#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-১৮
-তোমার চেয়ে জারা বয়সে বড় কি করে হয় আরাব?
বাবার উচ্চস্বরে আপেলে কামড় লাগাতে গিয়ে থেমে গেলো আরাব। খাওয়া বাদ দিয়ে ওটা টি টেবিলে রেখে আধশোয়া অবস্থা থেকে সোফা থেকে উঠে দাড়ালো ও। টিশার্টটা টেনে ঠিকঠাক করে বাবার চোখের দিকে তাকালো। রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন মিসেস ওয়াহিদ। একপলক আরাবের দিকে তাকিয়ে আবার স্বামীর দিকে তাকালেন উনি। তৌফিক ওয়াহিদ রাগে কাপছেন একপ্রকার। মিসেস ওয়াহিদ বললেন,
-কি হয়েছে তৌফিকার বাবা? এতো উত্তেজিত হচ্ছেন কেনো আপনি?
-সেটা তোমার ছেলেকেই জিজ্ঞাসা করো আজ!
-কি হয়েছে বলবেন তো!
-যেখানে আজ জারার আর ওর এনগেইজমেন্টের বিষয়ে জারার বাবার সাথে কথা হলো আমার,ও ওদের বাসাভর্তি মানুষের সামনে বলে এসেছে জারা নাকি ওর বয়সে বড়!
মিসেস ওয়াহিদ স্বামীর দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষন। আরাব মুচকি হেসে মাকে ইশারায় বুঝালো,চিন্তা করো না,সব ঠিক আছে। একটা ক্ষুদ্র শ্বাস ছেড়ে ওখান থেকে চলে গেলেন মিসেস ওয়াহিদ। স্বামী কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিতে চাইলেও আরাবের উপর আস্থা আছে তার। সবদিক সামলে নেবে তার ছেলে। স্ত্রীকে চলে যেতে দেখে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তৌফিক ওয়াহিদ।কিন্তু আরাব মুখ খুললো এবার। বললো,
-কেনো বাবা? জারার আমার আগে জন্ম নেওয়া বারন? নাকি আমার ওর পরে জন্ম নেওয়া অসম্ভব?
তৌফিক ওয়াহিদ হুংকার ছেড়ে বললেন,
-এনাফ অফ ইউর ননসেন্স! যেসব ফালতু কথা তুমি জারার বার্থডে পার্টিতে বলে এসেছো,এখন আবারো বলে নিজের উপর আয়ত্ব হারাতে আমাকে বাধ্য করো না আরাব!
ট্রাউজারের পকেটে দুহাত গুজে আরো আরাম করে দাড়ালো আরাব। বললো,
-কি কি ফালতু কথা বলে এসেছি আমি বাবা?
-কি কি বলোনি তুমি? এতোটা বাজেভাবে জারাকে অপমাম করে এসে এখনো এতোটা গা ছাড়া ভাব নিয়ে আছো কিভাবে? ওর বার্থ ইয়ার নাইন্টি সিক্স হলে তুমি কি করে ওর জুনিয়র হও বলতে পারো? হোয়ারএজ,ইউ আর টুইয়েন্টি এইট!
শব্দ করে হেসে দিয়ে বাবাকে পাশ কাটিয়ে চলে আসছিলো আরাব। তৌফিক ওয়াহিদ রাগী আওয়াজেই বললেন,
-আমি তোমার সাথে কথা বলছি আরাব!
দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরাব পিছন ফিরলো। বললো,
-ইউ নো হোয়াট বাবা,তোমার এতো রাগ কেনো হচ্ছে?
-তোমার বাজে বিহেভের জন্য!
-না বাবা,একদমই না! তুমি জানো আমি ঠান্ডা মেজাজের ছেলে। রাগটা সরাসরি দেখাই না কারোর উপর। অপমানের জবাবটা সবসময় মিছরির ছুড়ির মতো ফিরিয়ে দেই। রিয়্যাক্ট করি না। এজন্য তুমিও আমাকে নিয়ে গর্ব করো! আই নো দ্যাট! আমার বিহেভে কোনোদিনও এমন রাগ হবে না তোমার!
চুপ করে রইলেন তৌফিক ওয়াহিদ। ব্যবসায়ীক ঝামেলার ভীড়ে নিজের পরিবারকে,আরাবকে মাঝেমধ্যে কেমন যেনো অচেনা লাগে। সেখানে তার মনকে,ভাবনাকে বেশ ভালোমতোই বুঝে নিয়েছে আরাব। আরাবকে সময়টা না দিলেও,ও কখনো তার কথা ভোলেনি। এতোটা জোড় খাটানোর পরও প্রাধান্য দেয় তাকে। বাবাকে চুপ থাকতে দেখে আরাব একপা এগিয়ে বললো,
-শুনতে চাও তোমার রাগ কেনো হচ্ছে বাবা? আ’ল টেল ইউ। তোমার রাগ হচ্ছে এ কারনে নয় যে আমি এসব বলেছি। এনগেইজমেন্টটা হয়নি এ কারনেও নয়। এমনকি তোমার ডিল ক্যান্সেল হয়ে গেছে বলেও তোমার রাগ হচ্ছে না বাবা! তোমার রাগের একমাত্র কারন,তুমি ঠিক সময়ে ঠিক কথাটা বলতে পারো নি! ওখানে আমি যখন জারাকে বয়সে বড় বলছিলাম,আমি যে ওর বড় নই,আমার এইজ যে টুয়েন্টি এইট,এই কথাগুলো তুমি তখন বলতে পারোনি! বলতে পারোনি আমি ভুল বলছি! কারন তুমি কনফিউসড্ ছিলে বাবা। আমার এক্সাক্টলি বয়সটা কতো,আমার বার্থ ইয়ার কতো,বয়স নিয়ে আমি মিথ্যা বললেও সত্যিটা কি,এসব তুমি মনে করে উঠতে পারছিলে না! এখন বাসায় ফেরার সময় যখন তোমার অনুভব হয়েছে, নিজের ছেলের বয়স,জন্ম তারিখ,জন্মসাল তোমার তখন মনে পরেনি,এজন্যই এতো রাগ হচ্ছে তোমার! নিজের উপর রাগ হচ্ছে তোমার! শুধুমাত্র এ কারনে! নাথিং এলস্!
হাত মুঠো করে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইলেন তৌফিক ওয়াহিদ। আরাব যা যা বললো,অস্বীকার করতে কোনোভাবেই বাধ্য করতে পারছেন উনি নিজেকে। তখন কথাগুলো বলে আরাব থেমেছিলো দুসেকেন্ড জারার সামনে। তৌফিক ওয়াহিদ বলতে চেয়েছিলো আরাব ভুল বলছে,জারা ওর বয়সে বড় না। কিন্তু শুধুমাত্র সঠিকভাবে আরাবের জন্মদিন মনে করতে পারছিলেন না বলেই বলেননি। চোখ ভরে উঠলো তার। ঠিক কোন দুনিয়ায় হারিয়েছেন নিজেকে যে যাদের জন্য সবটা,তাদেরই ভুলতে বসেছেন। বাবাকে দুর্বল হতে দেখেই আরাব গরগর করে বলতে লাগলো,
-জারাপুকে আপু বানানোর কারন এনগেইজমেন্টটা আটকানো। আমি জানতাম ওই সময় সবার মতো তুমিও অধিক শকে পাথর হয়ে যাবে,কিছুই বলবে না! এনিওয়েজ! তোমার এই ডিল ক্যান্সেল হওয়ায় কতোটাকা লস হলো বাবা? আমার বিরুদ্ধে কেসটেস ফাইল করবে না তো আবার এই জন্যে?
-কাল থেকে টেনেহিচড়ে অফিস নিয়ে যাবো তোমাকে!
চড়া গলায় বলে উঠলেন তৌফিক ওয়াহিদ। মোবাইলটা বের করে হনহনিয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলেন উনি। বাবার চলে যাওয়া দেখে ঠোট টিপে হাসলো আরাব। তাকে ওরকম তেজেই মানায়,চুপসানোতে না। তাই ইচ্ছে করেই রাগিয়ে দিলো আবারো। না জানি পরেরদিন নতুন কি কথা তুলে অফিসে নিয়ে যাওয়ার নকশা আকে লোকটা ভেবে একটু হেসে নিলো আরাব।
তারপর এলোমেলো পা ফেলে নিজের রুমে ঢুকলো। গা এলিয়ে দিলো বিছানায়। মনজুড়ে আফসোস,আজ দোয়ার দেখা মেলেনি। কপালের উপর হাত রেখে চোখ সবে বন্ধ করেছে,পরের দু সেকেন্ডেই আবারো চোখ খুলে ফেললো ও। চোখ বন্ধ করতেই ও যেনো স্পষ্ট দেখতে পেলো,মৃত্তিকাদের বাসার সিড়িতে উকিঝুকি দিচ্ছে দোয়া!
“এরকম হলে তো তোর দোয়া লেগে গেছে আরাব! ওই মেয়ে তো তোকেই খুজছিলো! তোকেই দেখতে চাচ্ছিলো! ডুবে ডুবে তোকেই ভালোবাসতে শুরু করেছে আরাব! শি ইজ ইন লাভ উইথ ইউ! তোকে ভালোবাসে!”
শুয়ে থেকেই আকাশকুসুম ভাবতে ভাবতে দুহাত ছড়িয়েছে আরাব। তৎক্ষনাৎ কিছু ভাঙার শব্দ। আচমকা সামলে পাশে তাকাতেই সব আনন্দ মুর্ছা গেলো আরাবের। বাংলার পাঁচের মতো মুখ বানিয়ে বসে রইলো দম মেরে। বেডের পাশের টেবিলে থাকা ছোট হার্ট শেইপের কাচের শো পিসটা পরে টুকরোটুকরো হয়ে গেছে। আরাবের মনে হলো,ওর ভাবা কথাগুলোর প্রতিত্তরে ওই শো পিসের প্রতিটা টুকরো যেনো চেচিয়ে বলছে,
“তোর চুরাশি বাই একশো আটাশ বিপিবিশিষ্ট হার্টেরও খুব তাড়াতাড়িই এমন দশা হতে চলেছে সাইকো সাইন্টিস্ট! বেশিই এবড়োথেবড়ো চিন্তা করতে শুরু করেছিস তুই! ও মেয়ে তোর স্বপ্নেই রয়ে যাবে!”
•
আজকে ভার্সিটিতে ক্লাস নেই। দুপুরের রান্নাটা সেরে সুইসুতোর গোছা হাতে বারান্দায় আসলো দোয়া। ওর মা গোসলে গেছে। বেরোলে,ও ঢুকবে। বারান্দা থেকে আকাশটা ঘোলাটে বলেই মনে হচ্ছে। সকাল থেকেই দিনটা মেঘলা। শীতের শুরুর এ সময়টায় অসময়ী বৃষ্টিটা বেশ ভালো একটা সুঘ্রান দিয়ে যায় চারপাশে। তবে সেটা এখন আর ওর কাছে উপভোগ্যের নেই। হাতে সেলাই তুলতে তুলতে বাসার নিচে তাকালো একবার।
সদর দরজার সামনেই এক আট নয় বছরের বাচ্চা মেয়ে দুটো রজনীগন্ধার স্টিক হাতে দাড়িয়ে। বেশভুষায় বোঝা যাচ্ছে,ফুলকুড়োনি। দোয়া রেলিংয়ের দিকে এগিয়ে দাড়ালো। মেয়েটা এক ভদ্রলোকের কাছে বেশ আকুতিমিনতি করছে। এরইমাঝে গুরুমগুরুম আওয়াজ ডেকে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। দোয়া ছুট লাগালো ছাদের দিকে। মেলে দেওয়া জামাকাপড় ঘরে আনতে গিয়ে দেখলো তন্নি তৃষাও ছাদের দিকে ছুটছে। বুঝলো, ওরা ভিজবে। মানা করলো না দোয়া। কেনো মানা করবে? বৃষ্টিবিলাস যে জীবনের আনন্দকে সতেজ করে দিয়ে যায়। সে সতেজতার স্পর্শ পাওয়ার অধিকার সবার আছে। যেমনটা ওরও ছিলো। তাই ঠোটে হাসি রেখে কড়া গলায় বললো,
-বেশিক্ষন ভিজবি না তন্নি তৃষা! জ্বর হবে! তখন ক্লাসও মিস পরবে,টিউশনিও! তাড়াতাড়ি চলে আসিস!
তৃষা দোয়ার হাত ধরে আটকে দিয়ে বায়নার স্বরে বললো,
-চলোনা দোয়াপু,আজ একসাথে ভিজি!
তন্নিও বললো,
-হ্যাঁ আপু,আসো? আজকে একটা দিন ভিজি তিনজন একসাথে? দেখবে,সব খারাপ লাগা ধুয়ে যাবে এই বৃষ্টির ফোটাগুলোর সাথে।
কয়েকমুহুর্ত স্থির রইলো দোয়া। তারপর আস্তেকরে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
-তাড়াতাড়ি আয়।
মাথা নিচু করে মন খারাপ করে পা বাড়ালো তন্নি-তৃষা। ওদেরকে সিড়ি বেয়ে আড়াল হতে দেখলো দোয়া। তাচ্ছিল্যে হেসে জামাগুলো গোছাতে গোছাতে ঘরের দিকে এগোচ্ছিলো। কিন্তু কি মনে করে আরো একবার বাড়ির নিচে উকি দিলো ও।
সেই বাচ্চা মেয়েটা বাসার সামনের স্টলেই দাড়িয়ে। ভিজছে না,তবে মনটা খারাপ করে রেখেছে একদম। আশপাশটা পরখ করার চেষ্টা করলো দোয়া। কেউই নেই তেমন ওখানে। অবস্থার কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না। তবুও মেয়েটাকে ওভাবে দেখে স্থির থাকতে পারছে না ও। তাই আর সাতপাচ না ভেবে জামাগুলো ঘরে রেখে দিলো। একটা বড় কাগজ গায়ে জরিয়ে বাসার বাইরে বেরিয়ে আসলো ও। মেয়েটার সামনে দাড়িয়ে বললো,
-কি হয়েছে তোর? বৃষ্টিতে আটকা পরেছিস নাকি?
-উহু।
-তাহলে?
-ইচ্ছা কইরাই এহানে খাড়াইছি।
-কেনো?
-যাওনের জায়গা নাই তাই।
ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো দোয়ার। কোনোমতে বললো,
-যাওয়ার জায়গা নেই মানে? ত্ তোর মা বাবা? পরিবার?
-বাপজানে কামে গেছে। সৎমা কইছে আইজকা আরো পঞ্চাশ টাকা বেশি কামাই না করলে নাকি ঘরে তুলবো না। ছোট বইনটার জামা ছিড়া গেছে। ওর একখান ভালো শীতের জামা কেনোন লাগবো। আইজকার খোটা ফুল বেচছি আগের দামেই। মায়ের ওই পঞ্চাশ টাকা বেশি বেচোনের লাগি ওই বাসা থাইকা দুইটা ফুলও চুরি করছি। হেইডার দাম হইবো বিশ টাকা। তাও কেউ নিলো না! কেউ ওহনো না কিনলে কি আমার দোষ আপা? তুমিই কও? মারে কি কমু? বইনের জামা কোত্তে কিনমু?
তব্দা মেরে দাড়িয়ে রইলো দোয়া। এটুকো বয়সে এই বাচ্চা মেয়েটাও অভাবের তাড়না থেকে ছাড় পেলো না। ছলছল চোখ,তবুও ঠোটে হাসি ফুটিয়ে মেয়েটার হাতের স্টিকটা নিয়ে বললো,
-আমি পঞ্চাশ টাকা দেবো এগুলোতে। দিবি?
হাসিমুখে মাথা নাড়লো মেয়েটা। ওই হাসি দেখেই মন ভরে গেছে দোয়ার। পরপরই দমে গেলো ও। মেয়েটা বোনের জন্য জামাও তো কিনতে চেয়েছিলো। একটু মন খারাপ করে হঠাৎই উচ্ছ্বল হয়ে উঠলো দোয়া। মেয়েটাকে বললো,
-তুই এখানেই থাক! আমি আসছি!
কাগজটা মেয়েটার হাতে গুজে ছাউনির বাইরে বেরোতে যাচ্ছিলো দোয়া। কি মনে করে থেমে গেলো ও। করুনভাবে একটু বৃষ্টির ফোটাগুলোর দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে পা রাখলো ছাউনির বাইরে। বড়বড় ফোটা গায়ে লাগতেই এক অন্যরকম শিহরন। কতো পুরোনো এক অভিজ্ঞতা! চোখ মেলে উৎফুল্লভাবে দৌড় লাগালো ও। দোয়া দৌড়াচ্ছে। বৃষ্টির মধ্যে,ঠান্ডা বাতাসের বিরুদ্ধে বেরিয়েছে ও। আবারো এতোগুলো দিন পর!
ভিজতে ভিজতে বড় বড় পা ফেলে মুখার্জীবাড়ির পেছনের পুকুরঘাটে এসে দাড়ালো দোয়া। পদ্মফুলের কমতি নেই এ পুকুরে। কেনো থাকবে? অরুনাভ মুখার্জী নিজে এ পুকুরের সবরকম যত্মের দায়িত্বে আছেন যে! পুর্বপুরুষদের প্রতিমা বিসর্জনের এই জায়গার এতোটুকো অযত্ম হতে দেননি উনি। দোয়া ঝাপ দিলো পুকুরে। শব্দ শুনে ছাদ থেকে নিচে তাকালো তন্নি তৃষা। দোয়াকে দেখে পুরোই চমকে গেছে দুজনে। সাতরে দশ বারোটা পদ্ম তুলে নিলো ওখান থেকে দোয়া। তারপর উঠে এসে ওগুলো মেয়েটার হাতে দিয়ে বললো,
-এগুলো দুশোর নিচে বেচবি না বুঝলি? একেকটা বিশ টাকা! অনেক দাম এগুলোর!
-হ্যাঁ,অনেক দাম। আমি তো বলবো,ওগুলো অমুল্য দোয়া। তোমার হাতের স্পর্শ পেয়েছে যে! তোমার ভেজা চুলের সাথে পাপড়ির ছোয়াছুয়ি হয়েছে যে! তোমার শরীরের ঘ্রান নিজেদের মাঝে লুফে নিয়েছে যে! ওরা তো অমুল্য দোয়া! অমুল্য!
মাথার ভেজা চুলগুলো উল্টে দিয়ে বৃষ্টির মাঝেই দাড়িয়ে রইলো আরাব। বাইকটা আজ দুরে পার্ক করে এসেছে ধরা পরার ভয়ে। তবে এখান থেকে ওর কাঙ্ক্ষিত দৃশ্যটা দেখতে পারছে,এটাই বা কম কিসে? বাচ্চা মেয়েটার মুখে হাসি ফুটেছে। দোয়াও হাসছে। ওর বৃষ্টিভেজা মুখশ্রীর মায়বী রুপ যেনো আর স্পষ্টতর আজ। কোকড়া চুলগুলো ভিজে খানিকটা সোজা দেখাচ্ছে। কেউকেই গাল,গলায় লেপ্টে আছে। ওর খালি পায়ের তলায় রাস্তায় জমা জলরাশিও আজ চঞ্চল। দোয়ার আনন্দে আজ সতেজ এ বৃষ্টি,সুন্দর এ পদ্ম,সুঘ্রানে ভরপুর…আরাবের চারপাশ।
#চলবে…
#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-১৯
সদর দরজায় তৌফিকাকে দেখে খানিকক্ষন তব্দা মেরে দাড়িয়ে রইলো দোয়া। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো ওর। আজকের বিকালটায় পড়ানো নেই। তাই সবে রেডি হয়ে বেরোচ্ছিলো কাচাবাজার যাবে বলে। দরজা খুলতেই দেখে তৌফিকা দাড়িয়ে। ওকে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকতে দেখে তৌফিকা ভেতরে উকিঝুকি দিয়ে বললো,
-কি ব্যাপার দোয়া? পথ আগলে দাড়ালে যে? ভেতরে আসতে বলবে না আমাকে?
হুশে ফিরলো দোয়া। তাড়াতাড়ি সরে দাড়াতে দাড়াতে বললো,
-আ্ আপু? আপনি,এ্ এখানে…
ঠোট টিপে হেসে ভেতরে ঢুকলো তৌফিকা। দোয়ার হতভম্ব চেহারাকে পুরোপুরিভাবে ইগ্নোর করে আশপাশটা দেখতে লাগলো ও। পুরোটা একপলক দেখে নিয়ে একটা জোরে শ্বাস ফেলে দোয়ার সামনে দাড়ালো। বললো,
-কোথাও যাচ্ছিলে?
-হ্ হ্যাঁ মানে না,মানে আসলে…
-রিল্যাক্স! এমন অস্বাভাবিক কেনো হচ্ছো তুমি? টুইঙ্কেলের বাবা ফেরেনি এখনো। তাই একটু হাটতে বেরিয়েছিলাম। এই পুরোনো রাজবাড়িটা বেশ লাগছিলো দেখতে। দাড়িয়ে গেলাম,ব্যস দরজা খুলেই তুমি!
ঘটনাক্রম ভেবে দোয়া খুশি হলো। বললো,
-টুইঙ্কেল কোথায়?
-আমি এখানে!
পাশে তাকালো দোয়া। তুলসিতলার স্তম্ভর গায়ে থাকা ইট গুনছে টুইঙ্কেল। ঠিক কখন ভেতরে ঢুকেছে ও চোখেই পরেনি দোয়ার। দুটো লাফ দিয়ে গায়ের জামাটার লেখাটা দেখিয়ে বললো,
-দেখেছো,উইশমাম! সুপারগার্ল! তুমি দেখোই নি কখন এসেছি আমি!
দোয়া হেসে দিলো। টুইঙ্কেল ছুটে ওর কোলে উঠলো। দোয়া ওকে চুমো দিলো। তারপর তৌফিকাকে বললো,
-আপু,আমি তো এখানেই থাকি! চলুন ঘরে চলুন!
-তা তো বুঝতেই পেরেছি। তাই বলতে পারো আরো বেশি কম্ফর্টেবল ফিল করছি। নইলে কাহিনীটা কেমন হতো বলোতো? চেনা নেই জানা নেই,ভেতরে ঢুকে পরলাম!
তৌফিকার মজার স্বরে বলা কথাটায় দোয়া হাসলো। অরুনাভ মুখার্জী চশমা চোখে দিয়ে ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বললেন,
-কে এসেছে দোয়া?
-উ্ উনি আমার নতুন স্টুডেন্টের মা কাকাবাবু। ডক্টর তৌফিকা আইরাত।
তৌফিকা বেশভুষায় বুঝলো ইনিই দোয়ার কাকাবাবু অরুনাভ মুখার্জী। আরাব বলেছিলো ওকে ওনার কথা। মিষ্টিস্বরে বললো,
-আদাব কাকাবাবু।
অরুনাভ মুখার্জী অতিসুন্দর হাসি উপহার দিলেন ওকে। টুইঙ্কেল দোয়ার কোল থেকে নেমে একদৌড়ে ওনার কাছে গিয়ে বললো,
-এইযে গোপালভাড়! কত্তো খুজেছি তোমাকে জানো? আম্মু তো বলে পাবোই না নাকি তোমাকে! এখানে থাকো তুমি?তোমার মাথার চুল কই? পেট এতো বড় কেনো? তোমার গিন্নি কোথায় গেছে? পুটিদের দেখছি না যে! ওরা সব কই?
বড়বড় চোখে অরুনাভ মুখার্জী টুইঙ্কেলের দিকে তাকিয়ে রইলো। তৌফিকা যেনো পাথর হয়ে গেছে। দোয়াও বড়বড় করে তাকিয়ে ওর দিকে। টুইঙ্কেল ওর দিক তাকিয়ে ইনোসেন্ট হাসতেই আরাবের কথা মনে পরে গেলো ওর। তৌফিকা গলা ঝেরে বললো,
-টুইঙ্কেল! উনি দাদুভাই হন তোমার!
টুইঙ্কেল গাল ফুলালো। অরুনাভ মুখার্জীর দিকে তাকিয়ে দোয়া ইতস্ততবোধ নিয়ে বললো,
-কাকাবাবু,আসলে পাশেই ওনাদের বাসা। আপু খুব ভালোবাসেন আমাকে। এখান দিয়ে যাওয়ার পথে…
দোয়াকে শেষ না করতে দিয়ে অরুনাভ মুখার্জী বললেন,
-আরে ওখানে কেনো দাড়িয়ে উনি? ঘরে নিয়ে যা তোদের! এভাবে সদর দরজার কাছে দাড় করিয়ে রেখেছিস কেনো? আমি এক্খনি বাজারে যাচ্ছি! এতোদিন পর এ চিলেকোঠায় অতিথি এলো বলে কথা! তুই আপাতত চা চুলোয় দে গিয়ে যা! আর এইযে দিদিভাই, এইটাই আমার বাসা! চুল সব শেয়ালে নিয়ে গেছে। আর পুটিদের উপরে পাবে গিয়ে দেখো!
ওনার আন্তরিকতা দেখে খুশি হয়ে গেলো তৌফিকা। হাসিমুখে এগোলো ওনার দিকে। বললো,
-ব্যস্ত হবেন না। আমি শুধু দোয়ার পরিবারের সাথে দেখা করতে এসেছি। একটুপরেই চলে যাবো!
দোয়া একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। তৌফিকা এমনভাবে বলছে যেনো যেনেবুঝে,কোনো উদ্দেশ্যে এ বাসায় এসেছে ও। তবুও স্বাভাবিকই রইলো দোয়া। অরুনাভ মুখার্জীও কিঞ্চিত হতবাক চেহারায় একবার দোয়ার দিকে তাকালেন। তারপর জোরপুর্বক হাসি দিলেন একটা। বললেন,
-তা কি করে হয়? তুমি যাও গিয়ে সবার সাথে দেখা করো,আমি এখনি চলে আসবো। যাও যাও! দোয়া? ওকে নিয়ে যা উপরে!
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে সিড়ির দিকে তৌফিকাকে ইশারা করলো দোয়া। আর কিছু বললো না তৌফিকা। অরুনাভ মুখার্জী বেরিয়ে গেলে পুরো বাড়িটায় আরেকবার চোখ বুলালো ও। তারপর দোয়ার সাথে সিড়ি দিয়ে উঠে এলো দোতালায়। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে দোয়া ডাক লাগালো,
-মা? ও মা? দিয়ান? মা?
সালমা বেগম বিছানার চাদরের ছিড়ে যাওয়া একাংশ সেলাই করছিলেন। মাথা না তুলেই বললেন,
-দিয়ান তৃষার কাছে পড়া বুঝে আসতে গেছে। পেয়েছে না বই! সারাদিন গুনগুন করে পড়তেই দেখছি ওকে! কেনো যে শুধুশুধু টাকাগুলো নষ্ট করলি কে জানে!
তৌফিকা আটকে গেলো দরজাতেই। গোটা ঘরটায় চোখ বুলালো ও। সাধারন গোছানো জীবনধারার ছোয়া কোনায় কোনায়। দোয়ার মায়ের কথাগুলোও একদম ভেতরটায় ফুটেছে ওর। দোয়া একটা শুকনো ঢোক গিলে সৌজন্যে হেসে বললো,
-আপু? আসুন না ভেতরে!
সালমা বেগম ভ্রু কুচকালেন। এ বাড়িতে আসার মতো দোয়ার চেনাজানা কোনো আপু আছে,জানা ছিলো না তার। মাথা তুলে তৌফিকাকে দেখে সুইসুতো আর ছেড়া চাদরের উপর তাড়াহুড়ো করে ওড়না দিয়ে উঠে দাড়ালেন উনি। বললেন,
-আরে। আসুন? ভেতরে…
-তুমি করেই বলুন না আন্টি! আমি তো আপনার বয়সে ছোট।
তৌফিকার কথায় দোয়ার দিকে তাকালেন সালমা বেগম।ও মাথা নেড়ে আশ্বস্ত করলো মাকে। তৌফিকা ভেতরে ঢুকলো। টুইঙ্কেল একদৌড়ে ঘরের মেঝে থেকে উপর পর্যন্ত বড় জানালাটার কাছে গিয়ে বললো,
-আম্মু! এই দেখো মামার পছন্দের বড় জানালা!
অবুঝের মতো তৌফিকার দিকে তাকিয়ে রইলো দোয়া আর সালমা বেগম। তৌফিকা তাদের চাওনি দেখে চোখ বন্ধ করে সামলালো নিজেকে। মুখে হাসি ফুটিয়ে টুইঙ্কেলের কাছে এগিয়ে বললো,
-তুমি কি একটু চুপ করে থাকবে টুইঙ্কেল? নইলে উইশমামকে কোনোদিনও একেবারে রংধনুতে নিয়ে যাবো না বলে দিলাম!
শেষ কথাটা কড়াভাবে তবে ধীর গলায় বললো তৌফিকা। কানে যায়নি টুইঙ্কেল ছাড়া কারোরই। গাল ফুলিয়ে টুইঙ্কেল দিয়ানের কাছে গিয়ে বললো,
-এই ছেলেটা! কোলে নাও আমাকে!
মা বোনের দিকে তাকালো দিয়ান। তৌফিকা দাতে দাত চেপে বললো,
-উনি তোমার মামা হয় টুইঙ্কেল!
-এতো ছোট মামা নিবো না! আমার আর্…
-আয় মা,তুই আমার কোলে আয়! তোকে আজ অনেকগুলো চকলেট কিনে দেবো বাসায় যাওয়ার সময় ঠিকাছে?
কোনোমতে টুইঙ্কেলের মুখ থেকে আরাব নামটা থামিয়ে দিলো তৌফিকা। ইনোসেন্ট হাসি দিয়ে মাথা দুলালো টুইঙ্কেল। হাফ ছাড়লো তৌফিকা। এই মেয়ে এতো বেশি দুষ্টোমি করে,প্রতিবার আরাবকে মনেমনে হাজারবার ঝারে ও। সালমা বেগম বললেন,
-দিয়ান? ওকে একটু কোলে নে? তোর কোলে যাবে বললো!
-না আন্টি,থাক। ও এমনি তখন…
-থাকবে কেনো? আসুক একটু আমার কোলে? এসো টুইঙ্কেল! মামা হই তোমার।
দিয়ান হাত বাড়ালো। টুইঙ্কেল স্পষ্টভাবে বললো,
-এতো ছোট মামার কোলে যাইনা আমি!
দিয়ান অসহায়ভাবে দোয়ার দিকে তাকালো। ওর চোখজোড়া বলছে,এ কাকে পড়াস তুই আপুনি? এ তো আমারই ক্লাস নিচ্ছে!
সালমা বেগম পরিস্থিতি সামলাতে বললো,
-দোয়া? ওর জন্য একটু চা নিয়ে আয়? দিয়ান না হয় বিস্কুট আনতে যাক?
-কাকাবাবু গেছেন দোকানে। দিয়ানকে যেতে হবে না! আপু? আপনি বসুন? আমি চা করে আনছি।
তৌফিকা বাধা দিলো না। এটুকো আতিথেয়তা ছেলেপক্ষের প্রাপ্য। যেটা বেশ ভালোমতো এন্জয় করতে চায় ও! একমাত্র ভাইয়ের বউয়ের বাড়িতে এসেছে বলে কথা! অবশ্য সেটা আলাদা কথা,সবটাই একপাক্ষিক! দোয়া বেরিয়ে গেলো। বিছানায় বসে সালমা বেগমের সাথে টুকিটাকি কথা বলতে লাগলো তৌফিকা। দিয়ান টুইঙ্কেলকে ওর পাখি ধরার ফাদ দেখাচ্ছে,বোঝানোর চেষ্টা করছে এটা দিয়ে অনেকগুলো কবুতর ধরেছে ও,পরপরই ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু কবুতর দেখাতে পারছে না বলে দিয়ানের কথা কিছুতেই মানতে চাচ্ছে না টুইঙ্কেল। চারপাশ দেখতে দেখতে তৌফিকা বললো,
-বাড়িটা অনেক সুন্দর। একদম রাজবাড়ি।
-আগে রাজবাড়িই ছিলো। এখন পুরোনো চিলেকোঠা বলে সব।
-আপনারা কতোবছর হলো এ বাসায় আছেন?
সালমা বেগম মৃদ্যু হেসে বললেন,
-প্রায় সাড়ে চার বছর।
-এর আগে কোথায় ছিলেন?
-দোয়ার বাবার বাসায়।
-তারমানে দেশের বাড়ি?
-না। দোয়ার বাবা এখনকার স্থানীয় ছিলেন। দোয়ার দাদুভাই নিজস্ব বাসা করেছিলেন এখানেই।
-ওহ্। এই রায়নগরেই?
-না। ঢাকাতে। রওশন প্লাজা।
তৌফিকা তাকিয়ে রইলো তার মুখের দিকে। ঠিক কোন রওশন প্লাজার কথা বললেন সালমা বেগম বুঝে উঠতে পারলো না ও। কিন্তু ওর চোখে ওর হসপিটালের সামনের বহুতল রাজকীয় বাসাটা ভেসে উঠলো। বললো,
-কোন রওশন প্লাজা?
-রওশন প্লাজার সামনে থাকতাম আমরা।
দরজায় তাকালো তৌফিকা। চা হাতে ঘরে ঢুকেছে দোয়া। সালমা বেগম মৃদ্যু হেসে মাথা নামিয়ে নিলেন। চা এগিয়ে দিয়ে দোয়া বললো,
-টুইঙ্কেল কোথায় আপু?
তৌফিকা বেশ বুঝেছে এ বিষয়ে কথা বলতে চাইছে না দোয়া। সৌজন্য হেসে চা নিয়ে বললো,
-দিয়ান বললো পাশের ঘরে নিয়ে গেছে। তন্নি আপু,তৃষা আপুর কাছে।
-ও। আচ্ছা আমি ওকে ডেকে দিচ্ছি।
এরমাঝেই দিয়ান টুইঙ্কেলকে নিয়ে আসলো।হাসিমুখে আরো কিছুক্ষন আড্ডা দিলো তৌফিকা। কিন্তু মনের ভেতরটায় খুতখুত করছে ওর। এ কয়দিনে এই প্রথমবার ওর মনে হলো,দোয়া হয়তো এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি ওর সাথে। হয়তো এখনো ওই স্টুডেন্টের আম্মু সম্পর্কটাতেই আটকে আছে। কিন্তু পরেরমুহুর্তে দোয়ার বাকিসব ব্যবহারগুলো মনে পরতেই নিজেকে ভুল বলে দাবি করলো ও। এ আড়ালের কারন অন্যকিছুই। অচেনাবোধ নয়!
#চলবে…