#ডাক্তার_মিস
পর্ব ২৯
হাটতে হাটতে বুশরা বললো,
– যায়গাটা তো অনেক সুন্দর। কিভাবে সন্ধান পেলেন? আগে এসেছেন? নাকি প্রথমবার?
– এত প্রশ্নের উত্তর একসাথে দিব কিভাবে? আর ম্যাডাম, আপনি ভুলে যাচ্ছেন এটা আমার এলাকা।
– আচ্ছা একটা একটা করে দিন।
বলল বুশরা। তবে বরাবরের মতই তাতে ভ্রুক্ষেপ না করে রায়হান বলল।
– সামনে তাকাও।
পথের দিকে তাকিয়ে হাটছিল বুশরা। সঙ্গীর কথামত এবার সামনে তাকালো। দৃষ্টিসীমায় ধরা পড়ল এক মনরোম সুন্দর দৃশ্য। দুই তিন মিনিটের হাটা পথে তারা এসে পড়েছে একটা নদীর তীরে। স্বচ্ছ সবুজাভ আর নিস্তরঙ্গ পানি সে নদীর। ওপাশে ধানক্ষেত। আর এপাশটা গাছগাছালিতে ছাওয়া।
অপার্থিব সুন্দর এমন প্রাকৃতিক দৃশ্য এই ছোট্ট জীবনে দেখেনি বুশরা। আবেগের আতিশয্যে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো একটাই শব্দ,
– মাশাআল্লাহ।
– এই নদীর নাম কি জানো?
– কি?
– ধলতা।
– বাহ সুন্দর নাম তো।
এটুকু বলে থামলো বুশরা। রায়হানও চুপ। হঠাতই বুঝতে পেরে বুশরা বলে উঠলো,
– এই নদীর কথাই আপনি বলেছিলেন না? তারমানে এইটা কোন রিসোর্ট না?
হো হো করে হেসে উঠলো রায়হান। যেন খুব মজার কথা শুনেছে।
– তুমি এতক্ষন রিসোর্ট ভাবছিলে? এই অজ পাড়াগ্রামে রিসোর্ট দিলে আসবে কে? আর রাস্তার অবস্থা তো দেখেছোই। চলো সামনে এগোই।
– তারমানে আপনি বলছেন এইযে এত্ত সুন্দর একটা যায়গায় এই বাড়ি, বাগান, এ সবকিছু আপনার?
– না তো। এই ছোট্ট বাড়িটা আমার বউয়ের। আব্বার অনেক জমিজমা থাকলেও এই যায়গাটুকু আমার নিজের উপার্জনে কেনা। তাই দেনমোহর হিসেবে এইটাই তোমার নামে করেছি। অন্য কারো সাথে তোমার বিয়ে হলে হয়ত অনেক বড় এমাউন্টের দেনমোহর হতো কিন্তু আমার সেভিংস বলো, সম্পত্তি বলো, এইটুকুই।
– চেয়ারম্যানসাহেব, আপনি কি জানেন যে এই যায়গাটা, বাড়িটা আমার কত্ত পছন্দ হয়েছে? ছোট হোক তবু মোদের কাঁচা ঘর খাসা।
মূলত এই বাড়িটা বুশরাকে দেওয়ার পেছনে রায়হানের আরেকটা প্রচ্ছন্ন চিন্তা ছিল। বুশরা এতিমখানায় মানুষ হয়েছে, একটু বড় হওয়ার পরে হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করেছে। নিজের বাড়ি বলতে কখনো কিছু ছিল না ওর। তাই রায়হান চেয়েছিল শশুরবাড়ি ছাড়াও বুশরার যেন নিজস্ব একটা ঠিকানা থাকে, তা যত ছোটই হোক না কেন। রায়হানের সাথে অসামঞ্জস্য সম্পর্কটা সিন্দাবাদের ভুতের মত বোঝা হয়ে উঠলে যেন শ্বাস নেওয়ার এক চিলতে উঠান থাকে বুশরার, যেটা একান্তই ওর নিজের।
নদীর পাড়ে একটা বাশের মাচাং, উপরে ছনের ছাউনি দেওয়া। এমনিতেও চার পাশে অনেক গাছ গাছালী। সব মিলিয়ে এই বেলা বারোটায় ও যায়গাটা ছায়াঘেরা। বুশরাকে নিয়ে রায়হান গিয়ে বসলো বাসের মাচাঙ্গের উপর দুইপা ঝুলিয়ে। বুশরা বসতে একটু ভয় পাচ্ছিল। তবে রায়হান হাত ধরে সাহায্য করল।
– একটা কথা বলবো?
– বলো।
– আচ্ছা এই সুন্দর বাড়িটায় কি আপনি আর কাশফিয়া থাকার কথা ছিল?
– নাহ। কাশফিয়া গ্রাম পছন্দ করে না। ওর পছন্দ ব্যাস্ত শহর, আধুনিক জীবন। এটা আমি বানিয়েছি গত বছর। একান্ত একা কিছু সময় কাটানোর জন্য। তা আর হলো কই। তাই বউ নিয়ে আসলাম।
– আপনি খুব অস্বাভাবিক আচরণ করছেন এটা কি আপনি জানেন?
– কি অস্বাভাবিক?
– স্বাভাবিক স্বামীস্ত্রীর মত।
– দেখো… তুমিই বলে দিলে যে স্বাভাবিক।
– আপনি কিন্তু এড়িয়ে যাচ্ছেন আবারও।
– আচ্ছা শোন তবে। আমি কথাকে পাগলের মত ভালবাসতাম, হয়ত এখনো বাসি। কথায় কথায় বিয়ে করার জেদটা কিন্তু ওরই ছিল। কিন্তু কি জানো তো? ও যখন আমাকে ছেড়ে চলে গেছিল তখন অনেক যুক্তি দেখিয়েছিল। এই যেমন ধরো, মেয়েদের অভিবাবক ছাড়া বিয়ে জায়েজ না, সো বিয়েই হয়নি। স্বামীস্ত্রী ছয়মাস আলাদা থাকলে অটো ডিভোর্স হয়ে যায়। আর আমরাতো ওই অর্থে আলাদাই ছিলাম। এরকম আরো অনেক যুক্তি দেখিয়েছিল। কিন্তু আমার কাছে ও ছিল আমার বিবাহিতা স্ত্রী, পাক্কা দুই বছর। আমি প্রেম ভালবাসার সম্পর্ক থেকে তো বের হতে পারতাম, কিন্তু এইয়ে পবিত্র যে বন্ধন সেটাকে অস্বীকার করতে পারতাম না।
বুশরা একমনে শুনে যাচ্ছে রায়হানের কথা। কোন প্রশ্ন করে কথায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে না। মৃদুমন্দ বাতাসে উড়ছে বুশরার চুল। রায়হান একটু থেমে আবার বলল,
– কিন্তু দেখো। এই যে দুটো মাস পেরিয়ে গেছে তোমার সাথে আমার যে পবিত্র বন্ধন সেটাকে আমি অবহেলা করে গেছি। অনেকটা জেনেশুনে। এটা আমার ত্রুটি, আমার ভুল। তাই চেষ্টা করছি শুধরে নেওয়ার।
– নিজেকে একটু সময় দিন প্লিজ, এত তাড়াহুড়ার কিছু নেই কিন্তু। আমি অপেক্ষা করবো তো।
বুশরার এলোমেলো চুলগুলো কানের কাছে গুজে দিতে দিতে রায়হান বললো, “যথেষ্ট করেছো। কথা আমার অতীত, বর্তমান এখন থেকে বুশরার”।
– আমিও কি তুমি করে বলবো?
ছলছল চোখে জিজ্ঞাসা করলো বুশরা। তাকালো রায়হানের দিকে।
– সব কি আমার কথামত হবে?
– ক্কখনো না। তা, আমরা কি আজ এখানে থাকবো?
– তুমি কি চাও?
– আমি চাই সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানেই বসে থাকতে। তারপর আপনার ইচ্ছা।
– তবে তাই হোক।
বুশরা মজার ছলেই বলে কথাটা। অত কিছু চিন্তাভাবনা করেনি। একটানা এতক্ষন বসে থাকা সম্ভব কি অসম্ভব? দুপুরের খাওয়ার ব্যাবস্থা কি হবে? গোসলের কি হবে? আবার জ্বর আসলে কি হবে? এসব কোন চিন্তাই করতে ইচ্ছা করছে না আজকে ওর। প্রতিদিন কি পার্থিব চিন্তা করতে ভালো লাগে? আজ বরং সব চিন্তাদের ছুটি।
কাল একজন পাঠক কমেন্ট করেছিলেন, জ্বরের উত্তাপে বরফ গলতে শুরু করেছে। জি, কারন যেটাই হোক সম্পর্ক সহজ হয়ে আসছে আস্তে আস্তে। রায়হান আর বুশরার গল্পটা এগিয়ে যাবে আরও অনেক অনেক দূর। বহু দিন, মাস, বছর, যুগ হাতে হাত রেখে এগিয়ে যাবে তারা। ঝড় ঝাপটা আসলে হয়ত সাময়িকভাবে ছিটকে পড়বে, বা হয়ত হাতে হাত রেখে পাড়ি দেবে বিপদসংকূল পথ। আর সেই জীবনতরঙ্গের সাক্ষী হব আমি, আপনি, আপনারা। আপনাদের গঠনমূলক মন্তব্য, সমালোচনা আর সাপোর্ট আমার একান্ত প্রয়োজন। ধন্যবাদ।
চলবে…