প্রজাপতি উৎসব পর্ব-১৭

0
270

প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ১৭
আমি আর রঞ্জন অমর একুশে বইমেলায় এসেছি। রুম থেকে বেরোবার আগে অতন্দ্রিলা বারবার আমাকে সাবধান করে বলেছে,
– রূপা, জানিস তো রঞ্জনের ব্যাপারে আমার রিজার্ভেসন আছে। অ্যাপিয়ারেন্সস ক্যান বি ডিসেপ্টিভ। সৌন্দর্যের মত প্রতারক আর কিছু নাই। সাবধানে থাকিস।
-অ্যাপিয়ারেন্সের বিরুদ্ধে লাগলি কেন?
-আমার মামাও খুব হ্যান্ডসাম ছিল। সে জন্যই সিডিউস করতে পেরেছিল। ঠোকর খেয়ে রক্তাক্ত হবার আগে আমিও ওই পেখম মেলা ময়ূরের রঙের মূর্ছনায় বিবশ হয়ে ছিলাম।
আমি অতন্দ্রিলাকে বললাম,
-ওই লোকের সঙ্গে তোর একটা ভয়ংকর বিশ্রী অভিজ্ঞতা হয়েছিল অতন্দ্রিলা। কিন্তু অমন ঘটনা সচরাচর ঘটে না। ওই অভিজ্ঞতাকে জেনারালাইজ করা ঠিক না। তোর অবদমিত কষ্টের অবতল দর্পণে রঞ্জনকে বিকৃত এবং বিকট দেখাবে, এটাই স্বাভাবিক।
-আর তোর উতলা প্রেমের উত্তল দর্পনে রঞ্জনকে কেমন দেখায়?
-এই বয়সেরর অন্য যে কোন যুবকের চেয়ে বেশী দোষ ওর ভেতরে পাইনি। অন্তত রায়হান ভাইয়ের চেয়ে রঞ্জন দশ গুন ভালো। তবে হ্যাঁ ওকে নিয়ে দু একটা কাঁটা এখনও মনের ভেতর খচখচ করছে।
যাবার তাড়া ছিল বলে রঞ্জনকে নিয়ে কথা বাড়াইনি। অতন্দ্রিলা এখন পাশে থাকলে দেখতো লাল-শাদা পাঞ্জাবিতে ঝাঁকড়া চুল আর চওড়া কাঁধের রঞ্জনের দিকে মেয়েরা বারবার কেমন ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। কই রঞ্জন তো ওদের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দিচ্ছে না?
আর আমি নিজেও অকালবৃদ্ধ না। আমি নবীন, আমার মনের শাখায় শাখায় সবুজ পাতার সমারোহ। একটা সুদর্শন ছেলের পাশে থাকতে আমারও তো ইচ্ছে হয়, ভালো লাগে। অতন্দ্রিলা যখন বলেছে, অবশ্যই আমি সাবধান হবো। মিতির অবস্থা দেখেও আমাদের যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে। কিন্তু তাই বলে জীবনের ভরা বসন্তের পরম লগ্নগুলো হেলায় হারাতে চাই না।
বইমেলায় আজ ভিড় জমে গেছে। ধাক্কাধাক্কি লেগে যাবার মত অবস্থা। রঞ্জন আমার হাতটা শক্ত করে ধরলো, যেন সারা পৃথিবীকে জানান দিচ্ছে রূপা ওর। ওর এই দাবীমুখর অভিব্যক্তি আমার ভালো লাগছে। এর মাঝে একটা বোল্ডনেস আছে। আমিও রঞ্জনের গাঁ ঘেঁষে হাঁটতে লাগলাম। আমার সহজতায় রঞ্জন সামান্য সাহস পেলো। হাঁটতে হাঁটতে বললো,
-একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম।
-কী ব্যাপার?
-বেশ কিছুদিন ধরে তুমি আমারকে অ্যাভয়েড করছিলে।
-কখন অ্যাভয়েড করলাম?
-ঠিক অ্যাভয়েড না, কেমন কাটাকাটা আর শক্ত হয়ে আছো। আজ কি প্লিজ বলবে কেন এমন করছিলে?
আমি ভাবছিলাম কী বলবো। সিনেমা হলে ঠোঁটে চুমু খেতে দিতে চাওয়া, শেষ চিঠিটার রগরগে ভাষা, সপ্তর্ষির সঙ্গে ওর সন্দেহ জাগানো কথোপকথন, তারপর আবার ওর ঘরের ট্রাংকে ধর্ষিতা মেয়েদের অন্তর্বাস পাওয়া, সব মিলিয়ে মনটা রঞ্জনের উপর ত্যাক্ত হয়ে গিয়েছিল। আমাকে চুপ থাকতে দেখে রঞ্জন নিজেই বললো,
-মেয়েদের আন্ডার গার্মেন্টসের ঘটনায় আমি যে জড়িত না সে তো ওই ইন্সপেক্টর নিজেই বললেন। জাস্ট কেউ সন্দেহ করেছে বলে তুমি আমার উপর রাগ করে থাকতে পারো না।
-সত্যি কথা বলবো?
-হ্যাঁ, প্লিজ।
-ছেলেরা অনেক সময় শরীরের প্রেম আর সত্যিকার প্রেমকে গুলিয়ে ফেলে। আমার কেন যেন মনে হয় তুমি সেরকম ভ্রান্তির ভেতর দিয়ে যাচ্ছো।
-মানে বলতে চাইছো আমি তোমার সঙ্গে ফিজিকাল রিলেশনশিপ করার জন্য প্রেমের ভাণ করছি?
-আমি বলিনি ভাণ করছো। তুমি ফিজিকাল রিলেশনশিপকে প্রেম ভাবছো। অনেক বিরহের পর যখন কেউ বলে, সব পথ এসে মিলে গেল শেষে তোমার দুখানি নয়নে, সেটাই আমার চোখে ভালোবাসা।
-আর আমি কী করছি?
-এখন যদি কারো ভাবসাবে মনে হয় তার সব পথ দুখানি নয়নে এসে দুখানি বক্ষে কিংবা আরও নীচে কোথাও মিলতে চায় তাহলে সেটা ভালোবাসার ছদ্মবেশে কামনা। প্রথম দিকে তুমি আবেগভরে সুন্দর সুন্দর চিঠি লিখেছো। কিন্তু যখন তোমার কাছে মন সঁপে দিলাম তখন তোমার বিহেভিয়ার বদলে গেলো। মনে হলো…
আমি দ্বিধা করছিলাম বাকিটা বলতে, কাউকে আহত করতে ইছে করে না, কিন্তু রঞ্জন বললো,
-বিহেভিয়ার দেখে কী মনে হলো?
-মনে হলো ভালোবাসার আবেগকে তুমি শরীরের রম্যভবনে উঠবার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছো। আমি স্যরি এভাবে বলার জন্য। কিন্তু এটা ভেবেই আমি মন খারাপ করেছি।
রঞ্জন মনে হয় আহত কিংবা অপমানিত হলো, ওর মুখ কেমন লালচে হয়ে গেলো, উত্তেজনা চেপে রাখা কণ্ঠে বললো,
-আমার মনে হয় দেয়ার ইজ আ সিরিয়াস মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হিয়ার। এখানে একটা বড় আম্ফিথিয়েটার আছে না, চলো ওখানে চা নিয়ে বসে একটু কথা বলি।
আমি বললাম,
-অনেকদিন এখানকার টিএসসির ক্যান্টিনে যাই না। ওখানে এক কোনে নিরালায় বসে আলাপ করা যাবে।
রঞ্জন রাজি হলো। বহুদিন পর এখানকার টিএসসির ভেতর গেলাম। উন্মুক্ত করিডোরের শেষ মাথায় একটা ক্যাফে আছে। ক্যাফেতে চায়ের অর্ডার করে আমরা পেছনের দিকের একটা টেবিল নিয়ে বসলাম। রঞ্জন বললো,
-আমার মনে হয় ছেলেদের সম্পর্কে তোমার একটা বেসিক মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং আছে।
-কী সেটা?
-পৃথিবীতে এমন কোন চব্বিশ পঁচিশ বছরের ছেলে নেই যে ফিজিকাল ইন্টিমেসি চায় না। কেউ বলে, কেউ বলে না। অথচ তোমার ধারণা এটা কেবল আমার দোষ।
-ফিজিকাল ইন্টিমেসি চাওয়া নিয়ে আমার কোন সমস্যা নেই। ওটা একটা জৈবিক প্রয়োজন। কিন্তু এই চাহিদাকে ভালোবাসা বলা অন্যায়। সমাজের রীতিনীতি মেনে মানুষ এই চাহিদার হিসেব মিটায়। দুই যোগ দুই চারের মত। কিন্তু ভালোবাসা দুই যোগ দুই চার না।
-তাহলে ভালোবাসার সমীকরণ কী?
-ভালোবাসার সমীকরণ হলো দুই যোগ দুই সমান সমান পাঁচ।
-সেটা অসম্ভব। দুই যোগ দুই কখনো পাঁচ হয় না। ওই এক্সট্রা এক কোত্থেকে আসবে?
-ওই অতিরিক্ত এক আসে প্রচন্ড আবেগ আর মায়া থেকে। ওটাই ভালোবাসার এক্স ফ্যাক্টর। শরীরের আকর্ষণ নিয়ে আমরা মেয়েরা মাথাই ঘামাই না যদি দেখি পুরো সম্পর্কের ভেতর ওই এক্স ফ্যাক্টরটা আছে। কিন্তু ওই এক্স ফ্যাক্টর ছাড়া কোন ছেলে অ্যাপ্রোচ করলে তাকে নরখাদক মনে হয়।
-তুমি বলতে চাইছো তোমার প্রতি আমার আকর্ষণে কোন মায়া কিংবা আবেগ নেই। আমার ভিউপয়েন্ট কিন্তু আলাদা।
-সেটা কী?
– একজন মা যখন তার বাচ্চাকে ভালোবাসা দেখায় সে কিন্তু মাথায় হাত বুলিয়ে চুমু দিয়েই আদর করে দেখায়। তাই বলে কি মায়েদের কোন আবেগ নেই?
কথা বলতে বলতে রঞ্জনের মুখটা কেমন করুণ হয়ে গেছে। ওর এই কথা ভুল না, অনুভূতি যতই অপার্থিব হোক, বেশীরভাগের বোধগম্য প্রকাশ শেষ পর্যন্ত পার্থিবই হয়। বললাম,
-কিন্তু সেটা আবেগের পার্থিব প্রকাশ যার মাঝে মাখা থাকে সংযম,সৌন্দর্য এবং সহানুভূতি।
রঞ্জন এবার অসহায়ের মত বললো,
-ঠিক আছে, আমার অ্যাটিচুডে কোথাও ভুল থাকলে আমি সেটা ঠিক করে নেবো।
গল্প করতে করতে বিকেল হয়ে গেলো। তবু ভালো আমার মনে যা খচখচ করছিল তা সরাসরি রঞ্জনকে বলে দিলাম। একেই বলে, টু গেট দা বুল বাই দা হর্ন, একেবার শিং ধরে ষাঁড়কে কব্জা করা।
টিএসসি থেকে বের হবার সময় ঝাঁঝরির মত দেয়ালের পাশে আসতেই রঞ্জন হঠাৎ আমার কপালে আলতো করে চুমু খেলো। আমি রাগ করলাম না। বেচারা অন্য সমসাময়িক প্রেমিকদের মত আচরণ করতে চেয়েছে। তাছাড়া কপালের চুমুতে মিশে থাকে চার আনা শরীর আর বারো আনা মন। মাঝে রঞ্জনকে নিয়ে অনেক দ্বিধায় ছিলাম কিন্তু আজ কথা বলে মনে হলো সে সত্যিই হয়তো আমাকে কিছুটা মায়া করে। আমি বললাম,
-পাবলিক প্লেসে এমন করা কিন্তু খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার, কে কখন কী বলে বসে ঠিক নেই। তার মানে আবার ভেবো না আমি কোন প্রাইভেট প্লেসে এসব অ্যালাউ করবো।
-জানি, স্যরি।
সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে কী মনে করে টিটু ভাইকে খুব সংক্ষিপ্ত একটা ইমেইল করলাম,
টিটু ভাই,
আজ বইমেলায় গিয়েছিলাম রঞ্জনের সঙ্গে। ওর ভালোবাসা নিয়ে সংশয়ে আছি তাই ওকে প্রশ্ন করে অনেক কিছু জেনে নিলাম। আপনাকে কোন কিছু লুকোই না, এই কথাটিও বলে রাখলাম।
আপনি সেদিন উপমা দিয়ে জানতে চেয়েছিলেন আমার মনের ধারা কোনদিন আপনার দিকে বইবে কিনা।
তখন আমার একটা ব্রহ্মসঙ্গীত মনে পড়লো, দুই হৃদয়ের নদী একত্র মিলিল যদি, বলো, দেব, কার পানে আগ্রহে ছুটিয়া যায়॥ সম্মুখে রয়েছে তার তুমি প্রেমপারাবার,তোমারি অনন্তহৃদে দুটিতে মিলাতে চায়।
ভাবলাম, আসলেই তো, দুটি হৃদয় একত্রে মিলিত হবার পর আরও কোন মহাসমুদ্রে্র অভিমুখে ধাবিত না হলে স্রোতের অভাবে দুটো ধারাই শুকিয়ে যায়। রয়ে যায় মৃত প্রেমের ধূধূ বালিয়াড়ি। এ কারণেই পৃথিবীর সব স্বার্থপর ভোগবাদী মানুষেরা শেষমেশ অসুখী হয়। ওরা ভালোবাসাকে অসীম অনন্তের নীরব কল্লোলে নক্ষত্রের মত ভাসিয়ে রাখতে জানে না।
আমার এক শিক্ষক বলতেন ভালোবাসার মানুষে বেশী কাছে যেতে নেই, true love always makes the dearest one stay away. আসলেই কি তাই? সত্যিকার ভালোবাসা কি স্পর্শে গুটিয়ে যায়, লজ্জাবতীর পাতাটির মত?
ইতি,
রূপা
(চলবে)