প্রজাপতি উৎসব পর্ব-১৮

0
253

প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ১৮

চৌরঙ্গী-প্রান্তিক ঝোপের কাছে ভোর সকালে এক যুবকের লাশ পাওয়া গেছে। যুবকের সঙ্গে কোন আইডি ছিল না। লাশ শনাক্ত করতে অসুবিধা হচ্ছিল।

পুলিশ জাহাঙ্গীরগরের সবগুলো হলে গিয়ে যুবকটার ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছে। রঞ্জন ছবি দেখে অবাক হয়ে বলেছে,
-আরে এ তো খসরু ভাই। এ-ই তো আমার রুমমেট ছিল। কী হয়েছে ওনার?
-আপনি চেনেন একে? আপনাকে আমাদের সঙ্গে আসতে হবে।

রঞ্জনকে আবার লাবণির জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হতে হলো। লাবণি রাখঢাক না করে সরাসর কাজেত্র কথায় চলে এলো,
-আপনি বলছেন এই লোকের নাম খসরু। আপনার রুমমেট?

-হ্যাঁ, তাই তো বললাম, আগে রুমমেট ছিলেন।

-রেজিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। ওরা আপনার দেয়া তথ্য নিশ্চিত করে জানাবে। এই খসরুই তাহলে টিনের ট্রাংকের মালিক?

-হ্যাঁ,আন্ডার গার্মেন্টসগুলো টিনের ট্র্যাংকে লুকিয়ে আমাকে কী ফাঁসানোই না ফাঁসিয়েছিল খসরু ভাই। কী হয়েছে? উনি কি ধরা পড়েছেন?

-ওনার ডেডবডি পাওয়া গেছে আপনাদের ক্যাম্পাসেই।

-কী কান্ড, এ দেখি আল্লার বিচার। কীভাবে মরলো?

-কেউ ওনাকে বিশ্রীভাবে মেরেছে। বেঁচে থাকলেও ওনার পক্ষে আর রেপ করা সম্ভব হতো না।

-কিন্তু খসরু ভাইকে মারলো কে? ভিক্টিমদের কেউ নাকি?

-সেটা বের করতেই তো আপনাকে ডাকা। আপনি কবে ওকে শেষ দেখেছেন?

-ওই যে বলছিলাম উনি লাস্ট টার্মে পড়া শেষ করে চলে গেছেন, দু মাস হবে। চালাকি করে ট্রাংকটা যে বিছানার তলায় রেখে গেছেন সেটা কে জানতো?

-তারপর আর ওনাকে আপনি ক্যাম্পাসে দেখেননি?

-ক্যাম্পাসে আসতেই পারে মিছিলটিছিল করতে কিন্তু আমি দেখিনি।

-আমরা এখন কতগুলো প্রসেসের ভেতর দিয়ে যাবো। ডেডবডির পোস্ট মর্টেম হবে, ফরেন্সিক ইনভেস্টিগেশন হবে।

-বুঝলাম। ভালো কথা। আমি কি এখন যেতে পারি?

-এখন আসতে পারেন, তবে খুব শীগ্রই আপনার আঙ্গুলের ছাপ আর ব্লাড স্যাম্পল লাগবে।

রঞ্জন উত্তেজিত হয়ে বললো,
-কেন? এত ছাত্র থাকতে আমার আঙ্গুলের ছাপ কেন? আপনারা কি ভাবছেন আমি খসরু ভাইকে মেরেছি?

-ঠিক তা না, আপনি যেহেতু খসরুর রুমমেট ছিলেন, স্বাভাবিকভাবেই আপনি তদন্তের অংশ। আপনাকে সন্দেহের তালিকা থেকে সরাতে হলে আপনার আঙ্গুলের ছাপ আর ব্লাড স্যাম্পল লাগবে। এবার আর ডিবি অফিসে কষ্ট করে আসতে হবে না, আমাদের লোক এসে স্যাম্পল নিয়ে যাবে।

বেচারা রঞ্জনের সময়টাই খারাপ যাচ্ছে। একের পর এক আউলাঝাউলা বিপদে পড়ছে। ইন্সপেক্টর লাবণির সঙ্গে কথা শেষ হতেই আমি ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম,
-তোমার ভাগ্য খারাপ, রঞ্জন। তবে ভয়ের কিছু নেই। তুমি তো কোন দোষ করোনি।

-কিন্তু তবুও এটা একটা হ্যারেসমেন্ট। সবাই দেখছে বারবার আমাকেই পুলিশ প্রশ্ন করছে। ওরা কী ভাবছে? আমিও খুব ইন্সাল্টেড ফিল করছি। হোয়াই মি?

আসলে ডাকাবুকা চেহারার জন্যই রঞ্জন একটু বেশী নজরে পড়ে। তবে আমি রঞ্জনকে নিয়ে মোটেও ভয় পাচ্ছি না। দিলশাদ বলেছে ইন্সপেক্টর লাবণি খুব মেধাবী ডিটেকটিভ। বিনা কারণে কাউকে ঝামেলায় ফেলবেন না। উনি আসল শয়তানগুলোকে ঠিকই ধরবেন। একটা শয়তান তো নিজেই খুনই হলো। ওই খসরুর জন্য আমার মোটেও সহানুভূতি হচ্ছে না। আইন যে-ই নিজের হাতে তুলে নেক, এটার প্রয়োজন ছিল। যেমন কর্ম তেমন ফল।

বিকেলে হলে ফিরে মন খারাপ হলো। মিতির অভাবে আমার ঘরটা কেমন শূন্য শূন্য লাগছে। মিতি কাল রাতে সুইডেন চলে গেছে। মিতিকে বিদেয় দিতে আমি, অতন্দ্রিলা আর দিলশাদ এয়ারপোর্ট গিয়েছিলাম। মিতির শরীর ভালো যাচ্ছিল না। বাথরুমে গিয়ে কতক্ষণ বমি করলো। একদিকে প্রেগন্যান্সি, অন্যদিকে মানসিক চাপ, আবার হুট করে বিদেশ যাত্রা, একসাথে মেয়েটা কতদিক সামলাবে?

বোর্ডিং গেটে ঢোকার সময় আমাদেরকে জড়িয়ে ধরে মিতি হাউমাউ করে কাঁদলো। কী যে নরম মনের মেয়ে মিতি। অথচ এই মিতি এত চাপের মুখেও অ্যাবরসন করেনি। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে অটল ছিল। নিজের সুবিধার জন্য একটা প্রাণ বিসর্জন দিতে মিতি কোনভাবেই রাজি হলো না। আসলে বিপদের মুখে পড়লে বোঝা যায় কার মনের জোর কত বেশী। কুরুশকাঁটা দিয়ে ও বাচ্চার জন্য লাল উলের গরম জামা আর মোজা বুনেছিল গত ক মাস ধরে।। কাল দেখলাম সেগুলো পরম মমতায় ছোট ছোট ভাঁজ করে ব্যাগে ভরেছে। সুইডেনে মাস ছয়েক পর ওর ডেলিভারি হবে। ও সিঙ্গেল মাদার হিসেবে একাই বাচ্চা পেলে বড় করবে। মিতির বড় বোন স্মৃতি আপার হাজবেন্ড আলফ্রেড সুইডিশ। মিতির সিদ্ধান্তে স্মৃতি আপা আর আলফ্রেডের পূর্ণ সমর্থন আছে। মিতি উপসালা গিয়ে প্রথমে স্মৃতি আপার বাসায় উঠবে। তারপর পড়া শেষে একটা কোন চাকুরী জুটিয়ে নিজের মত করে থাকবে। স্মৃতি আপা মিতিকে বলেছে ওখানকার সোশাল সার্ভিস থেকেও অনেক সাহায্য পাওয়া যাবে।

আমার মনে হলো মিতি ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়নি, জেদ করে নিয়েছে। মিতি মুখে না বললেও বেশ বুঝতে পারছি রায়হান ভাইয়ের প্রতারণা ওর ভেতরটা ভেঙেচুরে দিয়েছে, ওর রোখ চেপে গেছে। আমি নিশ্চিত ইউরোপে গিয়ে রায়হান ভাইকে সে কোন একটা উচিত শিক্ষা দেবে। পিতৃপরিচয় রায়হান কোনভাবেই এড়াতে পারবে না।

কীভাবে কীভাবে যেন সব ভালো মানুষগুলো বিদেশ চলে যাচ্ছে। মিতি সুইডেন, টিটু ভাই মস্কো। টিটু ভাই পিএইচডির সেকেন্ড ইয়ারে। ওনার চাপ অনেক বেড়ে গেছে। উনি ফিল্ড ওয়ার্কের জন্য জর্জিয়ার রাজধানী তিবলিসিতে গেছেন। যোগাযোগ করার সময় পাচ্ছে না। এমন হতে পারে, আমার শেষ চিঠি পড়ে টিটু ভাই একটু মন খারাপ করেছেন। ভেবেছেন রঞ্জনের সাথেই যখন ঘুরে বেড়াচ্ছি, ওনার থেকে দূরে সরে থাকাই ভালো। আমি বুঝি আমার দোষ আছে। শেষের কবিতার মত রঞ্জনকে যেন আমি প্রতিদিনের ঘড়ায় তোলা জল আর টিটু ভাই ছায়া সুনিবিড় পদ্ম দীঘি ভেবে নিয়েছি। রঞ্জন যেন উত্তেজনার খোরাক, টিটু ভাই দিনের শেষে আত্মার শান্তি। মনের শান্তি না ভেবে আত্মার শান্তি কেন ভাবলাম? এটা কি মনেরও অধিক কিছু?

কিন্তু প্রশ্ন হলো আমি কি আসলেই দ্বিচারিতা করছি? টিটু ভাই কি আমাকে অমন খারাপ ভাবছেন? তা না হলে টিটু ভাই কেন চিঠির জবাবে বলেছিলেন,

প্রিয় রূপা,
হৃদয়ের পথ এক সময় দু দিকে বাঁকবেই। তিন দিকে বাঁকলেই বা কী করা যেতো? কিন্তু কুয়াশা কাটিয়ে চলতে হলে যে কোন একটা পথ বেছে নিতে হবে। সেই পথের শেষে গিয়ে যদি মনে হয় ভুল গন্তব্যে এলে, তখন প্রয়োজনে আবার বাঁকের মুখে ফিরে যাবে। তবু একটু ভেবে যে কোন একটা পথ বেছে নাও। বাকি পথগুলো না হয় মুখর পদচারণার অভাবে হরিৎ নিবিড়তায় ফিরে যাক।

রূপা, আজ বোধহয় উপদেশ বেশী দিচ্ছি। আসলে আমার মনটা ভীষণ বিক্ষিপ্ত। মনের ছত্রভঙ্গ আলোর রশ্মিগুলোকে ধ্যানের আতসি কাঁচে কেন্দ্রীভূত করা প্রয়োজন। ওদিকে আমার পড়ালেখার চাপ ক্রমশ বাড়ছে। খুব শীঘ্রই ফিল্ডওয়ার্ক শুরু হবে, মস্কোর বাইরে যাবো। এই সময় যোগাযোগ শিথিল হলে আশা করি মন খারাপ করবে না।
ইতি,
টিটু

আসলে আমাকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তার আগে আর টিটু ভাইকে আগ বাড়িয়ে চিঠি লিখবো না। উনি লিখলেই কেবল জবাব দেবো। তবে আমি টিটু ভাইকে ইন্সটাগ্রামে ফলো করছি। আমি জানি টিটু ভাই কখন কোথায় যাচ্ছেন। না জানলে অনেক কষ্ট পেতাম। টিটু ভাইও কি একইভাবে আমার খোঁজ নেন? আমার খোঁজ না জানলে কষ্ট পান?

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গলো দিলশাদের ফোনে। আমি বললাম,

-কী ব্যাপার এত ভোরে ফোন করেছিস কেন?

-ভোর কোথায়? সাড়ে নটা বাজে।

-আজ তো শুক্রবার।

-চাচা এসেছেন, গেস্ট লাউঞ্জে ওয়েট করছেন।

-চাচা মানে আমার আব্বা ?

-হুম, তাড়াতাড়ি আয়।

আমি ভাবলাম, না বলে না কয়ে আব্বা কেন এসেছেন? কোন বিপদ হয়নি তো?

(চলবে)