#ভালোবাসি_তাই
তন্বী ইসলাম-২
চারিদিকটায় চোখ বুলাতে বুলাতে আশা ভাবলো
“আহ, এই সেই নতুন ঠিকানা, এই আমার নতুন আশ্রয়। আজ থেকে এখানেই থাকতে হবে আমাকে, কাটাতে হবে খানিকটা সময়। সবার থেকে দূরে, সকলের মায়া কাটিয়ে।
কথাগুলো মনে মনে ভেবেই চোখদুটো বুজলো আশা। তখনই আবিদের কন্ঠ ওর কানে এলো। আবিদ নরম গলায় ডেকে বললো
“আশামনি, ভেতরে আয়।
আশা লক্ষ্য করলো, দরজার তালা খুলে ভাই তার রুমের ভেতর ঢুকে গেছে। আশা ধীরপায়ে রুমে ঢুকলো। চারপাশটা অবলোকন করলো ভালো করে।
ছোট্ট একটা রুম, একা থাকার জন্য পার্ফেক্ট। রুমে একটা সিঙ্গেল বক্স খাট, তার উপর সিঙ্গেল তোষক পাতা রয়েছে। মাথার কাছে একটা বালিশ, আর খাটের লম্বালম্বি একটা কোলবালিশ রাখা আছে। খাটের পাশেই খাটের সাথে লাগোয়া একটা ছোট্র পড়ার টেবিল, টেবিলের সামনে একটা প্লাস্টিকের চেয়ার পাতা। রুমের অপর পাশে একটা হাড়ি পাতিল রাখার রেক, আর পাশেই একটা কাপড় রাখার সেলফ রাখা। বেস এতোটুকুই। রুমের মাঝ বরাবর নাম মাত্র একটু যায়গা ফাঁকা রয়েছে। আদিব মুচকি হেসে বোনকে বললো
“রুম পছন্দ হয়েছে আশামনি?
আশা চারিপাশটা দেখতে দেখতে বললো
“হ্যাঁ, তবে এই জিনিসগুলো কার?
আদিব হাসলো। বোনকে এক সাথে জরিয়ে ধরে বললো
“যেদিন রুমটা ভাড়া নিয়েছি, সেদিনই এই সব কিছু কিনে রুমটা গুছিয়ে তারপর বাড়ি গিয়েছি। আমার বোনটাকে তো যেভাবে খুশি সেভাবে রাখতে পারি না বল। এই গুলো নিতান্তই প্রয়োজনীয় জিনিস। এগুলো লাগবেই৷ তুই এসে এগুলোর অভাব বোধ করিস, সেটা কি আমার ভালো লাগবে?
আশা অবাক নয়নে তাকালো ভাইয়ের দিকে। ক্ষীণ কন্ঠে বললো
“আমায় বড্ড ভালোবাসিস ভাইয়া, তাইনা?
আদিব হেসে বললো
“নাহ, আমি আমার ছোট্র আশামনিকে ভালোবাসি।
সন্ধ্যে নামার পরপরই স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা করলো আদিব। রাতেই ট্রেনেই বাড়ি ফিরবে সে। তখন বোনকে রুমে রেখে কোথায় যেনো গিয়েছিলো সে। একা রুমে নিঃসঙ্গতা অনুভব করছিলো আশা। বুক ফেটে তার কান্না পাচ্ছিলো। চোখদুটো ভিজে লাল বর্ণ ধারণ করছিলো ততক্ষণে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আদিব ফিরে আসে। হাতে একটা বিশালাকার ব্যাগ। তাতে বিভিন্ন ধরণের সব্জি আর ঘরের কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় দরকারি জিনিসপত্র। আদিব এক এক করে ব্যগ থেকে সবকিছু বের করে। একটা বিরিয়ানির প্যাকেট বের করে আশাকে বলে,
“এটা খেয়ে নিস আশামনি। রাতে আর কষ্ট করে রান্না করতে হবেনা। কতটা জার্নি হয়েছে আজকে। আশা ভাইয়ের কথায় মাথা নাড়িয়েছিলো শুধু। এরপর আরেকটা শপিং ব্যাগ থেকে বের করে বোনের সামনে রেখে সেটা থেকে একটা বক্স বের করলো আদিব। আশা বক্সটা দেখা মাত্রই অবাক হয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো
“স্মার্টফোন!!
আদিব হেসে বললো
“আমার আশামনির জন্য নিয়ে এলাম। তা নাহলে আমার বোনটাকে যখন তখন ইচ্ছে হলেই দেখতাম কি করে।
আশা খুশিমনে ফোনটা হাতে নিলো। কৃতজ্ঞতার সাথে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো
“থ্যাংকস ভাইয়া, আমি খুব টেনশনে ছিলাম কিভাবে তোকে আর মাকে না দেখে থাকবো।
বোনকে কিছুক্ষণ বুঝিয়ে শুনিয়ে, সাবধানে থাকার কথা বলে কিছুক্ষণ পরই রওনা করে দিয়েছিলো আদিব। আদিব চলে যাবার পরই ব্যগ থেকে একটা সবুজ রঙের থ্রি পিস বের করে ওয়াশরুমের দিকে গেলো আশা। গোসল করে ফ্রেশ হতে হবে তাকে। ওয়াশরুমে যাবার সময় আশা খেয়াল করলো৷ বাসাটা খুবই ছোট। নিচতলায় কটা রুম আছে জানা নেই, তবে উপরে মাত্র পাঁচটা রুম। একটাতে সে উঠেছে, আর তিনটে রুম নিয়ে বাড়িওয়ালা আন্টি থাকে ভাইয়ের কাছ থেকে শুনেছে। বাকিটায় কে বা কারা থাকে আশা সেটা জানেনা। এখানে আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত কারো দেখা পায়নি সে।
ওয়াশরুম থেকে গোসল করে এসে ভালোকরে তোয়ালে দিয়ে চুলগুলো পেচিয়ে নেয় আশা। এরপরে বিরিয়ানির প্যাকেট টা বের করে সেটা খাওয়া শুরু করে দেয় সে। খুব খিদে পেয়েছিলো তার। খাওয়া শেষ হলে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পরে আশা। মুহুর্তেই ঘুম এসে ভর করে দেয় ওর দুটো চোখে।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছে ঠিক জানা নেই। হটাৎ ই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভেংগে যায় আশার। কি হয়েছে বুঝার আগেই কোনো এক মাঝ বয়সী মহিলার কন্ঠস্বরে ভেসে আসে ওর কানে। মহিলাটি দরজার ওপাশ থেকে বলছে
“ভেতরে কে আছো, দরজাটা খোল।
আশা চোখদুটো কচলে নিলো একবার। এরপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলতেই দেখতে পেলো এক মাঝ বয়সী সুন্দরী মহিলা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। আশা কিছুটা অবাক হয়ে বললো
“আপনি কে?
“আমি লুৎফুন্নাহার। এ বাসাটা আমারই।
আশা তরিঘরি করে বললো
“ওহ, আসসালামু আলাইকুম আন্টি। ভেতরে আসুন।
মহিলাটি হাসিমুখের সালামের জবাব দিয়ে রুমের ভেতরে এলো। এরপর বিছানার এক প্রান্তে বসে চারিপাশটা দেখতে দেখতে বললো
“আমি জানতাম আজ তোমরা আসবে, তোমার ভাই সেদিন বলে গিয়েছিলো৷ কিন্তু আমার মনে ছিলোনা। মনে থাকলে আমি আরো আগেই চলে আসতাম অফিস থেকে। আশা অবাক হয়ে দেখলো মহিলাটিকে। এরপর বললো
“আপনি জব করেন আন্টি?
মহিলাটি অমায়িক হাসি হেসে বললো
“আমি এয়ার লাইন্সে জব করি।
আশা হেসে ছোট্র করে বললো
“ওহ।
“কখন এসেছো তোমরা?
“বিকেলে।
“তোমার ভাইয়া কোথায়? দেখতে পাচ্ছিনা যে।
“ভাইয়া চলে গেছে।
মহিলাটি হটাৎ উদ্বিগ্ন গলায় বললো
“ওমা, সেকি কথা! আজ এসে আজই চলে গেছে?
আশা কোনো উত্তর করলোনা। মহিলাটি আবারও বললো
“এখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে তোমার?
“নাহ আন্টি।
“কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানিও কেমন।
আশা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালো। মহিলাটি এবার আশাকে সাহস যুগিয়ে বললো
“আর হ্যাঁ শুনো, নিজেকে একা মনে করোনা। ওই যে সামনের রুমটা দেখতে পাচ্ছো, ওখানে তোমার মতো আরো দুজন মেয়ে থাকে, ওরাও স্টুডেন্ট । ওরা এলে ওদের সাথে কথা বলো৷ মিলামেশা করো। দেখবে ভালো লাগবে।
কথাটা শোনা মাত্রই আশার মনটা হটাৎ আনন্দে নেচে উঠলো। আসলে নিজের বয়সী কেউ থাকলে মন্দ হয়না। সময়টা অনায়াসেই কেটে যাবে তাদের সাথে গল্পগুজব করে।
মহলাটি উঠে পরলো এবার। নিজের রুমে যাবার জন্য রুমের বাইরে পা রাখতে রাখতে বললো
“তোমার নামটা যেনো কি?
“আশামনি।
“ওহ আচ্ছা। আশা শুনো, কিছুক্ষণ পর আমি তোমায় ডাকবো, তখন আমার রুমে এসোতো একবার।
আশা মুখে কিছু না বলে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোধক সম্বোধন জানালো। মহিলাটি চলে গেলো নিজের রুমে। উনি চলে যাবার পর আশা তার ব্যাগ থেকে প্রয়োজনীয় কাপড় চোপড়, বই খাতা বের করলো।কাপড়গুলো ভাজ করা অবস্থাতেই সেল্ফে রাখলো। সমস্ত কাপড়চোপড় গুছিয়ে রাখা হলে বই গুলো এক এক করে টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখলো সে। সবকিছু গুছানো শেষ হলে বিছানায় আবারও গিয়ে শুয়ে পরলো সে।
শোয়া মাত্রই বাড়ির কথা মনে পরলো হটাৎ। মায়ের কথা মনে পরছে খুব। না চাইতেও চোখের পানিরা এসে হাতছানি দিতে লাগলো বার বার। হটাৎই মনে হলো ভাইয়ার কিনে দেওয়া সেই মোবাইলটার কথা। সিম কার্ড লাগিয়ে দিয়ে ফোনটা চার্জে বসিয়ে দিয়ে গেছে ভাইয়া। আশা উঠে গিয়ে ফোনটা হাতে নিতে গিয়েও কি যেনো মনে করে আর নিলোনা। সে আবারও বিছানায় গিয়ে বসলো। বাড়ির স্মৃতিচারণ করতে লাগলো সে। তখনই পাশের রুম থেকে বাড়িওয়ালা আন্টির ডাক কানে এলো তার। ওড়নাটা ভালো করে মাথায় পেচিয়ে দিয়ে দরজার লকটা লাগিয়ে আন্টির রুমে গেলো সে। আশাকে দেখে বাড়িওয়ালা আন্টি হেসে বললো
“এসেছো?
“জ্বি আন্টি। শান্ত গলায় বললো আশা।
মহিলাটি সামনের ডাইনিং টেবিলের দিকে ইশারা করে আশাকে চেয়ারে বসতে বললো। আশা বিনয়ের সাথে গিয়ে বসলো চেয়ারটায়। বাড়িওয়ালা আন্টি আশার সামনে একটা প্লেট রেখে সেটাতে ভাত বাড়তে শুরু করলো। এতোক্ষণে আশার মাথায় ঢুকলো উনি কি করতে চাইছেন। বুঝতে পেরেই আশা তৎক্ষনাৎ উঠে পরলো চেয়ার থেকে। মহিলাটি অবাক হয়ে বললো
“এমা, উঠছো কেন?
“আমি খেয়েছি আন্টি, এখন আর কিছু খেতে পারবো না। শান্ত গলায় বললো আশা।
“কি খেয়েছো?
” বিরিয়ানি! ভাইয়া কিনে দিয়ে গিয়েছিলো।
“কখন খেয়েছো?
ভদ্রমহিলার কথায় মুখ তুলে তাকালো আশা। এরপর আবার দৃষ্টি সরিয়ে বললো
“সন্ধ্যায়।
বাড়িওয়ালা আন্টি মুচকি হেসে বললো
“এখন কয়টা বাজে জানো?
“নাহ। ছোট্ট করে বললো আশা।
“এখন বাজে রাত দশ টা। ওই সন্ধ্যায় খাওয়া ওইটুকু খাবার এখনো পেটে আছে? সারাটা রাত পার করবে কিভাবে? খিদেয় ঘুম আসবে না। তার চেয়ে খেয়ে নাও। আরামে ঘুমাতে তো পারবে। উনার কথায় আশা একটু নড়েচড়ে বসলো। উনি আবার মমতাভরে বললেন
“চুপচাপ বসে খেয়ে নাও। প্লেটে বাড়া খাবার না খেয়ে যেতে নেই।
আশা আর কথা বাড়ালো না। বাধ্য মেয়ের মতো খেতে বসলো। অন্যদিকে আন্টিও বসেছে খেতে। খাবার খাওয়ার এক ফাঁকে আন্টি আশাকে জিজ্ঞাসা করলো
“কে কে আছে বাড়িতে?
আশা নরম গলায় বললো
“মা আর ভাইয়া।
“তোমার বাবা নেই?
প্রশ্নটা শুনে কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলো আশা। এরপর শান্ত গলায় বললো
“আমি যখন খুব ছোট, তখন বাবা মারা গেছেন। মহিলাটি একটু হতাশ হলেন। এরপর আবারও প্রশ্ন করলেন
“তোমার ভাইয়া কি করে?
“ভাইয়ার দোকান আছে মার্কেটে।
“কিসের দোকান?
“ভাইয়া জেন্টস পোশাকের ব্যাবসা করে। ছেলে/পুরুষদের যাবতীয় পোশাক আশাক নিয়ে ভাইয়ার ব্যবসা।
“লেখাপড়া করেনি তোমার ভাই?
“জি করেছে। ব্যবসায়ের পাশাপাশি লেখাপড়াটা চালিয়ে নিয়েছে আমার ভাইয়া। বিবিএ পাস করার পর আর পড়া চালিয়ে যেতে পারেনি। ব্যবসার চাপ, সংসার চালানো, আমার লেখাপড়ার খরচ, সব মিলিয়ে অনেকটা চাপে পরে গেছে সে। এখন আবার ব্যবসাটাকেও আরো বড় করেছে। তাই আর কুলিয়ে উঠতে পারেনি।
ভদ্রমহিলা আশার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো
“ভাগ্যগুণে এমন এক ভাই পেয়েছো মানতেই হবে।
আশা আন্টির দিকে তাকালো। মুচকি হেসে বললো
“আমার ভাইয়া পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাইয়া। কথা বলতে বলতে এক সময় খাওয়া শেষ হয়ে গেলো ওদের। আন্টি টেবিলের এঁটো প্লেটগুলো টেবিলের এক পাশে নিয়ে রাখলেন। আশা এখনো চেয়ারেই বসে আছে। খানিক্ষন সে রুমের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ভালো করে দেখলো। তিনটে রুম পাশাপাশি। তিনটে রুমের একটা আন্টির বেডরুম। আরেকটাতে ডাইনিং টেবিল সহ ঘরের কিছু ফার্নিচার রাখা। পাশের রুমটার একপাশে সোফা সাজানো, অন্যপাশে একটা বিছানা পাতা। কিচেন আর ওয়াশরুম রুমেই এটাচ করা। সবটা দেখে যতটুকু বুঝতে পেরেছে, আন্টি হাই লেভেলের কোনো ধনী ব্যক্তি নয়। মোটামুটিভাবে তিনি মধ্যবিত্তের চেয়ে একটু উপরের কাতারেই পরেন।।
এতো বড় বড় তিনটে রুম থাকতেও আন্টি ছাড়া আর কাউকেই দেখতে পেলোনা আশা। মনের আগ্রহ থেকেই আশা বলে বসলো
“আর কাউকেই দেখতে পাচ্ছিনা যে আন্টি। আঙ্কেল কোথায়? বাসায় নেই?
আশার করা প্রশ্নে হটাৎ চমকালো আন্টি। আশা অবাক হলো। আন্টি নিমিষেই মুখের অবয়ব পালটে হাসি টেনে বললো
“তোমার আঙ্কেল নেই আশা। আমি একাই থাকি এখানে।
চলবে….