না চাহিলে যারে পাওয়া যায় পর্ব-২৯+৩০

0
480

#না চাহিলে যারে পাওয়া যায়
#পর্ব-২৯

ঝিলিককে ফিরিয়ে এনেছে সৌরভ। নিজেকে পাল্টে ফেলবে এই শর্তে ফিরিয়ে এনেছে ঝিলিককে। তাদের পরিবারে ডিভোর্স এর রেকর্ড নেই। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক যেমনই হোক বিয়ে টিকে থাকতে হবে। তাছাড়া সমাজে তাদের মানসম্মান প্রভাব পতি পত্তি আছে। ঝিলিক ডিভোর্স দিচ্ছে শুনলে সেসব কোথায় যাবে ভেবেই নিজেকে নতজানু করেছে সৌরভ। কথাগুলো বাবা মায়ের কান পর্যন্ত পৌঁছাক তা সে চায় না। তাই ঝিলিকের শর্ত মেনেই ঝিলিককে ফিরিয়ে এনেছে। ফিরে আসলেও ঝিলিক ভীষণ চুপচাপ থাকে। প্রয়োজন ছাড়া একটাও কথা বলে না, নিজের কাজে বেশ সিরিয়াস হয়েছে। কিছু জানতে চাইলে ভীষণ চমকে উঠে এমনভাবে তাকায় যেন কোন কথা ওর কানে ঢোকেনি। সৌরভ ঝিলিকের ব্যবহারে অবাক হলেও ওকে ঘাটে না। নিজের কাজে ব্যস্ত থাকে, ইচ্ছে করেই বাড়িতে দেরি করে ফিরে। এরমধ্যে রুহির প্রেগ্নেন্সির খবর যেন ঝিলিকের মুখে কালিমা লেপন করে দিয়েছে। ওদের বিয়ের বয়স পাঁচ পার হয়েছে অথচ এখনও বাচ্চার খবর নেই। সেদিন শিখা এসেছিলো ওদের কামড়ায়-
“তোমরা আর কতোদিন এমন নতুন কাপল হয়ে ঘুরবে বলোতো? আমরা কি নাতিপুতির মুখ দেখতে পাবো না?”
ঝিলিক মুখ নিচু করে বসে ছিলো নিশ্চুপ। সৌরভ আড়চোখে ঝিলিককে দেখছিলো। শিখা দু’জনকে দেখেই গভীর শ্বাস ফেলে-
“সমস্যা মনে হলে ডাক্তার দেখাও। আমরা শিগগিরই সুখবর শুনতে চাই। ঝিলিক বুঝতে পারছো তো আমার কথা?”
ঝিলিক মাথা নিচু করেই মাথা নাড়ে। সৌরভ সন্দিগ্ধ চোখে ঝিলিককে দেখে। মেয়েটা কি কিছু লুকাচ্ছে তার কাছে? ফিরে আসার মাস তিন চার পার হলেও সৌরভ ঝিলিকের সাথে ইন্টিমেট হয়নি। কাছে গেলেই ঝিলিক কেমন যেন কুঁকড়ে যায়। সৌরভের এবার জোর করতে একদম ইচ্ছে করেছি। থাক মেয়েটা তার মতো। একজনার ইচ্ছেয় কি সম্পর্ক হয়? ঝিলিকের যদি তাকে না লাগে তাহলে সে কেন বার বার নিজ থেকে এগুবে? মা চলে যেতেই সৌরভ ঝিলিককে প্রশ্ন করে-
“তুমি কি কিছু লুকচ্ছ আমার কাছে?”
ঝিলিক কেঁপে উঠে ভিতু কন্ঠে বলে-
“নাহ নাতো, কি লুকবো?”
“কিছু না লুকালেই ভালো।”
সৌরভ উঠে চলে গেলো। ঝিলিক ঠায় বসে রইলো সেভাবেই। সেই রাতে হঠাৎ সৌরভের ঘুম ভেঙে গেলো। ঝিলিক তখন বিছানার অপর প্রান্তে ঠকঠক করে কাঁপছে। ডিম লাইটের আলোয় প্রথমে না বুঝলেও পরে টের পেয়ে সৌরভ এগিয়ে গেলো ঝিলিকের দিকে। মেয়েটা বিরবির করে কিছু বলছিলো। কপালে হাত রাখতেই টের পেলো জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে ঝিলিকের। সৌরভ কান পেতে শুনে বোঝার চেষ্টা করে কি বলছে ঝিলিক। কিছুক্ষণ পরেই সৌরভের চোখে অবিশ্বাস খেলা করে। প্রচন্ড আক্রোশে ঝিলিককে মারতে চাইলেও শেষ মুহূর্তে কি ভেবে নিজেকে নিবৃত্ত করে। সারারাত আর ঘুমালো না সৌরভ। রুমের রকিং চেয়ারে বসে দোল খেতে খেতে ঝিলিকের দিকে চেয়ে রইলো অপলক।

জ্বরের তেজ কমলে সকালে চোখ মেলে তাকাতেই সৌরভকে তার দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে দেখে চমকে উঠে বসলো ঝিলিক-
“তুমি! এতো সকালে উঠেছো যে?”
সৌরভ স্থির চোখে ঝিলিকের দিকে তাকিয়ে থাকে। সৌরভের অচেনা দৃষ্টি দেখে ঝিলিকের সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো, সৌরভ কি সব জেনে গেলো? ঝিলিককে ইশারায় তার সামনে বসার নির্দেশ দিলো সৌরভ। ঝিলিক বিস্মিত কন্ঠে বলে-
“কি হয়েছে?”
“বলছি বসো।”
ঝিলিক ভয়ে ভয়ে বসে সৌরভকে দেখে। সৌরভ বরফ শীতল গলায় জানতে চাইলো-
“তুমি বাচ্চা নষ্ট করেছো?”
ঝিলিকের পুরো শরীর কেঁপে উঠলো। সে কি বলবে ভেবে পেলোনা। সৌরভের এই ঠান্ডা রুপ একদমই অচেনা তার কাছে। রাগ হলে সৌরভ তাকে মারে তার উপর অত্যাচার করে। কিন্তু এতো শীতল আচরণ এই প্রথম। ঝিলিক মাথা নেড়ে হ্যা বলে।
“কেন? কেন করলে এমন কাজ? মা হয়ে এতো নিষ্ঠুর আচরণ কিভাবে করলে?”
ঝিলিক চুপ। সৌরভ চেচিয়ে উঠলো-
“আনসার মি ঝিলিক। কেন করেছো এ কাজ?”
ঝিলিক কেঁপে উঠে সৌরভের চোখে চোখ রাখে, শান্ত গলায় বললো-
“বিকজ ইউ রেপড মি। আমি এরকম ভাবে সন্তান চাই না। ওকে দেখলেই তোমার নোংরা আচরণ মনে হবে আমার। তাই সারাজীবন সহ্য করার চাইতে ওকে মেরে ফেলা উত্তম মনে হয়েছে আমার কাছে। গট ইট?”
সৌরভের শরীরের রক্ত যেন টগবগ করে ফুটছে। মন চাইছে ঝিলিকের গলা টিপে মেরে ফেলতে। সৌরভ টকটকে লাল চোখে ঝিলিকের দিকে এগিয়ে এলো দু’হাত বাড়িয়ে। ঝিলিক পিছিয়ে গেলো না, সে স্ট্যাচু হয়ে তাকিয়ে রইলো সৌরভের দিকে। দেখতে চায় আজ সৌরভ কি করে তার সাথে। দু’জনেই দু’জনকে দেখছে অপলক। সৌরভ খপ করে ঝিলিকের গলা চেপে ধরলো।

★★★

“যে উদ্দেশ্য নিয়ে এতো নাটক করছো সে উদ্দেশ্য পূরণ হওয়ার পথে। এবার কি করবে তুমি? আর কতোদিন এমন থাকবে?”
পুরুষটি উঠে বসলো, হাত দিয়ে মাথার অল্প কাঁচাপাকা চুলগুলো হাতড়ালো-
“যতদিন প্রয়োজন হয় থাকবো। সন্তানের জন্য যা করা তা অন্যায় কিছু না এটা তো মানো?”
মহিলার চেহারায় মালিন্যতা, কাঁপা কাঁপা কন্ঠে ক্ষীন আওয়াজে বলে-
“যদি ও একবারও ঘুনাক্ষরেও জানতে পারে এসব তাহলে কি করবে জানো? আমি তো ভাবতেই পারিনা কি হবে। যে রাগ ওর ভুলে গেছো তুমি?”
“কিছু নাও করতে পারে। এবার পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। আমার আশা এবার অন্তত ও আমাকে বুঝবে।”
লোকটার চাপা আওয়াজ পাওয়া গেলো। মহিলা কিছুসময় তাকিয়ে দেখলো সামনের মানুষটাকে। তারপর শ্বাস ফেলে গম্ভীর হলো-
“বুঝলে তো আর চিন্তা নেই। কিন্তু ও যাতে না বোঝে এমন বুঝ দেওয়ার লোকেরও অভাব নেই এটা জেনে রেখো। এতো টেনশন আর নিতে পারি না বাপু। শরীরে সইছে না।”
“তোমাকে এতো টেনশন নিতে বলেছে কে? টেনশনের ভার আমার তুমি আরামে থাকো।”
ঠিক সেই সময় একটা আর্তচিৎকারে দু’জনেই চমকে উঠলো। মহিলা তাড়াহুড়ো করে বেড়িয়ে এলো কি হয়েছে দেখার জন্য।

“রাযীনকে বলার সময় হয়ে গেছে মনেহচ্ছে।”
“যা করবে ভেবে করবে মা। বড় আব্বু যদি জানে এসব তুমি কিছু বলেছো তাহলে কি করবে জানো তো?”
“কি করবে? কিছু করার ক্ষমতা আছে নাকি তার? শুয়ে শুয়ে কোথায় কি করবে?”
“করবে অনেক কিছু যেটা তুমি আমি ভাবতেও পারি না। দেখছো না সব সম্পদের বিষয়ে কেমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে? কোথায় কি করবে সব সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছে। কেউ যাতে তার কষ্টের সম্পদ নষ্ট না করতে পারে সে বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন সে।”
বেনুর কথায় শিখা ভাবনায় ডুবে গেলো। বেনু আজ যে খবর নিয়ে এসেছে সেটা শুনে শিখার চক্ষু কপালে উঠে গেছে। বেনুর বর জামসেদ গোপন সুত্রে খবর বের করেছে শশুরের হাতে গড়ে ওঠা শিপিং বিজনেসের একান্ন শতাংশের মালিক নাকি রাযীন হবে। খবরটা শুনেই শিখা সর্বাঙ্গ কেমন যেন জ্বালা করে উঠেছে। একটা সময় ছিলো যখন শিখা রাযীন কিংবা শুভ সৌরভকে আলাদা করে দেখতো না। কিন্তু এখন রাযীন বা রেনু ওদের কাউকেই সহ্য হয় না। তাও ভালো রাযীন এতোদিন দেশে ছিলো। সৌরভ তখন এদের সবার কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। শুভটাকেও ভাইজান ভীষণ ভালো বাসতেন। সেসময় তোমার আমার এমন ভেদাভেদ কখনো কারো মনে আসেনি। কিন্তু এখন যেন সবই হিজ হিজ হুজ হুজ। সবাই নিজের হিসাব নিকাসে ব্যস্ত। শিখা ভাবছে ভাইজান এমন কাজ করলো কি করে? তিনছেলেকে সমান অংশ দেবে আর দুইমেয়েকে সমান অংশ। এতো বিভেদ মেনে নেওয়া সম্ভব না। নিজের ছেলে আর ভাইয়ের ছেলের মধ্যে তফাত ভাইজান চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যেন। শিখা কপালে ভাজ তুলে আঙুল কচলাচ্ছে।
“মা কি ভাবছো এতো?”
বেনু অস্থির কন্ঠে জানতে চাইলে শিখা ঘোলাটে চোখে তাকায়-
“একটা বিহিত তো করতেই হবে। ভাইজানের এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে কিছু একটা তো করতেই হবে। যদিও আমি আগেই ভেবে রেখেছি কি করবো।”
শিখার চেহারার ভিলেন মার্কা হাসি ফুটে উঠতেই বেনুর চোখ চিকচিক করে-
“সত্যি কি এমন কিছু করবে? বেচারিকে কেন খামাখা কষ্ট দেবে?”
“ওই তো এখন তুরুপের তাস। ও কষ্ট পেলে রাজ আর ভাইজান দু’জনকে নাচানো যাবে।”
বেনু হাসলো, চোখ দুটোতে প্রতিশোধ স্পৃহা। এই মেয়েটা আসার পর থেকে রেনুটা কেমন যেন পাল্টে গেছে। আগে যে রেনু ওকে ছাড়া একপা চলতো সেই এখন ওকে মাসে দু’মাসেও খোঁজে না। কতোবড় স্বার্থপর ভাবা যায়?

হঠাৎ করে কোন আওয়াজ পেতেই রুহি বন্ধ দরজার পাশ থেকে সরে এলো। ভয়ে ওর গা কাঁপছে। এসব কি শুনলো ও? ওরা কি ওর কথাই আলোচনা করছিলো? কি করবে ওর সাথে? আনমনা হয়ে দোতলায় সিড়ি থেকে নামতে যায়। ঠিক তখনই পা পিছলে যায় রুহির। ভয়ে নিজের সর্ব্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠলো। পেটে তার অনাগত সন্তান বাঁচাতে হবে ওকে।

চলবে—
©Farhana_Yesmin

#না চাহিলে যারে পাওয়া যায়
#পর্ব-৩০

বলে যে রাখে আল্লাহ মারে কে। আপনি ভাবছেন এই দুনিয়ায় আপনার থাকার দিন মনেহয় ফুরিয়ে এসেছে অথচ উপর ওয়ালা নতুন করে আপনাকে বেঁচে থাকার রসদ দিচ্ছে। রুহি পরার সময় ভয়ে জ্ঞান হারানোর আগে ভেবেছিলো ও মনেহয় ওর সন্তানকে হারিয়ে ফেলবে। আর কোনোদিন মনেহয় রাযীনকে দেখতে পাবে না। কিন্তু ওই যে উপরওয়ালার ইচ্ছে? সেই ইচ্ছের ফলশ্রুতিতে সঠিক সময়ে কেউ রুহিকে পতন থেকে বাঁচায়। কেউ ওকে বুকের মাঝে জড়িয়ে নেয়। জ্ঞান ফেরার পরে রুহির হাত আপনাতেই পেটে চলে যায়। সন্তান হারানোর ভয়ে চোখ থেকে অনর্গল পানি পড়ছে। এমনটা তো সে চায়নি। কোন দোষ না করেও কেন সে এতো সাজা পাবে? কেন এ বাড়ির মানুষের জিঘাংসার স্বীকার হবে সে? বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে আসছে রুহির। কান্না জড়ানো কন্ঠে সে জানতে চায়-
“আমার বাচ্চা! আমার বাচ্চা!”
ঘরের বাতি জ্বলে উঠলো। রাযীনের উদ্বিগ্ন মুখ দৃশ্যমান হলো রুহির সামনে। সে রুহির কপালে হাত রেখে নরম কন্ঠে বললো-
“বেবি ভালো আছে রুহি বেবির কিছু হয়নি। তুমি ঠিক আছো তো? কি হয়েছিলো বলো তো?”
বেবি ভালো আছে কথাটা শুনে আনন্দে রুহির চোখ থেকে পানি পড়তে শুরু করলো। সে উঠে বসার চেষ্টা করতেই রাযীন তাকে ধরে বসিয়ে দিলো। রুহি রাযীনের বুকে মাথা রেখে ঝরঝর করে কেঁদে দিলো-
“সত্যি বলছেন? বাবু ঠিক আছে?”
রাযীন রুহির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো-
“হ্যারে বাবা। মিথ্যে বলবো কেন? তুমি নাকি মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাচ্ছিলে শুভ ধরেছে তোমাকে। শুভর জন্যই আজ আমাদের বাচ্চা বেঁচে গেলে রুহি। থ্যাংকস টু শুভ।”
“শুভ!”
রুহি বিরবির করে রাযীনের দিকে তাকালো। তার চোখের দৃষ্টিতে অবিশ্বাস। রাযীন হাসলো-
“হ্যা। ও না থাকলে কি হতো আমি তো ভাবতেই পারছি না। মা খুব রাগ হয়েছে আমার উপর। আমার নাকি অফিস যাওয়া বন্ধ। বেবি না আসা পর্যন্ত তোমার সাথে সাথে থাকতে হবে।”
রাযীনের একটা কথাও রুহির কানে যাচ্ছিলো না। রুহির কানে কেবল শুভর কথা বেজে যাচ্ছিলো। শুভ ওকে বাঁচিয়েছে? কেন? শুভর মা ওকে মেরে ফেলতে চায় আর শুভ বাঁচাতে চায়। কি নাটক মা ছেলের? নিশ্চিত এর মধ্যেও কোন স্বার্থ আছে। শুভ যদি ভাবে এভাবে রুহিকে কাছে টানবে তাহলে ভুল ভাবছে। রুহি কোনদিন আর শুভর হবে না। কখনোই না।
“এই কি ভাবছো?”
রাযীন রুহির গালে টোকা দিলো। রুহি রাযীনের দিকে চাইলো-
“কিছু না। একটু পানি খাওয়াবেন?”
“অবশ্যই। মা তোমার জন্য শরবত বানিয়ে পাঠিয়েছে। ডাক্তার এসেছিলো, বলেছে তুমি ভীষণ উইক। বেশি বেশি খেতে হবে তোমাকে।”
রুহিকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে ওর হাতে শরবতের গ্লাস ধরিয়ে দিলো রাযীন।
“তুমি খাও আমি কাপড় পাল্টে আসি। এতোক্ষণ তোমার জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম।”
রুহি ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। আপাতত মাথার মধ্যে শুভ ঘুরছে। শুভ কি চায় নতুন করে? কোন স্বার্থে বাঁচালো তাকে?

★★★

রুহির চিৎকার হয়তো ঝিলিককে বাঁচিয়ে দিলো। জিভ প্রায় বেড়িয়ে এসেছিলো সেই মুহূর্তে সৌরভের কানে রুহির চিৎকার গেছিলো। ঝিলিক চিৎকার শোনার অবস্থায় ছিলোনা। ও ধরেই নিয়েছিলো ও মারা যাচ্ছে। সেই অবস্থায় হঠাৎ সৌরভ ওকে ছেড়ে দেওয়ায় ও প্রথমে কিছুক্ষণ নেতিয়ে পড়ে রইলো। প্রচুর কাশি হচ্ছিল ঝিলিকের। অনেক কষ্টে চোখ মেলে পানির বোতল খুঁজলো। টেবিলে উপর বোতলটা অলস পড়ে ছিলো। ঝিলিক অনেক কষ্টে উঠে গিয়ে পানি পান করার চেষ্টা করলো। প্রথমবারে পুরো পানিটা মুখ থেকে গড়িয়ে গেলো। দ্বিতীয়বার চেষ্টা করে কিছু পানি খেতে পারলো। আরো কয়েকঢোক পানি পান করে ঝিলিক বিছানায় ঢলে পড়লো। শুন্য দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে ছাদের দিকে। আজ হয়তো সে মারা যেত। বাবা মা এতোক্ষণে খবর পেয়ে হয়তো কাঁদতে বসতো। সৌরভ এতোটা হিংস্র হবে এটা ভাবনাতে ছিলোনা। ঝিলিক ভেবেছে সৌরভের জন্য এসব কোন ব্যাপার না। নিজে বরং মানসিক কষ্টে ছিলো বাচ্চাটা নষ্ট করে। কয়েকদিন অনেক ভেবেছে, বারবার মনে হয়েছে বাচ্চাটা দেখলেই সৌরভের অপমানের কথা মনে হবে। এই বোধ তাড়া করে ফিরছিলো ঝিলিককে। শেষ মেষ সব ভেবে বাচ্চাটা না রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। ভেবেছিলো বাচ্চাটা না রাখলে মনের কষ্ট কিছুটা কমবে কিন্তু বাচ্চা ফেলে আসার পর থেকে বাচ্চাটা যেন সর্বদা ওকে মা মা বলে ডাকছিলো। একটা অপরাধবোধ কুঁড়ে কুড়ে খাচ্ছিলো ওকে। কিন্তু আজ যা হলো তাতে মনের মেষটুকুও কেটে গেলো। যা হয়েছে ভালো হয়েছে কোন আক্ষেপ নেই মনে।
“রুহির জন্য বেঁচে গেলে আজ। তোমার ভাগ্য বিশেষ ভালো বলতেই হবে।”
ঝিলিকের ভাবনায় ছেদ পড়লো। তাকিয়ে দেখলো সৌরভ রুমে ফিরে হিংস্র দৃষ্টি হেনে ওকে দেখছে। ঝিলিক চোখ ফিরেয়ে নিলো। ওর জানার ইচ্ছে হলোনা রুহি কিভাবে তাকে বাঁচালো। সৌরভ ওর দিকে এগিয়ে এলো-
“তুমি কি বুঝতে পারছো কি করেছো তুমি?”
ঝিলিক অনিচ্ছায় সৌরভকে দেখলো-
“তুমি কি বোঝো তুমি কি করো আমার সাথে? অকারণ আক্রোশে নিরপরাধ আমার উপর যে অত্যাচার করেছো এতোদিন তার জন্য তোমার চোখে কখনো অনুতাপ দেখিনি। সেই তুমি এমন প্রশ্ন করছো আমাকে?”
সৌরভ বিচলিত হলো কিছুটা-
“তাই বলে একটা নিস্পাপ প্রান কেঁড়ে নেবে?”
ঝিলিক জবাব দিলো না। উল্টো ঘুরে ঘুমালো। সৌরভের কষ্ট দেখে বুকটা একটু হালকা লাগছে যেন। বুঝুক লোকটা কষ্ট পেলে কেমন লাগে?

★★★

“শিখা, কেমন আছো?”
হঠাৎ করে রোজীকে দেখে মনের মধ্যে ঝড় বইলেও শিখা শান্ত থাকলো। বড় ভাবি তার কাছে কেন এসেছে শিখা জানে না। তবে চেহারা দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা বলতে চান। ভাবি কি কিছু টের পেলো? আড়স্ঠ শিখা মুখে স্মিত হাসি এনে জবাব দিলো-
“ভাবি, কোন দরকার? আপনি এলেন কেন কষ্ট করে? আমাকে ডাকলেই হতো।”
রোজী শিখার সামনে বসলো-
“প্রয়োজনটা আমার বলেই আমি এলাম শিখা। এতে কোনো সমস্যা নেই।”
শিখা উন্মুখ নয়নে রোজীর পানে চাইলো-
“কি দরকার বড় ভাবি। সিরিয়াস কিছু?”
রোজী চুপচাপ কিছু একটা ভাবলো তারপর মুখ তুলে শিখার চোখে চোখ রাখলো-
“তোমাকে একটা অনুরোধ করতে চাই শিখা। রাখবে?”
শিখা চমকে উঠলো। রোজী কখনো এমন করে কথা বলেনি তার সাথে। আজ হঠাৎ কি হলো? শিখা দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো-
“অনুরোধ কেন বড় ভাবি আপনি আদেশ করবেন।”
রোজী স্মান হাসি দিলো-
“আমি অনুরোধই করবো। তুমি রাখবে কিনা বলো?”
“না শুনে বলি কি করে? রাখার মতো হলে অবশ্যই রাখবো।”
মুখে বললেও মনে চিন্তার ঝড় বইছে শিখার। রোজী শিখার হাত ধরলো-
“রুহিকে ছেড়ে দাও শিখা। ওর কোন ক্ষতি করোনা প্লিজ। রাজ পাঁচ বছর দূরে ছিলো সয়েছি কিন্তু এবার এমন কিছু করোনা যা সইতে পারবোনা।”
শিখা স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। ওর মুখে কথা ফুটলো না। রোজী আবার বলতে শুরু করে-
“তোমার দুঃখ আমি বুঝি। চোখের সামনে মেয়ের কষ্ট দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারো না। কিন্তু আমার কথাটাও ভাবো শিখা। আমিও ছেলে হারিয়েছি। আমার দুঃখ তোমার চাইতে কিছু কম নয়। তুমি রাজের কাছ থেকে ঝিলিককে কেড়ে নিয়েছো, ওকে আমাদের থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছো সব তোমার কষ্ট থেকে করেছো ভেবে মেনে নিয়েছি। কিন্তু এবার অন্তত ছাড় দাও শিখা। এবার আমার ছেলেটার সাথে এমন কিছু করোনা। এমনিতেই ওদের বিবাহিত জীবন নিয়ে ওরা ভীষণ দ্বিধায় আছে। নতুন করে ওদের উস্কে দিয় না। এবার ক্ষমা করো শিখা। নিজে শান্তি পাবে বাকী আমরাও।”
শিখা রোজীর হাত ছাড়িয়ে মলিন হাসলো-
“আমার কষ্ট বুঝলেন কোথায় ভাবি? মেয়েটাও যদি মরে যেতো তাহলে ভালো হতো। প্রতিদিন মরতে হতোনা ওর। আর ওকে দেখে আমি কষ্ট পেতাম না। আপনাকে কথা দিতে পারছিনা ভাবি। আমরাও তো নির্দোষ ছিলাম কিন্তু প্রতিনিয়ত সাজা ভোগ করছি। সবই নিয়তি ভাবি। রুহির নিয়তিতে কষ্ট থাকলে তা থেকে কে বাঁচাতে পারবে তাকে?”
শিখা অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসলো। তার চেহারায় কাঠিন্য, চোখ দুটো যদিও ভিন্ন কথা বলছে। ছলছল চোখ দুটোতে স্পষ্ট বেদনা। রোজী কেবল খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলো তারপর রুম ছেড়ে বেড়িয়ে এলো। রোজীর বিশ্বাস ছিলো শিখা অতোটা খারাপ হবে না। কিন্তু এখন কথা বলার পরে বিশ্বাস নড়বড়ে হয়ে গেছে। প্রতিহিংসা শিখাকে বদলে দিয়েছে। রুহি মেয়েটাকে এবার কিছুতেই দুঃখ পেতে দেওয়া যাবে না। তাহলে হয়তো মেয়েটা বাঁচবে না।

চলবে—
©Farhana_Yesmin