ভুলবশত প্রেম পর্ব-২৯+৩০

0
540

#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক

২৯

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের নিকষিত আঁধারে মজে গিয়েছে সম্পূর্ণ আকাশ। দূর আকাশে বসেছে উজ্জ্বল তারার মেলা। সে তারার দিকে চেয়ে চেয়ে আমি কাটিয়ে দিচ্ছি নিষ্প্রভ মুহূর্তগুলো। বারংবার দৃষ্টির সামনে আদ্রিশের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠছে। আমার বলা প্রতিটা কথায় উনার চেহারার প্রতিক্রিয়া আমায় ক্ষণে ক্ষণে ব্যাকুল করে তুলছে। কিন্তু এ ব্যাকুলতার কোনো শেষ নেই। না আছে কোনো সমাধান। দিনশেষে আমার এ অনুভূতি, এ পরিস্থিতি ধীরেধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়বে। হয়তো ভবিষ্যত পরিস্থিতির শিকার হয়ে আদ্রিশকেও একসময় ভুলে যেতে হবে। স্মৃতির পাতা হতে উনার উপস্থিতি মুছে দিতে হবে। দিনশেষে আমি অন্য কারোর সংসারে নিজের সারাজীবন কাটাবো। হয়তো ইচ্ছের বিরুদ্ধে বা হয়তো জীবনের যাঁতাকলে পড়ে!

প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখি আপু আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আপুর হাতে ফোন, চাহনি উদ্দীপ্ত। আমার দিকে ফোনটা এগিয়ে দিয়ে আপু উত্তেজিত হয়ে বললো,
” আম্মু তোর সাথে কথা বলবে। এই নে।”

আমি নিরস চাহনিতে মলিন হেসে আপুর হাত থেকে ফোনটা নিলাম৷ ফোন কানে নিতেই ওপাশ থেকে আম্মু উত্তেজিত হয়ে বললো,
” পরশুদিন ইয়াসির আসবে তোকে দেখতে। পরশুদিন যেহেতু কলেজ নেই তাই সকাল সকাল নাফিসার সাথে বাসায় চলে আছিস। আমি বেয়াইনকে বলে রাখবো এ ব্যাপারে। ”

আম্মুর মুখে ইয়াসিরের নাম শুনে আমি কিয়ৎক্ষণের জন্য থমকে গিয়েছিলাম। হৃদপিণ্ডটা প্রবলতায় একটি ঢিপ শব্দ তুলে ধীরেধীরে মন্থর এবং স্বাভাবিক হয়ে এলো। আমার স্তব্ধতায় পূ্র্ণ অনুভূতি বাস্তবতা মেনে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। কারণ, আমি ইয়াসিরের ব্যাপারে বহু আগে থেকেই অবগত৷ কিন্তু রূপকথার রাজ্যের ভেতরে নিজের পছন্দ, নিজের অনুভূতির বেড়াজালে এ বাস্তবতা বেমালুম ভুলে বসেছিলাম আমি। এ অদ্ভুতুরে আমাকে মাঝেমাঝে আমি নিজেই চিনে উঠতে পারি না। নিজের আচরণে, নিজের অনুভূতিতে ক্ষণে ক্ষণে নিজেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি৷ সঠিক উপলব্ধি করতে পারি না, আসলে আমার এ অগোছালো মনটা কি চায়। আমার এ অগোছালো অনুভূতিগুলো কার সঙ্গ পেতে চায়।
যেমনটা এ মুহূর্তে হচ্ছে।

আপুর অগোচরে আমি চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। অতঃপর আম্মুকে ছোট্ট করে উত্তর দিলাম,
” আচ্ছা আম্মু।” এই বলে আপুকে ফোন দিয়ে দিলাম। আপু ফোনে আম্মুর সাথে কথা বলতে বলতে রুমে চলে গেলো। এদিকে আমি পুনরায় ভাবনার জগতে পাড়ি জমালাম।

গত বছর আব্বুর এক কলিগ আমাদের বাসায় দাওয়াতে আসেন। হুট করে উনি উনার ছেলের জন্য আব্বুর কাছে আমার বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসে। আপু তখন অবিবাহিত ছিলো এবং আপুকে বাদ দিয়ে আমায় পছন্দ করায় ইনিয়েবিনিয়ে সেই আংকেলকে না করে দেয়। কিন্তু উনি অর্থাৎ ইয়াসিরের বাবা সেসময় বললেন, উনি ‘না’ শুনতে চান না। বিয়ে যে এখনই দিতে হবে এমন নয়। আপুর বিয়ের পরই আমার বিয়ে হবে। তাঁর ছেলে বিদেশ থেকে আসার পরপরই আমাদের বিয়েটা দিয়ে দিবে। ব্যস, আব্বু পূর্বপরিচিতির রেশ ধরে তখন ব্যাহিকভাবে রাজি হয়ে যায়। পরে আরো খোঁজখবর নিয়ে সব ঠিকঠাক থাকায় সকলেই রাজি হয়ে যায়। সে সময় আমি আব্বু আম্মুর কথা রেখে বিয়েতে রাজিও হয়ে যাই। কারণ আমার ইচ্ছে ছিলো, আব্বু আম্মুর পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে করবো। কিন্তু এ বিয়েতে শুরু থেকেই আমার খুব একটা আগ্রহ ছিলো না। কিন্তু আব্বু আম্মুর পছন্দ,খুশি ভেবে আমি এই বলে নিজেকে বুঝ দেই যে, একবার বিয়ে হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। হয়তো বা এমনটাই হবে!

ব্যালকনিতে রাখা চেয়ারে বসে বসে আমি নিজেকে নিয়ে ভাবলাম৷ নিজেকে খোঁজার চেষ্টা করলাম। নিজের অনুভূতিগুলো উপলব্ধি করার চেষ্টা করলাম। হঠাৎ আপু এসে আমার পাশের চেয়ারে বসে কোনোরূপ ভূমিকা ছাড়াই জিজ্ঞেস করে বসলো,
” তুই ইয়াসিরকে বিয়ে করতে চাইছিস না?”

আপুর এহেন প্রশ্নে আমি থতমত খেয়ে গেলাম। কিয়ৎক্ষণ আপুর পানে নিষ্পলক চেয়ে রয়ে অতঃপর বললাম,
” তোর এমন কেনো মনে হলো আপু?”

ব্যালকনির কৃত্রিম আলোয় আপুর ঠোঁটের কোনে বিজ্ঞের ন্যায় হাসি দেখলাম। আপু বললো,
” দু তিন বছর হলেও তোর চেয়ে আমি বড়৷ আম্মুর সাথে কথা বলার সময় তোর চেহারার অবস্থা দেখেছি আমি৷ তুই যে বিয়েতে রাজি না সেটা আব্বু আম্মুকে বললেই তো পারিস। ”

আমি কিছুক্ষণ নত মস্তকে বসে রইলাম৷ অতঃপর বললাম,
” আব্বু আম্মু এতে খুব কষ্ট পাবে। ”

” সারাজীবন তুই থাকবি ঐ ছেলের সাথে। আব্বু আম্মু না৷ সেক্ষেত্রে পছন্দটা তোরও তো হওয়া চাই। ঠিক না?”

” হ্যাঁ। কিন্তু আমার সে সাহসটুকু নেই।”

আপু আমার কথা শুনে আমায় আশ্বস্ত করে বললো,
” এ নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। এ আমার উপর ছেড়ে দে। তুই শুধু শিওর হয়ে আমাকে জানা। ”
এই বলে আপু নিমিষের মাঝেই কৌতূহলী কণ্ঠে পুনরায় বললো,
” আচ্ছা তুই কি কাউকে পছন্দ করিস?”

আপুর এহেন প্রশ্নে আমি চট করে আপুর দিকে তাকালাম। আমার চোখেমুখে ক্রমেই আড়ষ্টতা ছেয়ে আসলো। আপু পুনরায় হয়তো আমাকে একই প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলো। কিন্তু এর পূর্বেই ব্যালকনিতে জেবা ভাবী এসে আপুকে বললো,
” তুমি এখানে বসে আছো! আমি তোমাকে ফোন দিয়ে দিয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছি। ”

আপু ঈষৎ চিন্তিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” কেনো, কি হয়েছে ভাবী? কোনো সমস্যা? ”

জেবা ভাবী আপুর প্রশ্নে উত্তেজিত হয়ে বললেন,
” মনে নেই? আজ দুপুরে বলেছিলাম, বাসায় পিজ্জা বানাবো আমরা। ভুলে গিয়েছো না কি?”

আপু এ পর্যায়ে মৃদু হেসে জবাব দিলো,
” না ভাবী। মনে আছে। চলো রান্নাঘরে যাই। ” এই বলে আপু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আমার দিকে চেয়ে বললো,
” তোর সাথে রাতে কথা বলছি আমি। ”

আমি প্রতিক্রিয়াহীন চাহনিতে আপুর দিকে চেয়ে রইলাম। এদিকে জেবা ভাবী আমায় বললেন,
” মিম, তুমিও আসো আমাদের সাথে। ”

এ মুহূর্তে আমার মাঝে তীব্র অনিচ্ছা এবং বিতৃষ্ণা একটি ভাব বিরাজ করায় আমি কৃত্রিম হেসে ভাবীকে বললো,
” আমার পড়া আছে ভাবী। আপনারাই বানান পিজ্জা।”

আমার জবাবে জেবা ভাবী মৃদু হেসে আপুকে নিয়ে চলে গেলেন। অতঃপর আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কিছুক্ষণ চোখের পাতা সন্নিবদ্ধ করলাম। এপার ওপার নানা ভাবনা শেষে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম৷ দূর্বল পা জোড়া এগিয়ে নিয়ে ব্যালকনির রেলিং এর কাছে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ রজনীর চাঁদ তারা খচিত আকাশপানে চেয়ে রইলাম৷ অতঃপর নিচে দৃষ্টি নামাতেই ইমাদ ভাইয়াদের গার্ডেনে আদ্রিশকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। দু হাত প্যান্টের পকেটে পুরে ঘাড় উঁচু করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। উনার আচমকা উপস্থিতি এবং এহেন চাহনিতে আমি যেমন বিচলিত হলাম তেমন বিব্রতও হলাম। আমি নিমিষের জন্য উনার দিকে চেয়ে ভীতসন্ত্রস্ত চাহনিতে এদিক ওদিক তাকালাম৷ কেউ দেখে ফেললো না তো! আদ্রিশকে এভাবে নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে যে কেউ সন্দেহ করবে। তখন যে আমার মান সম্মান সব এ বাড়িতেই খোয়াতে হবে তা ঢের জানা আছে আমার।
ত্রস্ত চাহনিতে চেয়ে আশেপাশে কাউকে না দেখে আমি আদ্রিশের দিকে চাইলাম৷ রগান্বিত হয়ে চাপা কণ্ঠে বললাম,
” আপনার মাথার সত্যিই খারাপ। ওখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো?”

আদ্রিশ মৃদু হেসে ইশারায় বললেন, কিছু শুনতে পাচ্ছেন না তিনি। অতঃপর আঙুলের ইশারায় আমায় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বললেন। এরই মাঝে উনি পকেট থেকে ফোন বের করে নাম্বার ডায়াল করে তা কানে ধরলেন। তৎক্ষণাৎ আমার হাতে থাকা ফোনটি বেজে উঠলো। অর্থাৎ আদ্রিশ আমাকে কল করেছেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি উনার কল দেখে তড়িঘড়ি করে রিসিভ করে উনার দিকে চাইলাম।অতঃপর অকপট রাগ দেখিয়ে বললাম,
” নিজের মানসম্মানের খেয়াল নেই মানলাম। অন্তত আমার মানসম্মানের খেয়াল তো রাখতেন! এভাবে বিনা চিন্তায় হুটহাট আপনি এখানে চলে এলেন!”

আদ্রিশ আমার এরূপ কথায় কোমল হাসি দিয়ে বললেন,
” এসব কাজ বিনা চিন্তায় এবং হুটহাট করতে হয় মিশমিশ।”

” খবরদার আমাকে আর ঐ নামে ডাকবেন না। নেক্সট থেকে আপনার মুখে ঐ নাম শুনলে খবর আছে। ”

” আচ্ছা? কি করবে তুমি?”

” সেটা আপনার ভাববার বিষয় না। ”

” ওকে। দ্যান ডু হোয়াট ইউ ওয়ান্ট। বাট আমি তোমায় এ নামেই ডাকবো। তুমি আমায় মে*রে ফেললেও তোমায় এ নামেই ডাকবো চিরকাল।”

” আশ্চর্য! সাধারণ কথাকে আপনি ম*রার কথায় নিয়ে যাচ্ছেন কেনো? মাথা কি খারাপ হয়ে গিয়েছে না কি?”

আদ্রিশ এক হাত প্যান্টের পকেটে রেখে আমার দিকে স্নিগ্ধ চাহনিতে তাকালেন। অতঃপর মনোমুগ্ধকর সে হাসি দিয়ে বললেন,
” সে তো বহু পূর্বেই হয়েছে৷ ”

আদ্রিশের এরূপ কথা শুনে আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। আমি প্রচণ্ড রাগ দেখিয়ে উনায় বললাম,
” আপনার এসব রঙচঙ মেশানো কথা আমার একদম পছন্দ হয় না। আপনাকে রেস্টুরেন্টে আমার জবাব শুনিয়ে দেওয়ার পরেও আপনি কি কারণে আমার পিছে পড়ে আছেন? রিজেক্ট নামক শব্দটার সাথে কি আপনি পরিচিত না? না কি রিজেক্ট হওয়ার শোক সামলে উঠতে পারেননি আপনি? আপনার সুবিধার জন্য সোজা কথায় আবারো বলে দিচ্ছি আমি৷ আপনি যা চান, সেটা কখনোই সম্ভব না। কখনোই না। শুনতে পেরেছেন আমার সব কথা?”

আদ্রিশ আমার পানে নিস্তব্ধ চাহনিতে চেয়ে আছেন। হয়তো আমার এরূপ ব্যবহার উনি কখনোই আশা করেননি। আদ্রিশ ক্ষণিকের জন্য আমার দিকে একই চাহনিতে চেয়ে রইলেন। অতঃপর শক্ত কণ্ঠে বললেন,
” ওখানেই দাঁড়াও। এক পা-ও এদিক ওদিক নড়বে না। আমি আসছি। ”
এই বলে উনি চট করে কল কেটে দিলেন। চোখের পলকে গার্ডেন ছেড়ে বাড়ির ভেতরের দিকে পা বাড়ালেন। আদ্রিশের এরূপ প্রতিক্রিয়ায় এ পর্যায়ে আমি কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। অতঃপর আদ্রিশের হুমকিপূর্ণ কথাগুলো স্মরণ করতে করতে ত্রস্ত পায়ে রুমের দরজা বন্ধ করতে এগিয়ে গেলাম। আমি স্পষ্ট টের পাচ্ছি আমার হৃদপিণ্ডের অস্বাভাবিক স্পন্দন। শুকনো একটা ঢোক গিলে ফোনটা দ্রুত বিছানায় ফেলে তড়িঘড়ি করে দরজা লক করে দিলাম আমি। নিমিষের মাঝেই দরজার ওপারে আদ্রিশের উপস্থিতি টের পেলাম। আদ্রিশ মৃদু তবে ক্ষিপ্রতার সহিত দরজায় টোকা মারতে লাগলেন। দরজার নিকটে এসে ক্ষিপ্রতার সহিত বললেন,
” দরজা খোলো। আমি সামনাসামনি কথা বলতে চাই। ”

আদ্রিশের এরূপ আচরণের জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম। আচমকা এহেন পরিস্থিতির শিকার হওয়ায় আমি প্রচণ্ড ঘাবড়ে গেলাম। ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো আমার। শুকনো একটা ঢোক গিলে কম্পনরত কণ্ঠে বললাম,
” কিন্তু আমি এভাবে কথা বলতে চাই না। ”

এদিকে দরজায় আদ্রিশের টোকা দেওয়ার শব্দ ক্রমাগত বাড়তে লাগলো। উনি পূর্বের ন্যায় বললেন,
” এ মুহূর্তে তোমার চাওয়া না চাওয়া কোনো ম্যাটার করে না আমার জন্য। আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই মানে চাই। দরজা খোলো। ”

আদ্রিশের এরূপ আচরণে প্রচণ্ড ভয়ে আমার চোখজোড়া ভিজে এলো। আমি কোনো প্রকারে নিজেকে সামলে নিয়ে শক্ত হবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে বললাম,
” আপনি প্লিজ যান এখান থেকে। নিচে কেউ আপনাকে দেখেনি?”

” নিচে কেউ বসে নেই। তুমি কথা না ঘুরিয়ে দরজা খোলো। ”

” নিচে কেউ দেখেনি, এর মানে এই নয় যে, এখনও আপনাকে কেউ দেখবে না। কেউ রুম থেকে বেরুলেই আপনাকে এভাবে দেখতে পাবে। তখন আমার কি হবে জানেন আপনি?”

” তোমার কি হবে তা জেনে আমার লাভ নেই। তুমি কি আমার কথা একবারো ভেবেছো?
এখন দরজা খোলো বলছি। এই যে, এখন আস্তে করে কথা বলছি। কিন্তু তুমি এ মুহূর্তে দরজা না খুললে আমি জোরে কথা বলতে বাধ্য হবো মিশমিশ। এতে এ বাড়ির সবাই কি ভাবলো তাতে আমার কিছুই যায় আসে না।”

আমি পরিস্থিতির যাঁতাকলে পড়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়লাম। শূন্য মস্তিষ্কে অস্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। লক্ষ্য করলাম, আমার চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরছে। আজকের এ পরিস্থিতির জন্য আমি কিছুতেই প্রস্তুত ছিলাম না। এহেন পরিস্থিতিতে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়লাম আমি। অতঃপর নিমিষের চিন্তাভাবনায় দরজা খুলতে উদ্যত হলাম। দরজা খুলতেই……
®সারা মেহেক

#চলবে

#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক

৩০

দরজা খুলতেই সামনে আদ্রিশকে দেখতে না পেয়ে আমি ভীষণ অবাক হলাম। কিছুক্ষণ পূর্বেই তো উনি এখানে ছিলেন। তাহলে চলে গেলেন কখন? অবশ্য উনাকে এখানে না দেখে যতটা না বিস্মিত হলাম এর চেয়েও ঢের স্বস্তি পেলাম৷ কারণ উনি যদি সত্যিই রুমে চলে আসতেন তাহলে মারাত্মক খারাপ কিছু ঘটে যেতো, যা মোটেও কাম্য ছিলো না।
আদ্রিশকে আশেপাশে না দেখতে পেয়ে আমি স্বস্তির সহিত রুমে প্রবেশ করলাম। অতঃপর ওয়াশরুমে গিয়ে ভালোভাবে মুখ ধুয়ে আয়নার দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। আয়নায় আমি নিজেকে দেখলাম না বরং আদ্রিশের প্রতিটি অকল্পনীয় কাজের পুনরাবৃত্তি হতে দেখলাম। আমি কখনো কল্পনাও করতে পারিনি যে আদ্রিশের এ রূপও আমায় দেখতে হবে। উনি আমায় বিয়ে করার জন্য এমন একটা পাগলামি করে বসবে তা পুনরায় চোখের সামনে ভাসতে দেখেই আমার শরীরের প্রতিটি লোম খাঁড়া হয়ে গেলো। কল্পনায় প্রতিটি মেয়েই চায় কেউ তাকে ভালোবাসুক, তার জন্য পাগলামি করুক। কিন্তু বাস্তবে কোনো মেয়ে এ পাগলামির শিকার হলে তার মনোহর কল্পনা এক ভয়ানক বাস্তবে রূপ নেয়। যা তার কাম্য ছিলো না। যা সে কল্পনাও করতো না৷

হঠাৎ ওয়াশরুমের দরজায় নদী টোকা মেরে বললো,
” মিম আপু, নাফিসা ভাবী তোমাকে ডাকছে। ”

আচমকা নদীর কণ্ঠ শোনায় আমি খানিক চমকে গেলাম। অতঃপর নিমিষেই নিজেকে ধাতস্থ করে বললাম,
” তুমি যাও নদী। আমি আসছি। ”

” না আপু। নাফিসা ভাবী তোমাকে আমার সাথেই যেতে বলেছে। এক্ষুনি চলো। ”

অতঃপর আমি কোনোরূপ কথা না বাড়িয়ে ওয়াশরুমের ভেতরে থাকা তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে বেরিয়ে এলাম। নদীকে দেখে মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলাম,
” কেমন আছো নদী?”

নদীও ফিরতি হাসি দিয়ে বললো,
” অনেক অনেক ভালো আছি। তুমি কেমন আছো ভা…ওপস সরি। মিম আপু।” এই বলে সে আমার সামনেই অবিন্যস্ত দৃষ্টিতে চেয়ে জিব কাটলো। ওর এ কাজে আমি ভীষণ অবাক হলাম৷ নদী আমাকে ঠিক কি নামে সম্বোধন করতে গিয়েছিলো তা বুঝতে সময় লাগলো না আমার। অর্থাৎ আদ্রিশ যে আমায় পছন্দ করেন এ বিষয়টা নদী ভালোমতোই জানে। কিন্তু এ মুহূর্তে এ নিয়ে ওকে ঘাঁটাঘাঁটি করার কোনো ইচ্ছেই প্রকাশ পেলো না আমার মাঝে। আমি ঠোঁটের কোনো ঈষৎ ভদ্রতামূলক হাসি এঁটে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললাম,
” চলো নিচে যাই নদী। আপু নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে আমার জন্য। ”

” হ্যাঁ চলো আপু।” এই বলে ও আমার হাত চেপে ধরলো৷ অতঃপর আমরা একত্রে নিচে নেমে এলাম।

সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতেই আদ্রিশের সাথে আমার দৃষ্টি বিনিময় হলো। উনি ড্রইংরুমের সোফায় বসে দু হাত ফোনটি ধরে রেখে বসে আছেন। এ মুহূর্তে উনার দৃষ্টি শান্ত এবং নিষ্পলক। চাহনি এমন যে, আমার উপর খুব রেগে আছেন। কিন্তু সে রাগ আপাতত শীতল রূপে আছে। তবে নিঃসন্দেহে যার বহিঃপ্রকাশ হবে উত্তপ্তরূপে।
আমি কয়েক পলকের জন্য আদ্রিশের দিকে চেয়ে রইলাম। অতঃপর নত দৃষ্টিতে নদীর সাথে রান্নাঘরে চলে এলাম।

ড্রইংরুমের সেন্টার টেবিলকে ঘিরে অবস্থিত সোফাগুলোয় কামাল আংকেল,নাসরিন আন্টী,ইমতিয়াজ ভাইয়া, জেবা ভাবী, কুহু,নদী,আদ্রিশ, আপু ও আমি বসে আছি। সকলের হাতেই পিজ্জার একটি করে প্লেট। প্রত্যেকের খাওয়াই প্রায় শেষের দিকে। এমতাবস্থায় ইমতিয়াজ ভাইয়ার কোলে থাকা ইকরা ছটফট করতে লাগলো৷ হয়তো সে এখন কোলে বসে থাকতে চাইছে না৷ সে চাইছে কেউ তাকে কোলে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করুক। ইকরার এরূপ ছটফটানি দেখে জেবা ভাবী দ্রুত পিজ্জা খাওয়া শেষ করে ইমতিয়াজ ভাইয়ার কোল থেকে ইকরাকে কোলে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে লাগলো।

হঠাৎ নাসরিন আন্টী আপুকে জিজ্ঞেস করলেন,
” কি ব্যাপার নাফিসা? মিমের বলে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে?”

আচমকা এমন একটা কথার বোম ফাটার সাথে সাথেই আমার বুকটা ধক করে উঠলো৷ দৃষ্টি আপনাআপনি চলে গেলো আদ্রিশের পানে। উনার চাহনিতে স্পষ্ট অবিশ্বাসের দেখা মিলছে। নিশ্চয়ই উনি এরূপ সংবাদ শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। মুহূর্তের মাঝেই উনার দৃষ্টি শক্ত হয়ে এলো। লক্ষ্য করলাম উনি উনার বাম হাতের মুঠো শক্ত করে সোফা চেপে ধরলেন। উনার এরূপ প্রতিক্রিয়ায় আমি খানিক ঘাবড়ে গেলাম। সাথে সাথে সাথে দৃষ্টি ফিরিয়ে সেন্টার টেবিলের উপর রাখলাম। আপু আমার পাশ থেকে নাসরিন আন্টীকে বললো,
” হ্যাঁ, আম্মু। পরশুদিন ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে ওকে। ”

নাসরিন আন্টী সায় জানিয়ে বললো,
” হ্যাঁ, বেয়াইন ফোন করে আমায় বললো। কালকেই চলে যেতে বললো তোমাদের।”

কামাল আংকেল এবার আপুকে জিজ্ঞেস করলেন,
” এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো!”

” আরো প্রায় এক বছর আগে থেকেই মোটামুটি বিয়ে ঠিক হয়েছিলো। যদিও আমাদের পক্ষ থেকে তেমন একটা সায় ছিলো না। তবে আংকেল তার ছেলের সাথে মিমের বিয়ে দেওয়ার জন্য এক পায়ে দাঁড়া হবার মতো অবস্থায় আছেন এখনও।”

” ছেলে তোমাদের পরিচিত? ”

” না আব্বু৷ ছেলে আমাদের পরিচিত না। ছেলের বাবা আব্বুর কলিগ। সেই সুবাদেই পরিচিতি দুজনের। ”

” ওহ, তাহলে তো ভালোই হলো। তা ছেলে করে কি?”

” সুইজারল্যান্ডে থাকে। ওখানকার এক কোম্পানিতে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আছে।”

” বাহ৷ ছেলে তো তাহলে ভালোই জব করে। আমাদের মিমের জন্য নিশ্চয়ই ভালো হবে!”

আপুদের কথার মাঝেই আমি আর এক মুহূর্তও বসে না থেকে সোফা ছেড়ে উঠে চলে এলাম। আমার পক্ষে ওখানে বসে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিলো। তীব্রভাবে অনুভব করছিলাম, আদ্রিশ আমার দিকে চেয়ে আছেন এবং উনার এ চাহনি যে অগ্নি শিখার ন্যায় ছিলো এতে কোনো সন্দেহ নেই। ফলস্বরূপ উনার এ চাহনির সামনে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠেছিলো আমার জন্য।

রুমে এসে দরজা বন্ধ করেই বিছানায় শুয়ে পড়লাম আমি। প্রচণ্ড অস্থির অনুভূত হচ্ছে আমার। ভেতরে সব যেনো তালগোল পাকিয়ে আসছে। ভবিষ্যতে আমার কি করা উচিত, কি সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত তা নিয়ে রীতিমতো আমার মাথাব্যথা শুরু হয়ে গেলো। বারংবার আদ্রিশের চেহারা চোখের সামনে ভেসে এলো। ভেসে এলো, কিছুক্ষণ পূর্বে দেখা উনার নতুন এক রূপ। কিছুক্ষণ আগ পর্যন্তও উনি আমার বিয়ের কথা জানতেন না। অথচ এমন এক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছিলেন। তাহলে আমার বিয়ের কথা শোনার পর উনি কি করবেন তা অনুমান করার সাহস হলো না আমার।

—-

আজ শেষের ক্লাস না হওয়ায় দ্রুতই কলেজ থেকে বেরিয়ে এলাম আমি৷ কথা ছিলো কলেজ শেষ হওয়ার পর বাসায় গিয়ে খাওয়াদাওয়া করে আমি আর আপু পার্লারের উদ্দেশ্যে বের হবো। আম্মুর বিশেষ আদেশ ছিলো, আমায় যেনো পার্লার থেকে ফেসিয়াল করিয়ে নিয়ে আসে। সর্বোপরি, আমায় আগামীকাল ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে!
প্রথম দফায় এ নিয়ে আপু ও আম্মুর সাথে বাকবিতন্ডায় জড়ালেও দিনশেষে তাদেরই জয় হলো। আমি কিছুতেই এতে নিষেধ করতে পারলাম না৷ তাদেরকে কিছুতেই বোঝাতে পারলাম না যে, আমি প্রচণ্ড বিরক্ত এতে। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে মুখ ভঙ্গিমায় তাদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম, আমি বিয়েটা করতে চাই না৷ আপু আমার এ ইশারা বুঝলো কি না জানা নেই। তবে আম্মু আমার ইশারা বুঝলো না। তার একটাই কথা, ছেলে এবং ছেলের পরিবার খুব ভালো। এমন ছেলে এ সময়ে এসে খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য বটে। ভাগ্য করে এমন ছেলে পেয়েছি আমি!

বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরও যখন খালি কোনো রিকশা পেলাম না তখন প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। কলেজের রাস্তা পেরিয়ে অপর রাস্তায় আসতেই আচমকা আমার সামনে আদ্রিশ এসে হাজির হলেন। উনাকে অকস্মাৎ এভাবে দেখে ভয়ে আমার আত্মা উড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। আমি তৎক্ষণাৎ ভীত কণ্ঠে উনায় জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনি এখানে কেনো?”

আদ্রিশ এর জবাব দিলেন না। আমার দিকে শক্ত চাহনিতে চেয়ে শান্ত কণ্ঠে বললেন,
” চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসো। কথা আছে তোমার সাথে।”

ব্যস, আদ্রিশের এ কথা আমার শ্বাসপ্রশ্বাস কয়েক সেকেন্ডের জন্য থামিয়ে দিতে যথেষ্ট ছিলো। যে মানুষটার সাথে গতকালের পূর্বেও দিব্যি ঝগড়া করেছি। আজ সে মানুষটাকেই আমি বাঘের মতো ভয় পেয়ে বেড়াচ্ছি। সবটাই ঘটেছে গতকালের সেই ঘটনার পর থেকে। এরপর থেকে যেনো এই মানুষটাই আমার কাছে অন্যরকম হয়ে গেলো।

আদ্রিশের সাথে এ মুহূর্তে আমার কথা বলার সাহস এবং ইচ্ছে, কোনোটাই হয়ে উঠলো না। ফলে আমি উনার প্রস্তাবে বেঁকে বসে বললাম,
” আমি আপনার সাথে কোনো কথা বলতে চাই না। আমি এখন বাসায় যাবো।”

আদ্রিশ আচমকা আমার দিকে মুখ এগিয়ে শক্ত কণ্ঠে বললেন,
” ভালোভাবে বলছি আমার সাথে চলো। তা না হলে, এই সবার সামনে তোমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে আমি দ্বিতীয়বারও ভাববো না। তখন সামলে নিও ব্যাপারটা।”

অতঃপর এই বলে উনি সামনে এগিয়ে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লেন। উনার এ কাজে আমি কিছুক্ষণের জন্য কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়লাম। শেষমেশ একপ্রকার পরিস্থিতির উপর জোরজবরদস্তি করে আমি গাড়িতে বসে পড়লাম। আদ্রিশ আমার দিকে এক পলক চাইলেন। অতঃপর গাড়ি স্টার্ট দিলেন।

প্রধান শহর হতে বেরিয়ে কিছুটা গ্রামীণ পরিবেশের এক পুকুর পাড়ে এসে গাড়ি থামালেন আদ্রিশ৷ জায়গাটা নিস্তব্ধ নিরব। শান্ত দুপুরের ঈষৎ উষ্ণ রোদ এসে শরীরে মৃদু উষ্ণতা ছাড়িয়ে দিচ্ছে।
আদ্রিশ গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়লেন। উনার দেখাদেখি আমিও নেমে পড়লাম। আদ্রিশ গাড়ির সামনে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি উনার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই উনি শীতল কণ্ঠে বললেন,
” তাহলে এ বিয়ের ব্যাপারটা তুমি আগে থেকেই জানতে?”

উনার এ প্রশ্নে আমার স্বাভাবিক অনুভূতি থমকে গেলো। ফলে আমি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার নিরবতা উপলব্ধি করতে পেরে আদ্রিশ পাশ ফিরে আমার দিকে চাইলেন। আমি তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি নত করে ফেললাম। আদ্রিশ পুনরায় আমায় জিজ্ঞেস করলেন,
” কি ব্যাপার? বলো। চুপ করে আছো কেনো?”

আমি নিচু স্বরে জবাব দিলাম,
” হুম।”

আদ্রিশ কিছুক্ষণ নিরব রইলেন। অতঃপর তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন,
” বাহ। তাহলে ম্যাডাম এ বিয়েতে খুব খুশি। তা, ছেলেকে নিশ্চয়ই খুব ভালোবাসো? তাই না?”

আমি তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি তুলে চাইলাম। ফলস্বরূপ আদ্রিশের সাথে আমার দৃষ্টি বিনিময় হলো। আমি অবিলম্বে প্রতিবাদী স্বরে জবাব দিলাম,
” আমি এ পর্যন্তও ঐ ছেলেকে দেখিনি। ভালোবাসা তো দূরের কথা। কাউকে না দেখেও কি আদৌ ভালোবাসা সম্ভব? অন্তত আমার পক্ষে এসব সম্ভব না। ”

আদ্রিশ ঈষৎ ব্যাকুলতার সহিত বললেন,
” তাহলে আমায় কি ভালোবাসো?”

উনার এ প্রশ্নে আমার শ্বাসপ্রশ্বাস থমকে এলো। আমি তৎক্ষনাৎ পুনরায় দৃষ্টিনত করলাম। কারন এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া অসম্ভব আমার জন্য। আদ্রিশ হয়তো আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। অতঃপর জিজ্ঞেস করলেন,
” এ কারণেই সেদিন রেস্টুরেন্টে আমায় ওসব কথা বলেছিলে তাই না?”

আমি দৃষ্টি তুলে বললাম,
” আপনার প্রস্তাবে রাজি না হওয়ার জন্য আমি সেদিন যা যা বলেছিলাম সবটাই ঠিক ছিলো। কিছুই বানিয়ে বলিনি আমি। আর সেদিন এ বিয়ের কথা ভেবে কিছুই বলিনি আমি।”

” ওকে, তাহলে তুমি এ বিয়েতে রাজি না। ঠিক তো?”

” আমি কখন এটা বললাম?”

” তাহলে কি তুমি বিয়েতে রাজি?”

” আমি এটাও বলিনি আপনাকে। ”

” তাহলে কি চাও তুমি? ”

আমি নিশ্চুপ রইলাম৷ আদ্রিশও নিশ্চুপ রইলেন। অতঃপর উনি প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
” একটা কথা জেনে রাখো মিশমিশ, আমি কখনোই তোমাকে অন্য কারোর সাথে সংসার করতে দিবো না। ”

আমি কাতর কণ্ঠে বললাম,
” আমি আপনাকে কখনোই বিয়ে করবো না৷ এটা আমি আগেও বলেছি, আবারও বলেছি। আমার পক্ষে কখনোই আব্বু আম্মুর বিরুদ্ধে যাওয়া সম্ভব না। ”

আদ্রিশ পাশ ফিরে গাড়ির উপর এক হাত ঠেকিয়ে আমার দিকে হুট করে এগিয়ে এসে শক্ত কণ্ঠে বললেন,
” তুমি কি করবে আমার জানা নেই৷ কিন্তু বিয়ে তো আমাকেই করতে হবে। মাইন্ড ইট।”

আমি করুন চাহনিতে চেয়ে বললাম,
” আদ্রিশ, আপনি আমার ফ্যামিলির অবস্থা সম্পর্কে বুঝতে পারছেন না। কোথায় আপনারা আর কোথায় আমরা!”

” খবরদার! এসবের দোহাই দিও না আমাকে। আমার তোমাকে চাই মানে চাই৷ সে যে করেই হোক।”

” আপনি এতোটা স্বার্থপর কি করে হতে পারেন আদ্রিশ?”

আমার প্রশ্নে আদ্রিশ নিজের রাগের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন। আচমকা গাড়ির উপর শক্ত হাতে থাবা মেরে বললেন,
” হ্যাঁ আমি খুব স্বার্থপর। আমার মতো স্বার্থপর কোথাও পাবে না তুমি। কিন্তু এ স্বার্থের পিছনে তুমি আছো। তোমার কারণেই আমি স্বার্থপর হয়েছি মিশমিশ। আমার অবস্থা কি বুঝতে পারছো না তুমি? আমায় উপর কি একটুও দয়ামায়া হচ্ছে না তোমার?”

আদ্রিশের এরূপ কথায় মুহূর্তেই আমার দু চোখ জলে ভরে উঠলো। উনার সামনেই আমি চোখের জল মুছে বললাম,
” আমি আমার আব্বু আম্মুকে খুব ভালোবাসি আদ্রিশ। তাদেরকে কষ্টে দেখা কিছুতেই সম্ভব না আমার পক্ষে। ”

আদ্রিশ কিছুক্ষণের জন্য নিরব রইলেন। আমায় দেখে আদ্রিশ হয়তো পূ্র্বের তুলনায় কিছুটা নরম হলেন। গুমোট গলায় বললেন,
” আমার কষ্ট সহ্য হবে তোমার? আমাকে এতোটা কষ্ট দিয়ে কি করে ভালো আছো তুমি? সেক্ষেত্রে তো তোমাকে স্বার্থপর বলা উচিত মিশমিশ।”

আমি কোনোরূপ প্রত্যুত্তর দিতে পারলাম না। আমার ভেতরটা যন্ত্রণায় ভরে উঠলো। পরিস্থিতিটা ক্রমশই বিষাক্ত হয়ে উঠলো। যা সহ্য করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়লো আমার জন্য। ফলে আমি প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে উনাকে বললাম,
” অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। আমায় বাসায় ফিরতে হবে। আপু চিন্তা করবে খুব।” এই বলে আমি পিছন ফিরে গাড়িতে বসার জন্য উদ্যত হলাম। আচমকা অঘোষিতভাবে আদ্রিশ চট করে পিছন থেকে আমার হাত ধরে ফেললেন। তড়িৎ গতিতে নিজের দিকে ফিরিয়ে ব্যগ্র কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
” শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করছি, তোমার আব্বু আম্মুকে ঐ বিয়ে ভাঙার কথা বলবে কি না?”

আমি কোনোরূপ জবাব না দিয়ে আদ্রিশের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করলাম। আদ্রিশ তো আমায় ছাড়লেনই না বরং পূর্বের তুলনায় আমার হাত আরো শক্ত করে চেপে ধরলেন। বললেন,
” আমার প্রশ্নের জবাব দাও মিশমিশ। জবাব না পাওয়া পর্যন্ত তোমাকে ছাড়ছি না আমি।”

আমি উপায়ন্তর না পেয়ে অনিহা সহিত বললাম,
” বলবো না।”

এ পর্যায়ে আদ্রিশ আমার হাত পূ্র্বের তুলনায় ঈষৎ জোরে চেপে ধরলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
” আমায় বিয়ে করবে কি না?”

আমি এ পর্যায়ে কোনোরূপ চিন্তাভাবনা ছাড়াই জিদপূর্বক কণ্ঠে বললাম,
” এটা একভাবেই সম্ভব। আর তা হলো আপনার স্বপ্নে। আমি যদি ইয়াসিরকে বিয়ে নাও করি, তবুও আপনাকে বিয়ে করবো না। ”

” কেনো? কি কারণ আছে এর?”

” আপনাকে শতবার বলেছি এর কারণ। আমার পক্ষে আর বলা সম্ভব নয়। আপনি বুঝলে বুঝুন, না হলে না বুঝুন। কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকবো। ”

আমার এ কথা শোনার পরই হুট করে আদ্রিশ উনার বাঁধন আলগা করে দিলেন। শান্ত এবং শীতল কণ্ঠে বললেন,
” ওকে ফাইন। তুমি তোমার সিদ্ধান্তে অটল থাকো। আমিও আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকবো। কিন্তু এরপর থেকে যা যা হবে তার সবটার জন্য তুমি দায়ী থাকবে মিশমিশ। ইউ উইল বি রিসপন্সিবল ফর দিস।”
®সারা মেহেক

#চলবে