌফিকা দাড়িয়ে। ওকে বেরোতে দেখেই বললো,
-তোর শার্টে রক্ত কেনো আরাব?
হচকিয়ে গেলো আরাব। মনেমনে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো জারাকে নিয়ে তৌফিকাকে শুনাবে বলে। কিন্তু ওর বোন সবসময়ই এক ক্লাস উপরে। পর্যাপ্ত ঘষেমেজে ধুয়ে মেলে দেওয়া শার্টটায় থাকা রনোকের হাতের রক্তের ছিটেফোটা দাগ ঠিকই চোখে পরেছে তৌফিকার। আরাব জোরপুর্বক হেসে বললো,
-কিহ্? রক্ত? কি রক্ত?কিসের রক্ত? কোথায় রক্ত? কেনো রক্ত?কিভাবে রক্ত? কোন পিএইচের রক্ত?
তৌফিকা এগিয়ে এসে শার্ট দিয়েই বারি লাগালো ওকে। হাতে দুটো কিল বসিয়ে বললো,
-উদ্দীপকের গুরুত্ব অপরিসীম। এতেই চলবে? নাকি আরো বুঝাবো?
-আরে আরে,মারছিস কেনো? আপু তুই কিন্তু কথায়কথায় আমার গায়ে হাত তুলিস। আমার আর ওই বয়স আছে?
-তোর বয়সের সেকেন্ডের হিসাব আছে আমার। টপিক একদম চেইন্জ করার চেষ্টা করবি না আরাব। এই রক্ত কিসের? কি হয়েছিলো? বললি দোয়ার ওখানে যাবি,দুইদিন কোথায় ছিলি তুই? বাসায় বলেছি আবারো ট্রিপে গেছিস,আমার কথা হয়েছে তোর সাথে। কাল নির্ঘাত চোরের মতো বাসায় ঢুকেছিস? এমন কেনো করিস তুই? টেনশন হয়না আমার? তোর কিছু হয়ে গেলো…
তৌফিকা ফুপিয়ে কেদে দিলো। আরাব হেসে জরিয়ে ধরলো বোনকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
-তুই জানিস আমি এমনই।
আরো কাদছে তৌফিকা। ভাইটার এতো গা ছাড়া স্বভাব বরাবরই ওর ভয়ের কারন। আরাব তৌফিকার চুলগুলো নেড়েচেড়ে বললো,
-আপু জানিস,দোয়ার চুলগুলোও কার্লি। কিন্তু একেবারে কোমড় অবদি। আর তোর চুলগুলো দেখ? এগুলোতে গ্রোথ হরমোন দরকার। কমপ্লান খাওয়াবি। আমি রেকোমেন্ড করে দিলাম।
তৌফিকা মাথা তুলে আরেকটা ঘুষি লাগিয়ে দিলো আরাবের বুকে। ওর গাল ফুলানো দেখে আরাব হেসে দিলো। তৌফিকা চোখের পানি মুছে বললো,
-বলনা আরাব,কিসের রক্ত ওটা? তোর শার্টে রক্ত লাগলো কি করে? কার রক্ত?
-রক্ত না সিস্টার বিডি,ওটা ইন্ডিকেটর। মিথাইল রেড!
ইনোসেন্ট একটা হাসি দিলো আরাব। তৌফিকা কিছুক্ষন সরু চোখে তাকিয়ে থেকে বললো,
-ডাক্তারি পরেছি বলে কেমিস্ট্রির সাধারন জ্ঞান নেই,এমনটা কেনো ভাবছিস তুই? আমাকে শিখাবি,কোনটা ব্লাড আর কোনটা মিথাইল রেড? সত্যিটা বল আরাব,নইলে জারাকে গিয়ে বলবো তুই ডাকছিস!
-ও যায়নি এখনো?
-না।
আরাব হতাশার শ্বাস ফেলে বললো,
-এক ছেলে দোয়াকে ডিস্টার্ব করতো। ওকে একটু বোঝাতে গিয়ে…
খানিকটা চুপ থেকে তৌফিকা মুচকি হাসলো। বললো,
-একটু বোঝানো? আর তুই? তোকে আমি ভালোমতো চিনি আরাব। এখন শুধু তোর ভালোবাসার সীমাটা আন্দাজ করার চেষ্টা করছি। বেচারা টিজার!
ঘাড়টা চুলকে লাজুক হাসলো আরাব।তৌফিকা বললো,
-বেরোবি?
-হুম। বায়োমেডিতে যাবো। ওখানেও ঝামেলা লেগে আছে কিছু।
-আবার কি?
-পরে বলবো। তুই আমার একটা কাজ কর।
-কি?
-তোর জুনিয়রকে সামলা আপু! জারাকে একটু সামলা? বাবাকে বোঝা? এই একটা আউটসাইডার মেয়ের জন্য আমি তোদের ছেড়ে,রংধনু ছেড়ে যেতে চাইনা আপু। বাবার সাথে আমার আর ঝামেলা করতে ভালো লাগে না! তিক্ত আমি!
আরাব একেবারে বাচ্চাদের মতো করে বললো। তৌফিকা বেশ কিছুক্ষন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। বললো,
-দোয়ার বিষয়ে ওকে বললে হতো না?
-দুটো ঘটনা ঘটতো। এক, বাকিগুলোর মতো বিশ্বাস করতো না।দুই,বিশ্বাস করে বাবাকে সবটা জানাতো। প্রথমটা বিরক্তিকর। দ্বিতীয়টা এইমুহুর্তে চাইছি না আমি।
-তাহলে বাবাকে বলবি কবে?
বোনের সামনে থেকে সরে তোয়ালে বিছানায় ছুড়লো। ব্যালকনির দিকে এগোলো আরাব। বাগানের কাঠগোলাপ গাছটা ফুলে ভরে আছে। ইদানিং এই গাছের দিকে তাকালেও ওর দোয়ার কথা মনে পরে। মুচকি হাসিতে চেহারা আবৃত রেখে বললো,
-শুধু একবার,একটাবার দোয়াকে বলি,ওকে ভালোবাসি।প্রতিউত্তরে ওউ বলুক,আমাকে ভালোবাসে। সেই মুহুর্তটার অপেক্ষায় আছি আপু। সেই পার্ফেক্ট সময়টার অপেক্ষা। সেদিন আমি বাবা কেনো,পুরো পৃথিবীকে জানিয়ে দেবো,দোয়া আমার। আমি দোয়াকেই ভালোবাসি। সে মুহুর্ত থেকে দোয়া আমার রঙে সাজবে। কোনো আড়াল,দেয়াল থাকবে না আমাদের মাঝে। আমি থাকতে দেবো না! কোনোভাবেই না!
•
হাতের কব্জি কচলাতে কচলাতে মৃত্তিকাদের বাসা থেকে বেরোলো দোয়া। মাঝে একদিন পেরিয়ে গেলো।আগেরদিন ফেরার সময় অরুনাভ মুখার্জীকে আসতে বলেছিলো, বাজার করার নাম করে। কিন্তু সেটা মুলত ছিলো রনোকের ভয়। আজকে কি বলতো কাকাবাবুকে?একাকীই বাড়ির জন্য হাটা লাগিয়েছে। তাই ভয়টাও বেশি। রাস্তায় লোকজনের চলাচল আছে। এদিকওদিক তাকিয়ে সেদিনের আন্টিদুটোকে খুজলো দোয়া। নেই। সেদিন যারা যারা ছিলো,তাদের একজনকেও দেখলে শান্তি পেতো ও। কিন্তু কেউই নেই। পা কাপছে ওর। তবুও জোরে হাটা লাগিয়ে অনেকটা পথ চলে আসলো। সন্ধ্যা নেমেছে। এদিকটায় লোকজনের আনাগোনাও কম। যদিও রনোককে যেখানে দেখেছিলো,সে জায়গা পার করে এসেছে ও। তবুও ফাকা রাস্তা দেখেই ভয় বেড়ে গেলো ওর। ঝড়ের পুর্বের শীতলতায় গা ছমছম করছে যেনো। আচমকাই ভুতের মতো কেউ একজন পায়ের তলায় এসে পরলো ওর। লাফিয়ে চারকদম পিছিয়ে গেলো দোয়া। লোকটা হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে দোয়ার পা জরিয়ে ধরে আর্তনাত করে উঠলো,
-ক্ষমা করে দাও দোয়া। আর কোনোদিনও এই মুখ দেখাবো না তোমাকে। আর কোনোদিনও আমার মুখোমুখি হতে হবে না তোমাকে। আর কোনোদিনও আমার নামও উচ্চারন করতে হবে না তোমাকে। ক্ষমা করে দাও। প্লিজ ক্ষমা করে দাও!
পা ছাড়ানোর জন্য অস্থির হয়ে পরলো দোয়া। চেহারা দেখেনি মানুষটার। তবে গলার আওয়াজ চিনতে ভুল হলো না এর। এটা রনোক। অস্ফুটভাবে বললো,
-ক্ কি করছেন কি? ছ্ ছাড়ুন আমার পা!
-আগে তুমি বলো আমাকে ক্ষমা করেছো?
-আ্ আরে,এসব…পা ছাড়ুন!
-না বললে ছাড়বো না দোয়া। এই মুখও দেখাবো না তোমাকে।
-আ্ আচ্ছা বেশ,ছাড়ুন পা। আ্ আপনি….
দোয়ার কথা শেষ হওয়ার আগেই উঠে দাড়ালো রনোক। আবছা আলোতে ওর চেহারা দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেছে দোয়া। ওকে থ্যাংকস্ বলে এদিকওদিক তাকিয়ে একপ্রকার ছুটে পালালো রনোক। দোয়া কয়েকসেকেন্ড তব্দা মেরে দাড়িয়ে রইলো। রনোকের এই অবস্থা,নাকি ওই ভুল দেখলো,ভুল শুনলো বুঝে উঠতে পারছে না ও একেবারেই। গলির পাশের বিল্ডিংটার তিনতলার ব্যালকনি থেকে এক বারোতেরো বয়সের ছেলে চেচিয়ে বললো,
-এইযে লম্বা বিনুনিওয়ালা আপু? তোমার সামনে থাকা পায়ড়াগুলো উড়িয়ে দাওতো।বাসায় আসুক! এই ভরসন্ধ্যায় এখনো রাস্তায় বসেবসে কি খাচ্ছে কে জানে!
উপরে তাকিয়ে ছেলেটাকে দেখলো দোয়া। তারপর সামনে তাকালো। অনেকগুলো কবুতর রাস্তায় পরে থাকা ঝালমুড়ি খাচ্ছে। দোয়ার চেহারায় একরাশ আনন্দের ঝলকানি। গলার সামনে দিয়ে রাখা শান্ত বিনুনিটাকে কাধে ছুড়ে মারলো। ওড়নাটা একহাতে বাতাসে ছড়িয়ে উচ্ছলভাবে দৌড় লাগিয়ে উড়িয়ে দিলো কবুতরগুলো।
দোয়া হাসছে। উড়তে থাকা পায়ড়াগুলোর দিকে তাকিয়ে হাসছে। আর সে হাসি বিদ্ধ হচ্ছে আড়ালে থাকা একজোড়া মুদ্ধ চাওনিতে। প্রেম পায়ড়া উড়তে শুরু করেছে তার হৃদমাঝারে। বুকে হাত গুজে খানিকটা দুরেই একটু আধারে বাইকে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে রইলো আরাব। দোয়ার হাসিতে চাওনি স্থির রইলো ওর। আগেরদিন অরুনাভ মুখার্জীকে নিয়ে বাসায় ফেরা,খেয়াল করেছিলো ও দোয়ার ভয়। এই ভয় কাটানোর উদ্দেশ্যেই রনোককে ছেড়েছিলো ও। কিন্তু তা যে দোয়ার হাসিতে ওকেই প্রশান্ত করে গেলো,এমনটা একদমই ভাবেনি ও। ডানহাতে বুকের বা পাশটা চেপে ধরলো আরাব। মুচকি হেসে মৃদ্যস্বরে আওড়ালো,
-চাইলেও তুমি আমার,না চাইলেও,তুমি আমার।তুমি…আমার!আমার এ ভাবনায় কোনোদিনও তোমার জোর খাটবে না দোয়া। মনে রেখো,তোমার এই বেরঙ শহর এভাবেই নিজ হাতে রাঙিয়ে দেবো আমি।তোমার ওই নিস্প্রান চাওনিতে এভাবেই প্রানোচ্ছলতা এটে দেবো।তোমার নিঃস্ব হৃদপ্রাঙনে প্রেমের সমৃদ্ধতা এনে দেবো আমি।ওই গম্ভীর,মায়াভরা মুখটায় এভাবেই জীবনের সবটুকো সুখপ্রাপ্তির হাসি একে দেবো।হ্যাঁ,এ সবটাই হবে! আমার পাগলামীগুলোতে পরিপুর্নতা পাবে সবটা। তোমাকে মুড়িয়ে আমার এ পাগলামীগুলোর নামকরনও হয়ে গেছে!ভালোবাসা!ভালোবাসি তোমাকে।এতোটা ভালোবাসি,হয়তো তার অনুভবটুকোও ধারন করার সাহস তোমার নেই।তাইতো অস্বীকার করো,চোখ সরিয়ে নাও। তাইনা? তোমার সব কথায়,সব কাজে এ ভালোবাসা বেড়ে যাচ্ছে দোয়া। নাও আই ফিল,ও শুধু বাড়তেই জানে। ইটস্ ইউর টার্ন টু ফিল,তোমার সবটা নিয়ে,আমি তোমাকেই ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি! আমার ভালোবাসাকে একবার অনুভব করলে,তুমিও ভালোবাসবে আমাকে। ট্রাস্ট মি। তখন আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা হবে তোমার নিজের চেয়েও বেশি,তোমার কল্পনার চেয়েও বেশি!দেখে নিও!
#চলবে…
#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-১৩
মানিব্যাগে থাকা খুচরো পয়সাসমেত দশ পাঁচটাকার নোটগুলো গুনলো দোয়া। চারশ আটাশ টাকা। ঠোট কামড়ে কিছু ভেবে তাকের উপর থেকে মাটির ব্যাংকটা নামালো। সুই দিয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে কিছু টাকা বের করলো ওখান থেকে। দেয়ালে ঝুলানো ছোট আয়নায় বিনুনিবাধা চুলের কপালের দিকটা হাত দিয়ে একটু ঠিক করেই বেরিয়ে যাচ্ছিলো ঘর থেকে। সালমা বেগম মেঝেতে বসে চাল বাছছিলেন। দোয়াকে বেরোতে দেখেই বললেন,
-বেরোচ্ছিস?
-হ্যাঁ মা।
-ব্যাগ নিলি না যে!
-ব্যাগ নিয়ে কি হবে? যাবো তো বাজারে।
ভ্রুকুটি করে তাকালেন সালমা বেগম। এখন তো রোতিকে পড়াতে যাওয়ার কথা দোয়ার। বাজারে কেনো যাবে ও? মায়ের চাওনি দেখে বিষয়টা বুঝলো দোয়া। এ কয়দিন রোতিকে পড়ানোর নাম করে বেরিয়ে টিউশনি খুজেছে। কিন্তু এভাবে আর কতো? তন্নি তৃষার প্রথম সেমিস্টারের রেজাল্ট আউট হয়েছে আজ। দুজনেই ফার্স্টক্লাস পেয়েছে। তাই ওদের দুজনকে সহ বাড়ির সবাইকে মিষ্টিমুখ করাবে বলে মিষ্টি কিনতে বেরোচ্ছিলো ও। একটা ছোট শ্বাস ফেলে হাসিমুখে মায়ের কাছে এসে বসলো দোয়া। বললো,
-রোতির ওখানের টিউশনিটা আমি ছেড়ে দিয়েছি মা।
বিস্ময়ে তাকালেন সালমা বেগম। পরিবারের ভরনপোষনের উপায়,টিউশনিটা ছেড়ে দিলো দোয়া,এটা কল্পনাতেও আসে না তার। কিন্তু দোয়া যা করে ভেবেই করে,এমনটাও তার বিশ্বাস। তাই বিস্ময় কমিয়ে গলা স্বাভাবিক করে বললেন,
-কেনো মা? কোনো ঝামেলা…
-তেমন কিছুই না মা! একটু বেশিই দুরে হয়ে যায়। ওখান থেকে মৃত্তিকাদের বাসায় আসতে আসতে সময় গরিয়ে যায়। তুমি চিন্তা করো না। ধারেকাছের মধ্যে আরো টিউশনির খোজ করছি। পেয়েও যাবো।
মেয়ের গালে হাত রাখলেন সালমা বেগম। কিছু বলতেও চাইছিলেন। দোয়া সুযোগ না দিয়ে চটপট বলে দিলো,
-শোনো মা,আজকে পায়েস করবে। তন্নি,তৃষা আর দিয়ানের জন্য। আমি মিষ্টির সাথে দুধ,পোলাওয়ের চাল,চিনিও নিয়ে আসবো। আর হ্যাঁ,কাকাবাবুকে একটাও,একদমই ছুতে দেবে না। দেখি চিনিছাড়া মিষ্টিজাতীয় কিছু পাই কি না! নিয়ে আসবো তার জন্যও। তুমি এরমধ্যে চালগুলো বেছে রাখো হুম? আমি আসছি।
মৃদ্যু হাসিতে মাথা নাড়লেন সালমা বেগম। দোয়াও অসম্ভব সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। মেয়েকে নিয়ে বড্ড গর্ব হয় সালমা বেগমের। খুশির নোনাজল গাল বেরিয়ে পরার আগেই ধীরপায়ে এগোলেন ছোট ট্রাংকটার দিকে। ওখান থেকে দোয়ার বাবার ছবিটা বের করে বললেন,
-দেখেছেন? আপনার মেয়ে ঠিক আপনার মতোই হয়েছে। আপন,পর,চেনা,অচেনা,কারো প্রতি দায়িত্ব পালনে কখনোও কোনো কমতি রাখে না। আফসোস শুধু একটাই,আমি ওকে আপনার মতো আগলে রাখতে পারিনি। যেখানে আপনি ওকে কতো যত্মে মানুষ করেছেন,আপনার অবর্তমানে আমি শুধু ওকে দায়িত্বের পাহাড় বইতে দেখে যাচ্ছি। জানিনা মেয়েটা কোনোদিনও একটুখানি স্বস্তির মুখ দেখবে কি না। কেউ কোনোদিনও ওর জীবনে সুখ হয়ে নামবে কি না। আমার এখন যে এই একটাই চাওয়া। কারন যদি তা না হয়,আপনার কাছে কোনো জবাব দেওয়ার মতো মুখ যে আমার থাকবে না,থাকবে না।
•
-তারমানে আপনার রিসার্চ,থেসিসের সব ডকুমেন্টস্ সেদিন চুরি হয়ে গেছে? গুন্ডাগুলো ওই কাগজপত্রের জন্যই আপনার উপর এটাক করেছিলো স্যার?
নিরবের আতঙ্কের স্বর শুনে মুচকি হাসলো আরাব। ছেলেটা এতো আতঙ্কে থাকে কেনো সবসময়,বুঝে উঠতে পারে না ও। কফির মগে চুমুক দিয়ে টেবিলে থাকা পেপারওয়েট ঘুরাতে ঘুরাতে বললো,
-রিল্যাক্স নিরব! তোমার এই আহামরি আতঙ্কভাবের জন্যই এ কয়দিন কিছু বলিনি তোমাকে।
-কিন্তু স্যার…
-তোমাকে শান্ত হতে বললাম নিরব।
নিরব খানিকটা চুপ হলো। মাথা নিচু করে গাল ফুলিয়ে রেখেছে একপ্রকার।কফি শেষ করে আরাব হেসে বললো,
-ফুলানো গাল নিয়ে তোমায় বেশ লাগছে দেখতে নিরব।
নিরব অসহায়ভাবে তাকালো আরাবের দিকে। যেখানে পেপার্সগুলো নিয়ে আরাবের ঘুম উড়ে যাওয়ার কথা,সেখানে ও এতোটা নিশ্চিন্ত কিভাবে তা বুঝে উঠতে পারছে না নিরব। আরাব বললো,
-অনেক কনফিউসড হয়েছো বুঝেছি। নাও লিসেন,থেসিসের ওগুলো কপিপার্ট ছিলো। যাতে মেইন পয়েন্টগুলো কোড ওয়ার্ডে লেখা। মেইন পেপার্স আমার কাছেই আছে। আমি ইচ্ছে করেই মেইনগুলো ছেড়ে কপিগুলো নিয়ে সাজেক যাবো ভেবেছিলাম। জানতাম এটাক হওয়ার পসিবিলিটি আছে। সো,এতোটা প্যারা নিও না! যারা অন্যের মেধা চুরির ধান্দায় থাকে,আই ডোন্ট থিংক,ওগুলো কোনোভাবে ওদের মাথায় ধরবে।
হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো নিরব। এতোটা তীক্ষ্ম চিন্তাভাবনা হয়তো আরাবের দ্বারাই সম্ভব। বললো,
-ওদের চিনেছেন?
ঠোট কামড়ে একটা হাসি দিলো আরাব।বললো,
-এতো ভেবো না তো এসব নিয়ে! চিল!
ভাবলেশহীনভাবে হুইস্টলিং করতে করতে কিছু কাগজপত্র চোখ বুলাচ্ছিলো আরাব। অনেকটা সময় পর নিরব বললো,
-ওই কাগজগুলোর জন্য আপনাকে কাল ইনস্টিটিউট চিফ অনেক কথা শুনিয়েছেন স্যার। কিছু বললেন না যে? তাছাড়া ওগুলোর কেউ মিসইউজ করলে? ওগুলো আপনার এতোগুলো দিনের এক্সপেরিমেন্টের ফল! এমনটাও তো হতে পারে,কেউ ওগুলো নিজের নামে চালিয়ে দিলো? তখন আপনার এতো রাতজাগা শ্রমের কোনো মুল্য থাকবে না স্যার! আপনাকে তো….
-ঠিক ডক্টর রওশনের মতো! রাইট নিরব?
বিস্ফোরিত চোখে তাকালো নিরব। তারপর বিমুর্ত গলায় বললো,
-স্যার আপনি…
-ভুল বললাম তাইনা? ডক্টর রওশন তো তার কর্মফল ভোগ করেছেন। তার সাথে আমার তুলনা হয় না। এনিওয়েজ,তুমি এসো এখন। একা থাকতে চাই।
নিরব বিস্ময়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো আরাবের দিকে। গলার স্বর পুরোটাই পাল্টে গেছে ওর। দেরি না করে বেরিয়ে আসলো আরাবের কেবিন থেকে। নিরব চলে যেতেই আরাব উঠে জানালার দিকে এগোলো। বাইরের ঝকঝকে রোদ থাইগ্লাসের এপার থেকে দেখতে বেশ লাগছে। পকেটে দুহাত গুজে নিরবে ব্যস্ত শহরের রাস্তার যানজটে চোখ আটকালো চুপচাপ। এই নিরবতাই তো আজও ওর অপরাধবোধের কারন। আজও…
•
দোয়াকে নিয়ে ঘড়ির দোকান ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত তাজীন। ভালোলাগার মানুষটাকে প্রথমবার কিছু উপহার দেবে বলে ঠিক করেছে। কথাবলা শুরু নানাবাসা থাকতেই। ঢাকায় ফিরে বেশ কিছুদিন দেখাও করেছে। এতে ভালোলাগাটা গাঢ়ই হয়েছে। ভালোবাসা নামকরনে দ্বিধাবোধ হয় না বললেই চলে।তাজীনের লাজুকতার পুরোটাই লক্ষ্য করছে দোয়া। রনোকের ঝামেলা মিটে যাওয়া নিয়ে মন ভালো ছিলো বলে,ওর সাথে শপিংয়ে আসায় মানা করতে পারেনি। ভার্সিটি থেকে দুজন মিলে তাই শপিংমলে ঢুকে পরেছে। দোকানের পর দোকান ঘুরে যাচ্ছে মেয়েটা,তবুও ঠিক করতে পারছে না কোন ঘড়িটা বেশি মানাবে ওর সেই ভালোলাগার মানুষটার হাতে। দোয়া বিশেষ কিছু জিজ্ঞাসা করেনি তাকে নিয়ে। শুধু এটুকো জানে,তাজীনের পছন্দের মানুষটি একজন ডক্টর,হার্টসার্জন।ঢাকাতেই থাকেন। কেনো যেনো এর বাইরে তাজীন ওকে কিছু বলেনি। প্রথম ভালোবাসা,সবখানে ইন্সিকিওর ফিল থাকতেই পারে। তবুও না বলার কারনটা ব্যস্ততাই ধরে নিলো দোয়া। নিজে থেকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করেনি তাই। অনেকক্ষন ঘুরে ক্লান্ত হয়ে একজায়গায় দাড়িয়ে গেলো তাজীন। মুখ দিয়ে শ্বাস ছেড়ে বললো,
-এতোবড় শপিংমল,সেখানে একটাও মনের মতো ঘড়ি পেলাম না? কি আছে কি তাহলে এখানে?
দোয়া নিশব্দে হাসলো। তাজীন সরু চোখে চেয়ে থেকে বললো,
-হাসছিস যে? ভুলটা কি বললাম? এতোগুলো দোকান ঘুরলাম,একটাও ঘড়ি পেলাম মনের মতো?
দোয়া তাজীনের কাধে হাত রেখে ঠোটে মুচকি ঝুলিয়ে বললো,
-দেখো তাজ,ঘড়ি তো ঘড়িই। এখন তাতে যদি তুমি পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য খোজো,তাহলে কি করে হবে বলোতো? হাতে পরার ঘড়িতে কি এমন স্পেশালিটি খুজছো তুমি সেটাও বলতে পারছো না। তাছাড়া তুমি ভালোবেসে দিলে সেটা অবশ্যই ভ্…
-হয়েছে হয়েছে মহোদয়া,অনেক বুঝেছেন,অনেক বলেছেন। আর বুঝতেও হবেনা,বলতেও হবে না। হাটা লাগান এবার।
দোয়া খেয়াল করলো ভালোবাসা কথাটা বলাতেই তাজীনের চেহারায় আরো লাজুকতা জুড়ে বসেছে। ওরই অদ্ভুত ভালোলাগছে এতে। ফোন বাজতেই তাজীন একপলক দোয়ার দিকে তাকালো। দোয়া মুচকি হেসে বোঝালো কথা বলে এসো। তাজীন খানিকটা সরে আসতেই আশেপাশে তাকালো দোয়া। সুপারশপে এর আগে একবার এসেছিলো অরুনাভ মুখার্জীর সাথে। তার পান্জাবী কেনার জন্য। এসে ওই এক পান্জাবীর দোকান থেকেই বাড়ি ফিরেছিলো। আজকে তাজীনের সাথে এসে চারপাশে চোখ বুলানোর সুযোগ হলো ওর। উপরেনিচে আশপাশ দেখতে দেখতে হঠাৎই ওড়নায় টান পরলো ওর।
পেছন ফিরলো দোয়া। বয়সের এক বাচ্চা মেয়ে। ফর্সা গরন। পরনে বেবি পিংক কালারের হাটু অবদি স্কার্ট,মাথার বড়বড় সোজা চুলগুলো দুই ঝুটি করে রাখা। হাতে আইসক্রিম। হাটুতে হাত রেখে মেয়েটার দিকে ঝুকে দোয়া হাসিমুখে বললো,
-কিছু বলবে?
-হেই কার্লি হেয়ার,আমি না আম্মু খুজে পাচ্ছি না!
সামনে ঝুলতে থাকা বিনুনির দিকে তাকালো দোয়া। বিনুনি করা চুল কোকড়া কিনা তা এই মেয়ে কিভাবে বুঝলো বিষয়টা ওর বুঝে আসলো না। কথাটা মাথা থেকে ঝেরে ফেললো তবুও। মিষ্টিস্বরে বললো,
-ওকে,আমি খুজে দিবো তোমার আম্মুকে। তারআগে বলোতো কি নাম তোমার?
-টুইঙ্কেল!
টুইঙ্কেল নিশ্চিন্তে আইসক্রিম খেতে লাগলো। মেয়েটার কিউটনেসের সাথে নামটা একদম মানানসই ভেবে মুচকি হাসলো দোয়া। সামনেই থাকা হেল্পডেস্ক চোখে পরলো ওর। টুইঙ্কেলের দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,
-আসো আমার সাথে,তোমার আম্মুকে খুজে দেই।
সবে আইসক্রিমে কামড় দিতে যাচ্ছিলো টুইঙ্কেল। দোয়ার কথা দুসেকেন্ড আটকে থেকে আইসক্রিমে কামড় না দিয়ে বললো,
-ওকে উইশ মাম,চলো!
উইশ মাম? আবারো ঘটকা লাগলো দোয়ার। টুইঙ্কেল দোয়ার হাত ধরে নিজেই আগেআগে হেল্পডেস্কের দিকে এগিয়ে গেলো। যেনো ওই দোয়াকে পথ চেনাচ্ছে। টুইঙ্কেল ডেস্কের সামনে গিয়ে ইশারা করলো দোয়াকে। ধ্যান ভাঙলো দোয়ার। বললো,
-আব্…তোমার ভালো নাম কি?
-টুইঙ্কেল বললেই আম্মু চিনে যাবে।
কথা বাড়ালো না দোয়া। অনেকবেশি পাকা কথা বলে মেয়েটা। টুইঙ্কেলের নাম ওখানে থাকা লোকটাকে স্পিকারে এনাউন্স করে দিতে বললো। লোকটা করলোও তাই। দোয়া খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে টুইঙ্কেলকে।আর টুইঙ্কেল নির্ভাবনায় আইসক্রিম খেতে ব্যস্ত। এতোবড় শপিংমলে হারিয়ে গেছে,তবুও ওকে দেখে এতোটুকো ভয়গ্রস্ত বলে মনে হচ্ছে না। ভাবখানা এমন,যেনো ওর আপনকারো সাথেই আছে,নয়তো এভাবে হারিয়ে গিয়ে অভ্যস্ত ও। এরইমাঝে এক মেয়ে ছুটে এসে জরিয়ে ধরলো টুইঙ্কেলকে। চোখেমুখে চুমো দিয়ে অস্থিরভাবে বললো,
-কোথায় গিয়েছিলি তুই? একটুখানি শান্তভাবে থাকতে পারিস না?
-থামো আম্মু। এতো চুমো কেনো দিচ্ছো সবার সামনে? লজ্জা লাগছে আমার।
তৌফিকা ওর একটা ঝুটি ধরে টান মারলো। তারপর একবার দোয়ার দিকে তাকিয়ে মেকি হাসি দিয়ে আবারো চোখ গরম করে টুইঙ্কেলের দিকে তাকালো। প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশিই বলে ওর মেয়েটা। সব আরাবের সঙ্গের ফল। এদিকে বড়বড় চোখে তাকিয়ে দোয়া। এই বাচ্চা মেয়েটা এমন এমন কথা বলছে,বিস্ময় শুধু বাড়ছেই ওর। তৌফিকা উঠে দাড়ালো। সৌজন্যে হেসে দোয়াকে বললো,
-আপনিই এনাউন্স করিয়েছেন ওর নাম? থ্যাংকস্!
-ন্ না না,থ্যাংকস্ দেওয়ার কিছু নেই। এটা তো আমার দায়িত্ব ছিলো। ওকে দেখে রাখবেন। আসছি।
দোয়া পেছন ফিরলো তাজীনকে খুজবে বলে। তৌফিকা ওর সামনে এসে দাড়িয়ে বললো,
-তা কি করে হয়? আমার মেয়েটাকে খুজে দিলেন,এককাপ কফি তো খেতেই হবে আপনাকে আমার সাথে!
-জ্ জ্বী না,তার কোনো প্রয়োজন….
-তুমি আমার বয়সে ছোট। তাই তুমি করেই বলছি হুম? কিছু মনে করোনা। আমি তোমাকে এভাবে যেতে দিচ্ছি না। প্লিজ!
-কিন্তু…
-কোনো কিন্তু না!
-আ্ আমার বান্ধবী….
-ও!ওউ এই মলেই আছে? ঠিকাছে ওকেও ফোন করে নাও! তবুও বসতেই হবে তোমাকে আমার সাথে! চলো এবার!
ওকে টানতে টানতে পাশেরই এক কফিশপে এনে বসালো তৌফিকা। দোয়ার কোনো বারন শোনেনি। মুখ কালো করে কফিশপে বসতে বাধ্য হলো দোয়া। প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে ওর। জীবনে কোনোদিনও এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি ওকে। তৌফিকা ওকে যেখানটায় বসিয়েছে,ওখান থেকে এক্সিট পয়েন্ট পুরোটাই দেখা যায়। চুপচাপ সেদিকেই তাকিয়ে রইলো তাজীনের জন্য। কফি ওর্ডার করে তৌফিকা বললো,
-তোমার বান্ধবীকে ফোন করলে না?
ফোন নেই বলাটা সমাচীন মনে হলো না দোয়ার। মৃদ্যু হেসে বললো,
-আ্ আমি দেখলেই ডেকে নেবো। এদিকেই আসবে ও।
-ফাইন। আমার পরিচয়টা দেই।আমি তৌফিকা আইরাত। একটা প্রাইভেট মেডিকেল থেকে এমবিবিএস শেষ করেছি। ম্যারিড। বরও ডাক্তার। প্রেমের বিয়ে ইউ নো! আর এইতো,একমাত্র মেয়ে,মুশফিকা সুপ্তি। উরফ্ টুইঙ্কেল!
দোয়া টুইঙ্কেলের দিকে তাকালো। তার চেহারায় থাকা ইনোসেন্ট হাসিটা দেখে হুট করেই ওর আরাবের কথা মনে পরে গেলো। ওড়না খামচে ধরলো দোয়া। এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। তবে টুইঙ্কেলের দিকে তাকাতেই,ওর কথাতে আরাবকে মনে পরছে কেনো ওর? টুইঙ্কেল বললো,
-আমি তো আমার নাম আগেই বলেছি উইশ মাম কে!
-ওলে,কতো ভালো কাজ করেছো তুমি। ওই দুমিনিটেই উইশ মামকে একদম বিরক্ত করে ফেলেছো তাইনা?
হতবুদ্ধির মতো মা মেয়ের কথোপকথন শুনে চলেছে দোয়া। একসময় ক্ষীণকন্ঠে বললো,
-উইশ মাম?
তৌফিকা থেমে গেলো। একটু জোরালো হেসে বললো,
-ও্ ওইযে,ওর উইশ রেখেছো। ওর আম্মুকে খুজে দিয়েছো,এ্ এজন্য! এজন্যই উইশ! তা তোমার আসল নাম কি দ্…
দোয়ার চাওনি দেখে প্রশ্ন থামিয়ে দিলো তৌফিকা। নাম ধরে সম্বোধন করেই নাম কি করে জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিলো ও। আবারো মেকি হেসে বললো,
-ত্ তোমার ন্ নাম কি?
-হ্যাঁ হ্যাঁ উইশমাম! তোমার নাম বলো তো! দেখি তুমি কি বলে ডাকতে বলো আমাকে!
কল্পনায় নিজের কপাল চাপড়ালো তৌফিকা। টুইঙ্কেলের এই বাড়তি কথাটার ফল না জানি কি হয়। এরমধ্যে কফি আসলেই এককাপ দোয়ার দিকে এগিয়ে,নিজেরটাতে চুমুক দিলো তৌফিকা। টুইঙ্কেলের প্রতিত্তরে দোয়া মুচকি হেসে বললো,
-আমি তাকওয়াতুল দোয়া। তুমি দোয়াপু বলেই ডাকতে পারো।
দোয়ার মুখে দোয়াপু কথাটা শুনে হিচকি উঠে গেলো তৌফিকার। আড়চোখে তাকালো কিছুটা দুরে দাড়ানো আরাবের দিকে। আহত দৃষ্টিতে দোয়ার দিকে তাকিয়ে শপিংমলের পিলারটায় মাথা ঠেকালো আরাব। বোনকে নিয়ে শপিংয়ে এসে দোয়াকে দেখে যতটা খুশি হয়েছিলো,ওর প্লানমতো দোয়া তৌফিকার কফিআড্ডার পরিবেশ তৈরী হওয়ায় যতটা খুশি হয়েছিলো,সবটুকোতে এই ” আপু ” শব্দটা জল ঢেলে দিলো। ওর কিঞ্চিত খোলা মুখ আর হতবিহ্বল চেহারা দেখে ঠোট চেপে কোনোমতে হাসি আটকালো তৌফিকা। ভবিষ্যতে ” মামী ” ডাকবে,সেই টুইঙ্কেলকেই আজ ” আপু ” ডাক শেখাচ্ছে দোয়া। কতো সাধ করে টুইঙ্কেলকে দোয়া টু উইশ,মামী টু মাম,উইশমাম ডাক শিখিয়ে পড়িয়ে দোয়ার কাছে পাঠালো আরাব। সেখানে দোয়াপু? আপু? বেচারা আরাবের বুকের বা পাশে তো লাগারই কথা!
#চলবে…
[ ভুলত্রুটি মার্জনীয় ]