ভালোবাসি তাই পর্ব-০১

0
1009

#ভালোবাসি_তাই
তন্বী ইসলাম-১

বিকেল বেলা থেকে শুরু হওয়া মুষলধারে বৃষ্টি পৃথিবীটাকে ধুয়ে সাফ করে দিয়ে এই কিছুক্ষণ আগে থেমেছে মাত্র। আকাশ থেকে তীব্র মেঘের আঁধার থেমে গিয়ে সেখানে দেখা দিয়েছে একফালি চাঁদ। পাশের ডোবা পুকুরগুলো থেকে শতশত ব্যাঙ এর ডাক কানে এসে ঠেকছে। ঝিঁঝিঁপোকারাও গান গাইতে শুরু করে দিয়েছে একভাবে। সেই সকল কান্ড মনোযোগ সহকারে উপভোগ করছে আশা। জানলার গ্রিলটার পাশে দাঁড়িয়ে সেখানে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। মুখে বিষণ্ণতা ছেয়ে আছে। চোখদুটোয় লাল আভা ধারণ করেছে। বিষণ্ণ মুখে বাইরের আমেজ যখন সে সাদরে গ্রহণ করছে ঠিক তখনই পাশের ঘর থেকে মায়ের ডাক শোনা গেলো। মায়ের ডাকে ধ্যান ভাংলো ওর। মা কি বলেছে সেটা সে খেয়াল করেনি।

তাই সামান্য জোরে জিজ্ঞাসার কন্ঠে বললো
“আমায় কিছু বললে মা?
দিলারা শান্ত গলায় উত্তর করলো
“একটু আয় মা আমার রুমে।
আশা দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন না করে বাধ্য মেয়ের মতো এগিয়ে গেলো মায়ের রুমে। দিলারা বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে। মেয়েকে ঘরে ঢুকতে দেখে বললো
“এদিকে আয় মা, আমার পাশে বস।
আশা তাই করলো। সে ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে চুপটি করে বসলো মায়ের কাছে। দিলারা পরম মমতায় মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। মায়ের মমতাভরা পরশ পেয়ে আকস্মিক ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো আশা। দিলারা তরিঘরি করে মেয়ে বুকে টেনে নিলেন। শান্তনা দিয়ে বললেন
“কাঁদিস না মা, তুই তো একেবারে আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছিস না তাইনা। তোর স্বপ্ন পুরণ করতে যাচ্ছিস। তোর না ছোটবেলা থেকেই সখ ছিলো ঢাকায় গিয়ে লেখাপড়া করবি, ওখানকার বড় ভার্সিটিতে পড়বি। আজ তো তোর সেই স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে। তাহলে কেন এভাবে বোকার মতো কাঁদছিস?

আশার গাল বেয়ে টপটপ করে পানি পরছে এখনো। সে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো
“আমি কিভাবে সেখানে একা থাকবো মা? তোমাদের না দেখে তো আমি পাগল হয়ে যাবো।
দিলারা মুচকি হেসে আচলে মেয়ের চোখের পানি মুছে দিলেন। আলতো করে কপালে চুমু খেয়ে বললেন
“পাগল মেয়ে, তোর কিছু হবেনা দেখিস। আর একা একা বলছিস কেন, ওখানে তোর অনেক অনেক বান্ধবী হবে দেখে নিস। আশা তাকালো মায়ের দিকে। বললো
“কালই যেতে হবে মা?
“আদিব তো তাই বললো। কালই নিয়ে যাবে তোকে। আশা আবারও কেঁদে উঠলো ফুপিয়ে। দিলারাকে জরিয়ে ধরে বললো
“তোমায় খুব মিস করবো মা।

দিলারা মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো
“নতুন যায়গা, নতুন পরিবেশ। সম্পুর্নটাই তোর জন্য নতুন। সাবধানে থাকিস মা। কোনো কিছু করার আগে অন্তত দশবার ভাববি। চোখ কান খোলা রেখে চলবি। বিনা কারণে বাহিরে বের হবি না একদম। মায়ের কথায় আশা দুপাশে মাথা নাড়িয়ে বললো
“আচ্ছা মা।
তৎক্ষনাৎ আদিব কোত্থেকে যেনো এসে মায়ের রুমে ঢুকলো। মা বোনকে এভাবে দেখে মুচকি হেসে বললো
“তোমার মেয়ে বিদেশে যাচ্ছেনা মা। বাংলাদেশের মাটিতেই থাকছে। এতো চিন্তা করার কোনো কারণ নেই।
দিলারা ছেলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো
“তোরা কিভাবে বুঝবি, আমার এতো চিন্তা কিসের। আগে বিয়ে কর, বাচ্চা কাচ্চা হোক। তখন বুঝবি মা বাবা কি জিনিস। কেনো সন্তানের জন্য মা বাবারা এতো চিন্তা করেন।

আদিব হাসতে হাসতে বিছানার এক প্রান্তে এসে বসলো। মাকে আশ্বাস দিয়ে বললো
“টেনশন করোনা মা। ওর কোনো রকম সমস্যা ওখানে হবেনা। আমিতো সব ব্যবস্থা করেই এসেছি বলো। হোস্টেলে থাকতে ভালো লাগবেনা, খাওয়া দাওয়া ভালো হবেনা, সেই চিন্তা করে ওর জন্য একটা ছোটখাটো রুম ভাড়া করে এসেছি। বাসাটাও অনেক নিরিবিলি, তোমার মেয়ের জন্য পার্ফেক্ট। শুধু রান্না করে খেতে হবে এই যা। দিলারা ছেলের কথা শুনে স্বস্তির দম নিলেন। এরপর বিছানা ছেড়ে উঠে বললেন
“খাবার বাড়তে যাচ্ছি। আয় তোরা, খেয়ে ঘুমাবি।

দিলারা উঠে যাবার পর আদিব বোনের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ স্নেহের চোখে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। এরপর নরম গলায় বললো
“কি কি নিবি, রাতে সবকিছু মনে করে গুছিয়ে রাখিস আশামনি। সকাল সকাল রওনা করতে হবে আমাদের। ভাইয়ের কথায় এক পলক ওর দিকে তাকালো আশা। কিন্তু কিছু বলতে পারলোনা। বুক চিরে কান্না আসছে খুব। তৎক্ষনাৎ রুম থেকে বেরিয়ে এলো সে। আদিবের মনটাও হটাৎ খারাপ হয়ে গেলো। একমাত্র আদরের বোনটি এই প্রথমবারের মতো ওদের ছেড়ে এতোটা দূরে চলে যাচ্ছে। বাবা মারা যাবার সময় খুব ছোট ছিলো আশা। বয়স বড়জোর আট কিংবা নয় হবে তখন।
সেই তখন থেকেই বড় ভাইয়ের দায়িত্ব ছাড়াও বাবার সমস্ত দায়িত্ব বলতে গেলে সেই করেছে। আজ যদি বাবা বেঁচে থাকতো, তাহলে হয়তো এই সমস্ত দায়িত্ব বাবাই পালন করতো। কথাগুলো ভেবেই চোখদুটো হটাৎ ভিজে গেলো আদিবের। সাথে সাথেই চোখদুটো হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে নিলো সে। এরপর সেখান থেকে উঠে গেলো দ্রুত সম্ভব। মুখে মুচকি হাসি ফুটিয়ে ছুটে চললো মা বোনের কাছে।

ভোরের আলো সবেমাত্র ফুটতে শুরু করেছে।। পূর্বদিক থেকে উঁকি মারা সুর্যটা ধীরে ধীরে তার রুপে ধাবিত হচ্ছে। জানলার আলো ভেদ করে সে সুর্যের আলো গিয়ে পরলো আশার চোখেমুখে। ঘুম ভেংগে গেলো তার। খুবই সন্তর্পণে আড়মোড়া ভেংগে ধীরে ধীরে উঠে বসলো বিছানায়। একবার জানলার দিকে তাকালো, এরপর বিছনা থেকে নেমে এগিয়ে গেলো জানলার পাশে। পর্দাগুলোকে দুপাশে সরিয়ে দিয়ে বাইরের কোলাহলময় অপরুপ প্রকৃতিটাকে অবলোকন করলো আরেকবার।

গাছের ডালে দুটো ছোট্ট পাখি বসে কিচির মিচির করছে। মোরগ মুরগি গুলো সারারাত বন্দি থাকার পর এইবার ছাড়া পেয়ে উঠোনে এসে মনের আনন্দে ডানা ঝাপটাচ্ছে। মৃদু হাসি ফুটে উঠলো আশার ঠোঁটের কোনায়। হাসিটা অটল রেখে সেখান থেকে চলে এলো সে, ফ্রেশ হতে হবে যে তাই। ওয়াশরুমে ঢুকে বেসিনের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাশ করার এক পর্যায়ে হটাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেলো তার। আহ, অপরুপ এই গ্রাম, অপার সৌন্দর্যে ভরপুর এই চারিপাশটা। মাত্র কয়েক ঘন্টা, এরপর এই সবকিছুকে বিদায় জানিয়ে চলে যেতে হবে নতুন ঠিকানায়। বসত করতে হবে এই অজানা, অচেনা যায়গায়। শুরু হবে এক নতুন অধ্যায়।

সকালের খাবার খেয়ে রেডি হতে হতে প্রায় সাড়ে দশটা বেজে গেছে। আদিব কিছুটা হতাশ গলায় আশার দিকে তাকিয়ে বললো
“দশটার ট্রেন মিস করে গেছি আশা। আরেক বার ট্রেন বারোটা পঞ্চাশে। আশা অবাক হয়ে ভাইয়ের দিকে তাকালো। উৎকন্ঠা নিয়ে বললো
“আরেক বার এক টার দিকে ট্রেন? এর আগে কোনো ট্রেন নেই?
” নাহ নেই, এখন বাসে যেতে হবে। ওই ট্রেনের অপেক্ষায় থাকলে যেতে যেতে রাত হয়ে যাবে। আশা মন খারাপ করে বললো
“কিন্তু বাসে যে আমার বমি পায় ভীষণ।
আদিব এসে বোনকে আলতো করে ধরলো। স্নেহভরা কণ্ঠে বললো
” ভয় পাসনা, তোকে বমির ট্যাবলেট আর কিছু টক আচার কিনে দিবো। তুই এক কাজ করে, আমাদের লেবু গাছটা থেকে কয়েকটা লেবু, আর পাতা নিয়ে আয়। পাতাগুলো সাথে রাখ, আর লেবুগুলো চিপে পানির সাথে মিশিয়ে বোতলে করে নিয়ে নে। যখন বমি বমি ভাব আসবে, লেবু পাতা শুকবি, এক ঢোক লেবু পানিও খেয়ে নিবি। দেখবি, আর কোনো প্রব্লেম হবেনা।

আশা মাথা নাড়ালো। এরপর এক দৌড়ে চলে গেলো উঠোনের এক পাশে থাকা ছোটখাটো লেবু বাগানটায়।
মা মেয়ের কান্না পর্ব সেড়ে যখন রওনা করলো তখন ঘড়িতে বাজে এগারোটা। আদিব সামনে আর আশা পেছন পেছন হাঁটছে। দুজনেই নিরব। সামনের সিএনজি স্টেশন থেকে একটা সিএনজি রিজার্ভ করে সেটাতে উঠে বসলো ওরা। নির্দিষ্ট সময় পর গিয়ে পৌছুলো একটা যায়গায়। এখানেই গন্তব্য শেষ নয়। এখান থেকে একটা অটোতে উঠে চলে গেলো বাস স্টপেজ এ। সেখানে নামার পর আশা খেয়াল করলো সামনেই সারি সারি বাস দাঁড়ানো। আদিব আশাকে সেখানে দাড় করিয়ে চলে গেলো টিকিট কাউন্টারে। মহাখালীর দুটো টিকেট করে পাশের দোকান থেকে কতগুলো আচারের প্যাকেট কিনে নিলো। বমির ট্যাবলেট আসার পথে একটা ফার্মেসি থেকে আগেই কিনে রেখেছিলো সে।

আদিব এসে দেখলো আশা এখনো আগের যায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি সীমাবদ্ধ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অসংখ্য বাসগুলোর দিকে। আচারের প্যাকেট গুলো আশার চোখের সামনে ধরতেই চোখগুলো চিকচিক করে উঠলো তার। হাসিমুখে সেগুলো ভাইয়ের হাত থেকে নিয়ে সাইড ব্যাগটার পকেটে রেখে দিলো সেগুলো। আদিব বললো
“আয় আমার সাথে।
আশা আদিবের পিছু হাঁটলো। আদিব একটা বাসকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে তার পাশে দাঁড়ানো এনা বাসে গিয়ে উঠে পরলো। বোনকে জানলার পাশের সিটে বসতে দিয়ে সে বসে পরলো তার পাশের সিটে।

গাড়ি ছাড়লো নির্দিষ্ট সময় পর। বিকেল প্রায় সাড়ে তিনটার দিকে বাস এসে মহাখালী থামলো। আশা এতোক্ষনে প্রায় আধমরা হয়ে গেছে। এই লম্বা সময়ে সে অনেকবার বমি করে করে এখন ক্লান্ত। ঠিকমতো দাঁড়াতেই পারছেনা সে। বমির ট্যাবলেট, লেবুপানি, লেবু পাতা, আচার কোনো কাজেই আসেনি। আদিব ওকে ধরে ধরে নামালো বাস থেকে। আশা অতিরিক্ত দুর্বল হয়ে যাওয়ায় হাঁটতেও পারছেনা। তাই আদিব ওকে ধরে রাস্তার পাশে থাকা একটা ইটের বাঁধের উপর নিয়ে বসালো। এরপর সে চলে গেলো একটা দোকানে। সেখান থেকে একটা পানির বোতল কিনে নিয়ে ফিরে এলো বোনের কাছে। পানির বোতলটা আশার হাতে দিতেই আশা বোতল থেকে কিছুটা পানি হাতে নিয়ে চোখেমুখে ছিটিয়ে দিলো। মুখটা ধুয়ে নিলো ভালো করে।

এরপর কয়েক ঢোক পানি খেয়ে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো সে। আদিব বোনের মাথায় হাত রেখে বললো
“এখন কেমন লাগছে আশামনি?
আশা সামান্য হেসে বললো
“ভালো লাগছে ভাইয়া।
“তাহলে চল এখন, বাসায় যেতে হবে তো।
আশা ক্লান্ত কন্ঠে ছোট্র করে বললো
“হুম।
পাশ থেকে একটা সিএনজি ডেকে ভাড়া নিয়ে কষাকষি করে শেষে বোনকে নিয়ে রওনা হলো আদিব। প্রায় আধঘন্টা পর সিএনজি এসে দাড়ালো একটা দুতলা বাসার সামনে। সিএনজি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে বোনকে নিয়ে বাসার ভেতরে ঢুকলো সে। সিড়ি বেয়ে বেয়ে ভাইয়ের পিছু পিছু উপরে উঠলো আশা। কাঙ্ক্ষিত রুমটির সামনে এসেই কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে গেলো সে। মাথায় ঘুরতে লাগলো একটি কথায়, ” আজ থেকে এখানেই তাকে থাকতে হবে। আশা অন্যমনস্ক হয়েই চারপাশটা দেখতে লাগলো ভালো করে।

চলবে….