প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ৩৩
আজ বিকেলে উপসালা থেকে মিতি ফোন করেছিল ।
নানা ব্যস্ততায় এতদিন মিতির কোন খবর নিতে পারিনি। মিতির নিজেরও খুব ন্যালাক্ষেপা সময় গেছে। একদিকে পড়ালেখা, অন্যদিকে রিটেইল শপের কাজ, তার উপর প্রেগন্যান্সি।
আজ শুনলাম মিতির একটা কন্যা সন্তান হয়েছে। নাম রেখেছে অরোরা। কিন্তু সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজ মিতি পেটের ভেতর লুকিয়ে রেখেছিল,
-রূপা, আমি বিয়ে করেছি।
আমি অবিশ্বাস মাখা কন্ঠে বললাম,
-বিয়ে করেছিস মানে? ঠাট্টা করছিস?
-ঠাট্টা না, সত্যি। সারা জীবন কি একা থাকবো? বিয়ে যদি করতে হয় আগে করাই ভালো। তাছাড়া অরোরার তো একটা ফাদার ফিগার লাগবে।
– হোয়াট অ্যা সারপ্রাইজ, কাকে বিয়ে করলি?
-ছেলেটার নাম এড্রিয়ান। সুইডিশ। আমি যে রিটেইল শপে কাজ করি ও সেটার ম্যানেজার।
-সুইডিশ ছেলে বিয়ে করলি?
-হুম, বাঙ্গালী ছেলেদের উপর ভক্তি উঠে গেছে।
– কীভাবে কী হলো, একদম শুরু থেকে খুলে বল।
-কোত্থেকে যে শুরু করি। অনেক কাহিনী। সামনাসামনি মন খুলে বলতে পারলে শান্তি হতো।
-তাহলে কিছুদিনের ছুটি নে। তারপর সবাইকে নিয়ে ইংল্যান্ডে চলে আয় বেরাতে। রায়হানের সঙ্গেও দেখা করে গেলি।
মিতি সামান্য রেগে বললো,
-রায়হান খবিশটার কথা আমাকে বলবি না। আমি কেন ওর সঙ্গে দেখা করবো? জানিস খবিশটা পাপের শাস্তি পেয়েছে?
-কী শাস্তি?
-বেন নেভিস পাহাড়ে উঠতে গিয়েছিল।
-কে, রায়হান?
-হুম, সামান্য একটু উঠতেই পিছলে পড়ে ডান পা ভেঙ্গে তিনভাগ হয়ে গেছে।
-তুই রায়হানের খবর কীভাবে জানলি?’
-আমি খোঁজ রাখি। ফেসবুকে ফলো করি। ওকে শাস্তি দিতে হবে না?
-তুই তো বিয়ে করে ফেলেছিস, বাচ্চা আছে। এখন রায়হানের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলাই ভালো।
-রায়হান অরোরার পিতৃত্ব স্বীকার করলে আমি ওকে মাথা থেকে ঝাড়বো। তার আগে না।
-আচ্ছা তাহলে এড্রিয়ানের কথা বল।
-তুই তো শুনেছিস স্যাটার ডে, সান ডে আমি রিটেইল শপে কাজ করি। আমি প্রেগন্যান্ট দেখে এড্রিয়ান খুব কেয়ারফুল ছিল আমার ব্যাপারে। কেয়ারিং ও বলতে পারিস। একদিম লাঞ্চের সময় বললো, তোমার পার্টনারকে তো কখনো দেখলাম না মিতি। আমি বললাম, আমার পার্টনার নেই, ব্রেক আপ হয়ে গেছে বাংলাদেশে থাকতে। কী আশ্চর্য এড্রিয়ানের দেখি উল্টো খুশীতে চোখ চকচক করে উঠলো। এভাবে গেলো কিছু দিন। একদিন রাতে এড্রিয়ান আমাকে একটা রেস্টুরেন্টে ইনভাইট করলো। আপুকে বললাম, যাবো নাকি? আপু বললো, যা, ঘুরে আয়, একটু ঘোরাঘুরি না করলে দম বন্ধ হয়ে যাবে।। সেদিন সন্ধ্যায় এড্রিয়ানে্র সঙ্গে অনেক আলাপ হলো। জিগেস করলাম ওর কোন মেয়ে বন্ধু আছে কিনা। এড্রিয়ান বললো ওর গার্লফ্রেন্ড ছিল কিন্তু এক বছর হল ব্রেক আপ হয়ে গেছে। এতদিন নাকি কাউকেই ওর ভালো লাগেনি কিন্তু আমাকে দেখে নাকি তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
-তারপর? তুই রাজি হয়ে গেলি?
-সে তো কোন প্রপোজ করেনি, জাস্ট বলেছে ভালো লাগে। আরও অনেকদিন ধরে দেখলাম এড্রিয়ানকে। ওদের বাড়ি গেলাম। ওর বাবা মা চুপচাপ কিন্তু খুব ভালো মানুষ। তারপর একদিন এড্রিয়ান বিয়ের প্রস্তাব করলো। আমার কান্না চলে এলো। সব জেনেবুঝে একটা প্রেগন্যান্ট মেয়েকে এড্রিয়ান বিয়ে করতে চেয়েছে। কত ভালো একটা মানুষ। আমি সঙ্গে সঙ্গে ওর প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। বিয়ের কিছুদিন পরই অরোরা হলো। এড্রিয়ান অরোরাকে অনেক আদর করে।
মিতি ফোন রাখবার পর ভাবলাম, মানুষের জীবন কী অদ্ভুত। এই সেদিন মিতি জাহাঙ্গীরনগরের আনন্দ দীঘিতে পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছিল। আজ সেই মিতি উপসালায় সুইডিশ হাজবেন্ড আর নিজের মেয়ে অরোরাকে নিয়ে সংসার বেঁধেছে।
মনে মনে ভাবলাম, ইস, মোহন যদি মিতির হাজবেন্ডের মত ভালো মানুষ হতো? সেদিন প্রোগ্রাম থেকে ফেরার সময় মোহন ট্যাক্সিতে গজগজ করছিল আমার সাজসজ্জা নিয়ে। আমি বললাম,
-মোহন, মেয়েরা কিন্তু ছেলেদেরকে দেখানোর জন্য সাজে না।
-তাই? তাহলে কেন সাজে?
-নিজের জন্য সাজে। এটা মেয়েদের একটা স্বভাব বলতে পারো।
-নিজের জন্য সাজে আর মৌমাছি এসে ভিড় জমায়।
মনে হচ্ছিল নায়লার কথে জিগেস করে মোহনকে বোবা বানিয়ে দিই। সুমাইয়ার মুখে নায়লার কথা শুনে প্রথমে কষ্ট পেলেও পরে নিজেকে সামলে নিয়েছি। এমন হতেই পারে নায়লাকে মোহনের পছন্দ ছিল আমার যেমন ভালো লেগেছিল রঞ্জনকে। কিন্তু পরে কোন কারণে ওদের সম্পর্ক এগোয়নি। নায়লা ইংল্যান্ডে এসেছে, মোহনও ইংল্যান্ডে এসেছে। এটা কাকতালীয় হতেই পারে কারণ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা পড়ালেখার জন্য নর্থ আমেরিকা, ইংল্যান্ড কিংবা অস্ট্রেলিয়াতেই আসে। এখন যদি রঞ্জন জেলে না থাকতো আর ইংল্যান্ডে চলে আসতো আমার কী করার ছিল?
আবার খারাপভাবে ভাবে ভাবলে কত কিছুই ভাবা যায়। নায়লার বাবা হয়তো নায়লাকে ইংল্যান্ডের প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার ছেলের সাথে নায়লার পছন্দ অপছন্দ উপেক্ষা করেই বিয়ে দিয়েছে। মোহন আমাকে বিয়ে করে সেই কষ্ট ভুলে থাকতে চেয়েছে। পরে হয়তো ওদের আবার যোগাযোগ হয়েছে। সম্পর্কের ছাই চাপা আগুন তখন ভসভস করে জ্বলে উঠেছে। মোহন মাস্টার্স পড়ার নাম করে নায়লার সঙ্গে মেশার জন্যই ইংল্যান্ডে চলে এসেছে। হয়তো সে নায়লার সঙ্গে গোপন অভিসার চালিয়ে যাবে। ইস, অতিরিক্ত ভাবতে ভাবতে আমি হয়তো তিলকে তাল বানিয়ে ফেলছি। একবার কাউকে নিয়ে মনে সন্দেহ জাগলে তাকে খারাপ ভাবার তো কোন শেষ নেই। সন্দেহ বড়ই ভয়ঙ্কর অভ্যাস। কিন্তু সন্দেহ ছাড়া উপায় কী?
আমি ফেসবুকে ঢুকে নায়লার প্রোফাইল খুঁজলাম। সুমাইয়া বলেছিল নায়লা ডিইউ-এ সাইকোলজি পড়তো। একটু সময় নিলেও নায়লাকে খুঁজে পেতে অসুবিধে হয়নি।মেয়েটা মনে হয় প্রতিদিন ফেসবুকে ছবি পোস্ট করে। নানা ভঙ্গিমায় নায়লাকে দেখে আমি সামান্য হলেও ইন্সিকিউরড ফিল করলাম। টিটু ভাই বলেছিল আমি ভোরের শিশির ভেজা শিউলির মত লাবণ্যময়ী। আর নায়লার ছবি দেখে মনে হলো মেয়েটা বাঁকা তরোয়ালের মত চকচকে আর ধারালো। নায়লায় প্রাখর্যে প্রলুব্ধ না হয়ে উপায় নেই। কিন্তু আমি এখুনি মোহনকে কিছু বলবো না। মোহনের পলিসি হলো অফেন্স ইজ দা বেস্ট ডিফেন্স। শেষে নিজের সাফাই গাইতে গিয়ে মোহন অফেন্সিভ হয়ে কী অশান্তি ডেকে আনবে কে জানে। বাচ্চা হবার দুমাস আগে আমি ওরকম ঝামেলা চাই না।
কিন্তু সব সময় কি ঝামেলা এড়ানো যায়? সেদিন মোহন শাওয়ার করছিল। ওর মোবাইলটা বিছানায়। হঠাৎ টুং করে শব্দ হলো। কারো টেক্সট মেসেজ এসেছে। ডিসপ্লেতে মেসেজ প্রিভিউ জ্বলজ্বল করছে। লুকিয়ে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। কেউ লিখেছে,
-প্রিয় সম্মোহন, তুমি লন্ডনে, আমি নটিংহামে, এত কাছাকাছি অথচ কতদূর।
(চলবে)
প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ৩৪
পদ্মপাতা আজ আট মাসে পড়লো। পদ্মপাতা ছোট ছোট হাত পা নেড়ে হামাগুড়ি দিয়ে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে চলে যায়। আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসে। আহ, আমার মন ভরে যায়।
পদ্মপাতাকে পৃথিবীর আলো দেখানোর জন্য রয়েল লন্ডন হাসপাতালে আমার সি সেকশন হয়েছিল। বাইরে তখন শুভ্র তুষার ঝরছিল। লম্বা একটা সুঁই আমার মেরুদন্ডে গেঁথে ওরা যখন স্পাইনাল কর্ড অ্যানেস্থেসিয়া দিলো, মোহন আমার পাশেই ছিল। মোহনকে ভীষণ নার্ভাস লাগছিল। ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছিল। স্বাভাবিক জন্ম হোক আর সিজারিয়ান হোক, নয় মাস গর্ভধারণের পর শিশুর জন্ম দিতে একটা মেয়েকে কী পরিমান ঝুঁকির ভেতর দিয়ে যেতে হয় সে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছিল। নাকি তার নার্ভাস হবার কারণ স্রেফ সুঁইভীতি? কে জানে।
আমাদের সংসারের সমীকরন বদলে গেছে। এখন আমি শুধু মোহনের স্ত্রী নই, আমি তার সন্তানের মা। সে পদ্মপাতার বাবা। দু চাকার সাইকেলের চেয়ে তিন চাকার রিক্সার ভারসাম্য বেশী থাকে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আমাদের ত্রিমুখী বন্ধন সংসারের অনিশ্চয়তা আর অস্থিরতা কাটিয়ে দেবে।
ঢাকায় থাকতে মোহন কথা দিয়েছিল আমার উপর ওসব ব্যাপারে জোর জবরদস্তি করবে না। মোহন এখনো তার কথা রেখেছে। তবে আমাকেও অনেক ছাড় দিতে হয়েছে। রাতবিরেতে পদ্মপাতা কেঁদে উঠলে মোহনের ঘুমে ডিস্টার্ব হয়, মোহন অন্য ঘরে গিয়ে বালিশে মাথা ঢেকে ঘুমিয়ে থাকে। পদ্মপাতাকে আমি একাই সামলাই। দিনেরাতে যতবার পদ্মপাতার ডায়াপার বদলানো লাগে, আমিই বদলাই। তারপর তো রান্নাবান্না, ঘর পরিষ্কার আছেই। আমি সবই মেনে নিয়েছি এই আশায় যে মোহন একদিন সত্যি সত্যি ভালো হয়ে যাবে।
মোহন সম্প্রতি একটা চাকুরী পেয়েছে। এতগুলো টাকা খরচ করে এদেশে পড়েছে। এই চাকুরীটা ওর আত্মবিশ্বাসের জন্য খুব প্রয়োজন ছিল। তবে অ্যাকাউন্টিং পড়ে এখানে এথনিক সেক্টরে কাজ যোগাড় করা কঠিন না। কেউ বিশ্বাস করবে না ইউকেতে বারো হাজার বাংলাদেশী রেস্টুরেন্ট আর টেইকঅ্যাওয়ে আছে। বছর শেষ সবাইকেই সরকারের কাছে হিসেব বুঝিয়ে দিতে হয়। এ কারনেই এখানে বাংলাদেশী অ্যাকাউন্টেন্সি প্র্যাক্টিস রমরমা।
সুমাইয়ার বান্ধবী লিনার হাজবেন্ডের চেমসফোর্ডে একটা টেইকঅ্যাওয়ে আছে। লিনা বললো বৈধ ব্যবসার পাশাপাশি অনেক অ্যাকাউন্ট্যান্ট নাকি গ্রাহককে চাহিবা মাত্র নকল পে স্লিপ বানিয়ে দেয়। অনেক কর্মচারী ওই কম বেতনের পে স্লিপ দেখিয়ে স্বল্প আয়ের মানুষ হিসেবে সরকার থেকে বিশেষ ভাতা এবং বাড়ি বরাদ্দ পায়। আবার রেস্টুরেন্ট গুলোও খরচ বেশী দেখিয়ে ট্যাক্সের টাকা বাঁচায়। মাস্টার্সের পর রোমান রোডে ওরকম একটা অ্যাকাউন্টিং ফার্মেই মোহনের চাকুরী হয়েছে। পাঁচ বছর কাজ করলে পারমানেন্ট রেসিডেন্স হয়ে যাবে। মোহনের ইচ্ছে কাজের ফাঁকে ফাঁকে পরীক্ষা দিয়ে চারটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হয়ে যাবে। তখন ভালো মেইনস্ট্রিম জব পাওয়া সহজ।
মোহন এভাবে ধীরে ধীরে জীবনে সাফল্যের পথে এগোবে। কিন্তু আজ বাদে কাল যদি মোহন আমাক ছেড়ে চলে যায় তখন আমার কী হবে? এ দেশের ডিগ্রী না থাকলে ভালো চাকুরী পাওয়া কঠিন। মোহনকে বলেছি পদ্মপাতা একটু বড় হলে আমি একটা মাস্টার্স কোর্সে করবো। মোহন আপাতত রাজি হয়েছে। কিন্তু টিউশন ফির জন্য টাকা জমাতে হবে। আমাদের বাসার কাছে একটা টেসকো আর একটা মরিসনস গ্রসারি স্টোর আছে। পদ্মাপাতা আরেকটু বড় হলে ওখানে কাজের জন্য অ্যাপ্লাই করবো।
আসলে পড়ালেখা আর কাজের কথা আমাকে শিখী বলেছে। লন্ডনে এসে শিখী মেয়েটাকেই আমার সবচেয়ে পছন্দ হয়েছে। অতন্দ্রিলার সঙ্গে ওর অনেক মিল আছে শুধু রং ছাড়া। অতন্দ্রিলার সবকিছু কালো। শিখীর সবকিছু ময়ূরপুচ্ছের মত রঙিন। জীবনের সমস্ত রঙ্গ যেন ওর যৌবন থেকে উপচে পড়ছে।
ওয়েস্টমিন্সটার অ্যাবির সামনে শিখী বাস্কিং করছিল, মানে রাস্তায় মাইক্রোফোন দিয়ে মিউজিক বাজাচ্ছিল। ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের কাছে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের সুর শুনে আমি থমকে গিয়েছিলাম। তাকিয়ে দেখি শ্যামল-বরণ একটা মেয়ে গভীর মনোযোগে বেহালার ছড়ে সুর তুলছে। ও যখন মিউজিক শেষ করে সবকিছু গুটাচ্ছিল, আমি কাছে গিয়ে বললাম,
-একটা কথা বলতে পারি।
শিখী আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বললো,
-বলুন।
-আপনি কী বাংলাদেশের?
-হ্যাঁ। ক্লাস এইট পর্যন্ত ঢাকায় ছিলাম, তারপর চলে আসি। আপনি বাংলাদেশের?
-জি, আমি রূপা। বেশীদিন হয়নি এসেছি।
-আমি শিখী।
-হঠাৎ সেন্ট্রাল লন্ডনে বেহালায় বাংলা মিউজিক শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। প্রচুর লোকও দেখলাম ভিড় করেছে।
-বেহালায় বাজিয়েছি বলেই সবাই শুনেছে। মিউজিক একা আবস্ট্রাক্ট এবং ইউনিভার্সেল। মিউজিকের ওয়েভে যে যার মনের মত শব্দের নৌকা ভাসাতে পারে। কিন্তু মিউজিকে শব্দ যোগ করলেই ওটা কন্টেক্সচুয়াল হয়ে যায়।
-আসলেই তাই। আপনি যখন বেহালায় সুর তুলছিলেন, আমি ভাবছিলাম আপনি কী গাইছেন, ‘আমি কোথায় পাবো তারে আমার মনে মানুষ যে রে’ নাকি ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’।
কথা বলতে বলতে শিখীর সঙ্গে কী যেন একটা ক্লিক করে গেলো। হতে পারে আমি নিজে খুব গতানুগতিক হওয়ায় খাপছাড়া অদ্ভুত প্রকৃতির মেয়েদের প্রতি বেশী আকৃষ্ট হই। অতন্দ্রিলার মতই শিখীও নিজের মত করে চলে। বাঙালি কমিউনিটির গসিপ কালচারের সঙ্গে তার একবারেই যায় না। তাই না পারতে সে কমিউনিটির সঙ্গে মেশে না। আমরা দুজন কাছের একটা কফি শপে গিয়ে বসলাম। কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললাম,
-আপনার শিখী নামটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। শিখী মানে কী?
-শিখী মানে ময়ূর। কিন্তু…
-কিন্তু কী?
-শিখী শব্দটা মাসকুলিন। ফেমিনিন হলো শিখিনী।
-তাই নাকি? আমার কাছে শিখী শব্দটাই ফেমিনিন লাগছিলো।
-আমিও তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু সেদিন একজন ভুল ধরিয়ে দিলো। ভেবে দেখুন জন্ম থেকে এই ভুলের বোঝা বয়ে চলছি।
-এখন তো বাংলায় মাস্কুলিন, ফেমিনিন সব শব্দ এক করে দিচ্ছে। সেই হিসেবে শিখী নামটা ঠিক আছে।
-বাহ, এটা ভালো বলেছেন। এতদিন ধরে খালি মনে হতো আব্বু আম্মু আমাকে ছেলেদের নাম দিয়েছে।
-জানেন, এই প্রথম কোন বাঙ্গালী মেয়েকে রাস্তায় বাস্কিং করতে দেখলাম।
-এটা আমার ভকেশন, আমার স্ট্রেস রিলিফ হয়। এখান থেকে যা আয় হয় আমি আরএসপিবিকে দিয়ে দিই।
-আরএসপিবি কী?
-নেচার কনজার্ভেশন চ্যারিটি।
-আপনি তাহলে অন্য কোন চাকুরী করছেন?
-নাহ। ইউসিএল-এ পিএইচডি করছি জেনেটিক এঞ্জিনিয়ারিং-এ। সুবিধা হলো ওটা ফান্ডেড পিএইচডি।
শিখীর কথায় আমি অবাক হলাম। যেই মেয়ে ইউসিএল-এ পিএইচডি করছে, সেই একই মেয়ে রাস্তায় ছন্নছাড়ার মত বাজনা বাজাচ্ছে। মেয়েটা দু বাহু বাড়ায়ে জীবনের দুই প্রান্ত ছুঁয়ে আছে। আমার ভাবনায় বাঁধা দিয়ে শিখী বললো,
-তবে ভাববেন না আমি খুব স্বাধীন। এখনো হ্যারোতে বাবামার সঙ্গে থাকি। ওনারা একমাত্র মেয়ের মায়া কাটাতে পারছেন না।
সেদিন বাড়ি ফিরে কেন যেন নিজেকে নিয়ে একটু হতাশ বোধ করলাম। নায়লার টেক্সট দেখার পর থেকে মনের ভেতর একটা কাঁটা খচখচ করছে। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না ক’জন মেয়ের সঙ্গে মোহনের সম্পর্ক ছিল। তাদের ভেতর কত জন মোহনকে আবার চাচ্ছে? মোহন কি আমাকে একটা বোকাসোকা দুধভাত মনে করে? মনের চাপ রাখতে না পেরে একবার নায়লার কথা সরাসরি জিগেস করলাম। মোহন পাত্তা না দিয়ে নখ কাটতে কাটতে বললো
-স্যরি, কার কথা বললে? শায়লা, লায়লা নাকি নায়লা?
-এদের সবাই তোমাকে পছন্দ করে?
-হ্যাঁ। আমার কী করার আছে বলো। ভার্সিটিতে এত মেয়ে আমাকে পছন্দ করতো, আমি কুলিয়ে উঠতে পারতাম না। মাঝে মাঝে মনে হতো আমি মোহন নাকি রাসপুটিন। যা হোক, তুমি কার কথা বলছো? শায়লা, লায়লা নাকি নায়লা?
অগনিত মেয়ে যে ওকে পছন্দ করতো সেটা নিয়ে মোহন বেশ গর্বিত। কিন্তু এত দিনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি মোহনের কথা যাচাই বাছাই না করে বিশ্বাস করা ঠিক না। মোহন যা বলছে তার উল্টোও হতে পারে। মোহনই হয়তো এই মেয়েগুলোর পেছনে ল্যালল্যাল করে ঘুরেছে। পরে একজন দুজন হয়তো ওকে দয়াপরবশ হয়ে পাত্তা দিয়েছে। আমি বিরক্তি চেপে রেখে বললাম,
-আমি নায়লার কথা বলছি। N ফর নায়লা।
-নায়লার কী কথা?
-নায়লা কি এখনো তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করে?
মোহন কী বুঝে সাবধান হয়ে উত্তর দিলো,
-আর বলো না, ও একটা স্টকার। আমার পেছনে লেগে আছে তো লেগেই আছে। বিয়ে হয়ে গেছে তাও আমার পিছু ছাড়ছে না।
-ও কোথায় আছে জানো?
-ইস, হঠাৎ তুমি নায়লাকে নিয়ে লাগলে কেন?
-তোমাদের কি বিয়ের কথা হয়েছিল?
-বুঝলাম না, এখন এ নিয়ে বলছো কেন। আমি একটা সুদর্শন যুবক। ঢাকায় নিজের বাড়ি,গাড়ি সব আছে। এ রকম পাত্রকে তো অনেক মেয়েই বিয়ে করতে চাইবে। নায়লা ইজ ওয়ান অফ দেম, সমুদ্রের তীরে নুড়ির মত। কিন্তু নায়লার কথা তোমাকে কে বললো?
-সেদিন প্রোগ্রামের সময় সুমাইয়া তোমাকে দেখে বললো এই ভাইয়ার তো নায়লার সঙ্গে বিয়ে হবার কথা ছিল। ও তোমাকে চিনতে পেরেছিল কিন্তু তুমি চেনোনি।
-কিন্তু বিয়ে তো হয়েছে তোমার সঙ্গে আমার। ইউ আর দা লাকি ওয়ান। সো ড্রপ ইট। তোমাকেও তো কারাগারে বন্দী রেপিস্ট রঞ্জন বিয়ে করতে চেয়েছে। সেটা নিয়ে আমি কিছু বলি?
আমি মোহনকে সাবধান করতে চেয়েছিলাম, করলাম। দেখা যাক কী হয়। নায়লার আর কোন টেক্সট এর মাঝে দেখিনি। মোহন যদি অফিসে বসে শায়লা, লায়লা, নায়লার সঙ্গে টেক্সট চালাচালি করে তাহলে আমার কিছু করার নেই।
কিন্ত আমাকে ইদানীং যে ব্যাপারটা সবচেয়ে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে তা হলো সন্ধ্যায় ঘরে ফিরলে মোহনের মুখ থেকে ভকভক করে মদের গন্ধ বের হয়।
(চলবে)