তবু সুর ফিরে আসে পর্ব-৩০+৩১

0
2241

#তবু_সুর_ফিরে_আসে

৩০ তম পর্ব

বুবুর যাওয়ার সময় হয়ে গেছে । কিভাবে কিভাবে এক মাস হয়ে গেল ! হেরা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। বুবুর সঙ্গে শপিং এ যাচ্ছে প্রতিদিন । বুবু রাজ্যের শপিং করছেন । হেরা কে একগাদা ড্রেস, শাড়ি কিনে দিলো। নিজের দুই ছেলের ব‌উ ছেলে নাতিদের জন্য, পরিচিত সবার জন্য গিফট কিনেছেন । নাদিয়া আর মিলার জন্য গিফট কিনে দিয়েছে। হেরা বুঝতে পারে ওকে বুবু বাকি দুজনের চেয়ে বেশি আদর করে।
আপনি আমাকে এত কিছু কিনে দিয়েছেন বুবু !
হ্যাঁ নাদিয়া, মিলা কে বলো না মন খারাপ করবে । তোমার জন্য আমার অন্য রকম অনুভুতি । তুমি আমার বাবুর ব‌উ । বাবুর জীবন টা মরুভূমি হয়ে ছিল তুমি বাবুকে আবার আনন্দে রেখেছো তাই তুমি আমার খুব প্রিয়।
হেরা বুবুকে জড়িয়ে ধরলো । একটা কথা বলব বুবু মায়ের আদর খুব একটা পাইনি আপনাকে দেখলে মনে হয় মা বুঝি এমনই হয় !
আমার কি মনে হয় জানো হেরা তুমি অনেক ভালো মা হবে ! আমার নিশালকে অনেক আদরে রাখবে ।
নিশালকে আদর না করে উপায় আছে ও কত ভালো আর একটা মাত্র ছেলে আমাদের।
খুব শান্তি পেলাম হেরা তুমি ওকে তোমাদের ছেলে বলেছো শুনে !
কি বলব বুবু ও যদি আমাকে মামনির জায়গা দিতে পারে আমি ওকে ছেলে ভাববো না কেন ?
খুব ভালো থাকো তোমরা , হেরার হাত ধরে জান্নাত আজমী বললেন।
তোমাকে একটা কথা বলতে চাইছি হেরা, বাবু তোমাকে বলবে না হয়তো কখনো ।
কি বুবু ?
বাবু সারাজীবন বাচ্চা খুব পছন্দ করতো । ওর অনেক গুলো ছেলে মেয়ে থাকবে বলতো। গীতির ইউটেরাসে ফেব্রয়েড মানে টিউমার ছিল তাই নিশালের পর কনসিভ হয়নি আরো নানান সমস্যা ছিল ওর। তুমি বাবুর সেই ইচ্ছেটা পূরন করো ভাই ! ও মুখ ফুটে বলবে না নিশাল বড় হয়ে গেছে দেখে । কিন্তু তুমি ওকে বলবে তুমি মা হতে চাও। তোমার অধিকার আছে মা হ‌ওয়ার ।
হেরা মাথা নিচু করে আছে বুবু আপনার ভাইয়ের ইচ্ছে ই আমার ইচ্ছে। উনি যা বলবেন তাই হবে আমার জীবনে।
তুমি ইচ্ছে প্রকাশ করবে তুমি কিছু চাইলে বাবু না করবে না । কথা দাও আমাকে বাবুকে বলবে ?
ঠিক আছে বলব কিন্তু যেদিন এ প্রসঙ্গ উঠবে সেদিন তার আগে না। হেরা হেসে দিল।
ঠিক আছে।
আমি খুব তাড়াতাড়ি শুনতে চাই তুমি মা হতে যাচ্ছো ! খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি চলে আসব এখানে তোমার যত্ন করার জন্য । একজন কেউ তো তোমার পাশে থাকতে হবে নাকি ? আমার ভাই তার অফিস, ফ্যাক্টরি নিয়ে পরে থাকবে ব‌উ এর যত্ন রাখতে পারবে না !
তাড়াতাড়ি কিনা জানিনা বুবু ! আমি আবারও বলছি আপনার ভাইয়ের ইচ্ছে আমার ইচ্ছে।
ঠিক আছে ঠিক আছে আমি বাবুকেও বলে যাব !

জান্নাত আজমী এই প্রসঙ্গ আবার ন‌ওশাদের সামনে তুললেন। নিশাল চলে গেছে বাসাটা খালি হয়ে গেছে !
হ্যাঁ বুবু ও থাকলে খুব যে দৌড় ঝাঁপ করে তা না কিন্তু বাসাটা ভরা ভরা লাগে!
বাসার আসল প্রাণ তো বাচ্চা রা ।
হ্যাঁ।
বাবু তুই তো সব সময় বলতি তোর তিন চার টা বাচ্চাকাচ্চা থাকবে । হেরার বয়স কম তোর মাসাআল্লাহ সম্পদের কমতি নেই নিয়ে নে ভাই আরো দুইটা বাচ্চা ।
বুবু যেভাবে বলছো মনে হচ্ছে দোকানে গিয়ে অর্ডার করলেই বাচ্চা চলে আসবে ! ন‌ওশাদ হাসছে !
আমি কি সেই কথা বলছি ? তুই আগে বল কি চিন্তা করেছিস ?
কিছু চিন্তা করিনি ! বুবু , বুবু প্লিজ আমাকে একটু সময় দাও চিন্তা করি আগে । ন‌ওশাদ মনে মনে ভাবছে , তোমাকে কিভাবে বলি বুবু আমার আর হেরার মাঝে সেই দূরত্ব‌ই এখনো অতিক্রম হয়নি। আমরা দুজন আগে নিজেদের বোঝাপড়া টা তৈরি করি তারপর দেখা যাবে ! আর হেরা কি সন্তানের জন্য তৈরি । ওর বয়স কত কম পড়াশোনা শেষ করবে । ওসব পরে দেখা যাবে ।
বুবু আর দুলাভাই চলে গেলেন ফ্লোরিডাতে । যাওয়ার দিন ন‌ওশাদের হাত ধরে খুব কাঁদলেন ! পরের বার এসে আব্বাকে দেখব কিনা জানিনা আমিই বা আর আসতে পারবো কিনা জানিনা বাবু । তুই ইউএসএ গেলে আমাকে দেখতে আসবি কিন্তু !
আসব বুবু তুমি এভাবে কাঁদলে আব্বা তো ভেঙে পড়বে আরও। তখন সামলাবো কিভাবে?
তুই হেরাকে সময় দিবি বাচ্চা বয়সী মেয়ে সারাদিন একা থাকে বাসায় তুই তো তোর কাজ নিয়েই ব্যস্ত !
ঠিক আছে সময় দিব ।
বুবু চোখের পানি ফেলতে ফেলতে এয়ার পোর্টে র জন্য গাড়িতে উঠে গেল। ন‌ওশাদের কাজ থাকায় এয়ার পোর্টে যেতে পারেনি ছোট ভাই ফারহান আর শোয়েব গিয়ে বিদায় দিয়ে এলো ।

ইদানিং ন‌ওশাদ যখন রাতে বাসায় ফিরে হেরা অপেক্ষা করতে করতে কোন কোন দিন ঘুমিয়ে যায় । হেরার অপেক্ষা করতে খারাপ লাগে না কারণ মানুষটা এসেই ওর সঙ্গে এত সুন্দর করে হেসে হেসে মজার মজার কথা বলবে ওর মন ভালো হয়ে যায়। এখন রাত প্রায় এগারোটা ন‌ওশাদ আসেনি । সন্ধ্যায় একবার ফোন দিয়ে বলেছে ফিরতে দেরি হবে। হেরা যেন ডিনার করে ফেলে। হেরা তবুও না খেয়ে বসে আছে। হেরার ভালো লাগে না মানুষটা একা একা বসে খায় এটা দেখতে।
ন‌ওশাদ যখন এসেছে অপেক্ষা করতে করতে হেরা ঘুমিয়ে গেছে। ন‌ওশাদ বাসায় ফিরেই আনারের মা কে প্রশ্ন করলো, খেয়েছে তোমার আম্মা ?
না স্যার আপনার জন্য ব‌ইসা আছে ।
কি বলো আমার তো দাওয়াত ছিল খেয়ে এসেছি !
আম্মা তো অসুখ ভালা হ‌ওয়ার পর খাইতেই পারে না । দুপুরেও কোন দিন খায় কোন দিন খায় না । ঐ সকালে ই আপনার সঙ্গে যা খায় সেইটাই।
এই কথাটা তুমি আগে বলবে না ? আচ্ছা ঠিক আছে তুমি খাবার নিয়ে উপরে এসো।
ন‌ওশাদ নিজের রুমে ঢুকে দেখে হেরা কমফোর্টারের নিচে শুয়ে দিব্যি ঘুমাচ্ছে । ন‌ওশাদ ফ্রেশ হয়ে হেরার কাছে বসে ওর গাল, নাক ধরে টানাটানি করতেই হেরা চোখ খুলে হাতটা ধরলো ন‌ওশাদের ।
কি হচ্ছে ?
না খেয়ে কেন ঘুমাচ্ছো ?
শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে গেছি । চলেন খেয়ে আসি ।
সরি হেরা আমার দাওয়াত ছিল খেয়ে এসেছি । আসলে অনেক দিনের অভ্যাস বাসায় না জানানো ভুলে গেছি যে আমার জন্য এখন কেউ না খেয়ে অপেক্ষা করে। সরি ।
আচ্ছা কোন ব্যাপার না । আমার খেতে খুব একটা ইচ্ছেও করছে না ।
আমি শুনেছি হেরা তুমি ঠিক ভাবে খাচ্ছো না ইদানিং।
সেরকম কিছু না একটু খাওয়ার পর আর খেতে ইচ্ছে করে না।
কেন?
জানি না।
আনারের মা হেরার খাবার নিয়ে ঢুকলো !
এত খাবার কে খাবে তোমার স্যার খেয়ে এসেছে আনারের মা?
রেখে যাও তো আনারের মা ! আনারের মা ট্রে রেখে চলে গেল ‌।
আমি একটা অপরাধ করেছি খেয়ে আসব তোমাকে জানাইনি এখন সেই অপরাধের জরিমানা দিব ঠিক আছে।
কিভাবে?
তোমাকে নিজের হাতে খাইয়ে দেই হেরা ।
হেরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে প্লিজ লাগবে না আমি খেয়ে নিচ্ছি !
উহু আমি দিব বলেই ন‌ওশাদ হেরার জন্য প্লেটে ভাত মেখে মুখের সামনে ধরলো ।
হেরা ভাত মুখে নেয়ার আগেই ওর চোখ ভিজে উঠলো ।
কি হলো ?
কিছু না এত সুখ‌ও পাওনা ছিল আমার ?
ছিল হেরা ! জানো একটা সময় আমি রাত করে বাসায় ফিরতাম ক্লান্তিতে খাওয়ার ইচ্ছে থাকতো না গীতি আমাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতো। কিন্তু আমার কখনো সুযোগ হলো না ওকে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়ার । খুব ইচ্ছে করতো ওকে মুখে তুলে খাইয়ে দেই কিন্তু ওর কারো হাতে খাওয়া পছন্দ ছিল না। ও আবার যেটা পছন্দ না সেটা করতে চাইতো না কখনো। কাউকে খুশি করার জন্যে ও না ।
আপনার খুব ইচ্ছে করতো তাই না উনাকে খাইয়ে দিতে ?
খুব !
আর কি কি করার ইচ্ছে ছিল করতে পারেননি আপনারা ?
অনেক ইচ্ছে ই ছিল । আমার খুব ইচ্ছে ছিল গীতিকে পাহাড়ের কাছ ঘেঁষা কোন একটা বাড়ি করে দিব তারপর হঠাৎ হঠাৎ ছুটি কাটাতে যাব ! সন্ধ্যায় দুজন বারান্দায় বসে নিরবতার শব্দ শুনব আকাশে থাকবে পূর্ণিমার চাঁদ।
আপনার তো অনেক টাকা আপনি কেন ইচ্ছে গুলো অপূর্ণ রাখলেন ?
ন‌ওশাদ হেরার দিকে তাকিয়ে হেসে দিল, বোকা মেয়ে টাকা দিয়ে কি সব সময় ইচ্ছে পূরণ করা যায় ?
সময়ের দরকার হয়। জীবন আমাকে সেই সময়টুকু দেয়নি হেরা। একটা সময় আমি টাকার পিছনে ছুটেছি তারপর টাকা এলো কিন্তু সময়টা আমার কাছে ধরা দিলো না ! দেশ বিদেশে কত জায়গায় ঘুরলাম কিন্তু আমার ছোট্ট সেই স্বপ্ন টা পূরন করতে পারলাম না।
হেরা খাওয়া শেষ করলো , আপনার খুব কষ্ট হয় তাই না এসব ভেবে ?
এখন আর কষ্ট ছাড়া অন্য সবকিছুই হয় । হাহাকার বোধ হয় । তারপর নিজেকে বুঝাই।
আসলে কি জানো ছোট ছোট অপূর্ণতার নাম‌ই জীবন। কিছু আফসোস না থাকলে জীবন একেবারে পানসে ! সব কিছু ঠিক‌ই ছিল গীতিই ফাঁকি টা দিলো আমাকে অসময়ে চলে গিয়ে।
হেরার খুব বলতে ইচ্ছে করছে আমার সঙ্গে কি সেই ইচ্ছা গুলো পূরণ করা যায় না ? অনেক কথার মত‌ই এই কথা টা বলতে পারেনি হেরা।
ন‌ওশাদ হাত ধুয়ে এসে চুপচাপ বসে রইল কিছুক্ষণ তারপর হেরার কাছে এসে বসলো।
তোমাকে বলতে খেয়াল ই ছিল না । তুমি আগামীকাল এলিন,নাহিনদের ভার্সিটিতে ভর্তি হতে যাচ্ছো সকাল সকাল উঠে রেডি হয়ে যেও।
আগামীকাল ? হেরা লাফিয়ে উঠলো!
কোন এডমিশন টেস্ট দিতে হবে না আমাকে ?
না । ভার্সিটির রেজিস্ট্রার আমার বন্ধু মানুষ বিশেষ বিবেচনায় তুমি কোন টেস্ট ছাড়াই ভর্তি হচ্ছো !
সাবজেক্ট ?
তোমার ইচ্ছা !
আপনি সাজেশন দিন প্লীজ !
তোমার মার্কশিট দেখে মনে হলো ইংলিশ, ইকোনমিক্স নিয়ে পড়লে তুমি ভালো করবে ! ল ‘ ও পড়তে পারো ইচ্ছে করলে !
আপনি যেটা বলবেন ?
তাহলে ইংলিশ ই পড়ো তোমার আগের সাবজেক্ট ।
ঠিক আছে। আমার খুব এক্সাইটেড লাগছে আবার ভয়ও লাগছে !
ভয় লাগছে কেন?
যদি আবার হারিয়ে যাই !
গাড়ি দিয়ে যাবে গাড়ি দিয়ে আসবে বাসায় । তোমার কাছে মোবাইল আছে হারাবে কিভাবে তাহলে ? বোকা মেয়ে। এসো আমার কাছে ! হেরা ন‌ওশাদের কাছ ঘেঁষে এলো।
একটা কথা বলব হেরা তুমি ভার্সিটিতে কাউকে বলো না তুমি বিবাহিতা ?
কেন ? বললে কি সমস্যা?
সমস্যা নেই দেখি ছেলেরা আমার সুন্দরী ব‌উ এর প্রেমে পড়ে কিনা!
এসব কি বলেন আপনি উল্টো পাল্টা কথা ! আমি ছেলেদের সঙ্গে কেন কথা বলতে যাব !
বারে এক সঙ্গে পড়বে বন্ধু থাকবে না তোমার ।
না আমি ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করি না ! আর আপনি জানেন আমি ছেলেদের কতটা এড়িয়ে চলি ! কোন একটা ছেলের আশেপাশে থাকলেই আমার অস্বস্তি হতে থাকে।
আমার পাশে থাকলেও ?
আপনি আর অন্য ছেলে কি এক হলেন ?
আচ্ছা ঠিক আছে কালকে ভর্তি হয়ে মাইকিং করে এসো, তুমি বিবাহিতা হে পুরুষ জাতি আমার কাছ থেকে দূরে থাকুন। ন‌ওশাদ হাসছে !
আপনি তো আমাকে টেনশনে ফেলে দিলেন ! এত সব ছেলেদের সঙ্গে কিভাবে পড়াশোনা করবো ?
চুপ কি সব ফালতু বিষয় নিয়ে টেনশন করো তুমি হেরা। তুমি তোমার মত পড়াশোনা করবে। আর দশটা মেয়ের মত বন্ধু বানাবে । যত খুশি বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে হৈচৈ করো দিন শেষে আমার বুকে ফিরে আসলেই হবে । আমি এ ঘরে একা থাকতে পারবোনা কখনো।
একা থাকতে কে বলেছে আপনাকে। কালকে আপনি ভর্তি করাতে নিয়ে যাবেন ?
সরি আমি যেতে পারবো না শোয়েব তোমাকে নিয়ে যাবে আর এলিন নাহিন থাকবে তো তোমার সঙ্গে। তোমার দুই গাইড !
হেরা মনে মনে কালকের দিনটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো।

পরদিন সকালে হেরা শোয়েব, এলিন, নাহিনের সঙ্গে ভার্সিটিতে গেল ভর্তি হ‌ওয়ার জন্য। রেজিস্টার ন‌ওশাদের বন্ধু হ‌ওয়ায় কোন ঝামেলাই হলো না হেরার ভর্তি হতে ।
আমি ভেবেছিলাম ভর্তি পরীক্ষা দিতে হবে ?
শোয়েব বলল, আপনার জন্য ওসব লাগবে না কারণ আপনি ন‌ওশাদ আজমীর ওয়াইফ । এই ভার্সিটির ভিসি থেকে রেজিস্ট্রার মামার খুব ঘনিষ্ঠ । তাই আপনার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা ।
আপনি এলিন দের সঙ্গে ঘুরে দেখেন ভার্সিটি টা এদিকের কাজ আমি সামলাচ্ছি ।
না ঘুরতে গেলে হারিয়ে যাব আবার !
আপনি খুব ভয় পান তাই না ? শোয়েব হাসছে!
আপনি তো আমার সব কিছু জানেন না তাই হাসছেন ।
না জানালে জানব কিভাবে মামি ?
সব কিছু সবার জানতে হয় না । হেরা ন‌ওশাদকে ফোন দেয়ার জন্য উঠে গেল ।
শোয়েব তাকিয়ে আছে হেরার দিকে । মনে মনে বলল, অদ্ভুত একটা মেয়ে !
এলিন নাহিন হেরা কে নিয়ে ঘুরে ঘুরে ভার্সিটি দেখালো। ওদের বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। ওরা দুজন কোন কারণ ছাড়াই ওকে বৌমনি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিল না। হেরা একটু অবাক হলো কিন্তু চুপ করে রইলো।
মাহাদি নামের নাহিনের ফ্রেন্ড হেরা কে দেখে নাহিন কে বলল, কে রে এই সুন্দরী ?
আমাদের আত্মীয় ।
এখানে পড়বে ?
হুম ।
রূপের আগুনে পাগল করে দিবে তো সবাই কে ।
সাবধানে বন্ধু আগুনে হাত পুড়ে গেলে আবার বলো না তোমাকে সতর্ক করিনি ।‌
হাত পুড়বে কেন মাহাদির হাত লোহার পুড়ে না কখনো ।
এমন‌ও তো হতে পারে হাত পুড়ে ছাই হয়ে গেল তুই টের‌ই পেলি না !
দেখা যাক । তুই একটু হেল্প কর নাহিন ,তাহলে হয়তো পুড়লো না কিছুই ।
নাহিন মাহাদির কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, প্রেমে পড়া বারন , কারনে অকারণ …. মনে রাখিস এই গানটা । আর কিছু বললাম না।
আজ‌ হেরার জীবনে একটা বিশেষ দিন । একদিন সে ভেবেছিল পড়াশোনা আর কোন দিন হবে না ।‌ আজ সে দারুন সুন্দর একটা ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে এসেছে। অনেক টাকা লেগেছে। কিন্তু তার কাছে যা অনেক টাকা তার স্বামীর কাছে সেটা কিছুই না। ইস নানা ভাই যদি জানতো খুব খুশি হতো ।
হেরা সন্ধ্যা থেকে অপেক্ষা করছে ন‌ওশাদের । মানুষ টার জন্য তার জীবনটা বদলে গেছে । এত সুন্দর একটা জীবন তার অপেক্ষায় ছিল সে জানতো না ।
গোল্ড ফিশ গুলোর কাছে বসে যখন ভাবছে নিজের জীবনটা নিয়ে তখন আনারের মা ছুটে এলো কাছে , আম্মা আপনার মোবাইল ক‌ই ?
উপরে চার্জে দেয়া কেন?
স্যার ফোন দিসিলো আপনারে ক‌ইছে রেডি হয়ে থাকতে বাইরে নিয়া যাইবো !
কি ? হেরা উঠে দাঁড়ালোকোথায় নিয়ে যাবে ?
আমি কেমনে বলবো যাইব ক‌ই ,মনে হয় কোন পার্টিতে তাড়াতাড়ি কাপড় পড়েন সুন্দর ক‌ইরা সাজেন দৌড় দেন।
হেরা চিন্তায় পরে গেল । সে ছুটে গেল এলিনদের কাছে ‌। এসব বিষয়ে দুই বোন খুব ওস্তাদ ।
বৌমনি তুমি আজকেই প্রথম ভাইয়ার সঙ্গে বাহিরে যাবে তোমাকে দারুন করে সাজিয়ে দিব আমরা দেখো !
তাড়াতাড়ি করো উনি চলে আসবেন !
কালো একটা মসলিনের শাড়ি বের করলো নাহিন হেরার আলমারি থেকে এটা পরো বৌমনি ব্ল্যাক ইজ অলওয়েজ এলিগ্যান্ট ।
দুই বোন মিলে হেরা কে খুব সাধারণ ভাবেই সাজালো । চোখে একটু কাজল , আইলাইনার, একটু নুড লিপস্টিক এক সাইডে একটা খোঁপা এতেই ন‌ওশাদ হেরার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ !
গাড়িতে উঠে হেরা জিজ্ঞেস করলো কোথায় যাব আমরা ?
তোমার আজ একটা বিশেষ দিন তুমি ভার্সিটিতে ভর্তি হলে আমাকে খাওয়াবে না হেরা ?
এই কথা আগে বলবেন না আমি তো ফ্রী ছিলাম বিকেল থেকে আপনার পছন্দের সব রান্না করে রাখতাম!
বোকা মেয়ে আমরা রেস্টুরেন্টে খাব ! আমাকে রেস্টুরেন্টে ট্রিট দিবে তুমি।
আমার কাছে টাকা নেই বিল আপনাকেই দিতে হবে , হেরা হেসে বলল।
উহু হুঁ তুমি দিবে !
হেরা ন‌ওশাদের কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, সত্যি আমার কাছে টাকা নেই।
ন‌ওশাদ হাসছে দেখা যাক কি হয় হেরা।
ওরা ন‌ওশাদের পছন্দের একটা রুফ টপ রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলো। হেরা উপর থেকে মুগ্ধ হয়ে দেখছে চারপাশ টা । ছাদে রেস্টুরেন্ট বৃষ্টি হলে কি হবে ?
ভিজে ভিজে খাব !
মোটেও সেরকম কিছু হবে না !
একটা জিনিস খেয়াল করেছো আমরা ঢুকতেই অনেকেই তাকাচ্ছিলো ! সবাই তোমাকে দেখছে !
কেন ?
দেখতে এত সুন্দর মেয়েটা এই বুড়োর সঙ্গে এসেছে কেন তাই ভাবছে !
ছিঃ এসব কি বলছেন আপনি !
ন‌ওশাদ হাসছে ।
নিজেকে বুড়ো ভাবতে আপনার খুব ভালো লাগে তাই না?
আমি তো বুড়োই !
এসব কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। রেস্টুরেন্টটা খুব সুন্দর।‌
এটা নিশালের খুব পছন্দের রেস্টুরেন্ট ।
তাহলে ও আসলে আসব আমরা।
ঠিক আছে।
আজ কেমন লাগলো তোমার ভার্সিটি ?
ভালো ।
ক্লাস কবে থেকে ?
আগামী মাস থেকে ।
গুড ।
বিল দেয়ার সময় ন‌ওশাদ একটা কার্ড হেরার হাতে দিয়ে বলল, এটা দাও ।‌ এবং যত্ন করে রাখো নিজের কাছে এটা তোমার ।
হেরা ন‌ওশাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
অবাক হ‌ওয়ার কিছু নেই তুমি বাসার বাহিরে যাবে টাকা লাগবে না সে জন্য ।
সেই রাতের পর ঠিক তিন দিন পর হেরা তার জীবনের সবচেয়ে বড় চমকটা পেলো ন‌ওশাদের কাছ থেকে ।
ন‌ওশাদের ফ্যাশন আউটলেটের উদ্বোধন এর দিন হেরা ন‌ওশাদের সঙ্গে পাঁচ তারকা হোটেলে এসে যখন ঢুকছে ওর খুব ভয় ভয় লাগছে। সুমনা কে দেখে যদিও সে একটু ভরসা পেলো।
তোমার জন্য দারুন একটা খবর আছে হেরা, সুমনা বলল।
কি খবর ভাবি ?
আমি তো বলবো না অপেক্ষা করো ! হেরা তুমি কি জানো এখানে উপস্থিত অনেক মেয়ে তোমাকে হিংসা করছে ! তাদের মধ্যে অনেক মিডিয়ার সেলিব্রিটি , বিজনেস উইমেন এমনকি বিজনেস ম্যানের স্ত্রী আছে !
কেন ভাবি আমি কি করলাম?
কারণ তুমি ন‌ওশাদের স্ত্রী । এখানে অনেকের কাছেই ন‌ওশাদ অনেক আকাঙ্ক্ষিত পুরুষ। অনেকেই চাইতো ন‌ওশাদ একটা সন্ধ্যা তার সঙ্গে কাটাক। কেউ কেউ তো চাইতো ন‌ওশাদ একটা রাত তার সঙ্গে কাটাতো যদি ফিসফিস করে সুমনা বলল।
কি বলছেন ভাবী !
হুম তুমি কল্পনাও করতে পারবে না সুন্দর মুখের আড়ালে মানুষের চরিত্র টা কত কালো।
মানুষের চরিত্রের আন্দাজ হয়তো করতে পারবো না কিন্তু আপনার বন্ধু অন্য রকম মানুষ সেটা আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি।
ঠিক বলেছো ন‌ওশাদ অন্য ভুবনের মানুষ।
অবশ্য পুরুষরা কেউ কেউ আরো বেশি হিংসা করছে ন‌ওশাদকে কারণ এত বছর একা থাকার পর তোমার মত কাউকে ন‌ওশাদ পেয়েছে।
কি যে বলেন ভাবি এখানে সব মেয়েরা কত স্মার্ট দেখতেও কত সুন্দর আমি ওদের মত এত যোগ্যতা সম্পন্ন ন‌ই।
সবাই ঘষে মেজে মেকআপ সুন্দরী তোমার মত ন্যাচারাল সুন্দরী না। দেখো তুমি হালকা মিষ্টি কালারের একটা জামদানী পড়েছে হালকা একটা গয়না পড়েছো এতেই তোমার দিক থেকে চোখ সরানো যাচ্ছে না ! আর যোগ্যতা র কথা যদি বলো এক এক মানুষের এক একদিকে যোগ্যতা তোমার গুনে তুমি অনন্য।
ন‌ওশাদ যখন হেরাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল সবার কাছে হেরার ভেতরে ভালোলাগা র অন্য এক অনুভূতি তৈরি হচ্ছিল এই ভালোলাগাকে কোন বিশেষনে ফেলতে পারবে না সে !
একটু পরেই মঞ্চে উঠে ন‌ওশাদ মিডিয়া , দেশের অনেক গন্যমান্য ব্যক্তিদের সামনে ঘোষণা করলো তার আউটলেট ‘হেরা’ র নাম। দেশীয় তৈরি পোশাকের নতুন ব্র্যান্ড হিসেবে ‘ হেরা ‘ কে পরিচয় করিয়ে দিল সবার সামনে।
হল ভর্তি অতিথিরা যখন করতালি দিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে
নাম শুনে হেরা তখন এত চমকে গেল সবসময় যা হয় চোখটা তাকে খুব যন্ত্রণা দেয় ওর চোখ ভিজে গেল সঙ্গে সঙ্গে । সে ঘুনাক্ষরেও কল্পনা করেনি এরকম কিছু একটা ঘটতে পারে তার জীবনে ! ন‌ওশাদের প্রতি ওর অনুভূতি টা সে প্রকাশ করতে পারে না কখনো কিন্তু তার এই মুহূর্তে খুব ইচ্ছে করছে মানুষ টাকে ছুঁয়ে দেখতে । এত উজাড় করে সন্মান সত্যি কেউ তাকে দিতে পারে ভাবনার সীমান্তে দূর দূর পর্যন্ত ছিল না কখনো তা। ন‌ওশাদ মঞ্চ থেকে দেখছে হেরা কে । হেরা চোখের পানি মোছায় ব্যস্ত তখন। কিছু পাওয়া অনেক প্রত্যাশা কে ছাড়িয়ে যায় । কিছু মানুষ এত ভালোবাসা নিয়ে আসে পৃথিবীতে ! হেরা মুগ্ধ হয়ে ন‌ওশাদকে দেখে তার মত নগন্য একটা মেয়ে কে কোথা থেকে নিয়ে এসে কোথায় জায়গা দিলেন উনি ! এত এত ভালোবাসা, সন্মানের যোগ্য সত্যি ই কি সে ছিল কখনো ! হেরা তাকিয়ে দেখছে শুধু ন‌ওশাদকে শত লোকের ভীড়ের মাঝে তার চোখ শুধু ন‌ওশাদের দিকেই যাচ্ছে । মনে মনে বলছে হেরা আপনি কি একটু আসবেন আমার কাছে, খুব ইচ্ছে করছে আপনাকে একটু ছুঁয়ে দেখি !

( চলবে )

#তবু_সুর_ফিরে_আসে

৩১ পর্ব

আপনি আমাকে এভাবে চমকে দিবেন আমি স্বপ্নেও ভাবিনি বাসায় ফেরার সময় গাড়িতে বসে ফিসফিস করে বললো হেরা !
ন‌ওশাদ‌ও ফিসফিস করে বলল,আপনি কি কি স্বপ্নে ভাবেন সেটা আগে শুনি মিসেস ন‌ওশাদ ?
এত সুন্দর স্বপ্ন তো কখনো দেখিনি আগে ।
তোমার স্বপ্ন গুলো শুনব এক সময়, সময় করে হেরা।‌ আজকের প্রোগ্রাম তোমার কেমন লাগলো ?
খুব ভালো এক কথায় চমৎকার! হেরা লজ্জা পেয়ে বলল, আমাকে মিসেস ন‌ওশাদ যখন বলছিলো অনেকে আমার খুব লজ্জা লেগেছে আবার ভালোও লেগেছে !
তাই ?
হ্যাঁ।
হেরা উত্তেজিত হয়ে বলল,আমি টিভিতে অভিনয় করে কয়েকজন নায়িকা, মডেল কেও দেখলাম ! এত মেকআপ লাগিয়েছে মুখে, টিভিতে তো এমন লাগে না দেখতে ?
ন‌ওশাদ হেসে দিল মেকআপ তোলার পর ওরা হয়তো নিজেরাই নিজেদের চিনে না বুঝলে ।
সত্যি ?
আমারো তাই ধারণা !
রুমে ঢুকে হেরা যখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কানের দুল খুলছে ন‌ওশাদ রিমোট দিয়ে টিভির চ্যানেল চেন্জ করছিল । হঠাৎ হেরা বলল, একটা কথা বলব ?
হুম , টিভির দিকে তাকিয়েই বলল ন‌ওশাদ ।
আজকের অনুষ্ঠানে আসা অনেক সেলিব্রিটি, আর আপনার পরিচিত মেয়েরা অনেকেই আপনার জন্য অনেক পাগল ছিল নাকি ?
ন‌ওশাদ মনোযোগ দিয়ে তাকালো হেরার দিকে কি বললে ?
অনেক মেয়ে আপনাকে পছন্দ করতো ? আপনার সঙ্গ চায়?
কে বলল তোমাকে এই কথা ? ন‌ওশাদ উঠে কাছে এসে দাঁড়ালো !
সুমনা ভাবি ।
আমি তো জানি না এই খবর !ইসস আগে জানলে কত মজা নিতে পারতাম ! ন‌ওশাদ হাসতে হাসতে বলল।
আপনি জীবনেও মজা নিতেন না । আপনি সেরকম মানুষ ই না ।
আমি কেমন মানুষ হেরা ?
আপনি এমন একটা মানুষ যে সব কিছু বদলে দিতে পারে । সব কিছুর উপর যার খুব নিয়ন্ত্রণ । নিজের আবেগ, নিজের অনুভূতি , রাগ সব কিছু ।
তুমি এতটা মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করেছো আমাকে ?
আমার সব মনোযোগ ই তো এখন শুধু আপনি আর আপনি হেরা বিড়বিড় করে বলল !
বুঝলাম না কি বলছো ?
বললাম আপনি ছাড়া আর কারো কথা তো ভাবি না দেখিও না তাই বললাম।
খুব ভালো শুনে ভালো লাগছে।
আপনার ব্যস্ততা কি আজকের পর কমে গেছে ?
অনেকটাই, কেন ?
ভুলে গেলেন ছেলের পেরেন্টস ডে যেতে হবে এই সপ্তাহে ?
ও তাইতো ।
সপ্তাহের শেষে একদিন ভোরে নিশালের ক্যাডেট কলেজে গিয়ে হাজির হলো দুজন। নিশাল ওদের পেয়ে খুব খুশি ! বন্ধুদের সবার সঙ্গে তার মামনির পরিচয় করিয়ে দিল । বন্ধুদের মায়েদের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিল । তার প্রিয় সোহাম ভাইয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল । হেরার এখন আর লজ্জা লাগে না নিশালের মামনির পরিচয়ে পরিচিত হতে । সে অনেকটাই সাবলীল এই পরিচয়টাতে । নিশাল ওর মোবাইল দিয়ে হেরাকে ফেসবুকে একাউন্ট খুলে দিল। ন‌ওশাদের সঙ্গে, তার নিজের সঙ্গে এড করে দিলো । তিন জন অনেক ছবি তুলল।
চমৎকার একটা দিন কাটালো হেরা । ন‌ওশাদ ওদের দুজনের ছুটোছুটি দেখলো সারাক্ষণ । ফিরে আসার সময় নিশালের জন্য হেরার খুব মন খারাপ হয়ে গেল ! চুপ করে আছে গাড়িতে বসে, ন‌ওশাদ প্রশ্ন করলো , শরীর খারাপ লাগছে?
না নিশালের জন্য মন খারাপ লাগছে । আবার অপেক্ষা করতে হবে ওকে আরেক টা পেরেন্টস ডে র জন্য ।
ওর অভ্যাস হয়ে গেছে হেরা , সামনে পরীক্ষা এখন ওর মনোযোগ শুধু পড়াশোনা তে । ও তো খুব স্টুডিয়াস মন খারাপ করে বসে থাকার সময় কোথায়?
আমার খুব খারাপ লাগছে।
পরীক্ষা শেষ হলে অনেক দিনের জন্য আসবে তখন মজা করো তোমরা । তুমি তোমার ভার্সিটিতে নিয়ে যেও ওকে।
ঠিক আছে।
ঢাকা ফিরে পরদিন থেকেই ন‌ওশাদ তার ছুটির প্রস্তুতি নিচ্ছিল । যে কয়দিন ছুটিতে থাকবে কোন কিছুর জন্য যেন অফিস তাকে বিরক্ত না করে সেই জন্য সে তার কাজ গুছিয়ে দিচ্ছে। সাতদিন ছুটিতে থাকবে হেরাকে নিয়ে , এই সাতদিন শুধু তার আর হেরার । এই ছুটির প্রস্তুতি অবশ্য প্রায় এক মাস আগে থেকেই নিয়েছে সে । যেখানে যাচ্ছে সেই জায়গাটা মনের মত করে সাজাতেই সময় লেগেছে অনেক দিন।
একদিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে ন‌ওশাদ হেরাকে বলল জিনিস পত্র গুছিয়ে নাও আগামীকাল আমরা যাচ্ছি ।
কোথায় ?
কোন এক বৃন্দাবনে !
হেরা উৎসুক হয়ে জানতে চাইলৈ,এটা কি ঢাকার ভেতরে নাকি বাহিরে ?
বাহিরে অনেক দূরে ।
আমাদের সঙ্গে সুমনা ভাবিরা যাবে ?
না শুধু রাঁধা আর কৃষ্ণ !
রাঁধা কৃষ্ণ কে ?
কেউ না তুমি নিজের দরকারি জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও। ন‌ওশাদ বুঝলো হেরার সঙ্গে দুষ্টামি করে লাভ নেই ও এসব দুষ্টামি বুঝে না হাসলো মনে মনে।
পরদিন দুপুরের আগেই ন‌ওশাদ হেরাকে নিয়ে সিলেট কম্পানিগন্জের উদ্দেশ্যে র‌ওনা হয়ে গেল । ওখানে সীমান্তে র কাছাকাছি একটা পাহাড়ি জায়গায় তার একটা বিশাল প্রোপার্টি আছে। অনেক বছর আগে সে এই জায়গাটা এক লন্ডন প্রবাসী ব্যক্তির কাছ থেকে কিনেছিল সে। খুব ইচ্ছে ছিল এখানে ছোট একটি বাড়ি করে গীতিকে উপহার দিবে । কাজ যখন চলছিল তখন‌ই গীতি চলে যায় । গীতিকে সেই উপহার দিয়ে সারপ্রাইজ দেয়ার সুযোগ টা তার হয়নি তার আগেই গীতি সব দেয়া নেয়ার উর্দ্ধে চলে গেছে।
তারপর অনেকদিন এই জায়গাটা নিয়ে সে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিল ।‌‌কিন্ত সবকিছুর পর সে একজন বিজনেস ম্যান এত সুন্দর জায়গা সে বেশিদিন অবহেলায় ফেলে রাখেনি । এখানে দারুন একটা রিসোর্ট বানাচ্ছে । টুরিস্ট স্পট হিসেবে এই জায়গার কদর বাড়ছে দেখেই সে জায়গাটা ফেলে রাখতে পারছে না। রিসোর্ট চালু হতে দেরি আছে। কিন্তু তার সেই ছোট্ট ঘর যা অনেক আগেই তৈরি করেছিল সেটা আবার সাজিয়েছে সে । হেরা কে নিয়ে এখানেই আসছে সে । গত এক মাস ঢাকায় বসে এই কটেজের সাজানোর কাজ সে করিয়েছে সাইট ম্যানেজার তৌহিদ এর দলবল দিয়ে । যেখান থেকে বসে এক সঙ্গে মেঘালয় পাহাড়ের সঙ্গে মেঘের মিলন দেখা যায় আবার ধলাই নদীর পাথর আর নীল জলের ছুটে চলা দেখা যায়।
ওরা পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেল ! হেরা গাড়িতে ওর ঘাড়ে মাথা রেখে ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিলো।
মাঝখানে একবার গাড়ি থামিয়ে ব্রেক নিলো যখন হেরার খারাপ লাগছিল বমি করলো । ন‌ওশাদ মনে মনে ভাবছে অসুস্থ হয়ে যাবে না তো আবার ! তাহলে তো পুরো পরিকল্পনা টাই মাটি হবে।
গাড়িটা যখন রিসোর্টে এসে পৌঁছালো সাইট ম্যানেজার তৌহিদ আরো লোকজন নিয়ে ওদের রিসিভ করার জন্য দাঁড়িয়ে আছে।
গাড়ি থেকে নেমেই ন‌ওশাদ কিছুটা বিরক্ত হলো ,কি ব্যাপার তৌহিদ এত লোকজন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেন ?
স্যার আপনি যা যা বলেছেন সব সেভাবেই করা আছে ।
বুঝেছি কিন্তু আমি যতদিন এখানে থাকব এই কটেজের দিকে লোকজন যেন প্রয়োজনের বাহিরে না দেখি ! আমি ছুটি কাটাতে এসেছি কোন অফিসিয়াল কথা হবে না। তোমরা তোমাদের মত কাজ করো ।
জ্বি স্যার। স্যার এই হলো সেলিম এই কটেজের দেখাশোনা র দ্বায়িত্বে ও আপনার যেকোন ধরনের আদেশের অপেক্ষায় আছে ।
ঠিক আছে । কিন্তু ডিনারের পর কাউকে লাগবে না এখানে ।
জ্বি স্যার।
হেরা গাড়ি থেকে নেমেই পাথর বিছানো পথটার ধরে উপরে উঠে গেল । ওদের কটেজ টা উপরে ।
হেরা হাত ইশারায় ডাকছে ন‌ওশাদকে ।
ঠিক আছে তোমরা যাও! আরেকটা গাড়ি আসার কথা ঐটা চলে এসেছে ?
জ্বি স্যার অনেক আগেই । আপনার জিনিস পত্র সব কটেজে রেখেছি স্যার।
যাও এখন তোমরা তোমাদের কাজে।
ন‌ওশাদ হেরার দিকে এগিয়ে গেল।
হেরা মুগ্ধ হয়ে বলল,দেখুন কি সুন্দর জায়গাটা ! কি সুন্দর দোলনা আছে ! এত সুন্দর সুন্দর ফুল , কি সুন্দর সবুজ ঘাস ! খালি পায়ে হাঁটতেই ভালো লাগছে!
তোমার পছন্দ হয়েছে হেরা?
খুব এত সুন্দর পাহাড় আর নদীটাও দূর থেকে দেখতে ভালো লাগছে ! ইস আর একটু আগে এলে কাছে যাওয়া যেত !
ন‌ওশাদ বলল,কালকে যেও আমরা আছি অন্তত সাত দিন।
ঠিক আছে কালকে যাব। নিয়ে যাবেন তো ?
অবশ্যই তুমি যা চাইবে সব হবে !
সেলিম একটু দূরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে । কিছু বলবে তুমি?
স্যার চা দিব ?
না সন্ধ্যার পর পরই ডিনার দিয়ে দাও ম্যাডাম সারাদিন কিছু খায়নি।
জ্বি স্যার।
হেরা চলো ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি হলে কি হবে এখানে যথেষ্ট ঠান্ডা। চলো ঘরের ভেতরে যাই।
সন্ধ্যা হ‌ওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিনার করে ওরা যখন কটেজের সামনে এসে দাঁড়ালো খোলা জায়গায়। ক্যাম্প ফায়ার জ্বালিয়ে রেখেছে সেলিম কে দিয়ে ন‌ওশাদ। পাশে বেতের বড় দুটো সোফার চেয়ার।
কটেজ টার চারপাশে ছোট ছোট গার্ডেন লাইট দিয়ে আলোকিত করা। বারান্দায় হালকা নীল লাইট জ্বলছে। একটা অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশ চারদিকে। সেলিম লোকটা ডেকোরেশনের সব গুলো লাইট জ্বালিয়ে রেখেছে , ঘরের‌ ভেতরেও একটা আলো ছায়ায় খেলা ।
ন‌ওশাদ সাদা একটা পলো গেঞ্জি আর নেভী ব্লু ট্রাওজার পরে আগুনের পাশে এসে বসলো। হেরা দুজনের জন্য কফির মগ হাতে নিয়ে যখন ন‌ওশাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো । ন‌ওশাদ হাত বাড়িয়ে দিল কফির মগটা এক হাতে নিয়ে অন্য হাতে হেরার হাত ধরলো ।
এখানে বসো দেখবে খুব ভালো লাগবে ! আপনি হাফ হাতা গেঞ্জি পরে আছেন ঠান্ডা লাগছে না ?
না ।
এত সুন্দর জায়গায় আপনার একটা বাড়ি আছে আপনার কি মজা যখন তখন আসতে পারেন এখানে।
আপনার না, বলো আমাদের ! আমার বাড়ি কি তোমার বাড়ি নয় হেরা ?
হেরা হাসলো হুঁ।
যখন তখন আসতে পারিনা হেরা । বিশ্বাস করবে ছয় বছর পর আসলাম।
কেন?
ইচ্ছে করেনি পরে বলবো কেন । তুমি এখানে একটুক্ষন একা বসতে পারবে না আমি দুই তিনটা ফোন করে আসব ভেতর থেকে? মোবাইল চার্জ এ দেয়া। এশার নামাজ টা পড়ে আব্বার একটা খোঁজ নিয়ে আসি।
ঠিক আছে।
ন‌ওশাদ ঘরের ভেতরে চলে গেল।
হেরা আগুন টার পাশে বসে র‌ইলো। ওর হঠাৎ মনে পড়লো বাড়িতে এরকম শীতের সন্ধ্যায় আগুন জ্বালিয়ে সব মামাতো ভাই বোন রা চারপাশে বসে আড্ডা দিতো। কত হাসাহাসি গল্প করতো। এখন সে কোথায় আর ওরা কোথায় ? যত‌ই সবকিছু , সবাই কে ভুলে থাকার চেষ্টা সে করুক মনে পড়ে যায় । নিজের অতীত ভালো হোক আর খারাপ কে কবে ভুলতে পেরেছে ? দীর্ঘ শ্বাস ফেলল সে।
ন‌ওশাদ কখন এসে পিছনে দাঁড়িয়েছে সে টের‌ই পায়নি।
এত মনোযোগ দিয়ে কি চিন্তা করছিলে হেরা ? ন‌ওশাদ ওর কাঁধে হাত রাখলো।
সেরকম কিছু না ! আগুন টা দেখে বাড়ির কথা মনে পড়ে গেল। কথা হয়েছে বাসায় আব্বা ভালো আছেন ?
হ্যাঁ ভালো আছে। তোমার কথা জিজ্ঞাসা করছে আনারের মায়ের কাছে।
আমি বলে এসেছি তো আব্বাকে ।
মনে থাকে কিছু আব্বার ভুলে গেছে।
আরো লোকজন সঙ্গে থাকলে ভালো লাগতো তাই না ? গল্প করা যেতো হেরা বলল।
না সব জায়গায় আড্ডা ভালো লাগে না । এখানে তোমার সঙ্গে শুধুই তোমার সঙ্গে সময় কাটাতে এসেছি হেরা। চারপাশ টা কত নিরব কিন্তু শোনো বাতাসে কি অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে ! শুনতে কত শান্তি লাগে দেখো।
হুম।
হেরা আমরা যে ঘরটাতে থাকব ওখানে বিছানার উপর একটা বক্স রেখে এসেছি কষ্ট করে নিয়ে আসবে প্লিজ !
নিয়ে আসছি দাঁড়ান বলে হেরা কটেজের ভেতরে ঢুকে গেল।
ন‌ওশাদ এই জায়গাটা গীতির জন্য কিনেছিল। কিন্তু গীতিকে নিয়ে আসা হলো না ! ভাগ্যের কি অদ্ভুত খেলা আজ হেরাকে নিয়ে এখানে এসেছে সে। এখানের কোথাও গীতির কোন ছোঁয়া নেই তবুও মনে হচ্ছে কোন এক অন্তরাল থেকে দৃষ্টি মেলে দেখছে তাকে গীতি। হয়তো খুব করে চেয়েছিল গীতিকে এখানে তাই মনে পড়ছে খুব গীতিকে। আচ্ছা একদিন কি সে ভুলে যাবে গীতিকে ? পারবে ?
ভুলে যাওয়া যায় । এটা বললে মিথ্যে বলা হয়। শুধু কিভাবে মনে রাখছে সে ,সেটাই আসল ! গীতি কে ভোলা যায় না ।
তবে এই কয় মাসে সে বুঝেছে মৃত গীতিকে জীবন্ত ভেবে, নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে নতুন করে কারো সঙ্গে জীবন শুরু করা যায় না।
ন‌ওশাদ যখন এসব ভাবছে হেরা তাদের বেড রুমের বিছানার উপর গিয়ে দেখে বিছানায় খুব সুন্দর একটা বক্স রাখা তার উপর ন‌ওশাদের একটা চিরকুট লেখা ,
” হেরা এটা তোমার জন্য । খুলে দেখো । বাঙালি কোন মেয়ে পাওয়া যাবে না আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যার একটা লাল শাড়ির স্বপ্ন নেই । যে লাল শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে আজীবন মেখে থাকে নতুন একটা শুরুর গল্প। থাকে অনেক অনেক আদর আর ভালোবাসার ছোঁয়া । শাড়িটা পরে আসবে একটু বাহিরে, আমারো খুব ইচ্ছে আজ আমার ভালোবাসায় কেউ জীবন শুরু করুক একটা লাল শাড়িতে ”
। ন‌ওশাদ
হেরা বক্স খুলে শাড়িটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে র‌ইলো ওর চোখে মুখে মুগ্ধতা আর বুকের ভেতরে শুধুই ধুকপুকানি , লজ্জা ।
তার হাতে সিঁদুরের মত লাল একটা কান্জিপুরাম শাড়ি , সোনালী জড়ির চ‌ওড়া পাড় আর আঁচল, পুরো জমিন জুড়ে জড়ির ভারী কাজ করা । এত সুন্দর কোন শাড়ি হতে পারে সে ভাবতেই পারছে না ! নরম, তুলতুলে শাড়িটা গালের সঙ্গে লাগিয়ে রাখলো হেরা। কি শাড়ি এটা, সে এসব শাড়ির নাম জানে না যদিও কিন্তু খুব ভালো লাগছে শাড়িটা ।
বক্সের ভেতরেই ব্লাউজ আর পেটিকোট ও রাখা । এত গোছানো একটা মানুষ সব দিকে খেয়াল উনার, মনে মনে ভাবছে হেরা।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়িটা পড়ছে আর ভাবছে আজ যদি এই শাড়িতে তাকে সুন্দর না লাগে এর চেয়ে কষ্টের আর কিছু হবে না ওর জন্য। কিন্তু শাড়িটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আয়নায় নিজেকে দেখেই নিজর‌ই লজ্জা লাগছে ওর ! তাকে ঠিক নতুন ব‌উ এর মতো লাগছে ! কিন্তু বুঝে উঠতে পারছে না ঘোমটা দিবে কি না ? একবার দিলো তারপর সঙ্গে সঙ্গে খুলে ফেলল , যে মানুষ টার সামনে ওড়না ছাড়াই কতবার হেঁটে যায় তার সামনে এখন ঘোমটা দেয়াটা নেহায়েত বেশি বেশি হয়ে যাবে। হাতের চুড়ি গুলো ছাড়া কোন গয়নার প্রয়োজন নেই এই শাড়ির সঙ্গে । চুলটা আঁচড়ে খুলে দিল চোখে গাঢ় করে কাজল পড়লো। কপালে লাল টিপ পড়ে তারপর ধীর পায়ে কটেজের বাহিরে এসে দাঁড়ালো ।
ন‌ওশাদ আগুনটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মনে মনে কিছু হয়তো ভাবছে । তার ভাবনায় সে এত মগ্ন হয়ে ছিল হেরা কটেজ থেকে বের হয়ে ওর কাছাকাছি চলে এসেছে সে টের‌ও পায়নি । হঠাৎ পায়ের আওয়াজ পেয়ে চোখ তুলে তাকাতেই একরাশ মুগ্ধতা ওকে ঘিরে ধরলো। আগুনের আলো আর হেরার গায়ে পড়া সোনালী জড়ির লাল শাড়ি সব মিলে মিশে তার মনে হচ্ছে একটা সূর্য তার সামনে জ্বলছে। ন‌ওশাদ উঠে দাঁড়ালো । কয়েক সেকেন্ড কোন কথাই সে বলতে পারলো না। হেরা লজ্জা লজ্জা মুখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
এদিকে এসো হেরা! সাবধানে ।
হেরা ন‌ওশাদের পাশে গিয়ে বসলো।
আপনি এত সুন্দর শাড়ি কখন কিনলেন ?
কিনেছি কয়দিন আগেই । আমি তো আর শপিং মলে যাই না পরিচিত একজন চেন্নাই গিয়েছিল চিকিৎসার জন্য তাকে দিয়ে আনিয়েছি । বুঝলে গীতির খুব শাড়ির শখ ছিল প্রচুর শাড়ি কিনতো ওর সঙ্গে থেকে আমিও শাড়ি‌ সম্বন্ধে অনেক জ্ঞান অর্জন করে ফেলেছি। হঠাৎ মনে হলো তোমাকে একটা লাল শাড়িতে দেখি, তাই আনালাম।‌ তোমার পছন্দ হয়েছে ?
খুব পছন্দ হয়েছে ! হেরা খেয়াল করলো ন‌ওশাদ একবারও শাড়ি পড়ে তাকে কেমন লাগছে বলছে না !
হঠাৎ বাতাস শুরু হয়েছে ।
ঝড় বৃষ্টি হবে নাকি এখন ?
সিলেটের বৃষ্টির কোন গ্যারান্টি নেই যেকোন সিজনে যখন তখন চলে আসে । ন‌ওশাদ কথাটা বলা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির ফোঁটা পড়া শুরু হয়ে গেল।
চলো বারান্দায় উঠি তোমার ঠান্ডা লেগে যাবে বৃষ্টি গায়ে পড়লে হেরা।
ন‌ওশাদ হেরার হাত ধরলো !
বারান্দায় উঠতেই ভালো বৃষ্টি শুরু হলো।
এখন বৃষ্টি হলে দারুন হবে তাই না ?
না । ন‌ওশাদ আচমকাই না বলে উঠলো ।
হেরা অবাক হয়ে চমকে তাকালো !
নিজেকে সামলে ন‌ওশাদ বলল, ঘুরতে এসেছি বৃষ্টি হলে ভালো লাগবে না হেরা।
হেরা জানে না এই বৃষ্টি এক ঝটকায় ন‌ওশাদের সামনে তার আর গীতির পুরো বিবাহিত জীবনটা নিয়ে এলো ।সেই ঝড় বৃষ্টির রাতটা সামনে নিয়ে এলো। এই অসময়ের বৃষ্টি কি গীতির ই চোখের পানি হয়তো বৃষ্টি হয়ে ওকে ভিজিয়ে দিতে চাচ্ছে ? ন‌ওশাদ নিজের উপরই বিরক্ত হলো কি সব যা তা ভাবছে সে !
আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে খুব ,বাতাসের সঙ্গে ঝিড়ঝিড় বৃষ্টি । ফাল্গুন মাসে এভাবে বৃষ্টি হবে ন‌ওশাদ অবাক হয়ে দেখছে। ওর সঙ্গে এমন কেন হচ্ছে ! যেদিন প্রথম হেরা রাতে ওর রুমে থাকতে এলো ইলেকট্রিসিটি চলে গেল কারণ ছাড়াই আইপিএস টা ডিস্টার্ব দিল। অন্ধকার ঘরে সে আর হেরা বসে র‌ইলো তারপর আজ আবার অসময়ের বৃষ্টি । সৃত্মি থেকে পালানো যায় না । সব কিছুর শুধু পুনরাবৃত্তি হয় কেন ?
হেরা হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি ধরছে হঠাৎ কি মনে করে একটু পানি ন‌ওশাদের দিকে ছিটিয়ে দিল। ন‌ওশাদ ওর দিকে তাকাতেই খিলখিল করে হেসে উঠলো কিশোরী দের মত। সেই হাসিতে কি ছিলো জানে না সে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ন‌ওশাদের মন থেকে সব পিছুটান ,সব দ্বিধা নিমিষেই মিলিয়ে গেল।
ন‌ওশাদ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখছে হেরা কে । মনে হচ্ছে লাল রং টা যেন ওর জন্যেই বানানো হয়েছে। ন‌ওশাদ হেরার হাত ধরে টেনে ঘরে নিয়ে এলো এসো আমার সঙ্গে !
বেড রুমের কেবিনেট থেকে চামড়ার উপর পুঁতি চুমকির কারুকাজ করা একটা বক্স বের করে হেরার হাতে ধরিয়ে দিলো।
কি এটাতে ?
খুলে দেখো ।
হেরা বক্স খুলে অবাক হয়ে গেল! বক্স ভর্তি সোনার গয়না।
এত গয়না !
এগুলো তোমার অধিকার হেরা । তোমার প্রাপ্য।
নিশালের মায়ের যা কিছু নিশালের ব‌উ এর জন্য রেখে দিলে হতো না !
এগুলো শুধু তোমার জন্য কিনেছি । আমি একজনের জিনিস আরেকজনকে দেই না হেরা, তোমার প্রতি আমার ভালবাসা টুকুও তাই । ন‌ওশাদ পেছন থেকে হেরাকে জড়িয়ে ধরে হেরার কানের লতিতে কামড় কাটলো। ঘাড়ের উপর থেকে চুল সরিয়ে চুমু খেলো। লজ্জা ছাড়াও এক অন্য অনুভূতিতে হেরার মন ভরে গেল। যা মন ছাপিয়ে ভালো লাগাটা শরীরে ছুঁয়ে যাচ্ছে। হেরা শিহরিত হচ্ছে ন‌ওশাদের ছোঁয়ায়। আজকের ছোয়াটা কেন যেন অন্য রকম লাগছে ওর ।
ন‌ওশাদ বলল,বিয়ের সময় গীতিকে কিংবা তোমাকে কাউকে কিছু দিতে পারিনি । গীতির সময় সামর্থ্য ছিল না আর তোমার আমার বিয়ের পরিস্থিতি তো যা ছিল । কিন্তু এখন আমার ইচ্ছে আমার স্ত্রীর কোন সাধ , অধিকার অপূর্ণ রাখবো না ।
এসো কাছে গয়না পড়িয়ে দেই ! ন‌ওশাদ হেরার মাথায় টিকলি থেকে শুরু করে গলায়, কানে, হাতে, সব গয়না নিজে হাতে পড়িয়ে দিলো। কানের কাছে এসে গেয়ে উঠলো, মোর প্রিয়া হবে এসো রানী/ দেব খোঁপায় তারার ফুল। কর্নে দোলাব তৃতীয়া তিথির/ চৈতী চাঁদের‌ও দুল।
হেরা আমার কিন্তু এখন নার্ভাস লাগছে খুব বলেই ন‌ওশাদ হেসে দিলো।
হেরা সেই যে চোখ নামিয়ে রেখেছে চোখ তুলে তাকাতেই পারছে না । তার মনে হচ্ছে এ যেন নতুন কোন এক ন‌ওশাদ । যে ন‌ওশাদ সব পরিস্থিতি ঠান্ডা মাথায় সামলে নেয় , যে মানুষটা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারার অসীম ক্ষমতা নিয়ে চলে কিন্তু এই মুহূর্তে তার সামনে ছটফটে এক ন‌ওশাদ আজমী । ঘরের দরজাটা যখন লক করে দিল সত্যি তাকে নার্ভাস লাগছে দেখে !
ব‌উ সাজে তোমাকে অপূর্ব লাগছে হেরা চোখ ফিরাতে পারছি না।‌ তাকাও একটু মুখটা তুলে । হেরা মুখ উঁচু করলো ঠিকই কিন্তু ন‌ওশাদের চোখে চোখ রাখতে পারছে না সে । লজ্জায় মিশে যাচ্ছে। তার সব ইন্দ্রীয় বলছে আজ রাতটা অন্য রাতের মত হবে না । আজ রাতে হয়তো এমন কিছু হবে যা আগে কখনো হয়নি !
চোখ তুলো আমার দিকে তাকাও।
ওর মুখটা দুই হাতে উঁচু করে ধরে ন‌ওশাদ বলল, এখন সত্যি বুঝতে পারছি কেন প্রথম থেকে তোমার চোখ গুলো দেখলে আমার ভেতরে একটা অস্বস্তি হতো, আসলে তোমাকে এভাবে গভীর করে একান্তই আমার করে পাওয়ার জন্যই হয়তো। এই চোখ গুলো আমাকে সত্যিই বেপরোয়া করে দিয়েছিল। ন‌ওশাদ হেরার চোখে চুমু খেলো। তারপর হেরার ঠোঁটে এক প্রগাঢ় চুম্বন এ আচ্ছন্ন হয়ে গেল। হেরার ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়েছে আগেও কিন্তু এতটা গভীর করে কখনোই নয় ! ন‌ওশাদ সঙ্গে সঙ্গে এক ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে তার ভেতরে অনেক অনেক বছর পর হাজারো ঝিঁঝিঁ পোকার সেই পুরোনো কোলাহল শুনতে পাচ্ছে সে ।
অস্ফুট স্বরে ন‌ওশাদ বলল, আমি বালুরচরের মত শুকিয়ে খড়খড়ে হয়ে গিয়েছি হেরা, তুমি উত্তাল ঢেউয়ের মতো আমার পাড় ভেঙে ভাসিয়ে নিয়ে যাও। হেরা ন‌ওশাদেকে তীব্র কামনায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। ন‌ওশাদ একেবারে নতুন করে যেন সারা শরীরে অনুভব করলো নারীস্পর্শ। হেরার শরীরের মাদকতায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল সে। সেই ঘোরের মাঝে সে টের পেল তার জীবনে কি ছিল না !
আলো আঁধারির আজকের রাতে তার আর হেরার মাঝে আর কোন দূরত্ব‌ই র‌ইলো না । আর কোন আড়াল নেই তাদের দুজনের মাঝে।
হেরার আজন্ম একটা ভয়ের কালো অধ্যায় হয়ে ছিল পৌরুষ । কোথায় যেন পড়েছিল হয়তো সব মেয়েদের মধ্যে এই ভয়টা থাকে! সে যে নোংরা পৌরুষ থাবার হাত থেকে বেঁচে এসেছে জীবনে ভীত হ‌ওয়াটাই স্বাভাবিক । কিন্তু আজ তার পায়ের পাতা থেকে হাঁটু, নাভি, গলায়, নাকে, কানের লতিতে, কপালে, ঠোঁটে, চিবুকের সেই ছোট্ট তিলে, হেরার বুকে হেরার সব টুকু তে এক স্নিগ্ধ, নরম, ধৈর্য্যশীল যে পৌরুষের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে ন‌ওশাদ তা সে ভাবতেও পারেনি কখনো। সে শিহরিত হচ্ছে, আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে ন‌ওশাদের আশ্লেষে, আলিঙ্গনে !
হেরার প্রতিটি রোমকূপ এ হারিয়ে যাওয়ার সময় ন‌ওশাদ জেনে গেল তার জীবনে এখন থেকে রাত আসা মানেই হবে উৎসব। আলোকিত এক উৎসব। দীর্ঘ শ্বাস আর হাহাকার ভরা রাত গুলোকে উৎসবের রাতে পরিনত করবে তার কাঠবিড়ালী।
বছরের প্রথম বৃষ্টিতে রাতটা ঝিরিঝিরি ছন্দে এগিয়ে যাচ্ছে হেরাও লজ্জার খোলস ছেড়ে সাহসী হয়ে উঠছে । ক্লান্তিতে চোখ বুজে থাকা ন‌ওশাদের উদোম বুকে জড়িয়ে হাত দিয়ে আজ শুধু ঠোঁট গুলো ছুঁয়েই দিলো না নিজেই চুমু খেল ন‌ওশাদের ঠোঁটে ।
উৎসবের রাতটা হেরা কে বুকে জড়িয়ে ই ঘুমিয়ে পড়লো ন‌ওশাদ।
টিপটিপ বৃষ্টি ছন্দের সঙ্গে অদ্ভুত এক অনুভূতি, শিহরণ নিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত ন‌ওশাদের বুকের ভেতর জড়িয়ে জেগে র‌ইলো হেরা । বারবার সে ঘুমন্ত ন‌ওশাদের মুখাটা দেখছে আর শিহরিত হচ্ছে।
পরদিন হেরা ঘুম ভেঙ্গে দেখে ন‌ওশাদ পাশে নেই ! কখন উঠে গেছে সে টের‌ও পায়নি । সব সময় মানুষটা আগে আগে ঘুম থেকে উঠে যাবেই । হেরার মাথার কাছে একটা চিরকুট রাখা । চিরকুট টা পড়ার আগে হাতে নিয়ে হেরা রাতটার কথা ভাবছে । চিন্তা করেই লজ্জা লাগছে তার আচ্ছা ন‌ওশাদের সামনে কিভাবে যাবে সে এখন ?

(চলবে)