#অবেলায়_ভালোবাসি
#মারিয়া_আক্তার
#পর্ব_১৫
পড়ন্ত বেলা। সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। সবাই নিজেদের কাজকর্ম শেষ করে ঢুকার চেষ্টায় আছে। তাহা ফ্রিজ থেকে আইসক্রিমের বক্সটা বের করে সোফায় গিয়ে আরাম করে বসে। বিপরীতমুখী সোফায় বসে আছে আফসানা বেগম এবং সাথী। সাথী বসে বসে মোবাইল টিপছে আর আফসানা বেগম মটরশুঁটির খোসা ছাড়াচ্ছেন। দু’জনকে একবার অবলোকন করে তাহা একটা বিটকেলি হাসি দেয়। তাহলে কি ওনাদের জন্য কিছু অপেক্ষা করছে? তাহা সিঁড়ির দিকে একবার তাকায়। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছেন ইব্রাহীম খলিল। এবার হবে ধামাকা। উনি ধুপধাপ পা ফেলে তাহার সামনে গিয়ে দাঁড়ান। তাহা সিঙ্গেল সোফায় বসে আছে। ড্রয়িংরুমে বসার জন্য ওই সোফাটা ওনার জন্যই বরাদ্ধ থাকে। কিন্তু ওই সোফাটায় এখন তাহা বসে। তাই তিনি তাহা’র সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু তার এভাবে দাঁড়ানো দেখে তাহা’র ওপর কোনোরকম বিরূপ প্রভাব পড়লো না। সে একমনে আইসক্রিম খাচ্ছে। বিষয়টা দৃষ্টিপাত করে সাথী তাহা’র উদ্দেশ্যে বলে,
“কিরে সোফা থেকে উঠছিস না কেন? জানিস না বাবা ওই সোফাটা ছাড়া অন্যসোফায় বসে না?”
তাহা চোখ উলটিয়ে তাকায় সাথীর পানে। এমনভাবে তাকালো যেন সাথীর কথাটায় তার কিছু এসে গেল না। তাহা ডো’ন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে,
“এখানে আরো একটা সোফা আছে। উনি চাইলে সেটায় গিয়ে বসতে পারেন। আমি এখান থেকে উঠছি না। আর আমিতো এই সোফাটায় কোনো সিলমোহর দেখছি না। কোথায়তো লেখা নেই যে এই সোফাটা অত্র এলাকার চেয়ারম্যান ইব্রাহীম খলিলের। তাহলে সোফা ছেড়ে ওঠার কোনো মানেই হয় না। আর মিস সাথী আপনার যদি এতই দরদ থাকে তাহলে নিজের জায়গাটা ছেড়ে ওনাকে বসতে দেন না।”
তাহা’র কথা শুনে সাথী রেগে গিয়ে কিছু বলবে তার আগে ইব্রাহীম খলিল তাকে হাত দিয়ে আটকে দিয়ে অন্যসোফায় গিয়ে বসে পড়েন। এসবের মধ্যেই কলিংবেল বেজে ওঠে। তাহা’র মা এসে দরজা খুলেন। দরজার ওপারে কারো গলার আওয়াজ শুনে তাহা শয়তানি হাসি দেয়। আব হোগা আসলি মাজা।
“আরে আহির তুমি এসময়ে?”
সোনিয়া বেগমকে বিনয়ের সাথে সালাম দেয় আহির। আহিরকে দরজা ছেড়ে দিলে আহির ভিতরে প্রবেশ করে। তারসাথে আরো তিনজোড়া পা ভিতরে প্রবেশ করে। তারা এসে ইব্রাহিম খলিলকে সালাম দেয়। আহিরের সাথের একজনকে দেখে সাথী দাঁড়িয়ে যায়। সবাই অবাক হয়ে তাকায় তার দিকে। সাথী সকলের দিকে তাকিয়ে গিয়ে সোফার একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে। আফসানা বেগম মটরশুঁটি উঠিয়ে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে রেখে আসেন। সেই সোফাটায় আহির আর ছেলেটাকে বসতে বলা হয়। তাহা আইসক্রিম বক্স হাতে নিয়ে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ওনাদের বসতে দেওয়ার জন্য। তাহা একনজর আহির আর আবিদের দিকে তাকায়। আবিদ তাহা’র দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে সোফায় গিয়ে বসে পড়ে।
“তোমরা এখন? কোনো দরকার ছিল কি আহির? আর ওনারা কারা তোমার সঙ্গে?”
সাথীর হাত পা কাঁপতে শুরু করেছে ইতোমধ্যে। আবিদ বাড়ি আসলো কেন?
“আঙ্কেল ও হচ্ছে আবিদ। ভার্সিটিতে ও আমার দু’বছরের জুনিয়র ছিল। আর ওনারা আবিদের বাবা-মা। আসলে ওনারা আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে।”
ইব্রাহীম খলিল মাথা নেড়ে আবিদের বাবা-মায়ের উদ্দেশ্যে বলেন,
“হুম বলুন। কি দরকার ছিল?”
আবিদের বাবা মুখ খুলেন এবার। আবিদকে দেখিয়ে বলেন,
“ও হচ্ছে আমার একমাত্র ছেলে আবিদ। বড় দু’টো মেয়ে আছে। দু’জনেরই বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। এখন ছেলের বিয়ে দেব ভাবছি। ছেলের জন্য মেয়ে দেখছিলাম তখন ছেলে বললো ও আপনার মেয়েকে ভালোবাসে।”
ইব্রাহীম খলিল অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকেন আসাদ সাহেব অর্থাৎ আবিদের বাবার দিকে।
“আমি আপনার কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। আমার মেয়েকে আপনার ছেলে ভালোবাসে? মানে আমার মেয়ের জন্য বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এসেছেন?”
ইব্রাহীম খলিল কথাটা বলে তাহা’র মা’য়ের দিকে তাকান। তাহা’র মাও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। বিষয়টা উনি নিজেও ধরতে পারছেন না।
“জ্বী চেয়ারম্যান সাহেব। আমার ছেলে আর আপনার মেয়ে একজন আরেকজনকে ভালোবাসে। তাই ভাবলাব বিষয়টা নিয়ে আপনার সাথে কথা বলা দরকার। আমরা কিন্তু আপনার সাথে আত্মীয়তা করতে আগ্রহী।”
ইব্রাহীম খলিল এবার সরাসরি তাহা’র দিকে তাকান। কোনো ভনিতা ছাড়াই প্রশ্ন করেন,
“এসব কি সত্যি তাহা?”
বাবার প্রশ্নে তাহা’কে বিন্দুমাত্র ঘাবড়াতে দেখা গেল না। সে অকপটে জবাব দিল,
“আমি কিভাবে বলবো? আপনার মেয়েকেই জিজ্ঞেস করে দেখেন চেয়ারম্যান সাহেব। কি সাথী তুই কি ওনাকে ভালোবাসিস?”
ইব্রাহীম খলিল অবাকের ওপর অবাক হচ্ছেন। উনি এতক্ষণ ভেবেছিলেন আবিদের বাবা তাহা’র কথা বলছেন কিন্তু এখন আবার তাহা সাথীর কথা বলছে। তাহা’র প্রশ্ন শুনে সাথী আমতাআমতা করে। কি বলবে কিছুই মাথায় আসছে না। আবিদকে একটা সময় খুব ভালো লাগতো। ভেবেছিল ওকেই বিয়ে করবে। কিন্তু ইদানীং আবিদকে আর ভালো লাগে না। বড়লোকের একটা ছেলেকে পটাতে পেরেছে। ছেলেদের নিজস্ব ব্যবসা আছে। সেই ছেলেকে ছেড়ে আবিদকে বিয়ে করার কোনো প্রশ্নই আসে না। আবিদ পেশায় একজন সাংবাদিক। বেশিদিন হয়নি জয়েন করেছে। আবিদকে ছেড়ে দিবে ভাবছিল। এমন অনেক ছেলের সাথেই তার সম্পর্ক ছিল। নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী ব্যবহার করেছে এবং পরে ছুঁড়ে ফেলেছে। কিন্তু এখনতো ফেঁসে যাবে মনে হচ্ছে।
“আপনি কি সাথীর কথা বলছেন?”
ইব্রাহীম খলিল প্রশ্নটা করলে আসাদ সাহেব ছেলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলেন,
“হুম সাথী। আপনার মেয়ে আর আমার ছেলে। ওরা দু’জন দু’জনকে ভালোবাসে।”
ইব্রাহীম খলিল তপ্তশ্বাস ফেলেন। সাথীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়েন।
“তুমি কি এই ছেলেটাকে ভালোবাসো সাথী?”
সাথী চমকে তাকায় ইব্রাহীম খলিলের দিকে। জবাব নেই তার কাছে। থাকলেও যা আছে সে জবাব দিতে পারবে না। ইব্রাহীম খলিলের কাছে সে খুবই আদরের। তিনি সাথীকে খুব ভালো মেয়ে বলে জানেন।
_____________
“তোমাকে কি আমি চিনি? না মানে আহির বললো তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছিলে। এবার বলো কি দরকার ছিল আমার কাছে।”
তাহা আহিরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সামনে আবিদ দাঁড়িয়ে। ছেলেটাকে বেশ ভদ্র বলে মনে হচ্ছে। বেশভূষাও দেখতে বেশ ভালো। এমন একটা ছেলে সাথীর সাথে রিলেশনে আছে এটা তাহা’র কাছে কেমন যেন লাগছে।
“আসলে একটা ব্যাপার নিয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলার ছিল। আপনি সাথী নামের একটা মেয়েকে ভালোবাসেন, তাই না?”
আবিদ কিছুটা অবাক হয় তাহা’র প্রশ্নে।
“তুমি এসব কি করে জানো?”
তাহা মৃদু হাসে আবিদের প্রশ্নে।
“আসলে ওতো চেয়ারম্যানের মেয়ে। আর আমি জানি কোনো একভাবে। আচ্ছা আপনিতো ওকে বিয়ে করতে চাচ্ছেন কিন্তু ওকে এখন রাজি করাতে পারছেন না। তাই না?”
আবিদ অবাকের ওপর অবাক হচ্ছে। আহির বলেছে মেয়েটা তার পরিচিত। কিন্তু এই মেয়েটা তার ব্যক্তিগত বিষয় সম্পর্কে জানে কিভাবে?
“হুম। তার আগে তুমি বল তুমি সাথীর কি হও?”
তাহা অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে কিয়ৎক্ষণ।
“আমি কি হই সেটা না হয় দু’দিন পর জানলেন। আমি আপনাকে যা বলি তা আগে শুনেন। আচ্ছা আগে বলুন আপনি সাথীকে সত্যি সত্যি বিয়ে করতে চানতো?”
আবিদ মাথা নাড়ায়। যার অর্থ হ্যাঁ।
“তাহলে শুনুন। আগামী শনিবার আসরের ঠিক পরে আপনি আপনার বাবা-মাকে নিয়ে চেয়ারম্যানের বাড়িতে চলে যাবেন। গিয়ে বিয়ের কথা বলবেন। সঙ্গে আহির মানে আহির পাটওয়ারিকে নিতে ভুলবেন না। উনি আপনাদের নিয়ে চেয়ারম্যানের বাড়িতে চলে যাবে। আপনি সেখানে গেলেই ভাববেন আপনার বিয়ে অর্ধেক পাঁকা।”
আবিদ ভ্রুঁ যুগল কিঞ্চিৎ বাঁকায়। বিষয়টা তার ভালো করে বোধগম্য হচ্ছে না।
“তার আগে বলো তুমি কে?”
“ভাবতে পারেন আমি আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী। বাকিটা না হয় আহিরের কাছে জেনে নিবেন। আচ্ছা আপনি যাবেন তো? আপনি গেলেই আমি আপনাদের বিয়ের কথা পাঁকা করিয়ে দিতে পারবো। যাবেন?”
আবিদ মন দিয়ে কিছুক্ষণ কিছু ভাবে। তারপর মাথা নাড়িয়ে বলে,
“আচ্ছা আমি যাবো। আহির ভাইয়াকি যাবে? তুমি ওনাকে বলেছো?”
তাহা মুচকি হেসে বলে,
“আমি ওনাকে বলে দেবো। আপনি শুধু যাবেন। ব্যাস। সবকিছু আমার ওপর ছেড়ে দেন।”
এতক্ষণ পুরোনো কথাগুলো ভাবছিল তাহা। সব ভেবে তাহা সাথীর দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দেয়। আইসক্রিমের বক্সটা মায়ের হাতে দিয়ে মাকে পিছন থেকে আলগা করে ধরে তার কাঁধের ওপর থুঁতনি রেখে বিজ্ঞদের মত তাকিয়ে রয় ড্রয়িংরুমের দিকে। পরবর্তী দৃশ্য দেখার অপেক্ষায় সে।
চলবে,,,ইনশাআল্লাহ
#অবেলায়_ভালোবাসি
#মারিয়া_আক্তার
#পর্ব_১৬
“আসবো?”
দরজায় দাঁড়িয়ে চিকন দেখতে একটা ছেলে প্রশ্ন করলো। সকলে উৎসুক হয়ে সেদিকে দৃষ্টিপাত করল। ছেলেটাকে দেখে সাথীর যেন আত্মার পানি শুকিয়ে গেল। আর তাহার মুখে হাসি ফুঁটলো।
“জ্বী! ভেতরে আসুন। কাকে চাই?”
এগিয়ে গিয়ে ছেলেটাকে ভ্রুঁ উঁচিয়ে প্রশ্ন করে তাহা। ছেলেটা মুচকি হেসে বলে,
“আমি চেয়ারম্যান সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।”
তাহা ছেলেটাকে ইব্রাহীম খলিলকে ইশারা করে দেখায়। ইব্রাহীম খলিল নিজের জায়গায় বসে থেকে বলেন,
“আমার সঙ্গে কি দরকার আপনার? আর আপনিই বা কে?”
ছেলেটা ইব্রাহীম খলিলের সামনে গিয়ে একবার সকলকে পর্যবেক্ষণ করে বলে,
“আমি ঢাকা থেকে এসেছি। আমি আদনান শরীফ। আপনি নাকি আমায় ডেকেছেন? আমার সঙ্গে নাকি দেখা করতে চেয়েছেন?”
ইব্রাহীম খলিলের কপালে তিনটে চিন্তার ভাঁজ ফুঁটে ওঠে।
“আদনান নামের কাউকে আমি চিনি বলে মনে হচ্ছে না। তাহলে আমি তোমায় কিভাবে ডাকলাম? কিছু বুঝতে পারছি না আমি।”
আদনানের হাসিখুশি মুখটায় অবাকের চিহ্ন ফুঁটে ওঠে।
“সাথীতো বললো আপনিই নাকি আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন?”
“সাথী? মানে তুমি সাথীকে কি করে চেনো?”
আদনান এবার সাথীর দিকে তাকিয়ে বলে,
“সাথী তুমিতো বলেছো তোমার বাবা আমায় দেখতে চেয়েছেন। সেজন্য তুমি আমায় জরুরী তলব করলে। আমি আমার কত ইম্পোর্টেন্ট মিটিং ছেড়ে এখানে এসেছি। সে ব্যাপারে তোমার কোনো ধারণা আছে? যদি তোমার বাবাকে আমার সম্পর্কে না-ই বলো তাহলে আমায় এখানে ডাকার মানে কি?”
বেশ জোরে ধমকে বলে ওঠে আদনান। এত জোরে ধমক দেওয়ায় সাথী কেঁপে ওঠে। সে আজ ভীষণ ফাঁসান ফেঁসেছে। আদনানকে সে ভালোবাসে। মূলত আদনানের চেয়ে আদনানের টাকাকে বেশি ভালোবাসে। আদনানের বাবা খুব বড় একজন ব্যবসায়ী। আদনান তার একমাত্র ছেলে। তারমানে তাদের সমস্ত সম্পত্তিই আদনানের। সাথী ভেবেছিল আবিদকে ছেড়ে দিয়ে সুযোগ বুঝে আদনানকে বলবে ইব্রাহীম খলিলের কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসতে। কিন্তু আদনান এখানে কেন আসলো? সাথীতো আদনানকে আসতে বলেনি। তাহলে? আদনান কেন বললো সাথী তাকে আসতে বলেছে? সাথী এতদিন এসব নিয়ে বেশ ছক কষেছিল। কিন্তু আজ তার সব আশায় এভাবে জল ঢাললো কে? সাথীর মাথায় কিছুই ঢুকছে না।
“কি হলো সাথী বলো তুমি। কে এই ছেলে? তুমি ওকে কি করে চেনো?”
ইব্রাহীম খলিল রাগে ফোঁসফোঁস করছেন। মাথায় যেন দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। যা বুঝার বুঝে গেছেন তিনি। কথায় আছে না, ‘সামাজদারকে লিয়ে ইশারাই কাপিহে।’ তেমনটাই উনি খুব তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। বিষয়টা বুঝতে ওনার তেমন বেগ পেতে হলো না।
“কি হলো সাথী বলছো না কেন তুমি? বলো তোমার বাবাকে, যে আমরা দু’জন দু’জনকে ভালোবাসি।”
আদনানের কথা শুনে সাথী শুকনো ঢোক গিলে। আজ তার একূল ওকূল সব কূলোই গেল। আহির, আবিদ, এবং তার বাবা-মা যেন অবাকের চরম পর্যায়ে। তাহা আগুনে ঘি ঢালার জন্য বলে ওঠে,
“মানে? সাথীতো আবিদ ভাইয়াকে ভালোবাসে। তাহলে আপনি কেন বলছেন ও আপনাকে ভালোবাসে?”
আদনান অবাক হয়ে বলে,
“আবিদ কে? সাথী এই মেয়েটা এসব কি বলছে? তুমি আবার কাকে ভালোবাসো?
সাথী চুপ করে ভাবছে কিভাবে নিজেকে এ সংকট থেকে বাঁচানো যায়। কিন্তু হায়! মস্তিষ্ক এখন পুরো ফাঁকা। কিছুই এখন মাথায় আসছে না। এখন কাউকেই মিথ্যা প্রমাণ করতে পারবে না। ওদের কাছে সাথীর ফটো আছে। একসাথে ঘুরতে গিয়ে বিভিন্ন জায়গায় দু’জনে মিলে অনেক সেলফিও তুলেছে। সেসব ফটো দু’জনের কাছেই আছে। তাই আর সাথী বোকার মত নিজেকে প্রমাণ করতে গেল না।
“কি হলো সাথী বলছো না কেন কিছু? ওরা দু’জন কি বলছে এসব? দু’জনই বলছে, তোমরা দু’জন দু’জনকে ভালোবাসো। তুমি কি দু’জনকে একসাথে ছিট করেছো নাকি?”
সাথী মাথা তুলে একবার ইব্রাহীম খলিলের দিকে তাকায়। যদি এবারের মত বেঁচে যায়। কিন্তু তাকিয়ে কোনো লাভ হলো না। ইব্রাহীম খলিল অগ্নীশর্মা হয়ে তাকিয়ে আছেন। তাহা’র কাছে এতেও ব্যাপারটা ঠিক জমলো না। তাই আগবাড়িয়ে গিয়ে বলে,
“আমি মনে হয় বিষয়টার কিছুটা বুঝতে পেরেছি। তারমানে সাথী একসাথে দু’জনের সাথে সম্পর্কে গিয়েছে। দু’জনকেই একসাথে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ছিঃ সাথী ছিঃ। তুই এমন। দু’টো মানুষকে তুই একসাথে ঠকালি। তুই আসলে একটা ছিটার!”
আবিদের বাবা এবার উঠে দাঁড়ান। এতক্ষণ বিচক্ষণতার সাথে বিষয়টা অবলোকন করেছিলেন। এবার ইব্রাহীম খলিলের উদ্দেশ্যে তাচ্ছিল্য হেসে বলেন,
“আপনার অনেক সুনাম শুনেছিলাম চেয়ারম্যান সাহেব। আজ দেখে নিলাম। আপনার মেয়ে একটা ধোঁকাবাজ। একসাথে দু’টো ছেলেকে ঠকিয়েছে। কেমন মেয়ে জন্ম দিয়েছেন আপনি? তাহলে আপনিও কি আপনার মেয়ের মত ঠকবাজ? অবশ্য যার মেয়ে এমন সে আর কেমনই হবে?”
আচমকা খুব জোরে একটা শব্দ হলো। গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাথী। ইব্রাহীম খলিল রাগে ফোঁসফোঁস করছেন। সবাই অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ড্রয়িংরুমে। জায়গাটা আপাতত স্তব্ধ হয়ে আছে। তাহা মুখে বাঁকা হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মনে হচ্ছে জীবনে হয়তো এর চেয়ে বেশি খুশি আর কোনোদিন হয়নি। তার দু’চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে সামনে ঘটা দৃশ্যটা দেখে। এই দৃশ্যটা দেখবে বলে সে কত কাঠখড় পোড়ালো। আর অবশেষে সে সার্থক। অনেকদিনের ঘা’য়ে যেন কিছুটা মলমলাগানো হলো আজ। তাহা’র হাসিমুখ দেখে আহিরের মুখেও অজান্তে হাসি ফুঁটে উঠে। কেন যেন তাহা’র খুশিতে আহিরেরও খুশি লাগছে। সবাইকে আরো একটু চমকে দেওয়ার জন্য তাহা ইব্রাহীম খলিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
“আপনি এটা কি করলেন চেয়ারম্যান সাহেব? আপনার একমাত্র কন্যাকে আপনি সবার সামনে থাপ্পড় মারলেন? কাজটা আপনি একেবারেই ঠিক করেন নি। ভীষণ অপরাধ করে ফেলেছেন আপনি।”
“মশকরা করছো তুমি আমার সঙ্গে?”
ইব্রাহীম খলিল ফোঁসফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়েন। এতক্ষণ রেগে ছিলেন। তাহা’র কথায় যেন আগুনে ঘি পড়লো। ইব্রাহীম খলিলের কথার বিপরিতে তাহা মুখটাকে ইনোসেন্ট করে ফেলে।
“আমার কি এত সাহস? আমি আপনার সঙ্গে মশকরা করবো? আমিতো বলতে চেয়েছি, সাথী আপনার একমাত্র মেয়ে তাকে এভাবে মারাটা ঠিক হয়নি। সাথীইতো আপনার একমাত্র মেয়ে। কিরে তাইনা সাথী? তুই না চেয়ারম্যান ইব্রাহীম খলিলের একমাত্র মেয়ে?”
“কি যা তা বলছো তুমি? ও আমার মেয়ে হতে যাবে কেন?”
বাবার কথায় তাহা অবাক হওয়ার ভান করে বলে,
“ও আপনার মেয়ে নয়?”
তাহা এবার আবিদের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
“ভাইয়া, সাথী না চেয়ারম্যানের একমাত্র মেয়ে? এমনটাইতো জানেন আপনি। তাই না?”
তাহা’র প্রশ্নে আবিদ মাথা নাড়ায়।
“হ্যাঁ, সাথীতো এমনটাই বলেছে।”
তাহা বাবার দিকে ফিরে তাকায়। তারপর কাঁধদুটোকে উপরের দিকে তুলে উলটিয়ে ঘটনাটা পর্যবেক্ষণ করতে বলে।
“তারমানে তুমি সকলকে বলেছো তুমি আমার মেয়ে?”
ইব্রাহীম খলিল খুব জোড়ে ধমকে বলে উঠেন সাথীকে। সাথী মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।
“অন্যের মেয়েকে নিজের মেয়ের জায়গা দেওয়াটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। ওর জন্য বাহিরের মানুষ আমাকে ছিঃ ছিঃ করবে। এর..”
ইব্রাহীম কথা অসমাপ্ত রেখে সাথীর সামনে গিয়ে দাঁড়ান।
“তুমি আজই আমার বাড়ি থেকে চলে যাবে। তোমার ওই মদখোর বাপের কাছে চলে যাবে। আমি যেন আমার বাড়িতে তোমায় দ্বিতীয়বার না দেখি। এই আমার শেষ কথা। আর আপনারা সবাই শুনুন, সাথী, এই মেয়েটা আমার মেয়ে নয়। তাই এর কোনো পাপকর্ম আমার ওপর বর্তাবে না।”
বাবার কথায় তাহা বা হাত ঢুকিয়ে বলে,
“কেন বর্তাবে না চেয়ারম্যান সাহেব? মেয়েটা আপনার রক্ত নয় সেটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু মেয়েটাতো আপনার আদর্শেই বড় হয়েছে। সেখানে ওর পাপকর্ম, সৎকর্ম সবকিছুর দায়ভারই কিন্তু আপনার ওপর বর্তাবে।”
তাহা এবার সকলের সামনে গিয়ে বলে,
“আচ্ছা আপনারাই বলুন, আমি কি ভুল বলেছি?”
কেউ কিছু বলছে না। তারমধ্যে আবিদ তাহা’কে বলে ওঠে,
“তুমি ওনাদের কি হও?”
তাহা কিছু বলবে তার আগে আহির বলে,
“ও চেয়ারম্যানের একমাত্র মেয়ে। তাহানিয়া ফেরদৌসি।”
আবিদ অবাক হয়ে বলে,
“তাহলে সাথীর সাথে ওর সম্পর্কটা কি? আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।”
“সাথী চেয়ারম্যান সাহেবের দ্বিতীয় স্ত্রীর আগের পক্ষের মেয়ে।”
আবিদ যেন একের পর এক ঝটকা খাচ্ছে। মেয়েটা তাকে পদে পদে ঠকিয়েছে। আদনানও অবাক হয়ে আছে। মেয়েটা এতদিন বলে এসেছে সে ইব্রাহীম খলিলের একমাত্র মেয়ে। কিন্তু আজ শুনছে সে চেয়ারম্যানের মেয়েই নয়। মেয়েটা সবদিক থেকেই তাকে ঠকিয়েছে। আর ওইদিকে সাথী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সব সমীকরণ ওলোটপালট হয়ে গেছে। কি থেকে যে কি হয়ে গেল? ইব্রাহীম খলিল সকলকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
“আপনারা সবাই যার যার বাড়ি যান। এখানে আর আপনাদের কোনো কাজ নেই। আর এই কথাটা সবসময় মাথায় রাখবেন, যে এই সাথীর নামের মেয়েটা আমার রক্ত নয়। তাই ওর কোনো কাজের জন্য আমায় দোষারোপ করতে আসবেন না কেউ। মাথায় রাখবেন কথাটা।”
ধুপধাপ পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় চলে যান ইব্রাহীম খলিল। তাহা সকলের দিকে একবার তাকায়। আদনান সাথীর দিকে একবার তাকিয়ে বলে,
“আমায় তুমি ছিট করেছো সাথী। এর ফল তোমায় ভোগ করতে হবেই। আদনান শরীফকে তুমি চেনো না। আই ও’ন্ট স্পেয়ার ইউ।”
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সেও তাহা’র বাড়ি ত্যাগ করে। আহির এখনো যেন শকে আছে। সাথী মেয়েটা এমন হবে ভাবেনি সে। আরো একটু ভালো হবে ভেবেছিল। উপরে উপরে দেখতেতো ভালোই। কিন্তু মানুষের অন্তরালের খবর কি কেউ জানে? আবিদের বাবা-মা আবিদকে হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে যেতে নেন। আবিদ একদৃষ্টিতে সাথীর দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটাকে সে খুব ভালোবাসতো। এভাবে যে ঠকে যাবে ভাবতে পারেনি। সবার সাথে আহিরও বেরিয়ে যায়। পেছন ফিরে একবার তাহা’র দিকে তাকায়। তাহা’র চোখেমুখে দুষ্টু-মিষ্টি হাসি। মেয়েটাকে হাসলে সুন্দর লাগে খুব। তাহা চারদিকে চোখ বুলিয়ে সাথীর দিকে আড়চোখে তাকায়। তারপর কাছে গিয়ে বলে,
“ছিঃ সাথী ছিঃ। তুই এসব করবি আমরা তা ভাবতেও পারিনি। আমাদের পরিবারের মান-সম্মান সব তুই মাটির তলায় মিশিয়ে দিলি? তোর জন্য এখন চেয়ারম্যান ইব্রাহীম খলিলকে লোকে মন্দ বলবে। শুধুমাত্র তোর জন্য। শুনলাম তোর বাবারও নাকি অনেক কীর্তিকলাপ আছে। আর এখন তুইও। আসলে রক্তটা দেখতে হবেতো।”
“তাহা চুপ কর তুই! নিজের ঘরে যা।”
সোনিয়া বেগম ধমকে বলে উঠেন তাহা’কে। তাহা মা’কে থামিয়ে দিয়ে বলে,
“আম্মু তুমি আজ অন্তত কিছু বলো না। তুমি এখন তোমার কাজে যাও। কত কাজ পড়ে আছে তোমার। যাও।”
তাহা আবারও সাথীর কাছে গিয়ে বলে,
“কিরে তোর পাতানো বাবা কি বললো শুনতে পাসনি? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এবাড়ি থেকে বিদায় হ্। এবাড়িতে যেন তোকে আর কখনও না দেখি।”
“এসব তুই করেছিস। তাই না তাহা?”
সাথীর প্রশ্নে তাহা দু’গাল হাত দিয়ে অবাক হওয়ার ভান করে।
“তুই কিভাবে বুঝে গেলিরে? আচ্ছা যাইহোক, বুঝে যেহেতু গেছিসই সেহেতু বলে দেওয়াই ভালো। হ্যাঁ সব আমিই করেছি। আমিই তোর কৃতকর্ম সবার সামনে ফাঁস করেছি? কি করবি তুই? কিচ্ছু করতে পারবি না আমার। এবার তুই বেরিয়ে যা আমার বাড়ি থেকে। ছোটবেলা থেকে অনেক সহ্য করেছি আর নয়। এবার আপনি নিজের মদখোর বাবার কাছে চলে যান সাথী আপুউউউউউউ।”
সাথীর মুখের ওপর ফুঁ দিয়ে তাহা হাসতে হাসতে নিজের রুমে চলে যায়। এতদিনে আজ একটু হলেও শান্তি লাগছে। কিন্তু এসবের মধ্যে যে তার আরো কিছু কাজ রয়ে গেছে। সেগুলোর সমাপ্তিও তাড়াতাড়ি করে ফেলবে। কিন্তু সেসব ভেবে তাহা’র খুব ভয় হচ্ছে। খুব!
চলবে,,,ইনশাআল্লাহ