প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ২৭ (কেবল এই পর্ব ১৮+)
জন্মনিরোধক পিল খেলে আমার শরীরে প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া হয়। রক্ত পড়তে থাকে, সহজে থামে না। আমার হরমোনাল সমস্যার কথা জেনেও মোহন আমার আমার বুকের উপর চেপে বসে আছে। এখন রাত দুটো। আমাদের বিয়ের মাত্র আড়াই মাস হয়েছে।
মোহনের বাঁধন থেকে আলগা হবার জন্য আমি হাত পা নাড়ছি। কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না। মোহনের গায়ের জোর আমার চেয়ে অনেক বেশী। মোহন বাঁ হাতটা সাঁড়াশির হয়ে আমার গাল দুদিক থেকে এঁটে ধরেছে। না চাইতেও আমার মুখ হাঁ হয়ে গেছে। ডান হাতে ধরা জন্মনিরোধক বড়িটা মোহন জোর করে আমার মুখে ঢুকিয়ে দিলো। তারপর ডান পাশের সাইড টেবিল থেকে একগ্লাস পানি আমার হা করা মুখে ঢাললো। কিছু পানি পেটে গেলো, কিছু পানি আমার শ্বাসনালীতে ঢুকলো, কিছু পানি গাল বেঁয়ে বিছানায় পড়লো।
ফুসফুসে পানি ঢুকে আমার এখন হেঁচকি আসছে। কিন্তু আমি হাঁচি দিতে পারছি না। কারণ মোহন আমার মুখ হাত দিয়ে চেপে বন্ধ করে রেখেছে, আমি যেন কন্ট্রাসেপ্টিভ পিল মুখ থেকে ফেলে দিতে না পারি।
আমার দম আটকে আসছিল, মনে হচ্ছিল শ্বাস বন্ধ হয়ে মরেই যাবো। জন্মনিরোধক বড়িটা গিলে ফেলার পর মোহন আমাকে ছেড়ে দেলো। আমি উঠে বসে জোরে জোরে হাঁচি দিলাম। আমার মাথাটা কেমন রক্তশূন্য হয়ে গেছে। রাগ আর অপমানে আমি দু হাত দিয়ে মুখ ঢাকলাম। কিন্তু সেটা কয়েক মুহূর্ত মাত্র। মোহন কাঁধে চাপ দিয়ে আবার আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিলো। সিগারেটের প্যাকেট থেকে সেলোফিন সরানোর মত অযত্নে আমাকে উন্মুক্ত করলো। তারপর পাঁচ মিনিট ধরে ওর শরীরের তৃপ্তি মিটিয়ে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে গেলো। আমার চোখের পানিতে বালিশ ভিজে যাচ্ছে, মোহন সেটা দেখেও গ্রাহ্য করলো না। একটু পর ওর নাক ডাকার শব্দ পাওয়া গেলো।
পরদিন ভোরে ঘুমে ভেঙ্গে দেখি মোহন নিজেই চা নিয়ে এসেছে। আমার দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বললো,
-নাও, সোনামণি, চা খেয়ে নাও।
আমি বললাম,
-প্লিজ মোহন, আমার চা খেতে ইচ্ছে করছে না।
-প্লিজ মিষ্টি পাখি, চা খেয়ে নাও। আমি তোমার পায়ে পড়ছি।
মোহন অদ্ভুত চরিত্রের মানুষ। অন্যায় অপরাধ করে নিজেই কান্না কান্না ভাব করবে। প্রয়োজনে পা ধরে মাফ চাইবে। মনে হবে যেন দোষটা আমিই করেছি। অন্যের মনে মিথ্যে অপরাধবোধ ঢুকিয়ে দেয়ার ও একটা পাকা ওস্তাদ। মোহনের পায়ে পড়ার আরেকটা অর্থ আছে। আমি যদি ওর কথামত এখন চা না খাই তাহলে সে ভীষণ রেগে যাবে। কিন্তু এক ফোঁটাও রাগারাগি করবে না। জোর করে মুখ হা করিয়ে চা গিলিয়ে দেবে। মোহন না বলা একদম সহ্য করতে পারে না।
অথচ বিয়ের আগে এই মোহনকে দেখে মনে হয়েছে এত ভদ্র আর বিনয়ী মানুষ দ্বিতীয়টি নেই। বাইরে কাউকে বললে বিশ্বাসই করবে না মোহন কোন রকম অভব্য আচরণ করতে পারে। আমি চায়ে চুমুক দিতেই মোহন খুশী হয়ে বললো,
-এই তো আমার লক্ষ্মী সোনা, চাঁদের কণা। তুমি তো জানো তোমাকে আমি কত ভালোবাসি রূপা। আমার জীবনের চেয়েও বেশী।
আমি ওর মিথ্যা কথার কোন উত্তর দিলাম না। মোহন বিস্কুটে কামড় দিয়ে বললো,
– প্রতি রাতে আমাকে কেন অমন করতে হয়, তুমি বুঝো না?
এবার কোন জবাব না দিলে মোহন ক্ষেপে যাবে। ছোট করে বললাম,
-কেন করতে হয়?
আমার পাল্টা প্রশ্নে মোহন বিরক্ত হলো। বললো,
-কেন করতে হয় এখনো বুঝো নাই? আমি বলি নাই তোমাকে পরিষ্কার করে?
-তুমি বলেছো তুমি বাচ্চা নিতে চাও না।
-এই তো, তাহলে না বুঝার ভাণ করো কেন? তুমি কি ল্যাবেন্ডিশ?
আমার মুখে বোধহয় একটা ম্লানিমার ছায়া পড়লো। মোহন সামান্য নরম হয়ে বললো,
-শোনো লক্ষ্মী সোনা, তুমি তো জানো তুমি আমার জান। শুধু চাই না এখুনি বাচ্চা নিয়ে আজাইরা ফেঁসে যেতে।
বাচ্চা না চাইলে ও নিজে কন্টাসেপ্টিভ নেয় না কেন? ও তো দেখে আমার কত ফিজিক্যাল রিয়েকশন হয়। এ কথা একবার বলেছিলাম, ও কোন শব্দনা করে আমার গালে চড় বসিয়ে দিয়েছিল। আমার শ্বশুর সাহেব অনুরোধ করেছেন মোহনকে নিয়ে কিছুদিন ধৈর্য ধরতে, মায়ামমতা পেলে নাকি পাথরেও ফুল ফোটে, মোহন নিশ্চয় আস্তে আস্তে ভালো হয়ে যাবে। তাই আপাতত দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছি। মোহনের কথার উত্তরে না বলে পারলাম না,
-মনে আছে বিয়ের আগে বলেছিলে তুমি বাচ্চা কত পছন্দ করো?
মোহন ভ্রু কুঞ্চিত করলো। মোবালইটা টেবিলে রেখে জামার আস্তিন গুটাতে গুটাতে আমার দিকে কটমট করে তাকালো। আমার ভয় লাগলো ও বোধহয় খুব রেগে যাবে। অবশ্য এ কদিন সংসার করে বুঝে গেছি দিনের আলোয় ও কখনো রাগ দেখায় না। মানুষের কাছে ওর একটা ইমেজ আছে, সেটা সে কখনোই নষ্ট হতে দেবে না। মোহন আমার সামেন এসে মিহি স্বরে বললো,
-সোনামণি, খামোখা বুঝে না বুঝার ভাণ করো না। বিয়ে করার জন্য ছেলেদের অনেক হু হা করতে হয়। ভাও ধরতে হয়। এটাই কালচার। বিয়ের আগে আমি কত কথাই বলেছি, সব সিরিয়াসলি নিলে চলবে?
-মানে, তুমি ওগুলো মিন করোনি?
মোহন আমার প্রশ্নে বিচলিত না হয়ে বললো,
– আমি কি বোকা নাকি রাম ছাগল যে বিয়ের পরই বাচ্চা নিয়ে ধরা খাবো? বিয়ের প্রথম তিন বছর হলো ফুর্তি করার সময়।
-কিন্তু আমি তো তোমার সব কথা বিশ্বাস করেছিলাম।
-অত কিন্তু কিন্তু করো না রূপামণি। তুমি একটা ইনোসেন্ট মেয়ে। দুনিয়াদারির কিছুই বুঝো না। হুট করে ঝোঁকের বশে বিয়ে করে কনফিউজড হয়ে আছো। রিটেইল থেরাপি দিলে তুমি ঠিক হয়ে যাবে। চলো একটু বাইরে বেরিয়ে আসি।
মোহন যে রাতে গায়ে হাত বেশী হাত তুলে, তার পরদিন আমাকে দামী কিছু কিনে দেয়। কখনো পারফিউম, কখনো কাপড়। গিল্টট্রিট। ওর ভাষায় রিটেইল থেরাপি, যেন আমার কোন রোগের চিকিৎসা। আমি বললাম,
-কোথায় যাবে?
-আমি আর তুমি বসুন্ধরা মার্কেটে যাবো। খান ব্রাদার্সে খুব ভালো ইন্ডিয়ান শাড়ি এসেছে। তোমাকে দুটো শাড়ি কিনে দেবো। নাস্তা করেই বের হবো
আমাকে রেডি হবার আদেশ দিয়ে মোহন পাশের ঘরে গেলো। তিন মাস আগের মোহন আর এই মোহনকে আমি কোনভাবেই মেলাতে পারি না। বিয়ের আগের মোহন ছিল পারফেক্ট জেন্টলম্যান। ভুবন ভোলানো মিষ্টি হাসি দেখে বোঝার উপায় ছিল না ওর মাঝে কোন নিষ্ঠুরতা থাকতে পারে। ভেবেছিলাম যার হাসি এত সুন্দর তার মনটা নিশ্চয় আরও সুন্দর। ও যখন বিয়ের প্রস্তাব করেছিলো, আমি প্রথমে রাজি হইনি। কিন্তু রঞ্জনের আসল চেহারা তখন বের হয়ে আসছিল। ওদিকে মার অসুস্থতায় মোহনের ফেরেশতার মত ভূমিকা দেখে আমার মন দ্রবীভুত হয়ে গেলো। মোহন বলেছিল আমাকে না পেলে আর কাউকে বিয়ে করবে না। কেউ আমাকে চাপ দেয়নি, নিজের সিদ্ধান্তে বিয়ে করেছি। কিন্তু বিয়ের পর দেখছি এই লোক ক্ষণে ভালো, ক্ষণে খারাপ। এখন সহ্য করা ছাড়া উপায় কী?
সেদিন বসুন্ধরায় গিয়ে মোহন সত্যি সত্যি আমাকে দুটো শাড়ি কিনে দিলো। আমার না, ওর পছন্দ মত। দোকান থেকে ফেরার পথে মোহন বললো,
-চলো ফুড কর্নারে গিয়ে চটপটি খাই।
ওই মুহূর্তে মনে হলো মোহন খুব ডমিনেটিং, কিন্তুএকটু মায়ামমতা দিলে ধীরে ধীরে ভালো হয়ে যাবে। আমরা যখন ক্যাফেতে চটপটি অর্ডার করে বসে আছি তখন সামনের টেবিল থেকে একটা মেয়ে উঠে এলো। মোহনেরর দিকে তাকিয়ে মেয়েটি বললো,
-মোহন, কতদিন পর দেখা, কেমন আছো?
মোহন সামান্য বিব্রত হয়ে বললো,
-ভালো, তোমার কী খবর লিসা?
লিসা অভিমানের স্বরে বললো,
-আমি বাঁচলাম কী মরলাম তাতে কার কী বা এসে যায়। ইনি কে?
-আমার স্ত্রী, রূপা।
-কী আশ্চর্য! তুমি বিয়ে করেছো? জানি না তো।
-তাড়াহুড়া করে বিয়ে করলাম। সবাইকে জানাতে পারিনি।
-তা ছাড়া আর কী উপায় ছিল? জানলে সবাই হামলে পড়তো। হা হা হা।
লিসা আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
-আজ ব্যস্ত তাই কথা বলতে পারলাম না ভাবী। আরেকদিন অনেক গল্প করবো। জেনে নেবো এত মেয়ের হাত থেকে এই লোককে আপনি কীভাবে ছিনিয়ে নিলেন।
আমার মুখ কালো হয়ে গেলো কিন্তু আমি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলাম। ফেরার পথে মোহন নিজেই বললো,
-লিসার কথা সিরিয়াসলি নিও না। ও সব সময় ফাজলামো করে।
সেদিন রাতে আবার মোহন আমার উপর চেপে বসলো। জোর করে পিল গেলালো। মোহনকে এতো বুঝালাম কন্ট্রাসেপ্টিভ নিলে আমার ব্লিডিং আরম্ভ হয়, সহজে থামে না। কিন্তু মোহনের তাতে কোন যায় আসে না। ও নিজের আনন্দটাই বোঝে। একটা স্বার্থপর পশুকে কোন দুঃখে বিয়ে করলাম নিজেই ভেবে পাই না। কিন্তু আল্লাহরও বিচার আছে। মোহনের এত সাবধানতার পরও শরীর জানান দিলো নতুন প্রাণের সম্ভাবনা। আমার প্রেগন্যান্সি টেস্ট রেজাল্ট পজিটিভ এলো। মোহন যখন বাড়ি ফিরলো তখন রাত হয়ে গেছে। আকাশে পূর্ণিমা চাঁদ। খুব ইচ্ছে ছিল মোহন এলে ওকে নিয়ে ছাদে যাবো। চাঁদের আলোয় হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমার প্রেগন্যান্সির কথা বলবো। ও নিশ্চয় আমার আবেগটা বুঝবে। শুনেছি বাবা হলে ছেলেরা অনেক বদলে যায়, সংসারে টান আসে। সেদিন শাড়ি পরে, কপালে টিপ দিয়ে সুন্দর করে সেজেছিলাম। মোহন আমাকে দেখে খুশী হয়ে বললো, ইস তোমাকে কী যে সুন্দর লাগছে, আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না। ও ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলো। আবার আমার গায়ে চেপে পিল খাওয়াতে যাবে, তখন আমি ঠান্ডা গলায় বললাম,
-পিলের দরকার নেই।
-দরকার নেই মানে?
-আমি প্রেগ্ন্যান্ট।
-কী বলছো, পাগল নাকি?
মোহন ওর নিজেরটুকু আদায় করে নিতে তবু ভুললো না। পরদিন থেকে মোহন অস্থিরভাবে ছোটাছুটি আরম্ভ করলো। কখনো পীরফকিরের কাছে থেকে পড়া পানি নিয়ে আসছে, কখনো হাতুড়ে ডাক্তারদের কাছে থেকে নানা রকম শেকড়বাকড়ের তেঁতো রস এনে আমাকে জোর করে গেলাচ্ছে । ওগুলো খেলে নাকি ভ্রুণ নষ্ট হবে। কিন্তু কিছুতেই কোন কাজ হলো না। বাবার অনাদর অবহেলা অগ্রাহ্য করে আমার গর্ভের ভ্রূণটা দিনদিন মা’র আদর আহলাদে পৃথিবীতে আসার জন্য তৈরি হতে লাগলো। আনন্দ গোপন রাখা আমার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ালো। আমার হাসিখুশী মুখ শ্বশুরবাড়ির কারও দৃষ্টি এড়ালো না। কিন্তু মোহন মানা করে দিয়েছে আমি যেন প্রেগ্ন্যান্সির কথা কাউকে না বলি। কেন কে জানে।
পরের শনিবার মোহন ওর ভুবন ভোলানো মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বললো,
-রুপামনি, কাল দুপুরে এক বন্ধুর বাসায় আমাদের দাওয়াত আছে। তুমি রেডি হয়ে থেকো, আমি অফিস থেকে এসে তোমাকে নিয়ে যাবো।
আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। শেষ পর্যন্ত মোহনের সুমতি হয়েছে। কত দম্পতি আইভিএফ ট্রিটমেন্ট করেও ছেলেমেয়ে পায় না। সেদিক থেকে আমরা সৌভাগ্যবান যে আল্লাহ আমাদের দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন, আমার ভেতরে বেড়ে উঠছে অমূল্য প্রাণ। বাবা ঠিকই বলেছিলেন, মায়া মমতা দিলে আর কিছুদিন সহ্য করলে মোহন ভালো হয়ে যাবে।
রবিবার বিকেলে বসুন্ধরা থেকে মোহনের কেনা হাফ-সিল্কের কটকি শাড়িটা পড়লাম। চোখে গাঢ় করে কাজল মেখে, কপালে কালো টিপ দিয়ে বাড়ির একমাত্র বউয়ের মত সুন্দর করে সাজলাম। গাড়িতে উঠে মোহন আমার হাত ধরলো। সেই আলতো স্পর্শ আমার মনে গিয়ে বাজলো। মোহনের এই মায়াটুকুই এতদিন মিস করছিলাম। বিশ্ব সংসারের প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে উঠলো।
আধঘন্টা পর শ্যামলিতে ওর বন্ধুর বাসায় চলে এলাম। মোহন পারফেক্ট জেন্টলম্যানের মত গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইলো। মোহনের বন্ধুর বাসার ঢোকার সময় ভীষণ আনন্দ হলো। বললাম,
-বাড়ির সামনে আরোগ্য নিকেওন লেখা কেন? তোমার বন্ধু কি ডাক্তার?
-হ্যাঁ, ও তো ডাক্তার। ক্লিনিক আর আর বাসা এক সঙ্গে।
আমরা দোতালায় উঠে কলিং বেল দিতেই মোহনের বন্ধু নিজেই দরজা খুলে আমাদের ভেতরে নিয়ে গেলেন। মোহন পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললো,
-রূপা, এ আমার স্কুল জীবনের ফ্রেন্ড আশফাক। সব সময় ক্লাসে ফার্স্ট হতো।
আশফাক ভাই আমাকে সালাম দিলেন। আশফাক ভাইয়ের ড্রইং রুমটা খুব বড়। ঘরেরে ভেতর অনেক চেয়ার। আমি প্রশ্নাতুর চোখে মোহনের দিকে তাকালাম। মোহন বললো,
-এটা আশফাকের ক্লিনিকের লাউঞ্জ, ওর অ্যাপার্টমেন্ট চার তলায়।
-তাহলে আমরা ওনার ক্লিনিকে কেন?
মায়া মায়া ভাব কহনেমোহনের চোয়াল আবার কেমন শক্ত হয়ে গেছে। মোহন বললো,
-রুপামনি,আশফাকের এখানে যখন বেড়াতে এসেছি, ভাবলাম তোমার একটা থরো চেক আপ হয়ে যাক।
ঠিক তখনই দুজন নার্স আমাকে ওখান থেকে পাশের ঘরে নিয়ে গেলো। ওরা আমাকে একটা বিছানায় শুইয়ে দিলো। গতকাল মোহন বাড়িতে নার্স এনে আমার রক্ত নিয়েছিলো। বলেছিল বাচ্চার হেরিডিটারি কোন রোগ হতে পারে কিনা পরীক্ষার করাবে। আজকের থরো চেক আপেরর জন্যই বোধহয় ওটা করেছিল।
মোহনের ডাক্তার বন্ধুটি এই মাত্র একটা মাস্ক আমার নাকেমুখে চেপে ধরেছে। আমি ধীরে ধীরে ঘুমের দেশে চলে যাবার আগে আবছা শুনতে পেলাম মোহন আমার কানের কাছে মুখ এনে বলছে,
-সোনামণি, চিন্তা করো না, অ্যাবরশনের পর সব আগের মত হয়ে যাবে।
(চলবে)
প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ২৮
সেদিন বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে গেলো। একদিকে শরীর খারাপ, অন্যদিকে মনের ভেতর তীব্র রাগ আর ঘৃণা। আমি কারও সাথে কথা না বলে সোজা বিছানায় চলে গেলাম। চোখ বন্ধ করে অসাড় হয়ে বিছানায় পড়ে রইলাম। মোহন আজ আর আমাকে ঘাটালো না। সবাইকে বললো আমার খুব মাথা ধরেছে।
পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে আমি ব্যাগ গুছাতে আরম্ভ করলাম। কখনো ভাবিনি আমার সংসার মাত্র তিন মাস স্থায়ী হবে। একেই কি বলে তাসের ঘর? মোহন অফিসে যাবার জন্য তৈরী হচ্ছিল। আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
-রূপামনি, কোথাও যাচ্ছো নাকি?
-হুম।
-কোথায়?
-আমাদের বাড়িতে।
-বাড়িতে? কেন কী হয়েছে?
আমি কাপড় গোছানো বন্ধ করে মোহনের দিকে তাকিয়ে বললাম,
-তোমার কী মনে হয়? নিজের স্ত্রীকে রাতের পর রাত অত্যাচার করছো, মিথ্যে কথা বলে অ্যাবর্সন ক্লিনিকে নিয়ে যাচ্ছো। তোমার মত একটা লোকের সঙ্গে আমার কি থাকা সম্ভব?
আমার কাছে থেকে এমন সরাসরি কথা বোধহয় মোহন আশা করেনি। মোহন কয়েক মুহূর্ত থ হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো,
-ঠাট্টা করছো, তাই না?
-মানে? ঠাট্টা করবো কেন? তুমি যে একটা আপাদমস্তক মিথ্যুক আর প্রতারক সেটা জানলে কি আমি কোনভাবেই তোমাকে বিয়ে করতাম? তুমি তো আগে আব্বুকে পটিয়েছো।
-রূপা, কথা কিন্তু তীরের মত, একবার বলে ফেললে পরে ফিরিয়ে নিতে পারবে না। তাই ভেবে বলো প্লিজ।
-আমি ঠিকই বলছি। তোমাকে বিয়ে করে আমি বিরাট ভুল করেছি। আমি আর এ বাড়িতে থাকছি না ।
-তুমি চাইলেই হয়ে গেলো?
-মানে?
-আমি তোমার হাজবেন্ড। আগে ডিভোর্স নাও, তার আগে আমি তোমাকে এখান থেকে কোথাও যাবার পারমিশন চিচ্ছি না।
-কেন? আমি গেলে তোমার কী সমস্যা?
-এত টাকা খরচ করে মাত্র বিয়ে করলাম। এক বছর সার্ভিস না পেলে আমার ফুল লস।
-এক বছর সার্ভিস মানে? কীসের সার্ভিস।
-উফ, তোমার দুই পায়ে পড়ি এত ন্যাকা সেজো না। একটা ছেলে একটা মেয়েকে কেন বিয়ে করে? কোন সার্ভিসের জন্য,বুঝো না? তিনশ পঁয়ষট্টি রাত সার্ভিস দাও, তারপর থাকলে থাকবে, গেলে যাবে।
-আমি কালই তোমাকে ডিভোর্স করবো।
– ডিভোর্স এত সহজ? কেইস হবে, কারণ দেখাতে হবে। এক বছর আগে ছাড়া পাবে না। সুতরাং সোনামণি, মাথা গরম না করে ঠান্ডা মাথায় নিজের কথা ভাবো, তোমার মার ক্লিনিকের খরচের কথা ভাবো, তারপর সিদ্ধান্ত নাও। ওকে? আমি এখন অফিস যাচ্ছি, এখন আর মাথা গরম করতে চাচ্ছি না। এসে কথা বলবো।
মোহনের সাথে তর্ক করে লাভ নেই। ও অফিস যাক। তারপর আমার যা করার আমি তাই করবো। একটু পর মোহন শিস দিতে দিতে অফিস চলে গেলো। আমি নাস্তা সেরে বাবার ঘরে গেলাম। গত এক মাস ধরে বাবার বেডসোর হচ্ছে। আমি অনেক যত্ন করে বাবার পিঠের ব্যান্ডেজ পাল্টে দিই। বাবা প্রতিদিন সকালে আমার অপেক্ষায় থাকেন। কী দুঃখজনক একটা ব্যাপার, মোহন বাদে এই বাড়ির সবার সঙ্গে আমার একটা আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কেমন একটা মায়ার বাধনে জড়িয়ে গেছি। বাবার ব্যান্ডেজ বদলে দিতে দিতে বললাম,
-বাবা, অনেক চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমি আর মোহনের সাথে থাকতে পারছি না।
বাবা কী বুঝলেন কে জানে। বললেন,
-মোহন আমার নিজের ছেলে, কিন্তু আমি জানি ও সাপের মত নিষ্ঠুর আর ঠান্ডা মাথার। তোমাকে কয়েকদিন দেখেই বুঝেছিলাম তুমি একটা আবেগপ্রবণ মেয়ে। ভেবেছিলাম এরকম একটা ইমোশনাল মেয়ে এই যান্ত্রিক ছেলের পাল্লায় কীভাবে পড়লো। তারপর ভেবেছি হয়তো তোমার আলোয় সেও আলোকিত হবে।
আমি বাবাকে বিছানায় শুইয়ে দিলাম। বাবা বললেন,
-আমি তো বুড়ো হয়ে গেছি মা। আমাদের কাছে বিয়ে ভাঙ্গা একটা বড় ব্যাপার, সোশাল ট্যাবু। আমি আর কী বলবো। যা তোমার জন্য ভালো, তুমি তাই করবে।
-আমি আজই চলে যাবো বাবা। আমার আর ভালো লাগছে না।
-জানি না মোহন কীভাবে নেবে, কিন্তু আমি তো প্রতদিন সকালে তোমার যত্নে অভ্যস্ত হয়ে গেছি মা, আমার খুব কষ্ট হবে।
আমার কান্নার স্বভাব, বাবার হাত ধরে কেঁদে ফেললাম। বাবা আমার মাথায় হাত রাখলেন, কিন্তু আর কিছু বলেলন না। সেদিন দুপুরে আমি ট্যাক্সি নিয়ে গাজিপুর চলে এলাম। আব্বু আমাকে দেখে বললো,
-আরে রূপা, তুই হঠাৎ? বলে আসবি না?
-আমি একদম চলে এসেছি আব্বু।
-মানে?
-আমি আর ওখানে ফিরে যাবো না।
আব্বু চমকে উঠে বললেন,
-কেন? মোহনের সঙ্গে কোন সমস্যা হয়েছে? নাকই শাশুড়ির সঙ্গে?
মোহনের সঙ্গে এমন সব সমস্যা হয়েছে যার বেশীরভাগ বাবাকে বলা যায় না। বললাম,
-শাশুড়ি খুব ভালো মানুষ। কিন্তু মোহনের সঙ্গে কিছুতেই মিলছে না। ওর গায়ে হাত তোলার অভ্যাস আছে।
-মোহন গায়ে হাত তোলে? আমি তো ভাবতেই পারছি না। এত ভালো একটা ছেলে।
-তোমার সঙ্গে হয়তো সে ভালো। ও একেক জনের সঙ্গে একেক রকম।
আব্বুর মন খারাপ হয়ে গেলো। সোফায় বসে মুখে হাত দিয়ে অনেকক্ষণ ভাবলো। তারপর বললো,
-তোর চাচা শেয়ারের কিছু টাকা ফেরত দিয়েছে। তোর মার খরচ আমরাই দেখতে পারবো। মোহনকে বলে দেবো ওর আর ইনভল্ভড হবার দরকার নেই। তাছাড়া তোর মার শরীর যত খারাপ বলেছিল, এখন আর ততো খারাপ নেই।
হঠাৎ মনে হলো মোহন কোনভাবে ডাক্তারকে দিয়ে ভুল কথা বলায়নি তো? যেন তাড়াতারি আমাকে বিয়ে করতে পারে? মোহনের পক্ষে কোন কিছুই অসম্ভব না। আমি বললাম,
-মোহনের জন্য এবার পরীক্ষা দিতে পারলাম না। আগামী বছর প্রাইভেটলি পরীক্ষা দেয়ার জন্য অ্যাপ্লাই করবো।
-সবই বুঝলাম, খালি ভাবছি, আর কিছুদিন দেখলে ভালো হতো না? মাত্র তিন মাস হলো। সন কিছু সেটেল হতেও তো সময় লাগে।
-আর কী দেখবো?
– হয়তো ও এভাবেই বেড়ে উঠেছে। আপ্নন মা না থাকায় নিজের স্ত্রীর সঙ্গে কীভাবে ব্যবহার করতে হবে জানে না। তুই চলে আশায় এখন হয়তো ওর একটা শিক্ষা হবে।
-জানি না আব্বু ভবিষ্যতে কী হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি ওর সঙ্গে থাকতে পারছি না। অন্তত এখানে কারো যন্ত্রণা ছাড়া ঠান্ডা মাথায় নিজেকে নিয়ে ভাবতে পারবো।
সেদিন বিকেলে মোহন আমাকে ফোন না করে আব্বুকে ফোন করলো। মোহন নিশ্চয় আব্বুর সঙ্গে মিহি করে কথা বলছে কারণ আব্বুকে উত্তেজিত হতে দেখলাম না। একটু পর ফোন রেখে আব্বু বললো,
-তুই চলে এসেছিস দেখে মোহনের খুব মন খারাপ। কান্না কান্না অবস্থা। বললো ও স্ট্রেসে থাকে বলে তোর সঙ্গে দু একবার খারাপ ব্যবহার করেছে, এমন আর কখনো হবে না। আমার মনে হচ্ছে ও জেনুইনলি স্যরি ফিল করছে।
-তুমি তো জানোই না ও কী করেছে।
-যাই করুক, সে তো স্যরি বলছে। তুই একটু ভাব। মোহন আজ আসতে চেয়েছিল, আমি বলেছি দু একদিন পর আসতে। সে রাজি হয়েছে।
আমি যাই বলি আব্ববু ভাববে আমার রাগের কারণেই আমি চলে এসেছি। মোহন সবাইকে খুব সহজে কনভিন্সড করে ফেলতে পারে। মিনু একদিন কথায় কথায় বলেছে অনেক মেয়েই মোহনকে চিঠি লিখতো। অথচ মোহন বিয়ের আগে বলেছিল, প্রেমিকা তো দূরের কথা, ওর কোন মেয়ে বন্ধুই নেই। তা ছাড়া আমার শ্বশুর সাহেবের বানানো বাড়িরে মোহন ওর বানানো বাড়ি বলে দাবী করেছিল। এ রকম একটা মিথ্যুকের সাথে কতদিন থাকা যায়?
(চলবে)