অনুভবে তুমি পর্ব-১০

0
600

#অনুভবে_তুমি
#পর্ব_১০
#লেখনীতে_মুগ্ধ_ইসলাম_স্পর্শ
ভাইয়ার মৃতদেহটা আমার কোলে। তার মৃত্যুর আগে আমাকে কিছু কথা বলে গিয়েছে। যেগুলো শুনে আমার শরীরের প্রতিটি পশম দাঁড়িয়ে গেছে। তার কথাগুলো ছিল,
‘- ভাই আমাকে তুই ক্ষমা করে দিস। তোর উপর অনেক অন্যায় করেছি আমি। জানি আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবে না। তুই দয়া করে আমাকে ক্ষমা করে দিস। আমি তোকে মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করেছি৷ তোর জীবনটাও শেষ করে দিয়েছি আমি। এই অপরাধের ক্ষমা হবে কিনা জানি না। শিখা তোর সাথে কখনো অভিনয় করেনি আমি তাকে অভিনয় করতে বাধ্য করেছি। মেয়েটা তোকে সত্যি ভালোবাসি রে ভাই। আজ আমার কারণে তোদের এই বিচ্ছেদ। তুই দয়া করে শিখার সাথে দেখা কর। ওর অবস্থা খুবই খারাপ। শিখা তোকে ঠকায়নি। সে তোর সুখের জন্য তোর ভালোর জন্য নিজের জীবনটা নরকে পরিণত করেছে।
ভাইয়ার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে তবুও সে কথা বলেই যাচ্ছে। আর এদিকে আমার মাথা শুধু ঘুরছে। ভাইয়ের কথার কোন মানে আমি বুঝতে পারছি না। আমি বললাম,
‘- এসব কথা পরে হবে আগে তুই হাসপাতালে চল৷
ভাইয়া আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
‘- আমি হয়তো আর বাঁচবো না। এতটাই পাপের ভার বেশি হয়েছে আমার।
বলতে না বলতেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করল আমার কোলে। সত্যি বলতে ওর মৃত্যুতে খুব একটা কষ্ট হলো না আমার। সব সমস্যা মিটিয়ে উপমাকে নিয়ে বাড়িতে নিয়ে গেলাম ভাইয়ার লাশ।
আবার সেই অবহেলিত হওয়া বাড়িতে ফিরবো ভাবিনি কখনো। সময় কতকিছুই না করতে বাধ্য করে।
বাড়ির ভিতরে ঢুকে তাকিয়ে রইলাম চারিদিকে। কোথাও কেউ নেই। বাড়িটা কেমন মৃত হয়ে গেছে।
‘- মা? কোথায় তুমি?
আমি ডাকার কিছু মুহূর্ত পরেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো মা। আমাকে দেখে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দেয় আমার মুখ৷
‘- বাবা এতদিন পর আমাদের কথা মনে পড়লো তোর? তুই কিভাবে মা’কে ছাড়া থাকতে পারলি?
বলেই হুহু করে কেঁদে ওঠে।
‘- মা কান্না থামাও। একটা খারাপ সংবাদ আছে।
মা এবার হেঁচকি তুলে বলল,
‘- তুই কি আবার আমাকে ছেড়ে চলে যাবি?
‘- তেমন কিছু না। বাইরে তোমার বড় ছেলের লাশ রয়েছে। দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে।
ভাইয়ার মৃত্যুর খবর শুনে মায়ের তেমন কোনো হেলদোল পেলাম না। আশ্চর্য! নিজের ছেলের মৃত্যুতে মায়ের এতটুকু কষ্ট নেই?
‘- ওর মতো কুলাঙ্গার বেঁচে থাকার অধিকার রাখে না। আমিই ওকে অভিশাপ দিয়েছিলাম যেন গাড়ির নিচে পড়ে মরে। আল্লাহ আমার কথা শুনেছে।
বুঝতে পারছি মায়ের মাথা ঠিক নেই। এদিকে বাবাও বাড়ি নেই। শিখাকেও দেখছি না। বাবাকে কল করে ডাকা হলো। আস্তে আস্তে পাড়াপ্রতিবেশি, আত্মীয়স্বজন সবাই চলে এলো। দাফনের কাজ শেষ করে আবার বাড়িতে ফিরলাম। মা মুখে শাড়ির আঁচল গুঁজে কাঁদছে। হাজার হোক মা-ই তো। সন্তান যতই অপরাধ করুক, মায়ের কাছে সে ক্ষমা পাবেই। বাবা সবসময় কেমন অপরাধীর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মায়ের অবস্থা তেমন একটা ভালো নয়। উপমাকে নিয়ে মায়ের পাশে বসলাম। উপমাকে দেখিয়ে বললাম,
‘- মা তোমার বউমা।
উপমা মা’কে সালাম দিল। মাও চোখের পানি মুছে উপমার থুতনিতে হাত রেখে বলল,
‘- অনেক মিষ্টি আমার বউমা। কবে বিয়ে করলি তোরা?
‘- অল্প কিছুদিন আগে। তা মা শিখাকে দেখছি না যে?
শিখার কথা বলতেই মায়ের মুখটা একটু বেশিই মলিন হয়ে গেল বোধহয়।
‘- শিখা আর তোর ভাইয়ার ডিভোর্স হয়েছে।
মায়ের কথা শুনে মনটা ধুক করে উঠলো।
‘- ডিভোর্স? কিন্তু কেন?
মা এবার কেঁদেই ফেলল।
হঠাৎ বাবা বলে ওঠে,
‘- তোর মা বলার অবস্থায় নেই। আমি বলছি। তুই যখন বাড়ি ছেড়ে চলে যাস তারপর থেকেই শিখার উপর অত্যাচার করত। কারণ শিখা তাকে স্বামী হিসেবে মানতে নারাজ। শিখা তোকে ঠকায়নি বাবা। আবির ( বড় ভাই) তোকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে শিখাকে ভয় দেখিয়ে বিয়ে করেছে। এগুলো আমরা জানতে পারি কিছুদিন আগে। আর শিখা তোর মৃত্যুর ভয়ে ওই জানোয়ারটাকে বিয়ে করে ফেলে নিজের জীবনের শখ-আহ্লাদ, তোকে নিয়ে দেখা সব স্বপ্ন, ইচ্ছে আকাঙ্খাকে গলা টিপে হত্যা করে। তখন আমরাও তোকে ভুল বুঝেছিলাম। কারণ আবির শিখাকে দিয়ে বলিয়েছে, তুই নাকি শিখার সাথে প্রতারণা করেছিস। তোকে নানান ভাবে আমাদের সামনে খারাপ করেছে। তারপর তুই যখন চলে গেলি তখন শিখার প্রতি শুরু হলো আবিরের অত্যাচার। জোর করে আমার থেকে সব সম্পত্তি লিখে নেয়। তারপর প্রতি রাতে নেশা করে বাড়িতে এসে শিখাকে মারতো। আমরা কিছু বলতে গেলে আমাদেরকে,,,,,
বলেই হুহু করে কেঁদে ওঠে বাবা। চোখের পানি যেন বাঁধ মানছে না।
আমি যতই বাবার কথা শুনছি ততই বুকটা চিনচিন করে উঠছে।
‘- তোমাদেরকেও কি?
‘- নেশা করে শিখাকে তো মারতোই। আমরা বাঁধা দিলে আমাদেরকেও মারতো সে।
বাবার এই কথাটি শুনে রাগে চোখদুটো বন্ধ হয়ে গেল৷ ইচ্ছে করছে জানোয়ারটাকে কবর থেকে তুলে আবার মেরে ফেলি৷
বাবা আবার বলতে শুরু করল,
‘- নেশা তো করতোই সাথে বাড়িতে মেয়েও নিয়ে আসতো। আর শিখাকে ঘরের বাইরে বের করে দিতো। শিখা আবিরের হাজারো লাথি খেয়ে পড়ে থাকতো। একটা সময় আমরা সবাই মিলে ওদের ডিভোর্স করিয়ে দেই। মেয়েটা প্রায় মরতে বসেছিল। প্রতি রাতে তোর ছবি জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় কান্না করতো। মেয়েটা আজও তোর ছবি দেখে চোখের পানি ফেলে। মেয়েটা শুধু কষ্টই পেয়ে গেল রে বাবা। শুধু তোর জীবনের কথা ভেবে মেয়েটা নিজের জীবনটাই জাহান্নাম করে দিল৷ ওদের ডিভোর্স করিয়ে দেওয়ার পরে ভেবেছিলাম ওর অন্য কোথাও বিয়ে দেব আমরা। কিন্তু তার আগেই ঘটে গেল আরও একটা দুর্ঘটনা। শিখার মুখে শুনেছি, কয়েকদিন আগে নাকি রাস্তায় তোর মতো কাউকে দেখে। আর তাই তোর কাছে ছুটে যাওয়ার জন্য রাস্তা পার হচ্ছিল এপাশ ওপাশ না দেখেই। হুট করে রাস্তায় চলে যাওয়ায় প্রাইভেট কারের সাথে ধাক্কা খায়। পা দুটো একটুর জন্য বেঁচে গেছে।
বাবার কথাগুলো শুনে আমার মাথায় বাজ পড়ার মতো অবস্থা। হঠাৎ খেয়াল করলাম গালদুটো ভিজে গেছে। আজ চোখদুটোও বেইমানি করছে নিজের সাথে। যাকে ভুল বুঝে দূরে চলে গেলাম, সেই কি-না আমার জন্য এতকিছু,,,,
উপমার দিকে তাকিয়ে দেখি উপমাও নিরবে চোখের পানি ফেলছে।
একটা মানুষ কতটা ভালোবাসলে তার ভালোবাসার মানুষের জন্য নিজের জীবনটা এভাবে বিষিয়ে তুলতে পারে।
আমি আর সেখানে না থেকে নিজের সেই অযত্নে রেখে যাওয়া ঘরে গেলাম। ঘরটা এখনো ঠিক আগের মতোই রয়েছে। দেয়ালেট চারিদিকে আমার আর শিখার ছবি টাঙানো। শিখার সাথে কাটানো সব মুহূর্ত গুলো এই চার দেয়ালে টাঙানো রয়েছে। ভেবেছিলাম ছবিগুলো হয়তো থাকবে না। এখন আর বুঝতে বাকি নেই যেদিন এই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম সেদিন কেন শিখা চোখের পানি ফেলেছিল নিশ্বব্দে। হয়তো সে চেয়েছিল আমি তাকে যেন একা করে চলে না যাই। আমি হয়তো তাকে ভালোবাসতেই পারিনি। তা নাহলে তার চোখের ভাষা বুঝতে পারিনি কিভাবে আমি? এতটাই স্বার্থপর হয়েছিলাম সেদিন?
একটু পর উপমা আমার পাশে এসে বসে। সেও অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে দেয়ালের দিকে। আমার কাঁধে হাত রেখে বলে,
‘- এভাবে ভেঙ্গে পড়ছো কেন? সময় এবং পরিস্থিতি যতই খারাপ হোক না কেন নিজের অবস্থানটা’কে ঠিক রেখে পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে।
উপমার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
‘- কি ভেবেছিলাম আর কি হয়ে গেছে। আমি শিখাকে আদৌও বুঝতেই পারিনি।
‘- প্রত্যেকের জীবনের একটা গল্প আছে । অতীতে ফিরে গিয়ে গল্পের শুরুটা কখনো পরিবর্তন করা সম্ভব নয় , কিন্তু কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে গল্পের শেষটা চাইলেই নতুন করে সাজিয়ে তুলতে পারো।
উপমার এরূপ কথার কোন মানে বুঝলাম না আমি।
আহাম্মকের মত প্রশ্ন করলাম,
‘- কি বলছো আর না বলছো মাথা ঠিক আছে তোমার? ভেবে কথা বলছো তো।
‘- আমি কোনো কথা না ভেবে বলি না। কোনোকিছু যদি সত্যিই তোমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়, তবে তুমি তা করবেই। কোনো বাঁধাই তোমাকে থামাতে পারবে না। কিছু কিছু সময় আসে যখন আমরা
বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের সীমারেখায় অবস্থান করি। তখন আমরা একই সঙ্গে দেখতে পাই ও পাই না। বুঝতে পারি ও পারি না। অনুভব করতে পারি ও পারি না।
সে বড় রহস্যময় সময়। নিজের ভুলের জন্য যেটা হয় সেটাকে সংশোধন করে নিতে হয়। চলো আমরা শিখা আপুর কাছে যাই।
আমি উপমাকে যত দেখি ততই অবাক হই। মেয়েটা এমন কেন? জীবনে এরকম দোটানায় পড়বো সেটা চিন্তারও অধিক বাইরে।
চলবে ইনশাআল্লাহ,,,,,