#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক
৪৩
রিতুর ফোনের স্ক্রিনে রোহান ভাইয়ার নাম্বার দেখে আমি ভয়ার্ত চাহনিতে রিতুর দিকে চাইলাম। আশ্চর্যের ব্যাপার, রিতুও আমার দিকে ভয়ার্ত চাহনিতে চাইলো। আমি কিঞ্চিৎ উদ্বিগ্নতা সহিত রিতুকে বললাম,
” রিতু, রোহান ভাইয়ার কল রিসিভ করিস না। আর রিসিভ করলেও আমার কথা বলিস না। ”
রিতু ফোন হাতে নিতে নিতে বললো,
” চিন্তা করিস না। ভাইয়াকে তোর কথা বলবো না।”
এই বলে সে কল রিসিভ করে রোহান ভাইয়াকে বলল,
” ভাইয়া, কোনো দরকার ছিলো? ”
“…….”
” আমি বাইরে। আমার এক ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে এসেছি। ”
“…….”
” লিজার সাথে দেখা করতে এসেছি। তুমি চিনবে না ওকে। আমি বাসায় বলে এসেছি। ”
“…..”
” আচ্ছা। রাখছি।”
এই বলে রিতু কল কেটে দিলো। মুহূর্তমধ্যেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমি এই ভেবে যে, রিতু আমার ব্যাপারে রোহান ভাইয়াকে কিছু বলেনি৷। রিতু ফোন রেখে আমায় বললো,
” তোর নাম বলতাম না ভাইয়ার কাছে। কারণ তোর সাথে দেখা করার কথা বললে ভাইয়া আমাকে আস্ত রাখতো না। ”
” যাক, ভালো কাজ করেছিস। আজ তাহলে উঠি। আমাকে বাসায় যেতে হবে। ”
রিতু আর কথা বাড়ালো না। ব্যাগ নিয়ে উঠতে উঠতে বললো,
” আচ্ছা চল। আরেকদিন দেখা হবে। ”
আমি রিতুর কথার প্রত্যুত্তর দিলাম না। বরং ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে ওর পাশাপাশি হাঁটা শুরু করলাম। এ মুহূর্তে আদ্রিশকে লোকেশন জানানোর কথা রইলেও আমি কোনো প্রকার ম্যাসেজ দিলাম না উনাকে।
কিছুক্ষণের মাঝেই আমরা রেস্টুরেন্টের বাইরে চলে এলাম। বাইরে বেরিয়ে দেখলাম আদ্রিশ গাড়ির সামনে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমায় এবং রিতুকে দেখে উনি সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। রিতু হাসিমুখে এগিয়ে গিয়ে আদ্রিশকে বললেন,
” কেমন আছেন আদ্রিশ ভাইয়া?”
আদ্রিশ মৃদু হেসে বললেন,
” এই তো ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? ”
” আমিও ভালো আছি। তো এখানে দাঁড়িয়ে আছেন যে?”
রিতুর প্রশ্নে আদ্রিশ আমার দিকে একবার চাইলেন। অতঃপর বললেন,
” ওকে ড্রপ করতে এসেছিলাম। পরে ভাবলাম ওকে একেবারে বাসায়ই নিয়ে যাই। এজন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম। ”
” ওহ আচ্ছা। তাহলে থাকুন আপনারা। আমি আসি আজ।”
এই বলে রিতু সামনের দিকে হাঁটা শুরু করলো। রাস্তার ওপারে ওর গাড়ি দাঁড় করানো।
অতঃপর আমি ও আদ্রিশ একত্রে রিতুকে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। যতক্ষণ রিতুকে দেখা গেলো ততক্ষণ আদ্রিশ বসে রইলেন। আমিও উনার উনার পাশে ফ্রন্ট সিটে বসে রইলাম। ধীরেধীরে রিতুর গাড়ি মিলিয়ে যেতেই আদ্রিশ আমায় বললেন,
” আমাকে এখনও লোকেশন পাঠাওনি কেনো? দ্রুত লোকেশন বলো। আর গাড়ি থেকে নামো। ”
আমি পাশ ফিরে শান্ত চাহনিতে একবার আদ্রিশের দিকে চাইলাম। অতঃপর পুনরায় সম্মুখ পানে চেয়ে বসে রইলাম। আদ্রিশ হয়তো আমার এহেন কাজে কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয়েছেন। এজন্যই হতভম্ব হয়ে বললেন,
” কি ব্যাপার? এভাবে কথা না বলে বসে আছো কেনো? দেরি হয়ে যাচ্ছে তো। আমি এখান থেকে বের হলে ইমাদকে ম্যাসেজ দিয়ে জানাবো। জলদি লোকেশন বলে গাড়ি থেকে নেমে পড়ো। আমি একটা রিকশা ঠিক করে দিচ্ছি। ”
আমি আদ্রিশের সম্পূর্ণ কথার পিঠে ছোট্ট করে বললাম,
” আমিও যাবো আপনার সাথে। ”
এই বলে আমি উনার দিকে চাইলাম। উনার বিস্ময়াভিভূত মুখমণ্ডল দেখার উপযোগী হলো। উনি কিয়ৎক্ষণ শান্ত চাহনিতে আমার দিকে চেয়ে প্রায় ধমকের সুরে বললেন,
” তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে মিশমিশ? তুমি ওখানে যাবে কেনো? ওখানে গিয়ে কি কাজ তোমার?”
আদ্রিশের এরূপ প্রতিক্রিয়া দেখে আমি ভীত হওয়ার পরিবর্তে উল্টো ঠায় বসে রয়ে বললাম,
” আছে একটা কাজ। সে কাজটা না করলেই নয় এমন।”
” কি এমন কাজ শুনি?”
” সেখানে গেলেই জানতে পারবেন। এখন দ্রুত চলুন। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। ”
আদ্রিশ এবার পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ ক্রোধান্বিত স্বরে বললেন,
” মিশমিশ, বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। ভালোভাবে বলছি গাড়ি থেকে নামো। তুমি নিজেও জানো জায়গাটা সেইফ না তোমার জন্য। তারপরও কেনো রিস্ক নিচ্ছো?”
আমি স্মিত হেসে আত্মপ্রত্যয়ের সহিত বললাম,
” আপনি আছেন না আমার সাথে। আমার আর চিন্তা নেই। আর কথা না বাড়িয়ে চলুন এবার।”
আদ্রিশ আমার কথায় ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লেন। কিয়ৎক্ষণ আমার দিকে চেয়ে সংশয় নিয়ে বললেন,
” এতোটা বিশ্বাস করো না আমার উপর। যদি তোমার কিছু হয়ে যায় আমি কখনোই নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না মিশমিশ।”
আমি আদ্রিশের হাতের উপর হাত রেখে পূর্বের ন্যায় বললাম,
” আমার কিচ্ছু হবে না আদ্রিশ। আমি আপনার উপর পুরোপুরি বিশ্বাস করি। আর এও জানি যে আপনি আমার শরীরে একটা আঁচড়ও লাগতে দিবেন না। কারণ আমি আপনাকে চিনি। আমায় নিয়ে আপনার মাঝে তৈরী হওয়া অনুভূতি সম্পর্কে আমি অবগত। এজন্য এতোটা আত্মবিশ্বাসী হয়ে বলছি এ কথা। ”
আমার কথায় আদ্রিশ দূর্বল হাসলেন। কিছু বলতে উদ্যত হতেই আমি নড়েচড়ে বললাম,
” এটা ভুলে যাবেন না যে, একমাত্র আমিই ফার্ম হাউজের লোকেশন জানি। আর আমায় না নিয়ে যাওয়া অব্দি আমি এ বিষয়ে কিছুতেই মুখ খুলবো না। এবার বুঝে নিন ব্যাপারটা।”
আদ্রিশ প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে হাসলেন। অতঃপর স্টিয়ারিং এ হাত রেখে বললেন,
” তোমায় নিয়ে আর পারলাম না। তুমি এভাবে ব্ল্যাকমেইল করবে জানলে কখনো তোমার মাধ্যমে লোকেশন নিতাম না। ”
উনার কথায় আমি শব্দ করে হেসে উঠলাম। বললাম,
” স্কিলটা নতুন করে আয়ত্ত করছি। কারণ বিপদে খুব কাজে লাগে এটা।”
আদ্রিশ মাথা নাড়িয়ে হেসে উঠলেন। গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বললেন,
” আরেকটা স্কিলও খুব ভালোভাবে আয়ত্ত করেছো। তা হলো জিদ। তুমি বড্ড জিদ্দি হয়ে গিয়েছো মিশমিশ।”
” এসব আপনার প্রভাব মিস্টার। ”
” আচ্ছা? আর কি কি প্রভাব ফেলেছি তোমার উপর? এখন জানতে মন চাইছে। কিন্তু পরিবেশ, পরিস্থিতি কোনোটাই অনুকূলে না। পরে ঠিকই জেনে নিবো আমি। ”
এই বলে আদ্রিশ গাড়ি চালিয়ে হাইওয়ের রাস্তায় ছুটলেন। আমি কথা না বাড়িয়ে গাড়ির বাইরে দৃষ্টিপাত করলাম। স্নিগ্ধ শীতল হাওয়া এসে আমার চোখেমুখে বাড়ি খেলো। হাওয়ার তীব্র আক্রোশে আমি রূদ্ধ নয়নে বসে রইলাম। মনের মাঝে ক্ষীণ ভীতিকর অনুভূতি জেগে উঠলো। আমার মন মস্তিষ্ক স্পষ্টরূপে জানান দিচ্ছে, জায়গাটা আমার জন্য নিরাপদ নয়। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আমার আগমন পরিস্থিতি বিপজ্জনক করে তুলতে পারে। কিন্তু আমার সেখানে যাওয়া প্রয়োজন। দুটো কারণে প্রয়োজন। প্রথমত আপুকে সে পরিস্থিতিতে স্বান্তনা দেওয়া, সামাল দেওয়া। দ্বিতীয়ত রোহান ভাইয়ার এ নিচ কাজের জন্য উপহার স্বরূপ তাকে কিছু দেওয়া। আর তাকে এ উপহার না দেওয়া অব্দি আমি কিছুতেই শান্ত থাকতে পারবো না।
.
হাইওয়ে হতেই আমরা সেই ফার্ম হাউজের কিঞ্চিৎ অংশ দেখতে পেলাম। গাছগাছালিতে ঘেরা ফার্ম হাউজটির দৃশ্যমান অংশ বলতে শুধু দুটি জানালা দেখা যাচ্ছে। দূর হতেই বুঝা গেলো, ফার্ম হাউজটি তৈরী করতে অনেক টাকা গুণতে হয়েছে।
আদ্রিশ গাড়ি নিয়ে হাইওয়ে হতে ছোট সড়কে নেমে এলেন। ফার্ম হাউজ থেকে বেশ দূরেই গাড়ি আড়াল করে পার্ক করে রাখলেন। ইমাদ ভাইয়া আমাদের পূর্বেই এখানে এসে হাজির হয়েছেন। উনিও ঠিক একই জায়গায় গাড়ি পার্ক করে রেখেছেন।
গাড়ি থামাতেই আমি ও আদ্রিশ নেমে পড়লাম। আচমকা ইমাদ ভাইয়া আমায় দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। বিস্মিত কণ্ঠে বললেন,
” মিম এখানে কেনো! ওকে কেনো এনেছিস আদ্রিশ? জানিস, জায়গাটা রিস্কি খুব। তারপরও?”
আদ্রিশ আমার দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বললেন,
” শখে আনিনি ওকে। ওর কাছে লোকেশন ছিলো। এ নিয়ে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করেই এসেছে। গাড়ি হাইওয়ে পাওয়ার একটু আগে ওর কাছ থেকে লোকেশন নিয়েই তোকে সেন্ট করেছিলাম। ”
ইমাদ ভাইয়া আমার দিকে চেয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লেন। অতঃপর বললেন,
” মেয়েটা আজ আমাদের বিপদে ফেলেই ছাড়বে।”
আমি বললাম,
” এমন কিছুই হবে না। চিন্তা করবেন না। চলুন এবার। আর আপনার সে বন্ধু কোথায়?”
” অন দা ওয়ে। ”
এই বলে ইমাদ ভাইয়া আদ্রিশকে বললেন,
” মিমকে এতদূর এনেছিস ভালো কথা। এবার ওকে গাড়িতে লক করে রেখে দে। ও আমাদের সাথে আসা মানেই বিপদ বাড়ানো। ”
আদ্রিশ চট করে আমার দিকে চেয়ে বললেন,
” ভালো কথা বলেছিস। এখন তো আর ব্ল্যাকমেইলের কিছু নেই। ”
আমি উনাদের কথায় তৎক্ষনাৎ প্রতিবাদ করে বললাম,
” মোটেও না। আমি আপনাদের সাথে যাবো মানে যাবোই। ”
আদ্রিশ এবার গরম চোখে চেয়ে বললেন,
” বাচ্চাদের মতো জিদ করো না। এতদূর এসেছো ভালো কথা। এবার গাড়িতে বসে থাকো।”
” কখনো না। আমি যা করতে চাইছি তা গাড়িতে বসে সম্ভব না। এর জন্য আমাকে আপনাদের সাথে যেতে হবে। ”
ইমাদ ভাইয়া সন্দেহ সহিত জিজ্ঞেস করলেন,
“এই বিপদে কি এমন কাজ করতে চাইছো তুমি?”
” তা বলতে পারবো না। তবে এটুকু জেনে রাখুন। একজনের কিছু পাওনা দিতে হবে তাকে। আর এটা অনেকক্ষণ ধরেই আমার ভেতরে পুষে রেখেছি আমি৷ তাই প্লিজ দেরি না করে দ্রুত চলুন। আর কথা বাড়াতে আসবেন না। কারণ আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল। আমার সাথে জোর করেও লাভ নেই। ”
আদ্রিশ ও ইমাদ ভাইয়া ব্যর্থ ভঙ্গিতে একে অপরের দিকে চাইলেন। ইমাদ ভাইয়া আদ্রিশকে বললেন,
” আগের চেয়েও আরো সতর্কতার সাথে কাজ করতে হবে আমাদের।”
আদ্রিশ সায় দিয়ে বললেন,
” হ্যাঁ। আমরা বরং শাহেদ এলেই যাই ওখানে। এতে কিছুটা হলেও রিস্ক কম থাকবে। ওকে নিয়ে আমি কোনোপ্রকারেরই রিস্ক নিতে চাচ্ছি না।”,
এই বলে আদ্রিশ কিঞ্চিৎ ক্রোধান্বিত চাহনিতে আমার দিকে চাইলেন। আমি উনার চাহনির বিপরীতে এমন ভাব ধরলাম যে, এ বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ অনবগত।
কয়েক মিনিটের মাঝেই শাহেদ সাহেব ও তার টিম চলে এলেন। তারা সকলে সাধারণ মাইক্রোতে এসেছেন। মাইক্রোটা আমাদের গাড়ির পিছে থামতেই শাহেদ সাহেবসহ চারজন নেমে এলেন সেখান থেকে। প্রত্যেকের চোখেমুখে তীব্র আত্মবিশ্বাস। শাহেদ সাহেব ইমাদ ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলেন,
” বাড়ির আশেপাশে গিয়েছিস?”
” হ্যাঁ। সামনের দিকে দুটো গার্ড বসে আছে। আর পিছনে একটা ব্যাকডোর আছে। আমাদের ওখান দিয়েই যেতে হবে। ”
শাহেদ সাহেব তীক্ষ্ণ চাহনিতে ফার্ম হাউজের দিকে চেয়ে বললেন,
” হুম। ওদিক দিয়েই যাবো।”
এই বলে উনি উনার টিমের লোকদের বাড়ির চারপাশে ছড়িয়ে যেতে বললেন। উনার টিম মেম্বার উনার কথামতোই কাজ করলো। লোকগুলো চলে যেতে শাহেদ সাহেব আমাদের সাথে নিয়ে চুপিচুপি পায়ে এগিয়ে চললেন।
আমরা গাছগাছালি ঘেরা জায়গাটুকু দিয়ে নিজেদের লুকানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করে হাঁটছি। যদিও বাড়ির ভেতর থেকে আমাদের নজরে পড়ার কথা না। তবুও সাবধানতার সাথে চলতে হবে।
বাড়ির ব্যাকডোরে আসতেই দেখলাম একজন লোক সেখানে পাহারাদার হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা লোকটিকে দেখে দেয়ালের আড়ালে নিজেদের লুকিয়ে ফেললাম। শাহেদ সাহেব আমাদের দেখে চুপিচুপি গিয়ে লোকটিকে পিছন থেকে জাপটে ধরে পিঠে গান চেপে ধরলেন এবং সাথে সাথে একটি গুলি চালিয়ে দিলেন৷ গুলি চালানোয় চাপা একটি শব্দ হলো। অর্থাৎ গানে সাইলেন্সার লাগিয়ে কাজ করলেন উনি।
লোকটির উপর গুলি চালিয়ে এক কোনায় ফেলে রেখে আমাদের ভেতরে ঢোকার নির্দেশ দিলেন উনি৷ লম্বা করিডোর ধরে চাপা পায়ে এগিয়ে গেলাম আমরা।
করিডোরের ভেতর দিয়ে জানালার সাহায্যে প্রতিটা রুমে নজর বুলালাম সকলে। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না। অতঃপর করিডোরের শেষ দিক দিয়ে দ্বিতীয় রুমে আপুকে হাত বাঁধা অবস্থায় দেখলাম। আপুকে দেখেই আমার বুকটা ধক করে উঠলো। সাথে সাথেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম আমি। তবে কিঞ্চিৎ ভয়ও জেঁকে বসলো আমার মনে। কারণ এখনও আপুর নাগালে আসতে পারিনি আমরা। এখনও অব্দি বিপদের তীব্র আশংকা রয়েছে।
শাহেদ সাহেব আশপাশে একবার নজর বুলিয়ে রুমের ভেতরে চাইলেন। রুমে আপু বাদে কেউ নেই এবং দরজা বাইরে থেকে লক করা। শাহেদ সাহেব চারপাশ কিঞ্চিৎ বিপদমুক্ত দেখে ধীর শব্দে জানালা খুললেন। জানালার গ্রিল না থাকায় খুব সহজেই রুমের ভেতর চলে গেলেন উনি। এরপর একে একে ইমাদ ভাইয়া ও আদ্রিশও ভেতরে চলে গেলেন। উনাদের দেখাদেখি আমিও ভেতরে যেতে উদ্যত হতেই আকস্মিকভাবে রুমের দরজা খুলে রোহান ভাইয়া রুমে প্রবেশ করলেন। আমি উনাকে দেখে সাথে সাথে জানালার আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম। পিছে রোহান ভাইয়ার ক্রুর কণ্ঠস্বর শুনলাম,
” পাখিরা খাঁচায় বন্ধি হলো শেষমেশ। আমাকে ধরা কি এতোই সহজ? উঁহু। এতো সহজে তোদের হাতে ধরা পড়বো না আমি৷ তবে তোরা তো আমার হাতে ধরা খেয়ে গেলি। এখন কোথায় পালাবি তোরা?”
®সারা মেহেক(এই প্রথম এমন কিছু লিখছি। জানি না কেমন হয়েছে। ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন)
#চলবে
#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক
৪৪(প্রথম অংশ)
রোহান ভাইয়ার এহেন কথা শুনে আমার শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো। আড়ালে লুকিয়ে শুকনো একটা ঢোক গিলে হাত দুটো শক্ত মুঠো করে রাখলাম। এতোক্ষণ যাবত ভয়ের ছিঁটেফোঁটাও না থাকলে এ মুহূর্তে ভয় আমায় জেঁকে বসলো। মনে হলো, আশেপাশে থেকে আচমকা কেউ আক্রমণ করে বসবে আমার উপর। এই ভেবে শুকনো একটা ঢোক গিললাম আমি৷ ওদিকে রোহান ভাইয়ার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম,
” একটা প্রবাদ বাক্য শুনেছিস আদ্রিশ? অতি চালাকের গলায় দড়ি? শুনে থাকার কথা। দেখেছিস? আজ সেটাই তোদের সাথে হচ্ছে। আমার সাথে চালাকি করতে এসে কি সহজে ধরা পড়ে গেলি তোরা!”
মুহূর্তমধ্যে আদ্রিশের ঈষৎ কম্পিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম,
” নাফিসা ভাবীকে ছেড়ে দে রোহান। তুই নাফিসা ভাবীকে যেভাবে গান পয়েন্টে রেখেছিস তাতে যেকোনো মুহূর্তেই দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। ”
আদ্রিশের এহেন কথা শুনে আমার হাত পা যেনো অসাড় হয়ে এলো। সকল চিন্তাভাবনা জট পাকিয়ে যেতে শুরু করলো। রোহান ভাইয়া আপুকে গান পয়েন্টে রেখেছে, এটা শোনার জন্য আমি কিছুতেই প্রস্তুত ছিলাম না। আমি দেয়ালের আড়াল হতে রুমের ভেতরে উঁকি দিলাম। রোহান ভাইয়া আপুকে গান পয়েন্টে রেখে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। আর আদ্রিশ, ইমাদ ভাইয়া, শাহেদ সাহেব তাদের পুর্বের স্থানেই দাঁড়িয়ে আছে। অবস্থা বেগতিক। আপুর হাত দুটো বাঁধা। ঠোঁট দুটো কাপড়ে এঁটে রাখা। শুকনো চোখ দুটোয় টলমলরত জল। চেহারায় স্পষ্ট ভীতির ছাপ। কিন্তু রোহান ভাইয়ার চেহারায় বিজয়ী হওয়ার আগাম খুশির ছাপ। রুমের ভেতরকার এ অবস্থা দেখে আমার চিন্তাশক্তি কিয়ৎক্ষণের জন্য অসাড় হয়ে এলো। এ মুহূর্তে আমার কিছু করা উচিত জেনেও কিছুই করতে পারছি না। কারণ এ বিপদাপন্ন পরিস্থিতিতে আসলে কি করা উচিত তা যেনো কিছুতেই আমার মস্তিষ্কে আসছে না। রোহান ভাইয়া ক্রুর হেসে বললেন,
” দূর্ঘটনা ঘটার জন্যই কাজটা করেছি দোস্ত। এখন এ বিপদ যেনো না ঘটে সে কারণে আমাকে দ্রুত ফর্মুলাটা দিয়ে নাফিসাকে নিয়ে বিদেয় হো।”
শাহেদ সাহেব বললেন,
” রোহান, নাফিসাকে ছেড়ে দাও। আমরা শান্তভাবে বসে কথা বলি। ”
রোহান ভাইয়া চট করে শাহেদ সাহেবের দিকে চেয়ে বললেন,
” তুই কোন ক্ষেতের মূলা? তোকে তো আগে কখনো দেখিনি। ”
এই বলে উনি শাহেদ সাহেবকে নিমিষের মধ্যেই পর্যবেক্ষণ শেষে বললেন,
” ওও। তুই তাহলে পুলিশ অফিসার। বাহ, আদ্রিশ। পুলিশও নিয়ে এসেছিস! এবার নাফিসাকে নিয়ে যাওয়ার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল। আমি আমার সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছি। ”
ইমাদ ভাইয়া এক পা এগিয়ে গিয়ে কম্পিত স্বরে বললেন,
” আচ্ছা, আমাদের ভুল হয়েছে রোহান। নাফিসাকে ছেড়ে দাও প্লিজ। ও তো তোমার কোনো ক্ষতি করেনি৷ ”
রোহান ভাইয়া দাঁতে দাঁত চেপে রাগত স্বরে বললেন,
” কে বলেছে ও আমার ক্ষতি করেনি? ওর প্রেমে পাগল ছিলাম আমি। কিন্তু ও আমাকে পাত্তা দেয়নি। তোকে বিয়ে করেছে। যাই হোক, ওসব ভুলে গিয়েছিলাম আমি। কিন্তু এখন আমি আমার মত পাল্টে ফেলেছি। যেহেতু সুযোগ আসে সেহেতু সুযোগের সদ্ব্যবহার করবো না আমি? অবশ্যই করবো। এবার আমাকে চুপচাপ ফর্মুলার ফাইলটা দে। নয়তো সেই ভিডিওর কথা মনে আছে তো? ”
এই বলে রোহান ভাইয়া শাহেদ সাহেবের উদ্দেশ্যে বললেন,
” তোর হাতে গান আছে না? দ্রুত সেটা বাইরে ফেলে দে। ”
শাহেদ সাহেব তৎক্ষনাৎ তা করলেন না। বরং রোহান ভাইয়ার দিকে চেয়ে রইলেন। রোহান ভাইয়া এক ধমক দিয়ে বললেন,
” কথা কি কানে যায় না? আমি এতোক্ষণ দেখছিলাম তো। শুট করার একটা সুযোগ খুঁজছিলি তুই। এবার ফটাফট হাতের গানটা ফেলে দে। না হলে এই লোডেড গানের সবক’টা গুলি তোদের বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে একটুও দেরি করবো না আমি। ”
শাহেদ সাহেব কিয়ৎ অপ্রতিভ হয়ে সতর্কতার সহিত হাতের গানটা নিয়ে পিছনে ফিরে জানালা দিয়ে তা ফেলে দিলেন। উনার আকস্মিক এ কাজে আমি কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গেলাম। কিন্তু তৎক্ষণাৎ উনার পরিকল্পনার আংশিক অংশ ধারণা করতে পারলাম। শাহেদ সাহেব রোহানকে বললেন,
” এবার আমি আমার গানটা ফেলে দিয়েছি। ব্যস, খুশি? নাফিসাকে এবার ছেড়ে দাও রোহান। ”
রোহান ভাইয়া পূর্বের ন্যায় বললেন,
” গাধা মনে করেছিস আমাকে? আদ্রিশ, আমার সময় নষ্ট না করে দ্রুত ফাইলটা দে। ”
আদ্রিশ সতর্ক কণ্ঠে আমতাআমতা করে বললেন,
” ফাইল দিবো কেনো? তুই তো এখন নাফিসা ভাবীকে ছাড়বি না। তাহলে এই ফাইল দিয়ে কাজ কি? তোর শর্ত ছিলো, ফাইল নিয়ে নাফিসা ভাবীকে ছেড়ে দিবি। কিন্তু তা তো তুই করছিস না। তাহলে তোকে ফাইল কেনো দিবো?”
রোহান ভাইয়া এ পর্যায়ে কিঞ্চিৎ ভড়কে গেলো। কিন্তু অতিদ্রুত নিজেকে সামলে নেওয়ার প্রচেষ্টায় বললেন,
” নাফিসার ভিডিওর কথা মনে নেই? আমার কাছেই আছে ওটা। বাইরে আমার লোকদের বললে মুহূর্তেই সব সাইটে আপলোড হয়ে যাবে ভিডিওটা। এবার কথা না বাড়িয়ে কাজ কর আদ্রিশ। অতিরিক্ত কথা সহ্য হচ্ছে না আমার। দ্রুত ফাইলটা দে আদ্রিশ।”
আড়ালে লুকিয়ে উঁকি দিয়ে সম্পূর্ণ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলাম আমি। অতি সাবধানে পুনরায় নিচে বসে পড়লাম আমি। ধীরেধীরে আমার মস্তিষ্ক সচল হতে শুরু করলো যেনো। আপুকে বাঁচানোর কোনো একটা পথ খুঁজতে কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করলাম। ওদিকে আদ্রিশ নিজের কথার জালে রোহান ভাইয়াকে কোনঠাসা করার সম্পূর্ণ চেষ্টায় আছেন। বুঝলাম, রুমের বাইরে হতে বাকি কাজটা আমায় করতে হবে। তবে এ ঠান ঠান উত্তেজনাকর মুহূর্তে যা করার একবারই করতে হবে। এতে দ্বিতীয় কোনো সুযোগ নেই। প্রথম ও শেষ সুযোগ। এ সুযোগ কাজে লাগাতে না পারলে আপুকে বাঁচানো দায় হয়ে যাবে। কিন্তু আমি যে নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছি না। কারণ এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন কখনও হয়নি আমি। সেক্ষেত্রে আমি পারবো তো কিছু করতে? নাহ, প্রচণ্ড ভয় করছে আমার। ভয়ে বুকের ভেতরে ঢিপঢিপ আওয়াজ তোলা হৃদপিণ্ডটা ছুটে বেরিয়ে আসতে চাইছে যেনো। পরিস্থিতি সামাল দিতে আমি লম্বা লম্বা শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। সেকেন্ডের মাঝেই চারপাশে চোখ বুললাম। উদ্দেশ্য ভারী কিছু খুঁজে পাওয়া। ডান পাশে চোখ বুলাতেই শাহেদ সাহেবের গান দেখতে পেলাম। তৎক্ষনাৎ নিচু হয়ে এগিয়ে গিয়ে গানটা হাতে নিলাম। কিন্তু আমি যে উদ্দেশ্যে ভারী কিছু খুঁজছি সে উদ্দেশ্য এই গান দিয়ে হাসিল করা যাবে না। কারণ সুযোগ বুঝে এ গানটা শাহেদ সাহেবের দিকে ছুঁড়ে দিতে হবে। আমি চারপাশে দ্বিতীয় কোনো ভারী বস্তু খুঁজার চেষ্টা করলাম। হঠাৎ ব্যাকইয়ার্ডে থাকা সেই গার্ডের লাশটির কথা মনে পড়লো। অনতিবিলম্বে আমি নিজেকে আড়ালে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গার্ডের কাছে গেলাম। তার শরীর হাতড়ে সাথে সাথেই একটা গান পেলাম। ব্যস, এই গানটা রোহান ভাইয়ার মুখ বরাবর ছুঁড়ে মারলে গানের আঘাতে সাথে সাথেই উনি ছিটকে পড়বেন। এরই ফাঁকে শাহেদ সাহেবের দিকে উনার গানটা এগিয়ে দিতে হবে। আপাতত এই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে হবে আমার। আপাত পরিস্থিতিতে এর চেয়ে আর কোনো সহজলভ্য পরিকল্পনা আমার মাথায় এলো না।
আমি দুটো গান হাতে নিয়ে ধীরেধীরে পূর্বের জায়গায় ফিরে এলাম। জানি না ভেতরে কি চলছে৷ তবে আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করার পূর্বে ভেতরকার পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত হওয়া জরুরি। আমি পূর্বের ন্যায় উঁকি দিলাম। রুমে কেউই নিজের পূর্বের জায়গায় নেই। রোহান ভাইয়া আপুকে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়েছেন। ইমাদ ভাইয়া, আপুর অনেকটাই কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছেন। আদ্রিশ ও শাহেদ সাহেব ইমাদ ভাইয়ার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রত্যেকের অবস্থানের এ পরিবর্তন দেখে অনুমান করলাম, নিশ্চয়ই কিছুক্ষণ পূর্বে এখানে কিছু হয়েছে।
রোহান ভাইয়া এখনও হুমকি ধামকি দিয়ে চলছেন। আমি কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে নিজের মাঝে সাহস সঞ্চার করলাম। অতঃপর আল্লাহর নাম নিয়ে তৎক্ষনাৎ জানালা বরাবর দাঁড়িয়ে গেলাম। আচমকা আমায় দেখে রোহান ভাইয়া হকচকিয়ে গেলেন। এরই সুযোগে আমি আনুমানিক অবস্থান বুঝে রোহান ভাইয়ার মুখ বরাবর গান ছুঁড়ে দিলাম। ভাগ্যক্রমে হতচকিত রোহান ভাইয়ার কপালে গিয়ে বাড়ি খেলো গানটি। তৎক্ষনাৎ উনি আপুকে ছেড়ে দিয়ে কপাল চেপে পিছিয়ে গেলেন। অনতিবিলম্বে আমি শাহেদ সাহেবের দিকে তার গানটি ছুঁড়ে দিলাম। উনি মুহূর্তমধ্যেই সেটি ক্যাচ করে রোহান ভাইয়ার দিকে তাক করলেন। রোহান ভাইয়া এখনও নিজেকে সামলে নিতে ব্যস্ত। ইতোমধ্যে ইমাদ ভাইয়া আপুকে নিয়ে পূর্বের স্থান হতে পিছিয়ে এসেছেন এবং আদ্রিশ রোহান ভাইয়ার দিকে এগিয়ে গিয়েছেন। ইমাদ ভাইয়া আপুকে নিয়ে জানালা দিয়ে বেরিয়ে আসতে আসতেই রোহান ভাইয়া অবিন্যস্ত দৃষ্টিতে এদিক ওদিক চাইলেন। হয়তো ঘটনার আকস্মিকতায় উনি হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছেন৷ এরই মধ্যে শাহেদ সাহেব রোহান ভাইয়ার কপালে গান ঠেকিয়ে শক্ত কণ্ঠে বললেন,
” রোহান, দ্রুত গানটা আমার হাতে দিয়ে দাও। কোনোরকমের চালাকি করার চেষ্টা করলেই আমি শুট করতে বাধ্য হবো। ”
রোহান ভাইয়া তা শুনলেন না। বরং আচমকা কব্জি দিয়ে শাহেদ সাহেবের হাতে আঘাত করলেন। ঘটনার প্রেক্ষিতে শাহেদ সাহেবের হাত হতে গান ছুটে গিয়ে নিচে পড়লো। তন্মধ্যে রোহান ভাইয়া শাহেদ সাহেবের দিকে গান তাক করলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হকচকিয়ে গেলাম। ভয়েরা দলা পাকিয়ে মস্তিষ্কে জমাট বেঁধে বসে রইলো।
আদ্রিশ এখনও ভেতরে আছেন৷ যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো কিছু হতে পারে। যদি রোহান ভাইয়া তীব্র আক্রোশে লোডেড গান দিয়ে কারোর উপর শুট করেন তাহলে কিছুই করার থাকবে না আমার। কিন্তু এ মুহূর্তে আমি কি করতে পারি তা কিছুতেই আমার মস্তিষ্কে এলো না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম আমি।
আচমকা আদ্রিশ রোহান ভাইয়ার হাঁটু বরাবর পা দিয়ে আঘাত করলেন৷ ফলস্বরূপ রোহান ভাইয়া ভারসাম্য সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে গেলেন। তন্মধ্যে আদ্রিশ পিঠের পিছন দিক হতে গান বের করে রোহান ভাইয়ার দিকে তাক করলেন। অতিদ্রুত ঘটে যাওয়া এ ঘটনা ও আদ্রিশের কাছে গান দেখে আমি আকাশচুম্বী বিস্ময় নিয়ে আদ্রিশের দিকে চেয়ে রইলাম।
®সারা মেহেক(জানি না ঘটনাগুলো ভালোভাবে তুলে ধরতে পেরেছি কি না৷ ভুলত্রুটি হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন)
#চলবে
#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক
৪৪(দ্বিতীয় অংশ)
আদ্রিশের হাতে গান দেখে আমার চোখজোড়া বিস্ময়ে চক্ষু কোটর হতে বেরিয়ে আসতে চাইলো যেনো। উনার কাছে গান কিভাবে এলো তা কিছুতেই আমার মাথায় এলো না।
এদিকে আদ্রিশ রোহান ভাইয়ার দিকে গান তাক করে শক্ত কণ্ঠে বললেন,
” ফুললি লোডেড গান। শুধু একবার ট্রিগার চাপবো। টার্গেট মিস হবে না রোহান৷ এজন্য যা করবি ভেবেচিন্তে করবি। তোর একটা স্টেপ আমার বিরুদ্ধে হবে, আর আমি এক সেকেন্ডও দেরি না করে ট্রিগার চেপে দিবো। ব্যস, তোর খেল ওখানেই খতম৷ সো, মাথার মধ্যে যা চলছে, সব ভুলে যা। কারণ এখন আমার সাথে পেরে উঠতে পারবি না তুই।”
রোহান ভাইয়া মাটিতে পরে থাকা গানটি হাতে নেওয়ার চেষ্টা চালাতেই আদ্রিশ পা দিয়ে গানটি দূরে সরিয়ে দেন। তন্মধ্যে শাহেদ সাহেব নিজের গান নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। কিঞ্চিৎ বিস্মিত কণ্ঠে আদ্রিশকে জিজ্ঞেস করলেন,
” আপনার কাছে গান কিভাবে মিস্টার আদ্রিশ?”
আদ্রিশ রোহান ভাইয়ার দিকে চেয়ে বললেন,
” চিন্তা করবেন না অফিসার। এটা লাইসেন্সড গান। ”
এই বলে আদ্রিশ শাহেদ সাহেবের উদ্দেশ্যে বললেন,
” রুমের দরজাটা খুলে দিন৷ আপনার টিম মেম্বার্সের কাউকে যে দেখতে পেলাম না?”
শাহেদ সাহেব মৃদু হাসার চেষ্টা করে বললেন,
” ওরা রোহানের চ্যালা-প্যালাগুলোকে কব্জা করে ফেলেছে। আমিই ওদের বলেছিলাম, আমার সিগন্যাল না পাওয়া পর্যন্ত নাফিসা যে রুমে আছে সে রুমে যেনো না আসে ওরা। ”
এই বলে শাহেদ সাহেব রুমের দরজা খুলে দিলেন। এই সুযোগে রোহান ভাইয়া মাটি থেকে উঠে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু এর পূর্বেই শাহেদ সাহেব সুযোগ বুঝে উনাকে পাকড়াও করলেন৷ এক হাতে রোহান ভাইয়ার হাত দুটো পেঁচিয়ে পিছনে ধরলেন এবং অপর হাতে গনা নিয়ে রোহান ভাইয়ার মাথায় ঠেকিয়ে বললেন,
” এতো সহজে পালাবি কোথায় রোহান? তোকে জেলের হাওয়া না খাওয়ানো পর্যন্ত আমি শান্তিতে বসে থাকবো না।”
রোহান ভাইয়া নিজেকে ছুটিয়ে নিতে প্রাণপণ চেষ্টা করলেন। কিন্তু শাহেদ সাহেবের শক্তির সাথে পেরে উঠতে পারলেন না। উনার এ প্রচেষ্টা দেখে আদ্রিশ বললেন,
” আর কতক্ষণ পরিস্থিতি নিজের দখলে রাখতে চাস! আর পারবি না দোস্ত। এবার ভালোয় ভালোয় নাফিসা ভাবীর ভিডিওটা দিয়ে দে। ”
আদ্রিশের কথা শোনামাত্র রোহান ভাইয়া ঠোঁট বাঁকিয়ে ক্রুর হাসিতে মেতে উঠলেন। বিজয়ী ভঙ্গিতে হেসে বললেন,
” এবার তো আমার পায়ের তলায় এসে পড়েছিস আদ্রিশ। আমি ঐ ভিডিও না দেওয়া পর্যন্ত তো সেটা পাচ্ছিস না তুই। এবার? এবার কি হবে?”
এই বলে রোহান ভাইয়া উন্মাদের ন্যায় অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। উনার এ হাসির শব্দ আমার কানে আঘাত করার মুহূর্তমধ্যেই আপুর ফুঁপিয়ে কান্না করার আওয়াজ আমার কানে গিয়ে ঠেকলো। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে আপুর দিকে তাকাতেই আপু কাঁদতে কাঁদতে ইমাদ ভাইয়ার বুকে মুখ গুঁজলো। ইমাদ ভাইয়া মায়াভরা দৃষ্টিতে আপুর দিকে চেয়ে মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলো৷ এ মুহূর্তে তার বলার কিছু নেই। কিন্তু আমার বলার এবং করার অনেক কিছু বাকি আছে। যে মানুষটার জন্য আপুর এ অবস্থা তাকে কিছু পাওনা না দিয়েই কি করে ছেড়ে দেওয়া যায়! অন্ততপক্ষে ঐ শ’য়’তানের গালে কষে একটা থাপ্পড় না মারা পর্যন্ত সারাজীবন আমার আফসোস রয়ে যাবে।
আমি আপুর উপর হতে নজর সরিয়ে রোহান ভাইয়ার দিকে চাইলাম। কে বলবে ঐ সুন্দর মুখশ্রীর আড়ালে এতো বড় একটা শ’য়’তান লুকিয়ে ছিলো! আসলে কি উনার জন্য এই থাপ্পড়টা যথেষ্ট? মোটেও নয়। এই থাপ্পড় যথেষ্ট নয়। আমার উচিত, উনাকে ইচ্ছামতো মেরে র’ক্তা’ক্ত করে রাস্তায় ফেলে রাখা। কিন্তু চাইলেই কি আর সব সম্ভব!
আমি ধীর পায়ে রুমের মধ্যে প্রবেশ করে রোহান ভাইয়ার সম্মুখপানে দাঁড়ালাম। আমায় দেখে আদ্রিশ সাথে সাথে আমার পাশে দাঁড়িয়ে পড়লেন। কিঞ্চিৎ উদ্বিগ্নতার সহিত বললেন,
” তুমি এখানে এসেছো কেনো? নাফিসা ভাবীকে নিয়ে ইমাদদের সাথে গাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়াও। আমি আসছি। ”
আদ্রিশের কথা কানে তুললাম না আমি। রোহান ভাইয়ার দিকে তীব্র ঘৃণাভরা চাহনিতে কিয়ৎক্ষণ চেয়ে রইলাম আমি। রোহান ভাইয়া আমায় দেখে চেয়ে পূর্বের ন্যায় সে বিশ্রী হাসিটা হাসলেন। ঠোঁট বাঁকিয়ে বললেন,
” কি পিচ্চি! আজ তুইও এসেছিস! তা তোর বোনকে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখে কেমন লাগলো তোর?”
এ মুহূর্তে রোহান ভাইয়ার একটি কথাও আমার সহ্য হলো না। দাঁতে দাঁত চেপে উনার চোখ বরাবর চাইলাম। অতঃপর তীব্র আক্রোশে শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে কষে একটা চড় বসিয়ে দিলাম উনার গালে। ঘটনার আকস্মিকতায় রোহান ভাইয়া হতভম্ব হয়ে গেলেন। অপমানে উনার মুখমণ্ডল কালো হয়ে এলো। উনি যে এমন কিছু কখনোই ভাবেননি তা উনার বদলে যাওয়া চেহারার রঙরূপ দেখেই স্পষ্ট বুঝতে পেলাম আমি। রোহান ভাইয়ার এরূপ অপমানিত চেহারা দেখে আমি প্রচণ্ড স্বস্তি অনুভব করলাম। বললাম,
” যখন থেকে আপনাকে চিনি, খুব ভালো হিসেবেই চিনতাম। আমার আপন কোনো ভাই না থাকায় আপনাকেই বড় ভাই হিসেবে মানতাম। কিন্তু আপনি সেটার যোগ্য নন। আজকের এ ঘটনায় আপনি সব লিমিট ক্রস করে দিয়েছেন। আপনার সাহস কি করে হয় একটা ফর্মুলার জন্য আপুর ভিডিও কালেক্ট করে আমাদের ব্ল্যাকমেইল করার? উচিত ছিলো, নোংরা জুতো দিয়ে আপনার গালে কয়েকটা চড় বসানো। কিন্তু এই থাপ্পড় পর্যন্তই সীমিত রইলাম আমি। খবরদার আর একবারও আমার আপুর আশেপাশে যেনো না দেখি আপনাকে৷ না হলে আমি আমার লিমিট ভুলে যাবো৷ সাধ্যমত আপনাকে বেইজ্জত করে রাস্তায় ঘুরাবো।”
রোহান ভাইয়া আমার কথা শুনে রাগে গজগজ করতে লাগলেন। শাহেদ সাহেবের কব্জা হতে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেন উনি। কিন্তু আদ্রিশ এগিয়ে এসে রোহান ভাইয়ার টিশার্টের কলার চেপে ধরে রাগত স্বরে বললেন,
” পাপ করে আবার এতো তেজ আসে কোথা থেকে? তোকে তো ভালোভাবে চিনি আমি। তুই যে কখনো শুধরানোর মানুষ না সেটাও জানি। কিন্তু এখন শুধরে যাবি। জেলের হাওয়া পানি খা কয়েকদিন। তারপর যদি লাইনে আসিস তুই।”
এই বলে উনি রোহান ভাইয়ার কলার ছেড়ে দিলেন। রোহান ভাইয়া তীব্র আক্রোশে বললেন,
” দেখি কয়দিন জেলে রাখতে পারিস তুই। আমাকে বন্দি করা এতো সহজ না। আর মিম, তোর তো সাহস কম না! আমায় চড় মারলি তুই! এ অপমান জীবনেও ভুলবো না আমি। তোদের জীবন নরক না বানানো পর্যন্ত আমি শান্তিতে বসবো না। আর ঐ ফর্মূলার কথা মনে রাখিস আদ্রিশ। খুব শীঘ্রই ফর্মুলাটা আমার নামে হবে। যাস্ট ওয়েট এণ্ড ওয়াচ।”
আদ্রিশ পুনরায় রোহান ভাইয়ার কলার চেপে বললেন,
” এসব হুমকি তখনই কাজে দিবে যখন তুই জল থেকে বের হবি। লজ্জা করে না, এতো বড় বড় কথা বলতে! ”
এই বলে উনি শাহেদ সাহেবের উদ্দেশ্যে বললেন,
” অফিসার, আপনি এখন ওকে থানায় নিয়ে যান। আমি সন্ধ্যায় এসে এফআইআর করবো। ”
শাহেদ সাহেব উনার টিমের দুজন মেম্বারকে ডেকে রোহান ভাইয়ার হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে রুম থেকে নিয়ে গেলেন। যেতে যেতে রোহান ভাইয়া তীক্ষ্ণ চাহনিতে আমাদের দিকে চেয়ে দাঁতে দাঁতে চেপে বললেন,
” তোদের দুইটাকে দেখে নিবো আমি। অপমান জিনিসটা আমার একদম সহ্য হয় না। আর সেই অপমানই করলি আমায়! দেখে নিব তোদের। ”
#চলবে