প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ৩৯
তিন মাস জেল খেটে মোহন একটু আগে বাড়ি ফিরেছে।
আমি পদ্মপাতার জন্য দুধের সেমাই বানাচ্ছিলাম। মোহন রান্নাঘরে এসে বললো,
-এত ঘিরিঙ্গি করে কারো কোন ফায়দা হলো?
আমি জেনে গেছি মোহন আর ভালো হবে না। বিরক্ত কন্ঠে বললাম,
-বুঝি না তুমি কী বলছো।
-ধোয়া তুলসী পাতা সেজো না রূপা, দেশে গেলে পিটায় তোমারে আমি তামা বানায় ফেলবো। আমি জেলে পচলাম আর তুমি মজা দেখলে?
-আমার কী করার ছিল? আমি তো আর তোমাকে জেলে ভরিনি।
-তুমি হেল্প করলা না কেন?
-কী হেল্প করার ছিল আমার? আর আমাকে হেল্প করতে বলো কেন, আমি কি পদ্মপাতাকে মেরেছি?
-তোমারে কি আডভাইস করেছিলাম? বললাম পুলিশকে বলো পদ্মপাতাকে তুমি মেরেছো। কষ্ট করে একটু জেল খাটো। মাত্র তো কয়েকটা মাস। আমার কথা মানলে না। ভালো মানুষ সাজলে। এখন বংশসুদ্ধ আমাদের বাংলাদেশে ফিরে যেতে হবে। কোন দিন ইউকে ফিরে আসতে পারবো না। ওরা আমাদের ইনফরমেশন আমেরিকার সাথে শেয়ার করবে। আমরা আমেরিকাও যেতে পারবো না তোমার জন্য সবার ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে গেলো। গাধা কোথাকার।
মোহনের শয়তানির ক্ষমতা দিন দিন ফুরিয়ে আসছে। ওর কথায় উত্তেজিত হয়ে কোন লাভ নেই। আমি ঠান্ডা মাথায় বললাম,
-জেল থেকে ছাড়া পেয়েছ পরশু। এখানে এলে আজ। দুই রাত কোথায় ছিলে? এলিটার হাজবেন্ড শুনলাম দেশে। সাদিয়া আপা বললো এলিটার বাসার কাছে তোমাকে ঘুরঘুর করতে দেখেছে।
-কীসের সাথে কী, পান্তা ভাতে ঘি। আমি দুই রাত কোথায় ছিলাম সেটা বড় হয়ে গেলো?
-বলছি, এলিটার এত মায়া, সে তোমার হয়ে জেল খাটতে পারলো না?
-তিন মাস ছিলাম না, এর মাঝে খুব বাড় বেড়েছো রূপা। হাতি খাঁদে পড়লে চামচিকাও লাথি মারে। তুমি এখন চামচিকা সেজেছো। একবার দেশে চলো সুন্দ্রী, দেখি ইউকের কোন শালা আমার হাত থেকে তোমারে বাঁচায়। বাসর রাতের মত একদম সবকিছু ছ্যাড়াব্যাড়া করে ফেলবো।
-আমি বাংলাদেশ যাচ্ছি না, মোহন। তুমি যাও। মানে না চাইলেও তোমাকে ঘাড়ে ধরে বের করে দেবে।
মোহন এবার আমার দিকে আঙ্গুল ইশারা করে হো হো করে হেসে বললো,
-মূর্খ মেয়েছেলে। খাল কেটে কুমীর এনেছো, এখন বলো দেশে যাবা না। তোমারে চুল ধরে ওরা দেশে পাঠাবে। আমার ভিসা বাতিল মানে তোমার আর পদ্মাপাতার ভিসাও বাতিল।
আমি চুলা থেকে সেমাই নামিয়ে বললাম,
-দ্যাখো তো, সেমাইয়ে চিনি হয়েছে কিনা।
মোহন তেতে উঠে বললো,
-রাখো তোমার সেমাই। ডিড ইউ গেট হোয়াট আই জাস্ট সেইড?
-মোহন, আমাকে আর পদ্মপাতাকে বাংলাদ্দেশ যেতে হবে না। আমরা ভিসা চেঞ্জ করেছি।
-ভিসা চেঞ্জ করেছো মানে?
-আমি স্টুডেন্ট ভিসায় ট্রান্সফার করেছি, পদ্মপাতা এখন আমার ডিপেন্ডেন্ট। শুধু তোমার কোন ভিসা নেই।
-কীভাবে স্টুডেন্ট ভিসায় ট্রান্সফার করলে? তোমার মাস্টার্স শেষ না। নাকি পাস করো নাই?
-আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না, তুমি নিজেকে নিয়ে ভাবো। ডিপোর্টেশনের আগে তোমাকে ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে যেতে পারে, জানো সেটা?
মোহন হঠাৎ কিচেন নাইফ হাতে নয়ে বললো,
-আমি গেলে তুমিও যাবা, নইলে সোজা ঘ্যাচাং।
আমি ওর ছুরি নাড়ানো দেখে ঘাবড়ালাম না। শিখী আমাকে পেপার স্প্রে দিয়েছে। বেশে বাড়াবাড়ি করলে সোজা মোহনের চোখে মেরে ৯৯৯ কল করবো। আমি শান্ত কন্ঠে বললাম,
-তোমার সঙ্গে বাংলাদেশ যাবার প্রশ্নই ওঠে না মোহন। তুমি একজন অ্যাবিউজিভ হাজবেন্ড। আমার কথা না হয় বাদ দিলাম। তুমি একজন অ্যাবিউজিভ বাবা। আমি চাইনা তোমার মত একটা জঘন্য লোকের সাথে পদ্মপাতা বড় হোক। গোবরে পদ্মফুল কতদিন থাকতে পারে বলো?
-রূপা। ঠান্ডা মাথায় ভেবে কথা বলো। সোজা ডিভোর্স দিয়ে দেবো হারামী মেয়ে কোথাকার।
-জেলে আমার চিঠি পাওনি?
-কীসের চিঠি?
-ডিভোর্স লেটার? ও বুঝেছি, চিঠি পাওয়ার আগেই তুমি ছাড়া পেয়ে গেছো। আচ্ছা আমার ল-ইয়ারকে আবার কপি পাঠাতে বলবো। ডিভোর্স লেটারের কন্ডিশনগুলো ভালো মত পড়ে নীচের ডান দিকে সাইন করে দিও। কালো কালি দিয়ে করলে ভালো হয়। নীল কালি ফটোকপিতে খারাপ আসে।
মোহন এবার সাদা হয়ে গেলো, রাগে নাকি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললো,
-আমাকে ডিভোর্স করবে তুমি? তুমি একা থাকতে পারবে?
-আমি একা অনেক ভালো থাকবো। এতদিন কেন তোমার সাথে ছিলাম সেটাই আফসোস।
-এইবার বুঝছি আমি, তুমি লুচু বাতেনকে বিয়ে করবে, তাই না?
-সবাইকে নিজের মত ভেবো না। এন্ড অফ দা ডে তুমিই হলে লুচু এবং লুজার।
-শয়তান কোথাকার। ঢাকায় তোমার মান সম্মানের আমি ফালুদা বানিয়ে ছাড়বো। রাতের পর রাত আমার সাথে মজা নিয়েছ। সব ভিডিও আমি ফাঁস করে দেবো।
মোহনের কথায় আমি নির্বাক হয়ে গেলাম। বললাম,
-হাজবেন্ড ওইয়াইফের ইন্টিমেট মোমেন্ট তুমি ভিডিও করেছো? আর ইউ সিক?
-তুমি ভেবেছো খুব বুদ্ধি তোমার। আরে গাধা মেয়ে, রাতে যে মাঝে মাঝে বাতি জ্বালিয়ে করতাম, কী ভেবেছো, তোমার রূপ দেখার জন্য?
-তুমি অসুস্থ মোহন। আগেও বলেছি, ইউ নিড সায়কায়াট্রিক হেল্প।
-প্রথমে আমার বন্ধুদের সাথে তোমার ভিডিও শেয়ার করবো। ওরা তোমার শরীরে প্রতিটা বর্গইঞ্চি চোখ দিয়ে চুক চুক করে চাখবে। ওটাও এক ধরণের রেপ, কী বলো? তারপর তোমার ভিডিও বাজারে ছেড়ে দেবো। যদি সেটা না চাও, ডিভোর্স লেটার উইথড্র করো, আমার সঙ্গে দেশে চলো।
বুঝলাম মোহনকে এতদিন যা ভেবেছি, তারচেয়েও নোংরা সে। মোহন একটা পার্ভার্ট। এদেশের পুলিশের রিপোর্ট বাংলাদেশের পুলিশকেও পাঠাতে হবে। আমি নিশ্চিত অতন্দ্রিলাকে বললে সে ডিজিটাল আইনে কিছু একটা ব্যবস্থা নেবে। আমি মোহনের দিকে তাকিয় শান্ত কন্ঠে বললাম,
-এখুনি ব্যাগ গুছিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যাও। বেশী দেরী করলে আমি পুলিশ ডাকবো। তাছাড়া শিখী এখুনি আসছে।
-শিখী কে? তুমি লেসবি নাকি? ঘরে মেয়ে আনো?
ঠিক তখুনি কলিং বেল বেজে উঠলো। আমি মোহনকে পাশ কাটিয়ে দরজা খুললাম। শিখী ঘরে ঢুকে জিগেস করলো,
-সব ঠিক আছে রূপা?
মোহন আসার পরই আমি শিখীকে টেক্সট করে আসতে বলেছিলাম। বললাম,
-হ্যাঁ, শিখী, থ্যাঙ্ক ইউ ফোর কামিং। ওই যে মোহন। উই আর ইন দা মিডল অফ অ্যা ক্লিন ডিভোর্স। মোহন ওর জামাকাপড় নিতে এসেছে। এখুনি চলে যাবে।
রাগে মোহনের চোখমুখ লাল হয়ে গেছে কিন্তু বাইরের মানুষের সামনে সে কখনো রাগ দেখায় না। মোহন জানে ও গ্যাঁড়াকলে আছে, একটু ঝামেলা করলেই আমি পুলিশে ফোন করবো। শিখীকে হাই, হ্যালো বলে সে বেডরুমে চলে গেলো। পদ্মপাতা লিভিং রুমে টিভি দেখছে। পদ্মপাতার প্রতি মোহনের কখনোই কোন মায়া ছিল না আর মোহনের প্রতিও পদ্মপাতা কোন টান অনুভব করে না।
একটু পর মোহন সুটকেস নিয়ে বেরিয়ে গেলো। বাইরে থেকে ঠাস করে বন্ধ করে দেয়া দরজার দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, দু রাত যখন এলিটার বাসায় কাটিয়েছে, বাকি রাতগুলো ওখানেই কাটাক।
তিনদিন পরই ইমিগ্রেশনের লোকরা মোহনকে বাংলাদেশ পাঠিয়ে দিলো। মোহন বাংলাদেশে নেমেই আমার পেছনে লাগলো। ফেসবুক মেসেঞ্জারে সে বিশ্রী সব মেসেজ পাঠাচ্ছে। মোহনের এক আজেবাজে বন্ধু আমাকে সরাসরি টেক্সট করে জানিয়েছে, ভাবী আপনার ভিডিও দেখলাম। মাইরি বলছি ভাবী, নিজের বউকেও এত গভীরভাবে জানা হলো না। আপনার বাঁ উরুর তিলটা এত কিউট, হাত দিয়ে ছুঁতে ইচ্ছে করছে। দেবেন ছুঁতে? মোহন কিন্তু অ্যালাউ করেছে।
বুঝলাম মোহন শুধু আমাদের অন্তরঙ্গ ভিডিও শেয়ার করেই ক্ষান্ত হয়নি, ওর জঘন্য বন্ধুদের ভাদ্র মাসের লোল-পড়া কুকুরের মত আমার পেছনে লেলিয়ে দিয়েছে। অতন্দ্রিলাকে জানাতেই সে বললো,
-রামছাগলটা বুঝলো না কত বড় ভুল করলো। ওই ভিডিও তো ব্লক করা হবেই, ও র্যাবের হাতে আচ্ছাসে ধোলাই খাবে।
এদিকে সোয়াসে আমার পিএইচডি স্টাডি আরম্ভ হয়ে গেছে। প্রথম বছর রিসার্চ মেথডসহ আরও দু একটা কোর্স নিতে হচ্ছে। অনেকগুলো সেমিনারেও নিয়মিত অংশগ্রহণ করছি। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে, ব্যক্তিগত জীবনের ঝড়ঝাপটা অতিক্রম করে আবার লেখাপড়া নিয়ে মেতে উঠেছি।
একদিন বিকেলে রিসার্চ অফিস থেকে বের হয়ে নীচ তলায় এসে দেখলাম সামনের অডিটোরিয়ামে ভাষা এবং রাজনীতির উপর কনফারেন্স হচ্ছে। এটা অরগানাইজ করেছে পলিটিক্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ ডিপার্টমেন্ট। আমি পিএইচডি করছি ল্যাঙ্গুয়েজ, কালচারস অ্যান্ড লিঙ্গুইস্টিক্স ডিপার্টমেন্টে। এ কারণেই এই কনফারেন্সের নোটিফিকশন চোখে পড়েনি।
ভাষা এবং রাজনীতির উপর কনফারেন্স বলে আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে অডিটোরিয়ামে ঢুলে গেলাম। ফেইস টু ফেইস প্রোগ্রামে এখনও সবাই আসে না। অডিটোরিয়ামে দর্শক সারির অর্ধেকটাই ফাঁকা। । আমি মাঝের সারির একাট সিটে বসে পাশের সিটে আমার ব্যাগ রাখলাম।
এই মুহূর্তে ভারতের জওহরলাল নেহরু ইউনভার্সিটির একজন স্কলার বক্তৃতা দিচ্ছেন। আমি মাঝ পথে ঢুকেছি দেখে ওনার বক্তৃতার শিরোনাম জানি না। কিন্তু উনি বলছেন, আমার বক্তব্য আমি এই বলে শেষ করতে চাই যে, একটা বহুভাষী দেশে ছোট ছোট প্রদেশগুলোর শক্তিশালী স্বায়ত্তশাসন ছাড়া নিজের ভাষার স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করা অসম্ভব।
ভারতীয় ভদ্রলোকের বক্তব্য শেষ হবার পর সঞ্চালক মঞ্চে এসে বললেন, এবারের বক্তব্যের বিষয়, দা পলিটিক্স অফ ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড আইডেন্টিটি ইন ইউক্রেইন। এ বিষয় বক্তব্য রাখবেন ইউসিএল এর পলিটিক্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ডক্টর জামিল হাসান টিটু।
টিটু ভাইয়ের নাম শুনে আমার মনের ভেতর এক হাজার ভোল্টের বজ্র এবং বিদ্যুৎ খেলে গেলো।
(চলবে)